যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যখন আগামী ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়ে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করবেন, তখন তাকে বিশ্ব রাজনীতির অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এর মাঝে আছে বেশ কিছু আঞ্চলিক রাজনীতি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভূমিকা কাম্য।
যেমন কয়েকটি আঞ্চলিক এবং সেই সঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতির কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এ মুহূর্তে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইয়েমেন সংকট আন্তর্জাতিক পরিসরে ব্যাপক আলোচিত হলেও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন জোটের ইয়েমেনের বিরুদ্ধে বিমান হামলা এখনও অব্যাহত রয়েছে।
এ বিমান হামলায় সেখানে এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার শিশু ওষুধের অভাবে ইতোমধ্যে মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে মানবিক সাহায্য শুরু করবে- এ প্রত্যাশা সবার। মার্কিন কংগ্রেস একটি War Powers Resolution পাস করলেও ট্রাম্প তাতে ভেটো দেন। এ আইনের মাধ্যমে কংগ্রেস ইয়েমেন যুদ্ধ বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্পের সৌদি আরব প্রীতির কারণে যুদ্ধ বন্ধ করা যায়নি।
বাইডেন প্রশাসনের এখন দায়িত্ব হবে সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে অস্ত্র বিক্রি বন্ধের উদ্যোগ নেয়া। আরব আমিরাত লিবিয়ায় জেনারেল হাফতারের বাহিনীকে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করায় লিবিয়ায় গৃহযুদ্ধের কোনো সমাধান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রে Leahy Law অনুযায়ী সেদেশের কোনো অস্ত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ওইসব দেশে কোনো অস্ত্র রফতানি করতে পারবে না, যে দেশগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত।
অথচ এ আইন ভঙ্গ করে আরব আমিরাতের সঙ্গে ২৪ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি করেছিলেন ট্রাম্প প্রশাসন। আমিরাত যেখানে ইয়েমেনে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত সেখানে আইন অনুযায়ী (Leahy Law) আমিরাতে অস্ত্র বিক্রি করা যাবে না। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের Arms Export Control Act অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র কোনো দেশকে ওই দেশের নিজের নিরাপত্তা ও সীমান্ত রক্ষার জন্যই শুধু অস্ত্র বিক্রি করতে পারবে।
কিন্তু সৌদি আরব ও আরব আমিরাতে বিক্রি করা অস্ত্র নিজ দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে ব্যবহৃত হয়নি। ব্যবহৃত হয়েছে ইয়েমেনে গণহত্যায়। বাইডেন প্রশাসনকে এখন এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু কাজটি সহজ নয়। কারণ অভিযোগে আছে, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত ইসরাইলের স্বার্থে কাজ করছে।
এখন বাইডেন প্রশাসন ইসরাইলি স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে পারবে কিনা, সেটাই দেখার বিষয়। ভুলে গেলে চলবে না, নির্বাচিত ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হারিসের স্বামী ইহুদি ধর্মাবলম্বী এবং কমলা হারিস অতীতে একাধিকবার ইসরাইলের স্বার্থে কথা বলেছেন। ইউটিউবে তার বক্তৃতা আছে, যেখানে কমলা হারিস ইসরাইলের নিরাপত্তার স্বার্থে ইসরাইলে অস্ত্র সরবরাহ ও দেশটির নিরাপত্তার পক্ষে কথা বলেছেন। এখন বাইডেন কি তার ভাইস প্রেসিডেন্টকে অস্বীকার করতে পারবেন? মনে হয় না।
শুধু তাই নয়, সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, বাহরাইনসহ কয়েকটি আরব দেশের সঙ্গে ইসরাইলের রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। ট্রাম্পের এই নীতি ইসরাইলে জনপ্রিয় হলেও ফিলিস্তিনিরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তর করে ট্রাম্প ইসরাইলের সরকারি সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেছিলেন। অথচ ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিশ্চিত করার ব্যাপারে তিনি কোনো উদ্যোগ নেননি।
ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য নীতি ছিল প্রো-ইসরাইলি, অর্থাৎ ইসরাইল ঘেঁষা। কিন্তু বাইডেন কি তা অনুসরণ করবেন? বাইডেনের জন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে ফিলিস্তিনিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটি বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার। তিনি কী করবেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।
মধ্যপ্রাচ্য সংকটের সঙ্গে ইরান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি পারমাণবিক চুক্তি (Joint Comprehensive Plan of Action- JCPOA) থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ট্রাম্পের এ সিদ্ধান্ত জার্মানি মেনে নেয়নি। অথচ জার্মানি JCPOA-এর সদস্য। এখানে প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আবারও JCPOA চুক্তিতে ফিরে যাবে। ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের বিরুদ্ধে কিছু অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল।
ইরান কোভিড-১৯ মোকাবেলায় আইএমএফ থেকে ৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহযোগিতা চেয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্পের বিরোধিতার কারণে ওই পরিমাণ অর্থ ছাড় করা হয়নি। এখন বাইডেন যদি অর্থ ছাড়করণের অনুমতি দেন, তাহলে তা ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের পথে কিছুটা অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হবে।
বাইডেন আরও যেসব বিষয় বিবেচনায় নেবেন, তার মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়-ইনের ‘Permanent Peace Regime’-এর ব্যাপারে উদ্যোগ, রাশিয়ার সঙ্গে নতুন START আলোচনা শুরু এবং ট্রাম্প প্রশাসনের বিলিয়ন ডলারের পারমাণবিক কর্মসূচি স্থগিত করা, ছয়টি মুসলমানপ্রধান দেশের ব্যাপারে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা বাতিল করা, কিউবার ব্যাপারে ওবামা প্রশাসনের নীতিতে ফিরে যাওয়া ও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করা, সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমানো, সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ কমানোর ব্যাপারে প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য বারবারা লি প্রস্তাবিত বিলের প্রতি সমর্থন দিয়ে (বছরে এ খাতে বাজেট ৩৫০ বিলিয়ন ডলার কমানো) প্রতিরক্ষা বাজেটে অর্থের পরিমাণ কমিয়ে ওই পরিমাণ অর্থ স্বাস্থ্য খাতে, শিক্ষায়, ক্লিন এনার্জিতে বরাদ্দ করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় যুক্তরাষ্ট্র আবার যোগ দেবে এবং কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী একটি ভূমিকা রাখবে।
ট্রাম্পের ‘একলা চলো’ নীতি যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব নেতৃত্ব থেকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছিল। এখন যুক্তরাষ্ট্রকে তার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হবে। সবাই জানে, ইউরোপ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেডিশনাল মিত্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে সমর্থন করা ও অব্যাহত ‘সোভিয়েত ভীতি’কে সামনে রেখে সামরিক জোট ন্যাটো গঠন করা এবং সমাজতন্ত্রের হাত থেকে পশ্চিম ইউরোপকে রক্ষা করা- এসব ছিল মার্কিন স্ট্র্যাটেজির অংশ। ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের আগ পর্যন্ত এ স্ট্র্যাটেজিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। কিন্তু ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ সম্পর্কের কিছুটা ক্ষতি হয়।
ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মোতায়েনে যে ব্যয় হয়, তা ওইসব দেশকে বহন করতে হবে বলে দাবি করেছিলেন ট্রাম্প, যা কিনা ওই দেশগুলো মেনে নেয়নি। ফলে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ক্ষতি হয়। একই সঙ্গে পশ্চিম ইউরোপে উৎপাদিত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসন অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছিল, যা পশ্চিম ইউরোপের নেতৃবৃন্দ মেনে নেননি। ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার এটাও ছিল অন্যতম কারণ।
ট্রাম্পের উত্থান ইউরোপ এবং ব্রাজিলের মতো দেশে ‘পপুলিজম’ বা জনতুষ্টিবাদের জন্ম দিয়েছে। ইউরোপে ভিক্টর উরবান (হাঙ্গেরি), জারোসলাভ কাজানিস্ক্রি (পোল্যান্ড), জানেজ জানসা (স্লোভেনিয়া), বরিস জনসন ও নাইজেল ফারাজ (ব্রিটেন), মারিয়া লি পেন (ফ্রান্স), জেইর বলসোনারো (ব্রাজিল) ও মাথিও সালভিনির (ইতালি) মতো নেতার উত্থান ঘটেছিল, যারা ট্রাম্পের আদর্শকে ধারণ করে নিজ নিজ দেশে ‘উগ্র জাতীয়তাবাদের’ জন্ম দিয়েছেন। তারা নিজ দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছেন।
তাদের ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে, তাও লক্ষ করার বিষয়। একই সঙ্গে চীনের ব্যাপারেও সদ্য গঠিত রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপের (আরসিইপি) বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা হবে অন্যতম আলোচিত বিষয়। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলো এর সদস্য।
এখানে বলা ভালো, জো বাইডেন একজন সিনেটর হিসেবে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সিনেট কমিটিতে কাজ করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি ২০০১-০৩ ও ২০০৭-০৯ মেয়াদে দু’দুবার সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির সদস্য ছিলেন। ফলে বৈদেশিক সম্পর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ আলোকেই বলা যায়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল।
এখন দেখার পালা এ অঞ্চলে তিনি কীভাবে মার্কিন স্বার্থ আদায়ে উদ্যোগী হবেন। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি হচ্ছে চীনের (১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার)। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি দেশকে এককাতারে নিয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার প্রভাব বলয় বিস্তার করছে বলে অনেকে মনে করেন। যদিও এটা ঠিক, অতীতে চীন কখনও কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল না। দেশটির আধিপত্য বিস্তারের কোনো ইতিহাসও নেই। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চীনের এ কর্মসূচির ব্যাপারে সন্দিহান। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি খুবই জরুরি।
এ অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। দক্ষিণ চীন সাগরে তেলের রিজার্ভ রয়েছে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ব্যারেল, আর গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
এর মধ্যে দিয়ে চীনের জ্বালানি চাহিদা অনেকটাই মিটবে। যুক্তরাষ্ট্রও চায় এই জ্বালানি সম্পদের ভাগিদার হতে। সুতরাং এখানেও একটা চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক ও মালবাহী জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরের জলপথ ব্যবহার করে চলাচল করে। এ কারণেই এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বেইজিং, যা মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করতে পারে।
তাই চীনকে মোকাবেলা করতে জাপানকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতি আরেকটি কারণ। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভয়টা ওই দেশকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীনের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে তার নৌবাহিনীকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করাতে পারে, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সামরিক কৌশলগত জলসীমা হিসেবে বিবেচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা রয়েছে ভারত মহাসারগীয় অঞ্চলে ৬০ ভাগ সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করায়। এক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন এ ধরনের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাইডেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন বেশি।
জো বাইডেনের এশিয়া নীতি আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই Regional Comprehensive Economic Partnership (RCEP) নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। গত ১৫ নভেম্বর আসিয়ান সম্মেলনে এই মুক্ত বাণিজ্য জোটটি গঠিত হয়। তবে মনে রাখতে হবে চীনের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার ব্যাপারে আসিয়ান নেতৃবৃন্দ ২০১২ সাল থেকেই আলোচনা চালিয়ে আসছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক কমানো, সরবরাহ শৃঙ্খলা শক্তিশালী করা এবং ই-কমার্সের জন্য নতুন বিধিবিধান চালু করা।
আরসিইপির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ এবং সেই সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তবে এটি কার্যকর হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। কারণ চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর সংসদে তা অনুমোদিত হতে হবে। নানা কারণে আরসিইপি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী এবং এক-তৃতীয়াংশ জিডিপি এ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আসবে।
চুক্তিবদ্ধ ১৫টি দেশে বাস করে ২২০ কোটি মানুষ। একটি বড় বাজার। বৈশ্বিক জিডিপিতে অঞ্চলটির সম্মিলিত অবদান ৩০ শতাংশের বেশি। দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। কোভিড-১৯-পরবর্তী যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠছে এবং চীনের নেতৃত্বে যে নতুন এক ‘বিশ্বায়ন’ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, আরসিইপি এক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। এখানে বলা ভালো, এ অঞ্চলে ঘিরে ওবামা প্রশাসনের আমলে টিপিপি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
কিন্তু ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে ২০১৭ সালে বেরিয়ে এসেছিলেন। ট্রাম্প বিশ্বকে একটি অস্থিরতার জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এখন জো বাইডেনকে ফিরে আসতে হবে। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বা বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ)-এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির একটা সমন্বয় প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বাইডেন যদি ট্রাম্পের নীতি অনুসরণ করেন, যদি চীনকে ‘একঘরে’ করার ট্রাম্পের নীতি সমর্থন করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেন, তাহলে চীন-মার্কিন দ্বন্দ্ব বাড়বে বৈ কমবে না।
বাইডেন তার ‘America Back’ ধারণার কথা বলেছেন। এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি না দিলেও প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবেন। এ থেকে ফিরে আসবেন না (গার্ডিয়ান, ২৫ নভেম্বর)। এখন দেখার বিষয়, বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি উঠতি শক্তিগুলো, বিশেষ করে চীনের সঙ্গে আদৌ কোনো দ্বন্দ্বে জড়িয়ে যান কিনা।
Jugantor
29.11.2020
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In his Office at UGC Bangladesh
Prof Rahman With US Congressman Joseph Crowley
here you go!!!
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
During his stay in Germany
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
At Fatih University, Turkey during his recent visit.
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In front of an Ethnic Mud House in Mexico
বাইডেন ও দক্ষিণ এশিয়া
22:26
1 comment
জো বাইডেন যখন আগামী ২০ জানুয়ারি (২০২১) যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে যাচ্ছেন, তখন একটি প্রশ্ন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে, তা হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে জো বাইডেনের ভূমিকা কী হবে। দক্ষিণ এশিয়া, ভারত মহাসাগর ও দক্ষিণ চীন সাগর এই তিন অঞ্চল ঘিরে আগামী দিনের বিশ্বরাজনীতি আবর্তিত হবে। এই তিনটি অঞ্চল একটির সঙ্গে অপরটির যোগসূত্র আছে এবং এ অঞ্চলে উত্তেজনা আছে। বৃহৎ শক্তির মধ্যকার ‘প্রভাব বলয় বিস্তারের’ প্রতিযোগিতাও আছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে এ অঞ্চলকে ঘিরে ‘ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’ রচিত হয়েছিল। এই ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারত। ভারতকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প প্রশাসন যে নীতি প্রণয়ন করেছিল, তাতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণও চেয়েছিল ওই প্রশাসন। এই স্ট্র্যাটেজির উদ্দেশ্য একটাই চীনকে ঘিরে ফেলা। এই স্ট্র্যাটেজি পুরনো Containment policy-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়, যখন যুক্তরাষ্ট্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে ফেলার স্ট্র্যাটেজি নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে রচিত স্ট্র্যাটেজির সফল বাস্তবায়ন আমরা দেখেছি ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন ছিল লক্ষ্য। এখনো সেই Containment policy নতুন করে সাজানো হচ্ছে। এবারের টার্গেট চীন। চীনকে দুর্বল করা, চীনকে ঘিরে ফেলা, চীনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে উসকে দেওয়া এসবই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির অংশ। আর তাই আমরা দেখি QUAD--কে সক্রিয় হতে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হতে, কিংবা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের উপস্থিতিকে যুক্তরাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করতে। এসব কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে চীন-ভারত উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে একদিকে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সুযোগ পেয়েছে এ অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব ও উপস্থিতি বাড়াতে নতুন একটি নৌ-ফ্লিট গঠন করতে চাচ্ছে। নেভি সচিব কেনেথ ব্রেইটথওয়েইটের কথায় এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। জাপানের ইয়েকোসুকা বন্দরে অবস্থানরত সপ্তম ফ্লিট দিয়ে ভারত মহাসাগরের পর্যবেক্ষণ নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন আর একটি ফ্লিট গঠিত হলে ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নেভি আরও শক্তিশালী হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ভারত মহাসাগরকেন্দ্রিক রাজনীতি আরও উত্তপ্ত হবে। অথচ ভারত মহাসাগরভুক্ত দেশগুলো ভারত মহাসাগরকে একটি শান্তির এলাকা হিসেবেই দেখতে চায়। শ্রীলঙ্কার নয়া সরকার গত ১২ অক্টোবর দায়িত্ব নিয়ে এই আহ্বন জানাল। ১৯৭১ সালে শ্রীলঙ্কার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এর পাঁচ দশক পর প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন সরকার পুনরায় এ আহ্বান জানাল। তিনি এই আহ্বানটি জানালেন এমন একসময় যখন চীন-ভারত সীমান্ত উত্তেজনা এখনো রয়েছে। লাদাখে যখন উত্তেজনা হ্রাস পায়নি, তখন ভারত দক্ষিণ চীন সাগরে তার নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীনের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর দ্বন্দ্ব চলছে। এই অঞ্চলের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থ রয়েছে। সেখানে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ নিয়মিত টহল দেয়। চীন সম্প্রতি ওই এলাকায় একটি নৌবাহিনীর মহড়া সম্পন্ন করেছে। ভারত মহাসাগর নিয়ে চীন-ভারত উত্তেজনা রয়েছে। চীনা স্বার্থকে চ্যালেঞ্জ করছে ভারত। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ‘চীনা স্বার্থকে’ চ্যালেঞ্জ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র তার ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের স্ট্র্যাটেজিতে পরিবর্তন আনছে। এখানে ভারত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম পার্টনার। এদিকে গত ৬ অক্টোবর জাপানের টোকিওতে QUAD-বা Quadrilateral Security Dialogue-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত ও অস্ট্রেলিয়া QUAD-এর সদস্য। QUAD-এর উদ্যোগে এর আগে একটি নৌ-মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়েছে। একদিকে ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যার বিশেষ করে লাদাখ অঞ্চলের সমস্যার যখন কোনো সমাধান হয়নি, ঠিক তখনই শ্রীলঙ্কার পক্ষ থেকে ভারত মহাসাগরকে শান্তির অঞ্চল হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হলো।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে লাদাখে চীন ও ভারতের মধ্যে উত্তেজনা বারবার আন্তর্জাতিক সংবাদের জন্ম দিচ্ছে। গত ১৫ জুনের পর থেকেই লাদাখ অঞ্চলে উত্তেজনা বজায় রয়েছে। লাদাখ ছিল একসময় ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের একটি অংশ। কিন্তু গেল বছর লাদাখকে কাশ্মীর থেকে আলাদা করে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করা হয়। লাদাখে চীনের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে ভারতের। গত ১৫ জুন লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং তাতে ২০ জন ভারতীয় সেনা মারা যান। সাম্প্রতিক সময়ে এটা ছিল একটা বড় ধরনের ঘটনা, যাতে প্রচলিত যুদ্ধ না হয়েও এতজন ভারতীয় সেনাকে প্রাণ দিতে হলো। এরপর থেকেই গালওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনা বিরাজ করছে। ভারতীয় সেনাপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ওই অঞ্চল সফর করেছেন। দুপক্ষই সেখানে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেছে। ভারত ফ্রান্স থেকে অত্যাধুনিক ছয়টি রাফায়েল যুদ্ধ বিমান উড়িয়ে এনে তা এই এলাকার কাছাকাছি হরিয়ানার আমবালা বিমানঘাঁটিতে মোতায়েন করেছে। এই বিমানগুলোর অর্ডার অনেক আগেই দিয়েছিল ভারত। এই উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ১০ সেপ্টেম্বর মস্কোতে ভারত ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ‘শান্তি ও স্থিতিশীলতা’ বজায় রাখার স্বার্থে একটি ঐকমত্যে উপনীত হয়েছিল। সেই ঐকমত্য ভেঙে গেছে। এক ধরনের শক্তি প্রদর্শনে লিপ্ত হয়েছে দেশ দুটি। গালওয়ান উপত্যকায় যখন উত্তেজনা বাড়ছে, তখনই দক্ষিণ চীন সাগরে ভারত যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়েছিল। দক্ষিণ চীন সাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের ‘স্নায়বিক যুদ্ধ’ চলছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সেখানে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ পাঠানো চীন খুব সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না। শুধু তা-ই নয়, গালওয়ান উপত্যকায় উত্তেজনার পর ভারত আন্দামান-নিকোবরের কাছে মালাক্কা প্রণালীতেও নৌবহর পাঠিয়েছে। ভারতের উদ্দেশ্য একটাই দক্ষিণ চীন ও মালাক্কা প্রণালীতে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে চীনকে এক ধরনের ‘চাপ’-এ রাখা, যাতে চীন গালওয়ান উপত্যকা থেকে সরে যায় এবং সেখানে উত্তেজনা হ্রাস পায়। এই যখন পরিস্থিতি, ঠিক তখনই ট্রাম্প প্রশাসনের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষামন্ত্রী (পরে বরখাস্তকৃত) নয়াদিল্লি ছুটে গিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল একটাই চীন-ভারত দ্বন্দ্বে ভারতের পাশে থাকা। ইতিমধ্যে বাইডেনের নির্বাচনে বিজয়ীর পর মোদি-বাইডেন ফোনালাপ হয়েছে। প্রশ্ন এখানেই, চীন-ভারত দ্বন্দ্ব যদি আরও বেড়ে যায় কিংবা লাদাখে যদি সীমিত যুদ্ধ শুরু হয়, তখন বাইডেন প্রশাসনের ভূমিকা কী হবে?
একটি ‘সীমিত যুদ্ধ’-এর সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেননা লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় (এলএসি) চীনের ভূখ-ের দাবিকে ভারত সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। সম্প্রতি চীনের সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী দাবি করেছেন, লাদাখ কোনো দিনই ভারতের অংশ ছিল না। লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে ভারত চুক্তির শর্ত ভেঙেছে বলেও দাবি করা হয়। চীন দাবি করছে, তারা ১৯৫৯ সালের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অনুসরণ করছে। ফলে আগামীতে সেনা কমান্ডারদের বৈঠক আদৌ কোনো ফল দেবে বলে মনে হয় না। এদিকে চীনের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার যে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে চীন-শ্রীলঙ্কা বাণিজ্য চুক্তিতে চীন বেশি সুযোগ পেয়েছে। শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এলাইনা বি টেপলিজ শ্রীলঙ্কার ডেইলি মিরের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে এই অভিমত পোষণ করেন। সম্প্রতি ভারতের সেনাপ্রধান ও পররাষ্ট্র সচিব মিয়ানমার সফর করেছেন। এর মধ্য দিয়ে চীনকে রুখতে মিয়ানমারকে কাছে টানছে ভারত এমন একটি মূল্যায়নপত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সেই সঙ্গে আছে অনেকগুলো সংবাদ ভারত চীনের সঙ্গে সীমান্তকে সামরিকায়ন করছে। QUAD-এ যোগ দিতে শ্রীলঙ্কার ওপর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের চাপ রয়েছে। রাশিয়া থেকে ফাইটার জেট আনছে ভারত। ভারতের বিমানবাহিনী প্রধান ঘোষণা করেছেন, শিগগিরই ভারতের এয়ার ডিফেন্স কমান্ড ঘোষণা দেওয়া হবে। গত ৩ অক্টোবর নরেন্দ্র মোদি হিমাচল প্রদেশের রোহতাংয়ে ১০০০০ ফুট উচ্চতায় অতল টানেল বা সুড়ঙ্গপথের উদ্বোধন করেছেন। এই টানেল নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সামরিক। এই টানেল উদ্বোধনের ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী দ্রুত সীমান্ত এলাকায় মোতায়েন করা যাবে। চীনকে টার্গেট করেই এই টানেল নির্মাণ। এর ফলে ভারতের অন্য অংশ থেকে লাদাখের লেহ-তে যাতায়াতের সময় কমে আসবে। সুতরাং এই এলাকায় পরিস্থিতি যখন এখনো শান্তিপূর্ণ নয়, তখন ভারত মহাসাগরকে শান্তির অঞ্চলে পরিণত করার শ্রীলঙ্কার আহ্বান কতটুকু কার্যকর হবে, তা একটা মৌলিক প্রশ্ন। এ ধরনের কর্মকা- প্রমাণ করে ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলসমূহে এক ধরনের উত্তেজনা থেকে যাবে। ফলে বাইডেন প্রশাসন এ ব্যাপারে কী সিদ্ধান্ত নেয়, এটা লক্ষ করার বিষয়।
আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে সেখানকার ‘ডিপ স্টেট’-এর ভূমিকা অনেক বড় ও ব্যাপক। এরা অনেক সময় সরকারের ভেতরে আরেকটি সরকার হিসেবে কাজ করে। সরকার কখনো কোনো নীতি গ্রহণ করলেও, এই ‘ডিপ স্টেট’-এর কারণে অন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। সুতরাং বাইডেন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করা কিংবা ভারত মহাসাগরে উত্তেজনা হ্রাস করার উদ্যোগ নিতে চাইলেও, এই ‘ডিপ স্টেট’ তা চাইবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। এই ‘ডিপ স্টেট’ যুদ্ধবাজ জেনারেল, অস্ত্র ব্যবসায়ী, তথা করপোরেট হাউজগুলোর স্বার্থে কাজ করে। অনেক কংগ্রেস সদস্যও তাদের স্বার্থে কাজ করেন। ফলে ‘ডিপ স্টেট’ যা চায়, কংগ্রেস সদস্যরা সে মতে আইনপ্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করেন এবং সরকারকে বাধ্য করেন তাদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে। দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিনি স্বার্থ রয়েছে। এই স্বার্থের পেছনে কাজ করছে চীনবিরোধী মনোভাব। ট্রাম্প এই রাজনীতি উসকে দিয়েছিলেন। এখন বাইডেন এই রাজনীতি কতটুকু ধারণ করবেন সেটাই দেখার বিষয়।
Desh Rupantor
25.11.2020
বাইডেন কি বিভক্তির দেয়াল ভাঙতে পারবেন?
05:20
1 comment
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সম্প্রতি বিবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি এমন সব কথা বলেছেন, যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং মার্কিন সমাজের বর্তমান অবস্থাকে তুলে ধরেছে। বারাক ওবামার ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্র এখন অনেক বেশি বিভক্ত। এ বিভক্তির দেয়াল তুলেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। মাত্র এক নির্বাচনে ট্রাম্পের বিভক্তির দেয়াল ভাঙা সম্ভব নয়; আরও কয়েক নির্বাচন লাগবে। বারাক ওবামা মনে করেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে তৈরি হওয়া তীব্র ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ দেশটির বিভক্তি আরও তীব্র করেছে। তার মতে, জো বাইডেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয় এসব বিভক্তি মেরামতের শুরু। এ প্রক্রিয়া শেষ হতে ও বিভক্তির প্রবণতা কমিয়ে আনতে একাধিক নির্বাচন পার করতে হবে।
বিবিসিকে ওবামা আরও বলেছেন, গ্রামীণ ও শহুরে আমেরিকান এবং অভিবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা ও বিভক্তি তৈরি হয়েছে। অনেক অন্যায্য বিষয় স্থান পেয়েছে সমাজে। যেমন, অসমতা ও তীব্র ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মতো বিষয় সামনে এসেছে। অনেকে একে ‘সত্য ও নৈতিকতার অবক্ষয়’ বলেছেন। এটি কিছু মার্কিন মিডিয়া ছড়িয়ে দিয়েছে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এগুলো ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন সমাজে। এসব কারণে আমরা এখন অনেক বেশি বিভক্ত একটি সমাজ। ওবামা শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবৈষম্য নিয়েই কথা বলেননি; বরং অতি সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেই ব্যাপারেও কথা বলেছেন। ওবামা স্পষ্ট করেই বলেছেন, ‘আমেরিকান সমাজে মৌলিক একটি ভুল জায়গা করে নিয়েছে। সেটি হল বর্ণবাদ ইস্যু। একে নিজেদের মূল পাপ বলে অভিহিত করেন সাবেক এ প্রেসিডেন্ট।
এ ধরনের কথাবার্তা যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে। খুব স্পষ্ট করে বর্ণবাদ তথা বিভক্ত সমাজ নিয়ে বারাক ওবামা অতীতে কোনোদিন কথা বলেছেন বলে আমার মনে হয় না। ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের রায় ট্রাম্প কর্তৃক মেনে না নেয়া, রায় বানচাল করতে নানা অপকৌশল, মামলা-মোকদ্দমা, ট্রাম্প কর্তৃক তার সমর্থকদের উসকে দেয়া, ভোট গণনা কেন্দ্রে হামলার ঘটনা একের পর এক যখন ঘটছে, তখনই বারাক ওবামা এ ধরনের কথা বললেন। একজন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন এ ধরনের কথা বলেন, তখন তা গুরুত্ব পায় বৈকি! পাঠক, কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর কথা স্মরণ করতে পারেন। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সারা যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎকে একটা প্রশ্নের মাঝে ফেলে দিয়েছিল। এ আন্দোলন ইউরোপের অনেক দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্ণবাদ যুক্তরাষ্ট্রের একটা পুরনো ‘রোগ’-১৯৬৩ সালে দেয়া মার্কিন লুথার কিং-এর সেই বিখ্যাত ভাষণ ও have a dream (আমার একটি স্বপ্ন আছে)-এর পর এতটা বছর পার হয়ে গেছে; কিন্তু বর্ণবাদকে সেখানে সমাজ থেকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ড এর সর্বশেষ উদাহরণ। টেলিভিশনের বদৌলতে সারা বিশ্বের মানুষ দেখেছে, ঘাড়ের ওপর হাঁটু চেপে ধরে একজন শ্বেতাঙ্গ অফিসার কীভাবে শ্বাস বন্ধ করে ‘খুন’ করেছিলেন জর্জ ফ্লয়েডকে। ফ্লয়েডকে বলতে শোনা গেছে, ‘আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, আমি শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছি না’; কিন্তু তারপরও ওই শ্বেতাঙ্গ অফিসার ফ্লয়েডের ঘাড়ের উপর থেকে হাঁটু সরিয়ে নেননি। দীর্ঘ ৮ মিনিট ওই অবস্থায় থেকে ফ্লয়েড মারা যান। ফ্লয়েডের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে দ্রুত আগুনের ফুলকির মতো ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ। শুধু কৃষ্ণাঙ্গরাই যে আজ ‘Black live Matters’-এর ব্যানারে সংগঠিত হয়েছে তেমনটি নয়; বরং শ্বেতাঙ্গরাও এ বিক্ষোভে শরিক হয়েছিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, একপর্যায়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে হোয়াইট হাউসের বাংকারে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল তার নিরাপত্তারক্ষীরা। শুধু একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এ ধরনের একটি আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, যা সারা যুক্তরাষ্ট্রে ছড়িয়ে গেছে; তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আমেরিকান সমাজে বৈষম্য বেড়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে, গরিব আরও গরিব হয়েছে (দেখুন Wealth Inequality in America)। এতে দেখা যায়, কীভাবে বৈষম্য তৈরি হয়েছে সেখানে।
কভিড-১৯ সংক্রমণের এ সময়টাতেও শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর মাঝে কভিড-১৯ এ আক্রান্ত, মৃত্যুহার ও চাকরি হারানোর হার বেশি (আরবান ওয়ার, ১০ এপ্রিল ২০২০)। গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদন (২০ মে, ২০২০) থেকে জানা যায়, করোনাভাইরাসে যুক্তরাষ্ট্রে যত মানুষ মারা গেছে (আক্রান্ত ১২০৭২৫৬০ জন, মৃত্যু ২৫৮৩৫৪ জন, ২০ নভেম্বর); তার মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ মৃত্যুর হার শ্বেতাঙ্গ মৃত্যুর চেয়ে তিনগুণ বেশি। ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশনের তথ্যমতে, প্রতি পাঁচজন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকানের মধ্যে একজনের কোনো হেলথ ইন্স্যুরেন্স অর্থাৎ স্বাস্থ্যবীমা নেই। এরা নিয়মিত চিকিৎসা পান না। মৃত্যুর এটা একটা বড় কারণ। ফলে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে ক্ষোভ থাকাটাই স্বাভাবিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতির দেশ (২১.৪ ট্রিলিয়ন ডলার, ২০১৯); কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেনি। করোনাভাইরাসের সময় এ বিষয়টি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ যখন বৃদ্ধি পায়, তখন দেখা গেল- হাসপাতালগুলোয় যথেষ্ট পরিমাণ আইসিইউ বেড নেই। ভেন্টিলেটর নেই। মাস্ক নেই। ডাক্তার তথা নার্সদের জন্য পিপিই নেই। শুধু ভেন্টিলেটরের অভাবে শত শত মানুষ সেখানে মারা গেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্র ৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে আফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধের পেছনে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা আরও উন্নত করা যেত, সবার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যেত। এতে স্বাস্থ্য সেক্টরে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের মাঝে যে বৈষম্য তৈরি হয়েছিল, তা কমিয়ে আনা যেত। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নীতির কারণে, বিশেষ করে ‘ওবামা কেয়ার’ বাতিল করে দেয়ায় এ বৈষম্য আরও বেড়েছে।
ট্রাম্প স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বীমা কোম্পানি তথা ওষুধ কোম্পানিগুলোর পক্ষে কাজ করে গেছেন। ফলে কভিড-১৯ মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ালেও এক্ষেত্রে তার কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। কৃষ্ণাঙ্গ অসন্তোষ দানা বাঁধার পেছনে ট্রাম্পের অনেক বক্তব্যও দায়ী। আন্দোলনকারীদের তিনি হুমকি দিয়েছিলেন। তিনি এ আন্দোলকে চিহ্নিত করেছিলেন অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাস হিসেবে (নিউইয়র্ক টাইমস)। যেখানে জর্জ ফ্লয়েডের হত্যাকাণ্ডে তার সহানুভূতি দেখানোর কথা; সেখানে তিনি তাদের সন্ত্রাসী, এমনকি সেনাবাহিনী নামিয়ে আন্দোলন দমন করার কথাও বলেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, ট্রাম্প প্রশাসনের অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার ও নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও ব্রায়েনও আন্দোলনকারীদের ‘বহিরাগত জঙ্গি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এ ধরনের বক্তব্য ছিল মূল ঘটনাকে আড়াল করার শামিল।
জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যু ও মৃত্যু-পরবর্তী ঘটনাবলিকে পর্যবেক্ষকরা আখ্যায়িত করেছেন ‘Racism and Racial Terrorism Has Fueled Nationwide Anger’ হিসেবে (অ্যামিওডম্যান, ট্রুথআউট, ১ জুন); অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যে বর্ণবাদ এখনও আছে, তা-ই উসকে দিয়েছে জর্জ ফ্লয়েডের এই মৃত্যু। আরেকজন বিশ্লেষক উইলিয়াম রিভাস পিট এ আন্দোলনকে একটি ‘বিপ্লবের’ সঙ্গে তুলনা করেছেন। একধরনের ‘কালার রেভুলেশন’-এর কথাও বলেছেন কেউ কেউ।
নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র একটি বড় ধরনের সংকটে আছে। করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা চরমে উঠেছে। ইতোমধ্যে ট্রাম্প বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে বের করে এনেছেন। অথচ করোনাভাইরাস একটি বৈশ্বিক সংকট সৃষ্টি করেছে। এখানে চীন, যুক্তরাষ্ট্র তথা শীর্ষ ধনী দেশগুলোর মাঝে একটা সহযোগিতার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তা না করে ট্রাম্প একা চলতে চান, যা করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য যথেষ্ট নয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে Black Lives Matter ট্রাম্পবিরোধী আন্দোলনে নতুন এক রূপ পেয়েছিল। এ আন্দোলন ইউরোপসহ অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। এর অর্থ হচ্ছে, ট্রাম্পের বর্ণবাদী নীতির ব্যাপারে বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সমর্থন নেই।
ট্রাম্প জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন হোয়াইট হাউসে। কিন্তু জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল তাতে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। ফলে ওই সময় জি-৭ সম্মেলন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি। এরপর নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হল প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। নির্বাচনে জয়-পরাজয় স্বাভাবিক একটি বিষয়। কিন্তু তিন সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও ট্রাম্প এ ফলাফল মানতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন। ১৯ নভেম্বর নিউইয়র্ক টাইমস আমাদের জানাচ্ছে-ট্রাম্পের উগ্র সমর্থকরা নির্বাচন কর্মকাণ্ডে জড়িতদের হুমকি দিচ্ছে। Independent-এর খবর- Georgia secretary of state and wife receive death threat amid election recount (১৯ নভেম্বর)।
ট্রাম্প সমর্থকরা জর্জিয়ায় ভোট জালিয়াতি হয়েছে, এ অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সেক্রেটারি অব স্টেট ব্রাড রাফেনস্পারগার এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। এর পরই তাকে ও তার স্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়ে টেক্সট মেসেজ পাঠানো হয়। অ্যারিজোনায়ও ভোট পুনঃগণনার সময় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিই বলে দেয় রাজনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র কতটা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদিকে কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ দ্বন্দ্ব; অন্যদিকে উগ্র ট্রাম্প সমর্থকদের ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা ও নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করা পুরো মার্কিন সমাজকে বিভক্ত করে ফেলেছে। এতে ২০ জানুয়ারিতে ক্ষমতা হস্তান্তর কীভাবে হবে, তা নিয়েও তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল
Jugantor
22.11.2020
বাইডেনের বিজয় এশিয়ার জন্য কী বার্তা দেয়
05:04
1 comment
এটা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হয়ে গেছে যে, জো বাইডেনই হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। আগামী ২০ জানুয়ারি (২০২১) তিনি শপথ নেবেন। তবে নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহের শুরু পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ৩ নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার পরাজয় স্বীকার করে নেননি। এমনকি তিনি তার সমর্থকদের উসকে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন করে ‘জাতিগত বিভক্তি’র জন্ম দিয়েছেন। সারাবিশ্বের মিডিয়া ও খোদ সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এই বিভক্তির কথা প্রকাশ্যে বললেও শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার ‘ভোট জালিয়াতি’র অভিযোগ অব্যাহত রেখেই হোয়াইট হাউস ছেড়ে যাবেন। নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য একটি ‘কালো দাগ’ রেখে গেল। ইতোমধ্যে এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়া হাউসগুলো এই প্রশ্ন তুলেছে যে, বাইডেন প্রশাসনের আমলে কেমন হবে তার এশীয় নীতি? এখানে অনেকগুলো প্রশ্ন জড়িত, যে প্রশ্নগুলোকে কেন্দ্র করেই জো বাইডেনের এশীয় নীতি পরিচালিত হবে।
প্রথমত, ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। যুক্তরাষ্ট্র এক ধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরু করে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটিয়েছিল। চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স তিনি এশীয় অঞ্চলে গড়ে তুলেছিলেন। জো বাইডেন এই নীতি থেকে সরে আসবেন কিনা, সেটা একটা প্রশ্ন। দ্বিতীয়ত, গত ১৫ নভেম্বর এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ১৫টি দেশকে নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি বড় বাণিজ্যিক জোট (রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ-আরসিইপি)। চীন রয়েছে এর নেতৃত্বে। এটাকে দেখা হচ্ছে বিশ্বের বড় মুক্তবাণিজ্য চুক্তি হিসেবে। আরসিইপির ব্যাপারে জো বাইডেনের প্রশাসন কোন দৃষ্টিতে দেখে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। তৃতীয়ত, ট্রাম্প প্রশাসন ডিসেম্বর (২০২০) মাসেই আফগানিস্তান থেকে ২ হাজার সৈন্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণকে উৎসাহিত করবে। জো বাইডেন প্রশাসন কোন দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখবে, তা একটা বড় প্রশ্ন এখন। চতুর্থত, এশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন নীতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারত। ট্রাম্পের ভারত সফর ও ট্রাম্প-মোদি সখ্য ইতোমধ্যে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছিল। মোদি ও ট্রাম্পের অনেক নীতি এবং স্ট্র্যাটেজি এক ও অভিন্ন। ট্রাম্পের নীতি সারাবিশ্বে দক্ষিণপন্থি রাজনীতির উত্থানের জন্ম দিয়েছিল। মোদি এই নীতি অনুসরণ করতেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জো বাইডেন ভারতের প্রশ্নে এই নীতি সমর্থন করবেন কিনা।
advertisement
পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত একটি উঠতি শক্তি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সফরে এসেছিলেন দুজন শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এস্পার। এরা দুজন ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে ‘টু প্লাস টু’ শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। এর আগে টোকিওতে ‘কোয়াড’-এর (য়ঁধফৎরষধঃবৎধষ ংবপঁৎরঃু ফরধষড়মঁব যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত যার সদস্য) শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (৬ অক্টোবর ২০২০)। এর পরই বঙ্গোপসাগর উপকূলে ভারতের বিশাকাপত্তমের কাছে গভীর সাগরে মালাবার নৌমহড়ায় অংশ নিয়েছিল (৩ নভেম্বর) এই চার দেশের নৌবাহিনী। অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনী গত ১৩ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মালাবার নৌমহড়ায় অংশ নিল। দ্বিতীয় পর্যায়ের মালাবার নৌমহড়া অনুষ্ঠিত হয়েছে আরব সাগরে গেল ১৭ থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত। কোয়াড শীর্ষ সম্মেলন মালাবার নৌমহড়া এবং পম্পেও-এস্পারের ভারত সফর মূলত একই সূত্রে গাঁথা। এর সঙ্গে আমরা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের শীর্ষ কর্মকর্তা মি. বিগানের ঢাকা সফরকেও যোগ করতে পারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশীয় প্যাসিফিক অঞ্চলকে যে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এটা তার বড় প্রমাণ।
মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশীয় প্যাসিফিক যে কত গুরুত্বপূর্ণ তার আরও একটি প্রমাণ হচ্ছে, ভারত সফরের পর পরই পম্পেও-এস্পার শ্রীলংকা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া সফর করেছিলেন। তবে নিঃসন্দেহে পম্পেও-এস্পারের নয়াদিল্লির সফরের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। বৈশ্বিক পরিম-লে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানো ও ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ উপস্থিতি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করছে, তার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারত। ভারতকে কেন্দ্র করেই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। মোদ্দা কথা হচ্ছে চীনকে ঠেকানো, আর এজন্য ভারতকে সঙ্গে নেওয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের এই যে নীতি, এখন জো বাইডেনের প্রশাসন তা কি পরিত্যাগ করবে? কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে বাইডেন কি কোনো পরিবর্তন আনবেন? চীনের ব্যাপারে তার দৃষ্টিভঙ্গিই বা কী হবে?
advertisement
এখানে বলা ভালো, জো বাইডেন একজন সিনেটর হিসেবে পররাষ্ট্রনীতিসংক্রান্ত সিনেট কমিটিতে কাজ করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি ২০০১-০৩ ও ২০০৭-০৯ দু-দুবার সিনেট ফরেন রিলেশন্স কমিটির সদস্য ছিলেন। ফলে বৈদেশিক সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই আলোকেই বলা যায়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এখন দেখার পালা, এ অঞ্চলে তিনি কীভাবে মার্কিনি স্বার্থ আদায়ে উদ্যোগী হবেন। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি হচ্ছে চীনের (১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার)। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি দেশকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার প্রভাববলয় বিস্তার করছে বলে অনেকে মনে করেন।
যদিও এটা ঠিক, অতীতে চীন কখনো কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল না। দেশটির আধিপত্য বিস্তারের কোনো ইতিহাসও নেই। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চীনের এই কর্মসূচির ব্যাপারে সন্দিহান। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশীয় প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি খুবই জরুরি। এ অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমন রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্ব। দক্ষিণ চীন সাগরে তেলের রিজার্ভ রয়েছে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ব্যারেল, আর গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীনের জ্বালানি চাহিদা অনেকটাই মেটাবে।
যুক্তরাষ্ট্রেও চায় এই জ্বালানিসম্পদের ভাগীদার হতে। তাই এখানেও একটা চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক ও মালবাহী জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরের জলপথ ব্যবহার করে চলাচল করে। এ কারণেই এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বেইজিং। যা মার্কিনি স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। তাই চীনকে মোকাবিলা করতে জাপানকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতি আরেকটি কারণ। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভয়টা ওই দেশকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীনের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে তার নৌবাহিনীকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করাতে পারে, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সামরিক কৌশলগত জলসীমা হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা রয়েছে, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৬০ ভাগ সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করার। এ ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন এ ধরনের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাইডেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন বেশি।
জো বাইডেনের এশীয় নীতি আলোচনা করতে গেলে অবশ্যই আরসিইপি (জঈঊচ) নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন। ১৫ নভেম্বর আশিয়ান সম্মেলনে এই মুক্তবাণিজ্য জোটটি গঠিত হয়। তবে মনে রাখতে হবে, চীনের সঙ্গে একটি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি করার ব্যাপারে আশিয়ান নেতারা ২০১২ সাল থেকেই আলোচনা চালিয়ে আসছিলেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য শুল্ক কমানো, সরবরাহ শৃঙ্খলা শক্তিশালী করা ও ই-কমার্সের জন্য নতুন বিধিবিধান চালু করা। আরসিইপির অন্তর্ভুক্ত দেশগুলো হচ্ছে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ ও সেই সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ- জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। তবে এটি কার্যকর হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। কেননা চুক্তিভুক্ত দেশগুলোর সংসদে তা অনুমোদিত হতে হবে। অনেকগুলো কারণের জন্য আরসিইপি অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
কেননা বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী ও এক-তৃতীয়াংশ জিডিপি এ বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আসবে। চুক্তিবদ্ধ ১৫টি দেশে বাস করে ২২০ কোটি মানুষ। এটি একটি বড় বাজার, বৈশ্বিক জিডিপিতে অঞ্চলটির সম্মিলিত অবদান ৩০ শতাংশের বেশি। দেশজ উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ২৬ লাখ ২০ হাজার কোটি ডলার। কোভিড-১৯ পরবর্তী যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠছে এবং চীনের নেতৃত্বে যে নতুন এক বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, আরসিইপি এ ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। এখানে বলা ভালো, এ অঞ্চল ঘিরে ওবামা প্রশাসনের আমলে টিপিপি (ঞচচ) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প ওই চুক্তি থেকে ২০১৭ সালে বেরিয়ে এসেছিলেন। ট্রাম্প বিশ্বকে একটা অস্থিরতার জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এখন জো বাইডেনকে ফিরে আসতে হবে। চীনের ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ বা বিআরআই (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ)-এর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি’র একটা সমন্বয় প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে বাইডেন যদি ট্রাম্পের নীতি অনুসরণ করেন, যদি চীনকে ‘একঘরে’ করার ট্রাম্পের নীতি সমর্থন করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেন, তা হলে ট্রাম্প স্নায়ুযুদ্ধ-২ এর যে ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন, তা আরও শক্তিশালী হবে মাত্র। কোভিড-১৯ মোকাবিলা করা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পুনরায় যোগ দিয়ে মহামারী রোধে একটা বৈশ্বিক অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করা, ইরান প্রশ্নে ৬ জাতি আলোচনা শুরু করা- এসব বিষয়ও স্থান পাবে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার তালিকায়। এ ক্ষেত্রে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল যে তার পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। একটা আশার জায়গা হচ্ছে, জো বাইডেন একজন বাংলাদেশি-আমেরিকানকে তার দক্ষিণ এশীয় উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। ওসমান সিদ্দিকী একজন মার্কিন কূটনীতিক, তিনি ফিজি, নাঊরু ও তুভালুতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত (১৯৯৯-২০০১) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার এই নিয়োগ নিঃসন্দেহে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে জো বাইডেন প্রশাসনকে আরও আগ্রহী করে তুলবে। আমাদের জন্যও এটা একটা প্লাস পয়েন্ট। জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতিতে এশিয়া গুরুত্ব পাবে। আমাদের দায়িত্বটি হবে এই গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমাদের স্বার্থ আদায় করে নেওয়া।
Amader Somoy
21.11.2020
এশিয়া-প্যাসিফিকের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসছে?
03:25
1 comment
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় একটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। তা হচ্ছে, এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনীতিতে তিনি কী পরিবর্তন আনতে যাচ্ছেন? নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভারতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সফরে এসেছিলেন দু'জন শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার। তারা দু'জন ভারতীয় প্রতিপক্ষের সঙ্গে 'টু প্লাস টু' শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। এর আগে টোকিওতে 'কোয়াড'-এর (কোয়াডরিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত যার সদস্য) শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল (৬ অক্টোবর, ২০২০)। এর পরই বঙ্গোপসাগর উপকূলে ভারতের বিশাখাপত্নমের কাছে গভীর সাগরে মালাবার নৌমহড়ায় অংশ নিয়েছিল (৩ নভেম্বর) এই চার দেশের নৌবাহিনী। অস্ট্রেলিয়ার নৌবাহিনী গত ১৩ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো মালাবার নৌমহড়ায় অংশ নিল। দ্বিতীয় পর্যায়ে মালাবার নৌমহড়া আরব সাগরে ১৭ থেকে ২০ নভেম্বর পর্যন্ত। 'কোয়াড' শীর্ষ সম্মেলনের মালাবার নৌমহড়া এবং পম্পেও-এসপারের ভারত সফর মূলত একই সূত্রে গাঁথা। এর সঙ্গে আমরা মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের শীর্ষ কর্মকর্তা মি. বিগাবের ঢাকা সফরকেও যোগ করতে পারি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে যে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে, এটি তার বড় প্রমাণ। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশিয়া-প্যাসিফিক যে কত গুরুত্বপূর্ণ, তার আরও একটি প্রমাণ হচ্ছে ভারত সফরের পরপরই পম্পেও-এসপার শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া সফর করেছিলেন। তবে নিঃসন্দেহে পম্পেও-এসপারের নয়াদিল্ল্নির সফরের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানো ও ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের নৌ উপস্থিতি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র যে স্ট্র্যাটেজি প্রণয়ন করছে, তার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ভারত। ভারতকে কেন্দ্র করেই যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। মোদ্দাকথা চীনকে ঠেকানো। আর এ জন্য ভারতকে সঙ্গে নেওয়া। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্পের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের এই যে নীতি, এখন জো বাইডেনের প্রশাসন তা কি পরিত্যাগ করবে?
জো বাইডেন একজন সিনেটর হিসেবে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সিনেট কমিটিতে কাজ করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি ২০০১-০৩ ও ২০০৭-০৯ দুই দুইবার সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির সদস্য ছিলেন। ফলে বৈদেশিক সম্পর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই আলোকেই বলা যায়, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এখন দেখার পালা তিনি কীভাবে মার্কিনি স্বার্থ আদায়ে উদ্যোগী হবেন। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ হিসেবে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতি হচ্ছে চীনের (১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার)। চীন তার 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি দেশকে এক কাতারে নিয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার প্রভাব বলয় বিস্তার করছে বলে অনেকে মনে করেন। যদিও এটি ঠিক, অতীতে চীন কখনও কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল না। দেশটির আধিপত্য বিস্তারের কোনো ইতিহাসও নেই। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চীনের এই কর্মসূচির ব্যাপারে সন্দিহান। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি খুবই জরুরি। দ্বিতীয়ত, এ অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। দক্ষিণ চীন সাগরের তেলের রিজার্ভ রয়েছে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ব্যারেল, আর গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীনের জ্বালানি চাহিদা অনেকটা মেটাবে। যুক্তরাষ্ট্রও চায় এই জ্বালানি সম্পদের ভাগীদার হতে। সুতরাং এখানেও একটি চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক ও মালবাহী জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরের জলপথ ব্যবহার করে চলাচল করে। এ কারণেই এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বেইজিং, যা মার্কিনি স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। তাই চীনকে মোকাবিলা করতে জাপানকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতি আরেকটি কারণ। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভয়টা ওই দেশকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীনের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে তার নৌবাহিনীকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করাতে পারে, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সামরিক কৌশলগত জলসীমা হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা রয়েছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৬০ ভাগ সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করার। এ ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন এ ধরনের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাইডেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন বেশি।
অর্থনীতিকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। এটাই স্বাভাবিক। কভিড-১৯ বিশ্ব অর্থনীতিতে আঘাত করেছে। তার ঢেউ লেগেছে যুক্তরাষ্ট্রেও। একটি মহামন্দার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। কিংবা শতাব্দীর ত্রিশের দশকের মহামন্দার কথা অনেকেই জানেন। জাপান ও চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ১ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন ও ১ দশমিক শূন্য ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বড় অর্থনীতি, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এই অর্থনীতি এখন ঝুঁকির মুখে। ফলে অর্থনীতি একটি বড় সেক্টর, যেখানে জো বাইডেনকে হাত দিতে হবে। আশার কথা, অর্থনীতিকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন এই শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত বিষয়। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাগর-মহাসাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে মরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের উষ্ণতাও বাড়ছে। এটি বৈশ্বিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটি বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে প্যারিস কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। পরে ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কপ-২১ চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। ১৭০টি দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করেছিল। অথচ ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কপ-২১-এ বিশ্বের ১৯৫টি দেশ রাজি হয়েছিল- ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখবে। জো বাইডেন বলেছেন, তিনি কপ-২১ চুক্তিতে ফিরে যাবেন। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপরেও গুরুত্ব দিয়েছেন বাইডেন, যা কিনা বিশ্বে তার অবস্থান আরও শক্তিশালী করবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে পশ্চিম ইউরোপ তথা ন্যাটোভুক্ত দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। ন্যাটোর দেশগুলোকে ন্যাটোতে দেওয়া অনুদানের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছেন।
মোদ্দাকথা, ট্রাম্প গত চার বছর বিশ্বকে একটি অস্থিরতার জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে এখন জো বাইডেনকে ফিরে আসতে হবে। চীনের 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' বা বিআরআইর (বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের 'এশিয়া-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি'র একটি সমন্বয় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বাইডেন যদি ট্রাম্পের নীতি অনুসরণ করেন, যদি চীনকে 'একঘরে' করার ট্রাম্পের নীতি সমর্থন করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করেন, তাহলে ট্রাম্প স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর যে ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন, তা আরও শক্তিশালী হবে মাত্র। কভিড-১৯ মোকাবিলা করা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফের যোগ দিয়ে মহামারি রোধে একটি বৈশ্বিক অ্যাপ্রোচ গ্রহণ করা, ইরান প্রশ্নে ছয় জাতি আলোচনা শুরু করা- এসব বিষয়ও স্থান পাবে বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকার তালিকায়। এ ক্ষেত্রে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল যে তার পররাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান পাবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।
Samakal
20.11.2020
সু চির বিজয় ও রোহিঙ্গা সমস্যার ভবিষ্যৎ
16:48
1 comment
মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে আবারও জয় পেয়েছে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষের। উচ্চকক্ষ (Amyotha Hluttaw) ২২৪ সদস্যের, আর নিম্নকক্ষ (Pyithu Hluttaw) ৪৪০ সদস্যের। উভয় কক্ষেই সেনাবাহিনীর জন্য আসন সংরক্ষিত। উচ্চকক্ষে ৫৬ আসন ও নিম্নকক্ষে ১১০টি আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। ফলে নিম্নকক্ষের সব আসনে নির্বাচন হয় না। মোট ৩৩০টি আসনে নির্বাচন হয় এবং বাকি আসনগুলো সেনাবাহিনী প্রধান কর্তৃক মনোনীত। উচ্চকক্ষেও সব আসনে নির্বাচন হয় না। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে এনএলডি নিম্নকক্ষে ২৫৫ আসন পেয়ে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এবার সর্বশেষ প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী উভয় কক্ষের ৬৬৪ আসনের মধ্যে এনএলডি ৩৪৬ (ঘোষিত ৪১৮ আসনের মধ্যে) আসন পেয়েছে। ফলে নিশ্চিত করেই বলা যায় অং সান সু চির দল এনএলডি’ই মিয়ানমারে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। তবে এই নির্বাচন মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের যেমন কোনো সমাধান দেবে না, ঠিক তেমনি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্যও কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না।
অস্ট্রেলিয়ার Lowy Institute-এর বুলেটিন The Interpreter-এর এক প্রতিবেদনে (১২ অক্টোবর ২০২০) বলা হয়েছিল : মিয়ানমারের এই নির্বাচন free, fair and safe’ হবে না। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আগে থেকেই ছিল। এটি শান্তিপূর্ণ, স্বাধীন ও অবাধ হয়নি। ইতিমধ্যে সেখানে ২৭,৯০০ লোক কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে, যা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি। এখন নির্বাচনের কারণে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। এই নির্বাচনে রাখাইনের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের ভোট প্রদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। মিয়ানমারের নির্বাচনী আইনের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রার্থিতার ক্ষেত্রে প্রার্থীকে মিয়ানমারের নাগরিক হতে হবে। ২০১০ সালের Political Parties Registration Law পরে ২০১৪ সালে পরিবর্তন করা হয়। যাতে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থীকে কোনো দলে যোগ দিতে হলে অথবা নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাকে ‘পূর্ণ’ নাগরিক হতে হবে। এই ‘পূর্ণ’ নাগরিকের বিষয়টি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য প্রযোজ্য। এরা পূর্ণ নাগরিক নন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সামরিক সরকার যে White Card ইস্যু করে, তাতে করে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণে কোনো নির্বাচন এবার অনুষ্ঠিত হয়নি। মুসলমান রোহিঙ্গারা এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। মিয়ানমার সরকার রাখাইন ও চিন স্টেটে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। ফলে ভোটারদের সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালের ২১ জুন সরকার রাখাইন স্টেটের আটটি টাউনশিপে ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই বিধিনিষেধ এখনো বহাল রয়েছে। ফলে মানুষ নির্বাচন-সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারেনি। কভিড-১৯-এর কারণে কোনো নির্বাচনী প্রচারণাও হয়নি। ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা একটি বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছিল।
দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সশস্ত্র আন্দোলন আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে আসছে। সাম্প্রতিককালে রাখাইন ও চিন স্টেটে আরাকান আর্মির সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এই দুই স্টেটে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। একই কথা প্রযোজ্য কাচিন, কারেন ও শান স্টেটের ক্ষেত্রেও। সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে এখানে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পরিবেশ ছিল না। স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল Wa state-এর অবস্থাও ছিল তেমনি। ফলে নামেমাত্র একটি নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু তাতে অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল না। সরকার তথা সেনাবাহিনীবিরোধী বক্তব্যের জন্য অনেক বিরোধীদলীয় প্রার্থী তথা সমর্থককে পেনাল কোডের ৫০৫(বি) ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ফলে যারাই অং সান সু চি সরকারের বিরোধিতা করেছেন, তাদের স্থান এখন জেলে। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম টিভি ও বেতারে তাদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু তাদের বক্তব্য আগে নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়েছিল। ফলে দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল, যা ছিল মুক্ত চিন্তার পরিপন্থী। আর ক্ষমতাসীন এনএলডি সরকার রাষ্ট্রীয় মিডিয়াকে ব্যবহার করেছিল, অন্যরা সেই সুযোগ পায়নি।Democratic Party for a New Society, National Democratic Force Party, Peoples Party-এর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, তারা সম-সুযোগ পাচ্ছে না।
মিয়ানমারের সংবিধানই একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে প্রধান অন্তরায়। এটি অগণতান্ত্রিকও ঘটে। শুধু ৭৫ ভাগ আসন পূর্ণ হয় গণতান্ত্রিকভাবে, বাকি আসন শুধু মনোনয়ন। এতে করে সেনাবাহিনীর অলিখিত কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। ২০০৮ সালে এই সংবিধান গ্রহণ করা হয়। এই সংবিধানের আলোকেই ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। সংবিধানে এমন সব শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, যাতে অং সান সু চি কোনো দিনই প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। শর্তে বলা হয়েছে ‘মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের স্বামী বা স্ত্রী বিদেশি নাগরিক হতে পারবেন না। তার সন্তানরা যদি বিদেশি নাগরিক হন, তাহলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন।’ এই শর্তের কারণে সু চি কোনো দিনই প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। কেননা তার প্রয়াত স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। তার দুই সন্তানও বিদেশি নাগরিক। সু চি এই শর্ত মেনেই নির্বাচনে গিয়েছিলেন এবং সংবিধান সংশোধনের দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠলেও, সেনাবাহিনীর সমর্থন এতে পাওয়া যায়নি। এবার নির্বাচনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকা এবং ব্যাপকসংখ্যক জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগ এই নির্বাচনকে অর্থহীন করেছে। সীমিত কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা সেখানে থাকলেও তাদের ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। রাখাইনে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ভোট দিতে পেরেছেন। ফলে এই নির্বাচন মিয়ানমারের জন্য আদৌ কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না।
কয়েক বছর ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অং সান সু চির একটি অলিখিত আঁতাত গড়ে উঠেছে। এই আঁতাতের কারণেই তিনি ক্ষমতায় আছেন। শুধু তা-ই নয় হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অত্যন্ত নগ্নভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইছেন। ফলে অং সান সু চির দলের পুনরায় ক্ষমতায় আসা ছিল একটি ওপেন সিক্রেট। সবাই এটা জানত। সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি দল আছে বটে। কিন্তু তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ছিল না। আগামীতেও নেই। সেনাবাহিনী চাইবে সু চি ক্ষমতায় থাকুক। কিন্তু তাতে করে মিয়ানমারের মূল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। মূল সমস্যা মূলত দুটি। এক. মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের একটা সমাধান। জাতিগতভাবে বিভক্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। গেল পাঁচ বছর অং সান সু চি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি এবং এর কোনো সমাধানও করেননি। ফলে আগামী পাঁচ বছর তার দল ক্ষমতায় থাকলেও তাকে স্টেট কাউন্সিলরের পদ নিয়েই খুশি থাকতে হবে। তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। সংবিধানে সংশোধনীও আনতে পারবেন না। আর জাতিগত দ্বন্দ্বেরও কোনো সমাধান দিতে পারবেন না। দুই. প্রায় ১১ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক (রোহিঙ্গা) এখন বাংলাদেশে বাস করে। এদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগও নেই। নির্বাচিত হলেও আগামী পাঁচ বছর তার কোনো উদ্যোগ থাকবে না। জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসবে না।
যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য অং সান সু চি বিশ^ব্যাপী একসময় প্রশংসিত হয়েছিলেন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন, তিনি আজ গণতান্ত্রিক বিশে^ একজন ঘৃণিত ব্যক্তি। তার শাসনামলেই তিনি জাতিগত দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়েছিলেন। শুধু সেনাবাহিনীর স্বার্থেই যে তিনি কাজ করেছেন, তেমনটি নয়। বরং সংখ্যাগুরু ‘বামার’দের তথা উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থে জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছেন। মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এ বিষয়টিকে তিনি কখনোই গুরুত্ব দেননি। তাই নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক হান্নাহ বেক যখন লেখেন, Her strongest critics accuse her, As a member of the Bamar ethnic majority, of racism and an unwillingness to fight for the hunman rights of all people in Myanmar’, তখন তিনি মিথ্যা বলেন না। নিজ ক্ষমতার স্বার্থে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তার কাছে মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা। এজন্যই আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করা হলেও তিনি নিজে সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে যাচ্ছেন বারবার।
উগ্র বৌদ্ধরা (পাঠক বার্মিজ বিন লাদেন হিসেবে পরিচিত ভিথারুর কথা স্মরণ করতে পারেন) তাকে শুধু সমর্থনই করছে না, বরং রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে উচ্ছেদ করার উদ্যোগকেও সমর্থন করছে। হান্নাহ বেক তার প্রতিবেদনে কাচিন প্রদেশের একজন রাজনীতিবিদ সেং নু পানের (Seng Nu Pan) উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে, ‘Now that she has tasted power, don’t think she wants to share it with anyone’ (তার প্রতিবেদন How a Human Rights Angel Lost her Halo, Nov. 14, 2020)। এটাই হচ্ছে আসল কথা। সু চি কাউকে ক্ষমতার ভাগ দিতে চাচ্ছেন না। যেখানে জাতিগত ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বেশি, সেখানে জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসানে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। তাই আগামী পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই
Desh Rupantor
17.11.2020
যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা হস্তান্তর কি শান্তিপূর্ণভাবে হবে?
01:38
1 comment
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার প্রায় দু’সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পরও ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা দূর হয়নি। ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী জো বাইডেন নির্বাচকমণ্ডলীর ৩০৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হলেও এখন অবধি তা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাইডেনকে এখন অবধি শুভেচ্ছা জানাননি এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য বাইডেনকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানাননি। অথচ ২০১৬ সালের এই দিনে ট্রাম্প যখন হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করে বিজয়ী হয়েছিলেন, তখন বারাক ওবামা তাকে হোয়াইট হাউসে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই প্রথম আমন্ত্রণ না জানানোর মতো ঘটনা ঘটল। অতীতে এ রকমটি হয়নি কখনও।
ট্রাম্প নিজে বারবার বলে আসছেন নির্বাচনে ‘কারচুপি’ হয়েছে। এ নিয়ে অঙ্গরাজ্যগুলোতে একাধিক মামলা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ট্রাম্প ও তার আইনজীবীরা সুপ্রিমকোর্টে যাবেন বলে ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন। মামলা পরিচালনার জন্য প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করা হয়েছে এবং ট্রাম্প দেশের কয়েকজন শীর্ষ আইনজীবীকে এ কাজের জন্য নিয়োগ করেছেন। যদিও সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, ট্রাম্প ও তার আইনজীবীরা এখন অবধি ‘ভোট চুরির’ কোনো সুস্পষ্ট প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। একটা যুক্তি ট্রাম্প নিজে উপস্থাপন করেছেন যে, নির্ধারিত সময়ের পর যেসব ‘পোস্টাল ভোট’ এসেছে, তা গ্রহণ করা যাবে না।
তিনি পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের ভোট গণনার ক্ষেত্রে এ অভিযোগটি উত্থাপন করেছেন। তবে এটা সবাই জানে যে ডেমোক্র্যাট সমর্থকরা ব্যাপক হারে এবার ‘পোস্টাল ব্যালট’ প্রদান করেছেন। এর মূল কারণ করোনাভাইরাস। এ করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আঘাত করেছে। তবে মার্কিন ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে, পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে কারচুপির সম্ভাবনা কম। তারপরও রিপাবলিকান শিবিরের পক্ষ থেকে এ দাবিটি জোরালো করা হয়েছে। এ দাবি নিয়েই তারা সুপ্রিমকোর্টে যাবেন। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভোট জালিয়াতির যে অভিযোগ করেছেন, তা বাতিল করেছে হোমল্যান্ড সিকিউরিটির সাইবার-সিকিউরিটি অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার সিকিউরিটি এজেন্সি (সিআইএসএ)।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে যখন এক ধরনের অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর একটি বক্তব্য যথেষ্ট গুরুত্বের দাবি রাখে। পম্পেও ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের একজন। ৯ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, জানুয়ারিতে Smooth transition of power to a second term for President Trump (Townhall 10 November)। অর্থাৎ ট্রাম্প জানুয়ারিতেই তার দ্বিতীয় টার্ম শুরু করবেন। পম্পেও সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও সিআইএ’র প্রধান ছিলেন। তিনি যখন এ ধরনের একটি কথা বলেন, তখন বিতর্কের মাত্রা বাড়ে বৈকি! ১০ নভেম্বর কলামিস্ট ফ্রেড কাপলান নিউজ ম্যাগাজিন SLATE-এ একটি নিবন্ধ লিখেছেন, যার শিরোনাম ‘Trump is Making a Serious Attempt to Hold onto Power’। মূল বক্তব্য হচ্ছে, যেভাবেই হোক ট্রাম্প ক্ষমতা ধরে রাখতে চাচ্ছেন! দেশরক্ষা মন্ত্রী এসপারকে চাকরিচ্যুত করে তিনি এ মেসেজটিই দিলেন যে তিনি এখনও ক্ষমতায়।
ট্রাম্প কর্তৃক নির্বাচনের ফলাফল মেনে না নেয়া এবং জো বাইডেনকে শুভেচ্ছা না জানানো মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য একটা খারাপ দৃষ্টান্ত রেখে গেল। অতীতে অনেক ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট দ্বিতীয়বার নির্বাচনে বিজয়ী হতে পারেননি। জেরাল্ড ফোর্ড (১৯৭৪-১৯৭৭), জিমি কার্টার (১৯৭৭-১৯৮১) ও জর্জ বুশের (১৯৮৯-১৯৯২) কথা আমরা উল্লেখ করতে পারি। আবার ২২তম প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের (১৮৮৫-১৮৮৯) কথাও আমরা এখানে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে পারি। তিনি ছিলেন ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রেসিডেন্ট, কিন্তু নির্বাচনে রিপাবলিকান দলীয় প্রার্থী বেঞ্জামিন হ্যারিসনের কাছে হেরে যান। কিন্তু ১৮৯২ সালের নির্বাচনে তিনি আবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিজয়ী হন। তিনি ১৮৯৩ সালে দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমতায় থাকেন ১৮৯৭ সাল পর্যন্ত। কোনো কোনো পর্যবেক্ষক এখন বলার চেষ্টা করছেন যে, বয়সের কারণে ২০২৪ সালে বাইডেনের পক্ষে হয়তো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা সম্ভব হবে না (তখন তার বয়স হবে ৮২ বছর); সেক্ষেত্রে ট্রাম্প আবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন! তবে এটা ভবিষ্যতের ব্যাপার। কী হবে বা হতে পারে, তা এ মুহূর্তে বলা যাবে না।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে ক্ষমতা পরিচালনা করতেন, তাতে খোদ রিপাবলিকান পার্টির মাঝেও এক ধরনের অসন্তুষ্টি ছিল। তিনি একটি পারিবারিক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার মেয়ে ইভানকা ও জামাই কুশনার ‘বিশেষ উপদেষ্টা’র পদ নিয়ে অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম ধনী ব্যক্তি হয়েও তিনি ট্যাক্স দিতেন মাত্র ৭৫০ ডলার, যা বড় বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। তিনি তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে চাপিয়ে দিতেন। ব্যবসা আর রাজনীতি যে দুটি ভিন্ন জিনিস- এটা বুঝতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তিনি রাষ্ট্র চালাতেন। তিনি ব্যবসা বোঝেন। কর ফাঁকির বিষয়টি বোঝেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের বিশ্ব আসরে যে একটি ভূমিকা আছে, যেখানে ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি কাজ করে না, এটা ট্রাম্প বোঝেননি। ফলে শুধু চীন নয়, ট্রেডিশনাল মিত্রদের সঙ্গেও যুক্তরাষ্ট্রের একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। এখন জো বাইডেন বিশ্ব আসরে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কতটা ফিরিয়ে আনতে পারবেন- এ প্রশ্ন অনেকের।
এখানে বলা ভালো, জো বাইডেন একজন সিনেটর হিসেবে পররাষ্ট্রনীতি সংক্রান্ত সিনেট কমিটিতে কাজ করে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি ২০০১-০৩ ও ২০০৭-০৯ সময়ে দু-দুবার সিনেট ফরেন রিলেশনস কমিটির সদস্য ছিলেন। ফলে বৈদেশিক সম্পর্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সম্পর্কে তার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা রয়েছে। এ আলোকেই বলা যায় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল সম্পর্কে তিনি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এখন দেখার পালা এ অঞ্চলে তিনি কীভাবে মার্কিন স্বার্থ আদায়ে উদ্যোগী হন। চীন বিশ্বের অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি। সাধারণ হিসাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হচ্ছে চীনের (১৪.১৪ ট্রিলিয়ন ডলার)। চীন তার ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ কর্মসূচির আওতায় ৬৪টি দেশকে এককাতারে নিয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার প্রভাব বলয় বিস্তার করছে বলে অনেকে মনে করেন। যদিও এটা ঠিক, অতীতে চীন কখনও কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি ছিল না। দেশটির আধিপত্য বিস্তারের কোনো ইতিহাসও নেই। কিন্তু মার্কিন নীতিনির্ধারকরা চীনের এ কর্মসূচির ব্যাপারে সন্দিহান। ফলে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে এশীয়-প্যাসিফিক অঞ্চলে তাদের সামরিক উপস্থিতি খুবই জরুরি। এ অঞ্চলে অবস্থিত দক্ষিণ চীন সাগরের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অনেক বেশি। দক্ষিণ চীন সাগরের স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে অর্থনৈতিক গুরুত্বও। দক্ষিণ চীন সাগরে তেলের রিজার্ভ রয়েছে ১১ দশমিক ২ বিলিয়ন ব্যারেল, আর গ্যাসের রিজার্ভ রয়েছে ১৯০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফিট। চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ চীন সাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এর মধ্য দিয়ে চীন তার জ্বালানি চাহিদার অনেকটাই মেটাবে। যুক্তরাষ্ট্রও চায় এ জ্বালানি সম্পদের ভাগিদার হতে। সুতরাং এখানেও একটা চীন-যুক্তরাষ্ট্র দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ বাণিজ্যিক ও মালবাহী জাহাজ দক্ষিণ চীন সাগরের জলপথ ব্যবহার করে চলাচল করে। এ কারণেই এই সমুদ্রপথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় বেইজিং, যা মার্কিন স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। তাই চীনকে মোকাবেলায় জাপানকে সব ধরনের সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য প্রদান করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র। কোরীয় উপদ্বীপের রাজনীতি যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তার আরেকটি কারণ। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক শক্তি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের ভয়টা ওই দেশকে নিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ চীনের সমুদ্রপথ ব্যবহার করে তার নৌবাহিনীকে প্রশান্ত মহাসাগরে প্রবেশ করাতে পারে, যা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি সামরিক কৌশলগত জলসীমা হিসেবে বিবেচিত। যুক্তরাষ্ট্রের একটি পরিকল্পনা রয়েছে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ৬০ শতাংশ সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোর। সেক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন এ ধরনের পরিকল্পনা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, বাইডেন অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ওপর গুরুত্ব দেবেন বেশি।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে পশ্চিম ইউরোপ তথা ন্যাটোভুক্ত দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। ন্যাটোর দেশগুলোকে ন্যাটোতে দেয়া অনুদানের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছেন। তিনি মুসলমান বিদ্বেষের কারণে কয়েকটি মুসলিমপ্রধান দেশের নাগরিকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। ইরানের সঙ্গে ছয় জাতি সমঝোতা থেকে ট্রাম্প বেরিয়ে গেছেন। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক ঝুঁকি কমেনি, বরং বেড়েছে। তার প্রো-ইসরাইলি নীতি ফিলিস্তিনি সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে গেছে। এ সংকট সমাধানের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
মোদ্দা কথা, ট্রাম্প গেল চার বছরে বিশ্বকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছেন, তা থেকে বেরিয়ে না এলে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব আসরে একা হয়ে যাবে। তাতে করে সুবিধা নেবে চীন। কোভিড-১৯-পরবর্তী বিশ্বে দুটো বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, দুই. বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে কোভিড-১৯-এর টিকা পৌঁছে দেয়া। এ দুটি ক্ষেত্রে যদি যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রশাসন কোনো ভূমিকা নেয়, তাহলে তা দেশটির ভাবমূর্তি উদ্ধারে একটি বড় ভূমিকা রাখবে। বিশ্ব আসরে তার অবস্থানও শক্তিশালী করবে। আশার কথা, জো বাইডেন দুটি ক্ষেত্রেই ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে (কপ-২১) ফিরে যাবে। একইসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় ফিরে গিয়ে বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মোকাবেলায়ও একটি ভূমিকা রাখবে। এদিকে চীন দেরিতে হলেও জো বাইডেনের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছে।
তবে আশঙ্কার জায়গা আছে অনেক। ১. পেনসিলভানিয়ার একজন বিচারপতি একটি রায় দিয়েছেন- তাতে তিনি বলেছেন, যে ভোটগুলো পরে এসেছিল এবং যা আলাদা করে রাখতে বলা হয়েছিল, তা গণনা করা যাবে না। ওই বিচারপতির মতো পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের সেক্রেটারি অব স্টেট ক্যাথি বুকভার নির্বাচনের আগে ১ নভেম্বর (২০২০) যে আদেশ জারি করেছিলেন (পোস্টাল ব্যালট সংক্রান্ত), তা ওই রাজ্যের নির্বাচন সংক্রান্ত বিধিমালার সেকশন ১৩০৮(এইচ)কে সমর্থন করে না (Townhall, Nov. 12)। এই আদেশ ট্রাম্প সমর্থকদের দাবিকে সমর্থন করবে। শুধু তাই নয়, ট্রাম্পের আইনজীবী গুলিয়ানি দাবি করেছেন, ৬ লাখ ৫০ হাজার ভোট অবৈধভাবে ফিলাডেলফিয়া ও পিটসবার্গে গণনা করা হয়েছে (ZeroHedge, 12 Nov.)। গুলিয়ানির বক্তব্য ও কোর্টের রায় অনেকটা একই। ২. নিউজ পোর্টাল Alter Net-এর একটি প্রতিবেদন ‘We're Witnessing the birth of a dangerous new strain in the right-wing movement' (11 Nov.)। এটি লিখেছেন Joshua Holland। বক্তব্য স্পষ্ট- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের জমানায় উগ্র দক্ষিণপন্থীদের উত্থান ঘটেছে। 3. Hoffpost-এর একটি শিরোনাম ‘Why Trumps transition chaos is a national security nightmare' (11 Nov.). প্রতিবেদক লিখছেন, ট্রাম্প আরও ১০ সপ্তাহ ‘কমান্ডার ইন চিফ’ হিসেবে থাকবেন। এ সময়ে তার যে কোনো সিদ্ধান্ত সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে যাবে। ৪. কোনো কোনো নিউজ পোর্টাল (OEN) আশঙ্কা করছে, Trump and Republicans Staging a Hayes/Tilden Coup; They Don't Need to Win Lawsuits, Just Stall (Rob Kall-এর প্রবন্ধ, 11 Nov.)। ১৮৭৬ সালের নির্বাচনে (হায়েস-রিপাবলিকান বনাম টিলডেন ডেমোক্র্যাট) এ ধরনের একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। ২৭০ নির্বাচনকমণ্ডলীর ভোট উভয় প্রার্থী পাওয়ায় প্রতিনিধি পরিষদে বিষয়টি যায় এবং অত্যন্ত কৌশলে হায়েসকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। এ ধরনের একটি অপচেষ্টাকে ‘coup attempt’ বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। Dahlia LithwickI তার প্রবন্ধে এই ‘coup attempt’-এর কথা বলেছেন (Slate, 10 Nov.)।
২০ জানুয়ারি নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেবেন। মাঝখানে এখনও অনেক কিছু ঘটতে পারে। তবে পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাষায়- এ পরিস্থিতি মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের প্রতিটি দেশকে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোকে গণতন্ত্রের ‘সবক’ দেয়। এখন নিজ দেশের গণতন্ত্রই প্রশ্নের মুখে। শেষ অবধি জো বাইডেনকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্বীকার করে নিতে হবে। কিন্তু ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পর একের পর এক যা ঘটে চলেছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো ভালো খবর নয়।
Jugsntor
15.11.2020
কতদূর যেতে পারবেন জো বাইডেন
06:12
No comments
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জো বাইডেন। আগামী ২০ জানুয়ারি (২০২১) তিনি শপথ নেবেন। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘ট্রাম্প যুগের’ অবসান হতে যাচ্ছে। গেল চার বছর ব্যক্তি ট্রাম্প যেভাবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার ব্যক্তিগত আচরণ ও নীতি যেভাবে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, প্রশ্ন এখানেই যে জো বাইডেন তা থেকে কতটুকু বের হয়ে আসতে পারবেন।
ট্রাম্পের আমলে মার্কিন সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বিভক্তিকে উসকে দিয়েছিলেন। অতীতে কোনো নির্বাচনেই মার্কিন সমাজ এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েনি। এই বিভক্তি যতটা না পার্টি লাইনে ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ব্যক্তিনির্ভর। একদিকে ট্রাম্প, অন্যদিকে বাকিরাএভাবেই বিভক্ত হয়ে পড়েছিল সমাজ। এই নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জন্ম হয়েছিল। পুরো ফলাফল ঘোষণা করার আগেই, কোথাও কোথাও ভোট গণনা কেন্দ্রে হামলা হয়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাম্প সমর্থকরা হামলা চালিয়েছিলেন। এ ধরনের হামলা অতীতে কোনো নির্বাচনের পর দেখা যায়নি।
এই নির্বাচন এবং নির্বাচনের ফলাফল মানতে অনীহা ও ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করা মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য ছিল বেমানান। এটা মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গেও বেমানান। মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি কখনই প্রাধান্য পায় না। প্রাধান্য পায় নীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে দায়বদ্ধতা ইত্যাদি। কিন্তু মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্পের উত্থান এবং দ্বিতীয়বার পুনর্নির্বাচনে বিজয়ী হতে তার নানা কৌশল ছিল গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এটা মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে নষ্ট করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কখনো ‘ব্যক্তি’ কোনো বড় ভূমিকা পালন করে না। পালন করে দলীয় নীতি। কিন্তু এবার দেখা গেল নীতির চেয়ে ‘ব্যক্তি ট্রাম্প’ গুরুত্ব পেয়েছিলেন বেশি। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আচরণ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ইমেজ প্রাধান্য পেয়েছিল বেশি। এ ক্ষেত্রে রিপাবলিকান দলের নীতি ও আদর্শ স্থান পেয়েছিল কম। ব্যক্তি ট্রাম্প রিপাবলিকান নীতি, আদর্শ ও স্ট্র্যাটেজির ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সর্বত্র। মার্কিন সমাজে যে এখনো জাতিগত বিদ্বেষ রয়েছে, শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসি যে এখনো একটি ফ্যাক্টর, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা আবারও প্রমাণিত। এত দিন এই মানসিকতা ‘চাপা’ পড়েছিল। এটা ছিল অনেকটা ‘ছাইচাপা দেওয়া আগুন’। ট্রাম্প তা উসকে দিয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন ড. মার্টিন লুথার কিং। ১৯৬৮ সালে আততায়ীর হাতে তার মৃত্যুর পর সেখানে জাতিগত বিদ্বেষ অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু ট্রাম্পের জমানায় এই বিদ্বেষ বেড়ে যায়। আমরা পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখেছি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জমানায় উগ্র শ্বেতাঙ্গগোষ্ঠী যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে, অতীতে তেমন শক্তিশালী তারা ছিল না। Ku klux Klan (গঠিত ১৮৬৫) এর পর থেকে এখন অব্দি প্রায় ১০০টি শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ তথ্যটি আমাদের দিয়েছে সাউদার্ন পোভার্টি ল সেন্টার (২০১৭)। এর বাইরে ৯৯টি ‘নিউ নাজি গ্রুপ’ তৎপর রয়েছে সেখানে। এই সব উগ্র গোষ্ঠী নাজি মতাদর্শে বিশ্বাসী। ট্রাম্পের জমানায় এরা শক্তিশালী হয়েছে।
এখন কতটুকু বদলাতে পারবেন জো বাইডেন? নির্বাচনে বিজয়ের পর তিনি তার নিজ রাজ্য দেলওয়্যারে উইলমিংটনে শত শত সমর্থকের উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, তার গুরুত্বও কম নয়। সেখানে চারটি বিষয়কে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, জাতিগত বিদ্বেষ কমিয়ে আনা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। করোনাভাইরাস কভিড-১৯ যে মার্কিন সমাজে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে, তা ট্রাম্প কখনই স্বীকার করেননি। কিন্তু জো বাইডেন তা শুধু স্বীকারই করেননি; বরং তার অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমেই রেখেছেন। তিনি ইতিমধ্যে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছেন। জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই যে কভিড-১৯ মোকাবিলায় বড় কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছেন, তা তিনি স্পষ্ট করেছেন। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। এটা যে একটা মহামারী, তা ট্রাম্প বিশ্বাস করতেন না। এমনকি তিনি কোনো নিয়মকানুন মানতেন না। মাস্ক ব্যবহার করতেন না। বিজ্ঞানকে তিনি অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছিলেন। কভিড-১৯-এ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। ৮ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১০১৮২৮১৮ জন। আর মৃত্যুর সংখ্যা ১২৫৬১২৩ জন। নতুন করে করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সেখানে আঘাত হেনেছে। মৃত্যুর সংখ্যাও সেখানে আবার বাড়ছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতাই জো বাইডেনকে ক্ষমতায় বসাতে যাচ্ছে। সুতরাং কভিড-১৯ মোকাবিলায় জো বাইডেন যে বড় কর্মসূচি নেবেন, এটাই প্রত্যাশিত। প্রথমেই তিনি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন।
অর্থনীতিকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। এটাই স্বাভাবিক। কভিড-১৯ বিশ্ব অর্থনীতিতে আঘাত করেছে, তার ঢেউ এসে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্রেও। একটি মহামন্দার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের মহামন্দার (Great Depression) কথা অনেকেই জানেন। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেটের পতনের পর পরই এই মহামন্দার সূত্রপাত হয়েছিল। ১৯৩৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৫ মিলিয়ন অর্থাৎ দেড় কোটি মানুষ বেকার হয়ে গিয়েছিল। কভিড-১৯ এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। শত শত মানুষ চাকরি হারিয়েছে। বেকারত্বের হার শতকরা ১৫ ভাগে থাকলেও, এখন তা নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশে। শেয়ারবাজারের নিম্নগতি এখনো লক্ষণীয়। দারিদ্র্যের গড় হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ (কৃষ্ণাঙ্গ ১৮ দশমিক ৮, শ্বেতাঙ্গ ৭ দশমিক ৫)। গড় প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। সেপ্টেম্বর (২০২০) পর্যন্ত এর পরিমাণ ২৬ দশমিক ৯৫ ট্রিলিয়ন ডলার। জাপান ও চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ১ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন ও ১ দশমিক ০৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বড় অর্থনীতি, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এই অর্থনীতি এখন ঝুঁকির মুখে। ফলে অর্থনীতি একটি বড় সেক্টর, যেখানে জো বাইডেনকে হাত দিতে হবে। আশার কথা, অর্থনীতিকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন এই শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত একটি বিষয়। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাগর-মহাসাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে মরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটা বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে প্যারিস কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। পরে ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কপ-২১ চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। ১৭০টি দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করেছিল। অথচ ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কপ-২১-এ বিশ্বের ১৯৫টি দেশ রাজি হয়েছিল ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখবে। জো বাইডেন বলেছেন, তিনি কপ-২১ চুক্তিতে ফিরে যাবেন। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন বাইডেন, যা কিনা বিশ্বে তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে পশ্চিম ইউরোপ তথা ন্যাটোভুক্ত দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। ন্যাটোর দেশগুলোকে ন্যাটোতে দেওয়া অনুদানের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছেন। তার মুসলমানবিদ্বেষের কারণে কয়েকটি মুসলমান দেশের নাগরিকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি সমঝোতা থেকে ট্রাম্প বেরিয়ে গেছেন। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণিক ঝুঁকি কমেনি; বরং বেড়েছে। তার প্রো-ইসরায়েলিনীতি ফিলিস্তিনি সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে গিয়েছিল। ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
মোদ্দাকথা, ট্রাম্প গেল চার বছরে বিশ্বকে স্থিতিশীলতার চেয়ে আরও বেশি অস্থিতিশীল করে তুলেছিলেন। চীনের সঙ্গে একধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করে তিনি বিশ্বে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিলেন। QUAD-কে সক্রিয় করে ও ইন্দো- প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়াতে ভারতের সঙ্গে একধরনের সামরিক অ্যালায়েন্সে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, চীনকে দুর্বল করতেই ট্রাম্প প্রশাসন এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এতে করে বিশ্বে জন্ম হয়েছিল একধরনের উত্তেজনার। কভিড-১৯-এর কারণে যেখানে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেখানে ট্রাম্প ‘চীনা ভাইরাস’ তথা চীনবিরোধী বক্তব্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতিকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে একাকী চলতে চেষ্টা করেছিলেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার, এই সংস্থায় চাঁদা দিতে অস্বীকার করা, কভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে আর্থিক দিক দিয়ে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করা, ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি (টিপিপি) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়া, এমনকি ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ইউনেসকোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা সবকিছুই প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আসরে নেতৃত্ব দেওয়ার যে সক্ষমতা, তা হারিয়েছিল। ফলে জো বাইডেন কতটুকু আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবেন, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে তার ভূমিকা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে কমলা হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও তার ‘রানিংমেট’ হিসেবে নির্বাচিত করায় এবং বিজয়ী ভাষণে তার নাম উচ্চারণ ও দক্ষিণ এশিয়ার কথা উল্লেখ করায় বাইডেনের মেসেজটি স্পষ্ট তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ একটা পরিবর্তন চেয়েছিল। সেই পরিবর্তনটি সম্পন্ন হয়েছে। নয়া প্রশাসন ২০২১ সালে দায়িত্ব নিয়ে বিশ^ আসরে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কতটুকু উদ্ধার করতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
Desh Rupantor
09.11.2020
মিয়ানমারের নির্বাচন কোনো আস্থার জায়গা তৈরি করে না
06:07
No comments
করোনা মহামারীর মধ্যেই আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। একদিকে করোনা সংকট, যাতে করে ইতোমধ্যে মারা গেছে দেশটির ৭৯৯ জন মানুষ, অন্যদিকে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন এ নির্বাচনের ব্যাপারে খোদ মিয়ানমারের ভেতরে ও বহির্বিশ্বে কোনো আগ্রহ তৈরি করেনি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাখাইন রাজ্যে অসন্তোষ এবং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনিশ্চয়তা। সব মিলিয়ে এ নির্বাচন অনেকটাই নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে পরিণত হতে যাচ্ছে।
এ নির্বাচন মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের যেমন কোনো সমাধান দেবে না, ঠিক তেমনি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্যও কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না। প্রথমত, অস্ট্রেলিয়ার Lowy Institute-এর বুলেটিন The Interpreter-এর এক প্রতিবেদনে (১২ অক্টোবর ২০২০) বলা হয়েছে, মিয়ানমারের এ নির্বাচন ‘free, fair and safe’ হবে না। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আছে। এটি শান্তিপূর্ণ, স্বাধীন ও অবাধ হবে না। ইতোমধ্যে সেদেশে ৩৩ হাজার ৪৮৮ লোক কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে, যা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি। এখন নির্বাচনের কারণে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, এ নির্বাচন হতে যাচ্ছে একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন।
দ্বিতীয়ত, এ নির্বাচনে রাখাইনের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের ভোট প্রদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। মিয়ানমারের নির্বাচনী আইনের ১০নং ধারায় বলা হয়েছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রার্থিতার ক্ষেত্রে প্রার্থীকে মিয়ানমারের নাগরিক হতে হবে। ২০১০ সালের Political Parties Registration Law ২০১৪ সালে পরিবর্তন করা হয়, যেখানে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থীকে কোনো দলে যোগ দিতে হলে অথবা নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাকে ‘পূর্ণ’ নাগরিক হতে হবে। এই ‘পূর্ণ’ নাগরিকের বিষয়টি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তারা পূর্ণ নাগরিক নন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সামরিক সরকার যে White card ইস্যু করে, তাতে করে প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণে কোনো নির্বাচন এবার হচ্ছে না এবং মুসলমান রোহিঙ্গারা এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না।
তৃতীয়ত, মিয়ানমার সরকার রাখাইন ও চিন রাজ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। ফলে ভোটারদের সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যাবে না। ২০১৯ সালের ২১ জুন সরকার রাখাইন স্টেটের ৮টি টাউনশিপে ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এ বিধিনিষেধ এখনও বহাল রয়েছে। ফলে মানুষ নির্বাচন সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারছে না। কোভিড-১৯-এর কারণে কোনো নির্বাচনী প্রচারণাও নেই। ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা একটি বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
চতুর্থত, দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সশস্ত্র আন্দোলন আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে আসছে। সাম্প্রতিককালে রাখাইন ও চিন রাজ্যে আরাকান আর্মির সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এ দুই রাজ্যে মানুষ ভোট দিতে পারবে না। একই কথা প্রযোজ্য কাচিন, কারেন ও শান রাজ্যের ক্ষেত্রেও। সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে সেখানে নির্বাচনে ভোট দেয়ার পরিবেশ নেই। স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ওয়া রাজ্যের অবস্থাও তেমনি। ফলে নামমাত্র একটি নির্বাচন হবে বটে; কিন্তু তা অংশগ্রহণমূলক হবে না।
পঞ্চমত, সরকার তথা সেনাবাহিনী বিরোধী বক্তব্যের জন্য অনেক বিরোধীদলীয় প্রার্থী তথা সমর্থককে পেনাল কোডের ৫০৫(বি) ধারায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ফলে যারাই অং সান সু চি সরকারের বিরোধিতা করছেন, তাদের স্থান এখন জেলে।
ষষ্ঠত, নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম টিভি ও বেতারে তাদের বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দিয়েছে। কিন্তু তাদের বক্তব্য আগে নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। ফলে দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হচ্ছে, যা মুক্তচিন্তার পরিপন্থী। ক্ষমতাসীন এনএলডি (National League for Democracy) সরকার রাষ্ট্রীয় মিডিয়াকে ব্যবহার করছে, অন্যরা সেই সুযোগ পাচ্ছে না। Democratic Party for a New Society, National Democratic Force Party, Peoples Party’র পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, তারা সমসুযোগ পাচ্ছে না।
সপ্তমত, মিয়ানমারের সংবিধান একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে প্রধান অন্তরায়। এটি অগণতান্ত্রিকও বটে। শুধু ৭৫ শতাংশ আসন পূর্ণ হয় জনগণের ভোটে, বাকি আসন শুধু মনোনয়ন। সেনাবাহিনীর অলিখিত কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। ২০০৮ সালে এ সংবিধান গ্রহণ করা হয়। এ সংবিধানের আলোকেই ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। সংবিধানে এমনসব শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, যাতে অং সান সু চি কোনোদিনই প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। শর্তে বলা হয়েছে, ‘মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের স্বামী বা স্ত্রী বিদেশি নাগরিক হতে পারবেন না। তার সন্তানরা যদি বিদেশি নাগরিক হন, তাহলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন।’ সু চির প্রয়াত স্বামী ব্রিটিশ নাগরিক। তার দুই সন্তানও বিদেশি নাগরিক। সু চি এ শর্ত মেনেই নির্বাচনে গিয়েছিলেন এবং সংবিধান সংশোধনের দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠলেও সেনাবাহিনীর সমর্থন এতে পাওয়া যায়নি।
অষ্টমত, নির্বাচনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভোট দেয়ার সুযোগ না থাকা, ব্যাপকসংখ্যক জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগ এ নির্বাচনকে অর্থহীন করেছে। সীমিত কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা সেখানে থাকলেও তাদের ভোট দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। রাখাইনে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ভোট দিতে পারবেন।
এখানে বলা ভালো, মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষবিশিষ্ট- উচ্চকক্ষ বা House of Nationalities (Amyotha Hluttaw) ও নিম্নকক্ষ বা House of Representative (Pyithu Hluttaw)। House of Nationalities-এর সদস্য সংখ্যা ২২৪। এখানে ১৬৮ আসনে নির্বাচন হয়, আর ৫৬ আসন (শতকরা ২৫ ভাগ) সেনাবাহিনীর সদস্যদের (কর্মরত) জন্য নির্ধারিত। এ কক্ষে অং সান সু চির দল এনএলডির আসন ১৩৫ (শতকরা ৬০.৩ ভাগ), সেনাবাহিনী সমর্থিত Union Solidarity and Development পার্টির আসন ১১, Arakan National Party’র আসন ১০। অন্যদিকে House of Representative-এর আসন সংখ্যা ৪৪০। এখানে ৩৩০ আসনে নির্বাচন হয়, ১১০ আসন সেনাবাহিনীর জন্য রিজার্ভ। ৩২৩ আসনে নির্বাচন হয়েছিল, ৭ আসনে সশস্ত্র বিদ্রোহের কারণে নির্বাচন হয়নি। এ কক্ষে এনএলডির আসন ২৫৫। Union Solidarity and Development party-এর আসন ৩০, Arakan National Party-এর আসন ১২। নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, রাজ্য পর্যায়ে যেসব আঞ্চলিক দল রয়েছে (Arakan National Party, Shan League for Democracy, Kachin Democratic Party ইত্যাদি) তারা রাজ্য পর্যায়ে নির্বাচনে আসন পেয়েছে। জাতীয় পর্যায়ে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। মিয়ানমারের সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো পদ নেই। তবে অং সান সু চি বর্তমানে স্টেট কাউন্সেলর, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অলিখিত প্রধানমন্ত্রী। একজন প্রেসিডেন্ট আছেন (উইন মিন্ট), যিনি একটি প্রেসিডেনশিয়াল ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। সরাসরি জনগণের ভোটে তিনি নির্বাচিত হন না। সাধারণত তিনটি কমিটির সদস্যদের নিয়ে এই ইলেকটোরাল কলেজ গঠিত হয়। একটি কমিটি গঠিত হয় বিভিন্ন রাজ্যের এমপিদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে। দ্বিতীয়টি সেনাবাহিনীর এমপিদের নিয়ে। আর তৃতীয়টি বিভিন্ন টাউনশিপের প্রতিনিধিত্ব (নিম্নকক্ষ) নিয়ে।
কাজেই এ নির্বাচন মিয়ানমারের জন্য আদৌ কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। গত বেশ কয়েক বছর ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অং সান সু চির একটি অলিখিত আঁতাত গড়ে উঠেছে। এ আঁতাতের কারণেই তিনি ক্ষমতায় আছেন। শুধু তাই নয়, হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অত্যন্ত নগ্নভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইছেন। ফলে অং সান সু চির দলের পুনরায় ক্ষমতায় আসা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি দল আছে বটে। কিন্তু তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ। স্বাভাবিকভাবেই সেনাবাহিনী চাইবে সু চি ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু তাতে করে মিয়ানমারের মূল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। মূল সমস্যা মূলত দুটি- এক. জাতিগত দ্বন্দ্ব। জাতিগতভাবে বিভক্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। গেল পাঁচ বছর অং সান সু চি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি এবং এর কোনো সমাধানও করেননি। ফলে আগামী পাঁচ বছর তার দল ক্ষমতায় থাকলেও তাকে স্টেট কাউন্সেলরের পদ নিয়েই খুশি থাকতে হবে। তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। সংবিধানে সংশোধনীও আনতে পারবেন না। আর জাতিগত দ্বন্দ্বেরও কোনো সমাধান দিতে পারবেন না। দুই. প্রায় ১১ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক (রোহিঙ্গা) এখন বাংলাদেশে অবস্থান করছে। তাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগ নেই। নির্বাচিত হলেও আগামী পাঁচ বছর তার কোনো উদ্যোগ থাকবে না। জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমার নতুন একটি সরকার পাবে বটে; কিন্তু তাতে করে মিয়ানমারের সমস্যার কোনো সমাধান হবে না।
Jugantor
18.10.2020
কতদূর যেতে পারবেন জো বাইডেন
19:34
No comments
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন জো বাইডেন। আগামী ২০ জানুয়ারি (২০২১) তিনি শপথ নেবেন। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ‘ট্রাম্প যুগের’ অবসান হতে যাচ্ছে। গেল চার বছর ব্যক্তি ট্রাম্প যেভাবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার ব্যক্তিগত আচরণ ও নীতি যেভাবে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, প্রশ্ন এখানেই যে জো বাইডেন তা থেকে কতটুকু বের হয়ে আসতে পারবেন।
ট্রাম্পের আমলে মার্কিন সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বিভক্তিকে উসকে দিয়েছিলেন। অতীতে কোনো নির্বাচনেই মার্কিন সমাজ এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েনি। এই বিভক্তি যতটা না পার্টি লাইনে ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল ব্যক্তিনির্ভর। একদিকে ট্রাম্প, অন্যদিকে বাকিরাএভাবেই বিভক্ত হয়ে পড়েছিল সমাজ। এই নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জন্ম হয়েছিল। পুরো ফলাফল ঘোষণা করার আগেই, কোথাও কোথাও ভোট গণনা কেন্দ্রে হামলা হয়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাম্প সমর্থকরা হামলা চালিয়েছিলেন। এ ধরনের হামলা অতীতে কোনো নির্বাচনের পর দেখা যায়নি।
এই নির্বাচন এবং নির্বাচনের ফলাফল মানতে অনীহা ও ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করা মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য ছিল বেমানান। এটা মার্কিন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গেও বেমানান। মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি কখনই প্রাধান্য পায় না। প্রাধান্য পায় নীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে দায়বদ্ধতা ইত্যাদি। কিন্তু মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্পের উত্থান এবং দ্বিতীয়বার পুনর্নির্বাচনে বিজয়ী হতে তার নানা কৌশল ছিল গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এটা মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে নষ্ট করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কখনো ‘ব্যক্তি’ কোনো বড় ভূমিকা পালন করে না। পালন করে দলীয় নীতি। কিন্তু এবার দেখা গেল নীতির চেয়ে ‘ব্যক্তি ট্রাম্প’ গুরুত্ব পেয়েছিলেন বেশি। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আচরণ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ইমেজ প্রাধান্য পেয়েছিল বেশি। এ ক্ষেত্রে রিপাবলিকান দলের নীতি ও আদর্শ স্থান পেয়েছিল কম। ব্যক্তি ট্রাম্প রিপাবলিকান নীতি, আদর্শ ও স্ট্র্যাটেজির ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সর্বত্র। মার্কিন সমাজে যে এখনো জাতিগত বিদ্বেষ রয়েছে, শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসি যে এখনো একটি ফ্যাক্টর, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা আবারও প্রমাণিত। এত দিন এই মানসিকতা ‘চাপা’ পড়েছিল। এটা ছিল অনেকটা ‘ছাইচাপা দেওয়া আগুন’। ট্রাম্প তা উসকে দিয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল রাইটস মুভমেন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন ড. মার্টিন লুথার কিং। ১৯৬৮ সালে আততায়ীর হাতে তার মৃত্যুর পর সেখানে জাতিগত বিদ্বেষ অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু ট্রাম্পের জমানায় এই বিদ্বেষ বেড়ে যায়। আমরা পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখেছি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জমানায় উগ্র শ্বেতাঙ্গগোষ্ঠী যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে, অতীতে তেমন শক্তিশালী তারা ছিল না। Ku klux Klan (গঠিত ১৮৬৫) এর পর থেকে এখন অব্দি প্রায় ১০০টি শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এ তথ্যটি আমাদের দিয়েছে সাউদার্ন পোভার্টি ল সেন্টার (২০১৭)। এর বাইরে ৯৯টি ‘নিউ নাজি গ্রুপ’ তৎপর রয়েছে সেখানে। এই সব উগ্র গোষ্ঠী নাজি মতাদর্শে বিশ্বাসী। ট্রাম্পের জমানায় এরা শক্তিশালী হয়েছে।
এখন কতটুকু বদলাতে পারবেন জো বাইডেন? নির্বাচনে বিজয়ের পর তিনি তার নিজ রাজ্য দেলওয়্যারে উইলমিংটনে শত শত সমর্থকের উদ্দেশে যে ভাষণ দেন, তার গুরুত্বও কম নয়। সেখানে চারটি বিষয়কে তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। করোনাভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া, অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, জাতিগত বিদ্বেষ কমিয়ে আনা ও জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। করোনাভাইরাস কভিড-১৯ যে মার্কিন সমাজে বড় ধরনের ক্ষতি করেছে, তা ট্রাম্প কখনই স্বীকার করেননি। কিন্তু জো বাইডেন তা শুধু স্বীকারই করেননি; বরং তার অগ্রাধিকারের তালিকায় প্রথমেই রেখেছেন। তিনি ইতিমধ্যে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করেছেন। জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই যে কভিড-১৯ মোকাবিলায় বড় কর্মসূচি হাতে নিতে যাচ্ছেন, তা তিনি স্পষ্ট করেছেন। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতা ছিল চোখে লাগার মতো। এটা যে একটা মহামারী, তা ট্রাম্প বিশ্বাস করতেন না। এমনকি তিনি কোনো নিয়মকানুন মানতেন না। মাস্ক ব্যবহার করতেন না। বিজ্ঞানকে তিনি অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছিলেন। কভিড-১৯-এ যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে। ৮ নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে কভিড-১৯-এ আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১০১৮২৮১৮ জন। আর মৃত্যুর সংখ্যা ১২৫৬১২৩ জন। নতুন করে করোনাভাইরাসের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সেখানে আঘাত হেনেছে। মৃত্যুর সংখ্যাও সেখানে আবার বাড়ছে। করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের ব্যর্থতাই জো বাইডেনকে ক্ষমতায় বসাতে যাচ্ছে। সুতরাং কভিড-১৯ মোকাবিলায় জো বাইডেন যে বড় কর্মসূচি নেবেন, এটাই প্রত্যাশিত। প্রথমেই তিনি একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেছেন।
অর্থনীতিকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। এটাই স্বাভাবিক। কভিড-১৯ বিশ্ব অর্থনীতিতে আঘাত করেছে, তার ঢেউ এসে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্রেও। একটি মহামন্দার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। বিংশ শতাব্দীর ত্রিশের দশকের মহামন্দার (Great Depression) কথা অনেকেই জানেন। ১৯২৬ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেটের পতনের পর পরই এই মহামন্দার সূত্রপাত হয়েছিল। ১৯৩৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৫ মিলিয়ন অর্থাৎ দেড় কোটি মানুষ বেকার হয়ে গিয়েছিল। কভিড-১৯ এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। শত শত মানুষ চাকরি হারিয়েছে। বেকারত্বের হার শতকরা ১৫ ভাগে থাকলেও, এখন তা নেমে এসেছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশে। শেয়ারবাজারের নিম্নগতি এখনো লক্ষণীয়। দারিদ্র্যের গড় হার ১০ দশমিক ৫ শতাংশ (কৃষ্ণাঙ্গ ১৮ দশমিক ৮, শ্বেতাঙ্গ ৭ দশমিক ৫)। গড় প্রবৃদ্ধি ২ দশমিক ৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রে ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। সেপ্টেম্বর (২০২০) পর্যন্ত এর পরিমাণ ২৬ দশমিক ৯৫ ট্রিলিয়ন ডলার। জাপান ও চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ১ দশমিক ২৯ ট্রিলিয়ন ও ১ দশমিক ০৭ ট্রিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বড় অর্থনীতি, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এই অর্থনীতি এখন ঝুঁকির মুখে। ফলে অর্থনীতি একটি বড় সেক্টর, যেখানে জো বাইডেনকে হাত দিতে হবে। আশার কথা, অর্থনীতিকে তিনি অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন এই শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত একটি বিষয়। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাগর-মহাসাগরের পানির উচ্চতা বাড়ছে মরু অঞ্চলের বরফ গলে যাওয়ায়। জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। এটা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটা বিশ্বাস করতেন না। বিশ্বের উষ্ণতা রোধকল্পে প্যারিস কপ-২১ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল ২০১৫ সালে। তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিল। পরে ২০১৫ সালের ২২ এপ্রিল জাতিসংঘের সদর দপ্তরে কপ-২১ চুক্তিটি অনুমোদিত হয়েছিল। ১৭০টি দেশ ওই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে তা আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত করেছিল। অথচ ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। কপ-২১-এ বিশ্বের ১৯৫টি দেশ রাজি হয়েছিল ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখবে। জো বাইডেন বলেছেন, তিনি কপ-২১ চুক্তিতে ফিরে যাবেন। এটি একটি ভালো সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে বিকল্প জ্বালানি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন বাইডেন, যা কিনা বিশ্বে তার অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে পশ্চিম ইউরোপ তথা ন্যাটোভুক্ত দেশ ও মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল। তিনি জার্মানি থেকে সেনা প্রত্যাহার করার কথা বলেছেন। ন্যাটোর দেশগুলোকে ন্যাটোতে দেওয়া অনুদানের পরিমাণ বাড়ানোর কথা বলেছেন। তার মুসলমানবিদ্বেষের কারণে কয়েকটি মুসলমান দেশের নাগরিকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাতায়াত নিষিদ্ধ করেছেন। ইরানের সঙ্গে ৬ জাতি সমঝোতা থেকে ট্রাম্প বেরিয়ে গেছেন। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণিক ঝুঁকি কমেনি; বরং বেড়েছে। তার প্রো-ইসরায়েলিনীতি ফিলিস্তিনি সংকটকে আরও গভীরে নিয়ে গিয়েছিল। ফিলিস্তিন সংকট সমাধানের ব্যাপারে ট্রাম্প প্রশাসন কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নিতে পারেনি।
মোদ্দাকথা, ট্রাম্প গেল চার বছরে বিশ্বকে স্থিতিশীলতার চেয়ে আরও বেশি অস্থিতিশীল করে তুলেছিলেন। চীনের সঙ্গে একধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করে তিনি বিশ্বে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দিয়েছিলেন। QUAD-কে সক্রিয় করে ও ইন্দো- প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বাড়াতে ভারতের সঙ্গে একধরনের সামরিক অ্যালায়েন্সে গিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। অনেক পর্যবেক্ষকের ধারণা, চীনকে দুর্বল করতেই ট্রাম্প প্রশাসন এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এতে করে বিশ্বে জন্ম হয়েছিল একধরনের উত্তেজনার। কভিড-১৯-এর কারণে যেখানে চীন-যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সেখানে ট্রাম্প ‘চীনা ভাইরাস’ তথা চীনবিরোধী বক্তব্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতিকেই সামনে নিয়ে এসেছিলেন।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে একরকম বিচ্ছিন্ন করে একাকী চলতে চেষ্টা করেছিলেন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা থেকে সদস্যপদ প্রত্যাহার, এই সংস্থায় চাঁদা দিতে অস্বীকার করা, কভিড-১৯ মোকাবিলায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থাকে আর্থিক দিক দিয়ে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করা, ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ চুক্তি (টিপিপি) থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেওয়া, এমনকি ২০১৭ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই ইউনেসকোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা সবকিছুই প্রমাণ করে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আসরে নেতৃত্ব দেওয়ার যে সক্ষমতা, তা হারিয়েছিল। ফলে জো বাইডেন কতটুকু আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারবেন, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে তার ভূমিকা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে কমলা হ্যারিসকে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও তার ‘রানিংমেট’ হিসেবে নির্বাচিত করায় এবং বিজয়ী ভাষণে তার নাম উচ্চারণ ও দক্ষিণ এশিয়ার কথা উল্লেখ করায় বাইডেনের মেসেজটি স্পষ্ট তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে কমলা হ্যারিস একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ একটা পরিবর্তন চেয়েছিল। সেই পরিবর্তনটি সম্পন্ন হয়েছে। নয়া প্রশাসন ২০২১ সালে দায়িত্ব নিয়ে বিশ^ আসরে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কতটুকু উদ্ধার করতে পারবে, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন।
Desh Rupsntor
09.11.2020
আইনি জটিলতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন
07:16
No comments
যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা-ই হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল শেষ পর্যন্ত আইনি জটিলতায় জড়িয়ে গেল। ৩ নভেম্বর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এ লেখা যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। তবে শনিবার পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, তাতে নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে এগিয়ে আছেন ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী জো বাইডেন। তিনি পেয়েছেন ২৬৪টি ভোট, অন্যদিকে ট্রাম্পের পক্ষে রয়েছে ২১৪টি ভোট। দরকার ২৭০টি ভোট। বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনা এখনও চলছে। আর এখানেই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে। পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, নেভাদা ও অ্যারিজোনায় শনিবার পর্যন্ত ভোট গণনা চলছিল।
তবে এই ভোট গণনা এখন আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া ও মিশিগানে ভোট গণনার প্রশ্নটি এখন আদালতে গড়িয়েছে। ট্রাম্প শিবিরের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে যে, নির্ধারিত সময়ের পরে যেসব ভোট এসেছে, অর্থাৎ ব্যালট ভোটে প্রদত্ত ভোট নির্ধারিত সময়ের পরে ভোট গণনাকেন্দ্রে আসায় তা গ্রহণ করা যাবে না। ট্রাম্প শিবিরের পক্ষ থেকে ‘ভুয়া’ ও ‘জাল ভোটের’ অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যের বিচারকরা তা নাকচ করে দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো রাজ্যে (পেনসিলভানিয়া) সুপ্রিমকোর্ট নির্ধারিত সময়ের পরে আসা ভোট আলাদা করে গণনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। জো বাইডেন ও ট্রাম্প উভয়ের জন্য পেনসিলভানিয়ায় বিজয়ী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে রয়েছে ২০ নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট। শনিবার পর্যন্ত ভোট গণনায় এখানে এগিয়ে আছেন জো বাইডেন। কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে আছেন ট্রাম্প। বাইডেন যদি এই অঙ্গরাজ্যে বিজয়ী হন, হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পথ তার নিশ্চিত হবে। আর ট্রাম্প যদি ‘বিজয়ী’ হন, তাহলে তিনি প্রতিযোগিতায় আরও এগিয়ে যাবেন। অ্যারিজোনা, নেভাদা, জর্জিয়া ও মিশিগান রাজ্যের ভোটাভুটিতে এগিয়ে আছেন জো বাইডেন। বিশ্লেষকরা জো বাইডেনকে সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তবে আইনি বিষয় জড়িত থাকায় ফলাফল পেতে আমাদের আরও ক’দিন অপেক্ষা করতে হবে।
ট্রাম্প এর আগে দাবি করেছিলেন, নির্বাচনের দিনে রাতের মধ্যে সব ভোট গণনা করতে হবে (Huffpost, ২৮ অক্টোবর)। অথচ ফেডারেল আইন অনুযায়ী বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকরা আগাম ভোট দিতে পারবেন, যা পরে গণনা করা হবে। ইতোমধ্যে ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ রাজ্যগুলোতে ৩১.১ মিলিয়ন ভোটার তাদের আগাম ভোট প্রদান করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সেনাসদস্য ও কূটনৈতিক কোরের সদস্য বিদেশে অবস্থান করছেন এবং সেখানে অবস্থান করে তারা ভোট দিয়েছেন। এ নিয়ে একটা ‘জটিলতা’ তৈরি হলেও হতে পারে। কারণ যে মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে, তার কোনো একটিতে যদি রায় আগাম ভোটের বিপক্ষে যায়, তখন চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে। বিষয়টি সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। আর এখানেই ট্রাম্পের প্লাস পয়েন্ট। সর্বশেষ তিনি বিচারপতি অ্যামি কনি ব্যারেটকে সুপ্রিমকোর্টে মনোনয়ন দিয়েছেন। সিনেট তার মনোনয়ন ‘কনফার্ম’ করায় বিচারপতি ব্যারেট শপথও নিয়েছেন। ৯ সদস্যবিশিষ্ট সুপ্রিমকোর্টে রিপাবলিকান মতাদর্শী ও বিশ্বাসী বিচারপতির সংখ্যা ৬। পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচন প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্ট এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন যা ট্রাম্পের পক্ষে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ অতীতে কখনই এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘নানা কাহিনী’ একদিকে তাকে যেমন বিতর্কিত করেছে, তেমনি নির্বাচন নিয়ে তার ‘ভূমিকা’ও করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। গত ১ অক্টোবর এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প যখন বলেন, পোস্টাল ব্যালটে জালিয়াতি হতে পারে, তখন থেকেই গুজবের ডালপালা গজাচ্ছে। তার ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে মিডিয়া প্রশ্ন তুলেছিল তখন। ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে একটা আশঙ্কার জায়গা থাকলই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভোট দেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। সিনেট ও প্রতিনিধিসভার সদস্যদের সমন্বয়ে এ নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়। প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা আলাদা আলাদা। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া আর নেভাদা রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা আলাদা। কোনো রাজ্যে বেশি, কোনো রাজ্যে কম। পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট ২০টি, আবার ডেলাওয়ারে মাত্র ৩টি। সবচেয়ে বেশি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট ক্যালিফোনিয়ায়- ৫৪টি, নিউইয়র্কে ৩৩টি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনো প্রার্থী কোনো রাজ্যে বিজয়ী হলে সে রাজ্যে যে ক’টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট রয়েছে, তার পুরোটা তিনি পেয়েছেন বলে গণ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে যে প্রার্থী হেরে যান, তিনি নির্বাচকমণ্ডলীর কোনো ভোট পান না। নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। জিততে হলে পেতে হবে ২৭০টি ভোট। নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে।
কিন্তু এরই মাঝে নির্বাচনের ফলাফল কিংবা খোদ নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে। আমরা দেখেছি ট্রাম্প সমর্থকরা হাতে রাইফেল নিয়ে ঘুরছেন। ভোট গণনাকেন্দ্র আক্রমণ করেছেন। এমনকি কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার বলে চলেছেন, ‘ভোট কারচুপি’ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন উন্নয়নশীল বিশ্বের ‘ভোট কারচুপি’ নিয়ে কথা বলে, যখন গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র চর্চা আজ প্রশ্নের মুখে। ট্রাম্পের মিথ্যাচার আজ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র চর্চাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, এই নির্বাচন অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। এক. এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুরো মার্কিন সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বিভক্তিকে উসকে দিয়েছেন। অতীতে কোনো নির্বাচনেই মার্কিন সমাজ এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েনি। এই বিভক্তি যতটা না পার্টি লাইনে, তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিনির্ভর। একদিকে ট্রাম্প, অন্যদিকে বাকিরা- এভাবেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমাজ। দুই. এই নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জন্ম হয়েছে। পুরো ফলাফল ঘোষণা করার আগেই কোথাও কোথাও ভোট গণনাকেন্দ্রে হামলা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাম্প সমর্থকরা হামলা চালিয়েছেন। এ ধরনের হামলা অতীতে কোনো নির্বাচনের পর দেখা যায়নি। তিন. এই নির্বাচন এবং নির্বাচনের ফলাফল মানতে অনীহা ও ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করা মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি কখনই প্রাধান্য পায় না। প্রাধান্য পায় নীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে দায়বদ্ধতা ইত্যাদি। কিন্তু মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্পের উত্থান এবং দ্বিতীয়বার পুনর্নির্বাচনে বিজয়ী হতে তার নানা কৌশল গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এটা মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে নষ্ট করেছে। চার. মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কখনও ‘ব্যক্তি’ কোনো বড় ভূমিকা পালন করে না। পালন করে দলীয় নীতি। কিন্তু এবার দেখা গেল নীতির চেয়ে ‘ব্যক্তি ট্রাম্প’ গুরুত্ব পেয়েছেন বেশি। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আচরণ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ইমেজ প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এ ক্ষেত্রে রিপাবলিকান দলের নীতি ও আদর্শ স্থান পেয়েছে বেশি। ব্যক্তি ট্রাম্প রিপাবলিকান নীতি, আদর্শ ও স্ট্র্যাটেজির ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সর্বত্র। পাঁচ. মার্কিন সমাজে যে এখনও জাতিগত বিদ্বেষ রয়েছে, শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসি যে এখনও একটি ফ্যাক্টর, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা আবারও প্রমাণিত হল। এতদিন এই মানসিকতা ‘চাপা’ পড়ে ছিল। এটা ছিল অনেকটা ‘ছাই চাপা দেয়া আগুন’। ট্রাম্প তা উসকে দিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল রাইটস ম্যুভমেন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন ড. মার্টিন লুথার কিং। ১৯৬৮ সালে আততায়ীর হাতে তার মৃত্যুর পর সেখানে জাতিগত বিদ্বেষ অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু ট্রাম্পের জমানায় এই বিদ্বেষ বেড়ে যায়। আমরা পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখেছি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জমানায় উগ্র শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠী যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে, অতীতে তেমন শক্তিশালী তারা ছিল না। Ku Klux Klan (১৮৬৫ সালে গঠিত)-এর পর থেকে এখন অবধি প্রায় ১০০টি শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই তথ্যটি আমাদের দিয়েছে Southern Poverty Law Center (২০১৭)। এর বাইরে ৯৯টি ‘নিউ নাজি গ্রুপ’ তৎপর রয়েছে। এসব উগ্র গোষ্ঠী নাজি মতাদর্শে বিশ্বাসী। ট্রাম্পের জমানায় এরা শক্তিশালী হয়েছে।
বিজয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জো বাইডেন ‘ঐক্যবদ্ধ আমেরিকার’ কথা বলেছেন। ধৈর্য ধারণের কথা বলছেন। তবে ফলাফলের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে যাওয়ায় চূড়ান্ত ফলাফল পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচরণ পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য তা কোনো ভালো খবর নয়। ইতোমধ্যে ফিলাডেলফিয়ার মেয়র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ফলাফল মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জিমি কার্টার ও আল-গোরের দৃষ্টান্ত টেনেছেন। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার (৩৯তম প্রেসিডেন্ট, ১৯৭৭-১৯৮১) রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে হেরে গিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সিনিয়র জর্জ বুশ (১৯৮৯-১৯৯৩) বিল ক্লিনটনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। আর জুনিয়র বুশের কাছে আল গোর ফ্লোরিডার ভোটে হেরে গিয়ে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প কি তা করবেন? রিপাবলিকানরা ৬০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সংগ্রহ করেছেন শুধু আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এর অর্থ হচ্ছে, ট্রাম্প সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যাবেন। অন্যদিকে জো বাইডেন বলেছেন, তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ট্রাম্প-বাইডেন লড়াই আমাদের আরও কিছুদিন দেখতে হবে। নির্বাচনের ফলাফলের এই লড়াই যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয়।
Jugantor
8.11.2020
Subscribe to:
Posts (Atom)