রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সু চির বিজয় ও রোহিঙ্গা সমস্যার ভবিষ্যৎ

মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে আবারও জয় পেয়েছে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি। মিয়ানমারের পার্লামেন্ট দুই কক্ষের। উচ্চকক্ষ (Amyotha Hluttaw) ২২৪ সদস্যের, আর নিম্নকক্ষ (Pyithu Hluttaw) ৪৪০ সদস্যের। উভয় কক্ষেই সেনাবাহিনীর জন্য আসন সংরক্ষিত। উচ্চকক্ষে ৫৬ আসন ও নিম্নকক্ষে ১১০টি আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত। ফলে নিম্নকক্ষের সব আসনে নির্বাচন হয় না। মোট ৩৩০টি আসনে নির্বাচন হয় এবং বাকি আসনগুলো সেনাবাহিনী প্রধান কর্তৃক মনোনীত। উচ্চকক্ষেও সব আসনে নির্বাচন হয় না। ২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে এনএলডি নিম্নকক্ষে ২৫৫ আসন পেয়ে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছিল। এবার সর্বশেষ প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী উভয় কক্ষের ৬৬৪ আসনের মধ্যে এনএলডি ৩৪৬ (ঘোষিত ৪১৮ আসনের মধ্যে) আসন পেয়েছে। ফলে নিশ্চিত করেই বলা যায় অং সান সু চির দল এনএলডি’ই মিয়ানমারে সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। তবে এই নির্বাচন মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের যেমন কোনো সমাধান দেবে না, ঠিক তেমনি বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার জন্যও কোনো সুসংবাদ বয়ে আনবে না। অস্ট্রেলিয়ার Lowy Institute-এর বুলেটিন The Interpreter-এর এক প্রতিবেদনে (১২ অক্টোবর ২০২০) বলা হয়েছিল : মিয়ানমারের এই নির্বাচন free, fair and safe’ হবে না। অর্থাৎ নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা আগে থেকেই ছিল। এটি শান্তিপূর্ণ, স্বাধীন ও অবাধ হয়নি। ইতিমধ্যে সেখানে ২৭,৯০০ লোক কভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছে, যা থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি। এখন নির্বাচনের কারণে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ৫ অক্টোবর এক বিবৃতিতে জানিয়েছিল, এই নির্বাচন হতে যাচ্ছে একটি ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। এই নির্বাচনে রাখাইনের অধিবাসী রোহিঙ্গাদের ভোট প্রদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। মিয়ানমারের নির্বাচনী আইনের ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও প্রার্থিতার ক্ষেত্রে প্রার্থীকে মিয়ানমারের নাগরিক হতে হবে। ২০১০ সালের Political Parties Registration Law পরে ২০১৪ সালে পরিবর্তন করা হয়। যাতে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থীকে কোনো দলে যোগ দিতে হলে অথবা নির্বাচনে অংশ নিতে হলে তাকে ‘পূর্ণ’ নাগরিক হতে হবে। এই ‘পূর্ণ’ নাগরিকের বিষয়টি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য প্রযোজ্য। এরা পূর্ণ নাগরিক নন। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে তৎকালীন সামরিক সরকার যে White Card ইস্যু করে, তাতে করে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গাকে তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ফলে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের অংশগ্রহণে কোনো নির্বাচন এবার অনুষ্ঠিত হয়নি। মুসলমান রোহিঙ্গারা এবার নির্বাচনে অংশ নিতে পারেনি। মিয়ানমার সরকার রাখাইন ও চিন স্টেটে ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল। ফলে ভোটারদের সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালের ২১ জুন সরকার রাখাইন স্টেটের আটটি টাউনশিপে ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যাপারে বিধিনিষেধ আরোপ করে। এই বিধিনিষেধ এখনো বহাল রয়েছে। ফলে মানুষ নির্বাচন-সংক্রান্ত তথ্য জানতে পারেনি। কভিড-১৯-এর কারণে কোনো নির্বাচনী প্রচারণাও হয়নি। ফলে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা একটি বড় প্রশ্নের মুখে পড়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও সশস্ত্র আন্দোলন আন্তর্জাতিক সংবাদ হয়ে আসছে। সাম্প্রতিককালে রাখাইন ও চিন স্টেটে আরাকান আর্মির সশস্ত্র তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে এই দুই স্টেটে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। একই কথা প্রযোজ্য কাচিন, কারেন ও শান স্টেটের ক্ষেত্রেও। সশস্ত্র সংঘর্ষের কারণে এখানে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার পরিবেশ ছিল না। স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল Wa state-এর অবস্থাও ছিল তেমনি। ফলে নামেমাত্র একটি নির্বাচন হয়েছে বটে। কিন্তু তাতে অংশগ্রহণ ব্যাপক ছিল না। সরকার তথা সেনাবাহিনীবিরোধী বক্তব্যের জন্য অনেক বিরোধীদলীয় প্রার্থী তথা সমর্থককে পেনাল কোডের ৫০৫(বি) ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। ফলে যারাই অং সান সু চি সরকারের বিরোধিতা করেছেন, তাদের স্থান এখন জেলে। নির্বাচন কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোকে জাতীয় সম্প্রচার মাধ্যম টিভি ও বেতারে তাদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু তাদের বক্তব্য আগে নির্বাচন কমিশন থেকে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়েছিল। ফলে দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছিল, যা ছিল মুক্ত চিন্তার পরিপন্থী। আর ক্ষমতাসীন এনএলডি সরকার রাষ্ট্রীয় মিডিয়াকে ব্যবহার করেছিল, অন্যরা সেই সুযোগ পায়নি।Democratic Party for a New Society, National Democratic Force Party, Peoples Party-এর পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছিল যে, তারা সম-সুযোগ পাচ্ছে না। মিয়ানমারের সংবিধানই একটি সর্বজন গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে প্রধান অন্তরায়। এটি অগণতান্ত্রিকও ঘটে। শুধু ৭৫ ভাগ আসন পূর্ণ হয় গণতান্ত্রিকভাবে, বাকি আসন শুধু মনোনয়ন। এতে করে সেনাবাহিনীর অলিখিত কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে, যা গণতান্ত্রিক চরিত্রের সঙ্গে বেমানান। ২০০৮ সালে এই সংবিধান গ্রহণ করা হয়। এই সংবিধানের আলোকেই ২০১৫ সালে সাধারণ নির্বাচন হয়েছিল। সংবিধানে এমন সব শর্ত যুক্ত করা হয়েছে, যাতে অং সান সু চি কোনো দিনই প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। শর্তে বলা হয়েছে ‘মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টের স্বামী বা স্ত্রী বিদেশি নাগরিক হতে পারবেন না। তার সন্তানরা যদি বিদেশি নাগরিক হন, তাহলে তিনি প্রেসিডেন্ট পদের জন্য অনুপযুক্ত বলে বিবেচিত হবেন।’ এই শর্তের কারণে সু চি কোনো দিনই প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। কেননা তার প্রয়াত স্বামী ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক। তার দুই সন্তানও বিদেশি নাগরিক। সু চি এই শর্ত মেনেই নির্বাচনে গিয়েছিলেন এবং সংবিধান সংশোধনের দাবি বিভিন্ন মহল থেকে উঠলেও, সেনাবাহিনীর সমর্থন এতে পাওয়া যায়নি। এবার নির্বাচনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকা এবং ব্যাপকসংখ্যক জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগ এই নির্বাচনকে অর্থহীন করেছে। সীমিত কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা সেখানে থাকলেও তাদের ভোট দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। রাখাইনে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ভোট দিতে পেরেছেন। ফলে এই নির্বাচন মিয়ানমারের জন্য আদৌ কোনো ভালো সংবাদ বয়ে আনবে না। কয়েক বছর ধরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে অং সান সু চির একটি অলিখিত আঁতাত গড়ে উঠেছে। এই আঁতাতের কারণেই তিনি ক্ষমতায় আছেন। শুধু তা-ই নয় হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে অত্যন্ত নগ্নভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যায় সেনাবাহিনীর পক্ষে সাফাই গাইছেন। ফলে অং সান সু চির দলের পুনরায় ক্ষমতায় আসা ছিল একটি ওপেন সিক্রেট। সবাই এটা জানত। সেনাবাহিনী সমর্থিত একটি দল আছে বটে। কিন্তু তাদের পক্ষে ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা ছিল না। আগামীতেও নেই। সেনাবাহিনী চাইবে সু চি ক্ষমতায় থাকুক। কিন্তু তাতে করে মিয়ানমারের মূল সমস্যার কোনো সমাধান হবে না। মূল সমস্যা মূলত দুটি। এক. মিয়ানমারের জাতিগত দ্বন্দ্বের একটা সমাধান। জাতিগতভাবে বিভক্ত মিয়ানমারের সশস্ত্র তথা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ইতিহাস অনেক পুরনো। গেল পাঁচ বছর অং সান সু চি এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেননি এবং এর কোনো সমাধানও করেননি। ফলে আগামী পাঁচ বছর তার দল ক্ষমতায় থাকলেও তাকে স্টেট কাউন্সিলরের পদ নিয়েই খুশি থাকতে হবে। তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারবেন না। সংবিধানে সংশোধনীও আনতে পারবেন না। আর জাতিগত দ্বন্দ্বেরও কোনো সমাধান দিতে পারবেন না। দুই. প্রায় ১১ লাখ মিয়ানমারের নাগরিক (রোহিঙ্গা) এখন বাংলাদেশে বাস করে। এদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তার কোনো লক্ষণীয় উদ্যোগও নেই। নির্বাচিত হলেও আগামী পাঁচ বছর তার কোনো উদ্যোগ থাকবে না। জনগোষ্ঠীর একটা অংশকে বাইরে রেখে যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফিরে আসবে না। যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষার জন্য অং সান সু চি বিশ^ব্যাপী একসময় প্রশংসিত হয়েছিলেন এবং নোবেল শান্তি পুরস্কারও পেয়েছিলেন, তিনি আজ গণতান্ত্রিক বিশে^ একজন ঘৃণিত ব্যক্তি। তার শাসনামলেই তিনি জাতিগত দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়েছিলেন। শুধু সেনাবাহিনীর স্বার্থেই যে তিনি কাজ করেছেন, তেমনটি নয়। বরং সংখ্যাগুরু ‘বামার’দের তথা উগ্র বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের স্বার্থে জাতিগত নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছেন। মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এ বিষয়টিকে তিনি কখনোই গুরুত্ব দেননি। তাই নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদক হান্নাহ বেক যখন লেখেন, Her strongest critics accuse her, As a member of the Bamar ethnic majority, of racism and an unwillingness to fight for the hunman rights of all people in Myanmar’, তখন তিনি মিথ্যা বলেন না। নিজ ক্ষমতার স্বার্থে জাতিগত দ্বন্দ্ব ও মিয়ানমারে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি তার কাছে মুখ্য নয়। মুখ্য হচ্ছে ক্ষমতায় থাকা। এজন্যই আন্তর্জাতিকভাবে রোহিঙ্গা গণহত্যার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করা হলেও তিনি নিজে সেনাবাহিনীকে সমর্থন করে যাচ্ছেন বারবার। উগ্র বৌদ্ধরা (পাঠক বার্মিজ বিন লাদেন হিসেবে পরিচিত ভিথারুর কথা স্মরণ করতে পারেন) তাকে শুধু সমর্থনই করছে না, বরং রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে উচ্ছেদ করার উদ্যোগকেও সমর্থন করছে। হান্নাহ বেক তার প্রতিবেদনে কাচিন প্রদেশের একজন রাজনীতিবিদ সেং নু পানের (Seng Nu Pan) উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে, ‘Now that she has tasted power, don’t think she wants to share it with anyone’ (তার প্রতিবেদন How a Human Rights Angel Lost her Halo, Nov. 14, 2020)। এটাই হচ্ছে আসল কথা। সু চি কাউকে ক্ষমতার ভাগ দিতে চাচ্ছেন না। যেখানে জাতিগত ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা বেশি, সেখানে জাতিগত দ্বন্দ্বের অবসানে কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না। তাই আগামী পাঁচ বছরে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই Desh Rupantor 17.11.2020

1 comments: