রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আইনি জটিলতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা-ই হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল শেষ পর্যন্ত আইনি জটিলতায় জড়িয়ে গেল। ৩ নভেম্বর সেখানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও এ লেখা যখন লিখছি, তখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না কে হতে যাচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। তবে শনিবার পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, তাতে নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে এগিয়ে আছেন ডেমোক্র্যাটদলীয় প্রার্থী জো বাইডেন। তিনি পেয়েছেন ২৬৪টি ভোট, অন্যদিকে ট্রাম্পের পক্ষে রয়েছে ২১৪টি ভোট। দরকার ২৭০টি ভোট। বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে ভোট গণনা এখনও চলছে। আর এখানেই সমস্যাটা তৈরি হয়েছে। পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া, নেভাদা ও অ্যারিজোনায় শনিবার পর্যন্ত ভোট গণনা চলছিল। তবে এই ভোট গণনা এখন আইনি লড়াইয়ে জড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে পেনসিলভানিয়া, জর্জিয়া ও মিশিগানে ভোট গণনার প্রশ্নটি এখন আদালতে গড়িয়েছে। ট্রাম্প শিবিরের পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে যে, নির্ধারিত সময়ের পরে যেসব ভোট এসেছে, অর্থাৎ ব্যালট ভোটে প্রদত্ত ভোট নির্ধারিত সময়ের পরে ভোট গণনাকেন্দ্রে আসায় তা গ্রহণ করা যাবে না। ট্রাম্প শিবিরের পক্ষ থেকে ‘ভুয়া’ ও ‘জাল ভোটের’ অভিযোগ উত্থাপন করা হলেও কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যের বিচারকরা তা নাকচ করে দিয়েছেন। আবার কোনো কোনো রাজ্যে (পেনসিলভানিয়া) সুপ্রিমকোর্ট নির্ধারিত সময়ের পরে আসা ভোট আলাদা করে গণনা করার নির্দেশ দিয়েছেন। জো বাইডেন ও ট্রাম্প উভয়ের জন্য পেনসিলভানিয়ায় বিজয়ী হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে রয়েছে ২০ নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট। শনিবার পর্যন্ত ভোট গণনায় এখানে এগিয়ে আছেন জো বাইডেন। কয়েক হাজার ভোটের ব্যবধানে পিছিয়ে আছেন ট্রাম্প। বাইডেন যদি এই অঙ্গরাজ্যে বিজয়ী হন, হোয়াইট হাউসে যাওয়ার পথ তার নিশ্চিত হবে। আর ট্রাম্প যদি ‘বিজয়ী’ হন, তাহলে তিনি প্রতিযোগিতায় আরও এগিয়ে যাবেন। অ্যারিজোনা, নেভাদা, জর্জিয়া ও মিশিগান রাজ্যের ভোটাভুটিতে এগিয়ে আছেন জো বাইডেন। বিশ্লেষকরা জো বাইডেনকে সম্ভাব্য বিজয়ী হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তবে আইনি বিষয় জড়িত থাকায় ফলাফল পেতে আমাদের আরও ক’দিন অপেক্ষা করতে হবে। ট্রাম্প এর আগে দাবি করেছিলেন, নির্বাচনের দিনে রাতের মধ্যে সব ভোট গণনা করতে হবে (Huffpost, ২৮ অক্টোবর)। অথচ ফেডারেল আইন অনুযায়ী বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকরা আগাম ভোট দিতে পারবেন, যা পরে গণনা করা হবে। ইতোমধ্যে ‘ব্যাটেল গ্রাউন্ড’ রাজ্যগুলোতে ৩১.১ মিলিয়ন ভোটার তাদের আগাম ভোট প্রদান করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সেনাসদস্য ও কূটনৈতিক কোরের সদস্য বিদেশে অবস্থান করছেন এবং সেখানে অবস্থান করে তারা ভোট দিয়েছেন। এ নিয়ে একটা ‘জটিলতা’ তৈরি হলেও হতে পারে। কারণ যে মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে, তার কোনো একটিতে যদি রায় আগাম ভোটের বিপক্ষে যায়, তখন চূড়ান্ত ফলাফল নিয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে। বিষয়টি সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে। আর এখানেই ট্রাম্পের প্লাস পয়েন্ট। সর্বশেষ তিনি বিচারপতি অ্যামি কনি ব্যারেটকে সুপ্রিমকোর্টে মনোনয়ন দিয়েছেন। সিনেট তার মনোনয়ন ‘কনফার্ম’ করায় বিচারপতি ব্যারেট শপথও নিয়েছেন। ৯ সদস্যবিশিষ্ট সুপ্রিমকোর্টে রিপাবলিকান মতাদর্শী ও বিশ্বাসী বিচারপতির সংখ্যা ৬। পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, নির্বাচন প্রশ্নে সুপ্রিমকোর্ট এমন সিদ্ধান্ত দিতে পারেন যা ট্রাম্পের পক্ষে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ অতীতে কখনই এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘নানা কাহিনী’ একদিকে তাকে যেমন বিতর্কিত করেছে, তেমনি নির্বাচন নিয়ে তার ‘ভূমিকা’ও করেছে প্রশ্নবিদ্ধ। গত ১ অক্টোবর এক টুইট বার্তায় ট্রাম্প যখন বলেন, পোস্টাল ব্যালটে জালিয়াতি হতে পারে, তখন থেকেই গুজবের ডালপালা গজাচ্ছে। তার ‘উদ্দেশ্য’ নিয়ে মিডিয়া প্রশ্ন তুলেছিল তখন। ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে একটা আশঙ্কার জায়গা থাকলই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সাধারণ মানুষ ভোট দেন বটে; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটে। সিনেট ও প্রতিনিধিসভার সদস্যদের সমন্বয়ে এ নির্বাচকমণ্ডলী গঠিত হয়। প্রতিটি রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা আলাদা আলাদা। যেমন ক্যালিফোর্নিয়া আর নেভাদা রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলীর সংখ্যা আলাদা। কোনো রাজ্যে বেশি, কোনো রাজ্যে কম। পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট ২০টি, আবার ডেলাওয়ারে মাত্র ৩টি। সবচেয়ে বেশি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট ক্যালিফোনিয়ায়- ৫৪টি, নিউইয়র্কে ৩৩টি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনো প্রার্থী কোনো রাজ্যে বিজয়ী হলে সে রাজ্যে যে ক’টি নির্বাচকমণ্ডলীর ভোট রয়েছে, তার পুরোটা তিনি পেয়েছেন বলে গণ্য করা হয়। এ ক্ষেত্রে যে প্রার্থী হেরে যান, তিনি নির্বাচকমণ্ডলীর কোনো ভোট পান না। নির্বাচকমণ্ডলীর ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। জিততে হলে পেতে হবে ২৭০টি ভোট। নয়া প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবেন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে। কিন্তু এরই মাঝে নির্বাচনের ফলাফল কিংবা খোদ নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে, তাতে বহির্বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তি যথেষ্ট ক্ষুণ্ন হয়েছে। আমরা দেখেছি ট্রাম্প সমর্থকরা হাতে রাইফেল নিয়ে ঘুরছেন। ভোট গণনাকেন্দ্র আক্রমণ করেছেন। এমনকি কোনোরকম প্রমাণ ছাড়াই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বারবার বলে চলেছেন, ‘ভোট কারচুপি’ হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন উন্নয়নশীল বিশ্বের ‘ভোট কারচুপি’ নিয়ে কথা বলে, যখন গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্র চর্চা আজ প্রশ্নের মুখে। ট্রাম্পের মিথ্যাচার আজ যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র চর্চাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, এই নির্বাচন অনেক প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছে। এক. এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পুরো মার্কিন সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়েছে। খোদ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এই বিভক্তিকে উসকে দিয়েছেন। অতীতে কোনো নির্বাচনেই মার্কিন সমাজ এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েনি। এই বিভক্তি যতটা না পার্টি লাইনে, তার চেয়ে বেশি ব্যক্তিনির্ভর। একদিকে ট্রাম্প, অন্যদিকে বাকিরা- এভাবেই বিভক্ত হয়ে পড়েছে সমাজ। দুই. এই নির্বাচনের ফলাফলকে কেন্দ্র করে সহিংসতার জন্ম হয়েছে। পুরো ফলাফল ঘোষণা করার আগেই কোথাও কোথাও ভোট গণনাকেন্দ্রে হামলা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ট্রাম্প সমর্থকরা হামলা চালিয়েছেন। এ ধরনের হামলা অতীতে কোনো নির্বাচনের পর দেখা যায়নি। তিন. এই নির্বাচন এবং নির্বাচনের ফলাফল মানতে অনীহা ও ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ করা মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে বেমানান। মার্কিন গণতান্ত্রিক সমাজে ব্যক্তি কখনই প্রাধান্য পায় না। প্রাধান্য পায় নীতি, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে দায়বদ্ধতা ইত্যাদি। কিন্তু মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্পের উত্থান এবং দ্বিতীয়বার পুনর্নির্বাচনে বিজয়ী হতে তার নানা কৌশল গণতন্ত্রের পরিপন্থী। এটা মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে নষ্ট করেছে। চার. মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কখনও ‘ব্যক্তি’ কোনো বড় ভূমিকা পালন করে না। পালন করে দলীয় নীতি। কিন্তু এবার দেখা গেল নীতির চেয়ে ‘ব্যক্তি ট্রাম্প’ গুরুত্ব পেয়েছেন বেশি। ট্রাম্পের ব্যক্তিগত আচরণ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ইমেজ প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এ ক্ষেত্রে রিপাবলিকান দলের নীতি ও আদর্শ স্থান পেয়েছে বেশি। ব্যক্তি ট্রাম্প রিপাবলিকান নীতি, আদর্শ ও স্ট্র্যাটেজির ঊর্ধ্বে উঠে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সর্বত্র। পাঁচ. মার্কিন সমাজে যে এখনও জাতিগত বিদ্বেষ রয়েছে, শ্বেতাঙ্গ সুপ্রিমেসি যে এখনও একটি ফ্যাক্টর, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তা আবারও প্রমাণিত হল। এতদিন এই মানসিকতা ‘চাপা’ পড়ে ছিল। এটা ছিল অনেকটা ‘ছাই চাপা দেয়া আগুন’। ট্রাম্প তা উসকে দিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল রাইটস ম্যুভমেন্টের অন্যতম নেতা ছিলেন ড. মার্টিন লুথার কিং। ১৯৬৮ সালে আততায়ীর হাতে তার মৃত্যুর পর সেখানে জাতিগত বিদ্বেষ অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু ট্রাম্পের জমানায় এই বিদ্বেষ বেড়ে যায়। আমরা পরিসংখ্যান ঘেঁটে দেখেছি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জমানায় উগ্র শ্বেতাঙ্গ গোষ্ঠী যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে, অতীতে তেমন শক্তিশালী তারা ছিল না। Ku Klux Klan (১৮৬৫ সালে গঠিত)-এর পর থেকে এখন অবধি প্রায় ১০০টি শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। এই তথ্যটি আমাদের দিয়েছে Southern Poverty Law Center (২০১৭)। এর বাইরে ৯৯টি ‘নিউ নাজি গ্রুপ’ তৎপর রয়েছে। এসব উগ্র গোষ্ঠী নাজি মতাদর্শে বিশ্বাসী। ট্রাম্পের জমানায় এরা শক্তিশালী হয়েছে। বিজয়ের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জো বাইডেন ‘ঐক্যবদ্ধ আমেরিকার’ কথা বলেছেন। ধৈর্য ধারণের কথা বলছেন। তবে ফলাফলের বিষয়টি আইনি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে যাওয়ায় চূড়ান্ত ফলাফল পেতে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে নিঃসন্দেহে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আচরণ পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য তা কোনো ভালো খবর নয়। ইতোমধ্যে ফিলাডেলফিয়ার মেয়র প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ফলাফল মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি জিমি কার্টার ও আল-গোরের দৃষ্টান্ত টেনেছেন। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার (৩৯তম প্রেসিডেন্ট, ১৯৭৭-১৯৮১) রোনাল্ড রিগ্যানের কাছে হেরে গিয়ে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়েছিলেন। সিনিয়র জর্জ বুশ (১৯৮৯-১৯৯৩) বিল ক্লিনটনের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। আর জুনিয়র বুশের কাছে আল গোর ফ্লোরিডার ভোটে হেরে গিয়ে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প কি তা করবেন? রিপাবলিকানরা ৬০ মিলিয়ন ডলার অর্থ সংগ্রহ করেছেন শুধু আইনি লড়াই চালিয়ে যাওয়ার জন্য। এর অর্থ হচ্ছে, ট্রাম্প সহজে হেরে যাওয়ার পাত্র নন। তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যাবেন। অন্যদিকে জো বাইডেন বলেছেন, তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে, ট্রাম্প-বাইডেন লড়াই আমাদের আরও কিছুদিন দেখতে হবে। নির্বাচনের ফলাফলের এই লড়াই যুক্তরাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে যায়, সেটাই দেখার বিষয়। Jugantor 8.11.2020

0 comments:

Post a Comment