কথা রাখলেন না মনমোহন সিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় (২০১০) সাংবাদিকরা যখন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন_ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। আমরা সেদিন আশ্বস্ত হয়েছিলাম। এমনকি গত ১১ জুলাই ভারতের নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের (নিপকো) ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রেমচাঁদ পঙ্কজ যখন ভারতের স্থানীয় সংবাদপত্রকে জানান, টিপাইমুখে বরাক নদীতে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই (আমার দেশ, ১২ জুলাই), তখনো আমরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাইনি। এমনকি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়নি। কিন্তু এখন? ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ_২২ অক্টোবর দিলি্লতে টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটি যৌথ বিনিয়োগে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কথা ছিল, ভারত যদি কিছু করে, তাহলে বাংলাদেশকে জানিয়েই করবে। অথচ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো, বাংলাদেশকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করল না ভারত। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভারতের জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগম এনএইচপিসি, রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ সংস্থা এসজেভিএন ও মণিপুর সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। যৌথ বিনিয়োগের এই প্রকল্পে এনএইচপিসির ৬৯ শতাংশ, এসজেভিএনের ২৬ শতাংশ আর মণিপুর সরকারের ৫ শতাংশ শেয়ার থাকবে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে ভারত শেষ পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেই। অথচ খোদ মণিপুর রাজ্যে এই বাঁধের বিরোধিতাকারীরা অত্যন্ত সক্রিয়। তারা দীর্ঘদিন ধরে সেখানে আন্দোলন করে আসছে। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষও এ ব্যাপারে সক্রিয়। বাংলাদেশেও অতীতে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে সমাবেশ হয়েছে, সেমিনার হয়েছে। মণিপুরের পরিবেশবাদীরাও ওই সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা বাংলাদেশি জনগণকে প্রতিবাদী হতেও আহ্বান জানিয়ে গেছেন। তবে এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালে বড় ধরনের অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ভারতকে রাজি করাতে পারেনি। দেখা গেছে, ভারত একতরফাভাবে অনেক কিছু আদায় করে নিয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ সে ক্ষেত্রে আদায় করতে পারেনি কিছুই। ভারতের এই ভূমিকা বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের নেতিবাচক ভূমিকাকে এখন সামনে নিয়ে এল।
উল্লেখ্য, ভারতের মণিপুর রাজ্যের চোরাচাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। এসজেভিএনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে ১৬২ দশমিক ৮০ মিটার উঁচু পাথরের বাঁধের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাঁচটি ইউনিট থাকবে, আর প্রতিটির ক্ষমতা হবে ২৫০ মেগাওয়াট। এতে বছরে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ২১১ কোটি টাকা। আর এটি শেষ হবে ৮৭ মাসে। বাঁধটির নির্মাণকাজ শেষ হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা বরাক নদী হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার মূল ধারা। সুরমা ও কুশিয়ারা পরে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে আমাদের বিশাল মেঘনা। বরাক নদী পাহাড় থেকে নেমেই সুরমা ও কুশিয়ারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফলে এর স্রোতের গতি ও বালু বহনের পরিমাণ পদ্মার চেয়ে অনেক বেশি। টিপাইমুখ হাই ড্যাম নির্মিত হলে নদীগর্ভে অতিরিক্ত বালুর সঞ্চালন ও সঞ্চয়ন, হঠাৎ বন্যা, অতিবন্যা_সবই পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সম্পূর্ণ হাওর জনপদের ওপর। আনুমানিক ১০-১৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের হাওর, বিল-ঝিল, বাঁওড় ও নদী-নালা বালুতে প্রায় ভরে যাবে। উর্বরা ধানের জমি পুরু বালির স্তরের নিচে চাপা পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে কৃষি। হারিয়ে যাবে শস্য তথা বোরো, শাইল ও আমন ধানের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। সুরমা ও কুশিয়ারা ধ্বংস হলে মেঘনার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। সুতরাং শুধু সিলেট ও সিলেটের হাওর অঞ্চলই নয়, মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে মেঘনা নদী অধ্যুষিত জনপদে বসবাসরত এ দেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ। ধস নামবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও দেশের অর্থনীতিতে। ইতিমধ্যে বরাক নদীর দুই তীরে ভারত কর্তৃক অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বর্তমানে ওই নদী থেকে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ৮৩ দশমিক ৫৯ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ পাঁচ বছর আগে এ প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৩০০ ঘনমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সুরমা ভাটিতে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার মরে গেছে। ভারত যে শুধু টিপাইমুখ বাঁধই নির্মাণ করছে তা নয়; বরং উজানে ছোট-বড় মিলিয়ে ২২৫টি বাঁধ নির্মাণ করছে। উদ্দেশ্য, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে প্রায় ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ইতিমধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলোর ওপর ভারত ১৬টি বৃহৎ বাঁধ চালু করেছে এবং আটটি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণাধীন। আরো ৬৪টি নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।
ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি সংবাদপত্রে ছাপা হলো এমন একটি সময়ে, যখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় ফিরে এসে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি হবেই। অথচ খোদ মনমোহন সিংই আমাদের জানান দিয়েছেন, যা পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে যে চুক্তি হতে আরো সময় লাগবে। গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যখন আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী আমরা কতটুকু পানি পাচ্ছি, সংবাদপত্রগুলোই তার সাক্ষী। এমনকি ভারতের অভ্যন্তরে একটি আন্তনদীসংযোগ গ্রুপের কথাও আমরা শুনেছি। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দা ও গোদাবরিতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখান থেকে পেনার ও কাবেরিতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। মোট ৩৭টি নদীকে ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচসুবিধা দেওয়া হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ শুকনো মৌসুমে তার মিঠা পানির মোট ৮৫ শতাংশই ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা থেকে পায়। এককভাবে ব্রহ্মপুত্র থেকেই পাওয়া যায় মোট প্রয়োজনের ৬৫ শতাংশ পানি। সুতরাং ভারতের পরিকল্পনা মতো পানি প্রত্যাহার করা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
বাংলাদেশে প্রবাহিত অধিকাংশ নদীর উৎসস্থল হচ্ছে ভারত। ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবহমান নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এ ক্ষেত্রে গঙ্গা বাদে অন্য কোনো নদীর পানিবণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি। বাহ্যত পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারতের উদাসীনতা, এক ধরনের 'চুক্তি' বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি এককভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া ইত্যাদি মূলত ভারতের এক ধরনের পানি আগ্রাসনের ফল। ভারতের এই ভূমিকা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য পাওনা থেকে শুধু বঞ্চিতই করছে না, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভারত এই কাজ করতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, একটি নদী যদি দুই-তিনটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাহলে ওই নদীর পানি কিভাবে বণ্টন হবে। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালের ভিয়েনা সম্মেলন, ১৯২১ সালের আন্তর্জাতিক দানিয়ুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইন, আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার-সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ, ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নম্বর নীতি কিংবা আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশনের ৫ ও ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ_প্রতিটিতে ভাটির দেশের অধিকার সংরক্ষিত। উজানের দেশ এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, যা ভাটির দেশের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি রামসার কনভেনশন (জলাভূমিবিষয়ক কনভেনশন) অনুযায়ী জলাভূমি সংরক্ষণ ও সেই সঙ্গে সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ ওপরে উলি্লখিত প্রতিটি আইনের পরিপন্থী। এমনকি আইনে 'যুক্তি', 'ন্যায়পরায়ণতা' ও আলাপ-আলোচনার যে কথা বলা হয়েছে, তাও অনুসরণ করেনি ভারত। বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে যে ইতিবাচক একটি দিক পরিলক্ষিত হয়েছিল, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণে তা এখন নষ্ট হলো। তাই ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হতে হবে জাতিসংঘ সনদের ২.৭ ধারা অনুযায়ী, যেখানে সমমর্যাদার কথা বলা হয়েছে। টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ সেই সমমর্যাদাকে নিশ্চিত করে না।
দৈনিক কালের কন্ঠ। ২৯ নভেম্বর ২০১১।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com
উল্লেখ্য, ভারতের মণিপুর রাজ্যের চোরাচাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। এসজেভিএনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে ১৬২ দশমিক ৮০ মিটার উঁচু পাথরের বাঁধের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাঁচটি ইউনিট থাকবে, আর প্রতিটির ক্ষমতা হবে ২৫০ মেগাওয়াট। এতে বছরে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ২১১ কোটি টাকা। আর এটি শেষ হবে ৮৭ মাসে। বাঁধটির নির্মাণকাজ শেষ হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা বরাক নদী হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার মূল ধারা। সুরমা ও কুশিয়ারা পরে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে আমাদের বিশাল মেঘনা। বরাক নদী পাহাড় থেকে নেমেই সুরমা ও কুশিয়ারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফলে এর স্রোতের গতি ও বালু বহনের পরিমাণ পদ্মার চেয়ে অনেক বেশি। টিপাইমুখ হাই ড্যাম নির্মিত হলে নদীগর্ভে অতিরিক্ত বালুর সঞ্চালন ও সঞ্চয়ন, হঠাৎ বন্যা, অতিবন্যা_সবই পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সম্পূর্ণ হাওর জনপদের ওপর। আনুমানিক ১০-১৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের হাওর, বিল-ঝিল, বাঁওড় ও নদী-নালা বালুতে প্রায় ভরে যাবে। উর্বরা ধানের জমি পুরু বালির স্তরের নিচে চাপা পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে কৃষি। হারিয়ে যাবে শস্য তথা বোরো, শাইল ও আমন ধানের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। সুরমা ও কুশিয়ারা ধ্বংস হলে মেঘনার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। সুতরাং শুধু সিলেট ও সিলেটের হাওর অঞ্চলই নয়, মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে মেঘনা নদী অধ্যুষিত জনপদে বসবাসরত এ দেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ। ধস নামবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও দেশের অর্থনীতিতে। ইতিমধ্যে বরাক নদীর দুই তীরে ভারত কর্তৃক অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বর্তমানে ওই নদী থেকে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ৮৩ দশমিক ৫৯ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ পাঁচ বছর আগে এ প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৩০০ ঘনমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সুরমা ভাটিতে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার মরে গেছে। ভারত যে শুধু টিপাইমুখ বাঁধই নির্মাণ করছে তা নয়; বরং উজানে ছোট-বড় মিলিয়ে ২২৫টি বাঁধ নির্মাণ করছে। উদ্দেশ্য, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে প্রায় ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ইতিমধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলোর ওপর ভারত ১৬টি বৃহৎ বাঁধ চালু করেছে এবং আটটি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণাধীন। আরো ৬৪টি নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।
ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি সংবাদপত্রে ছাপা হলো এমন একটি সময়ে, যখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় ফিরে এসে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি হবেই। অথচ খোদ মনমোহন সিংই আমাদের জানান দিয়েছেন, যা পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে যে চুক্তি হতে আরো সময় লাগবে। গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যখন আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী আমরা কতটুকু পানি পাচ্ছি, সংবাদপত্রগুলোই তার সাক্ষী। এমনকি ভারতের অভ্যন্তরে একটি আন্তনদীসংযোগ গ্রুপের কথাও আমরা শুনেছি। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দা ও গোদাবরিতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখান থেকে পেনার ও কাবেরিতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। মোট ৩৭টি নদীকে ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচসুবিধা দেওয়া হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ শুকনো মৌসুমে তার মিঠা পানির মোট ৮৫ শতাংশই ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা থেকে পায়। এককভাবে ব্রহ্মপুত্র থেকেই পাওয়া যায় মোট প্রয়োজনের ৬৫ শতাংশ পানি। সুতরাং ভারতের পরিকল্পনা মতো পানি প্রত্যাহার করা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
বাংলাদেশে প্রবাহিত অধিকাংশ নদীর উৎসস্থল হচ্ছে ভারত। ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবহমান নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এ ক্ষেত্রে গঙ্গা বাদে অন্য কোনো নদীর পানিবণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি। বাহ্যত পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারতের উদাসীনতা, এক ধরনের 'চুক্তি' বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি এককভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া ইত্যাদি মূলত ভারতের এক ধরনের পানি আগ্রাসনের ফল। ভারতের এই ভূমিকা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য পাওনা থেকে শুধু বঞ্চিতই করছে না, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভারত এই কাজ করতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, একটি নদী যদি দুই-তিনটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাহলে ওই নদীর পানি কিভাবে বণ্টন হবে। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালের ভিয়েনা সম্মেলন, ১৯২১ সালের আন্তর্জাতিক দানিয়ুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইন, আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার-সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ, ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নম্বর নীতি কিংবা আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশনের ৫ ও ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ_প্রতিটিতে ভাটির দেশের অধিকার সংরক্ষিত। উজানের দেশ এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, যা ভাটির দেশের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি রামসার কনভেনশন (জলাভূমিবিষয়ক কনভেনশন) অনুযায়ী জলাভূমি সংরক্ষণ ও সেই সঙ্গে সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ ওপরে উলি্লখিত প্রতিটি আইনের পরিপন্থী। এমনকি আইনে 'যুক্তি', 'ন্যায়পরায়ণতা' ও আলাপ-আলোচনার যে কথা বলা হয়েছে, তাও অনুসরণ করেনি ভারত। বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে যে ইতিবাচক একটি দিক পরিলক্ষিত হয়েছিল, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণে তা এখন নষ্ট হলো। তাই ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হতে হবে জাতিসংঘ সনদের ২.৭ ধারা অনুযায়ী, যেখানে সমমর্যাদার কথা বলা হয়েছে। টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ সেই সমমর্যাদাকে নিশ্চিত করে না।
দৈনিক কালের কন্ঠ। ২৯ নভেম্বর ২০১১।
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com