রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

কথা রাখলেন না মনমোহন সিং

কথা রাখলেন না মনমোহন সিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় (২০১০) সাংবাদিকরা যখন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তিনি বলেছিলেন_ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। আমরা সেদিন আশ্বস্ত হয়েছিলাম। এমনকি গত ১১ জুলাই ভারতের নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন লিমিটেডের (নিপকো) ম্যানেজিং ডিরেক্টর প্রেমচাঁদ পঙ্কজ যখন ভারতের স্থানীয় সংবাদপত্রকে জানান, টিপাইমুখে বরাক নদীতে প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হবেই (আমার দেশ, ১২ জুলাই), তখনো আমরা বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে চাইনি। এমনকি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এর ব্যাখ্যা চাওয়া হয়নি। কিন্তু এখন? ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ_২২ অক্টোবর দিলি্লতে টিপাইমুখ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে একটি যৌথ বিনিয়োগে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কথা ছিল, ভারত যদি কিছু করে, তাহলে বাংলাদেশকে জানিয়েই করবে। অথচ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো, বাংলাদেশকে জানানোর প্রয়োজনীয়তা বোধ করল না ভারত। সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভারতের জাতীয় জলবিদ্যুৎ নিগম এনএইচপিসি, রাষ্ট্রায়ত্ত জলবিদ্যুৎ সংস্থা এসজেভিএন ও মণিপুর সরকার এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। যৌথ বিনিয়োগের এই প্রকল্পে এনএইচপিসির ৬৯ শতাংশ, এসজেভিএনের ২৬ শতাংশ আর মণিপুর সরকারের ৫ শতাংশ শেয়ার থাকবে। এই চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে ভারত শেষ পর্যন্ত টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেই। অথচ খোদ মণিপুর রাজ্যে এই বাঁধের বিরোধিতাকারীরা অত্যন্ত সক্রিয়। তারা দীর্ঘদিন ধরে সেখানে আন্দোলন করে আসছে। বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষ করে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের মানুষও এ ব্যাপারে সক্রিয়। বাংলাদেশেও অতীতে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে সমাবেশ হয়েছে, সেমিনার হয়েছে। মণিপুরের পরিবেশবাদীরাও ওই সেমিনারে অংশ নিয়েছেন। তাঁরা বাংলাদেশি জনগণকে প্রতিবাদী হতেও আহ্বান জানিয়ে গেছেন। তবে এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিককালে বড় ধরনের অগ্রগতি লক্ষ করা গেলেও টিপাইমুখ বাঁধ বন্ধ করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ভারতকে রাজি করাতে পারেনি। দেখা গেছে, ভারত একতরফাভাবে অনেক কিছু আদায় করে নিয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ সে ক্ষেত্রে আদায় করতে পারেনি কিছুই। ভারতের এই ভূমিকা বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের নেতিবাচক ভূমিকাকে এখন সামনে নিয়ে এল।
উল্লেখ্য, ভারতের মণিপুর রাজ্যের চোরাচাঁদপুর জেলার তুইভাই ও বরাক নদীর সঙ্গমস্থলে টিপাইমুখ বাঁধটি নির্মিত হচ্ছে। এসজেভিএনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, এই প্রকল্পে ১৬২ দশমিক ৮০ মিটার উঁচু পাথরের বাঁধের পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাঁচটি ইউনিট থাকবে, আর প্রতিটির ক্ষমতা হবে ২৫০ মেগাওয়াট। এতে বছরে ৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৯ হাজার ২১১ কোটি টাকা। আর এটি শেষ হবে ৮৭ মাসে। বাঁধটির নির্মাণকাজ শেষ হলে বাংলাদেশ বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কেননা বরাক নদী হচ্ছে সুরমা ও কুশিয়ারার মূল ধারা। সুরমা ও কুশিয়ারা পরে মিলিত হয়ে সৃষ্টি করেছে আমাদের বিশাল মেঘনা। বরাক নদী পাহাড় থেকে নেমেই সুরমা ও কুশিয়ারায় বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। ফলে এর স্রোতের গতি ও বালু বহনের পরিমাণ পদ্মার চেয়ে অনেক বেশি। টিপাইমুখ হাই ড্যাম নির্মিত হলে নদীগর্ভে অতিরিক্ত বালুর সঞ্চালন ও সঞ্চয়ন, হঠাৎ বন্যা, অতিবন্যা_সবই পড়বে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, বিশেষ করে সম্পূর্ণ হাওর জনপদের ওপর। আনুমানিক ১০-১৫ বছরের মধ্যে এ অঞ্চলের হাওর, বিল-ঝিল, বাঁওড় ও নদী-নালা বালুতে প্রায় ভরে যাবে। উর্বরা ধানের জমি পুরু বালির স্তরের নিচে চাপা পড়বে। ধ্বংস হয়ে যাবে কৃষি। হারিয়ে যাবে শস্য তথা বোরো, শাইল ও আমন ধানের আঞ্চলিক বৈচিত্র্য। ধ্বংস হয়ে যাবে জীববৈচিত্র্য। সুরমা ও কুশিয়ারা ধ্বংস হলে মেঘনার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। সুতরাং শুধু সিলেট ও সিলেটের হাওর অঞ্চলই নয়, মহাবিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে মেঘনা নদী অধ্যুষিত জনপদে বসবাসরত এ দেশের প্রায় অর্ধেক জনগণ। ধস নামবে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও দেশের অর্থনীতিতে। ইতিমধ্যে বরাক নদীর দুই তীরে ভারত কর্তৃক অবকাঠামো নির্মাণের ফলে বর্তমানে ওই নদী থেকে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে ৮৩ দশমিক ৫৯ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ পাঁচ বছর আগে এ প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৩০০ ঘনমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, সুরমা ভাটিতে কমপক্ষে তিন কিলোমিটার মরে গেছে। ভারত যে শুধু টিপাইমুখ বাঁধই নির্মাণ করছে তা নয়; বরং উজানে ছোট-বড় মিলিয়ে ২২৫টি বাঁধ নির্মাণ করছে। উদ্দেশ্য, আগামী ৫০ বছরের মধ্যে প্রায় ৯৯ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা। ইতিমধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারতের নদীগুলোর ওপর ভারত ১৬টি বৃহৎ বাঁধ চালু করেছে এবং আটটি বৃহৎ বাঁধ নির্মাণাধীন। আরো ৬৪টি নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।
ভারতের টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি সংবাদপত্রে ছাপা হলো এমন একটি সময়ে, যখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলে ঢাকায় ফিরে এসে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে তিস্তার পানিবণ্টনের ব্যাপারে একটি চুক্তি হবেই। অথচ খোদ মনমোহন সিংই আমাদের জানান দিয়েছেন, যা পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে যে চুক্তি হতে আরো সময় লাগবে। গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে একটি চুক্তি হয়েছিল ১৯৯৬ সালে, যখন আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছিল। ওই চুক্তি অনুযায়ী আমরা কতটুকু পানি পাচ্ছি, সংবাদপত্রগুলোই তার সাক্ষী। এমনকি ভারতের অভ্যন্তরে একটি আন্তনদীসংযোগ গ্রুপের কথাও আমরা শুনেছি। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্রের পানি নিয়ে যাওয়া হবে গঙ্গায়। সেখান থেকে তা নিয়ে যাওয়া হবে মহানন্দা ও গোদাবরিতে। গোদাবরির পানি নিয়ে যাওয়া হবে কৃষ্ণায় এবং সেখান থেকে পেনার ও কাবেরিতে। নর্মদার পানি নিয়ে যাওয়া হবে সবরমতিতে। মোট ৩৭টি নদীকে ৩১টি খালের মাধ্যমে সংযোগ প্রদান করে ১৫০ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে সেচসুবিধা দেওয়া হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের ওপর মারাত্মক আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বর্তমানে পাওয়া প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশ শুকনো মৌসুমে তার মিঠা পানির মোট ৮৫ শতাংশই ব্রহ্মপুত্র ও গঙ্গা থেকে পায়। এককভাবে ব্রহ্মপুত্র থেকেই পাওয়া যায় মোট প্রয়োজনের ৬৫ শতাংশ পানি। সুতরাং ভারতের পরিকল্পনা মতো পানি প্রত্যাহার করা হলে তা আমাদের দেশের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনবে।
বাংলাদেশে প্রবাহিত অধিকাংশ নদীর উৎসস্থল হচ্ছে ভারত। ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবহমান নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এ ক্ষেত্রে গঙ্গা বাদে অন্য কোনো নদীর পানিবণ্টনের ব্যাপারে কোনো চুক্তি হয়নি। বাহ্যত পানিবণ্টনের ব্যাপারে ভারতের উদাসীনতা, এক ধরনের 'চুক্তি' বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া, উজানে বাঁধ নির্মাণ করে পানি এককভাবে প্রত্যাহার করে নেওয়া ইত্যাদি মূলত ভারতের এক ধরনের পানি আগ্রাসনের ফল। ভারতের এই ভূমিকা বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে বড় ধরনের ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ভারত আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য পাওনা থেকে শুধু বঞ্চিতই করছে না, বরং বাংলাদেশের অর্থনীতিকেও ধ্বংস করার উদ্যোগ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ভারত এই কাজ করতে পারে না। আন্তর্জাতিক আইনে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, একটি নদী যদি দুই-তিনটি দেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তাহলে ওই নদীর পানি কিভাবে বণ্টন হবে। আন্তর্জাতিক নদীর ব্যবহার সম্পর্কে ১৮১৫ সালের ভিয়েনা সম্মেলন, ১৯২১ সালের আন্তর্জাতিক দানিয়ুব নদী কমিশন কর্তৃক প্রণীত আইন, আন্তর্জাতিক নদীর পানি ব্যবহার-সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালে আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ, ১৯৯২ সালের ডাবলিন নীতিমালার ২ নম্বর নীতি কিংবা আন্তর্জাতিক জলপ্রবাহ কনভেনশনের ৫ ও ৭ নম্বর অনুচ্ছেদ_প্রতিটিতে ভাটির দেশের অধিকার সংরক্ষিত। উজানের দেশ এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, যা ভাটির দেশের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি রামসার কনভেনশন (জলাভূমিবিষয়ক কনভেনশন) অনুযায়ী জলাভূমি সংরক্ষণ ও সেই সঙ্গে সেখানকার উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ ওপরে উলি্লখিত প্রতিটি আইনের পরিপন্থী। এমনকি আইনে 'যুক্তি', 'ন্যায়পরায়ণতা' ও আলাপ-আলোচনার যে কথা বলা হয়েছে, তাও অনুসরণ করেনি ভারত। বাংলাদেশে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের মধ্য দিয়ে যে ইতিবাচক একটি দিক পরিলক্ষিত হয়েছিল, টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণে তা এখন নষ্ট হলো। তাই ভারতের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু সেই বন্ধুত্ব হতে হবে জাতিসংঘ সনদের ২.৭ ধারা অনুযায়ী, যেখানে সমমর্যাদার কথা বলা হয়েছে। টিপাইমুখে বাঁধ নির্মাণ সেই সমমর্যাদাকে নিশ্চিত করে না।
দৈনিক কালের কন্ঠ। ২৯ নভেম্বর ২০১১। 
লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

টিপাইমুখ বাঁধ ও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক


ভারতের মনিপুর রাজ্যে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে শুধু একটি প্রশ্নের মুখেই ঠেলে দেয়নি, বরং বাংলাদেশকে ভারত কী চোখে দেখে সেই বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে। টিপাইমুখে বাঁধটি নির্মিত হলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল বড় ধরনের পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হবে। নয়াদিলি্লতে গত ২২ অক্টোবর যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা আগামী ৮৭ মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা। প্রস্তাবিত ওই বাঁধটি সম্পর্কে খোদ মনিপুরবাসীরও আপত্তি রয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের ক্ষোভ একাধিকবার প্রকাশ হলেও, ভারতের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে টিপাইমুখে আদৌ কোনো বাঁধ নির্মিত হচ্ছে না। এমনকি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিলি্ল সফরের সময়ও (জানুয়ারি ২০১০) ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেছিলেন ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। তিনি এ কথাও বলেছিলেন ভারত যদি কিছু করে, তাহলে বাংলাদেশকে জানিয়েই করবে। এরপর মনমোহন সিং ঐতিহাসিক সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তখন টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কেননা আমরা বিশ্বাস করেছিলাম ভারতের প্রধানমন্ত্রীর কথায়। কিন্তু আজ যখন চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হলো, এখন কী বলবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী?
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন একটি মাত্রা পেয়েছে। আমরা ইতোমধ্যে ভারতকে ট্রানজিট দিয়েছি। অথচ এখন অবধি ট্রানজিটের ফি নির্ধারিত হয়নি। এমনকি ভারতের ৪২ চাকার যান চলাচলের জন্য আমাদের যে পরিবেশগত ক্ষতি হবে, তারও কোনো সমীক্ষা তৈরি হয়নি। ওই যান চলাচল করছে। এর জন্য রাস্তা তৈরি করতে হচ্ছে। ফলে বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলে কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতারও সৃষ্টি হয়েছে। সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সম্পর্কিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, সেখানে ট্রানজিটের কথা আছে। অথচ তিস্তার পানি আমরা পাইনি। চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়নি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে।
শুধু তিস্তার পানি বণ্টনের কথা কেন বলি, এর আগে ১৯৯৬ সালে আমরা গঙ্গার পানি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলাম। কিন্তু ওই চুক্তি অনুযায়ী যে পরিমাণ পানি পাওয়ার কথা, সেই পরিমাণ পানিও আমরা এখন পাচ্ছি না। ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যে সমঝোতা হয়েছিল, তাতেও রয়ে গেছে এক ধরনের অস্পষ্টতা। ওই সমঝোতার প্রতিবাদে ছিটমহলবাসীরা ১০ দিন চুলা না জ্বালিয়ে যে প্রতিবাদ করেছিলেন, তার সংবাদও ঢাকার পত্র পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। তিনবিঘা করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে বটে, কিন্তু তিনবিঘা আমরা পাইনি। অথচ আমরা বেরুবাড়ী দিয়েছিলাম কত আগে ১৯৭৪ সালে। ভারত সে উন্নয়ন ও সহযোগিতা চুক্তিটি স্বাক্ষর করেছে, তা নিয়েও কথা আছে। ওই চুক্তিতে নিরাপত্তার যে ধারাটি রয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ওই চুক্তিতে যে ভাষা ও বক্তব্য রয়েছে, তার মাধ্যমে অতি কৌশলে ভারত বাংলাদেশের কাছ থেকে ট্রানজিট আদায় করে নিয়েছে। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় আমরা আমাদের দক্ষতা দেখাতে পারিনি। ভারতের দক্ষ আমলারা কৌশলে আমাদের কাছ থেকে ট্রানজিট আদায় করে নিল। যদিও এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আমলাদের চেয়ে দু'জন উপদেষ্টার (ড. মসিউর রহমান ও ড. গওহর রিজভী) ব্যক্তিগত ও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা কাজ করেছিল বেশি। কেননা তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পৃক্ত ও প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা তারা বাস্তবায়ন করেছেন মাত্র।
এখন যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা আসলে কী? ভারত কী চায়? ভারত বড় দেশ। বড় অর্থনীতি। যদিও জনগোষ্ঠীর ৩৭ ভাগ এখনো দরিদ্র সেখানে (২০১০)। ভারতের কোনো কোনো রাজ্যে দারিদ্র্য এত বেশি যে প্রায়ই সেখানে কৃষকরা ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে আগামী ৩০ বছরে ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনীতিতে পরিণত হবে। মাথাপিছু আয় এখন ৯৪০ ডলার (বর্তমান) থেকে বেড়ে গিয়ে দাঁড়াবে ২২ হাজার ডলারে। তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারত অবদান রাখবে শতকরা ১৭ ভাগ (বর্তমানে মাত্র ২ ভাগ)। এই যে ভারত, এই ভারত আমাদের উন্নয়নে বড় অবদান রাখতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতা নিয়ে (মমতাও এ থেকে বাদ যান না)। এই মানসিকতা বোঝানোর জন্য আমি রাশিয়ার সঙ্গে বেলারুশের সম্পর্কের বিষয়টির দিকে দৃষ্টি দিতে চাই। দেশ দুটো এখন স্বাধীন। বেলারুশ সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত থাকলেও, ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার মধ্য দিয়ে স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। রাশিয়ার যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে বেলারুশে। বেলারুশ রাশিয়ার তেলের ওপর নির্ভরশীল। উঁৎুযনধ বা ঋৎরবহফংযরঢ় পাইপ লাইনের মাধ্যমে রাশিয়া তেল সরবরাহ করে বেলারুশকে। বেলারুশ আবার এই তেলের একটি অংশ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত কয়েকটি দেশে বিক্রি করে। এই তেল সরবরাহ নিয়ে ২০০৯ সালে দেশ দুটোর মধ্যে যে তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল ্তুএধং ডধৎ্থ হিসেবে। বেলারুশের প্রেসিডেন্ট লুকাশেংকো বরাবরই রাশিয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে শঙ্কিত। ইতোমধ্যে দেশ দু'টো একটা ঈঁংঃড়স্থং টহরড়হ গঠন করেছে এবং একটি ্তুটহরড়হ ঝঃধঃব্থ চুক্তিতেও দেশ দু'টো স্বাক্ষর করেছে। রাশিয়ার নেতৃবৃন্দ মনে করেন রাশিয়ার ন্যাচারাল অধিকার রয়েছে তার পাশের দেশ বেলারুশে। রাশিয়ার নেতৃবৃন্দ এটাকে বলছেন ্তুতড়হব ড়ভ চৎরারষবমবফ ওহঃবৎবংঃ্থ। অর্থাৎ তাদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এলাকা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ এই তত্ত্বের প্রবক্তা। মূল কথা হচ্ছে রাশিয়ার পাশের দেশ বেলারুশে রাশিয়ার স্বার্থ রয়েছে। বেলারুশকে এই 'রাশিয়ার স্বার্থ'কে স্বীকার করে নিতে হবে। রাশিয়ার এটা স্বাভাবিক অধিকার।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ্তুতড়হব ড়ভ চৎরারষবমবফ ওহঃবৎবংঃ্থ-এর ধারণাটি আমাদের জন্য একটা দৃষ্টান্ত হতে পারে। ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে বাংলাদেশে। ভারতের সঙ্গে স্বার্থ মূলত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের 'সাতবোন' রাজ্যের উন্নয়ন। ভারতের এই ৭টি রাজ্য (অসম, ত্রিপুরা, মনিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও অরুণাচল) মূলত মূল ভূখ- থেকে বিচ্ছিন্ন। সেখানে উন্নয়নও হচ্ছে না। দারিদ্র্যের ও অশিক্ষার হারও বেশি। এখন 'সাতবোন' রাজ্যের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের অংশগ্রহণ খুবই জরুরি। গুজরাল ডকট্রিন-এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে 'সাতবোন' রাজ্যের উন্নয়নের কথা বলা হয়েছিল। ১৯৯৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর গুজরাল (ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী) লন্ডনের দিরয়াল ইন্সটিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সে বক্তৃতা দেয়ার সময় গুজরাল তার এই মতবাদ তুলে ধরেছিলেন। ওই মতবাদে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়নে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা, চট্টগ্রাম পোর্ট ব্যবহারের কথা বলা হয়েছিল। এটা ছিল মূলত 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন'-এর সম্প্রসারিত ও পরিবর্তিত রূপ। 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন'-এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে ভারতের স্বার্থ নিশ্চিত করা। একইসঙ্গে তৃতীয় কোনো দেশকে এ অঞ্চলের ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করা। এ অঞ্চলের উন্নয়নে ভারতই ভূমিকা রাখবে। অন্য কোনো দেশ নয়- এটাই 'ইন্ডিয়া ডকট্রিন'-এর মূল কথা।
'গুজরাল ডকট্রিন'-এ বাংলাদেশের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে 'সাতবোন রাজ্যের' উন্নয়নের কথা বলা হলেও, ভারত ধীরে ধীরে এই মতবাদ নিয়ে এগিয়ে গেছে। ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেবগৌড়ার বাংলাদেশ সফরের সময় (জানুয়ারি ১৯৯৭) এটা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত হয় যে ভারত ও বাংলাদেশ ৪টি দেশ নিয়ে (ভূটান ও নেপালকে সঙ্গে নিয়ে) একটি উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা গড়ে তুলবে। এই উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতাকে তখন বলা হয়েছিল উন্নয়নের চতুর্ভুজ বা ঝড়ঁঃয অংরধহ এৎড়ঃিয ছঁধফৎধহমষব (ঝঅএছ)। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারিতে কাঠমা-ুতে অনুষ্ঠিত চার দেশীয় পররাষ্ট্র সচিবদের বৈঠকে ঝঅএছ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে ঝঅএছ এ সমগ্র ভারতবর্ষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যকে। দীর্ঘদিন উন্নয়নের চতুর্ভুজ নিয়ে তেমন কিছু শোনা না গেলেও, মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে এই ধারণাটি আবার সামনে চলে এসেছে। যে সমঝোতা স্মারক ও প্রটোকল স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতা চুক্তিটি বাদে বাকিগুলো আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়। এর একটিতেও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। বাংলাদেশের স্বার্থ যে সব ক্ষেত্রে জড়িত ছিল (যেমন তিস্তাসহ সব নদীর পানি বণ্টন চুক্তি, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত, ৪৬টি পণ্যের পরিবর্তে ৪৮০টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার ইত্যাদি), সে সব ক্ষেত্রে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়নি। ফলে ভারত সম্পর্কে এ দেশের জনগণের এক অংশের যে নেতিবাচক ধারণা রয়েছে, তাতে আদৌ কোনো পরিবর্তন আসবে না। ভারতের নেতৃবৃন্দের এই কর্তৃত্ববাদী আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। জাতিসংঘ সনদের ২নং এবং ৪.১ নং ধারায় যে সমতা ও সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে, এর আলোকেই আমরা ভারতের সঙ্গে স্থায়ী দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলতে চাই। কিন্তু ভারত যদি একতরফাভাবেও নিজ স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে, তাতে বিতর্কের মাত্রা বাড়বেই। ভারতের নেতৃবৃন্দের 'মাইন্ডসেটআপ'-এ পরিবর্তন আনতে হবে।
বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে 'ছোট' দেশ হতে পারে। কিন্তু প্রায় ১৬ কোটির দেশ এটি। বাংলাদেশও অনেক কিছু ভারতকে দিতে পারে। কিন্তু তথাকথিত বন্ধুত্বের নামে ভারত সব স্বার্থ আদায় করে নেবে, তা হতে পারে না। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আরো একবার প্রমাণিত হলো ভারতের নিজেদের স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে ভারত এতটুকু ছাড় দিতে নারাজ। বাঁধ নির্মাণের সংবাদটি প্রকাশিত হওয়ায় বাংলাদেশে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। সিলেটে ১ ডিসেম্বর সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করা হয়েছে। বেগম জিয়া কঠোর ভাষায় এর নিন্দা করেছেন। বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ যখন উদ্বিগ্ন, তখন ভারত সরকারের এক মুখপাত্র বলেছেন টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের তেমন ক্ষতি হবে না। এই বক্তব্য বন্ধুত্বের মানসিকতার পরিপন্থী। এটাকে বন্ধুত্ব বলে না।
আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু একতরফাভাবে বন্ধুত্ব হয় না। বন্ধুত্ব হতে হবে দু'তরফা, উভয়ের স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেই স্বার্থকে সামনে রেখেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা গেল ভারত তার স্বার্থের বিষয়টিকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছে। বাংলাদেশের অগ্রাধিকার তার কাছে আদৌ কোনো গুরুত্ব পায়নি। আমরা আশা করব ভারতীয় নেতারা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের সেন্টিমেন্ট বুঝবেন এবং টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত যে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছে, তা কার্যকর করা থেকে বিরত থাকবেন।
দৈনিক যায় যায় দিন ২৮ নভেম্বর, ২০১১। ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক,  অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সার্ক কোন পথে?

দু’দিনব্যাপী সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে গত ১১ নভেম্বর আদ্দু ঘোষণার মধ্য দিয়ে। মালদ্বীপ তার রাজধানী মালেতে দু’দুবার সার্ক শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করলেও এবার তারা বেছে নিয়েছিল সাগরঘেঁষা ছোট্ট শহর আদ্দুকে। সেই শহরকে তারা শীর্ষ সম্মেলনের জন্য তৈরী করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে শীর্ষ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানরা অবস্থান করেছিলেন অপর আরেকটি দ্বীপে। কিন্তু সম্মেলন শেষ হওয়ার পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে সার্ক দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি ও এ অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য কতটুকু কাজ করতে পেরেছে? সার্ক-এর বয়স একেবারে কম নয়। ১৯৮৫ সালে ঢাকায় যে সংগঠনটির জন্ম, তার বয়স ২৬ বছর। এই ২৬ বছরে মোট ১৭টি সম্মেলন করেছে সার্ক। পরবর্তী ১৮তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন হবে নেপালে। এই যে ১৭টি সম্মেলন, তাতে অর্জন কতুটুকু? ২০ দফা ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন থেকে তেমন কিছুই হয়নি। মালদ্বীপ জলবায়ু পরিবর্তনে বড় ধরনের ঝুঁকির মাঝে রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেই বলা হচ্ছে, বিশ্বের উষ্ণতা যেভাবে বাড়ছে তা যদি রোধ করা সম্ভব না হয় তাহলে এ শতাব্দীর শেষের দিকে দেশটি সাগরের বুকে হারিয়ে যাবে। এ ব্যাপারে বিশ্ব জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাশিদ সমুদ্রের নীচে কেবিনেট মিটিং পর্যন্ত করেছিলেন, যা সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেছিল। কিন্তু আদ্দু সিটিতে যখন শীর্ষ সম্মেলন আয়োজন করা হয় তখন মালদ্বীপের এই ভূমিকার সাথে দেশটির আগের ভূমিকাকে আমি মেলাতে পারি না। কেননা ৮টি দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানদের সম্মেলনে অংশ নেয়া ও তাদের সাথে আসা শত শত সরকারি কর্মচারী তথা গণমাধ্যম কর্মীদের বিমানে আসা ও যাতায়াতের জন্য যে পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ হয়েছে, তা দেশটির জন্য ভালো নয়। এমনকি তা জলবায়ু পরিবর্তনে মালদ্বীপের অবস্থানের পরিপন্থী। পাঠক আপনাদের ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত Cop 15 (15th Conference of the parties)-এর কথা একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। কিয়োটো প্রটোকল পরবর্তী জলবায়ু সম্মেলনগুলো জাতিসংঘ কর্তৃক Cop নামে অভিহিত করা হয়। উন্নত ও অনুন্নত দেশগুলো আগামীতে কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ কমাবে, সে লক্ষ্যেই Cop সম্মেলনগুলো হচ্ছে (চলতি বছরের ডিসেম্বরে Cop 17-এ একটি চুক্তি হবার কথা)। এটা এখন স্বীকৃত যে, বায়ুমণ্ডলে কার্বন নিঃসরণের ফলে বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে। কোপেনহেগেন সম্মেলনে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে ১৫ হাজার প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। খরচ হয়েছিল ১২২ মিলিয়ন ডলার (সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের থাকা-খাওয়ার খরচ আলাদা)। মজার ব্যাপার হাজার হাজার প্রতিনিধি গেলেন কার্বনের নিঃসরণ কমাতে একটি চুক্তি করতে। কিন্তু তাদের আনা-নেয়া, গাড়ি ব্যবহার করে তারা নিজেরাই বায়ুমণ্ডলে ১২ দিনে ৪০ হাজার ৫০০ টন কার্বন ছড়িয়েছেন। এই তথ্যটি জাতিসংঘের এবং যা টাইম সাময়িকীতে ৮ ডিসেম্বর ছাপা হয়েছিল। আদ্দু সিটিতে প্রতিনিধিরা কী পরিমাণ কার্বন নিঃসরণ করেছেন বা মালদ্বীপ সম্মেলন আয়োজনের পেছনে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে, তার পুরো হিসাব আমার কাছে জানা নেই। কোন সাংবাদিকের লেখনিতেও আমি তা পাইনি। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই নয়, বিশ্বব্যাপী যেখানে অর্থনীতিতে মন্দাভাব বিরাজ করছে, সেখানে এ ধরনের শীর্ষ সম্মেলন ও ‘ফটোসেশন’ করার মধ্যে কোন ধরনের যৌক্তিকতা আছে বলে আমার মনে হয় না।
অতীতের প্রতিটি সম্মেলনের মত আদ্দু সম্মেলনেও ২০ দফার একটি ঘোষণা আছে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া যেসব সমস্যার সম্মুখীন, সে ব্যাপারে সুস্পষ্ট কোন দিক-নির্দেশনা এই ঘোষাণাপত্রে নেই। কোন সুস্পষ্ট কর্মসূচীও গ্রহণ করা হয়নি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার সময়ে যখন এ ধরনের একটি সম্মেলন হয়, তখন আমাদের প্রত্যাশা থাকে মন্দা মোকাবিলায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো যৌথভাবে একটি কর্মসূচী নেবে। কিন্তু কোন কর্মসূচীর কথা বলা নেই ২০ দফায়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো মন্দায় আক্রান্ত। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমছে ৩৯ ভাগ। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩ ভাগ। বর্তমান হিসাব অনুযায়ী সরকার প্রতিদিন ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে ১৩৩ কোটি টাকা। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। এই চিত্র নেপাল, শ্রীলংকা কিংবা মালদ্বীপের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মালদ্বীপের একমাত্র আয় পর্যটন খাত। তাতে মন্দার কারণে ধস নেমেছে। এখন করণীয় কী, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া যেত। কিন্তু তা নেয়া হয়নি। দ্বিতীয়ত, একটি দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গড়ার লক্ষ্যে ভিশন স্টেটমেন্ট তৈরী করার কথা বলা হয়েছে। যেখানে ১৯৫৭ সালে যাত্রা শুরু করা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইসি থেকে) এখন ভেঙে যাবার মুখে, সেখানে আমরা সিদ্ধান্ত নিচ্ছি দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন গড়ার। গ্রীস ও ইতালীর অর্থনৈতিক সংকট প্রমাণ করেছে ছোট্ট ও বড় অর্থনীতি নিয়ে গড়া ঐক্য সাময়িক, দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জার্মানী ও ফ্রান্স আজ ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা বলছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে থাকবেই। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং গ্র“প সিটির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০৫০ সালে ভারত হবে বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতি। ওই সময় ভারতের জিডিপির (ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতার ভিত্তিতে) পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৮৫ দশমিক ৯৭ ট্রিলিয়ন ডলার। চীন থাকবে দ্বিতীয় অবস্থানে। মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ৫৩ হাজার ডলার। এমনকি বর্তমান অবস্থা দিয়েও যদি বিচার করি, তাহলেও ভারতের অর্থনীতির সাথে ভুটান বা নেপালের অর্থনীতিকে মেলান যাবে না। বিশাল একটি পার্থক্য রয়ে গেছে। বড় অর্থনীতি ছোট অর্থনীতিকে গ্রাস করে। ফলে রাজনৈতিক ঐক্য এক ধরনের অর্থনৈতিক আধিপত্যে পরিণত হয়, যেমনটি হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ক্ষেত্রে। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন, বিশেষ করে হিমালয়ের হিমবাহগুলো যে গলে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে কী কর্মসূচী নেয়া যায়, তার কোন উল্লেখ নেই। হিমালয়ের গাঙ্গোত্রী হিমবাহ গত ৩০ বছরে ১.৫ কিলোমিটার দূরে সারে গেছে। হিমালয়ে উষ্ণতা বাড়ছে। অন্যদিকে সমুদ্রের পানি এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী ১৭ ভাগ এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে। ২০ মিলিয়ন মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে বড় শহরগুলোতে আশ্রয় নেবে। মালদ্বীপের কথা উল্লেখ না-ই করলাম। এক্ষেত্রে করণীয় কী? আদ্দু ঘোষণায় কোন কর্মসূচী নেই এ ব্যাপারে। অথচ এ অঞ্চলের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ আদৌ দায়ী নয়। বাংলাদেশ বছরে কার্বন নিঃসরণ করে মাত্র ০.২ টন। কিন্তু ভারত করে অনেক বেশি। জলবায়ু আলোচনায় বাংলাদেশ ও ভারতের অবস্থান এক নয়। ভারত উন্নয়নশীল বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশের গ্র“পে (ব্রাজিল, চীনসহ) আন্তর্ভুক্ত। মূলত ভারতের কারণেই এ অঞ্চলে কার্বন নিঃসরণ কমানোর ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ দ্বীপ রাষ্টগুলোর সমন্বয়ে গঠিত গ্র“পে তার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করেছে। এই দেশগুলো ২০২০ সালের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ ৮৫ ভাগ কমাতে চায়। ভারতের অবস্থান এটা নয়। চতুর্থত, দারিদ্র্য এ অঞ্চলের বড় সমস্যা। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ৫৬ ভাগ এখনও দরিদ্র। ভারতে ২০০৪ সালে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ২৭ দশমিক ৫ ভাগ, ২০১০ সালে তা বেড়েছে ৩৭ দশমিক ০২ ভাগে। প্রতিদিন ভারতে ৫ হাজার শিশু মারা যায় অপুষ্টিজনিত আর দারিদ্র্যের কারণে। ভারতে কোন কোন রাজ্যে দারিদ্র্য অনেক বেশি। ১৯৯১ সালের কলম্বোর সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে কমিশনের রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেনি। কমিশন সামরিক খাতে ব্যয় বাড়ছে কমানোর কথা বললেও, ভারত ও পাকিস্তান ব্যয় বরাদ্দ কমায়নি। ওই রিপোর্ট কাগজ-কলমেই থেকে গেছে। পঞ্চমত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃবাণিজ্য সম্পর্ক বাড়েনি। এ অঞ্চলের দেশগুলোর বাণিজ্যের একটা ক্ষুদ্র অংশ পরিচালিত হয় নিজেদের মধ্যে। বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়েনি। দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে। বাংলাদেশী পণ্য রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেড়েছে প্রায় ৮ গুণ। একমাত্র শ্রীলংকা ছাড়া প্রতিটি দেশের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি সবচেয়ে বেশি। অথচ সার্কের এ ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেই। ষষ্ঠত, ভারত বড় অর্থনীতির দেশ হওয়ায় এ অঞ্চলে দেশটি এক ধরনের অর্থনৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, যা আঞ্চলিক সহযোগিতার পথে প্রধান অন্তরায়। সপ্তমত, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে ভিসামুক্ত যাতায়াতের প্রস্তাব করা হলেও এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত হয়নি। অথচ সেভেন চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপ যাতায়াত অবাধ করেছে (সব দেশ অবশ্য তাতে রাজি হয়নি। ২৭টির মাঝে ১৫টি দেশ সেভেন চুক্তি স্বাক্ষর করে)। অষ্টমত, আদ্দু ঘোষণায় সাফটা চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে (২০০৬ সাল থেকে কার্যকর)। কিন্তু ভারতের নানাবিধ শুল্ক বাধার কারণে সাফটা পূর্ণ কার্যকর হচ্ছে না। ভারত অনেক পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ঘোষণা দিলেও সেখানে রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। অনেক পণ্যই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো উৎপাদন করে না। এমনকি নিগেটিভ লিস্টের কারণেও অনেক পণ্যের ভারতে প্রবেশাধিকার সীমিত। নবমত, দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় সমস্যা জ্বালানি সংকট। বাংলাদেশ কিংবা শ্রীলংকার মত দেশে বিদ্যুতের ঘাটতি রয়েছে। আদ্দু ঘোষণায় বিদ্যুতের বাজার খোঁজার জন্য একটি সমীক্ষা চালানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা থাকলেও বিতরণ ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করছে বিদ্যুৎ সংকট সমাধানের একমাত্র পথ। নেপাল ও ভুটানে প্রচুর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এই দুটো দেশ থেকে বিদ্যুৎ আনতে হলে বাংলাদেশকে ভারতের মর্জির উপর নির্ভর করতে হবে। আর ভারত বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে দেখে। সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেপালের সপ্তকেয়সি হাই ড্যাম থেকে এক হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার প্রস্তাব দিয়েছেন। এই বাঁধটি বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁও থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে নেপালের অভ্যন্তরে নির্মিত হবে। সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে ভাল। কিন্তু ভারতের উপর দিয়ে বিদ্যুৎ আনতে হবে। সমস্যাটা এখানেই। ভারত নিজে নেপাল ও ভুটানের সাথে যৌথভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। কিন্তু ত্রিপক্ষীয় চুক্তিতে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারতের বৈদেশিক নীতিতে বহুপাক্ষিকতা নেই, যা বাংলাদেশ বিশ্বাস করে। ফলে বিদ্যুতের বিতরণ নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। দশমত, সার্ক ফুড ব্যাংক, বীজ ব্যাংক, দুর্যোগ মোকাবিলায় ও সন্ত্রাস দমনে সমন্বিত প্রচেষ্টার যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে, তা ভালো। তবে আগামী দিনগুলোই বলবে এ ব্যাপারে সার্কের সফলতা কতটুকু। সীমিত পর্যায়ে হলেও সার্কের সফলতা কিছুটা রয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সার্ককে নতুন করে চিন্তা করতে হবে।
চীনকে সার্কের কাঠামোয় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি উঠেছে। এটা নিয়ে চিন্তভাবনা করা যেতে পারে। আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত না হলেও সার্কের সদস্য। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু ভারতের কারণে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে চীন খুব বেশি দূরে নয়। বাংলাদেশের সীমান্ত থেকেও চীন খুব বেশি দূরে নয়। চীন নিকট প্রতিবেশী। এখন চীন সার্কের সদস্য হলে বিশ্ব আসরে সার্কের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তবে এক্ষেত্রে সার্কের নামের পরিবর্তন হতে পারে। অতীতে বিমসটেকও পরিবর্তিত হয়ে BBIMSTEC (Bay of Bengal Initiative for Multi Sectoral Technnical and Economic Cooperation) হয়েছে।
সার্ক সম্মেলন এলেই সার্ক সম্পর্কে ভালো ভালো কথা বলা হয়। ফটো সেশন হয়। এবারও হয়েছে। অনেক সিদ্ধান্ত কাগজ-কলমেই থেকে গেছে। বাস্তবায়ন হয়নি। সার্ক তৃতীয় দশকে পা দিয়ে এখন সার্ককে নতুন করে মূল্যায়ন করতে হবে। সার্ককে একটি কার্যকরী আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে চীনকে এই সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত করে এর একটি নতুন কাঠামো দেয়া যেতে পারে। একই সাথে সার্ক-আসিয়ান সম্পর্ক ও যোগাযোগ বাড়াতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব ,  নভেম্বর ২০১১। ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক,  অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

ডিসিসির বিভক্তি কার স্বার্থে?

সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীকে দু’ভাগে ভাগ করে দু’টি পৃথক সিটি কর্পোরেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে মন্ত্রিসভা এ ধরনের একটি সিদ্ধান্তের অনুমোদন দিয়েছে। আগামী সংসদ অধিবেশনে এ সংক্রান্ত একটি বিল উত্থাপিত হবে বলে আশা করছি। এবং এ ক্ষেত্রে যা হয়, তাই হতে যাচ্ছে। সংসদে বিলটি পাস হবে এবং চারশ’ বছরের পুরনো ঢাকা শহরকে আমরা দেখবো দু’টি সিটি কর্পোরেশনের অধীনে পরিচালিত হতে। ঢাকা মহানগরীকে দু’ভাগে ভাগ করার পেছনে সরকারের যুক্তি যেটাই থাকুক না কেন, সরকারের এই সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিরোধী দল সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। শুধু তাই নয় সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা, যারা ঢাকা মহানগরী থেকে নির্বাচিত হয়েছেন, তারা এই বিভক্তিকে সমর্থন করেছেন, এমন কোন দালিলিক ডকুমেন্টও আমাদের কাছে নেই। এমনকি ঢাকা মহানগরী বর্তমানে ৯২টি ওয়ার্ডে বিভক্ত। নির্বাচিত কাউন্সিলরদের (কমিশনার) অনেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। তারা এর আগে ঢাকা মহানগরীকে দু’ভাগে ভাগ করার কোন প্রস্তাব করেছেন, এমনটিও আমাদের জানা নেই। সে কারণেই সরকার যখন এই সিদ্ধান্তটি নিল, তখন এটা বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে মাত্র। ইতোমধ্যে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়র সাদেক হোসেন খোকা সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তিনি ডিসিসিকে আরো শক্তিশালী করারও আহ্বান জানিয়েছেন।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কর্পোরেশনের সেবা নাগরিকদের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর যে কথা বলা হয়, তাতে এখন নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হতে পারে। শুধু তাই নয়, সিটি কর্পোরেশন দু’টি পরিচালনায়ও নানা জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। প্রসঙ্গত, বিভক্তির ফলে ডিসিসির দক্ষিণে পড়বে ৫৬টি ওয়ার্ড, আর উত্তরে পড়বে ৩৬টি। এর ফলে আয় ও ব্যয়ের দিক দিয়ে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হতে বাধ্য। কেননা ডিসিসির বেশি আয় হয় দক্ষিণ অঞ্চল থেকে। এখন বিভক্তির ফলে দক্ষিণ অঞ্চল থেকে রাজস্ব আসবে ৭০ শতাংশ। আর উত্তর অঞ্চল থেকে রাজস্ব আসবে মাত্র ৩০ শতাংশ। এর ফলে একাধিক সমস্যা সৃষ্টি হতে বাধ্য। উত্তর অঞ্চল থেকে রাজস্ব কম আসলে, সেখানে কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নিয়মিত পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। একই সাথে উত্তর অঞ্চলের মানুষ সিটি কর্পোরেশনের নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে। দ্বিতীয়ত, দুই মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর ক্ষমতা পরিচালনা করতে গিয়ে এদের মাঝে দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। আর আমাদের দেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে করে এ দ্বন্দ্ব যদি সশস্ত্র সংঘর্ষে রূপ নেয়, তাতে আমি অবাক হবো না। তৃতীয়ত, সিটি কর্পোরেশনের একটা বড় কাজ হচ্ছে স্থানীয় বাজার, রাস্তাঘাট উন্নয়ন ও পয়ঃনিষ্কাশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করা। কিন্তু ডিসিসি ভাগ হলে এক ধরনের সমন্বয়হীনতার সৃষ্টি হবে। লোকবলের অভাব হেতু বর্জ্য-ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। চতুর্থত, দু’টি কর্পোরেশন গঠিত হলে সরকারের খরচও বাড়বে। কেননা দ্বিতীয় মেয়রের জন্য অফিস তৈরি, জনবল নিয়োগ ইত্যাদি ক্ষেত্রে সরকারকে আর্থিক সাহায্য দিতে হবে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাবে। সে ক্ষেত্রে এই সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন ওয়ার্ডসমূহের কাউন্সিলদের সাথে, বিশেষ করে বিরোধী দল থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের সাথে মেয়রের একটা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হতে পারে। যা কিনা কর্পোরেশনের সুষ্ঠু পরিচালনার ক্ষেত্রে একটি বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করতে পারে। এমনকি এ খাতে যে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হবে, অর্থনীতির এ মন্দার যুগে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী বর্তমানে ডিসিসিতে রয়েছেন, তাদের কেউই নতুন সৃষ্ট সিটি কর্পোরেশনে যোগ দিতে চাইবেন না। তাদের ট্রান্সফার করা হলে, তারা উচ্চ আদালতে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিট করতে পারেন। ফলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ট্রান্সফারের বিষয়টি একটি বড় সমস্যা তৈরি করতে পারে। তাদের পেনশনের ব্যাপারটিও এর সাথে জড়িত। পঞ্চমত, সরকার যেভাবে সীমানা চিহ্নিত করে সিটি কর্পোরেশন উত্তর ও সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণ করেছেন, তা আইনগত জটিলতায় জড়িয়ে যেতে পারে। ভুক্তভোগী যে কোন নাগরিক ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের প্রতিকার চাইতে পারেন। উচ্চ আদালতের যে কোন সিদ্ধান্ত নানা জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। ষষ্ঠ, সিটি কর্পোরেশনের বিভক্তি সংক্রান্ত বিলটি সংসদে পাস হয়ে গেলে সরকার দু’টি সিটি কর্পোরেশনে দু’জন প্রশাসক নিয়োগ করবে। সরকার ১২০ দিনের মধ্যে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দেবে। এখানে নানা জটিলতায় (মামলা-মোকদ্দমা, প্রার্থী বাছাই ইত্যাদি) নিয়োগপ্রাপ্ত প্রশাসকরা নির্ধারিত সময়ের বাইরেও ক্ষমতা ভোগ করবেন। সরকার এমনিতেই ডিসিসির নির্বাচন দিতে পারেনি। বর্তমান ডিসিসির মেয়র ২০০২ সালের ২৫ এপ্রিল দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। তার টার্ম শেষ হয়ে যাবার পরও বর্তমান সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি। যে সমস্যার জন্য সরকার নির্বাচন দিতে পারেনি, সেই সমস্যা থেকে যাবে। ফলে ডিসিসির বিভক্তি কোন কাজে আসবে না। প্রশাসকরা যদি রাজনীতিবিদ হন (যার সম্ভাবনা বেশি), তাহলে তারা নিজেরাও নানা কৌশলে ক্ষমতা ধরে রাখতে চাইবেন। ফলে নতুন নতুন সমস্যা তৈরি হবে। সপ্তম, ২০০৫ সালে বিশ্বব্যাংকের ঋণে আন্তর্জাতিক কনসালট্যান্টের মাধ্যমে সীমানা সমীক্ষা চালানো হয়। ওই সময় মন্ত্রিসভায় অন্যান্য দেশের মতো এককেন্দ্রিক কর্তৃপক্ষ (ইউনিটারি অথরিটি) প্রতিষ্ঠার বিষয়টি অনুমোদন করা হয়। তখন মন্ত্রিসভার ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্তটি ওই সিদ্ধান্তের সাথে সাংঘর্ষিক। এতে করে বিশ্বব্যাংকের সাথে সরকারের সম্পর্ক আরো খারাপ হতে পারে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সাথে দাতা সংস্থাগুলোর সম্পর্ক ভালো নয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড়করণ বন্ধ রেখেছে। এখন ডিসিসির বিভক্তির সিদ্ধান্ত দাতা সংস্থাটির সাথে সম্পর্কের আরো অবনতি ঘটাতে পারে।
সুতরাং ডিসিসির বিভক্তি নাগরিকদের সেবা নিশ্চিত করতে আদৌ কোন সাহায্য করবে না। সরকার তার ক্ষমতাবলে এই কাজটি করতেই পারে। কিন্তু এর ফলাফল ভোগ করবে এই ঢাকা শহরে বসবাসরত নাগরিকরা। ডিসিসির বিভক্তি কোন সমাধান নয়। পৃথিবীর অনেক বড় বড় শহর, বিশেষ করে লন্ডন, নিউইয়র্ক কিংবা কোলকাতার মতো শহরে একজনই মেয়র আছেন। লন্ডন কিংবা নিউইয়র্কের মেয়রের কর্মকাণ্ড অনেক ব্যাপক। প্রশাসনিক এলাকাও তাদের বড়। সেখানে একজন মেয়র যদি বিশাল এক এলাকার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারেন, তাহলে ঢাকার একজন মেয়র পারবেন না কেন। আসলে ডিসিসির বিভক্তির বিষয়টি রাজনৈতিক। ক্ষমতাসীন দলে একাধিক মেয়র প্রার্থী রয়েছেন। তাদেরকে খুশি করার জন্যই মূলত এই বিভক্তি। এর মধ্যে দিয়ে মেয়রের মর্যাদাও ছোট করা হল। বর্তমান মেয়র একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীর মর্যাদা পেয়ে থাকেন। প্রটোকল অনুযায়ী মন্ত্রীর সমমর্যাদা ভোগ করেন। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী মেয়র একজন প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা ভোগ করবেন। এর মধ্য দিয়ে একদিকে যেমনি মেয়রের মর্যাদাকে এক ধাপ নিচে নামানো হল, অন্যদিকে তেমনি সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী ও বর্তমান মেয়র সাদেক হোসেন খোকার পুনঃনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রশ্নে অন্তরায় সৃষ্টি করা হল। মেয়র খোকা নিশ্চয়ই প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। এমনকি বিরোধী দলের অন্যান্য যেসব প্রার্থীর নাম শোনা যায়, তারাও সিনিয়র নেতা। তারা নিশ্চয়ই নয়া আইন অনুযায়ী প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদাসম্পন্ন একটি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। আসলে সিটি কর্পোরেশনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের বিকল্প কিছু নেই। অনেক বড় বড় সিটি কর্পোরেশন মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট হিসেবে পরিচালিত হয়। নাগরিক সুবিধার সাথে সম্পর্কিত সকল বিষয় (পুলিশ, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, জ্বালানি, রাস্তাঘাট ইত্যাদি) এই মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্টের আওতাধীন থাকে। ফলে একদিকে যেমনি এক ধরনের দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তেমনি নাগরিকের ন্যূনতম সুবিধাও নিশ্চিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষিতে এসব বিষয়াদিতে নগর প্রশাসনের করার কিছুই নেই। শহরের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও, পুলিশ বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। নগর প্রশাসনের ভূমিকা এখানে শূন্য। তাই ডিসিসির বিভক্তি নয়। বরং ডিসিসিকে ঠিক রেখে এটাকে মেট্রোপলিটান গভর্নমেন্ট হিসেবে উন্নীত করা যায়। আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা ও ঢাকার প্রাক্তন মেয়র মরহুম মোহাম্মদ হানিফ এই মেট্রোপলিটন গভর্নমেন্ট ধারণার পক্ষে ছিলেন। বর্তমান মেয়রও এমনটি চান। শুধু তাই নয় আগামী একশ বছরের ঢাকাকে চিন্তা করে এখনই একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত। বুড়িগঙ্গা থেকে শীতলক্ষ্যার পাড় ঘেঁষে কেরাণীগঞ্জ থেকে সাভার হয়ে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত আগামী দিনের জন্য একটি পরিকল্পিত ঢাকা মহানগরীর মাস্টার প্লান তৈরিতে এখন থেকেই কাজ শুরু করা উচিত। এটা না করে ডিসিসিকে ভাগ করে ঢাকা মহানগরীকে আধুনিক নগরী হিসেবে গড়ে তোলা যাবে না। প্রায় দেড় কোটি লোক বাস করে এই ঢাকা নগরীতে। জলাবদ্ধতা, ট্রাফিক জ্যাম, হকারদের ফুটপাত দখল, বিদ্যুৎ সংকট, শিশুদের খেলার মাঠের অভাব, রাস্তাঘাটের দুরবস্থা- এই নিয়ে যে ঢাকা মহানগর, এই মহানগরের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। এই মুহূর্তে এটাই জরুরি। এটাই প্রায়োরিটি। সরকারের এদিকে নজর দেয়া উচিত। কিন্তু এদিকে নজর না দিয়ে সরকার যখন ডিসিসিকে ভাগ করার উদ্যোগ নেয়, তখন প্রশ্ন উঠবে বৈকি। মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে বটে। কিন্তু সিদ্ধান্তটি কার্যকর না করাই মঙ্গল।
দৈনিক ইনকিলাব।নভেম্বর ২০১১।
ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক,  অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সন্ধানে

শ্লোগানের ভাষা স্পষ্ট। যারা নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের পাশে অবস্থিত জুকোট্টি পার্ক দখলকারীদের খবরাখবর টিভি ও সংবাদ মাধ্যমে অনুসরণ করছেন তারা শ্লোগানগুলোর সাথে মোটামুটিভাবে পরিচিত। `We are 99%, America Land of Free’, `Greed is Our Policy’, `Occupy together’. বেকার নয়া গ্রাজুয়েট কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠীর একটা অংশের ঠাঁই হয়েছে জুকোট্টি পার্কে। সংবাদপত্রগুলোর ভাষায় এই আন্দোলনকে চিহ্নত করা হয়েছে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন। এই আন্দোলন হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ। আজ যখন এই প্রতিবাদ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে যায় তখন সংগত কারণেই সে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে একটি নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র বড় অর্থনীতির দেশ। কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষের সাথে ধনী শ্রেণী হিসেবে পরিচিত এক শ্রেণীর মানুষের বৈষম্য যখন স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে, তখন বুঝতে হবে পুঁজিবাদী সমাজেও ফাঁটল সৃষ্টি হয়েছে। এটাও কোন সমাধান নয়। এক সময় সমাজতান্ত্রিক সমাজকে বলা হত বৈষম্যহীন সমাজ, অর্থাৎ সেখানে মানুষে মানুষে কোন বৈষম্য নেই। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল তথাকথিত পার্টির কার্ডধারীরা বিশেষ সুবিধাভোগী। ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে যখন সমাজতন্ত্রের ভাঙন শরু হয়েছিল, তখন আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেই সমাজ প্রত্যক্ষ করার। সমাজে বিরাজমান দ্বন্দ্ব, এক শ্রেণীর ক্ষমতা কারায়ত্ত করার কারণেই সমাজতন্ত্রের পতন ঘটলো। সমাজতন্ত্রও কোন সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। এক সময় দুর্ভীক্ষপীড়িত, অধিক জনসংখ্যা, কর্মহীন, শিক্ষাহীন এবং সুশাসনহীন দেশ সোমালিয়া ও সুদানকে বলা হত অকার্যকর রাষ্ট্র। অর্থাৎ রাষ্ট্র অকার্যকর। আজ ইউরোপের একটি রাষ্ট্র গ্রীসও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের ধনী রাষ্ট্রগুলো গ্রীসকে ১১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েও গ্রীসের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। এক সময় ইউরোপে এক মুদ্রা ইউরো চালু হয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৯টি দেশের মাঝে ১৫টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। কিন্তু সেই এক মুদ্রা ইউরো এখন কাজ করছে না। গেল অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ইউরোপের ভয়াবহ ঋণ সঙ্কট কাটাতে ইউরোপিয়ান ফিন্যানসিয়াল স্ট্যাবিলিটি ফান্ড গঠন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। চুক্তির অংশ হিসেবে গ্রীসের ঋণের ওপর ৫০ শতাংশ লোকসানের দায় নেবে ইউরো জোনের ব্যাংকগুলো। কিন্তু এই উদ্যোগ ইউরোপের অর্থনৈতিক সঙ্কটকে মোকাবেলা করতে আদৌ কোন সাহায্য করবে কি না, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারে। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটা বড় ধরনের সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর সমাধান কোন পথে? যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি গত প্রায় দু’বছর যাবৎ ভালো যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে সেখানে বেশ কিছু ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরির বাজারও ভালো নয়। তরুণ গ্রাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেড়িয়ে কোন চাকরি পাচ্ছে না। এদের একটা অংশই এখন জুকোট্টি পার্কে জমায়েত হয়েছে। শুধু জুকোট্টি পার্ক কেন? ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ এর মতো অকুপাই শিকাগো, কিংবা অকুপাই ক্যালিফোর্নিয়ার মতো আন্দোলন এক শহর থেকে অন্য শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। এ থেকেই বোঝা যায় মার্কিনি অর্থনীতি ভালো নয়। আমেরিকার বাজেট ঘাটতির পরিমাণ এখন এক লাখ চল্লিশ হাজার কোটি ডলার, আর তাদের ঋণের পরিমাণ ১৫ হাজার মিলিয়ন ডলার। অথচ ওবামা প্রশাসন কোটি কোটি ডলার খরচ করছে যুদ্ধের পেছনে। ইরাকে প্রতি সেকেন্ডে মার্কিন সামরিক ব্যয়ের পরিমাণ এক হাজার বিলিয়ন ডলারের ওপর। পরিসংখ্যান বলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় অর্থনীতির দেশে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের পেছনে (ইরাক ও আফগানিস্তান) ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করছে (প্রতিমাসে ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার), সেখানে জনগোষ্ঠীর ৯ দশমিক ১ ভাগের কোন চাকরি নেই। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগ মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ মানুষ। ক্ষোভটা তাই ওয়াল স্ট্রিটকে ঘিরেই। ওয়াল স্ট্রিটকে ধরা হয় পুঁজিবাদের একটা সিম্বল হিসেবে। প্রধান প্রধান কর্পোরেট হাউসগুলোর অফিস সেখানে। স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনও এখানে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদী সমাজে ১৯৭০ সালে ধনীশ্রেণী হিসেবে পরিচিতদের হাতে যুক্তরাষ্ট্রের মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হত। আজ ২০১১ সালে তারা ভোগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ক্যালিফোর্নিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের (ব্রাকলে) অধ্যাপক এমানুয়েল সাজ তার এক গবেষণায় দেখিয়েছেন কিভাবে আমেরিকান সমাজে বৈষম্য তৈরি হয়েছে। তার মতে ১০ ভাগ আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ গ্রহণ করে। ডেভিট গ্র তার এক প্রবন্ধে (The Richest TV Have Captured America’s Wealth, Alternet) উল্লেখ করেছেন আমেরিকান ধনীদের মোট সম্পদের পরিমাণ ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার, যা কি না যুক্তরাষ্ট্রের গরিব জনগোষ্ঠীর অর্ধেকের মোট সম্পদের চাইতে বেশি। অর্থাৎ ১৫৫ বিলিয়ন জনগোষ্ঠীর সম্পদের চাইতে বেশি। তার মতে শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ৭০ ভাগের মালিক। যদিও নোবেল পুরস্কার বিজীয় অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিস্ট মনে করেন শীর্ষে থাকা ওই এক ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। অথচ ২৫ বছর আগে ধনীরা নিয়ন্ত্রণ করতো মাত্র ১২ ভাগ সম্পদ (By the 1% for the 1% Vanityfare) অপর এক গবেষক রবার্ট রিচ এর মতে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চ বেতনভোগী মানুষদের মাঝে ৫ ভাগ, ৩৭ ভাগ ভোগ্যপণ্যের ত্রে“তা। এই পরিসংখ্যানই বলে দেয় যুক্তরাষ্ট্রে একটি শ্রেণী ধনী থেকে আরো ধনী হচ্ছে, আর অপর শ্রেণী গরিব থেকে আরো গরিব হচ্ছে। যাদের ক্রয় ক্ষমতা কম, সম্পদের পরিমাণও কম। যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি সমাজ ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে Casino Capitalism অর্থাৎ ক্যাসিনো নির্ভর একটি অর্থনীতি, যেখানে এক রাতে লক্ষ ডলার জুয়া খেলায় হেরে যান অনেক আমেরিকান। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ধনীরা ব্যক্তিগত প্লেন নিয়ে আটলানটায় যান। ক্যাসিনোগুলোর নিজস্ব ফাইভ স্টার হোটেল আছে। সেখানে থাকেন। সারারাত জুয়া খেলে রোববার যার যার শহরে চলে যান। ওখানে এক দিকে ক্যাসিনোগুলোর জৌলুস, অন্যদিকে ক্যাসিনোগুলোর কিছুটা দূরে জরাজীর্ণ পুরনো বাড়ি, সেখানে বাস করে ব্লাক আমেরিকানরা, তাদের অনেকেরই চাকরি নেই। স্বাস্থ্য সেবাও তারা পান না। কী বৈসাদৃশ্য একই দেশের নাগরিক। একজন যেখানে এক রাতে জুয়া খেলে হেরে যান কয়েক হাজার ডলার, অন্যজন সারা মাসেও যার রোজগার নেই মাত্র এক হাজার ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের এই সমাজ ব্যাবস্থায় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। পশ্চিম ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থায় ‘সোস্যাল ডেমোক্রেসির’ ধারণা সেখানে গরিবদের ন্যূনতম অধিকার (স্বাস্থ্য, শিক্ষা) নিশ্চিত করেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে এই অধিকার নিশ্চিত হয়নি। রাষ্ট্র সব নাগরিকের ন্যূনতম অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি। আমি যুক্তরাষ্ট্রে গৃহহীন মানুষ দেখেছি। ভিক্ষা করে এমন লোকও আমি সাবওয়েতে দেখেছি। গায়িকা ম্যাডোনার ভাইও গৃহহীনদের একজন এ খবরও ছাপা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন, অর্থাৎ ১ কোটি ৬৪ লক্ষ শিশু রয়েছে অত্যন্ত গরিব। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার দরিদ্র পরিবারের যে সীমা নির্ধারণ করেছে (অর্থাৎ ২২ হাজার ৫০ ডলার বছরে), সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ২১ ভাগ শিশু সন্তান (প্রতি ৫ জনে ১ জন) ওই সব পরিবারে বসবাস করে। জীবনের কোন এক সময় ৯০ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ শিশু ফুড স্ট্যাম্প (বিনে পয়সায় খাদ্য) এর ওপর নির্ভরশীল ছিল। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সদ্য পাস করা একজন গ্রাজুয়েট কোন চাকরির সংস্থান করতে পারছে না। সেখানে ২০১০ সালে কর্পোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। জুকোট্টি পার্কে যারা দিনের পর দিন অবস্থান করে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন, তাদের অনেকেরই চাকরি নেই। অথচ সরকারি হিসাব অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র বছরে ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে যুদ্ধের জন্য ব্যয় করেছে ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার। অথচ এই বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়ে অনেকের চাকরির সংস্থান করা যেত। শিশুদের স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ানো যেত। বাড়ানো যেত ‘সামাজিক নেট’ এর পরিধি (ফুড স্ট্যাম্প, হাউজিং ইত্যাদি)। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা করেনি। ইরাক ও আফগানিস্তানের যুদ্ধ সেখানে যখন কোন সামাধান বয়ে আনতে পারেনি, তখন লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ‘তৃতীয় যুদ্ধ’ এর সূচনা করেছিল। গাদ্দাফির হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে একটা অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে বটে, কিন্তু লিবিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী একটি অস্থিতিশীলতার জন্ম হল। লিবিয়ায় ‘আরেকটি আফগানিস্তান’ কিংবা আরেকটি সোমালিয়া জন্ম হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র সেখানে জড়িয়ে গেছে। এখন জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় সেখানে যুদ্ধের খরচ মেটাতে হচ্ছে। এটা বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে যুক্তরাষ্ট্র সমাজে এই যে বৈষম্য, এই বৈষম্যের কারণেই সেখানে ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’র মতো আন্দোলনের জন্ম হয়েছে। যদিও পুঁজিবাদী সমাজে এই বৈষম্য নতুন কিছু নয়। পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিই হল আসল কথা। এই সমাজে যে ধনী সে আরো ধনী হয়। পুঁজি এখানে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। এমনকি এটাও বলা হয় মার্কিন কংগ্রেস হচ্ছে `Billionaire friendly’ অর্থাৎ কংগ্রেসে যারা সদস্য তারা ধনীদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তারা নিজেরাও ধনী। সুতরাং ধনীদের সাহায্যে তারা কাজ করবেন। কর্পোরেট হাউসগুলো যাতে ব্যবসা পায়, সেই উদ্যোগই তারা নেবেন। কেননা নির্বাচনের সময় ওই কর্পোরেট হাউসগুলো তাদের চাঁদা দেয়, যার পরিমাণ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। আজ জুকোট্টি পার্কে যারা সমবেত হয়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিচ্ছেন তারা বাহ্যত ক্ষমতার পটপরিবর্তনে খুব একটা ভূমিকা রাখেন না। অসমতা আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজ সারা বিশ্বব্যাপীই চলছে আন্দোলন। চিলিতে (সান্তিয়াগো শহরে) আন্দোকারীরা স্কুলগুলো দখল করে বিনা বেতনে শিক্ষার দাবিতে আন্দোলন করছে। ইসরাইলে আন্দোলন হচ্ছে জীবন-যাত্রার মানের ঊর্ধ্বগতি আর অতিরিক্ত বাড়ি ভাড়ার কারণে। যেখানে শতকরা ৫০ জন যুবক বেকার সেখানে আন্দোলন হচ্ছে বেকারত্বের বিরুদ্ধে। যুক্তরাজ্যে বিশেষ করে লন্ডন শহরে আন্দোলন হচ্ছে শিক্ষায় বাজেট কমানোর প্রতিবাদে। জার্মানি ফ্র্যাঙ্কফুর্টে আন্দোলন হচ্ছে অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রতিবাদে। অকল্যান্ড, তাইপে আর সিউলের বিক্ষোভের ধরনও অনেকটা তেমনি। মূল সুরটা এক জায়গায় বাধা- তা হচ্ছে বৈষম্য আর অসমতা। বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থা মানুষের মাঝে অসমতা দূর করতে পারেনি। বরং কোথাও কোথাও মানুষ আরো গরিব হয়েছে। সুতরাং একুশ শতকে এসে একটি নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যত তাড়াতাড়ি এ দিকটার দিকে নজর দেবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমাদের মতো দেশ বিশ্ব মন্দায় এখন অব্দি আক্রান্ত হয়নি। তবে অচিরেই আমরা উপলব্ধি করতে শুরু করবো। মন্দার কারণে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের তৈরি পোশাকের বাজার সংকুচিত হয়ে আসবে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে আসবে। দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে। সরকার যদি কৃচ্ছ্রসাধন না করে, তাহলে এক বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে পড়বে দেশ। নিউইর্কের ‘অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট’ আন্দোলন আমাদের দেখিয়ে দিল সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এখনই।
দৈনিক ইনকিলাব,  নভেম্বর ২০১১। ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক,  অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিএনপির রোডমার্চ ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৃতীয় রোডমার্চ গতকাল ২৭ অক্টোবর ময়মনসিংহে শেষ হয়েছে। এর আগে দ্বিতীয় রোডমার্চ চাঁপাইনবাবগঞ্জে শেষ হয় গত ১৯ অক্টোবর। প্রথম রোডমার্চটি শেষ হয়েছিল সিলেটে গত ১১ অক্টোবর। বিএনপি তথা চারদল আরো রোডমার্চ করার পরিকল্পনা করছে। প্রশ্ন হচ্ছেএই রোডমার্চ বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে কতটুকু পরিবর্তন আনতে পারবে? কিংবা সরকার কী এই রোডমার্চের ব্যাপারে কোন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে? গত ১১ অক্টোবর প্রথম রোডমার্চের পর প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রীরা যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে করে এটা ধারণা করা স্বাভাবিক যে সরকারের প্রতিক্রিয়া ইতিবাচক ছিল না। দ্বিতীয় রোডমার্চে বেগম জিয়া বিভিন্ন পথসভায় কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন, এটা তার পুরনো দাবি। তিনি গণঅভ্যুত্থানের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। যদিও গণঅভ্যুত্থানের ডাক তিনি দেননি। ঢাকা ঘেরাওয়ের কর্মসূচির প্রতিও তিনি ইংগিত দিয়েছেন। সব মিলিয়ে এটা স্পষ্ট যে বিএনপি একটি কঠোর অবস্থানে যাচ্ছে। সরকার এ ব্যাপারে আদৌ উৎকণ্ঠিত এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। সরকারি দলের নেতারা এই রোডমার্চ নিয়ে প্রায়সই বিরূপ মন্তব্য করছেন। এর ফলে দেশ একটি বড় ধরনের সঙ্কটের মুখে যাচ্ছে বলেই আমার ধারণা। এমনিতেই দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা, তার প্রভাব বাংলাদেশেও অনুভূত হচ্ছে। টাকার মান কমে গেছে, সারা বিশ্বব্যাপী যেখানে ডলারের দাম কমে গেছে, সেখানে বাংলাদেশে বেড়েছে ডলারের দাম। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে ইউরোপে রফতানি কমছে। তৈরি পোষাক শিল্পএখন ঝুঁকির মুখে। ইউরোপে তৈরি পোষাক শিল্পের অর্ডার কমে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকেও অর্ডার কমে আসবে এখন। যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদ বিরোধী আন্দোলন অর্থনীতিতে আঘাত করেছে। ফলে আমদানিতে নেতীবাচক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বাংলাদেশের পোষাক শিল্প। ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে একটি খবর- তিন হাজার ওভেন ও নিট গার্মেন্টস কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। গত সেপ্টেম্বরে (২০১১) রফতানি আয় ২৩ শতাংশ কমেছে। যা নিঃসন্দেহে একটি চিন্তার কারণ। আমাদের রাজনীতিবিদদের এটা নিয়ে ভাবা উচিত। ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) রফতানি আয় হয়েছিল ২৩৩৯ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার, যা প্রায় ১৭ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকার সমান। জুলাইয়ের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আয় কমেছে প্রায় ৬ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ কম। এমনি এক পরিস্থিতিতে বেগম জিয়ার নেতৃতে বিএনপি রোডমার্চ করছে। বেগম জিয়া জানিয়ে দিয়েছেন যে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত তারা আর ঘরে ফিরে যাবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার। বিএনপি এখন সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে যাচ্ছে। যদিও পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২০১৩ সালের শেষের দিকে।
বিএনপি যেসব এজেন্ডাকে সামনে রেখে রোডমার্চের আয়োজন করেছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করা। পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতায় নির্বাচন পরিচালনা করার কোন সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতের একটি রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করতে হলে সরকারকে নতুন করে সংসদে একটি বিল আনতে হবে। এটা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে নামকরণ করতে হবে, তার কোন মানে নেই। কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে, হতে পারে এটি একটি নির্দলীয় সরকার। এই নির্দলীয় সরকারে কারা থাকবেন, তা সংসদ ঠিক করে দিতে পারে। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করেই ওই নির্দলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব। বর্তমান প্রধান বিচারপতি তার দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসাবে এই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। বিকল্প হিসেবে ব্যারিস্টার রফিকুল হকের মতো সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে এই দায়িত্বটি দেয়া যেতে পারে। তিনজন গুণী ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি টিমও গঠন করা যেতে পারে, যাদের দায়িত্ব হবে শুধু একটি নির্বাচন পরিচালনা করা। তবে মূল কথা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধী দলের সম্মতি না পেলে কোন প্রস্তাবই জট খুলবে না। এ জন্য একটি সংলাপ অত্যন্ত জরুরি। সরকারের মন্ত্রীরা বারে বারে বিএনপির সংসদে আসা ও সেখানে গিয়ে প্রস্তাব দেয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে অতীতে বিরোধী দলকে সংসদে কথা বলতে দেয়া হয়নি। সংসদে গালি-গালাজ ও অতীত বারবার টেনে আনা হয়েছে। বিচারাধীন মামলা নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে। সংসদ হয়ে পড়েছে এক দলীয়। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সরকার এখন যে কাজটি করতে পারে, তা হচ্ছে নিজেদের উদ্যোগে একটি নির্দলীয় সরকারের কাঠামো সংসদে উপস্থাপন করা ও তা সংসদে পাশ করানো। মহাজোটের শরিকরাও পারে এ ধরনের একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করতে। বিএনপি ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে পারে, অথবা তাতে সংশোধনী আনতে পারে। এর মাধ্যমে সরকার তার আন্তরিকতা প্রমাণ করতে পারে। সরকার যদি এ ধরনের কোন প্রস্তাব না আনে, তাহলে রাজনৈতিক সঙ্কট আরো ঘনীভূত হবে। ১৯৯৬ সালেও বিএনপি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। কিন্তু ওই সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। ওই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাস হয়েছিল। এখন দেয়ালের লিখন থেকে সরকার কী কিছু শিখবে? সরকার যদি নমনীয় হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গল। পত্র পত্রিকায় যেসব জনমত প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় একটি নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত সবচেয়ে বেশি। সরকার যদি একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, আমার বিশ্বাস তাতে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে বৈ কমবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা দেয়ালের লিখন থেকে কেউ কিছু শিখি না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে একটি সমঝোতা প্রয়োজন। এ জন্য বিএনপির সাথে সংলাপ অত্যন্ত জরুরি। যদিও সংলাপের অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। অতীতেও সংলাপ কোন ফল বয়ে আনেনি। তবুও সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্পও নেই। এ ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নিদেন পক্ষে সংসদের স্পিকার একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিরপেক্ষ থেকে দুই প্রধান দলকে এক টেবিলে ডাকতে পারেন। কোন ধরনের পূর্ব শর্ত ছাড়াই আলোচনা হতে পারে। ওই আলোচনায় একটা সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব বলেই আমি মনে করি। মনে রাখতে হবে ইতোমধ্যে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্ন সেতু। ওই সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এমনি এক পরিস্থিতিতে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে যদি সমঝোতা না হয়, তাহলে বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে দেশ এক গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত হবে। এর ফলে প্রধান দু’টো দল আদৌ লাভবান হবে না। 
দৈনিক ইনকিলাব ,  নভেম্বর ২০১১। ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক,  অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিপ্লবের সংজ্ঞা হবে ..........

বলতে দ্বিধা নেই, এই অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এরা আন্দোলন গড়ে তুলছে। যেমনটি হয়েছিল কায়রোতে। তাহরির স্কয়ারের ঘটনা নিঃসন্দেহে অকুপাই মুভমেন্টকে অনুপ্রাণিত করেছে। মার্কস বলেছিলেন, শোষিতশ্রেণী হচ্ছে বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবকে সংগঠিত করবে ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তৎকালীন সময়ে জার্মান ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু সেখানে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায়। মাও জে ডং কৃষকদের সংগঠিত করে দীর্ঘ লংমার্চ করে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। একুশ শতকে এক তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য আর অক্ষমতার শিকার, তারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপীই একটি পরিবর্তন আনছে
বিশ্বব্যাপী আজ যে 'অকুপাই মুভমেন্টে'র জন্ম হয়েছে তা কি বিপ্লবের সনাতন সংজ্ঞাকে বদলে দিয়েছে? একুশ শতকে 'অকুপাই মুভমেন্ট'কে কেন্দ্র করে কী একটি 'বিপ্লব' সংঘটিত হবে? 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটে'র দৃষ্টান্ত নিউইয়র্ক ছেড়ে ছড়িয়ে পড়ছে আটলান্টিকের ওপারের দেশগুলোতে। একই সঙ্গে অকুপাই পোর্টল্যান্ড ক্যালিফোর্নিয়ার পোর্টল্যান্ড পোর্টে অনুষ্ঠিত হলেও তা ছড়িয়ে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পাড়ের দেশগুলোতে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রতিটি অকুপাই মুভমেন্টের পেছনে কাজ করছে একটি জিনিস, তা হচ্ছে সমাজন অসমতা, বৈষম্য ও অর্থনৈতিক ক্ষমতা সীমিত এক শ্রেণীর হাতে কেন্দ্রীভূত হওয়ার বিরুদ্ধে এক সরব প্রতিবাদ। নিউইয়র্কের 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' আন্দোলন ৬০ দিন পর ভেঙে দেওয়া হলেও এর রেশ রয়ে গেছে। আন্দোলন বন্ধ হয়নি। বিক্ষোভকারীরা দিনের পর দিন নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটের পাশে জুকোটি পার্কে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছিল। প্রচণ্ড শীত ও তুষারপাতের মধ্যেও শত শত বিক্ষোভকারী তাঁবু টানিয়ে তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছিল। আন্দোলনের এতটুকুও কমতি নেই। সর্বশ্রেণীর মানুষের সমর্থন তারা পেয়েছিল। ইন্টারনেটের মাধ্যমে তাদের আন্দোলনের খবর পেঁৗছে গিয়েছিল পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে। অকুপাই ওয়ালস্ট্রিটের মতো ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজা দখল করে নিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। এই আন্দোলনের নামকরণ করা হয়েছে October 2011 Movement. ১৯ নভেম্বর পর্যন্ত এই আন্দোলন পার করেছে ৪৫ দিন। October 2011 Movement -এর উদ্দেশ্য একটাই, যুদ্ধ ব্যয় কমানো (৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার) ও সামাজিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানো। বলা ভালো, জুকোটি পার্ক কিংবা ফ্রিডম প্লাজা বেছে নেওয়ার কারণ কিন্তু একটাই, জুকোটি পার্কের পাশেই রয়েছে ওয়ালস্ট্রিট, এখানে রয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শেয়ারবাজার, রয়েছে বড় বড় করপোরেট হাউসের সদর দফতর। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার মূল কেন্দ্র এখানে। আর ফ্রিডম প্লাজার কাছেই রয়েছে কংগ্রেস ভবন ও সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের অফিস। বিক্ষোভকারীরা এই দুটি জায়গা কেন বেছে নিল, তা বুঝতে আমাদের কষ্ট হয় না।
১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙন ও সমাজতন্ত্রের পতনের পর বিশ্বব্যাপী একটি ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, পুঁজিবাদই সমাজের মঙ্গল আনতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক কনজারভেটিভ তাত্তি্বক (ফুকিয়ামা) এই ধারণার স্বপক্ষে তাদের লেখনী অব্যাহত রাখেন। কিন্তু মাত্র ২০ বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হলো পুঁজিবাদও সমাজ বিকাশে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। পুঁজিবাদী সমাজেই একটি বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে। যেমন বলা যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের কথা। শতকরা ১৫ ভাগ মানুষ সেখানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। যুক্তরাষ্ট্রের সম্পদের ৫ ভাগের ১ ভাগের মালিক হচ্ছে জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ ভাগ। ১৯৭০ সালে ধনী শ্রেণীর হাতে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ অর্থ সঞ্চিত হতো। আজ ২০১১ সালে তারা ভোগ করে মোট সম্পদের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ১০ ভাগ আমেরিকান দেশটির মোট বেতনের ৪৯ দশমিক ৭ ভাগ বহন করে। শীর্ষে থাকা ১ ভাগ ধনী যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ৭০ ভাগের মালিক। আর জোসেফ স্টিগলিজের মতে, শীর্ষে থাকা এই ১ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে যুক্তরাষ্ট্রের মোট সম্পদের ৪০ ভাগ। এই ধনীরা এক রাতে জুয়াখেলায় হেরে যান লাখ লাখ ডলার। যুক্তরাষ্ট্রে এমন এক সমাজের সৃষ্টি হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে Casino capitalism . অথচ পরিসংখ্যান বলে, সেখানে ১৬ দশমিক ৪ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ৬৪ লাখ শিশু অত্যন্ত গরিব। জুকোটি পার্কে জমায়েত হওয়া অনেক তরুণ জানিয়েছে, তারা গ্র্যাজুয়েট করার পর চাকরি পাচ্ছে না। অথচ ২০১০ সালে করপোরেট হাউসগুলোর প্রধান নির্বাহীর বেতন বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে এই যে বৈষম্য, একই ধরনের বৈষম্য লক্ষ্য করা যায় পশ্চিম ইউরোপের অনেক দেশেই। এক ধরনের class warfaveÕ বা শ্রেণীযুুদ্ধের সূচনা হয়েছে পুঁজিবাদী সমাজে। অকুপাই মুভমেন্টগুলো তার বড় প্রমাণ। এই শ্রেণীযুদ্ধের কথা বলেছিলেন মার্কস। মার্কসের বিশ্লেষণে এই শ্রেণীদ্বন্দ্ব কোনো সমাজে বিপ্লবের সূচনা করতে পারে। মার্কস এবং অ্যাঙ্গেলসের বিখ্যাত The communist Manifesto গ্রন্থে এই শ্রেণীদ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে লিখেছিলেন, \'..a fight that each time ended, either in a revolutionary reconstitution of society at large, or in a common ruin of the contending classes. \' অর্থাৎ দ্বন্দ্বের ফলে সমাজে বিপ্লবী পরিবর্তন আসবে অথবা উভয় শ্রেণীর বিলুপ্ত ঘটবে। মার্কস চূড়ান্ত বিচারে শোষিতশ্রেণীর ক্ষমতা গ্রহণের কথা বলেছিলেন। সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব সনাতন। আজ এত বছর পরও শ্রেণীদ্বন্দ্বের প্রকাশ ঘটেছে অকুপাই মুভমেন্ট আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মার্কস আজও বেঁচে থাকলে যুক্তরাষ্ট্রের এই শ্রেণীদ্বন্দ্বকে কীভাবে বিশ্লেষণ করতেন বলতে পারব না। তবে নোয়াম চমস্কির লেখনীতে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থার চমৎকার বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সমাজকে আখ্যায়িত করেছেনPlutonomy হিসেবে অর্থাৎ সম্পদশালী ধনী শ্রেণীনির্ভর একটি সমাজ। নোয়াম চমস্কি লিখেছেন, ÔIncreasingly, wealth concentrated in the financial sector. Politiciasis faced with the rising cost of campaigns, were driven ever deeper into the Pockets of Wealthy backers.Õ এটাই হচ্ছে আসল কথা। সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে কিছু ধনিকশ্রেণীর হাতে। রাজনীতি-অর্থনীতি এরাই পরিচালনা করে। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসকে বলা হয় Billionaire friendly.Õ .' ধনিকশ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে কংগ্রেস। ধনীদের টাকায় কংগ্রেস সদস্যরা নির্বাচিত হন। এরপর কংগ্রেস সদস্যরা ধনীদের আরও সুযোগ-সুবিধা দেন। নোয়াম চমস্কি তাই আমেরিকার ওই অকুপাই মুভমেন্টে এতটুকুও অবাক হননি! তিনি লিখেছেন, The most exciting aspect of the occupy movement is the construction of the linkage that are taking place all over. If they can be sustained and expanded. Occupy can lead to dedicated efforts to set society on a moral human course. মার্কস যেখানে বিশ্বাসের কথা বলেছেন, সেখানে চমস্কি বলছেন, 'গড়ৎধষ যঁসধহ পড়ঁৎংব'-এর কথা। বিশ্বজুড়ে যে অকুপাই মুভমেন্ট পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে একটা সমন্বয় থাকা দরকার_ এটাও চমস্কির অভিমত। স্পষ্টতই যুক্তরাষ্ট্র তথা পুঁজিবাদী সমাজে একটি পরিবর্তন আসন্ন। কেননা দেখা যাচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজে অসমতা ও বৈষম্য বাড়ছে। পশ্চিম ইউরোপ এক সময় ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গর্ব করত। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ইউরোপীয় ঐক্যে একটি বড় ধরনের ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। গ্রিস ও ইতালির পরিস্থিতির রেশ ধরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভক্তির কথা প্রকাশ্যেই বলা হচ্ছে। ফ্রান্স ও জার্মানি এই বিভক্তির পক্ষে। কেননা ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত গরিব দেশগুলো দেউলিয়া হয়ে পড়েছে। এরা ঋণ গ্রহণ করে ঋণ পরিশোধ করতে পারছে না। প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। বেকার সমস্যা বাড়ছে। শ্রেণী-বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। জার্মানি ইউরোপে একটি ধনী রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত হলেও দেশটিতে দরিদ্রতার হার ৬ ভাগ আর বেকারত্বের হার ৬ দশমিক ৬ ভাগ। সুইজারল্যান্ড ইইউর সদস্য নয়। এখানে বেকারত্বের হার ২ দশমিক ৮ আর ৭ ভাগ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বেলজিয়ামে এই হার যথাক্রমে ৬ দশমিক ৮ ও ১৫ ভাগ। পর্তুগাল ঋণ সমস্যায় জর্জরিত। এখানে বেকারত্ব ও দরিদ্রতার নিচে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১২ দশমিক ৩ ও ১৮ ভাগ। শুধু ইউরোপের কথা কেন বলি। অস্ট্রেলিয়া, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা তাইওয়ানের মতো শিল্পোন্নত দেশেও অকুপাই মুভমেন্টের খবর আমরা জানি। কেননা এসব দেশেও বেকারত্ব বাড়ছে। দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে ওইসব দেশেও অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই, এই অকুপাই মুভমেন্টের জন্ম দিয়েছে তরুণ প্রজন্ম। সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এরা আন্দোলন গড়ে তুলছে। যেমনটি হয়েছিল কায়রোতে। তাহরির স্কয়ারের ঘটনা নিঃসন্দেহে অকুপাই মুভমেন্টকে অনুপ্রাণিত করেছে। মার্কস বলেছিলেন, শোষিতশ্রেণী হচ্ছে বিপ্লবের অন্যতম হাতিয়ার। শ্রমিকশ্রেণী বিপ্লবকে সংগঠিত করবে ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে। তৎকালীন সময়ে জার্মান ছিল শিল্পোন্নত দেশ। কিন্তু সেখানে বিপ্লব হয়নি। বিপ্লব হয়েছিল সামন্ততান্ত্রিক দেশ রাশিয়ায়। মাও জে ডং কৃষকদের সংগঠিত করে দীর্ঘ লংমার্চ করে বিপ্লব সম্পন্ন করেছিলেন। একুশ শতকে এক তরুণ প্রজন্ম, যারা বৈষম্য আর অক্ষমতার শিকার, তারা সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপীই একটি পরিবর্তন আনছে। এই পরিবর্তনকে 'বিপ্লব' বলা যাবে কি-না জানি না, কিন্তু একুশ শতকে বিশ্ব যে একটি পরিবর্তন লক্ষ্য করবে, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

কোন পথে আরব বিশ্ব ?

আরব বিশ্বের রাজনীতি এখন কোন পথে? গেল বছরের নভেম্বরে তিউনিসিয়ার দীর্ঘদিনের শাসক বেন আলির দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে যে পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছে তাতে গাদ্দাফির পতন ও মৃত্যুই শেষ কথা নয়। বরং পরিবর্তন আসছে সিরিয়ায়, সেখানে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দিন যত যাচ্ছে, দেশটিতে গণঅসন্তোষ তত বাড়ছে। গত প্রায় আট মাস ধরে সেখানে সরকারবিরোধী যে আন্দোলন হচ্ছে, তাতে প্রায় তিন হাজার ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছে। গাদ্দাফির মৃত্যুর পর প্রেসিডেন্ট আসাদকে কিছুটা নমনীয় মনে হয়। গত ২ নভেম্বর কায়রোতে আরব লিগের প্রস্তাবনায় সিরিয়ায় সহিংসতা বন্ধে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ওই চুক্তি অনুযায়ী সিরিয়ার বিভিন্ন শহর থেকে সেনা প্রত্যাহার, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি ও বিরোধী পক্ষগুলোর সঙ্গে আলোচনার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ওই চুক্তির ভবিষ্যত্ ইতোমধ্যে প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। কেননা চুক্তি স্বাক্ষরের পরও সিরিয়ার সেনাবাহিনী ট্যাঙ্ক ব্যবহার করেছে এবং একটি ঘটনায় ২৪ জন মানুষ হোমসে শহরে মারা গেছে। চলতি সপ্তাহে কায়রোতে সিরিয়ার সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে আলাপ শুরু হওয়ার কথা। এই আলোচনার ফলাফলের ওপর অনেক কিছুই এখন নির্ভর করছে। বলা ভালো, আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ ১৯৭১ সাল থেকেই সিরিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন। বাথ পার্টির মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা পরিচালনা করতেন। ২০০০ সালে তার স্বাভাবিক মৃত্যুর পর তার বড় সন্তান বাশার আল আসাদ ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
আরব বিশ্বের এই যে পরিবর্তন, এই পরিবর্তনের ঢেউ গিয়ে লেগেছে বাহরাইনেও। সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও শাসক হামাদ বিন ঈসা আল খলিফার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে। গত ৪ নভেম্বর রাজধানী মানামায় বড় ধরনের বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে নারীরা অংশগ্রহণ করেছেন। পুলিশের গুলিতে একজন বিক্ষোভকারী মারাও গেছেন। তিউনিসিয়া থেকে শুরু করে বাহরাইন পর্যন্ত সর্বত্রই সরকার পতনের আন্দোলন হচ্ছে। কোথাও কোথাও সরকারের পরিবর্তন হয়েছে এবং একটি গণতান্ত্রিক ধারাও সেখানে শুরু হয়েছে। তিউনিসিয়ায় সর্বজন গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং একটি ইসলামিক শক্তি সেখানে নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এন্নাহদার বিজয় আরব বিশ্বে নতুন এক রাজনৈতিক শক্তির জন্ম দিয়েছে। লিবিয়ায় গণ-আন্দোলনের মুখে গাদ্দাফির পতন হয়নি। একটি গৃহযুদ্ধে এবং বিদেশি শক্তির সামরিক হস্তক্ষেপে গাদ্দাফির সরকারের পতনই শুধু হয়নি, গাদ্দাফি নিজে নিহতও হয়েছেন। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়াতে কোন ধরনের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে তা নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আগামী আট মাসের মধ্যে সেখানে নির্বাচনের কথা বলছে। কিন্তু প্রশ্ন আছে অনেক। যদি লিবিয়াতে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়, তা হলে আরেকজন স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের আবির্ভাব হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। মুস্তাফা আবদেল জলিলের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন সেখানে যুদ্ধ পরিচালক করেছে এবং গাদ্দাফি-পরবর্তী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিলের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে থাকবে। অতীতে আবদেল জলিল গাদ্দাফির বিচারমন্ত্রী ছিলেন। পক্ষ ত্যাগ করে তিনি বিদ্রোহীদের দলে যোগ দেন। কিন্তু জিবরিল যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে সেখানেই বসবাস করেন। সম্ভবত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। জলিলের চেয়ে জিবরিল যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের খুব কাছের ব্যক্তি হবেন। যুদ্ধের কারণে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে চলে গেছে। গাদ্দাফি নিজেও অস্ত্রভাণ্ডার খুলে দিয়েছিলেন। ন্যাটোর বিমান থেকেও বিদ্রোহীদের জন্য অস্ত্র ফেলা হয়েছিল। এসব অস্ত্রের হদিস পাওয়া খুব কঠিন হবে। বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে ওইসব অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে। এই অস্ত্র আল কায়দার কাছে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ফলে গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় অস্ত্র একটি বড় ভূমিকা পালন করবে, যা গণতন্ত্রের উত্তরণে কোনো সাহায্য করবে না। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় ইসলামী জঙ্গিরা অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। বেশ কয়েকটি জঙ্গি গ্রুপের খবর পাওয়া যায়, যারা গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে; যেমন, বলা যেতে পারে Islamic Fighting Group (IFG), Abu Ubaidah-bin Januah Brigade, Abdel Hakim Belhadj Group, Tripoli Military Council কিংবা Salafi Group-এর কথা। এদের কারও কারও সঙ্গে আল কায়দার যোগাযোগ রয়েছে বলেও ধরে নেওয়া হয়। এক সময় IFG-কে পশ্চিমা শক্তি সমর্থন করেছিল। ১৯৯৬ সালে গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলনে IFG-কে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী দাঁড়ায় সেটা দেখার বিষয়। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে রাজনৈতিক দল ব্যবস্থাপনা, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা-যা লিবিয়াতে নেই। এখানে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। এখন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সদস্যরা একাধিক দলের জন্ম দিতে পারেন এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন। লিবিয়ায় বেকার সমস্যা প্রকট। জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ বেকার। লিবিয়ায় বিশাল তেলের রিজার্ভ থাকলেও তেলনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। লিবিয়ার জনগোষ্ঠীর ৪০ ভাগ হচ্ছে তরুণ। এদেরকে মূল ধারায় নিয়ে আসা, চাকরির ব্যবস্থা করা হবে কঠিন কাজ। না হলে এখানে চিরস্থায়ী একটি অস্থিতিশীলতা থাকবেই। লিবিয়া গোত্রকেন্দ্রিকভাবে বিভক্ত। গোত্রের লোকজন একত্রিত হয়ে মরুভূমি তথা পাহাড়ের নিচে বসবাস করেন। এরা আধুনিকমনস্ক নন। গাদ্দাফি যে গোত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা গাদ্দাফির মৃত্যুকে সহজভাবে নেবেন না। ফলে একধরনের বিরোধিতা থেকেই যাবে। উপরন্তু দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বিরোধের জন্ম হয়েছে। তেল কূপগুলো পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চল থেকে। গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রভাব বাড়বে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর আগ্রহ মূলত লিবিয়ার তেল ও গ্যাসের কারণে। বিশ্বের রিজার্ভের ৩৫ ভাগ তেল রয়েছে লিবিয়ায়, যার পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন ব্যারেল। গ্যাস রিজার্ভ রয়েছে ১ হাজার ৫০০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। যুদ্ধের আগে প্রতিদিন তেল উত্তোলিত হতো এক দশমিক তিন মিলিয়ন ব্যারেল থেকে এক দশমিক ছয় মিলিয়ন ব্যারেল। ভূমধ্যসাগরের নিচ দিয়ে পাইপের সাহায্যে এই গ্যাস যায় ইতালিতে (ত্বেবহংঃত্বধস চরঢ়বষরহব)। লিবিয়ার অভ্যন্তরে মাত্র এক ডলারে তেল পাওয়া যেত। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেলপ্রতি তেলের মূল্য ৮০ ডলার। সুতরাং আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর স্বার্থটা কোথায় তা সহজেই অনুমেয়। লিবিয়ার পুনর্গঠনের নামে তখন লিবিয়াতে ব্যবসা খুঁজবে মার্কিনি কোম্পানিগুলো। আর লিবীয় সরকারকে তেল বিক্রি করে (অতিরিক্ত তেল উত্তোলন করে) পুনর্গঠনের বিল পরিশোধ করতে হবে। ঠিক যেমনটি হয়েছে ইরাকে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাটেজিতে লিবিয়ার অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পেন্টাগন জবনঁরষফরহম অসবত্রপধহ উবভবহংব শীর্ষক যে দীর্ঘ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, তাতে লিবিয়া একটি ফ্যাক্টর। লিবিয়ার প্রশাসনকে যদি হাতে রাখা যায়, তা হলে উত্তর আফ্রিকা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। লিবিয়া নিয়ন্ত্রণে এলে পার্শ্ববর্তী শাদ ও নাইজারও নিয়ন্ত্রণে আসবে। শাদ ও নাইজারে রয়েছে তেল ও ইউরেনিয়াম, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই প্রয়োজন। একুশ শতকে যে নতুন আফ্রিকার জন্ম হতে যাচ্ছে, সেখানে ফরাসি ভাষাভাষী অঞ্চলে কর্তৃত্ব বাড়বে যুক্তরাষ্ট্রের। কঙ্গো, রুয়ান্ডা, আইভরি কোস্ট ছিল একসময় ফ্রান্সের কলোনি। ফরাসি ভাষা এখানে সরকারি ভাষা। এ অঞ্চলে তখন বাড়বে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব। ইতোমধ্যেই আফ্রিকাতে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নতুন একটি মিলিটারি কমান্ড অঋজওঈঙগ। এ জন্য লিবিয়ায় ‘বন্ধুপ্রতিম’ সরকারের খুব প্রয়োজন ছিল। গাদ্দাফির মত্যু এই হিসাবটা সহজ করে দিল। লিবিয়ার ঘটনাবলি দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, পৃথিবীর যেকোনো রাষ্ট্রের সরকারকে উত্খাত করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র রাখে। তবে অবশ্যই সেই সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের অপছন্দের হতে হবে। অতীতে গাদ্দাফিকে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ইরাকে সাদ্দামের বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র গাদ্দাফিকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় গাদ্দাফিকে চলে যেতে হল। এভাবে একটি স্বাধীন দেশে ন্যাটোর বিমানবহর দিয়ে হামলা কোনো আন্তর্জাতিক আইন অনুমোদন করে না। এটা স্পষ্টতই আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ। নিরাপত্তা পরিষদ লিবিয়ায় তথাকথিত ‘গণহত্যা’(?) ঠেকাতে ন্যাটোর বিমান হামলার অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের কোনো অনুমতি দেয়নি। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে নিরাপত্তা পরিষদে এ কথাগুলো আর কেউ বলবে না। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আফ্রিকায় সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই লিবিয়ায় সরকার পরিবর্তন হল।
প্রশ্ন হচ্ছে, সমগ্র আরব বিশ্বের এই যে পরিবর্তন, এই পরিবর্তন কি সেখানে একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দেবে? তিউনিসিয়ায় এন্নাহদা পার্টির উত্থান সেখানে একটি ‘তুরস্ক মডেলের’ জন্ম দিতে যাচ্ছে। তুরস্কে ইসলাম আর গণতন্ত্রের সমন্বয়ে নতুন এক রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হয়েছে। তুরস্কে ইসলামপন্থীরা কট্টরপন্থী নন। এরা আল কায়দাকে সমর্থনও করে না। বরং আল কায়দার রাজনীতিকে সমালোচনা করে। আধুনিকমনস্ক তুরস্কের নেতৃত্ব ইসলামিক বিশ্বে নতুন এক ইমেজ নিয়ে এসেছে। এন্নাহদার নেতা ঘান্নুচি তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী এরদোগানের রাজনীতির অনুসারী। এ কথা তিনি স্বীকারও করেছেন। একসময় মিসরের ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির রাজনীতিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন ঘান্নুচি। এখন সেখান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। ‘তুরস্ক মডেল’ এখন তার কাছে আদর্শ। আগামী ২৮ নভেম্বর মিসরে সংসদ নির্বাচন। সেখানে ইসলামিক ব্রাদারহুড পার্টির বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কোন পর্যায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটাই দেখার বিষয়। সামরিক জান্তা প্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাবি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলেই ধারণা করা হচ্ছে। দেশটিতে অশান্ত পরিস্থিতি দিন দিন বাড়ছে। এখানে ইসলামপন্থীদের ক্ষমতা পরিচালনা করা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। ইয়েমেনের পরিস্থিতি একটু ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট সালেহ ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনও পর্যন্ত সেই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখেননি। তুলনামূলক বিচারে আল কায়দা অনেক শক্তিশালী ইয়েমেনে। এখানে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর বিজয়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। তরুণ সমাজ সেখানে সালেহবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। কিন্তু তাদের কোনো সংগঠন নেই। তবে আল কায়দার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে একটা ভয় থেকেই গেল। সিরিয়াতেও এদের তত্পরতা রয়েছে।
স্পষ্টতই আরব বিশ্বে ইসলামিক শক্তির উত্থান ঘটেছে। ১৯৫২ সালে মিসরে জামাল আবদুন নাসেরের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে আরব জাতীয়তাবাদী রাজনীতির জন্ম হয়েছিল, যা ছড়িয়ে গিয়েছিল প্রতিটি আরব রাষ্ট্রে। এখন তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্রমনা একটি ইসলামিক শক্তির উত্থান সমগ্র আরব বিশ্বে ছড়িয়ে যায় কি না সেটাই দেখার বিষয়।দৈনিক সকালের খবর, ২৩ নভেম্বর ২০১১। ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক,  অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

প্রসঙ্গ : উচ্চশিক্ষা কমিশন

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নামের পরিবর্তন হচ্ছে। নামটি পরিবর্তন করে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন বা হেক। ইউজিসি থেকে হেক, পরিবর্তনটা কী শুধু নামের? নাকি কাজেরও? ১৯৭৩ সালে মঞ্জুরি কমিশন গঠিত হয়েছিল। যে আইন বলে ইউজিসি গঠিত হয়েছিল, ২০১১ সালে এসে ওই আইন অচল। সুতরাং পরিবর্তনটা প্রয়োজন ছিল। এটা যুগের চাহিদা। সুতরাং নাম পরিবর্তন ও আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল, এটা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু যেভাবে জগাখিচুড়ি আকারে প্রস্তাবিত 'বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন-২০১১' আইনটি সংসদে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমার আপত্তি রয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পূর্ণকালীন সদস্য পাঁচজনই রেখে দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে আরো ১১ জন খ-কালীন সদস্য নেওয়া হচ্ছে, যাদের মাঝে থাকবেন দুইজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি। বর্তমান কাঠামোয়ও খ-কালীন সদস্যরা রয়েছেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে ইউজিসি পরিচালনায় এরা কোনো ভূমিকা রাখেন না। ফলে উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও খ-কালীন সদস্যরা আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না। সুতরাং খ-কালীন সদস্যদের নিয়ে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। উপরন্তু এতে করে কমিশনের ব্যয় বরাদ্দ বেড়ে যাবে।
সংবাদপত্রে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার মান উন্নয়ন। তার এ বক্তব্যে আমি উৎফুল্ল হয়েছি। মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলে বাহবা নেন। তিনিও নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি কি বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করতে পারি, গত ৪৬ মাসে আপনার মন্ত্রণালয় উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? ঢালাওভাবে ও দলীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ যদি শিক্ষার মানোন্নয়নের মাপকাঠি হয়, আমার বলার কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহলে অভিযোগ আছে, একটি 'সিন্ডিকেট' তৈরি হয়েছে। এরা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়ভাবে একের পর এক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে চলছে। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কমিটির সদস্য। তারা 'বিশেষ ক্ষমতা' ভোগ করেন। সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে রয়েছে তাদের যোগাযোগ। বিশেষ ক্ষমতা তাদের এত বেশি ক্ষমতাশালী করেছে যে কোনো উপাচার্যের পক্ষেই তাদের অবজ্ঞা করা সম্ভব হয় না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই সিন্ডিকেটের একজন সদস্যের ছেলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগও হয়েছে অতি সম্প্রতি। এসব নিয়োগ যদি শিক্ষার মানোন্নয়নের মাপকাঠি হয়, আমি দুঃখিত।
বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন-২০১১-এর খসড়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি বলে আমি মনে করছি। প্রথমত, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিশ্চিত করার স্বার্থে একটি আলাদা কমিশন গঠন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে একটি কমিশনের আওতায় যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাখা হয়, তাহলে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আলাদা ভিডিশন হিসেবে এটাকে রাখতে হবে। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা কমিশনে দুটো ভিডিশন থাকবে_একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, অপরটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। মনে রাখতে হবে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধরন এক নয়। ব্যবস্থাপনাও এক নয়। সংগত কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যত না নজরদারিতে থাকবে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নজরদারিতে থাকবে বেশি। দ্বিতীয়ত, মাত্র ৫ জন পূর্ণকালীন সদস্য দিয়ে প্রায় একশটি (পাবলিক ও প্রাইভেট) বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ জন্য সদস্যসংখ্যা নূ্যনতম দশজন করা উচিত। নূ্যনতম পাঁচজন সদস্যকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া উচিত। একজনের পক্ষে ৫৬টি (আরো নূ্যনতম ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের অপেক্ষায়) বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করা সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালোর জন্য একটি 'সহযোগী পরামর্শক' সংস্থা থাকতে পারে, যারা কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তারা পরামর্শ দেবেন। এ সংস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে। এমনকি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। উচ্চশিক্ষা কমিশনের নীতিনির্ধারণী কাঠামোয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো প্রতিনিধি থাকতে পারবে না। চতুর্থত, বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটি ভালো ও প্রশংসাযোগ্য। পঞ্চমত, প্রস্তাবিত আইনে শিক্ষার মান ও রেটিং নিশ্চিত করার স্বার্থে একটি 'অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল' গঠন করার বিধান রাখা হয়েছে কিনা, আমি নিশ্চিত নই। এটা অবশ্যই থাকা উচিত। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল থাকা উচিত। কেননা ইতিমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেই একধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ বৈষম্য কমিয়ে আনার স্বার্থেই অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল থাকা উচিত।
মূল কাঠামোতে এসব বিষয় থাকা উচিত। এর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য রেগুলেশন ও স্ট্যাটিউট থাকা উচিত। বিশেষ করে স্ট্যাটিউটে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত বিধি-বিধানে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। এখন এ ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য কিছু ক্ষমতা ভোগ করেন)। উপাচার্যের মর্জির কাছে অনেক ভালো ছাত্রও শিক্ষক হতে পারে না। এ কারণেই পিএসপির মত একটি কাঠামো দাঁড় করানো যায় কিনা, তা ভেবে দেখা যেতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করবে উচ্চশিক্ষা কমিশন। একই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। মালিকপক্ষ যা চায়, তাই হয়। আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় 'অধ্যাপক' তথা 'ডক্টরেট' ডিগ্রি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। যিনি কোনোদিন শিক্ষকতা করেননি, তিনি দিব্যি ক্ষমতার বলে অধ্যাপক পদবি ব্যবহার করছেন। আমি একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিনি, যারা কোনোদিন শিক্ষকতা করেননি। শিক্ষকতা না করে উপাচার্য হয়েছেন! রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। সরকারি চাকুরে, কলেজ থেকে অবসর নিয়ে অনেক 'শিক্ষক' এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও এরা আদৌ শিক্ষকতা করার ক্ষমতা রাখেন কিনা, তা দেখার কেউ নেই। আরো একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে_ পিতার বা স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজ সন্তান বা স্ত্রীকে উপাচার্য বানানোর পাঁয়তারা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবারের সন্তানদের চাকরির ক্ষেত্র হতে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভাল করা জরুরি। তদারকিটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত কাঠামোয় এর বিধান থাকা উচিত। মঞ্জুরি কমিশনের সচিবালয়কে শক্তিশালী করাও প্রয়োজন। একজন সচিবের নেতৃত্বে বিশাল এ কর্মকা- পরিচালনা করাও অসম্ভব। প্রস্তাবিত আইনে এ ব্যাপারে বিশেষ দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।
শুধু নাম পরিবর্তন করেই শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যাবে না। চাই আন্তরিকতা। চাই বলিষ্ঠ উদ্যোগ। শুধু লোক দেখানো একটি উদ্যোগ যদি নেওয়া হয়, তাতে চেয়ারম্যানের মর্যাদা হয়ত বাড়বে (প্রতিমন্ত্রীর বা পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা), কিন্তু শিক্ষার মানের তাতে উন্নতি হবে না।
ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক,  অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

ইউরোপীয় ইউনিয়নে বিভক্তি কি আসন্ন?

ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট যখন একক মুদ্রা ইউরোর ভবিষ্যৎকে একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে, তখন অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কল্পনাতেই থেকে যেতে পারে। ২০১১ সালের মাঝামাঝি সময়ে অর্থনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত অভিন্ন ইউরোপের ধারণাটি কোন অমূলক ধারণা ছিল না। বরং ১৯৫৭ সালে ইউরোপিয়ান কমিউনিটি সৃষ্টির পর ১৯৯২ সালের ফেব্র“য়ারিতে স্বাক্ষরিত মাসট্রিচট চুক্তি ছিল অভিন্ন ইউরোপ গঠনের লক্ষ্যে একটি বড় ধরনের পদক্ষেপ। মাসট্রিচট চুক্তিতে একটি একক মুদ্রা ও একটি ইউরোপীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এরপর ১৯৯৭ সালের মার্চ মাসে সেঙেন চুক্তি এবং ১৯৯৯ সালের ১ জানুয়ারি ইউরোপের একক মুদ্রা ইউরো চালুর সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে অভিন্ন এক ইউরোপের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল ইউরোপ। বলা ভালো, ১৯৯৩ সালের ১ নভেম্বর ইউরোপীয় কমিউনিটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) নাম ধারণ করে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইতিমধ্যে সম্প্রসারণ ঘটেছে। পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ২০০৪ ও ২০০৭ সালে বেশ ক’টি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইইউতে যোগ দিয়েছে। ইইউর সদস্য সংখ্যা এখন ২৭। ১৯৯৯ সালে তৎকালীন ইইউর ১৫টি দেশের মাঝে ১১টি দেশে ইউরো চালু করেছিল। এখন চালু রয়েছে ১৭টি দেশে। ইউরো চালু হওয়ার সময়ই ইউরো নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তখন বলা হয়েছিল, ইউরোপের উত্তরের ধনী দেশগুলো ইউরো চালু হলে এ থেকে সুবিধা নিতে পারে। আজ এত বছর পর এই আশংকাই সত্যে পরিণত হল। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালে ইউরো চালু হওয়ার সিদ্ধান্ত হলেও তিন বছর পর্যন্ত নিজ নিজ দেশের মুদ্রা চালু থাকে এবং ২০০২ সালের জুলাই মাসে ইউরোর কাগজি ও ধাতব মুদ্রা চালু হওয়ার পর পুরনো মুদ্রা বাতিল হয়ে যায়। গত ৯ বছর ইউরো নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন দেখা না দিলেও চলতি বছরের প্রথম দিকে ইইউ’র কয়েকটি দেশ বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। দেশগুলো ঋণ শোধ করতে না পেরে অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়ে। ইতিমধ্যে পাপেন্দ্র“র নেতৃত্বাধীন গ্রিস সরকারের পতন হয়েছে ও পাপাদেমস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। একই সঙ্গে ইতালির প্রধানমন্ত্রী বার্লুসকোনিও পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন।
পাপেন্দ্র“ ও বার্লুসকোনির পরিণতি প্রমাণ করে ইউরোপ কী বড় ধরনের অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারগুলো প্রচুর ঋণ গ্রহণ করেও সেই ঋণ শোধ করতে পারছে না। ধীরে ধীরে রাষ্ট্র দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন অর্থনৈতিকভাবে হস্তক্ষেপ করলেও সেই দেউলিয়া রোধ করতে পারছে না। গ্রিস কিংবা ইতালি কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের কথা ঘোষণা করলেও জনসাধারণ তার বিরোধিতা করছে। তারা দিনের পর দিন বিক্ষোভ মিছিল করছে। গ্রিসের পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) গ্রিসকে ‘উদ্ধারের’ জন্য যে ঋণ দিয়েছে, তা ছিল শর্তযুক্ত। ওই শর্ত মেনেই আবাসন করের ওপর একটি বিল পাস করেছে গ্রিসের সংসদ। পাশাপাশি কমানো হয়েছে পেনশন। কমানো হয়েছে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা। গ্রিসের রাস্তায় বিক্ষোভ তাই নিত্যদিনের চিত্র। এ চিত্র আজ ইতালিতেও লক্ষ্য করা যায়। অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ইতালি ও গ্রিসের বাইরে আয়ারল্যান্ড ও পর্তুগালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বেশ নাজুক। গ্রিসে ২০১০ সালে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১৩ ভাগ। আর দেশটির ঋণ পরিস্থিতি জিডিপির ১০০ ভাগকেও ছাড়িয়ে গেছে। ফলে গ্রিসের পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছিল যে, সরকারি কর্মচারীদের বেতন পর্যন্ত দিতে পারছিল না সরকার। এমন এক পরিস্থিতিতে আইএমএফ ও ইউরো জোনের দেশগুলো ৩ বছরের জন্য ১১০ বিলিয়ন ইউরো ঋণ দেয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু শর্ত হিসেবে ঘাটতি কমানোর কথা বলা হলে তা মারাÍক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। আয়ারল্যান্ডে ২০০৯ সালে যেখানে ঘাটতি ছিল জিডিপির ১১ ভাগ, সেখানে ২০১০ সালে তা উন্নীত হয় ৩১ ভাগে। পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য ৮৫ বিলিয়ন ইউরোর একটি ‘উদ্ধার কর্মসূচি’ ঘোষণা করা হয়েছে। পর্তুগালের পরিস্থিতি আরও খারাপ। ২০০৯ সালে ঋণের পরিমাণ ছিল জিডিপির ৭৬ ভাগ। আর ২০১১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১১৫ ভাগে। ফলে ২০১১ সালের মার্চে সেখানে সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে এবং পর্তুগালকে ঋণ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের জন্য ৭৮ মিলিয়ন ইউরো ঋণ গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত স্বল্পোন্নত দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। বড় অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত জার্মানি কিংবা ফ্রান্স ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কম। এ কারণেই একক মুদ্রা হিসেবে চালু হওয়া ইউরোর ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। ইতিমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে জাতীয় মুদ্রায় আবার ফিরে যেতে। বলা হচ্ছে, জাতীয় মুদ্রায় ফিরলে সমস্যার সামধান হবে। ইউরোপের স্বল্পোন্নত বা গরিব দেশগুলোর ধারণা, ইউরো চালু হওয়ার পর ইউরোপের শক্তিশালী (অর্থনেতিক দিক থেকে) ও দুর্বল দেশগুলোর মধ্যে একটা ব্যবধান তৈরি হয়ে গেছে। তাদের ধারণা, ইউরো তাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে শক্তিশালী দেশগুলো তাদের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিয়েছে। প্যাকেজ ভর্তুকি ও ঋণ দিয়েও সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। ফলে নিজ মুদ্রায় ফিরে যাওয়ার দাবি কোন কোন মহলে উচ্চারিত হচ্ছে।
‘ইউরো জোন’-এর এই অর্থনৈতিক সংকট ইউরোপের ঐক্যকে বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন টিকবে কিনা সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। অথচ একসময় ইউরোপীয় ইউনিয়নকে একটা মডেল হিসেবে ধরা হতো। ইতিমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আমরা ‘দক্ষিণ এশীয় ইউনিয়ন’ গঠনের কথা শুনেছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সমন্বয়ে অদূর ভবিষ্যতে একটি ‘এশীয় ইউনিয়ন’ গঠিত হতে পারে, এমন ধারণাও করেছিলেন কেউ কেউ। এখন ইউরো জোনের সংকটের ফলে নতুন করে এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। এখানে বলা ভালো, ১৯৫৭ সালে মাত্র ৬টি দেশ নিয়ে (বেলজিয়াম, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, হল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ) ইউরোপীয় ঐক্যের (ইইসি) যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) পরিণত হয়েছে। ইউরোপের ২৭টি দেশ এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য। বেশ কটি পূর্ব ইউরোপের দেশ ইতিমধ্যে শুধু ইইউতেই যোগ দেয়নি, বরং ন্যাটোতেও যোগ দিয়েছে। ন্যাটোর এই সম্প্রসারণ নিয়েও নানা কথা রয়েছে। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মাঝে ২৪টি দেশ এখন ন্যাটোর সদস্য।
ইউরোপে এরই মাঝে বেশ কয়েকটি সংস্থার জš§ হয়েছে, যে সংস্থাগুলো ইউরোপীয় ঐক্যকে ধরে রেখেছে। যেমন বলা যেতে পারে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, ইউরোপীয় কাউন্সিল, ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় আদালত, নিরীক্ষক দফতর, অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিটি, আঞ্চলিক কমিটি, ইউরোপীয় ব্যাংক এবং ইউরোপীয় মুদ্রা ইন্সটিটিউট ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কথা। এই সংস্থাগুলো অভিন্ন ইউরোপের ধারণাকে শক্তিশালী করেছে। কিন্তু ইউরোপের অর্থনৈতিক মন্দা পুরো দৃশ্যপটকে এখন বদলে দিল। এখন শুধু ইউরোই নয়, বরং খোদ ইউরোপীয় ইউনিয়নের অস্তিত্ব প্রশ্নের সম্মুখীন। যে যুক্তি তুলে এক সময় ব্রিটেন ও ডেনমার্ক ইউরো জোনে (এক মুদ্রা নিজ দেশে চালু) যোগ দিতে চায়নি, সেই যুক্তিটি এখন সত্য বলে প্রমাণিত হল। অর্থনৈতিক সংকট থেকে উদ্ধারের কাজটি অত সহজ নয়। একটি দেশের সমস্যায় অন্য দেশ আক্রান্ত হচ্ছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে ইউরোর ভবিষ্যৎ নিয়ে। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়, তা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বর্তমান কাঠামো আদৌ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কিনা?
২০০৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যখন তার ৫০তম পূর্তি উৎসব পালন করে তখনই বার্লিন ঘোষণার মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, ইইউর মাঝে বিভক্তি আছে। লুক্সেমবার্গ ইউরোপের অন্যতম প্রধান অর্জন হিসেবে ইউরোর মুদ্রার কথা উল্লেখ করেছিল। অথচ মাত্র তিন বছরের মধ্যেই প্রমাণিত হল, ইউরো সব দেশের স্বার্থ রক্ষা করতে পারছে না। ব্রিটেন ও ডেনমার্ক প্রথম থেকেই ইউরোকে প্রত্যাখ্যান করে আসছিল। পোল্যান্ড ও ইতালি চেয়েছিল ইউরোপের ক্রিশ্চিয়ান মূল্যবোধকে প্রাধান্য দিতে। কিন্তু ফ্রান্স এর বিরোধিতা করেছিল। দেশটি ধর্মকে আলাদা রাখতে চেয়েছিল। চেক রিপাবলিক ও পোল্যান্ড নিরাপত্তার বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিলেও ফ্রান্স ও জার্মানি এটা নিয়ে চিহ্নিত ছিল এ কারণে যে, নিরাপত্তার বিষয়টিতে যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ রাশিয়াকে ক্ষেপিয়ে তুলতে পারে। জার্মানি ও স্পেন ইইউ’র জন্য নতুন একটি সাংবিধানিক চুক্তি করতে চাইলেও ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ডস ছিল এর বিরোধী। পূর্ব ইউরোপের সাবেক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোও তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৮৯ সালে ‘ভেলভেট রেভ্যুলিউশন’ এই দেশগুলোকে সোভিয়েতনির্ভরতা থেকে বের হয়ে আসতে সাহায্য করে। সেখানে সমাজতন্ত্রের পতন হয় ও দেশগুলো গণতন্ত্রের পথে ধাবিত হয়। কিন্তু ২০০৪ সালের আগে পূর্ব ইউরোপের কোন দেশই ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারেনি। এই দেশগুলোর ওপর কোপেনহেগেন ফর্মুলা চালিয়ে দেয়া হয়েছিল। কোপেনহেগেন ফর্মুলায় কতগুলো শর্ত দেয়া হয়েছিল, যা পূরণ করলেই ইইউ’র সদস্যপদ পাওয়া যাবে। শর্তগুলোর মধ্যে ছিল গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু, মুক্তবাজার অর্থনীতি প্রবর্তন, মানবাধিকার রক্ষা, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। এসব শর্ত পূরণ হওয়ার পরই কয়েকটি পূর্ব ইউরোপীয় দেশ ২০০৪ ও ২০০৭ সালে ইইউতে যোগ দেয়। বসনিয়া-হারজেগোভিনা ও ক্রোয়েশিয়া এখনও ইইউতে যোগ দিতে পারেনি। এখন অর্থনৈতিক সংকট সব সংকটকে ছাপিয়ে গেছে। ঋণ সংকটে জর্জরিত ইউরোপে আবারও মন্দার আশংকা বাড়ছে। সামনের বছর ইউরো ব্যবহারকারী ইউরো জোনের প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা শূন্য দশমিক পাঁচ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশংকা করা হচ্ছে। এর ফলে ইইউর ঐক্য নিয়ে যে সন্দেহ, তা আরও বাড়বে। ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোকে দুই স্তরে বিভক্ত করার প্রস্তাব উঠেছে। জার্মানি ও ফ্রান্স একটি দুই স্তরবিশিষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন চাচ্ছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট সারকোজি খোলামেলাভাবেই এই বিভক্তির কথা বলছেন। জার্মানির চ্যান্সেলর মার্কেলও চাচ্ছেন একটা পরিবর্তন। তিনি বলছেন এক নয়া ইউরোপ গড়ার কথা। যদিও এই বিভক্তির বিরোধিতা করছেন ইউরোপীয় কমিশনের চেয়ারম্যান জোসে ম্যানুয়েল বারোসো। এখন সত্যি সত্যিই ইউরোপ ভাগ হয়ে যাবে কিনা কিংবা ‘নতুন ইউরোপ’-এর স্বরূপ কী হবে, তা এই মুহূর্তে বলা খুব কঠিন। তবে একটি পরিবর্তন যে আসবেই, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক,  অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

বান কি মুনের সংলাপের আহ্বান এবং দেশের বর্তমান রাজনীতি...

জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন তার বাংলাদেশ সফরের সময় এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে সংলাপই হচ্ছে গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর পথ। সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথাও জানিয়েছেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকবে কি থাকবে না, বিষয়টি নির্ভর করছে বাংলাদেশের জনগণের ওপর। তবে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ওপর তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন। বান কি মুন এই মন্তব্যটি করলেন এমন একটি সময় যখন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দুটো রোডমার্চের পর তৃতীয় আরেকটি রোডমার্চ করতে যাচ্ছে আগামী ২৬ ও ২৭ নভেম্বর। সরকারের পতন, মধ্যবর্তী নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতেই বিএনপির এই রোডমার্চ। যদিও এককভাবে বিএনপি এই রোডমার্চে অংশ নিচ্ছে না। চারদলীয় জোটের বাইরে আরো কিছু ছোট ছোট দল এই রোডমার্চে অংশ নিচ্ছে।
সরকার ও বিরোধী দল যখন পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে একটি 'অবস্থান' নিয়েছে, তখন একটি রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে বান কি মুনের মতো ব্যক্তিত্ব এই আহ্বান জানালেন। এর গুরুত্ব রয়েছে বৈকি। এই আহ্বান গুরুত্বপূর্ণ আরো একটি কারণে। আর তা হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও বাংলাদেশে এর প্রতিক্রিয়া। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ইতোমধ্যেই আক্রান্ত। গ্রিস ও ইতালিতে সরকারের পতন হয়েছে। আর অকুপাই ম্যুভমেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের এক শহর থেকে অন্য শহরে ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের অবস্থাও ভালো নয়। গত ৩ মাসে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ২৩ শতাংশ। জুলাই-সেপ্টেম্বরে এই ঘাটতির পরিমাণ ১৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ বেশি। অন্যদিকে সরকারের ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সরকার ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিচ্ছে। ১ নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ১৬ হাজার ৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। যা চলতি অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৮৪ শতাংশ। আর দৈনিক হিসেবে সরকারের ব্যাংক ঋণের গড় ১৩৩ কোটি টাকা। নতুন নোট ছেপে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ছে। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি কোনো আশার কথা বলে না।
সরকার ইতোমধ্যে তাদের ৩৪ মাসের শাসনকাল পার করেছে। এ ক্ষেত্রে খুব সঙ্গত কারণেই সরকারের 'পারফরমেন্স' বিচার করা যায়। গত ৩৪ মাসে একাধিক সেক্টরে সরকারের ব্যর্থতা প্রকট। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নের মুখে। সরকার জ্বালানি তেলের দাম আরো এক দফা বাড়িয়েছে। এখন শোনা যাচ্ছে সিএনজি এবং বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হবে। সরকারের ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বাড়ছে। কারণ দাতারা তাদের প্রতিশ্রুতি দেয়া ঋণ বন্ধ করে দিয়েছে। ব্যাংক থেকে অতিরিক্ত ঋণ নেয়ার কারণে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। খোদ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ দুর্নীতির প্রশ্ন তুলেছে। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির অভিযোগ করেছে স্বয়ং বিশ্বব্যাংক। অথচ যোগাযোগমন্ত্রী এখনো তার পদে বহাল আছেন। অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশ হলে মন্ত্রী পদত্যাগ করতেন। শেয়ারবাজার নিয়ে 'জুয়াখেলা' এখনো বন্ধ হয়নি। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা অনশন পর্যন্ত করেছেন। কিন্তু তাতে সরকারের এতটুকু টনক নড়েছে বলে মনে হয় না। মূল্যস্ফীতি এখন সর্বকালের শীর্ষে। বিদেশ থেকে রেমিট্যান্সের প্রবাহ কমে গেছে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতায় সাধারণ মানুষের এখন নাভিশ্বাস। তারা চায় একটি পরিবর্তন। তাই সাধারণ মানুষ যে বেগম জিয়ার প্রতি সমর্থন ছুড়ে দেবে এটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বলে। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই আস্থা ও বিশ্বাস নেই। সরকারি দল বিরোধী দলকে 'শত্রু' মনে করে। প্রধানমন্ত্রী লালমনিরহাটের পাটগ্রামের সমাবেশে বলেছেন, 'জোট সরকারের মন্ত্রীর দুর্নীতিতে পদ্মা সেতুর ঋণ স্থগিত হয়েছে' (সকালের খবর, ২০ অক্টোবর)। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে, তা রীতিমত এক প্রশ্ন। কেননা বর্তমান সরকারের যোগাযোগমন্ত্রীর দুর্নীতির প্রশ্নই তুলেছিল বিশ্বব্যাংক। আর জোট সরকার ক্ষমতা ছেড়েছে ৫ বছর আগে। পাঁচ বছর আগের দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক তোলেনি।
আসলে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সরকারকে এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখার কাজটি করে বিরোধী দল। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলাদেশে বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিরোধী দলকে আদৌ গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া হয়নি। 'ব্রুট মেজরিটির' জোরে সরকার প্রতিটি সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে সংসদে ও সংসদের বাইরে 'চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স'-এর অভাবেই রাষ্ট্র একনায়কতান্ত্রিক হয়ে ওঠে। ইতিহাসে এর ভুরি ভুরি প্রমাণ রয়েছে। বাংলাদেশের বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে এই 'চেকস অ্যান্ড ব্যালেন্স'-এর অভাবটি অত্যন্ত প্রবল। সরকার এককভাবে যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেই সিদ্ধান্তের চ্যালেঞ্জ করার কেউ নেই। সরকার বিরোধী দলের মতামত গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তাও বোধ করে না। বাংলাদেশের গণতন্ত্রের একটা বড় সমস্যা হচ্ছে সংসদকে কার্যকর না করা। পঞ্চম জাতীয় সংসদ থেকে সংসদ বয়কটের যে সংস্কৃতি চালু হয়েছে, বিশ বছর পরও সেই সংস্কৃতি অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিরোধী দল পঞ্চম সংসদে ১১৮ দিন (৯টি অধিবেশনে), ৭ম সংসদে ১৬৫ দিন (৯টি অধিবেশনে), ৮ম সংসদে ২২৩ দিন (৯টি অধিবেশনে) সংসদ বয়কট করে। ৯ম সংসদের সংসদ বয়কটের হিসাব-নিকাশ আমরা আরো পরে পাব। তবে সংসদ বয়কট তো অব্যাহত রয়েছে। উপরে উল্লেখিত তিনটি সংসদেই মারাত্মক কোরাম সঙ্কট পরিলক্ষিত হয়। ৭ম সংসদের ৯ম অধিবেশনে মোট ৩ ঘণ্টা ১২ মিনিট কোরাম সঙ্কটের কারণে ব্যয় হয়। ৮ম সংসদে ২২৭ ঘণ্টা অপচয় হয় কোরাম সঙ্কটে যা সংসদের মোট কার্যকালের একপঞ্চমাংশ। এর জন্য আর্থিক ক্ষতি হয় প্রায় ২০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা (টিআইবি রিপোর্ট)। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় কার্যকরী জাতীয় সংসদ আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। নির্বাচন হয়েছে। সরকার পরিবর্তন হয়েছে। নতুন সংসদ গঠিত হয়েছে। কিন্তু সংসদীয় রাজনীতিতে যা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হচ্ছে সংসদকে শক্তিশালী করা।
দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সংসদকে শক্তিশালী করতে পারিনি। সরকারে যারা থাকেন, তাদের দায়িত্বটি বেশি। কিন্তু এ কথাটা আমরা ভুলে যাই। সংসদ হচ্ছে জাতীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা। জাতীয় নীতি এখানে প্রণীত হবে। জাতীয় স্বার্থ জাতীয় সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে সংসদে ডিবেট হবে। সরকারের নীতির সমালোচনা করে বিরোধী দল বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন করবে। কিন্তু এই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। যে কারণে সরকারি নীতি হয়ে যাচ্ছে একপক্ষীয়। জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অনেক চুক্তি স্বাক্ষরিত হলেও, তা সংসদে উপস্থাপিত হয় না। আলোচনাও হয় না। কিছুদিন আগে সিপিডির এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ডেপুটি স্পিকার। তিনি বলেছিলেন সংসদ সদস্যরা জাতীয় নীতি নির্ধারণী বিষয়ে বক্তব্য দেন না, প্রস্তাবও রাখেন না, এমনকি কোনো প্রশ্নও উত্থাপন করেন না। অতি সম্প্রতি ট্রানজিট ফি ছাড়াই ট্রান্সশিপমেন্টের কয়েকটি চালান ত্রিপুরা গেছে। যেখানে এখনো ট্রানজিট ফি নির্ধারিত হয়নি, সেখানে কী করে ভারতীয় পণ্য পরিবহন করা হয়? বিষয়টি বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। অথচ বিষয়টি নিয়ে সংসদে আলোচনা হলো না। শুধু তাই নয়, ভারতীয় ৪২ চাকার যান চলাচলের ফলে বাংলাদেশ যে পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সেই ক্ষতি আমরা কীভাবে পূরণ করব, সে ব্যাপারেও কোনো ব্যাখ্যা নেই। ইতোমধ্যে ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে, তারও কোনো সুস্পষ্ট জবাব আমরা পাইনি। অথচ সংসদে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা কিংবা সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। ডেপুটি স্পিকার এটা স্বীকার করলেও, সংসদে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনার কোনো পরিবেশও তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি। সংসদীয় রাজনীতিতে একটি 'ছায়া মন্ত্রিসভা' থাকে। এটা সংসদীয় রাজনীতির একটি সৌন্দর্য। কিন্তু বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। বর্তমান বিরোধী দলও সংসদে একটি 'ছায়া মন্ত্রিসভা' গঠন করতে পারেনি। এই 'ছায়া মন্ত্রিসভায়' যারা থাকবেন, তারা সরকারের বিভিন্ন নীতির সমালোচনা করে বিকল্প একটি নীতি উপস্থাপন করবেন। বাংলাদেশে এই সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি অনিবার্যভাবে দুটি শক্তি। গণতন্ত্র বিনির্মাণে এদের মাঝে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। এটি না থাকলে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য। পঞ্চম জাতীয় সংসদে বিএনপি পেয়েছিল প্রাপ্ত ভোটের ৩০.৮১ ভাগ, আর আওয়ামী লীগ ৩০.০৮ ভাগ, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪৪ ভাগ ভোট, আর বিএনপি ৩৩.৬১ ভাগ, অষ্টম জাতীয় সংসদে বিএনপি ৪০.৯৭ ভাগ ভোট, আর আওয়ামী লীগ ৪০.১৩ ভাগ ভোট।
সর্বশেষ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্তি ৪৮.০৬ ভাগ, আর বিএনপির ৩২.৪৫ ভাগ। পরিসংখ্যানই বলে দেয় বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মাঝে একটি 'সমঝোতা' কেন প্রয়োজন। এই 'সমঝোতা' নেই বিধায় গণতন্ত্র এখানে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে।
এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতিতে বান কি মুন যখন সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে একটি 'সংলাপ'-এর আহ্বান জানান, তখন তিনি সরকারকে একটা মেসেজ পেঁৗছে দেন বলেই আমার ধারণা। সরকার এই মেসেজ থেকে কতটুকু ধারণ করবে, তা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু একটা সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে ২০১২ সালে বাংলাদেশকে একটি বড় ধরনের সমস্যার মধ্যে পড়তে হবে। সুতরাং 'সংলাপ'টা জরুরি। জাতির বৃহত্তম স্বার্থেই বিভিন্ন জাতীয় প্রশ্নে, বিশেষ করে দশম জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে একটি ঐকমত্য প্রয়োজন। 
দৈনিক যায় যায় দিন। ২১ নভেম্বর ২০১১। ড. তারেক শামসুর রেহমান অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com