রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রসঙ্গ : উচ্চশিক্ষা কমিশন

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নামের পরিবর্তন হচ্ছে। নামটি পরিবর্তন করে রাখা হচ্ছে বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন বা হেক। ইউজিসি থেকে হেক, পরিবর্তনটা কী শুধু নামের? নাকি কাজেরও? ১৯৭৩ সালে মঞ্জুরি কমিশন গঠিত হয়েছিল। যে আইন বলে ইউজিসি গঠিত হয়েছিল, ২০১১ সালে এসে ওই আইন অচল। সুতরাং পরিবর্তনটা প্রয়োজন ছিল। এটা যুগের চাহিদা। সুতরাং নাম পরিবর্তন ও আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন ছিল, এটা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু যেভাবে জগাখিচুড়ি আকারে প্রস্তাবিত 'বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন-২০১১' আইনটি সংসদে উপস্থাপন করা হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমার আপত্তি রয়েছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পূর্ণকালীন সদস্য পাঁচজনই রেখে দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে আরো ১১ জন খ-কালীন সদস্য নেওয়া হচ্ছে, যাদের মাঝে থাকবেন দুইজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি। বর্তমান কাঠামোয়ও খ-কালীন সদস্যরা রয়েছেন। আমার অভিজ্ঞতা বলে ইউজিসি পরিচালনায় এরা কোনো ভূমিকা রাখেন না। ফলে উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও খ-কালীন সদস্যরা আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না। সুতরাং খ-কালীন সদস্যদের নিয়ে উচ্চশিক্ষার মান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। উপরন্তু এতে করে কমিশনের ব্যয় বরাদ্দ বেড়ে যাবে।
সংবাদপত্রে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার মান উন্নয়ন। তার এ বক্তব্যে আমি উৎফুল্ল হয়েছি। মন্ত্রীরা এ ধরনের কথা বলে বাহবা নেন। তিনিও নেবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমি কি বিনীতভাবে জিজ্ঞেস করতে পারি, গত ৪৬ মাসে আপনার মন্ত্রণালয় উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নে কী কী পদক্ষেপ নিয়েছে? ঢালাওভাবে ও দলীয়ভাবে শিক্ষক নিয়োগ যদি শিক্ষার মানোন্নয়নের মাপকাঠি হয়, আমার বলার কিছু নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মহলে অভিযোগ আছে, একটি 'সিন্ডিকেট' তৈরি হয়েছে। এরা বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয়ভাবে একের পর এক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে চলছে। ওই সিন্ডিকেটের সদস্যরা প্রায় প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ কমিটির সদস্য। তারা 'বিশেষ ক্ষমতা' ভোগ করেন। সরকারের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে রয়েছে তাদের যোগাযোগ। বিশেষ ক্ষমতা তাদের এত বেশি ক্ষমতাশালী করেছে যে কোনো উপাচার্যের পক্ষেই তাদের অবজ্ঞা করা সম্ভব হয় না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই সিন্ডিকেটের একজন সদস্যের ছেলের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগও হয়েছে অতি সম্প্রতি। এসব নিয়োগ যদি শিক্ষার মানোন্নয়নের মাপকাঠি হয়, আমি দুঃখিত।
বাংলাদেশ উচ্চশিক্ষা কমিশন আইন-২০১১-এর খসড়ায় বেশ কিছু পরিবর্তন আনা জরুরি বলে আমি মনে করছি। প্রথমত, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার মান নিশ্চিত করার স্বার্থে একটি আলাদা কমিশন গঠন করা উচিত। এ ক্ষেত্রে একটি কমিশনের আওতায় যদি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে রাখা হয়, তাহলে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি আলাদা ভিডিশন হিসেবে এটাকে রাখতে হবে। অর্থাৎ উচ্চশিক্ষা কমিশনে দুটো ভিডিশন থাকবে_একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য, অপরটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য। মনে রাখতে হবে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ধরন এক নয়। ব্যবস্থাপনাও এক নয়। সংগত কারণেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যত না নজরদারিতে থাকবে, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নজরদারিতে থাকবে বেশি। দ্বিতীয়ত, মাত্র ৫ জন পূর্ণকালীন সদস্য দিয়ে প্রায় একশটি (পাবলিক ও প্রাইভেট) বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করা সম্ভব নয়। এ জন্য সদস্যসংখ্যা নূ্যনতম দশজন করা উচিত। নূ্যনতম পাঁচজন সদস্যকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেখভাল করার দায়িত্ব দেওয়া উচিত। একজনের পক্ষে ৫৬টি (আরো নূ্যনতম ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের অপেক্ষায়) বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করা সম্ভব নয়। তৃতীয়ত, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেখভালোর জন্য একটি 'সহযোগী পরামর্শক' সংস্থা থাকতে পারে, যারা কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। তারা পরামর্শ দেবেন। এ সংস্থায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রতিনিধিত্ব থাকতে পারে। এমনকি সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদেরও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। উচ্চশিক্ষা কমিশনের নীতিনির্ধারণী কাঠামোয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কোনো প্রতিনিধি থাকতে পারবে না। চতুর্থত, বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটি ভালো ও প্রশংসাযোগ্য। পঞ্চমত, প্রস্তাবিত আইনে শিক্ষার মান ও রেটিং নিশ্চিত করার স্বার্থে একটি 'অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল' গঠন করার বিধান রাখা হয়েছে কিনা, আমি নিশ্চিত নই। এটা অবশ্যই থাকা উচিত। শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল থাকা উচিত। কেননা ইতিমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেই একধরনের বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। এ বৈষম্য কমিয়ে আনার স্বার্থেই অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল থাকা উচিত।
মূল কাঠামোতে এসব বিষয় থাকা উচিত। এর পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য রেগুলেশন ও স্ট্যাটিউট থাকা উচিত। বিশেষ করে স্ট্যাটিউটে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগসংক্রান্ত বিধি-বিধানে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। এখন এ ক্ষমতা উপাচার্যের হাতে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য কিছু ক্ষমতা ভোগ করেন)। উপাচার্যের মর্জির কাছে অনেক ভালো ছাত্রও শিক্ষক হতে পারে না। এ কারণেই পিএসপির মত একটি কাঠামো দাঁড় করানো যায় কিনা, তা ভেবে দেখা যেতে পারে, যা নিয়ন্ত্রণ করবে উচ্চশিক্ষা কমিশন। একই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। মালিকপক্ষ যা চায়, তাই হয়। আরো দুর্ভাগ্যের বিষয় 'অধ্যাপক' তথা 'ডক্টরেট' ডিগ্রি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। যিনি কোনোদিন শিক্ষকতা করেননি, তিনি দিব্যি ক্ষমতার বলে অধ্যাপক পদবি ব্যবহার করছেন। আমি একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে চিনি, যারা কোনোদিন শিক্ষকতা করেননি। শিক্ষকতা না করে উপাচার্য হয়েছেন! রাষ্ট্রপতির কার্যালয় এসব দেখেও না দেখার ভান করছে। সরকারি চাকুরে, কলেজ থেকে অবসর নিয়ে অনেক 'শিক্ষক' এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। বয়স সত্তরের কাছাকাছি হলেও এরা আদৌ শিক্ষকতা করার ক্ষমতা রাখেন কিনা, তা দেখার কেউ নেই। আরো একটা প্রবণতা শুরু হয়েছে_ পিতার বা স্বামীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে নিজ সন্তান বা স্ত্রীকে উপাচার্য বানানোর পাঁয়তারা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবারের সন্তানদের চাকরির ক্ষেত্র হতে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দেখভাল করা জরুরি। তদারকিটাও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত কাঠামোয় এর বিধান থাকা উচিত। মঞ্জুরি কমিশনের সচিবালয়কে শক্তিশালী করাও প্রয়োজন। একজন সচিবের নেতৃত্বে বিশাল এ কর্মকা- পরিচালনা করাও অসম্ভব। প্রস্তাবিত আইনে এ ব্যাপারে বিশেষ দিকনির্দেশনা থাকা উচিত।
শুধু নাম পরিবর্তন করেই শিক্ষার মানোন্নয়ন করা যাবে না। চাই আন্তরিকতা। চাই বলিষ্ঠ উদ্যোগ। শুধু লোক দেখানো একটি উদ্যোগ যদি নেওয়া হয়, তাতে চেয়ারম্যানের মর্যাদা হয়ত বাড়বে (প্রতিমন্ত্রীর বা পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদা), কিন্তু শিক্ষার মানের তাতে উন্নতি হবে না।
ড. তারেক শামসুর রেহমান আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক,  অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment