রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন এবং ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন


গত ৪ নভেম্বর কানের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে কোনো রকম সিদ্ধান্ত ছাড়াই। বিশ্বের ধনী ২০টি দেশের সরকার তথা রাষ্ট্রপ্রধানরা এই শীর্ষ সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন এমন একটি সময় যখন সারা বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিতে এক রকম অস্থিরতা বজায় রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি বড় বড় শহরে অসমতা, বেকারত্ব আর একশ্রেণীর হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত হওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে যখন জনমত শক্তিশালী, ঠিক তখনই প্রেসিডেন্ট ওবামা ছুটে গেলেন আটলান্টিক মহাসাগরের ওপারে বিনোদন নগরী হিসেবে পরিচিত ফ্রান্সের কান শহরে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে। জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে গ্রিসের ঋণসঙ্কট নিয়েও আলোচনা হয়েছে। সেটাও ছিল আলোচনার অন্যতম বিষয়। ঋণ এখন অনেকটা অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে। ইউরোপের ধনী রাষ্ট্রগুলো গ্রিসকে ১১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েও গ্রিসের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। গ্রিসের মোট ঋণের পরিমাণ এখন ২ দশমিক ৬ ট্রিলিয়ান ডলার। এই ঋণ গ্রিস শোধ করতে পারছে না। অনেকটা দেউলিয়া হয়ে গেছে রাষ্ট্রটি। গ্রিস 'ইউরো জোনে' থাকবে কী, থাকবে না, এটা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পাপান্দ্রু একটি গণভোট করতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত তিনি বাতিল করতে বাধ্য হন। এখন সর্বশেষ আস্থা ভোটে পাপান্দ্রু টিকে গেলেও তিনি পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু তা গ্রিসের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। গ্রিসের পরিস্থিতি যখন অবনতিশীল তখন ধারণা করা হয়েছিল জি-২০ নেতারা একটি উদ্ধার অভিযানে এগিয়ে আসবেন। কিন্তু 'ফটো সেশন' এর মধ্য দিয়ে দুদিনব্যাপী জি-২০ এর শীর্ষ সম্মেলন শেষ হলো। এমনকি অসমতা, বেকারত্ব আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সারা বিশ্বজুড়ে যে আন্দোলন চলছে সে ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত নিল না জি-২০ এর নেতারা।
এই মুহূর্তে গ্রিসের ঋণ পরিস্থিতি যেমনি আলোচনার অন্যতম বিষয়, ঠিক তেমনি আলোচনার বিষয় আমেরিকার অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও। যে দেশ শিশুদের নূ্যনতম অধিকার (২১ ভাগ সন্তান নির্ধারিত দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করে) নিশ্চিত করতে পারেনি, সেই দেশ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে শুধু অন্য দেশের (আফগানিস্তান, ৬ বিলিয়ন ডলার বছরে) সেনা প্রশিক্ষণের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৬ জনের মধ্যে ১ জন গরিব। ৪ কোটি ৬২ লাখ মানুষ বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে, শতকরা হার যা ১৫ দশমিক ১ ভাগ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে আবার আফ্রো-আমেরিকানদের এবং হিস্পানিকদের সংখ্যা বেশি। এই হার যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৪ ও ২৬ দশমিক ৬ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সংস্থান না করে, তাদের নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে যুদ্ধের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর একটা অংশ রয়েছে, যাদের হেলথ ইনস্যুরেন্স নেই। স্বাস্থ্যসেবার বাইরে রয়েছে এমন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬ দশমিক ৩ ভাগ। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ যুদ্ধের খরচ মেটাতে কর দেন। ওবামা প্রশাসনের যুদ্ধের জন্য বাজেট প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন ডলার (যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী যুদ্ধের পেছনে খরচ ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার) , স্বাস্থ্য বীমা নিশ্চিত করা যায়। কিন্তু ওবামা প্রশাসনের নজর এদিকে নেই। যুদ্ধ তাদের দরকার। যুদ্ধ প্রলম্বিত করে করপোরেট হাউজগুলো মুনাফা লুটছে। যুদ্ধ মানেই তো ব্যবসা। সুতরাং আজ যে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন গড়ে উঠছে, এটা অত্যন্ত স্বাভাবিক।
যুক্তরাষ্ট্রেই গবেষণা হচ্ছে যুদ্ধের খরচ যদি কমানো যায়, তাহলে ওই অর্থ দিয়ে সামাজিক খাতে কী কী পরিবর্তন আনা সম্ভব। পেটাগনের হিসাব মতে প্রতিমাসে আফগানিস্তান ও ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার, যার তিন ভাগের ২ ভাগ খরচ হয় আফগানিস্তানে। পেন্টাগন ইরাক ও আফগানিস্তানে গত ৪০ মাসে খরচ করেছে ৩৮৫ বিলিয়ন ডলার, যা কি না বয়োজ্যেষ্ঠদের স্বাস্থ্যবীমা খাতে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে গত ১০ বছরে। গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু সেনাদের ব্যবহৃত গাড়ির জ্বালানি তেল (আফগানিস্তানে) বাবদ (অক্টোবর ২০১০ থেকে মে ২০১১ পর্যন্ত) যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। যদি যুদ্ধক্ষেত্রে তেল সরবরাহ ও জনশক্তির খরচ হিসাব করা হতো, তাহলে প্রতি গ্যালন তেলের মূল্য গিয়ে দাঁড়াতো ১০০ ডলারে। প্রতি বছর আফগানিস্তানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বজায় রাখতে (সেনা সদস্যদের জন্য) যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয় বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে আফগানিস্তানে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খরচ ছিল ৫ লাখ ৭ হাজার ডলার (বছরে)। ২০১০ সালে এটা বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬৭ হাজার ডলারে। আর ২০১১ সালের হিসাব ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৯৪ হাজার ডলারে। এটা কংগ্রেশনাল রিপোর্ট। এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ইরাকে ২০০৭ সালে প্রতি মার্কিন সেনার জন্য বছরে খরচ ছিল ৫ লাখ ১০ হাজার ডলার, ২০১১ সালে তা বেড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ২ হাজার ডলারে। ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস আফগানিস্তানে যুদ্ধের খরচের জন্য বরাদ্দ দিয়েছে ১১৩ বিলিয়ন ডলার। ইরাকের জন্য বরাদ্দ ৪৬ বিলিয়ন। এখন ওবামা প্রশানকে যুদ্ধের জন্য যদি অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ করতে না হতো, তাহলে এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে (১) ৫৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন শিশুর (নিম্ন আয়ের পরিবারের) স্বাস্থ্যসেবা, (২) ২৩ মিলিয়ন নিম্ন আয়ের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা (৩) ২০২ মিলিয়ন ছাত্রের বৃত্তি, (৪) ১৪ দশমিক ৩৫ মিলিয়ন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা ও (৫) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ১৪ দশমিক ২৬ মিলিয়ন আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করা সম্ভব। সুতরাং আজকে ওয়াশিংটনে কিংবা নিউ ইয়র্কে যে আন্দোলন হচ্ছে, তার পেছনে কারণগুলো কি, তা সহজেই অনুমেয়। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হলেও, ওবামা প্রশাসন যুদ্ধ বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেননি। বরং তিনি লিবিয়ায় নতুন একটি ফ্রন্ট ওপেন করেছেন। লিবিয়ায় যে যুদ্ধের সূচনা তিনি করেছিলেন তাকে চিহ্নিত করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবে। লিবিয়ায় গাদ্দাফির মৃত্যুর পর এখন সম্ভাব্য টার্গেট হচ্ছে সিরিয়া ও ইরান। সুতরাং আগামীতে যুদ্ধ বন্ধের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর সঙ্গতকারণেই যুদ্ধের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হলে সামাজিক খাতে আরো কাটছাঁট করতে হবে। এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বয়োজ্যেষ্ঠরা আর শিশুরা। 
তাদের স্বাস্থ্য সুবিধা আরো সীমিত হবে। যুদ্ধের কারণে সমাজের একটা অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, সুবিধাভোগী একটি অংশ বরং এতে উপকৃতই হচ্ছে। ব্যবসার প্রসার ঘটিয়ে করপোরেট হাউজগুলো আরো ধনী হচ্ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের ধনিক শ্রেণী, যাদের সংখ্যা মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ১ শতাংশ, তারা দেশটির মোট সম্পদের ৩৩ শতাংশের মালিক। সুতরাং করপোরেট হাউজগুলোর বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ যে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক।
আজ নিউ ইয়র্কের জুকোটি পার্কে (অকুপাই ও ওয়াল স্ট্রিট) শত শত তরুণ সমবেত হয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করলেন, তার সঙ্গে কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের আন্দোলনের বেশ মিল পাওয়া যায়। সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইটগুলো ব্যবহার করে মিসরের তরুণ সমাজ একটি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। পতন ঘটেছিল হোসনি মোবারকের। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কেও তরুণরা এই সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো ব্যবহার করছে। তবে পার্থক্যটা এখানেই যে এতে করে ওবামা প্রশাসনের পতন ঘটবে না। তবে ওবামা প্রশাসন নিশ্চয়ই এটা থেকে কিছু শিখবে। ২০১২ সালে সেখানে নির্বাচন। ওই নির্বাচনে অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলন কোনো প্রভাব ফেলবে না, তা বলা যাবে না। আরো একটা কথা। সারা বিশ্বব্যাপীই পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে, রোমে, লন্ডনে, অকল্যান্ডে। গ্রিসের অর্থনৈতিক সঙ্কট রাষ্ট্রটিকে একটি 'ব্যর্থ রাষ্ট্র' এ পরিণত করেছে। ইউরোপে এক মুদ্রা ইউরো এখন অনেকটা অকার্যকর। বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই এখন বড় ধরনের হুমকির মুখে। এখন বিশ্ব নেতারা সমস্যার সমাধানে কি উদ্যোগ নেন, সেটাই দেখার বিষয়। তবে একটি বিপ্লব সেখানে আসন্ন। এই বিপ্লবকে মার্কস বেঁচে থাকলে হয়তো সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হিসেবে আখ্যা দিতেন। এটা একটা সামাজিক বিপ্লব। এই সামাজিক বিপ্লব সেখানে একটি পরিবর্তন আনবে। ধনী ও গরিবের মধ্যে পার্থক্য ঘোচাতেই হবে। শ্রেণীবৈষম্য কমিয়ে আনতেই হবে। না হলে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটবে। হোয়াইট হাউজ প্রশাসন এটা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবে যে এভাবে চলতে দেয়া যায় না। এভাবে বৈষম্য বজায় রেখে উন্নয়ন সম্ভব নয়। এই পরিবর্তনটুকু যত দ্রুত আনা যায়, ততই মঙ্গল। সমাজতন্ত্র যেমনি ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছিল, ঠিক তেমনি পুঁজিবাদও এখন ব্যর্থ প্রমাণিত হলো। নতুন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা জরুরি, যেখানে কোনো বৈমষ্য থাকবে না, সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টন হবে, আর রাষ্ট্র জনগণের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
কিন্তু এই প্রত্যাশা পুরণে জি-২০ সম্মেলন কোনো আশার বাণী শোনাল না। প্রতিবারের মতো এবারোও তারা ফটো-সেশন করলেন। ওবামা অনেক আশ্বাসের বাণী শোনালেন। ইতোমধ্যে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন ৫০ দিন পার করেছে। প্রচ- শীতেও বিক্ষোভকারীদের মাঝে এতটুকু হতাশা আসেনি। বরং তা ছড়িয়ে গেছে ক্যালিফোর্নিয়াতেও। সেখানে অকল্যান্ড সমুদ্রবন্দর বন্ধ করে দিয়েছে বিক্ষোভকারীরা। একই সঙ্গে খোদ ওয়াশিংটনের ফ্রিডম প্লাজাতেও ড়পঃড়নবৎ-২০১১ সড়াবসবহঃ, যা যুদ্ধের বিরুদ্ধে পরিচালিত, তা পার করেছে ৩০ দিন। এই যে পরিস্থিতি, এই পরিস্থিতি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এই পরিস্থিতি আমাদের মনে কমিয়ে দেয় বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে বাধ্য।

ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com 

0 comments:

Post a Comment