রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আরব বসন্ত' কি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে?

লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির হত্যাকা-, তিউনেসিয়ায় নির্বাচনে ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত এন্নাহদা পার্টির বিজয়, সিরিয়ায় দীর্ঘ গণঅসন্তোষ আর মিসরে বারে বারে নির্বাচন পিছিয়ে যাবার পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, 'আরব বসন্ত' কী তার লক্ষ্যে পেঁৗছতে পারবে? বেকার ফল বিক্রেতা বওকুজিজির আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে তিউনেসিয়ায় পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়েছিল। ২৩ বছরের শাসক বেন আলি উৎখাত হয়েছিলেন। সেখানে গত ২৩ অক্টোবর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। নির্বাচিত সংসদ দেশটির জন্য একটি সংবিধান ও একজন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করবে। নির্বাচনে বিজয়ী এন্নাহদা পার্টির প্রধান রশিদ ঘান্নুচি সেখানে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে যাচ্ছেন। তবে তিউনেসিয়া নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেছে। বিগত দিনগুলোতে তিউনেসিয়া একটি আধুনিক ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছিল। একটি ইসলামী রাষ্ট্র হলেও, নারীরা এখানে সমানাধিকার ভোগ করে। পুরুষদের একাধিক বিয়ে সেখানে নিষিদ্ধ। হিজাব এখানে নারীদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। এখন এন্নাহদার প্রভাবাধীন একটি সরকার এই নীতি রাখবে নাকি কট্টর ইসলামিক অনুশাসন প্রর্বতন করবে, সেটাই দেখার বিষয়। অন্যদিকে মিসরে হতাশা বাড়ছে। ফেব্রুয়ারিতে দীর্ঘদিনের শাসক হোসনি মোবারকের পতনের পর ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা বারে বারে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দিচ্ছে। এখন জান্তাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল তানতাবি নিজেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছেন। ইসলামপন্থী হিসেবে পরিচিত ইসলামিক ব্রাদারহুডের উত্থান ঠেঁকাতেই একটি ডানপন্থী গ্রুপ সেখানে সক্রিয়, যারা তানতাবিকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করছেন। লিবিয়ায় গাদ্দাফির পতনের পর সবার দৃষ্টি এখন সিরিয়ার দিকে। তবে গাদ্দাফির হত্যাকা- ও লিবিয়ায় একটি অন্তর্বর্তী প্রশাসনের ক্ষমতা গ্রহণ এ অঞ্চলের রাজনীতিতে আগামী দিনে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন ডেকে আনতে পারে। সেখানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান ঘোষণা করেছেন। তিনি দেশটিকে ইসলামী শরিয়াহ আইন দ্বারা পরিচালনার পক্ষপাতী। তার এই ঘোষণা যে ওয়াশিংটনে একটি ভিন্ন সিগনাল পেঁৗছে দেবে, তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। কোন ধরনের সরকার ব্যবস্থা সেখানে প্রবর্তিত হবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে লিবিয়ায় একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। লিবিয়া এখন রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার দ্বারা পরিচালিত হবে, নাকি সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা সেখানে প্রবর্তন করা হবে, এটা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যদি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা সেখানে প্রবর্তন করা হয়, তাহলে আরেকজন স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের আর্বিভাব হওয়া বিচিত্র কিছু নয়। মুস্তাফা আবদেল জলিলের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন সেখানে যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং গাদ্দাফি-পরবর্তী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশেষ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহমুদ জিবরিলের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে থাকবে। অতীতে আবদেল জলিল গাদ্দাফির বিচারমন্ত্রী ছিলেন। পক্ষত্যাগ করে তিনি বিদ্রোহীদের দলে যোগ দেন। কিন্তু জিবরিল যুক্তরাষ্ট্রে থাকতেন। পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে সেখানেই বসবাস করতেন। সম্ভবত তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। জলিলের চেয়ে জিবরিল যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের খুব কাছের ব্যক্তি হবেন। যুদ্ধের কারণে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র সাধারণ মানুষের কাছে চলে গেছে। গাদ্দাফি নিজেও অস্ত্রভা-ার খুলে দিয়েছিলেন। ন্যাটোর বিমান থেকেও বিদ্রোহীদের জন্য অস্ত্র ফেলা হয়েছিল। এসব অস্ত্রের হদিস পাওয়া খুব কঠিন হবে। বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রও রয়েছে ওইসব অস্ত্রশন্ত্রের মধ্যে। এই অস্ত্র আল-কায়েদার কাছে পেঁৗছে যাবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। ফলশ্রুতিতে গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় অস্ত্র একটি বড় ভূমিকা পালন করবে, যা গণতন্ত্রে উত্তরণে কোনো সাহায্য করবে না। গাদ্দাফি-পরবর্তী লিবিয়ায় ইসলামী জঙ্গিরা অন্যতম একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। বেশ কয়েকটি জঙ্গি গ্রুপের খবর পাওয়া যায়, যারা গাদ্দাফির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। যেমন বলা যেতে পারে ওংষধসরপ ঋরমযঃরহম এৎড়ঁঢ় (ওঋএ), অনঁ টনধরফধয নরহ ঔধহঁধয ইৎরমধফব, অনফবষ ঐধশরস ইবষযধফল এৎড়ঁঢ়, ঞৎরঢ়ড়ষর গরষরঃধৎু ঈড়ঁহপরষ কিংবা ঝধষধভর এৎড়ঁঢ় এর কথা। এদের কারও কারও সঙ্গে আল-কায়েদার যোগাযোগ রয়েছে বলেও ধরে নেয়া হয়। এক সময় ওঋএ-কে পশ্চিমা শক্তি সমর্থন করেছিল। ১৯৯৬ সালে গাদ্দাফিবিরোধী আন্দোলনে ওঋএকে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করেছিল। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কী দাঁড়ায়, সেটা দেখার বিষয়। গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে রাজনৈতিক দল ব্যবস্থাপনা, একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন, নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা, যা লিবিয়ায় নেই। এখানে কোনো রাজনৈতিক দল নেই। এখন অন্তর্বর্তী প্রশাসনের সদস্যরা একাধিক দলের জন্ম দিতে পারেন এবং পরস্পরের বিরুদ্ধে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতে পারেন। লিবিয়ায় বেকার সমস্যা প্রকট। জনগোষ্ঠীর ৩০ ভাগ বেকার। লিবিয়ায় বিশাল তেলের রিজার্ভ থাকলেও তেলনির্ভর শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। লিবিয়ার জনগোষ্ঠীর ৪০ ভাগ হচ্ছে তরুণ। এদের মূল ধারায় নিয়ে আসা, চাকরির ব্যবস্থা করা হবে কঠিন কাজ। নাহলে এখানে চিরস্থায়ী একটি অস্থিতিশীলতা থাকবেই। লিবিয়া গোত্রকেন্দ্রিকভাবে বিভক্ত। গোত্রের লোকজন একত্রিত হয়ে মরুভূমি তথা পাহাড়ের নিচে বসবাস করে। এরা আধুনকিমনস্ক নয়। গাদ্দাফি যে গোত্রের প্রতিনিধিত্ব করেন, তারা গাদ্দাফির মৃত্যুকে সহজভাবে নেবেন না। ফলে এক ধরনের বিরোধিতা থেকেই যাবে। উপরন্তু দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলের বিরোধের জন্ম হয়েছে। তেলকূপগুলো পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত। বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চল থেকে। গাদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তিগুলোর প্রভাব বাড়বে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর আগ্রহ মূলত লিবিয়ার তেল ও গ্যাসের কারণে। বিশ্বের রির্জাভের ৩৫ ভাগ তেল রয়েছে লিবিয়ায়, যার পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন ব্যারেল। গ্যাস রিজার্ভ রয়েছে ১৫০০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার। যুদ্ধের আগে প্রতিদিন তেল উত্তোলিত হত ১ দশমিক ৩ মিলয়ন ব্যারেল থেকে ১ দশমিক ৬ মিলিয়ন ব্যারেল। ভূমধ্যসাগরের নিচ দিয়ে পাইপের সাহায্যে এই গ্যাস যায় ইতালিতে (এৎববহংঃৎবধস চরঢ়বষরহব)। লিবিয়ার অভ্যন্তরে মাত্র এক ডলারে তেল পাওয়া যেত। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি তেলের মূল্য আশি ডলার। সুতরাং আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর স্বার্থটা কোথায়, তা সহজেই অনুমেয়। লিবিয়ার পুনর্গঠনের নামে এখন লিবিয়াতে ব্যবসা খুঁজবে মার্কিন কোম্পানিগুলো। আর লিবীয় সরকারকে তেল বিক্রি করে (অতিরিক্ত তেল উত্তোলন করে) পুনর্গঠনের বিল পরিশোধ করতে হবে। ঠিক যেমনটি হয়েছে ইরাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্রাটেজিতে লিবিয়ার অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পেন্টাগন জবনঁরষফরহম অসবৎরপধহ উবভবহংব শীর্ষক যে দীর্ঘ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে, তাতে লিবিয়া একটি ফ্যাক্টর। লিবিয়ার প্রশাসনকে যদি হাতে রাখা যায়, তাহলে উত্তর আফ্রিকা নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। লিবিয়া নিয়ন্ত্রণে আসলে পার্শ্ববর্তী শাদ ও নাইজারও নিয়ন্ত্রণে আসবে। শাদ ও নাইজারে রয়েছে তেল ও ইউরেনিয়াম, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুবই প্রয়োজন। একুশ শতকে যে নতুন আফ্রিকার জন্ম হতে যাচ্ছে, সেখানে ফ্রান্স ভাষাভাষী অঞ্চলে কর্তৃত্ব বাড়বে যুক্তরাষ্ট্রের। কঙ্গো, রুয়ান্ডা, আইভরি কোস্ট ছিল একসময় ফ্রান্সের কলোনি। ফরাসি ভাষা এখানে সরকারি ভাষা। এ অঞ্চলে এখন বাড়বে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব। ইতিমধ্যেই আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে নতুন একটি মিলিটারি কমান্ড অঋজওঈঙগ। এ জন্য লিবিয়ায় 'বন্ধুপ্রতিম' সরকারের খুব প্রয়োজন ছিল। গাদ্দাফির মৃত্যু এই হিসাবটা সহজ করে দিল। লিবিয়ার ঘটনাবলি দিয়ে এটা প্রমাণিত হয়ে গেল যে, পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রের সরকারকে উৎখাত করার ক্ষমতা যুক্তরাষ্ট্র রাখে।
তবে অবশ্যই সেই সরকারকে যুক্তরাষ্ট্রের অপছন্দের হতে হবে। অতীতে গাদ্দাফিকে যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ইরাকে সাদ্দামের বিরুদ্ধে অভিযানের সময়ও যুক্তরাষ্ট্র গাদ্দাফিকে তার স্বার্থে ব্যবহার করেছিল। এখন প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় গাদ্দাফিকে চলে যেতে হল। এভাবে একটি স্বাধীন দেশে ন্যাটোর বিমান বহর দিয়ে হামলা কোনো আন্তর্জাতিক আইনে অনুমোদন করে না। তারপরও ন্যাটোর বিমান বহর লিবিয়ায় আক্রমণ করে শেষ পর্যন্ত গাদ্দাফি সরকারের পতন ঘটিয়েছে। 'আরব বসন্ত' এর জন্য লিবিয়ার ঘটনাবলি একটি শিক্ষা। এদিকে সিরিয়ায় দীর্ঘ ৮ মাস ধরে চলা সংকটেরও কোনো সমাধান হচ্ছে না। প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ হুশিয়ার করে দিয়েছেন যে, যদি লিবিয়ার ন্যায় সিরিয়ায় হামলা হয়, তাহলে তা সারা মধ্যপ্রাচ্যে 'আগুন' জ্বলবে। প্রেসিডেন্ট বাশারের এই মন্তব্যকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে সিরিয়ার রাজনৈতিক সংকটেরও কোনো সমাধান হচ্ছে না। সেখানে সংখ্যালঘু শিয়ারা ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে দীর্ঘদিন। বিশেষ করে একটি গোষ্ঠী (আলওয়াতে) সেখানে ক্ষমতা দখল করে আছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সুনি্নদের কোন ভূমিকা সেখানে নেই। ১৯৭১ সাল থেকেই বাশার পরিবার ক্ষমতায়। বাশার আল আসাদের পিতা হাফিজ আল আসাদ ক্ষমতা দখল করে বার্থ পার্টির মাধ্যমে ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর পুত্র বাশার ক্ষমতায় বসেন। এখানে কোনো গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম হয়নি। এদিকে ইয়েমেনের পরিস্থিতিও আশাব্যঞ্জক নয়। সুতরাং 'আরব বসন্ত' নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। এখানে সম্ভাবনা দুটো। এক. একটি আধুনিক ইসলামিক শক্তির ক্ষমতা গ্রহণ। বিশেষ করে 'তুরস্ক মডেল'-এ এই অঞ্চলের জনগণ আকৃষ্ট হতে পারে। দুই. একটি 'আথোরেটরিয়ান' নেতৃত্ব ক্ষমতায় থেকে যেতে পারে। বিশেষ করে লিবিয়া ও সিরিয়ার ক্ষেত্রে এ কথা প্রযোজ্য। এক্ষেত্রে ইসলামিক শক্তি এই 'আথোরেটরিয়ান' নেতৃত্বকে কতটুকু চ্যালেঞ্জ করতে পারবে, সেটাই দেখার বিষয় এখন।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়,
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক সদস্য,
tsrahmanbd@yahoo.com 

0 comments:

Post a Comment