রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

এই সরকার যতদিন জনদুর্ভোগ ততদিন

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সদর্পে ঘোষণা করেছেন, আগামী তিন বছর বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকবে। তার এই ঘোষণা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ২ জানুয়ারি। গত ১ জানুয়ারি বিদ্যুৎ ভবনে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে এর আওতাধীন কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ও সার্বিক বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে মন্ত্রী এ ঘোষণা দেন। মন্ত্রীর এ ঘোষণায় অনেকে অবাক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমান সরকার একের পর এক বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই চলছে। এতে করে সাধারণ মানুষ যে কত বড় ভোগান্তির মাঝে রয়েছে, তা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই এতটুকুও। মহাজোট সরকারের তিনবছরে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। স্বাধীনতার পর মূল্যস্ফীতি কখনও ‘ডাবল ডিজিট’ (দশ শতাংশের বেশি) অতিক্রম করেনি। বর্তমানে এই মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণও আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ মাত্র ৯৩৫ কোটি ডলার। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিল ‘মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ হবে’। কিন্তু এই কাজটি করতে পারেনি সরকার। অসাধু সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি থেকেছে বাজার। ফলে দিনের পর দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। আর সাধারণ মানুষকে বইতে হয়েছে বোঝা। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী বেঁচে থাকার জন্য সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছে। গত নভেম্বরে (২০১১) মানুষ সঞ্চয়পত্র ভেঙেছে ১ হাজার ১৩৪ কোটি ১৪ লাখ টাকার। বছরের শেষ দিনে জ্বালানি তেলের দাম আরো এক দফা বৃদ্ধি করায় বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। একটি ভালো সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের মঙ্গলে কাজ করা ও জনমুখী সিদ্ধান্ত নেয়া। কিন্তু মহাজোট সরকার তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একের পর এক ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটলো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণাটি দিয়ে।
বিদ্যুৎ নিয়ে সংকট আছে। চাহিদা বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেভাবে উৎপাদন হচ্ছে না। হাজার হাজার ফ্যাট এই ঢাকা শহরেই তৈরি হচ্ছে। এসব ফ্যাটে কী আদৌ পূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে? যদি না হয়, তাহলে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্মিতব্য এই ফ্যাটগুলো যারা ক্রয় করেছেন তারা এখন কী করবেন? আবাসন শিল্পের সাথে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয়-রোজগারের কী হবে? ডেভেলপাররা যদি ক্রেতাদের ফ্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তাহলে এই শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবেন। সরকারের জন্য আদৌ তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার ২০০৯ সালে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে অতি দ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট ৩১০০ লাইন কিলোমিটার দ্বি-মাত্রিক (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ ৩ বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে যে, স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের ৮টি ব্লককে পিএসসির আওতায় বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কনোকো ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সাথে রাশিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাসপ্রম এবং অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোষও শিগগিরই কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, স্থলভাগে সুনেত্রার মতো বিশাল মজুদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। কনোকো ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে সারা দেশব্যাপী প্রচুর গণসংযোগ করেছেন। তাদের যুক্তি একটাইÑ কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের গ্যাস রফতানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাচারের একটা সম্ভাবনা আছে। কেননা মায়ানমার এবং ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মায়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এ ক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়াও যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে তা দিতে ন্যূনতম আরো ৫ থেকে ৬ বছর সময় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে যে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেক্স যে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সংকটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে এই মজুদও বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।
যেহেতু গ্যাসের একটি সংকট আছে, তাহলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করবো?
গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩টি টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবেÑ এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ৬ হাজার হেক্টর কৃষি জমি নষ্ট হবে এবং অনেককে তাদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উন্মুক্ত পদ্ধতির একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তুললে, তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড় পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে শতকরা ১০ ভাগ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন যে, বড় পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও, তাতে এখন রাজনীতি ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীর কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ৬ জন মানুষ। এরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিল। সেই থেকে ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি ঝুলে আছে। এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করতে পারেনি। যদিও ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, রফতানির সুযোগ না রাখা, দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, খনির মুখে একটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু ওই রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকার কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করেনি। ফলে একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর আমাদের কোনো কাজে আসছে না। এখানে বলা ভালো, বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ৭৯ শতাংশ, চীন ৭৮, জার্মানি ৪৯, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯২, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ। এখানে আরো একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরকার খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে আমদানিকৃত (ভারত) কয়লার ওপর নির্ভর করে। এই সেক্টরটিও আমরা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি।
অতীতে বিদ্যুৎ ঘাটতিতে সরকারি দলের সংসদরাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। গত ৩ আগস্ট (২০১১) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল। কমিটির সভায় সরকারের দেয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিসংখ্যানও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। সরকারি দলের এমপিরা যখন খোদ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন, তখন বুঝতে কারো বাকি থাকে না পরিস্থিতি আদৌ ভালো নয়। এই যখন পরিস্থিতি তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী অবিবেচকের মতো ঘোষণা করলেন, তিন বছর ধরেই বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকবে। এর অর্থ কী? জনগণকে আরো কষ্টের মধ্যে ঠেলে দেয়ার অর্থ আর যাই হোক সুশাসন হতে পারে না। আসলে প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই সরকারের ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। বিদ্যুৎ তো একটি সেক্টর মাত্র। জনগণের সাথে একরকম ‘বিচ্ছিন্ন’ অর্থমন্ত্রী যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তখন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বর্তমানে সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই জনগণের প্রতি। বর্তমান সরকার যতদিন ক্ষমতা ধরে রাখবে, জনদুর্ভোগ তত বাড়বে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে আগামী দিনের জনদুর্ভোগের বিষয়টি নিশ্চিত হলো মাত্র।

সরকার পতনের জন্য বেগম জিয়া কঠিন কর্মসূচি দেননি


গেল সপ্তাহে দুই নেত্রী গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী তার শাসনের তিন বছর পালন উপলক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন। অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবিতে রোডমার্চের কর্মসূচির অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন বেগম জিয়া। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের চাইতে বেগম জিয়ার ভাষণ ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তিনি সরকার পতনের জন্য কোনো হঠকারী কর্মসূচি দেননি। আগামী ১২ মার্চ তিনি ঢাকা এক সমাবেশের ডাক দিয়েছেন।  তবে যা গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে তিনি স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহাল ছাড়া তাঁর নেতৃত্বাধীন জোট দশম জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেবে না। বেগম জিয়া কোনো কঠিন কর্মসূচি না দেয়ায় (বিশেষ করে হরতাল, অবরোধ), পরোক্ষভাবে তাঁর প্রশংসা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফ। তিনি রোডমার্চের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের পক্ষে। বেগম জিয়া তাঁর রোডমার্চ কর্মসূচিতে ব্যাপক জনসমর্থন পেয়েছেন। বেগম জিয়া তরুণ ও অভিজ্ঞদের সমন্বয়ে সম্পদের সঠিক ব্যবহারের কথা বলেছেন। তিনি দুর্নীতি দূর, দ্রব্যমূল্যের নিয়ন্ত্রণ, যানজটমুক্ত শহর, কৃষকদের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করেছেন। তিনি মহাজোট সরকারের তিন বছরের শাসনকে ‘প্রতারণার শাসন’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। বেগম জিয়া বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়েও কথা বলেছেন। ট্রানজিটের নামে করিডোর দেয়ার অভিযোগ করে খালেদা জিয়া বলেন, ক্ষমতায় আসার জন্য ভারতীয়দের যেসব কথা দিয়েছিল, সব তারা রক্ষা করেছে। নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে ভারতের গাড়ি চলার ব্যবস্থা করছে। এতে কৃষি ও পরিবেশের ক্ষতি হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যে সংলাপের আয়োজন করেছেন, তাঁকে তিনি ‘সাজানো সংলাপ’ হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনে দলীয় লোক নিয়োগে তারা সচেষ্ট। বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ও অবিলম্বে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানান।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন গত ৫ জানুয়ারি, তাতে তিনি তাঁর সরকারের সাফল্যগাঁথাই গেয়েছেন বেশি করে এবং বিরোধী দলকে সমালোচনা করতেও তিনি ভোলেননি। একদিকে তিনি যখন সরকার পরিচালনায় বিরোধী দলের সহযোগিতা চান, আর অন্যদিকে বিরোধী দলকে সমালোচনা করে তিনি এটাই প্রমাণ করলেন বিরোধী দলের সহযোগিতা তিনি আসলে চান না। দিকনির্দেশনামূলক কোনো বক্তব্য তাঁর ভাষণে নেই। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রীর দফতর বদল হয়েছে। কিন্তু অতীতে তার অতি কথনে মানুষ ছিল বিরক্ত। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কোনো বক্তব্য নেই। এখানেও তিনি সমালোচনা করেছেন বিরোধী দলের।
সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা ভালো নয়। দেশে বিশ্বমন্দার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার যখন ক্ষমতা নেয়, তখন মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৬.০৬ ভাগ, আর মূল্যস্ফীতির হার এখন ১১.৫৮ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার ব্যাপারে বিরোধী দলের মতামত প্রয়োজন। সরকারের ভর্তুকি নিয়েও সমস্যা রয়েছে। ক্ষমতা নেয়ার সময় ভর্তুকি ছিল ৯ হাজার কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ গিয়ে দাঁড়াবে ৪৬ হাজার কোটি টাকায়। রফতানি খাতে কিছুটা ধীরগতি লক্ষ্যণীয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩.৫৫ শতাংশ কম রফতানি হয়েছে। আর নভেম্বর মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় ১৭ শতাংশ কম এসেছে রফতানি আয়। আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকে গেল বছরের শেষের দিন থেকে। ভর্তুকির চাপ কমাতে ও বিদেশি সাহায্য সময়মতো ছাড় না পাওয়ায় অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। গত অক্টোবর পর্যন্ত তা ২২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছর জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে মনে হয় না। ২০১০-১১ অর্থবছরের জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৬.৭ শতাংশ। চলতি বছর জিডিপির লক্ষ্যমাত্রা ৭ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও তা অর্জিত হবে বলে মনে হয় না। (কালের কণ্ঠ, ৬ জানুয়ারি)। ডলারের সাথে টাকার মান কমে যাওয়ায় অর্থনীতিতে তা বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। ইউরোপে মন্দা বিরাজ করায় রফতানি অর্ডার কমে যাওয়ার কারণে প্রায় সাড়ে তিন হাজার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। অর্থনীতির এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, সে ব্যাপারে বিরোধী দলের মতামত প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে এ ব্যাপারে বিরোধী দলের মতামত চাইতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা চাননি।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন, তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বাড়িয়েছেন। চাকরির বয়সসীমা ৫৭ থেকে ৫৯ বছরে করা হয়েছে। কিন্তু যে প্রশ্নটি সহজেই করা যায় তা হচ্ছে চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো আমলাদের দক্ষতা প্রমাণ করে না। সারা বিশ্বব্যাপী যেখানে কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, সেখানে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সচিবদের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু অনেক সচিবের দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বয়সের কারণে এবং দলীয় বিবেচনায় অনেকে সচিব পর্যায়ে পদোন্নতি পেয়েছেন, কিন্তু তারা অনেকেই অদক্ষ। এসব অদক্ষ আমলাদের নিয়ে সরকার তার লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জন করবে, সে প্রশ্নই থেকে যায়।
গত ৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী পুলিশ বাহিনীর জন্য ৫টি সচিব পদ সৃষ্টির কথা ঘোষণা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী এই ঘোষণা শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তাদের খুশি করলেও (যারা এখন সচিব হতে পারবেন), সামগ্রিকভাবে জনসাধারণের কাছে পুলিশ বাহিনীর জন্য আস্থার জায়গাটা কী তৈরি হয়েছে? প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে খুব কিছু বলেননি। কিন্তু সংবাদপত্রগুলো মহাজোট সরকারের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে চিত্র তুলে ধরেছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মহাজোট সরকারের ৩ বছরে সারাদেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ৯১০৪টি, অপহরণ হয়েছে ১২৮০টি, ক্রসফায়ার হয়েছে ৪০৪টি, গুপ্তহত্যা হয়েছে ৭১টি, রাজনৈতিক খুন ৬০০, চাঞ্চল্যকর ৩টি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ আসামিকে দণ্ডাদেশ মওকুফ, শাসক দলের ৭১০০ নেতাকর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। (যুগান্তর, ২ জানুয়ারি ২০১২)।
এই চিত্র পুলিশ বাহিনীর সফলতা প্রমাণ করে না। তবুও প্রধানমন্ত্রী পুলিশের জন্য ৫টি সচিব পদ সৃষ্টি করেছেন। একই সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের প্রথম শ্রেণী ও উপ-পরিদর্শকদের দ্বিতীয় শ্রেণীতে ্উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এর ফলে সামগ্রিকভাবে সরকারের খরচ আরো বাড়বে। বিশ্বমন্দার এই যুগে এই ব্যয় বৃদ্ধি কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা এখনই কার্যকরী করার প্রয়োজন নেই।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে তার অর্জনের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় যখন বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম্য ও মাস্তানীর সংবাদ প্রকাশিত হয়, তখন কী প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যকে ম্লান করে দেয় না? জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সাতক্ষীরা ছাত্রলীগের মতো  সারা দেশজুড়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ড (টেন্ডারবাজি, মাস্তানী, হত্যাকাণ্ড, শ্লীলতাহানি) মহাজোট সরকারের অনেক অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্যখাতে তার সরকারের সাফল্যের কথা বলেছেন বটে, কিন্তু সংবাদপত্রই বলে দেয় অনিয়ম নিয়োগ বাণিজ্যে অনেক সাফল্য ম্লান হয়ে গেছে। (সমকাল, ৫ জানুয়ারি ২০১২)।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্র সফলতার(?) কথা বললেও বাস্তবতা হচ্ছে মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ভারতের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। এতে করে তুলনামূলক বিচারে ভারতের অর্জন বেশি, বাংলাদেশের অর্জন কম। অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরতা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বহুপাক্ষিকতার চরিত্রকে নষ্ট করেছে। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে দুইজন উপদেষ্টার ‘বিতর্কিত ভূমিকা’ কার্যত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকাকে খর্ব করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিদেশ সফরে ব্যস্ত সময় কাটালেও, দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য কোনো সম্মান তিনি বয়ে আনতে পারেননি। কখনো কখনো তাঁর শিশুসুলভ আচরণ (ফটো তোলা, অটোগ্রাফ দেয়া), পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থানকে দুর্বল করেছে। বাংলাদেশ যখন টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে ভারতের উদ্যোগকে প্রতিবাদ করতে পারে না, যখন তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিতে ভারতকে রাজি করাতে পারে না, তখন আমাদের পররাষ্ট্রনীতির দৈন্যদশাই ফুটে ওঠে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর চীন ও মিয়ানমার সফরের পর দেশ দুটোর সাথে আমাদের সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, তা বলা যাবে না। অথচ পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য রক্ষার জন্য এ দুটো দেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
ড. মোহাম্মদ ইউনূস ইস্যু ও র‌্যাবের ভূমিকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক কিছুটা ভাটা লক্ষ্য করা যায়। হিলারী কিনটন মিয়ানমার সফরে এলেও বাংলাদেশ সফর করা থেকে বিরত থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে পররাষ্ট্রনীতির কোনো দিকনির্দেশনা নেই। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে পদ্মা সেতুর  কথা উল্লেখ করেছেন বটে, কিন্তু অর্থ প্রাপ্তির বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। বিশ্বব্যাংক অর্থ বিনিয়োগ করবে, এমন কোনো কথা প্রধানমন্ত্রী বলেননি। কিন্তু সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে উল্লেখিত দুর্নীতির অভিযোগ মহাজোট সরকারের ভাবমূর্তি যে নষ্ট করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেই সাথে অনেক অদক্ষ মন্ত্রী সরকারের কর্মকাণ্ডে কোনো গতি আনতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের দুর্বলতা এখানেই।
দুই নেত্রীর ভাষণের মধ্যে দিয়ে কতগুলো বিষয় সামনে চলে এলো। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল। এটা না হলে বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী জোট নির্বাচনে অংশ নেবে না। ‘বল’ এখন সরকারের কোটে। সিদ্ধান্ত নিতে হবে সরকারকেই। দুই. নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রাষ্ট্রপতির সংলাপ ফলপ্রসূ হবে না, যদি না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সরকার নমনীয় না হয়। তিন. ১২ মার্চের ঢাকা সমাবেশের আগে বিরোধী দল সরকারের কাছ থেকে একটা সুস্পষ্ট জবাব চায়। সরকার যদি ইতিবাচক সাড়া না দেয়, তাহলে বিরোধীদল বাধ্য হবে কঠোর কর্মসূচি দিতে। যাতে লাগাতার হরতাল কিংবা ঘেরাও এর মতো কঠোর কর্মসূচি আসতে পারে। চার. বেসামাল অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে বিরোধী দলের সাথে আলাপ-আলোচনাটা জরুরি। সরকারের যদি শুভবুদ্ধির উদয় না হয়, তাহলে সরকার বিরোধী দলের সাথে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সংলাপে বসবে। কিন্তু সরকারের একক সিদ্ধান্ত  ও বিরোধী দলকে উপেক্ষা করা গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার পরিপন্থী। তথাকথিত যুদ্ধাপরাধী হিসেবে শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের জেলে আটকে রেখে বিচারের নামে যে প্রহসন চলছে, তাতে শংকিত এ দেশের মানুষ। এমনি এক পরিস্থিতিতে একটি সমঝোতা প্রয়োজন। ইতিহাস বলে সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বেগম জিয়ার চট্টগ্রামে দেয়া ভাষণ একটি ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এখন সরকার যদি আন্তরিক হয়, যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে একটি ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে, আমাদের বিশ্বাস আমরা একটা বড় ধরনের সঙ্কট এড়াতে পারবো।

আসল কথাটি বলে ফেলেছে দিল্লি হাইকোর্ট ইভিএম দিয়ে কারসাজি করার সুযোগ রয়েছে


আসল কথাটি বলে ফেলেছে দিল্লির হাইকোর্ট। গত ১৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে বলেছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম যন্ত্রটি টেম্পার প্রুফ নয়। অর্থাৎ ইভিএম দিয়ে কারসাজি করার সুযোগ রয়েছে। এই সংবাদটি পিটিআই ও টাইমস অব ইন্ডিয়া কর্তৃক পরিবেশিত এবং তা বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকাতেও ছাপা হয়েছে। বিচারপতি একে সিক্রি ও বিচারপতি রাজিব সাহাই অ্যান্ডলাউর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায়টি দেন। ভোট গণনার বিষয়ে যাতে সব সন্দেহ দূর হয়, বিচারপতিরা সে নির্দেশও দেন। ইভিএম বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকেই উপায় বের করতে হবে বলে রায় দেন হাইকোর্ট।
বাংলাদেশে ইভিএম নিয়ে যখন বিতর্ক বাড়ছে, তখন দিল্লি হাইকোর্টের এই রায় আমাদের অনেক চিন্তার খোরাক জোগাবে। যেহেতু ইভিএম শতকরা একশত ভাগ কারসাজি রোধ করার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না, সে কারণেই দিল্লি হাইকোর্ট  এই রায়টি দিয়েছেন। বাংলাদেশে সীমিত আকারে ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে এটি ব্যবহৃত হয়েছে। সেখানে ভুল-ত্রুটি যে হয়নি, তা বলা যাবে না। হয়েছে এবং তা সংবাদপত্রে ছাপাও হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহৃতও হয়নি। এমনি এক পরিস্থিতিতে একটি বা দু’টি স্থানীয় নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করে তা জাতীয় নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা ঠিক হবে না। উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা জাপানেও ইভিএম নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করার পর তাতে যদি সাফল্য আসে, তখনই আমরা জাতীয় পর্যায়ে এই মেশিন ব্যবহার করতে পারি। অথচ এরই মাঝে বিদায়ী সিইসি ইভিএম ব্যবহার করার ঘোষণা দিয়ে যথেষ্ট বিতর্কিত হয়েছেন।
ইতোমধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে একটি সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন। আগামী মাসে ইসিসহ অপর দুই নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। সংশোধিত সংবিধানে ৫ জন নির্বাচন কমিশনারের (সিইসিসহ) কথা বলা হয়েছে। এটা সত্য। কিন্তু এই মুহূর্তে নির্বাচন কমিশনে অতিরিক্ত আরো দু’জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়ার প্রয়োজন নেই। এতে সংবিধানের ধারাবাহিকতাও লঙ্ঘিত হবে না। সংবিধানে পাঁচজনের কথা বলা আছে সত্য, কিন্তু সরকার যদি মনে করে এই মুহূর্তে (যখন দেশে কোনো নির্বাচন নেই) নির্বাচন কমিশনে পাঁচজন কমিশনারের প্রয়োজন, সে ক্ষেত্রে সংবিধান লঙ্ঘিত হবে না। সবচেয়ে বড় কথা নির্বাচন কমিশনে এই মুহূর্তে আরো দু’জনের বসার জায়গাও নেই। গাড়ি নেই। জনবল নেই। কমিশনারদের কাজও তেমন নেই। কমিশনাররা ব্যস্ত থাকেন ‘বিদেশ সফর’ নিয়ে। যেখানে সারা বিশ্বব্যাপী কৃচ্ছ্রসাধন চলছে, সেখানে দু’জন নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দিয়ে সরকারের খরচ না বাড়ানোই শ্রেয়।
‘শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আস্থার সঙ্কটের সৃষ্টি হয়েছে, তার কোনো সমাধান দেবে না। বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি করেছেন। কিন্তু সংবিধানে এখন কোনো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদন দেয় না। কিন্তু সরকার যদি চায়, তাহলে সমাধান একটা আছে। সরকার উচ্চ আদালতের রায়ের প্রতি সমর্থন জানাতে পারে। যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়েছে, সেই রায়ের দ্বিতীয় অংশে, যেখানে আরো দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে মত দিয়েছেন, এই অংশটুকু বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে সরকার। এ ক্ষেত্রে মহাজোটের শরিকদের (যারা এখনও চাচ্ছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন) কাউকে দিয়ে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করাতে পারে এবং সরকার পরোক্ষভাবে তা সমর্থন করতে পারে। উক্ত প্রস্তাবে  তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিবর্তে ‘নিরপেক্ষ সরকার’ বলা যেতে পারে, যাদের কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্পন্ন করা। ওই ‘নিরপেক্ষ সরকার’-এর সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে তিন সদস্যের একটি যৌথ কাউন্সিল থাকবে। এককভাবে কারো কোনো ক্ষমতা থাকবে না। নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে এরা সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রশাসনের সহযোগিতা নিয়ে এরা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। তিন সদস্যের ওই কাউন্সিলে কারা কারা থাকবেন, সে ব্যাপারে বিরোধী দলের সাথে কথা বলা যেতে পারে।
নির্বাচনে ইভিএম মেশিনের সিদ্ধান্তটি ভালো নয়। এ ব্যাপারে সিইসির অতি উৎসাহ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। পত্রিকাতে খবর বেরিয়েছে নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে ভোটারদের প্রশিক্ষণ দেবে। এটা হাস্যকর বিষয়। শহরের মানুষজন হয়তো ওই মেশিনের ব্যবহার জানবে। কিন্তু গ্রামে? যেখানে এখনও মানুষ অশিক্ষিত, সেখানে সিইসি এই মেশিন ব্যবহার করাবেন কীভাবে? দেখা গেল ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত কর্মকর্তাদের (যারা নির্বাচন পরিচালনায় নিয়োজিত থাকবেন), সহযোগিতা চাইছেন ভোটাররা। সে ক্ষেত্রে ভোটারদের প্রভাবিত করার একটা সম্ভাবনা রয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ ওই কর্মকর্তার কথায় প্রভাবিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বিঘিœত হবে। ঢাকায় বসে এই প্রবণতা রোধ করা যাবে না। বাংলাদেশে এ ধরনের মেশিন ‘বিক্রি’ করার লোকের অভাব নেই। কনসালটেন্সি করার লোকেরও অভাব নেই। তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যে পেয়েছি। বুয়েটের জনৈক বিশেষজ্ঞ এর পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি দেখিয়েছেন। তাঁর এই ‘বিশ্লেষণ’ জ্ঞান এর জন্য ইসি থেকে তিনি কত টাকা নিয়েছেন, তা আমরা জানি না। কিন্তু ইভিএম মেশিনের যে খারাপ দিকও আছে, তা সেমিনার করে আমাদের জানিয়ে দিলেন আরেক ‘বিশ্লেষক’। এখন জানান দিলেন দিল্লির হাইকোর্ট।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা এটা নিয়ে কোনো ধরনের পরীক্ষায় যেতে চাই না। ইভিএম মেশিন খোদ আমেরিকাতেও সর্বত্র ব্যবহৃত হয় না।
২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের আমন্ত্রণে Democracy and the American Political Process:  Single Country Project for Bangladesh প্রজেক্টের আওতায় আমাদের ক’জন শিক্ষককে যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারা সাউথ ক্যারোলিনা স্টেট ইলেকশন কমিশনে গিয়েছিলেন। সেখানে তাদের স্বাগত জানিয়েছিলেন মিস ডোনা রয়সন। যিনি ছিলেন কমিশনের সহকারী নির্বাহী পরিচালক। সেখানেই ভোট মেশিনের সাথে তাদের পরিচয়। ডোনা তাদের জানিয়েছিলেন ওই মেশিন নিয়ে সমস্যা আছে। সর্বত্র তা ব্যবহৃতও হয় না। খোদ যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমাজে ভোট মেশিন যখন সর্বত্র গ্রহণযোগ্য হয়নি, সেখানে বাংলাদেশে সিইসির অতি উৎসাহ প্রশ্নের জন্ম দিতে বাধ্য। তত্ত্বগতভাবে ভোট মেশিন ভালো। কিন্তু আমাদের শিক্ষা, আমাদের পরিবেশ, আমাদের সমাজ সেই পর্যায়ে এখনও উন্নীত হয়নি যে আমরা এখনই ভোটার মেশিন ব্যবহার করবো। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি আরো শক্তিশালী হলে, সহনশীলতা আরো বাড়লে এবং পরস্পরের প্রতি আস্থার একটা ভিত্তি যদি দাঁড় করাতে পারি, তাহলেই আমরা ভোটার মেশিনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এর আগে নয় এবং এটা চালু করা উচিতও হবে না।
বিদায়ী সিইসিসহ দু’জন নির্বাচন কমিশনারই সাবেক আমলা, দু’জন বেসামরিক একজন সামরিক। জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ক আগেও ছিল না, এখনও নেই। জনগণের পাল্স তারা বুঝতে পারেন না। নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী কিংবা ইভিএম মেশিন ব্যবহারের আগে যা দরকার, তা হচ্ছে পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের সংস্কৃতি গড়ে তোলা। বিরোধী দলকে ‘আঘাত’ করে নয়, বরং আস্থায় নিয়েই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে জনগণের কাছে তা গ্রহণযোগ্য হয় না। ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করে বিএনপি সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়ায় (বিএনপি ২৭৮টি আসন অন্যরা ২২টি) বিএনপিকে নয়া নির্বাচন দিতে হয়। সাধারণ ভোটারদের মাঝে ওই নির্বাচন কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারেনি। ফলে সংসদ টিকে ছিল মাত্র ১৩ দিন। আর সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আওয়ামী লীগ যদি এককভাবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে, তা দেশকে শুধুমাত্র একটি সঙ্কটের মাঝেই ঠেলে দেবে না বরং বহিঃবিশ্বে আওয়ামী লীগ একটি ইমেজ সঙ্কটের মুখে পড়বে। তাই যা প্রয়োজন, তা হচ্ছে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করা, ও তার জন্য একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা। নির্বাচনের এখনও অনেক বাকি। কিন্তু চারদলীয় জোট এর রোডমার্চ ও সর্বশেষ চট্টগ্রামে জনসমাবেশ ও কর্মসূচি আমাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করছে যে চারদলীয় জোট সরকার পতনের আন্দোলনে যাচ্ছে। আমরা আতঙ্কিত এ কারণে যে দেশের অর্থনীতি আদৌ ভালো নয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাব খুব শিগগিরই আমরা অনুভব করবো। সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনাও প্রশ্নের মুখে। সরকার সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিয়েছে। যার ফলে বাড়ছে মুদ্রাস্ফীতি, যার পরিমাণ এখন প্রায় ১২ ভাগ। এর প্রতিক্রিয়া কী হবে এটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। এর প্রভাব ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তথা আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মূল্য ক্রয়সীমার বাইরে। এ ক্ষেত্রে রাজনীতিতে অস্থিরতা যদি বৃদ্ধি পায়, তাহলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হতে বাধ্য। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটি সংলাপ হোক। বিএনপি তথা চারদলীয় জোট তার রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করুক। পাল্টা কর্মসূচি দিলেই সঙ্কটের গভীরতা বাড়বে, যা কারো জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না।
বিএনপি যদি তার গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করতে না পারে, তাহলে দলটিকে বাধ্য করা হবে কঠোর কর্মসূচি দিতে। তাই বিএনপি তথা চারদলীয় জোটের সাথে সংলাপ জরুরি। সেই সাথে দিল্লি হাইকোর্টের রায়কে বিবেচনায় নিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হবে না- এ ধরনের ঘোষণা দেয়াও প্রয়োজন। জোর করে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার বড় ধরনের রাজনৈতিক বিতর্কের সৃষ্টি করতে পারে। এ দেশের সুধী সমাজ বারবার ইভিএমের বিপক্ষে বলে আসছে। হাইকোর্টের (দিল্লি) রায় তাদের বক্তব্যকেই সমর্থন করলো। আমরা আশা করবো সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহৃত হবে না এই মর্মে নিশ্চয়তা দেবে। দিল্লি হাইকোর্টের রায়ের পরেও যদি সরকার ইভিএম নিয়ে এগিয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে সরকারের উদ্দেশ্য সৎ নয়।

অভ্যুত্থান চেষ্টা আত্মোপলব্ধির সুযোগ এনেছে

বাংলাদেশে একটি সেনা অভ্যুত্থানের চেষ্টা নস্যাৎ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। এটাকে সেনা অভ্যুত্থান না বলে সেনা ঘটনা বলাই বাঞ্ছনীয়। কেননা অভ্যুত্থানের এতটুকু পরিবেশও তারা সৃষ্টি করতে পারেনি। গত কয়েকদিন ধরে পত্রপত্রিকায় এ সংক্রান্ত যেসব সংবাদ ছাপা হয়েছে এবং যেসব প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে, তার একদিকে যেমনি ইতিবাচক দিক রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে নেতিবাচক দিকও। ইতিবাচক দিক হচ্ছে সেনা নেতৃত্ব এ ধরনের চেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়েছে এবং সংবাদ সম্মেলন করে জাতিকে তা জানান দিয়েছে। এতে গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের প্রতি সেনাবাহিনীর অব্যাহত সমর্থন সেনা নেতৃত্ব আবারও প্রমাণ করলেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে সেনা নেতৃত্ব অতীতে কখনও প্রেসের মুখোমুখি হননি। এবার হলেন। এর মধ্য দিয়ে এক ধরনের জবাবদিহিতা তৈরি হয়েছে। এটা ভালো। পৃথিবীর অনেক দেশেই অতীতে যেসব সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে (বিশেষ করে আফ্রিকাতে ষাট ও সত্তরের দশকে), সেখানে অনেক সময় বাইরের শক্তি সেনাবাহিনীকে প্ররোচিত করেছিল ক্ষমতা দখল করতে। বাংলাদেশে সর্বশেষ ঘটনায় একটি নিষিদ্ধ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর নাম এসেছে। তবে তা ব্যাপক সেনা নেতৃত্বকে আকৃষ্ট করতে পারেনি।
আমাদের সেনাবাহিনী আমাদের গৌরবের। এই সেনাবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি থেকে যুদ্ধ করেছে জনতার সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এই সেনাবাহিনী এখন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে যাচ্ছে আফ্রিকাতে। এক একজন সেনা সদস্য বিদেশে পালন করছেন এক একজন ‘রাষ্ট্রদূতের’ দায়িত্ব। আজকে যারা সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করতে চান, তারা ভালো করেননি। যারাই অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছেন, তারা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে নষ্ট করতে চেয়েছিলেন। সেনাবাহিনী যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ‘কমিটেড’, তাতে আঘাত হানতে চেয়েছিলেন। আশার কথা, তাদের অসৎ উদ্দেশ্য সফল হয়নি। আরও একটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দল উভয়ই সেনা নেতৃত্বকে প্রশংসা করেছে। সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যাওয়া ঊর্ধ্বতন সেনা অফিসাররাও এ ধরনের যে কোন চেষ্টার সমালোচনা করেছেন। তবে এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এক. একটি নিষিদ্ধ ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতার নাম এসেছে। হিজবুত তাহরীর নামক সংগঠনটির তেমন কোন জনপ্রিয়তা বাংলাদেশে আছে বলেও আমার মনে হয় না। মাঝেমধ্যে তরুণদের মাঝে এদের কর্মতৎপরতা পত্রপত্রিকায় লক্ষ্য করা যায়। সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসারদের একটা অংশের মাঝে এরা কিছুটা পৌঁছতে পেরেছে বলেই মনে হয়। এটা একটা খারাপ দিক। সংগঠনটি বাংলাদেশভিত্তিক নয়। এদের একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবেই এরা পরিচালিত হয়। সারা বিশ্বে মুসলমান তরুণদের মাঝেই এদের প্রভাব কিছুটা আছে। এদের রাজনীতি সম্পর্কে আমি যতদূর জানি, এরা ‘ইসলামী খেলাফত’ প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী। সেনাবাহিনীর মতো একটি শৃংখলিত বাহিনীতে এরা ‘অনুপ্রবেশ’ করবে, এটা কাম্য নয়।
দুই. ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান নিয়ে দুটি বড় দল পরস্পর পরস্পরকে ‘অভিযুক্ত’ করেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন। মন্ত্রীরা সরাসরি অভিযোগ এনেছেন। নামধাম উল্লেখ করে অভিযোগগুলো আনা হয়েছে। ফলে বিএনপিও সংবাদ সম্মেলন করে সরকারি দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। দুটো বড় দলই রেষারেষির রাজনীতিতে জড়িয়ে গেছে। এটা ভালো নয়। সরকার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তদন্ত কমিটিকে খুব দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে। ব্যর্থ সেনা ঘটনা নিয়ে যখন তদন্ত হচ্ছে, তখন এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য না করাই শ্রেয়। এতে করে তদন্তকাজে বাধা আসতে পারে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা বিব্রত হতে পারেন। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ব্যর্থ সেনা ঘটনা নিয়ে কোন মন্তব্য না করেন, তাহলে তারা বিচক্ষণতার পরিচয় দেবেন। আরও একটা কথাÑ ব্যর্থ সেনা ঘটনা নিয়ে সংবাদও ছাপা হচ্ছে প্রতিদিন। ওইসব সংবাদে যাদের সংশ্লিষ্টতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তারা আদৌ জড়িত ছিলেন কিনা আমরা জানি না। তদন্ত পর্যায়ে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশ করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা ভেবে দেখার বিষয়। মানুষের জানার আগ্রহ থাকবে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু কোন মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর তথ্য যদি ছাপা হয়, তাহলে তা শুধু ওই ব্যক্তিকেই নয়, বরং বেশ কয়েকটি পরিবারকে চিরদিনের জন্য ধ্বংস করে দিতে পারে। তিন. ব্যর্থ সেনা ঘটনা নিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা বেশ কয়েকটি রিপোর্ট করেছে কয়েকদিন পরপর। একটি ভারতীয় ইংরেজি দৈনিকের মন্তব্যও আমার চোখে পড়েছে। আনন্দবাজার পত্রিকায় কোন কোন মন্তব্যে নয়াদিল্লির সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে। এটা কতটুকু সত্য, আমরা জানি না। তবে ওইসব মন্তব্য বাংলাদেশের ইমেজ বৃদ্ধিতে আদৌ সাহায্য করবে না। বিশেষ করে জঙ্গিবাদ প্রসঙ্গে মন্তব্য সঠিক নয়। একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল সেনাবাহিনীকে হেয়প্রতিপন্ন করা যাবে না। সেনাবাহিনী আমাদের আস্থার জায়গা। এই সংগঠনটিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্য সৎ নয়।
এই ব্যর্থ সেনা ঘটনা আমাদের জন্য অনেক চিন্তার খোরাক জোগাবে। এক. এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সেনা নেতৃত্ব আদৌ এর সঙ্গে কোনভাবে জড়িত ননÑ এটা প্রমাণিত হয়েছে। এখন এ ধরনের বিচ্ছিন্ন ঘটনা যাতে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। দুই. কেন তরুণ অফিসাররা ধর্মান্ধ গোষ্ঠী হিজবুত তাহরিরের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন, এটা সেনা নেতৃত্বকে অনুসন্ধান করতে হবে। ধর্মপালন করা ও ধর্মান্ধ হওয়া এক নয়। ধর্ম আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। প্রতিটি বাড়িতেই ধর্মচর্চা করা হয়। তার অর্থ ধর্মান্ধ হওয়া নয়। সেনাবাহিনীর তরুণ সদস্যরা ধর্মচর্চা করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা কেন বিপথে যাবেন? আমার ধারণা বিভিন্ন পর্যায়ে যে সেনা প্রশিক্ষণ হয়, সেখানে ‘ধর্মান্ধতার’ বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। ধর্ম নিয়ে যাতে কেউ বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সে বিষয়টিও দেখা উচিত। তরুণকে খুব সহজেই ধর্মের নামে আকৃষ্ট করা যায়। তাদের বিভ্রান্ত করা সহজ। কোনটা ভালো, কোনটি খারাপÑ এটা ওই বয়সে তারা বিবেচনায় নিতে পারে না। কেননা ধর্ম সম্পর্কে তাদের তখন তেমন পড়াশুনা থাকে না। ফলে ধর্ম নিয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়ায়, তারা খুব সহজেই তরুণ সমাজের মাঝে ‘প্রবেশ’ করেন। ‘হিজবুত তাহরির’ এই কাজটিই করেছে। সেনা নেতৃত্ব বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ভালো করবেন। দুই. এখন রেষারেষির সময় নয়। কে দায়ী, কে দায়ী নয়, এর ভাগীদার কেÑ এ নিয়ে পরস্পরকে অভিযুক্ত না করে দুটি বড় দল যদি সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করার জন্য আরও ‘সাজেশন’ দেয়, তাহলে তারা ভালো করবেন। তিন. বিএনপির জন্য এটা একটা ভালো সুযোগ সংসদে যাওয়ার। সংসদীয় কার্যক্রমে অংশ নিয়ে তারা সংসদে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারেন। একটা যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারেন সরকারের সঙ্গে। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারকে অবশ্যই সহনশীল হতে হবে। বিরোধীদলকে সংসদে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে। সংসদে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ করা চলবে না। চার. ব্যর্থ সেনা ঘটনার সঙ্গে যদি সিভিলিয়ানরা জড়িত থাকে, তাদের শাস্তির ব্যাপারে কোন ছাড় দেয়া যাবে না। তবে অহেতুক রাজনৈতিক নেতৃত্বকে টেনে না আনাই মঙ্গল।
বাংলাদেশের সেনাবাহিনী আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক। সারা বিশ্বে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে তারা নেতৃত্বের সারিতে রয়েছেন। এটা আমাদের কম পাওয়া নয়। বিপথগামী কিছু ব্যক্তি, এ ধরনের অপকর্ম করে শুধু সেনাবাহিনীর এই অর্জনকে নষ্ট করতে চায়। এরা বাংলাদেশের শত্র“। গণতন্ত্রের শত্র“। আমাদের আশার কথা সেনাবাহিনীর ঐক্যে তাতে এতটুকুও ফাটল দেখা দেয়নি। এটা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কোন তত্ত্বেই এর সমর্থন মেলে না। সারা বিশ্ব যেখানে গণতন্ত্রমুখী, যেখানে সামরিক অভ্যুত্থান পশ্চিমা বিশ্বে কোথাও গ্রহণযোগ্যতা পায় না, সেখানে গুটিকয়েক ব্যক্তির এই অপচেষ্টা, শুধু নিন্দাই কুড়াবে মাত্র। এ ঘটনা বাংলাদেশের দুটি বড় দলকে যদি গণতন্ত্রের স্বার্থে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসতে পারে, তাহলে আগামীতে আমরা গণতন্ত্রকে আরও কিছুটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারব। দেখার বিষয় বড় দলগুলো এই সুযোগটি নেয় কিনা।
দৈনিক যুগান্তর ২৭ জানুয়ারি ২০১২।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ প্রসঙ্গে দুটি কথা


সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব ঘটনা হতে চলেছে, তাতে করে একজন শিক্ষক হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। প্রায়ই আমাকে এক ধরনের বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। এতদিন ছাত্রদের রাজনীতির কারণে শিক্ষাঙ্গনে অশান্তি ছিল। এখন শিক্ষকরা এমন সব কর্মকা-ে নিজেদের জড়িত করছেন, যাতে করে শিক্ষক হিসেবে আমাকে পরিচয় দিতেও লজ্জা লাগে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্ব ছাত্র পড়ানো। কিন্তু সেই কাজটিও আমি ঠিকমতো করতে পারছি না পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকার কারণে। দুটো ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করছি। যা আমাকে ব্যথিত করেছে। এক. অধ্যাপক আসিফ নজরুলের কক্ষে তালা ও আগুন দেয়া। সেইসাথে তাকে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি। দুই. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনির্বাচিত শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এ মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর কর্তৃক লাঞ্ছিত। ওই ঘটিনায় প্রক্টর অবশ্য পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তা তিনি করেছেন ছাত্র ও শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে। কিন্তু তিনি বা তার সমর্থকরা যে কা-টি করলেন, তা কি উপাচার্য মহোদয়কে একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিলেন না? ওই ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভিসিকে তলব করেছিল। এতে করেই বোঝা যায় শিক্ষামন্ত্রী ওই ঘটনায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। একজন ভিসিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন তলব করে তখন তো আমরাও লজ্জিত হই। কেননা তিনি তো আমাদের সহকর্মী। হয়ত আগামীকালই তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। তিনি শিক্ষক এটাই তার বড় পরিচয়। এর আগে হাইকোর্ট তাকে একবার তলব করেছিলেন। এটাও তার জন্য সুখের ছিল না। তখন একজন শিক্ষক তার একজন নারী সহকর্মীকে যৌন নিপীড়ন করেছিলেন। তাতে সারাদেশ সোচ্চার হয়েছিল। শিক্ষক রাজনীতি এমনই যে ওই শিক্ষককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেননি উপাচার্য। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে (সাঈদী) কথা বলেছেন। সস্নোগান '৭১ নামে একটি সংগঠন তার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, ক্যাম্পাসে তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি যে পূর্ণ নিরাপত্তায় আছেন তা বলতে পারব না। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি বুঝি দেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, তখন তার বুঝে শুনে কথা বলা উচিত ছিল। যদিও তিনি অস্বীকার করেছেন তিনি ওই ধরনের কথা বলেননি। কিন্তু ততদিন কি অনেক দেরি হয়ে যায়নি? একজন আইনের শিক্ষক হিসেবে তিনি তো জানবেন, কোন কথাটা বলা ঠিক, কোনটা ঠিক নয়। আমাদের মূল্যবোধ দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে। সিনিয়র শিক্ষকদের আমরা সম্মান করি না। ব্যক্তি তথা দলীয় স্বার্থ যেখানে বেশি, সেখানে নূ্যনতম সম্মানবোধ এতটুকুও স্থান পায় না জাবির অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছনা করার ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবমূর্তি জাতির কাছে কতটুকু উজ্জ্বল হয়েছে, এটা লাঞ্ছনাকারীরা কতটুকু উপলব্ধি করেছেন, আমার সন্দেহ হয়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেকে অপমানিত বোধকরি। আমি অনেক 'ছোট' হয়ে গেছি অন্যদের কাছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে আলোচিত। একের পর এক ছাত্র হত্যা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না। নারী শিক্ষক নির্যাতনকারীকে আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারিনি। একজন সিনিয়র শিক্ষক একজন জুনিয়র শিক্ষককে 'চড়-থাপ্পর' পর্যন্ত মেরেছিলেন। 'ফেসবুকে' একজন সিনিয়র শিক্ষককে নিয়ে যখন লেখালেখি হলো, তখন প্রশাসন ছিল নির্লিপ্ত।  একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে। একজন শিক্ষক ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর 'মৃত্যু' পর্যন্ত কামনা করেন। কী জঘন্য অপরাধ। এখানে উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এরচেয়ে তো আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। প্রতিটি অন্যায়ের যদি বিচার হতো, তাহলে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটছে, তা ঘটত না। স্বীকার করি প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনাকারী শিক্ষক রুহুল আমিন খন্দকার বর্তমান উপাচার্যের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হননি, কিন্তু বর্তমান উপাচার্যের আমলে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ করেছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার চাইতে ব্যক্তিগত আনুগত্য ও রাজনৈতিক আনুগত্যতা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এরা তাই সিনিয়রকে সম্মান করে না। করতে শেখেনি। 
হত্যার বিচারের দাবিতে মশাল মিছিল
একজন ছাত্র এক সময় শিক্ষক হবে। শিক্ষকের ছত্রচ্ছায়ায় সে নিজেকে বিকশিত করবে। এটাই স্বাভাবিক। যুগে যুগে তাই হয়ে আসছে। কিন্তু আজ 'ছাত্র'-শিক্ষকের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তোলে! আর উপাচার্য মহোদয় রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই 'শিক্ষকের' বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। এ কোন বিশ্ববিদ্যালয় আমরা দেখছি? জাবির শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের সংবাদ ছেপেছে একটি পত্রিকা। এগুলো সবই কি অসত্য? দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে উপাচার্য মহোদয়ের সম্মান কি তাতে বেড়েছে? উপাচার্য নিজে একজন প-িত মানুষ। ভালো গবেষক। তাহলে তার হাত দিয়ে এসব অনিয়ম হলো কী করে? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে থাকতে হবে আরো অনেক দিন। কিন্তু ভরসা পাচ্ছি না। একজন অধ্যাপক মামুনের ওপর হামলা হয়েছে। কাল যে আমার বিরুদ্ধে হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? এমনিতেই আমি 'বিপদ'-এ আছি। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আমাকে থানায় জিডি পর্যন্ত করতে হয়েছে। সেদিনও আমি কর্তৃপক্ষের সাহায্য পাইনি। আজ মামুন যখন লাঞ্ছিত হলেন, তিনিও কর্তৃপক্ষের সাহায্য ও সহযোগিতা পাবেন, তা মনে হয় না। উপাচার্যের অবস্থান হওয়া উচিত নিরপেক্ষ। অধ্যাপক মামুনের লাঞ্ছনার ছবি যখন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তখন তার উচিত ছিল সিনিয়র শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা। তিনি তা করেননি। না করে তিনি তার নিরপেক্ষতা খুইয়েছেন। তিনি উপাচার্য। এর অর্থ তিনি আমাদের অভিভাবক। একজন শিক্ষক যখন লাঞ্ছিত হন, তখন তার পাশে তার দাঁড়ানো উচিত। তাকে উপদেশ দেয়ার উদ্দেশ্য আমার নয়। কিন্তু তিনি এখনও পারেন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে। যদি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়, ভালো। নতুবা উপস্থিত শিক্ষকদের মতামত নেয়া যেতে পারে। একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলে, আমার বিশ্বাস, শিক্ষকরা আর আন্দোলনে যাবেন না। যার বিরুদ্ধে অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে উঠেছে, তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার কথায় হয়ত সাধারণ শিক্ষকরা আস্থা রাখতে পারছেন না। কিন্তু একটি তদন্ত কমিটি যদি তাকে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয়, এটা তার নিজের জন্যও ভালো। এতে করে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। গত শনিবার একজন অভিভাবক যখন আমাকে পেয়ে রীতিমত অভিযোগ করলেন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে,তাকে আমি জবাব দিতে পারিনি। আগামীতে আমি জবাবটি দিতে চাই। এ জন্য উপাচার্য মহোদয়কেই এগিয়ে আসতে হবে। 
নিহত জুবায়ের
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক রয়েছেন, দেশজুড়ে যাদের পরিচিতি রয়েছে। একজন শিক্ষকের জন্য আমরা কেন সবাই অপমানিত হব? জাতির কাছে কেন ছোট হব? শিক্ষিকা নির্যাতনকারীকে আমরা হালকা শাস্তি দিয়েছি। সেদিন শিক্ষক হিসেবে আমরা অসম্মানিত হয়েছিলাম। সেদিনও আমরা বলেছিলাম ওই কুলাঙ্গার শিক্ষককে দিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষক সমাজকে বিবেচনা করা যাবে না। আজ যারা অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছিত করেছে, তারা শিক্ষক বটে। কিন্তু তাদের দিয়েও সব শিক্ষককে বিবেচনা করা যাবে না। আরো একটা কথা। কোনো অবস্থাতেই দীর্ঘস্থায়ী ক্লাস যাতে বন্ধ না থাকে, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া সবার উচিত। আমি আশা করি সব শিক্ষকই এটা চান। কর্তৃপক্ষ এদিকে নজর দেবেন। আমার কথা জাহাঙ্গীরনগরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। কর্তৃপক্ষ নতুন একজন প্রক্টর নিয়োগ করেছেন। যদিও তার সম্পর্কে কথা উঠেছে তিনি বেশিরভাগ সময়ে দেশের বাইরে থাকেন। এমতাবস্থায় তিনি ক্যাম্পাসে শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করবেন কীভাবে? জাহাঙ্গীরনগরে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, তখন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। সেখানে সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। উপাচার্যের প্রশাসন পরিচালনা নিয়েও কথা আছে। স্বয়ং ইউজিসির চেয়ারম্যান শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে উপাচার্যের উপস্থিতিতেই তার সমালোচনা করেছিলেন। ওই সমালোচনার মুখে তিনি পদত্যাগের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। দুর্নীতির ও অযোগ্যতার অভিযোগ যদি থাকে এবং শিক্ষকদের মধ্যে যদি তার ব্যাপারে আস্থার ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে সসম্মানে বিদায় নেয়াই শ্রেয়। জোর করে ক্ষমতায় থাকা শোভন নয়। প্রতিটি ক্যাম্পাসেই যা ঘটছে তা ভালো নয়। দৃষ্টিকটু। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। শিক্ষক-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি যেন দেখা না হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে জুবায়ের হত্যার যেমনি বিচার চাই, ঠিক তেমনি বিচার চাই অধ্যাপক মামুনের লাঞ্ছিত করার ঘটনারও। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র পড়তে আসে। জীবন দিতে আসে না। আমরা যদি ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারি, এ ব্যর্থতা আমাদের সবার। যে অচলাবস্থা জাহাঙ্গীরনগরে সৃষ্টি হয়েছিল তা কাম্য নয়। সবে প্রথম বর্ষের ছাত্ররা তাদের শিক্ষাজীবন শুরু করেছে। তারা এ ঘটনায় কী শিক্ষা পেল? তারা দেখল তাদের এক সিনিয়র বড় ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। তারা দেখল একজন শিক্ষক অপর একজন শিক্ষকের ওপর চড়াও হয়েছে। শিক্ষকদের ওপর তাদের আস্থা কী থাকে আর? আমি লজ্জিত। দুঃখিত। এবং অপমানিত বোধ করছি পুরো ঘটনায়। আসুন সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে আমরা কাজ করি। দৈনিক যায় যায় দিন,  ২৭ জানুয়ারি ২০১২ ড. তারেক শামসুর রেহমানপ্রফেসর,  আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগজাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আস্থার একটা জায়গা তৈরি হয়েছে

ছাত্রীকে যৌনকর্মী সাব্যস্ত করায় ইউএনওকে হাইকোর্ট তলব করেছেন। এ ধরনের একটি সংবাদ ছাপা হয়েছে সকালের খবর-এ, গত ১৮ জানুয়ারি। একজন ইউএনও একজন স্নাতক ছাত্রীকে পতিতা হিসেবে রায় দিয়েছিলেন। এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল জাতীয় দৈনিকে। ওই রিপোর্টটি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চের নজরে আনা হলে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইউএনওকে তলব করেন। গত ২৩ জানুয়ারি ইউএনও হাইকোর্টে উপস্থিত হন। মহামান্য হাইকোর্ট উক্ত ঘটনা তদন্তের জন্য একটি কমিটি গঠন করার নির্দেশ দিয়েছেন। অতীতে হাইকোর্টের এই বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এমন অনেক রায় দিয়েছেন, যা আমাদের আশান্বিত করেছে। আমরা একটা আস্থার জায়গা খুঁজে পেয়েছি। ফেইসবুকে প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনা করে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। সেদিন উপাচার্য ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে কোনো ব্যবস্থা নেননি। কিন্তু হাইকোর্টের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল ওই সংবাদে। তখন হাইকোর্টের এই বেঞ্চ একটি রায় দিয়েছিলেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে নিজেও জাবিতে ফেইসবুক সন্ত্রাসের শিকার হয়েছিলাম। সেদিন উপাচার্যকে লিখিতভাবে জানানোর পরও উপাচার্য অভিযোগটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেননি। হাইকোর্টের ওই রায়ের পর (ফেইসবুক সংক্রান্ত) আমি আশা করব জাবির উপাচার্য ফেইসবুক কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত করবেন। হাইকোর্ট বিষয়টি দেখবেন, সেটাও আমি আশা করব। কেননা আমাদের আস্থার জায়গাটা তো ওই হাইকোর্ট।
যে ‘গুণধর’ একজন ছাত্রীকে পতিতা হিসেবে রায় দেন তার নাম কাউসার নাসরীন। তিনি নীলফামারী জেলার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা। তার নামও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। আমার ভাবতে অবাক লাগে একজন নির্বাহী কর্মকর্তা কী করে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত দিতে পারেন। তিনি তো উচ্চশিক্ষিত। সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রিও নিয়েছেন। একজন কলেজে পড়ুয়া ছাত্রী যদি কারও সঙ্গে কোনো প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে, তাকে তো কোনো অবস্থাতেই ‘পতিতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করা যায় না এবং তাকে এক টাকা জরিমানাও করা যায় না। গুণধর কাউসার নাসরীন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে তার নিজের যোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিলেন না, বরং প্রশাসনের ক্যাডারদের ভূমিকা ও যোগ্যতাকেও প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন। আরেকজন ‘গুণধর’ প্রাশাসনিক কর্মকর্তার নাম বলি। তিনি হচ্ছেন জনাব মুজাহিদ। তিনি পিরোজপুর জেলা সদরের এসি (ল্যান্ড)। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগ প্রচুর। আমি নিজেও তার একটি অন্যায় সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছি। ক্ষমতায় থাকলে সিদ্ধান্ত দেওয়া যায়। কিন্তু ওই সিদ্ধান্তটি যদি অযৌক্তিক ও নিয়মবহির্ভূত হয়, তাহলে তার ওই সিদ্ধান্তটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে বৈকি! জনাব মুজাহিদ কিংবা কাউসার নাসরীনরা প্রশাসনের প্রতিনিধিত্ব করেন। ওরা এক সময় সচিব পর্যন্ত হবেন। তারা কি এই যোগ্যতা রাখেন? লোভ যেখানে জনাব মুজাহিদকে সিদ্ধান্ত নিতে প্ররোচিত করে, সেখানে পর্যায়ক্রমে মুজাহিদ সাহেবরা সচিব হলে কী করবেন, আল্লাহ মালুম। কাউসার নাসরীন আর মুজাহিদরা আমাদের জন্য কোনো আশার জায়গা নয়। হাইকোর্টের ওই রুলের পরিপ্রেক্ষিতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যদি কাউসার আর মুজাহিদদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়, আমি খুশি হব। প্রসঙ্গক্রমেই এসে গেল পুলিশ বিভাগে পাঁচটি সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তার পদ সৃষ্টির প্রসঙ্গটিও।
পুলিশ বাহিনীর শীর্ষ পাঁচজন ‘এ’ গ্রেডভুক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা হবেন। একই সঙ্গে পুলিশ পরিদর্শকদের (ইন্সপেক্টর) প্রথম শ্রেণী ও উপপরিদর্শকদের (এসআই) দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে উন্নীত করা হচ্ছে। গত ৩ জানুয়ারি পুলিশ সপ্তাহ ২০১২ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা নিঃসন্দেহে পুলিশ বাহিনীকে সন্তুষ্ট করবে। কিন্তু যে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশ বাহিনী চলে, সেই জনগণের কাছে পুলিশের আস্থা এতে কতটুকু বাড়বে? নানা কারণে পুলিশ আজ বিতর্কিত। সংসদ সদস্য ফারুককে পিটিয়ে আহত করার ঘটনার মধ্য দিয়ে পুলিশের ‘সাফল্য’ কতটুকু নিহিত ছিল, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু এতে করে পুলিশের ভাবমূর্তি দেশে ও বিদেশে উজ্জ্বল হয়নি, এটা আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরেই ‘তদবির’ করে আসছিলেন তাদের জন্য ১০টি ‘সচিব পদ’ সৃষ্টি করা হোক। ব্যক্তিগত আলাপ চারিতায় অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আমার কাছে এর যুক্তি তুলে ধরেছেন। এর প্রয়োজনীয়তা আছে কি নেই, এই বিতর্কে আমি যাব না। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ‘পাঁচ সচিব পদ’ সৃষ্টির ঘোষণার একদিন আগে দৈনিক যুগান্তরে যে প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল (সারা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেসামাল), তাতে আমি হতাশ না হয়ে পারি না। আমার আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মহাজোট সরকারের ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে যুগান্তর প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল, তাতে দেখা যায় সারা দেশে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ৯ হাজার ১০৪টি, অপহরণ হয়েছে ১ হাজার ২৮০টি, ক্রসফায়ার হয়েছে ৪০৪টি, গুপ্তহত্যা হয়েছে ৭১টি, রাজনৈতিক খুন ৫০০, চাঞ্চল্যকর তিনটি হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ আসামিকে দণ্ডাদেশ মওকুফ, শাসক দলের ৭ হাজার ১০০ নেতাকর্মীর মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই যে পরিসংখ্যান, এই পরিসংখ্যান কি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত বাহিনীর জন্য কোনো আশার সংবাদ? শীর্ষস্থানীয় পুলিশ কর্মকর্তারা কি এ সংবাদে খুশি? আমরা সাধারণ আমজনতা, আমরা এ ঘটনায় খুশি নই। পুলিশ বাহিনী এখন ‘পাঁচজন সচিব’ পাবে। তাতে করে আমাদের আমজনতার লাভ কী হল? ‘সচিব পর্যায়ের’ পদ সৃষ্টি করে সম্মান বাড়ানো যায় না। তবে আমি  পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা (যার আইজি হওয়ার কথা ছিল) ফণীভূষণ চৌধুরীর বক্তব্যে কিছুটা আশার আলো দেখতে পেয়েছি। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশের অনেক ব্যর্থতা আছে। থানায় প্রকৃত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। পুলিশ ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে মামলা কিংবা জিডি নিতে চায় না। পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি বাড়ছে। এমনকি ক্ষমতার অপব্যবহারও হচ্ছে।’ ফণীবাবুর এই বক্তব্য (পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে) পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছিল। জানি না আইজিপি হলে তিনি এ ধরনের কথা বলতে পারতেন কি না। তবুও তাকে সাধুবাদ জানাই সত্য কথা বলার জন্য। যে অনুষ্ঠানে তিনি তার বক্তব্য রাখছিলেন, সেখানেও অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। একজন সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তার আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে (সকালের খবর, ৪ জানুয়ারি)। সিনিয়ার পুলিশ কর্মকর্তাদের এ ধরনের আচরণ কাম্য নয়। এতে করে পুলিশের মতো একটি শৃঙ্খলা বাহিনীর চেইন অব কমান্ড ভেঙে যায়। এতে করে অন্যরা আরও উত্সাহিত হতে পারেন। ফণীবাবুর বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। আজ একজন ফণীবাবু বলছেন, কালকে আরেকজন বলবেন। পুলিশ বিভাগে দুর্নীতি কি ‘ওপেন সিক্রেট’ নয়? জুনিয়ার কর্মকর্তারা ঢাকায় পোস্টিং পেতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন এই অভিযোগটি কি অসত্য? ঢাকায় পুলিশ কর্মকর্তাদের নামে-বেনামে যে সম্পত্তি রয়েছে, তা কি বৈধ? সাবেক একজন আইজিপির সংবাদ ছাপা হয়েছিল, যিনি ৩০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। সরকার তাকে রাষ্ট্রদূত পদে নিয়োগ দিয়েছে। কিন্তু ওই অভিযোগটি কি অসত্য? দুদক বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবে, এটা শুনেছিলাম। এর পরের খবর আমরা জানি না। তবুও আমি চাই উত্থাপিত অভিযোগটি মিথ্যা প্রমাণিত হোক। কেননা সবাই আইজিপি হতে পারেন না। তিনি যদি অভিযুুক্ত হন, তাহলে জাতির আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়।
পুলিশ বিভাগে পাঁচজন সচিব পদ সৃষ্টি করে পুলিশের সেবার মান বাড়ানো যাবে না। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের জন্য সরকারের ব্যয় বরাদ্দ এখন এমনিতেই অনেক বেশি। এরপর পাঁচটি পদ সৃষ্টির ফলে রাষ্ট্রের ব্যয় বরাদ্দ আরও বাড়বে। বাংলাদেশের মতো একটি গরিব রাষ্ট্রে সচিবদের সংখ্যা অনেক। সচিবদের যোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এখন বিশ্বব্যাপী কৃচ্ছ্র সাধন চলছে। অনেক ধনী রাষ্ট্র রাষ্ট্রের ব্যয় বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে গ্রিস, ইতালি কিংবা পর্তুগাল ও স্পেনের খবর আমরা জানি। সেখানে বিশ্ব মন্দার কারণে অর্থনীতি মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থাও খুব ভালো নয়। মুদ্রাস্ফীতি কমানো যাচ্ছে না। ডলারের সঙ্গে টাকার মান সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে এসেছে। রেমিট্যান্সের প্রবাহ কম। রিজার্ভও বাড়ছে না। সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দৈনন্দিন চাহিদা মেটাচ্ছে। অর্থনীতি নিয়ে যখন আমরা শঙ্কায়, তখন এই মুহূর্তে পুলিশ বিভাগে পাঁচ সচিবের পদ সৃষ্টি করার প্রয়োজন ছিল না। এতে করে খরচ আরও বাড়বে। এই মুহূর্তে পাঁচ সচিবের প্রয়োজন নেই। প্রধানমন্ত্রী একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। এই সিদ্ধান্ত মানতেই হবে। এই সিদ্ধান্তটি যদি পরে কার্যকর হয়, তাতে ক্ষতির কিছু নেই। এই মুহূর্তে যেটা প্রয়োজন, তা হচ্ছে পুলিশের ভাবমূর্তি উদ্ধার করা। র্যাবের ভূমিকা আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে ‘মনিটর’ করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো র্যাবের ভূমিকায় আজ সোচ্চার। ঝালকাঠির লিমনের ঘটনায় দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি। র্যাবের অনেক ভালো কাজ এই একটি ঘটনায় ম্লান হয়ে গেছে। ঢাবির মেধাবী ছাত্র আবদুল কাদেরকে নির্যাতন করা ও তার বিরুদ্ধে ছিনতাইয়ের মামলা দেওয়া-এই একটি ঘটনায় পুলিশের ভাবমূর্তি কোথায় নেমে গিয়েছিল সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তারা তা যদি উপলব্ধি করে না থাকেন, তাহলে তারা ভুল করবেন। উচ্চ আদালত ‘কাদেরের ঘটনায়’ কী মন্তব্য করেছিলেন, আমরা নিশ্চয়ই তা ভুলে যাইনি।
আজ উচ্চ আদালত একজন ইউএনওর ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে যে রুল ইস্যু করেছেন, তা একটি আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। উচ্চ আদালতের এই রায়টি এল এমন একটি সময় যখন প্রশাসনে ৮টি সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। সিনিয়র সচিব পদ সৃষ্টি করে কি প্রশাসনের দক্ষতা বাড়ানো যাবে? এতে করে তো সরকারের খরচ আরও বাড়ল। যখন কাউসার নাসরীন আর মুজাহিদের মতো প্রশাসনিক ক্যাডারের অযোগ্যতা ও অদক্ষতা উচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তখন সিনিয়র আট সচিব পদ সৃষ্টি আমাদের কোনো আশার বাণী শোনায় না। আমি জানি একজন কাউসারকে দিয়ে সব প্রশাসনিক ক্যাডারকে বিচার করা যাবে না। ঠিক তেমনি একজন মুজাহিদকে দিয়ে আমার সব ছাত্রকে (যারা এসি-ল্যান্ড হয়েছে) আমি বিচারও করতে পারব না। তবে ছোটখাটো ঘটনায় হতাশার জায়গা তৈরি হয়। বলতে দ্বিধা নেই-অনেক এসি (ল্যান্ড) ও সচিবকে আমি পেয়েছি, যারা যথেষ্ট দক্ষ। মহামান্য হাইকোর্টের একটি রুল ইস্যু আমাদের একটা ভরসার জায়গা তৈরি করেছে। প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এ থেকে যদি কিছু শেখেন, যদি জুনিয়র কর্মকর্তাদের ‘জনগণের সেবক’ হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন, তাহলে তা প্রশাসনের জন্য ভালো। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে নয়, বরং অন্যায়কারীকে শাস্তি দেওয়াই শ্রেয়।
দৈনিক সকালের খবর ২৬ জানুয়ারি ২০১২।
লেখক : প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd(a)yahoo.com

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাই, বাণিজ্য নয়

শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও ইউজিসির সদস্য থাকার সুবাদে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আমি বিরোধিতা করছি। কেননা এতে একদিকে সার্টিফিকেট বাণিজ্য হবে, অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে 'মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের' বিস্ফোরণ ঘটবে, যারা একসময় 'মামা-খালুর' জোরে কিংবা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনের উচ্চ পদগুলো দখল করবে এবং আমরা পরিণত হবো একটি মেধাশূন্য জাতিতে। কারা সেখানে শিক্ষক হবেন, এটা কি বিবেচনায় নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী?
দু'দুটি জাতীয় দৈনিকে এখন এই জানুয়ারি মাসে সরকার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেসরকারি) অনুমোদন দিতে যাচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, ঠিক তখনই অন্য একটি জাতীয় দৈনিক ধারাবাহিকভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি ছাপছে। বিষয়টি কাকতালীয়ভাবে কি-না জানি না, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি সরকারের নীতিনির্ধারকরা সংবাদগুলো মিলিয়ে দেখবেন। ১৯ ও ২১ জানুয়ারি প্রকাশিত দুটি জাতীয় সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পড়ে যা জানা গেল তা হচ্ছে, ৭৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন চূড়ান্ত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। যা আমাকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে তা হচ্ছে, আবেদনকারীদের মধ্যে ৪ জন রয়েছেন_ যারা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ব্যবসায়ী, সাবেক আমলা, সাংসদ_ তাদের কথা নাইবা বললাম। সংবাদে এমন কথাও বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয় একটি 'ফিট লিস্ট' তৈরি করেছে, যার ভিত্তিতে নতুন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার অনুমতি দেওয়া হবে এবং প্রধানমন্ত্রী এগুলো অনুমোদন করবেন।
উচ্চশিক্ষা কোনো ব্যবসা নয় যে, এখান থেকে মুনাফা অর্জন করতে হবে। মুনাফা অর্জন করার অনেক জায়গা রয়েছে। ঢাকা তো এখন 'দোকানদার'দের শহরে পরিণত হয়েছে। নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে পণ্যের মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করলেও কারও কিছু বলার নেই। ব্যবসা করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তাহলে 'বাণিজ্য' কেন? আর যদি 'বাণিজ্য' করতেই হয়, তাহলে সরকারকে এটা ঘোষণা দিতে হবে_ এখানে যে কেউ পুঁজি বিনিয়োগ করে এখান থেকে 'মুনাফা' তুলে নিতে পারবেন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও তাহলে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা দিতে হবে! কথাটা শুনতে খারাপ শোনায়; কিন্তু বাস্তবতা কি তাই বলে না? যেখানে খোদ ৫৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বাণিজ্য আমরা বন্ধ করতে পারছি না, সেখানে ইউজিসি আরও ৭৫টি আবেদন চূড়ান্ত করে কীভাবে? তাহলে কি ধরে নেব শর্ষের মধ্যে ভূত আছে!
শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা ও ইউজিসির সদস্য থাকার সুবাদে নতুন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আমি বিরোধিতা করছি। কেননা এতে একদিকে সার্টিফিকেট বাণিজ্য হবে, অন্যদিকে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে 'মাস্টার্স ডিগ্রিধারীদের' বিস্ফোরণ ঘটবে, যারা একসময় 'মামা-খালুর' জোরে কিংবা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রশাসনের উচ্চ পদগুলো দখল করবে এবং আমরা পরিণত হবো একটি মেধাশূন্য জাতিতে। কারা সেখানে শিক্ষক হবেন, এটা কি বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে? কারা বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্য হয়েছেন এবং আগামীতে হবেন, তা কি অজানা? বিদেশি দূতাবাসে কাজ করা ব্যক্তি এখন উপাচার্য নামের আগে অবৈধভাবে 'অধ্যাপক' লেখেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ ব্যাপারে কি করণীয় কিছু নেই?
না, আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে নই। কিন্তু শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে আমি 'কমপ্রোমাইজ' করতে রাজি নই। হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েটকে বিশ্বের 'জব মার্কেটে' নিয়ে যেতে হলে শিক্ষার মান বাড়াতে হবে। এর বিকল্প নেই। আজ প্রায় ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সরকারি ও বেসরকারি) সঙ্গে কলেজের কোনো পার্থক্য আমি খুঁজে পাই না। সবগুলোতে বিবিএ চালু হয়েছে। বাংলায় পড়ানো হয় বিবিএ। নোট তৈরি করে দেন 'স্যাররা'। ক্লাসে উপস্থিত থাকার বালাই নেই। উপস্থিত থাকলেও নোটবই খুলে লেখায় কোনো বারণ নেই। আর গ্রেডিং মান সর্বোচ্চ। ওই 'গোল্ড মেডেল'ধারীদের একজনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাননি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে শিক্ষার মান আজ কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, করপোরেট হাউসগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তা জানেন। আগে বাংলায় পাস করেও ব্যাংকে চাকরি পাওয়া যেত। এখন বাংলার জায়গা দখল করেছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটরা। বেতন পনের হাজারেরও নিচে (আমাদের জমানায় আইবিএ-এমবিএর সূচনা বেতন ছিল প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো, সেই আশির দশকে)। করপোরেট হাউসগুলো শোষণ করছে। আর এর ক্ষেত্র তৈরি করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। যেহেতু আবেদনকারীদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে অনুমোদন দিতে হবে, সে ক্ষেত্রে কতগুলো নীতি অনুসরণ করা যায়। এক. সুনির্দিষ্টভাবে বলে দিতে হবে তাদের শিক্ষার কারিকুলাম সীমাবদ্ধ থাকবে নির্দিষ্ট কয়েকটি বিষয়ের ওপর। এর বাইরে কোনো বিষয়ের জন্য তারা ভবিষ্যতে আবেদন করতে পারবে না। দুই. একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় একেকটি বিষয় নিয়ে তাদের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করতে পারে। এক গাদা বিষয়ে তারা ছাত্রভর্তি করাতে পারবে না। তিন. ফার্মেসি, আইটি, গার্মেন্ট, মেরিন সায়েন্স, বিদেশি ভাষা, জাহাজ নির্মাণ প্রকৌশল, জিন প্রযুক্তি, অটো মেকানিকস্, কৃষিপ্রযুক্তি তথা কৃষিবিজ্ঞান, নার্সিং, পরিবেশ, মহাশূন্য ইত্যাদি বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করে দিতে হবে। এক একটি বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে থেকে তিন-চারটি বিষয় নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে পারে। ফার্মেসি, গার্মেন্ট, জাহাজ নির্মাণ শিল্পে আমাদের মান আন্তর্জাতিক সম্পন্ন এবং আমরা একটি নেতৃত্বের আসনে রয়েছি। অন্যদিকে নার্সিং খাত, মেরিন সায়েন্স ও সাগরবিজ্ঞান, পরিবেশ ও কৃষি একটি অগ্রাধিকার খাত। বিদেশে প্রচুর চাহিদা রয়েছে এবং এসব ফিল্ডে আমরা প্রচুর জনশক্তি রফতানি করতে পারব। এ জন্য বিদেশি ভাষানির্ভর একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। বিষয়ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত বিশ্বে আজও রয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগে উৎসাহিত করা যেতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে ইতিপূর্বে (১ জানুয়ারি) সমকালে প্রকাশিত আমার একটি লেখার (বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা) নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মূলত দু'জন। একজন (আবুল কাসেম হায়দার) একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা। অপরজন (মামুনুর রশিদ) একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। আরেকজন আবদুল মান্নান, এক সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি ও বর্তমানে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। তিনি অবশ্য আমার নাম উল্লেখ না করে সহযোগী অপর একটি দৈনিকে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন (সংকটের আবর্তে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়)। তিনটি লেখার মূল বিষয় একটাই_ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভালো, সংকট নেই, সেশনজট নেই। আমি কারও বক্তব্যের সমালোচনা করব না। শুধু একটা ব্যাখ্যা দেব। সিদ্ধান্ত নেবেন পাঠক। উদ্যোক্তা ও অধ্যাপক মহোদয় যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণগান গাইবেন, তাতে আমি অবাক হইনি। অবাক হয়েছি মামুনের লেখায়, যেখানে অসত্য তথ্য রয়েছে। জীবনটা যার সবে শুরু, সে যদি শুরুতেই বিভ্রান্তিতে পড়ে (টাকার মোহ), আমাকে তা কষ্ট দেয়। এই তরুণরাই 'আরব বিপ্লব' সম্পন্ন করেছে। এই তরুণরাই 'অকুপাই মুভমেন্ট'-এর জন্মদাতা। আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। এক. আমি কখনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপক্ষে নই। পক্ষে। আর এ কারণেই বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা হোক, আমি তা চাই। তাতে করে প্রতিযোগিতা বাড়বে। শিক্ষার মান উন্নয়নে তা সহায়ক হবে। কোন আইনে তা হবে, বিষয়টি দেখবে সরকার। তবে অবশ্যই তাদের পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় (শাখা) প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের লাভ, আমাদের ছাত্ররা বিদেশি শিক্ষকের অধীনে পড়তে পারবে। ক্রেডিট ট্রান্সফার সহজ হবে। দুই. আমি কখনও বলিনি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসা করতে দেওয়া হোক। তারা যদি ভালো পড়ায়, তাহলে ছাত্ররা সেখানেই ভর্তি হবে। তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তিন. চট্টগ্রামে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যানের জন্য সরকার জমি দিয়েছে। এটা যৌক্তিক। এখানে দাতা দেশগুলোর ফান্ড ও প্রশিক্ষকও রয়েছেন। ওই বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয়টির সঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা করা যাবে না। চার. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও প্রায় ক্ষেত্রে ৪টি ফার্সদ্ব ক্লাস ছাড়া শিক্ষক হওয়া যায় না। কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েই এই নিয়মটি রক্ষিত হয় না। পাঁচ. কোনো অবস্থাতেই কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ বছরে অধ্যাপক হওয়া যায় না। পিএইচডি থাকলে, ১২ বছরের ওপর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থাকলেও অধ্যাপক হওয়া যাবে না, যদি না নূ্যনতম ১০ থেকে ১২টি গবেষণাপত্র না থাকে (অবশ্যই তা হতে হবে রেফারড জার্নালে)। ছয়. কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১১-এ। আমি এর পক্ষে। এপিইউ কেন বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে না, আমি তা বুঝতে অক্ষম। আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্যও অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল গঠনের পক্ষে। সাত. আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের বিপক্ষে কথাটি সত্য নয়। কাসেম হায়দার, উপাচার্য সাবেক, উপাচার্য সাইফুল মজিদসহ অনেকে আমার বন্ধুসম। 'নেতিবাচক' বলা হয়েছে এ কারণে যে, এপিইউ কখনও মান উন্নয়ন, দুর্নীতি রোধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। আট. এপিইউর সদস্য, যারা সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে, তাদের সদস্যপদ বাতিল করতে হবে। নয়. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এবং উপাচার্যদের 'ডাটা ব্যাংক' প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং শিক্ষক নিয়োগে কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠীস্বার্থ নিরুৎসাহিত করতে হবে। এটাকে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যাবে না। পদোন্নতির নীতিমালা থাকতে হবে। স্ত্রী বা পুত্রকে ভিসি বানানো যাবে না।
মোট কথা একুশ শতকে দাঁড়িয়ে মানসম্মত শিক্ষা যদি আমরা দিতে না পারি, আমরা সার্টিফিকেটসর্বস্ব জাতিতে পরিণত হবো।
দৈনিক সমকাল, ২৬ জানুয়ারি ২০১২
প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান
অধ্যাপক আন্তর্জাতিক সম্পর্ক জাবি ও ইউজিসির সাবেক সদস্য

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে দুটি কথা

সীমান্তে বাংলাদেশিদের নগ্ন করে নির্যাতন করার যে কাহিনী গত ১৯ জানুয়ারি দৈনিক ডেসটিনিসহ অন্যান্য সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে, তা পাঠ করে যে বিষয়টি আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে? ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার নিকটবর্তী মোহনগঞ্জ সীমান্তে এক বাংলাদেশি গরু ব্যবসায়ীকে উলঙ্গ করে দল বেঁধে বিএসএফের নির্মম নির্যাতনের ঘটনা যখন ভারতীয় টেলিভিশন প্রচার করে, তখন এ দুটি দেশের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এ ঘটনায় ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তাতে করে কী বিএসএফের মনোভাবের আদৌ পরিবর্তন হয়েছে? না, পরিবর্তন হয়নি। ফেলানীর হত্যাকা-ের খবর বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, ভারতের মনোভাবের এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি। ফেলানীর ঘটনার অনেক পর বিএসএফ দুঃখ প্রকাশ করেছিল। ভারতের উচ্চ পর্যায় থেকে আমাদের ওয়াদা করা হয়েছিল এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু তারপরও সীমান্তে মানুষ মরছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কোনো না কোনো সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে নিরীহ বাংলাদেশিরা মারা যাচ্ছে। এসব ঘটনায় ভারতীয়দের মনোভাব আমাদের বুঝতে কষ্ট হয় না। ভারতীয়রা আমাদের সম্মানের চোখে দেখছে না। এভাবে গুলি করে মানুষ মারার ঘটনা কিংবা উলঙ্গ করে নির্যাতনের ঘটনা পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্তে ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি সীমান্তেই অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটে। কিন্তু তাই বলে অনুপ্রবেশকারীদের গুলি করে হত্যা করা? এটা চরম মানবাধিকার লংঘনের শামিল। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মেক্সিকোর দ্বন্দ্ব রয়েছে সীমান্ত নিয়ে। মেক্সিকান নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে অনুপ্রবেশের ঘটনা অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। এটা প্রতিরোধের জন্য যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন নানা পন্থা অবলম্বন করলেও, এটা বন্ধ হচ্ছে না। সুড়ঙ্গ তৈরি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে মেক্সিকান নাগরিকদের হত্যা করেছে, এ ধরনের ঘটনা কখনই ঘটেনি। এমনকি ইউরোপেও ধনী রাষ্ট্রগুলোতে অবৈধ অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে অহরহ। মানুষ পাচারকারীরা বিভিন্ন রুট দিয়ে ফ্রান্স কিংবা যুক্তরাজ্যে মানুষ পাচার করে। সীমান্তে এরা ধরাও পড়ে। কিন্তু গুলি করে হত্যা করার ঘটনা কখনই ঘটেনি। সাধারণত পাচারের সময় ধরা পড়ে এবং তাদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যা ঘটছে এবং ঘটে চলেছে, তা কোনো মতেই সমর্থনযোগ্য নয়। ভারতের উদ্দেশ্য যে সৎ নয়, এটা তারা বারবার প্রমাণ করছে। এসব হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটছে এমন এক সময় যখন বর্তমান সরকার ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
মহাজোট সরকারের গত তিন বছরে যে বিষয়টি উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা ও ভারতীয় স্বার্থের ব্যাপারে বাংলাদেশের অঙ্গীকার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর (২০১০) ও ফিরতি সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় আসা (২০১১) ছিল দুদেশের মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। শুধু তাই নয়, সোনিয়া গান্ধী এবং একাধিক ভারতীয় মন্ত্রীর ঢাকা সফর গেল বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটি উচ্চ মাত্রায় পেঁৗছে দিয়েছে। অন্যদিকে চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পাকিস্তনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এই তিনটি দেশের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই জাতীয় স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হয়নি, এমন অভিযোগও উঠেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষতা দিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা যখন মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তখন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিগত বছরে এ প্রশ্নটি বারবার উঠেছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এর ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি গত তনি বছরে সবচেয়ে বেশি দিন বিদেশে কাটিয়েছেন। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে তিনি খুব একটা সফল না হলেও, বিদেশ সফরে তিনি সফল হয়েছেন। সংখ্যার দিক থেকে যা একশ দিন অতিক্রম করেছে (২০১১) অনেক আগেই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার শিশুসুলভ বালখিল্যতায় প্রটোকল উপেক্ষা করে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে ছবি তুলে ও অটোগ্রাফ সংগ্রহ করে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা সমৃদ্ধি করতে পারলেও (বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৪ নভেম্বর) গত তিন বছরে বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সাফল্য বয়ে আনতে পারেননি। গেল বছরের প্রায় শেষের দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক গত সেপ্টেম্বরে প্রস্তাবিত জনগণের ক্ষমতায়ন মডেল সংক্রান্ত 'জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন' শীর্ষক রেজ্যুলেশনটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বড় পাওয়া। প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বকে আরো স্পষ্ট করেছিলেন। কিন্তু 'ভারতমুখী' পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের সব অর্জনকে মস্নান করে দিয়েছে। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে 'ভাষা' ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে করে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাল্লাটা ভারতের দিকে ঝুঁকে গেছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তিটা তুলনামূলকভাবে কম। বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও (৪৮:৫২ ভাগ), চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হবে না এবং সেখানে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশকে জানানো হবে, এ ধরনের প্রতিশ্রুতি ভারত দিলেও, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ সংক্রান্ত একটি চুক্তি গত ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তার কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাজ কার্যকর হলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়ার ও এ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। ঘাটতি বাড়ছে। ভারত অতি সম্প্রতি ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বললেও, তা দিয়ে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যাবে না। স্পর্শকাতর তালিকা বাদ কিংবা সাফটা চুক্তি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পরপরই বেরুবাড়ি আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিন বিঘা আমরা পাইনি। সমুদ্র সীমানা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিবাদ (ভারত-বাংলাদেশের সীমানার ৮নং বস্নকে ৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা দাবি করেছে। ৪নং বস্নকেরও দাবি ভারতের) দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সমাধান হয়নি। এখন আমরা আছি আরবিট্রেশনে। ফলশ্রুতি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হলেও, দেখা গেছে বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের অর্জন কম; কিন্তু ভারতের প্রাপ্তি অনেক বেশি। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি এক ধরনের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাও আমরা লক্ষ করি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে চীন সফর করে এই দুই নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে পররাষ্ট্রনীতিতে এক ধরনের ব্যালেন্স বা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। চীন সফরের সময় তিনি কুনমিং-কক্সবাজার সড়ক ও বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। চীন এ ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছে। কুনমিং-কক্সবাজার মহাসড়ক নির্মিত হলে, তা এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। এর ফলে আগামীতে আমরা সড়কপথেই যে শুধু চীনে যেতে পারব তা নয়, বরং চীন তার ইউনান প্রদেশের পণ্য রফতানিতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরও ব্যবহার করতে পারবে। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। আমাদের জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। এখন দেখতে হবে ভারত-বাংলাদেশ পরিবর্তিত সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। ইতিমধ্যে চীনকে সার্কের সদস্যপদ দেয়ার আহ্বান জানান হয়েছে। বাংলাদেশ এই প্রস্তাবটি স্থাপন করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সার্কের নাম পরিবর্তন করতে হবে। চীন বর্তমানে সার্কের পর্যবেক্ষক। সম্প্রতি মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ভুটান, ভারত, নেপাল ও চীনকে নিয়ে 'গঙ্গা নদী অববাহিকা সংস্থা' ও 'ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা সংস্থা' গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য এ ধরনের সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এখানেও মূল সমস্যা ভারতের আচরণ নিয়ে। কেননা এ অঞ্চলে বিপুল জ্বালানি সম্পদের (জলবিদ্যুৎ) সম্ভাবনা থাকলেও, ভারত দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় এর সমাধান করছে। আর বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে। ফলে বাংলাদেশ যে বহুপাক্ষিকতার প্রস্তাব করেছে, তা কাগজ-কলমে থেকে যেতে পারে। ২৬ বছরে পা দিয়েও সার্কের কর্মকা- তেমন আশাব্যঞ্জক নয়। এক সময় চীন এ অঞ্চলের দেশগুলোর সমন্বয়ে ২০০১ সালে 'কুনমিং উদ্যোগ' এর কথা বলেছিল। কিন্তু ভারত তাতে সায় দেয়নি। ভারত চাচ্ছে 'মেকং গঙ্গা সহযোগিতা', যা 'কুনমিং উদ্যাগ' এর বিকল্প।
এই যখন পরিস্থিতি, তখন অহরহ ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফ গুলি করে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করছে। এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছে সত্য; কিন্তু তাতে করে আস্থার জায়গাটা আর রাখা যায় না। এমনকি গত শুক্রবার কুমিল্লা সীমান্তে একজন চোরাকারবারির মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে একজন বিজিবির সদস্যকে ধরে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা (বিএসএফ) ২০ ঘণ্টা পরে তাকে ফেরত দেয়া কোনোমতেই কাম্য নয়। ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতায় যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে সম্পর্ক উন্নত হবে না। বাংলাদেশের মানুষ বারবার লাঞ্ছিত হবে, অপমানিত হবে, এই প্রবণতা যদি বন্ধ না হয়, তাহলে বাংলাদেশ-ভারতের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই। দেশ হিসেবে আমরা 'ছোট' হতে পারি। কিন্তু দেশ হিসেবে আমাদের অর্জন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও বেশি। এ কথা স্বয়ং স্বীকার করেছেন অমর্ত্য সেন। তাই ভারতীয় নেতৃবৃন্দের মানসিকতা পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি।

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে সার্চ কমিটি

শেষ পর্যন্ত যা আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা-ই হয়েছে। নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে রাষ্ট্রপতির সার্চ কমিটির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। রাষ্ট্রপতি ২৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময় করে এই সার্চ কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। এর আগে বিএনপি বলে আসছিল নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তন। বিএনপি তার এই দাবির সপক্ষে চারটি লংমার্চ পর্যন্ত করেছে। সর্বশেষ চট্টগ্রামে লংমার্চ শেষে অনুষ্ঠিত জনসভায় লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বিএনপি নেতারা যে উৎসাহী হবেন, তা তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু একটি সমঝোতা কিভাবে সম্ভব, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। সরকার একটি সার্চ কমিটি গঠন করবে। যদিও সংবিধানের চতুর্থ অধ্যায়ে রাষ্ট্রপতির অধিকার সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে, তাতে রাষ্ট্রপতির এ ধরনের 'বিশেষ অধিকারের' কোনো কথা বলা নেই। সংবিধানের ৪৮(৩)-এ বলা আছে, রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন, যেখানে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। এর বাইরে তিনি যে সিদ্ধান্তই নেবেন (এ ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত), তিনি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে বাধ্য। আইনি ব্যাখ্যায় রাষ্ট্রপতি এখন সার্চ কমিটি গঠনের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি রয়েছে। আমি এতে আপত্তির কিছু দেখি না। রাষ্ট্রপতি আমাদের, এ জাতির অভিভাবক। আইনি ব্যাখ্যায় যা-ই থাকুক, রাষ্ট্রপতি একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। বিএনপি ওই উদ্যোগের প্রতি সম্মান জানিয়ে সংলাপে অংশ নিয়েছে_এটাও একটা ভালো দিক। কিন্তু এখন বিএনপি সার্চ কমিটি গঠনের বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করায় এ কমিটি এখন তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলবে। সরকার হয়তো একটি সার্চ কমিটি গঠন করবে এবং এর একটি আইনি কাঠামোও দেবে, কিন্তু তাতে করে আস্থার যে সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তা মিটবে না। বিএনপি ইতিমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যাপারে একটি জনমত সৃষ্টি করে ফেলেছে। রাষ্ট্রপতির সংলাপে একাধিক দল, যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সরকারের মিত্র, তারাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তনের দাবি জানিয়েছে। ফলে এর পেছনে একটি মত সমাজে আছে। এখন সরকার যদি এই মতের প্রতি সম্মান না দেখায়, তাহলে রাজনীতিতে সংকট আরো বাড়বে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে একটি সম্ভাব্য বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সম্ভাব্য এই বিদ্রোহের সঙ্গে বিএনপির জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছেন। প্রতি-উত্তরে বিএনপি বলছে, সশস্ত্র বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার না করার কথা। বাংলাদেশে যখন গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে এবং এর ভিত্তি শক্তিশালী হয়েছে, তখন সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ প্ররোচিত করা একটি আত্মঘাতী কাজ। কেউ এটা সমর্থন করবে না। যে মুহূর্তে একটি তদন্ত কমিটি সেনা বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধান নিয়ে কাজ করছে, সেই মুহূর্তে পরস্পরকে দোষারোপ করে বক্তব্য না দেওয়াই শ্রেয়। দোষারোপের রাজনীতি, পরস্পরকে অভিযুক্ত করার প্রবণতা পরিত্যাগ করে দেশের সমস্যার দিকে নজর দেওয়া উচিত। এমনিতেই দেশের পরিস্থিতি যে ভালো, তা বলা যাবে না। অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব আশার কথা বলে না। ২০১১-১২ অর্থবছরের প্রথম মাসে (জুলাই) আয় হয়েছিল ২৩৩৯ দশমিক ৫২ মিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ১৭ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকার সমান। জুলাইয়ের তুলনায় সেপ্টেম্বরে আয় কমেছিল প্রায় ছয় হাজার ৬৯০ কোটি টাকা, অর্থাৎ ৩৮ দশমিক ১৩ শতাংশ কম। এমন এক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি একাধিক রোডমার্চ সম্পন্ন করেছিল। খালেদা জিয়া জানিয়ে দিয়েছেন যে সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা আর ঘরে ফিরে যাবেন না। এর অর্থ পরিষ্কার_বিএনপি এখন সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে যাচ্ছে। যদিও পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ২০১৩ সালের শেষের দিকে।
বিএনপি মূলত একটি এজেন্ডাকে সামনে রেখে রোডমার্চের আয়োজন করেছিল। আর তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তন করা। পাঁচ দফা সংবিধান সংশোধনী অনুযায়ী এখন আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার আওতায় নির্বাচন পরিচালনা করার কোনো সুযোগ নেই। উচ্চ আদালতের একটি রায় অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃ প্রবর্তন করতে হলে সরকারকে নতুন করে সংসদে একটি বিল আনতে হবে। এটা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে নামকরণ করতে হবে, তার কোনো মানে নেই। কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। হতে পারে এটি একটি নির্দলীয় সরকার। এই নির্দলীয় সরকারে কারা থাকবেন, তা সংসদ ঠিক করে দিতে পারে। উচ্চ আদালতের রায় অনুসরণ করেই ওই নির্দলীয় সরকার গঠন করা সম্ভব। বর্তমান প্রধান বিচারপতি তাঁর দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে এই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন। বিকল্প হিসেবে ব্যারিস্টার রফিকুল হকের মতো সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে এই দায়িত্বটি দেওয়া যেতে পারে। তিনজন গুণী ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি এলডার্স কাউন্সিল গঠন করা যেতে পারে, যাদের দায়িত্ব হবে শুধু একটি নির্বাচন পরিচালনা করা। তবে মূল কথা হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে বিরোধী দলের সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে। বিরোধী দলের সম্মতি না পেলে কোনো প্রস্তাবই জট খুলবে না। এ জন্য একটি সংলাপ অত্যন্ত জরুরি। সরকারের মন্ত্রীরা বারবার বিএনপিকে সংসদে আসার ও সেখানে গিয়ে প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে অতীতে বিরোধী দলকে সংসদে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। সংসদে গালাগাল ও অতীত বারবার টেনে আনা হয়েছে। বিচারাধীন মামলা নিয়ে মন্তব্য করা হয়েছে। সংসদ হয়ে পড়েছে একদলীয়। এ ক্ষেত্রে সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সরকার এখন যে কাজটি করতে পারে, তা হচ্ছে নিজেদের উদ্যোগে একটি নির্দলীয় সরকারের কাঠামো সংসদে উপস্থাপন করা ও তা সংসদে পাস করানো। মহাজোটের শরিকরাও পারে এ ধরনের একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করতে। বিএনপি ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানাতে পারে, অথবা তাতে সংশোধনী আনতে পারে। এর মাধ্যমে সরকার তার আন্তরিকতা প্রমাণ করতে পারে। সরকার যদি এ ধরনের কোনো প্রস্তাব না আনে, তাহলে রাজনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত হবে। ১৯৯৬ সালেও বিএনপি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করেছিল। কিন্তু ওই সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। ওই সংসদেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাস হয়েছিল। এখন দেয়ালের লিখন থেকে সরকার কি কিছু শিখবে? সরকার যদি নমনীয় হয়, তাহলে তা আমাদের জন্য মঙ্গল। পত্রপত্রিকায় যেসব জনমত প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় একটি নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত সবচেয়ে বেশি। সরকার যদি একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়, আমার বিশ্বাস তাতে সরকারের ভাবমূর্তি বাড়বে বৈ কমবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা দেয়ালের লিখন থেকে কেউ কিছু শিখি না।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে এখনো বেশ কিছুটা সময় বাকি আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও নির্বাচন আয়োজনের প্রশ্নে একটি সমঝোতা প্রয়োজন। এ জন্য বিএনপির সঙ্গে সংলাপ অত্যন্ত জরুরি। যদিও সংলাপের অভিজ্ঞতা আমাদের ভালো নয়। অতীতেও সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। তবুও সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে। নিদেনপক্ষে সংসদের স্পিকার একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। তিনি নিরপেক্ষ থেকে দুই প্রধান দলকে এক টেবিলে ডাকতে পারেন। কোনো ধরনের পূর্বশর্ত ছাড়াই আলোচনা হতে পারে। ওই আলোচনায় একটা সমাধানে পেঁৗছান সম্ভব বলেই আমি মনে করি। মনে রাখতে হবে ইতিমধ্যে আমাদের ভাবমূর্তি অনেক নষ্ট হয়েছে। পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের স্বপ্নের সেতু। ওই সেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি ১৬ জানুয়ারি ঢাকা সফররত ব্রিটিশ আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী অ্যান্ড্রো মিশেল ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে তাঁর দেশের দেওয়া সাহায্যের অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে যেকোনো ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভায় পরিবর্তন এনে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের ব্যাপারে উত্থাপিত দুর্নীতির অভিযোগের একটি জবাব দিতে চেয়েছেন। কিন্তু ব্রিটিশ মন্ত্রী মিশেল যে জবাবদিহিতার কথা বলেছেন, সেই জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো, যদি আমরা সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারতাম। বিরোধী দল এ ক্ষেত্রে 'ওয়াচ ডগ' হিসেবে কাজ করতে পারত। কিন্তু সেটি আমরা পারিনি। এদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম হানা জাতীয় প্রেসক্লাব আয়োজিত (১৬ জানুয়ারি) মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে যে বক্তব্য রেখেছেন, তাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। তিনি মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে সংলাপ অব্যাহত থাকা প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের মূল কথা। যেকোনো জাতীয় ইস্যুতে সংলাপ অব্যাহত রাখতে হবে। এই সংলাপ গণতন্ত্রের যাত্রাপথকে শক্তিশালী করবে মাত্র। রাজনীতিতে বিরোধিতা থাকবেই। কিন্তু তাতে যেন আস্থার সংকট সৃষ্টি না হয়। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস রাখাটা জরুরি। বিএনপি সংসদে এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃ প্রবর্তনের প্রস্তাব করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলকে অবশ্যই সহনশীল হতে হবে। সরকারি দল যদি সংসদে বিএনপিকে ওই প্রস্তাব উত্থাপনে বাধা দেয়, তাহলে তা এক বাজে নজির হয়ে থাকবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সরকারি দলের আচরণে যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে রাজনীতি আরো সংকটের মধ্যে পড়বে। আমরা বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতির চর্চা দেখতে চাই। বিরোধী দলের সঙ্গে আস্থার যে ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছে, সেই ঘাটতি কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। সার্চ কমিটি গঠিত হোক, ক্ষতি নেই। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠিত হোক। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃ প্রবর্তন নিয়ে যে দাবি শক্তিশালী হয়েছে, সে ব্যাপারেও সরকারের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন।
দৈনিক কালের কন্ঠ, ২৫ জানুয়ারি ২০১২।
লেখক : প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com