অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সদর্পে ঘোষণা করেছেন, আগামী তিন বছর বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকবে। তার এই ঘোষণা পত্রিকায় ছাপা হয়েছে গত ২ জানুয়ারি। গত ১ জানুয়ারি বিদ্যুৎ ভবনে বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে এর আওতাধীন কোম্পানি ও সংস্থাগুলোর চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ও সার্বিক বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়কালে মন্ত্রী এ ঘোষণা দেন। মন্ত্রীর এ ঘোষণায় অনেকে অবাক হলেও বাস্তবতা হচ্ছে বর্তমান সরকার একের পর এক বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েই চলছে। এতে করে সাধারণ মানুষ যে কত বড় ভোগান্তির মাঝে রয়েছে, তা নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই এতটুকুও। মহাজোট সরকারের তিনবছরে দেশের অর্থনীতি বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে রয়েছে। স্বাধীনতার পর মূল্যস্ফীতি কখনও ‘ডাবল ডিজিট’ (দশ শতাংশের বেশি) অতিক্রম করেনি। বর্তমানে এই মূল্যস্ফীতি ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বৈদেশিক রিজার্ভের পরিমাণও আশাব্যঞ্জক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী রিজার্ভের পরিমাণ মাত্র ৯৩৫ কোটি ডলার। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিল ‘মজুতদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ হবে’। কিন্তু এই কাজটি করতে পারেনি সরকার। অসাধু সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি থেকেছে বাজার। ফলে দিনের পর দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। আর সাধারণ মানুষকে বইতে হয়েছে বোঝা। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী বেঁচে থাকার জন্য সাধারণ মানুষ সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়েছে। গত নভেম্বরে (২০১১) মানুষ সঞ্চয়পত্র ভেঙেছে ১ হাজার ১৩৪ কোটি ১৪ লাখ টাকার। বছরের শেষ দিনে জ্বালানি তেলের দাম আরো এক দফা বৃদ্ধি করায় বেড়ে যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। একটি ভালো সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের মঙ্গলে কাজ করা ও জনমুখী সিদ্ধান্ত নেয়া। কিন্তু মহাজোট সরকার তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় একের পর এক ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটলো বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ঘোষণাটি দিয়ে।
বিদ্যুৎ নিয়ে সংকট আছে। চাহিদা বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। কিন্তু সেভাবে উৎপাদন হচ্ছে না। হাজার হাজার ফ্যাট এই ঢাকা শহরেই তৈরি হচ্ছে। এসব ফ্যাটে কী আদৌ পূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে? যদি না হয়, তাহলে লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্মিতব্য এই ফ্যাটগুলো যারা ক্রয় করেছেন তারা এখন কী করবেন? আবাসন শিল্পের সাথে জড়িত কয়েক লাখ মানুষ। তাদের আয়-রোজগারের কী হবে? ডেভেলপাররা যদি ক্রেতাদের ফ্যাট বুঝিয়ে দিতে না পারেন, তাহলে এই শিল্পের সাথে জড়িত হাজার হাজার কর্মী বেকার হয়ে যাবেন। সরকারের জন্য আদৌ তা কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় প্রাকৃতিক গ্যাস দিয়ে। এই গ্যাস এখন ফুরিয়ে আসছে। চলমান গ্যাস সংকট মোকাবিলায় সরকার ২০০৯ সালে ‘ফাস্ট ট্র্যাক প্রোগ্রাম’ নামের একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এর অধীনে অতি দ্রুত নতুন গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য বাপেক্সের হাতে থাকা ৩, ৬, ৮ ও ১১ নম্বর ব্লকের মোট ৩১০০ লাইন কিলোমিটার দ্বি-মাত্রিক (টু-ডি) সিসমিক জরিপের কাজ ৩ বছরের মধ্যে সম্পন্ন করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে যে, স্থলভাগের ২৩টি ও অগভীর সমুদ্রের ৮টি ব্লককে পিএসসির আওতায় বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে কনোকো ফিলিপস একটির দায়িত্ব পেয়েছে। একই সাথে রাশিয়ার তেল-গ্যাস উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাসপ্রম এবং অস্ট্রেলিয়ার কোম্পানি সান্তোষও শিগগিরই কাজ পাচ্ছে। এমন অভিযোগও উঠেছে যে, স্থলভাগে সুনেত্রার মতো বিশাল মজুদ বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। কনোকো ফিলিপস যে দায়িত্বটি পেয়েছে, সেটা নিয়ে বাংলাদেশে বড় ধরনের বিতর্ক হচ্ছে। তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতারা এই চুক্তির বিরোধিতা করে সারা দেশব্যাপী প্রচুর গণসংযোগ করেছেন। তাদের যুক্তি একটাইÑ কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশের গ্যাস রফতানি করা যাবে না। গভীর সমুদ্রে গ্যাস পাচারের একটা সম্ভাবনা আছে। কেননা মায়ানমার এবং ভারত গভীর সমুদ্রে গ্যাস পেয়েছে। মায়ানমারের গভীর সমুদ্রে প্রাপ্ত গ্যাস আগামী বছর যাবে থাইল্যান্ডে। চীনও এই গ্যাস কিনছে। এ ক্ষেত্রে যদি গ্যাস পাওয়াও যায়, তা উত্তোলন ও জাতীয় গ্রিডে তা দিতে ন্যূনতম আরো ৫ থেকে ৬ বছর সময় প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের কাছে বিকল্প কী, এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। যদিও একটা কথা ইদানীং শোনা যাচ্ছে যে, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোনায় বাপেক্স যে ৪.৫ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (সম্ভাব্য মজুদ) গ্যাস আবিষ্কার করেছে, তা যদি উত্তোলনের ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সংকটের একটা সমাধান সম্ভব। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে এই মজুদও বিদেশিদের হাতে তুলে দেয়া হতে পারে। যদিও এখন পর্যন্ত সরকার বিষয়টি খোলাসা করেনি।
যেহেতু গ্যাসের একটি সংকট আছে, তাহলে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান আমরা কীভাবে করবো?
গ্যাসের বিকল্প হতে পারে কয়লা। এ পর্যন্ত দেশে পাঁচটি কয়লাখনি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত মজুদের পরিমাণ ২ হাজার ৫০০ মিলিয়ন টন। এ কয়লা সম্পদ ৭৩টি টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য। তবে উত্তোলনযোগ্য কয়লার পরিমাণ ২০ টিসিএফ গ্যাসের সমতুল্য ধরা যেতে পারে, যা ৩০ থেকে ৪০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু কয়লা উত্তোলন নিয়েও বাংলাদেশে একটি বড় বিতর্ক রয়েছে। কয়লা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে তোলা হবে, নাকি আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তোলা হবেÑ এটা নিয়ে বিতর্ক বাড়ছে। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করলে ৬ হাজার হেক্টর কৃষি জমি নষ্ট হবে এবং অনেককে তাদের ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করতে হবে। তেল-গ্যাস, খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ, বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা তোলার বিপক্ষে। অথচ উন্মুক্ত পদ্ধতির একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে এই পদ্ধতিতে ৯০ শতাংশ কয়লা তোলা যাবে। অন্যদিকে আন্ডারগ্রাউন্ড পদ্ধতিতে তুললে, তোলা যাবে মাত্র ১০ শতাংশ কয়লা। বড় পুকুরিয়া কয়লা ক্ষেত্রের বেলায় দেখা যাচ্ছে শতকরা ১০ ভাগ কয়লাও তোলা সম্ভব হচ্ছে না। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ অভিমত দিয়েছেন যে, বড় পুকুরিয়া থেকে ১০০ মিলিয়ন টনের বেশি কয়লা তোলা সম্ভব হবে না। পক্ষান্তরে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে ৬০০ থেকে ৭০০ মিলিয়ন টন কয়লা তোলা সম্ভব, যা বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তা দেবে।
জ্বালানি খাতে কয়লা একটা সম্ভাবনার সৃষ্টি করলেও, তাতে এখন রাজনীতি ঢুকে গেছে। ২০০৬ সালের ২৬ আগস্ট ফুলবাড়ীর কয়লাখনি উত্তোলনের বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগণের সাথে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সংঘর্ষ হয়। তাতে মারা যান ৬ জন মানুষ। এরা উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলনের বিরোধিতা করেছিল। সেই থেকে ফুলবাড়ী কয়লা উত্তোলনের বিষয়টি ঝুলে আছে। এ ব্যাপারে সরকার এখন পর্যন্ত কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করতে পারেনি। যদিও ২০০৭ সালের ১১ জুন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার বুয়েটের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোমিন পাটোয়ারীকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। ওই কমিটি ২০০৮ সালের ৮ জানুয়ারি সরকারের কাছে তাদের রিপোর্ট জমা দিয়েছিলেন। তাতে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন, রফতানির সুযোগ না রাখা, দেশের চাহিদা পূরণের জন্য ৫০ বছরের জ্বালানি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা, খনির মুখে একটি বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার বিধান রাখা হয়েছিল। কিন্তু ওই রিপোর্ট গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি বর্তমান সরকার কোনো কয়লানীতিও গ্রহণ করেনি। ফলে একটি সম্ভাবনাময় সেক্টর আমাদের কোনো কাজে আসছে না। এখানে বলা ভালো, বিশ্বের ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় কয়লা থেকে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া ৭৯ শতাংশ, চীন ৭৮, জার্মানি ৪৯, ভারত ৬৯, দক্ষিণ আফ্রিকা ৯২, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৫০ শতাংশ। এখানে আরো একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ কয়লা মজুদ থাকা সত্ত্বেও সরকার খুলনা ও চট্টগ্রামে দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে আমদানিকৃত (ভারত) কয়লার ওপর নির্ভর করে। এই সেক্টরটিও আমরা ভারতের হাতে তুলে দিয়েছি।
অতীতে বিদ্যুৎ ঘাটতিতে সরকারি দলের সংসদরাই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। গত ৩ আগস্ট (২০১১) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভায় বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করা হয়েছিল। কমিটির সভায় সরকারের দেয়া বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিসংখ্যানও প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল। সরকারি দলের এমপিরা যখন খোদ প্রতিমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেন, তখন বুঝতে কারো বাকি থাকে না পরিস্থিতি আদৌ ভালো নয়। এই যখন পরিস্থিতি তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী অবিবেচকের মতো ঘোষণা করলেন, তিন বছর ধরেই বিদ্যুতের দাম বাড়তে থাকবে। এর অর্থ কী? জনগণকে আরো কষ্টের মধ্যে ঠেলে দেয়ার অর্থ আর যাই হোক সুশাসন হতে পারে না। আসলে প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই সরকারের ব্যর্থতা চোখে লাগার মতো। বিদ্যুৎ তো একটি সেক্টর মাত্র। জনগণের সাথে একরকম ‘বিচ্ছিন্ন’ অর্থমন্ত্রী যখন এ ধরনের কথাবার্তা বলেন, তখন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বর্তমানে সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই জনগণের প্রতি। বর্তমান সরকার যতদিন ক্ষমতা ধরে রাখবে, জনদুর্ভোগ তত বাড়বে। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে আগামী দিনের জনদুর্ভোগের বিষয়টি নিশ্চিত হলো মাত্র।