রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন

গেল বছর বিশ্বব্যাপী যেসব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, সেই সব পরিবর্তনের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে তরুণ সমাজ। বিশেষ করে 'আরব বসন্ত' থেকে শুরু করে নিউইয়র্কের 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' প্রতিটি ক্ষেত্রেই আন্দোলন পরিচালনা করা ও সংগঠিত করার পেছনে অবদান সবচেয়ে বেশি এই তরুণ সমাজের। একুশ শতকে এই তরুণ সমাজ পাল্টে দিচ্ছে সমাজকে, সভ্যতাকে। গত ২ জানুয়ারি পর্যন্ত (২০১২) নিউইয়র্কের 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' তাদের আন্দোলনের ১০৬ দিন পার করেছে। যে কোনো বিবেচনায় এটা একটি বড় ঘটনা। আরব বিশ্বে ২০১০ সালের শেষের দিকে যে আন্দোলনের জন্ম, তা সংগঠিত করছে তরুণ সমাজ, যারা ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে একের পর এক পরিবর্তন ডেকে আনছে আরব বিশ্বে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা 'প্রাগ বসন্তের' কথা জানেন। জানেন 'ভেলভেট বিপ্লব' এর কথাও। ১৯৬৮ সালের 'প্রাগ বসন্ত' সাবেক চেকোসস্নাভিয়ার সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংস্কারের উদ্যোগ (ডুবচেকের নেতৃত্বে) ব্যর্থ করে দিয়েছিল। সেদিন সোভিয়েত ট্যাংক চেকোসস্নাভিয়ার রাজধানী প্রাগে নেমেছিল। এরপর ১৯৮৯ সেই চেকোসস্নাভিয়াতেই নাট্যকার ভাসলাভ হাভেলের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণভাবে সমাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল। সেই আন্দোলন ছড়িয়ে গিয়েছিল পূর্ব ইউরোপের প্রতিটি রাষ্ট্রে। একে একে পতন ঘটেছিল পূর্ব ইউরোপের প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক সরকারের, ইতিহাসে যা চিহ্নিত হয়ে আছে 'ভেলভেট রেভুলেশন' হিসেবে। এই 'ভেলভেট রেভ্যুলেশন' একটি বড় পরিবর্তন এনেছিল পূর্ব ইউরোপে। সেখানে সমাজতন্ত্রের বদলে প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র চালু হয়েছে। এর ঠিক ২২ বছর পর সারা আরব বিশ্বে শুরু হয়েছে পালাবদল। আরব লিগভুক্ত ২২টি দেশে কোথাও প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্র নেই। সেখানে ছিল বা এখনো রয়েছে একনায়কতান্ত্রিক শাসন। গণতন্ত্র সূচকে এ দেশগুলোর অবস্থান অনেক নিচে (যেমন ১৬৭টি দেশের মাঝে লিবিয়ার অবস্থান ১৫৮, সুদানের ১৫১, সিরিয়ার ১৫৩, ইয়েমেনের ১৪৬)। দুর্নীতিতেও এরা সেরা (১৭৮টি দেশের মাঝে মিসরের অবস্থান ১৩৮, লিবিয়ার ১৪৬, আলজেরিয়ার ১০৫, ইরাক ১৭৫, মৌরিতানিয়া ১৪৩)। আর সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই এসব দেশে। ১৯৬টি দেশের মাঝে ইয়েমেনের অবস্থান ১৭৩, তিউনেসিয়ার ১৮৬, সিরিয়ার ১৭৮, সুদানের ১৬৫, লিবিয়ার ১৯৩। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে পরিবর্তনটা কেন প্রয়োজন ছিল আরব বিশ্বে? 'প্রাগ বসন্ত' চেকোসস্নাভিয়ার সমাজ ব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি বটে; কিন্তু পরিবর্তন এসেছিল 'ভেলভেট রেভ্যুলেশন' এর মধ্যে দিয়ে। আজ আরব বিশ্বও সেই পরিবর্তনের দারপ্রান্তে। ইতিমধ্যে 'জেসমিন বিপ্লব' ও 'রেভুলেশন ২.০' তিউনেসিয়া ও মিসরে পরিবর্তন ডেকে এনেছে। ইতিহাসের এটাই অনিবার্যতা। সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত ঐতিহাসিক জ্যাকব বুরচার্ডের মতে (ঔধপশড়ন ইঁৎপযধৎফঃ), ইতিহাসের শিক্ষা হচ্ছে কোনো শক্তি যখন উন্নয়ন বা নতুন সৃষ্টির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তখন সে শক্তির পতন অনিবার্য। 
আরব বিশ্বে এমনটিই হয়েছে। শাসক চক্র সেখানে যুগের সঙ্গে তাল রেখে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছিল। তরুণ সমাজ ছিল বেকার। এদের জন্য কর্মসংস্থান করা যায়নি। সারা আরব বিশ্বে ২৫ বছরের নিচে যে জনগোষ্ঠী, তা মোট জনগোষ্ঠীর অর্ধেক (মিসরে ৫২.৩ ভাগ, সিরিয়া ৫৫.৩ ভাগ, ইয়েমেন ৬৫.৪ ভাগ, তিউনেসিয়া ৪২.১ ভাগ, লিবিয়া ৪৭.৪ ভাগ)। এই জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সংস্থান করা যায়নি। এরাই আজ 'আরব বসন্ত' এর নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই আরব বিপ্লব আমাদের জন্য অনেক চিন্তার কারণ। এক. আরব বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও জনগোষ্ঠীর একটা বড় অংশ তরুণ সমাজ, যাদের বয়স ২৫ বছরের নিচে। এদের একটা বড় অংশ বেকার। পরিকল্পনাহীনভাবে আমরা গ্রাজুয়েট তৈরি করছি। কিন্তু চাকরির সংস্থান করতে পারছি না। ৩৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, সেই সঙ্গে আরো দুটো মেরিটাইম ও টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। হাজার হাজার মাস্টার্স ডিগ্রিধারী বেরুচ্ছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরুচ্ছে লাখ লাখ। এ সমাজে আমাদের এত মাস্টার্স ডিগ্রিধারীর প্রয়োজন নেই। শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে যারা জড়িত, তারা বিষয়টি চিন্তা করেন না। উচ্চশিক্ষা সীমিত হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে প্রয়োজন বাজার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা। সেদিকে না গিয়ে অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার জন্য আমাদের সন্তানদের আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছি। এরা পাস করে সমাজের বোঝা হয়ে যাচ্ছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বেকার থাকছে। এরা যে কোনো সরকারের জন্যই একটি 'থ্রেট', যেমনটি আমরা আরব বিশ্বে লক্ষ্য করি। দুই. এই তরুণ সমাজকে প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে কর্মসংস্থান করা যায়। এ জন্য দরকার সদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। আমলানির্ভর আমাদের যে সমাজব্যবস্থা, তাতে আমলারা 'বাজার অনুসন্ধান'-এ বিদেশ সফরে ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু সেই 'বাজার' আজো সৃষ্টি হয়নি। লিবিয়া থেকে হাজার হাজার কর্মী দেশে ফেরত এসেছেন। সরকার প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে দিয়েছে। এটা নিয়েও কথা আছে। সবচেয়ে বড় কথা ৫০ হাজার টাকা কোনো সমাধান নয়। এদের জন্য স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা জরুরি। এ জন্য দরকার বড় বিনিয়োগ। তিন. অর্থনীতি কোনো আশার কথা বলে না। মুখথুবড়ে পড়ছে অর্থনীতি। সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। সরকার যে হারে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিচ্ছে, তা অর্থনীতির জন্য কোনো মঙ্গল নয়। ইতিমধ্যে এই ঋণের পরিমাণ ২৫ হাজার কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে ১৪২ কোটি টাকা হিসেবে, প্রতি সেকেন্ডে এই ঋণের পরিমাণ ১০ লাখ টাকা। বছর শেষে এই ঋণ ৩০ হাজার কোটি টাকার অংককে ছাড়িয়ে গেছে। এতে করে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। চার. অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশ একটি বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী রফতানি আয় কমেছে শতকরা ৩৯ ভাগ। বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে শতকরা ২৩ ভাগ। খাদ্যে মুদ্রাস্ফীতির পরিমাণ এখন ১১ দশমিক ৭৩ ভাগ। তৈরি পোশাকে আমাদের বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। ইতিমধ্যে ৩ হাজার তৈরি পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতি কোনো আশার কথা বলে না। পাঁচ. অসমতা আর বৈষম্য যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি সমাজকেও বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট ম্যুভমেন্ট' এর বড় প্রমাণ। সেখানে সম্পদশালীদের নিয়ন্ত্রিত একটি অর্থনীতির জন্ম হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে চষঁঃড়হড়সু। এই অর্থনীতি রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের ধনী ১ ভাগের হাতে ১৯৭০ সালে যেখানে মোট আয়ের ৮ থেকে ৯ ভাগ কেন্দ্রীভূত ছিল, আজ তা বেড়েছে ২৩ দশমিক ৫ ভাগে। আর সম্পদের কথা যদি বলি, তাহলে ওই ১ ভাগের হাতে ২৫ বছর আগে সম্পদ যেখানে ছিল মাত্র ১২ ভাগ, আজ তা বেড়েছে ৪০ ভাগে। 'অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট' এর মূল স্পিরিটের সঙ্গে 'আরব বসন্ত' এর মিল আছে এক জায়গাতেই_ আরব বিশ্বে সম্পদশালী একটি ধনী শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যারা বছরের পর বছর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। আরব বিশ্বের গত ৬০ বছরের যে রাজনীতি, সেখানে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক ছিল না। সেখানে ধনী শ্রেণীর হাতে সম্পদ যেভাবে বেড়েছে সেভাবে গরিব শ্রেণীর সংখ্যাও বেড়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কিংবা আরব বিশ্বের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। কিন্তু বাংলাদেশে অসমতা ও বৈষম্য রয়েছে। ধনী ও গরিব শ্রেণীর মাঝে ব্যবধান গত ৪০ বছরে কমেনি। ৫৬ ভাগের মতো মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। তরুণ সমাজের একটা বড় অংশ বেকার। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় তাদের চাকরিও হচ্ছে না। আমেরিকার কংগ্রেসকে বলা হয় 'বিলিওনিয়ারস ক্লাব'। ধনী লোক ছাড়া সিনেট কিংবা 'হাউস অফ রিপ্রেজেনটেটিভ' এর সদস্য হওয়া যায় না। সাধারণ একজন মানুষের কংগ্রেসের সদস্য হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আজ বাংলাদেশের জাতীয় সংসদও কোটিপতিদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে। সংসদে সনাতন রাজনীতিবিদদের চেয়ে 'ব্যবসায়ী রাজনীতিবিদ' এর সংখ্যা বাড়ছে। পরিসংখ্যানই বলে দেয় ব্যবসায়ী তথা ধনী শ্রেণীর সংখ্যা সংসদে বাড়ছে। বাংলাদেশে কোটিপতিদের সংখ্যা এখন কয়েক হাজার। এই পরিসংখ্যান আমাদের মধ্যে একটা আশঙ্কা তৈরি করে যে, বাংলাদেশেও 'আরব বসন্ত' এর ঢেউ এসে লাগতে পারে।
'আরব বসন্ত' প্রমাণ করেছে ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি যদি নজর দেয়া না হয়, তাহলে জনতা রাস্তায় নেমে আসবেই। দীর্ঘ ১৮ দিন তাহরির স্কোয়ারের (কায়রো) অবস্থান করে মিসরবাসী হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করেছিল। জনতার শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তিউনেসিয়ার জয়নুল আবেদিন বেন আলি, আর ইয়েমেনের আলি আবদুল্লাহ সালেহ। একুশ শতকে 'আরব বসন্ত' এক ধরনের 'বিপ্লব' এর সূত্রপাত করেছে। এ থেকে আমরা যদি শিক্ষা নেই, আমাদের মঙ্গল সেখানেই নিহিত। তাই যে বিষয়টি জরুরি, তা হচ্ছে তরুণ সমাজের দিকে নজর দেয়া, তাদের আশা-আশঙ্ক্ষাকে সম্মান জানাব।

0 comments:

Post a Comment