রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পররাষ্ট্রনীতি : তুলনামূলক বিচারে সফলতা কম

মহাজোট সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে গত তিন বছরে যে অভিযোগটি পুষ্ট, তা হচ্ছে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা ও ভারতীয় স্বার্থের ব্যাপারে বাংলাদেশের অঙ্গীকার। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর (২০১০) ও ফিরতি সফরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ঢাকায় আসা (২০১১) ছিল দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। শুধু তা-ই নয়, সোনিয়া গান্ধী এবং একাধিক ভারতীয় মন্ত্রীর ঢাকা সফর গেল বছর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে একটি উচ্চমাত্রায় পেঁৗছে দিয়েছে। অন্যদিকে চীন, যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে এই তিনটি দেশের অবস্থান বেশ গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে এই জাতীয় স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হয়নি, এমন অভিযোগ উঠেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর দুজন উপদেষ্টা যখন মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, তখন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। বিগত বছরে এ প্রশ্নটি বারবার উঠেছে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এর ব্যাখ্যাও দিতে হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি, যিনি গত তিন বছরে সবচেয়ে বেশি দিন বিদেশে কাটিয়েছেন। বছরের প্রায় শেষের দিকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক গত সেপ্টেম্বরে প্রস্তাবিত জনগণের ক্ষমতায়ন মডেলসংক্রান্ত 'জনগণের ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন' শীর্ষক রেজুল্যুশনটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ায় বাংলাদেশের জন্য এটা একটা বড় পাওয়া। প্রধানমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করে পূর্বমুখী পররাষ্ট্রনীতির গুরুত্বকে আরো স্পষ্ট করেছিলেন। কিন্তু 'ভারতমুখী' পররাষ্ট্রনীতি বাংলাদেশের সব অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময় যে উন্নয়ন ও সহযোগিতাসংক্রান্ত চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, এর গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। ওই চুক্তিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তাতে ভারতীয় স্বার্থই রক্ষিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। গত তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে পাল্লাটা ভারতের দিকে বেশি ঝুঁকে গেছে, বাংলাদেশের প্রাপ্তিটা তুলনামূলকভাবে অনেক কম। বাংলাদেশ তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারেনি। এ ব্যাপারে একটি সমঝোতা হলেও (৪৮:৫২ ভাগ) চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হবে না এবং সেখান থেকে অবকাঠামো নির্মাণ করা হলে বাংলাদেশকে তা জানানো হবে_এ ধরনের প্রতিশ্রুতি ভারত দিলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল ভারতে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণসংক্রান্ত একটি চুক্তি গত ২২ অক্টোবর স্বাক্ষরিত হয়েছিল। তখন বাংলাদেশ এ ব্যাপারে তার কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। টিপাইমুখ বাঁধ ও ফুলেরতল ব্যারাক কার্যকর হলে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হয়ে পড়বে এবং এ অঞ্চলে মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হবে। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য ভারতের অনুকূলে। ঘাটতি বাড়ছে। ভারত অতিসম্প্রতি ৪৬টি পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বললেও তা দিয়ে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানো যাবে না। স্পর্শকাতর তালিকা বাদ কিংবা সাফটা চুক্তি অনুযায়ী স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমাদের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি।
ছিটমহল বিনিময় নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, তাতেও অস্পষ্টতা রয়ে গেছে। স্বাধীনতার পরপরই বেরুবাড়ী আমরা দিয়েছিলাম। কিন্তু তিনবিঘা আমরা পাইনি। সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিবাদ (ভারত বাংলাদেশের সীমানার ৮ নম্বর ব্লকে ৩১ হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা দাবি করেছে। ৪ নম্বর ব্লকেরও দাবি ভারতের) দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান হয়নি। এখন আমরা গেছি আরবিট্রেশনে। ফলে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ হলেও দেখা গেছে, বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের অর্জন কম, কিন্তু ভারতের প্রাপ্তি অনেক বেশি। পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনার ক্ষেত্রে ভারতের প্রতি একধরনের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতাও আমরা লক্ষ করছি। তবে প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের আগে চীন সফর করে ওই দুই নিকট-প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করে পররাষ্ট্রনীতিতে একধরনের ব্যালেন্স বা ভারসাম্য রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। চীন সফরের সময় তিনি কুনমিং-কঙ্বাজার সড়ক ও বাংলাদেশে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। চীন এ ব্যাপারে আগ্রহও দেখিয়েছে। কুনমিং-কঙ্বাজার মহাসড়ক নির্মিত হলে তা এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। ফলে ভবিষ্যতে আমরা সড়কপথেই যে শুধু চীনে যেতে পারব তা নয়, বরং চীন তার ইউনান প্রদেশের পণ্য রপ্তানিতে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরও ব্যবহার করতে পারবে। চীন বড় অর্থনীতির দেশ। আমাদের প্রয়োজনেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটা জরুরি। এখন দেখতে হবে ভারত-বাংলাদেশ পরিবর্তিত সম্পর্কের প্ররিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়। ইতিমধ্যে চীনকে সার্কের সদস্যপদ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ এ প্রস্তাবটি কার্যকর করত পারে। সে ক্ষেত্রে সার্কের নাম পরিবর্তন করতে হবে। চীন বর্তমানে সার্কের পর্যবেক্ষক। নিকট-অতীতে মালদ্বীপের আদ্দু সিটিতে ১৭তম সার্ক শীর্ষ সম্মেলন শেষ হয়েছে। ওই সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী ভুটান, ভারত, নেপাল ও চীনকে নিয়ে 'গঙ্গা নদী আববাহিকা সংস্থা' ও 'ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা সংস্থা' গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবস্থাপনার জন্য এ ধরনের সংস্থার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এখানেও মূল সমস্যা ভারতের আচরণ নিয়ে। কেননা এ অঞ্চলে বিপুল জ্বালানি সম্পদের (জলবিদ্যুৎ) সম্ভাবনা থাকলেও ভারত দ্বিপক্ষীয় আলোকে এর সমাধান করছে। আর বাংলাদেশ বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাস করে। ফলে বাংলাদেশ যে বহুপাক্ষিকতার প্রস্তাব করেছে, তা কাগজে-কলমে থেকে যেতে পারে। ২৬ বছরে পা দিয়েও সার্কের কর্মকাণ্ড এখন পর্যন্ত তেমন আশাব্যঞ্জক নয়।
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে বড় ধরনের উত্থান-পতন হচ্ছে। এর ঢেউ এসে বাংলাদেশেও লাগবে। ইউরোপ আমাদের তৈরি পোশাকের একটি বড় বাজার। কিন্তু ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা আমাদের পোশাক শিল্পে আঘাত হেনেছে। রপ্তানিতে ধস নেমেছে। এ বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের নতুন নতুন বাজার সন্ধান করতে হবে এবং সেই আলোকে পররাষ্ট্রনীতি নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে। আসিয়ান একটি বড় বাজার। ভারত চেষ্টা করছে আসিয়ানের পূর্ণ সদস্যপদ পেতে। বাংলাদেশের চেয়ে একধাপ এগিয়ে তারা এখন আসিয়ানের 'ডায়লগ পার্টনার' (বাংলাদেশ আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামের সদস্য)। বাংলাদেশকে এখন আসিয়ানের সদস্যপদ পেতে উদ্যোগী হতে হবে। সেই সঙ্গে সার্ক ও আসিয়ানের মধ্যে সম্পর্ক কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়, সে প্রচেষ্টাও চালাতে হবে। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি নেই। সনাতন দেশগুলোতেই রপ্তানির বাজার আমরা খুঁজছি। গত তিন বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো নতুন বাজার আমরা খুঁজে পাইনি। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই বিষয়টির ওপর এখন গুরুত্ব দিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঝুঁকির মুখে যে কয়টি দেশ রয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। নভেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের (সিভিএফ) তৃতীয় সম্মেলন। সম্মেলন শেষে ১৪ নভেম্ব্বর ১৪ দফা ঢাকা ঘোষণা গৃহীত হয়। ওই ১৪ দফায় বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে অর্থপ্রাপ্তির পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা, বিশেষ করে 'আইলা' ও 'সিডর' পরবর্তী মানুষগুলোর দুরবস্থা বিশ্ব আসরে তুলে ধরা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কতটুকু সফল, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। নিকট-অতীতে সমাপ্ত ডারবান সম্মেলনও বাংলাদেশের জন্য কোনো আশার সংবাদ বয়ে আনেনি।
পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থটাই হলো প্রধান। এই জাতীয় স্বার্থ সব সময় রক্ষিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। মহাজোট সরকারের সময় গত তিন বছরে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, তা নিয়ে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, সন্ত্রাসবাদ, জ্বালানি, বিদেশে কর্মসংস্থান ইত্যাদি 'অপ্রচলিত ধারণা' এমন বৈদেশিক নীতিতে প্রভাব ফেলছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা। তাই ২০২১ সাল সামনে রেখে (যখন বাংলাদেশের বয়স গিয়ে দাঁড়াবে ৫০ বছর) বাংলাদেশকে তার সনাতন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আর শুরুটা করতে হবে এখন থেকেই। কিন্তু গত তিন বছর পররাষ্ট্রনীতি যেভাবে পরিচালিত হয়েছে, তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক সন্দেহ-অবিশ্বাসে ঢাকা ছিল। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়েও ওয়াশিংটন যে খুশি, তা বলা যাবে না। দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা। দুর্নীতির অভিযোগে পদ্মা সেতু থেকে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন স্থগিত করার ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য একটি ইমেজ সংকট সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশে একটি পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করেছে। এই পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে বাংলাদেশে একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। গত তিন বছরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতার হার তুলনামূলক বিচারে অনেক কম। জাতীয় স্বার্থকে চিহ্নিত করার ব্যর্থতা বহির্বিশ্বে আমাদের অবস্থানকে দুর্বল করছে। পররাষ্ট্রনীতিতে সফলতা পেতে হলে একদিকে যেমনি প্রয়োজন দক্ষতা ও দূরদর্শিতা, অন্যদিকে তেমনি প্রয়োজন সঠিক নীতিটি প্রণয়ন।
 অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, 
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
tsrahmanbd@yahoo.com

0 comments:

Post a Comment