রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সাক্কুর বিজয় যে প্রশ্নের জবাব দেয় না

সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন। সম্প্রতি সমকালসহ তিনটি পত্রিকায় জনমত সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনটি পত্রিকার জনমত সমীক্ষায় দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত অত্যন্ত শক্তিশালী।
কুমিল্লার প্রথম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে বিএনপি থেকে অব্যাহতি পাওয়া মনিরুল হক সাক্কুর বিজয় এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। সাক্কুর বিজয় দুটো বিষয়কে সামনে নিয়ে এসেছে। এক. ইভিএম মেশিন ব্যবহার করে নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব, দুই. দলীয় সরকারের অধীনে যে কোনো নির্বাচন হতে পারে_ যদি এ ক্ষেত্রে সরকার নিরপেক্ষ থাকে এবং কোনো হস্তক্ষেপ না করে। কুমিল্লার ক্ষেত্রে এ দুটো বিষয়ই সফল হয়েছে। অর্থাৎ ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হয়েছে এবং মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যে ফল দেওয়াও সম্ভব হয়েছে। দু'একটি ক্ষেত্রে ইভিএম মেশিন নিয়ে কিছুটা জটিলতা হয়েছে। কিন্তু তাতে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি। কুমিল্লায় নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী হেরে গেছেন এবং তা বিপুল ব্যবধানে। এ ক্ষেত্রে সরকার বা সরকারি প্রার্থী কোনো হস্তক্ষেপ করেননি। এর আগে আমরা নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও এমনটি প্রত্যক্ষ করেছিলাম। সেখানেও সরকারি দলের প্রার্থী হেরে গিয়েছিলেন। যদিও ব্যাপকভাবে ইভিএম মেশিন ব্যবহার করা হয়নি। এখন যে কেউ, বিশেষ করে সরকারি দলের নেতারা বলতে পারেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম মেশিন ব্যবহার হবে এবং বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন সম্পন্ন করা সম্ভব, তাতে ক্ষতি কী? এ ধরনের যুক্তি অস্বীকার করা যাবে না। তবে এটাও সত্য, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন আর জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন এক নয়।
বর্তমান রাজনীতিতে যে ক'টি বিষয় বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, তার মধ্যে ইভিএম মেশিন ব্যবহার আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, এ বিষয় দুটি রয়েছে। এর বাইরে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে একটি বিতর্ক রয়েছে। রাষ্ট্রপতি এ ব্যাপারে একটি সংলাপ করছেন। সেই সংলাপে বিএনপিও অংশ নিয়েছে। এটা একটা ভালো দিক। এ ব্যাপারে এটা সমাধান পাওয়া যাবে বলেও আশা করছি। বিভিন্ন দলের সঙ্গে মতবিনিময়কালে একটি সার্চ কমিটি গঠনের কথা বারবার আসছে। গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে সার্চ কমিটি গঠিত হলে বিএনপি তথা বিরোধী জোটের কোনো আপত্তি থাকবে না বলেই আমার বিশ্বাস। এখন দেখতে হবে সেই সার্চ কমিটি কাদের নিয়ে গঠিত হয়। এ ক্ষেত্রে একটি আইনি কাঠামো থাকা বাঞ্ছনীয়, যাতে করে ভবিষ্যতে এ বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন না ওঠে। প্রয়োজনে সার্চ কমিটির বিষয়টিকে সংবিধানের অংশ করা যেতে পারে। কুসিক নির্বাচনে ইভিএম মেশিনের সফল ব্যবহার হতে আমরা দেখেছি। তবে ইভিএম মেশিন নিয়ে বিতর্ক যে নেই তা আমি বলব না। আমি নিজে যুক্তরাষ্ট্রে দেখেছি, সেখানে ব্যাপকভাবে ইভিএম মেশিন ব্যবহৃত হয় না। খোদ স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচন কমিশনের আপত্তিও আমি দেখেছি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো একটি দেশে এর ব্যাপক ব্যবহার যে কোনো বিতর্কের জন্ম দেবে না, এটা আমি বিশ্বাস করি না। এখানে যে বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে ইভিএম মেশিন ব্যবহারের প্রশ্নে একটি ঐকমত্য প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান বেশ শক্তিশালী, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু এটাই চূড়ান্ত নয়। সমঝোতা না হলে এককভাবে ইভিএম মেশিন ব্যবহার বিতর্কের মাত্রা বাড়াবে। কুসিক নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে যখন একটি দলীয় সরকার ক্ষমতায়। সরকারি দল কুসিক নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন একটি ভিন্ন বিষয়। এখানে নানা স্বার্থ কাজ করে। স্থানীয় সুবিধাভোগীরা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাজ করে। ক্ষমতায় থাকার কারণে এরা শক্তিশালী হয়েছে আর্থিক দিক ও সেই সঙ্গে প্রশাসন নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে। একটি দলীয় সরকারের অধীনে যখন নির্বাচন হবে, তখন সেই সুবিধাভোগীরা প্রভাব খাটাবে। স্থানীয় প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকতে পারবে না। তাদের পক্ষে সেই সুবিধাভোগী শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। সে কারণেই নিরপেক্ষ তথা তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকা জরুরি। কুসিক নির্বাচনে স্থানীয় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পক্ষে নির্বাচনে অনিয়ম করা সম্ভব ছিল না। সারাদেশের চোখ ছিল কুমিল্লার দিকে। উপরন্তু সরকার ছিল নির্লিপ্ত। সরকারের জন্য এই নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকা প্রমাণ করা জরুরি ছিল। নির্বাচনে যদি কোনো রকম অনিয়ম হতো তা ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে একটি প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিত। তাই আওয়ামী লীগ প্রার্থী আফজল খানের কাছে একটা মেসেজ পেঁৗছে দেওয়া হয়েছিল। যদিও আফজল খানের অতীত ইতিহাস খুব একটা ভালো নয়। তিনি ইচ্ছা করলে অনিয়ম করতে পারতেন। কিন্তু বোধকরি কঠোর হুশিয়ারি আফজল খানকে নিবৃত্ত করে। তবে এটাও সত্য, পার্টিতে দ্বন্দ্ব ছিল। দলীয় নেতৃত্বের একটি অংশের সমর্থন তিনি নিশ্চিত করতে পারেননি। স্থানীয় সংখ্যালঘুদের সমর্থনও তিনি পাননি। ফলে ব্যক্তিগতভাবে তার নিজের পরাজয়ের পরও দলকে তিনি 'জিতিয়ে' দিলেন। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন। সম্প্রতি সমকালসহ তিনটি পত্রিকায় জনমত সমীক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে। তিনটি পত্রিকার জনমত সমীক্ষায় দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনমত অত্যন্ত শক্তিশালী। সমকাল সমীক্ষাটি পরিচালনা করে ৬৪ জেলা শহর ও ৩৫১টি উপজেলায়। এখানে শহর ও গ্রাম্য জনগোষ্ঠীর মতামতও নেওয়া হয়েছে। মতামতে দেখা গেছে, মাত্র ২২ শতাংশ উত্তরদাতা বলছেন, দলীয় সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে। আর ৫৫ শতাংশের বেশি বলছেন, এমনটি সম্ভব নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিরোধী দলের সংসদে গিয়ে কথা বলা উচিত কি-না, এ প্রশ্নে ৭৪ শতাংশ উত্তরদাতা হ্যাঁ জবাব দিয়েছেন। ১৫ শতাংশ বলেছেন না। শুধু সমকাল কেন প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের জনমত জরিপেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে জনমত ভারী। প্রথম আলোর জনমত সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭৩ শতাংশ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। ডেইলি স্টারের জনমত সমীক্ষার ফলও অনেকটা তেমনই। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কী সিদ্ধান্ত নেবেন, তা এই মুহূর্তে স্পষ্ট নয়। তবে সরকার বড় ধরনের সংকট এড়াতে পারবে, যদি তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার গঠনের একটি সিদ্ধান্ত নেয়।
সংবিধানে এ মুহূর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। গত বছরের ১০ মে উচ্চ আদালতের একটি রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করা হয়। পরে সংসদে সংবিধানের ১৫তম সংশোধনী গৃহীত হয়, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল ঘোষিত হয়েছে। এখন তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করতে হলে সংবিধানে আবার সংশোধনী আনতে হবে। উচ্চ আদালতের রায়কে অনুসরণ করেই এ ব্যবস্থা প্রবর্তন করা যায়। উচ্চ আদালতের পূর্ণ রায় এখনও পাওয়া যায়নি। অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি রায় লিখছেন। বলা হচ্ছে, এপ্রিলের মধ্যে পূর্ণ রায় আমরা পেয়ে যাব। আংশিক রায়ে আদালত আরও দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরিচালনার কথা বলেছিলেন। রায়ের এ অংশ অনুসরণ করে সরকারি দলের কোনো সদস্য, নিদেনপক্ষে সরকার সমর্থক কোনো দল এ ধরনের একটি প্রস্তাব সংসদে আনতে পারে। সরকার ওই প্রস্তাবে সমর্থন জানিয়ে তা সংসদে পাস করাতে পারে। এটা প্রয়োজনে সংবিধানে অন্তর্ভুক্তিরও দরকার হবে না। সংসদে গৃহীত যে কোনো সিদ্ধান্ত সরকার মানতে বাধ্য। তবে স্পষ্টতই সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী হিসেবে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তার সঙ্গে বর্তমান কাঠামোর কোনো মিল থাকবে না। নির্বাচনের জন্য যে সরকার গঠিত হবে, তা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে নিরপেক্ষ সরকার হিসেবেও চিহ্নিত হতে পারে। এখানে নিরপেক্ষ সরকারের প্রধান হিসেবে কাউকে চিহ্নিত না করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কাউন্সিলও গঠন করা যেতে পারে। যাদের কাজ হবে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করা। কোনো উপদেষ্টা রাখার প্রয়োজন নেই। সচিবরা অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসন পরিচালনা করবেন। ব্যক্তির বদলে তিন প্রতিষ্ঠানের প্রধানকেও কাউন্সিলের সদস্য করা যায়। অথবা বর্তমান প্রধান বিচারপতিকে তার দায়িত্বের অতিরিক্ত হিসেবে নিরপেক্ষ সরকারের প্রধান করা যায়। বলার অপেক্ষা রাখে না_ তিনি কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবেন না। তবে সবকিছুই নির্ভর করছে সরকারের সদিচ্ছার ওপর। সরকার নিরপেক্ষ সরকার গঠন করতে বাধ্য নয়। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। বড় ধরনের সংকট এড়াতে এবং বিরোধী দলকে আস্থায় নিতে নিরপেক্ষ সরকার (শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য) গঠন করা মঙ্গল। কুসিক নির্বাচন সরকারের অবস্থানকে শক্তিশালী করলেও (ইভিএম মেশিন ব্যবহার ও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন), এটাই শেষ কথা নয়।

প্রফেসর ড. তারেক শামসুর রেহমান,
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
ঃংৎধযসধহনফ@ুধযড়ড়.পড়স

0 comments:

Post a Comment