রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ প্রসঙ্গে দুটি কথা


সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব ঘটনা হতে চলেছে, তাতে করে একজন শিক্ষক হিসেবে আমি উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। প্রায়ই আমাকে এক ধরনের বিব্রতকর অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। এতদিন ছাত্রদের রাজনীতির কারণে শিক্ষাঙ্গনে অশান্তি ছিল। এখন শিক্ষকরা এমন সব কর্মকা-ে নিজেদের জড়িত করছেন, যাতে করে শিক্ষক হিসেবে আমাকে পরিচয় দিতেও লজ্জা লাগে। একজন শিক্ষক হিসেবে আমার দায়িত্ব ছাত্র পড়ানো। কিন্তু সেই কাজটিও আমি ঠিকমতো করতে পারছি না পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকার কারণে। দুটো ঘটনার কথা আমি উল্লেখ করছি। যা আমাকে ব্যথিত করেছে। এক. অধ্যাপক আসিফ নজরুলের কক্ষে তালা ও আগুন দেয়া। সেইসাথে তাকে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার দাবি। দুই. জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনির্বাচিত শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ এ মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর কর্তৃক লাঞ্ছিত। ওই ঘটিনায় প্রক্টর অবশ্য পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তা তিনি করেছেন ছাত্র ও শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখে। কিন্তু তিনি বা তার সমর্থকরা যে কা-টি করলেন, তা কি উপাচার্য মহোদয়কে একটি বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ঠেলে দিলেন না? ওই ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ভিসিকে তলব করেছিল। এতে করেই বোঝা যায় শিক্ষামন্ত্রী ওই ঘটনায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। একজন ভিসিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যখন তলব করে তখন তো আমরাও লজ্জিত হই। কেননা তিনি তো আমাদের সহকর্মী। হয়ত আগামীকালই তিনি আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। তিনি শিক্ষক এটাই তার বড় পরিচয়। এর আগে হাইকোর্ট তাকে একবার তলব করেছিলেন। এটাও তার জন্য সুখের ছিল না। তখন একজন শিক্ষক তার একজন নারী সহকর্মীকে যৌন নিপীড়ন করেছিলেন। তাতে সারাদেশ সোচ্চার হয়েছিল। শিক্ষক রাজনীতি এমনই যে ওই শিক্ষককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারেননি উপাচার্য। ফলে ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে আস্থার জায়গাটা নষ্ট হয়ে যায়। আসিফ নজরুলের বিরুদ্ধে অভিযোগে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে (সাঈদী) কথা বলেছেন। সস্নোগান '৭১ নামে একটি সংগঠন তার বিরুদ্ধে মিছিল করেছে, ক্যাম্পাসে তাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি যে পূর্ণ নিরাপত্তায় আছেন তা বলতে পারব না। একজন শিক্ষক হিসেবে আমি বুঝি দেশে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে, তখন তার বুঝে শুনে কথা বলা উচিত ছিল। যদিও তিনি অস্বীকার করেছেন তিনি ওই ধরনের কথা বলেননি। কিন্তু ততদিন কি অনেক দেরি হয়ে যায়নি? একজন আইনের শিক্ষক হিসেবে তিনি তো জানবেন, কোন কথাটা বলা ঠিক, কোনটা ঠিক নয়। আমাদের মূল্যবোধ দিন দিন পাল্টে যাচ্ছে। সিনিয়র শিক্ষকদের আমরা সম্মান করি না। ব্যক্তি তথা দলীয় স্বার্থ যেখানে বেশি, সেখানে নূ্যনতম সম্মানবোধ এতটুকুও স্থান পায় না জাবির অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছনা করার ঘটনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভাবমূর্তি জাতির কাছে কতটুকু উজ্জ্বল হয়েছে, এটা লাঞ্ছনাকারীরা কতটুকু উপলব্ধি করেছেন, আমার সন্দেহ হয়। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে আমি নিজেকে অপমানিত বোধকরি। আমি অনেক 'ছোট' হয়ে গেছি অন্যদের কাছে। এই বিশ্ববিদ্যালয় নানা কারণে আলোচিত। একের পর এক ছাত্র হত্যা হচ্ছে। কিন্তু এই প্রবণতা বন্ধ হচ্ছে না। নারী শিক্ষক নির্যাতনকারীকে আমরা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারিনি। একজন সিনিয়র শিক্ষক একজন জুনিয়র শিক্ষককে 'চড়-থাপ্পর' পর্যন্ত মেরেছিলেন। 'ফেসবুকে' একজন সিনিয়র শিক্ষককে নিয়ে যখন লেখালেখি হলো, তখন প্রশাসন ছিল নির্লিপ্ত।  একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়কে ডেকে আনে। একজন শিক্ষক ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর 'মৃত্যু' পর্যন্ত কামনা করেন। কী জঘন্য অপরাধ। এখানে উচ্চ আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। এরচেয়ে তো আর দুঃখজনক কিছু থাকতে পারে না। প্রতিটি অন্যায়ের যদি বিচার হতো, তাহলে একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটছে, তা ঘটত না। স্বীকার করি প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু কামনাকারী শিক্ষক রুহুল আমিন খন্দকার বর্তমান উপাচার্যের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত হননি, কিন্তু বর্তমান উপাচার্যের আমলে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে গুরুতর সব অভিযোগ করেছে। শিক্ষাগত যোগ্যতার চাইতে ব্যক্তিগত আনুগত্য ও রাজনৈতিক আনুগত্যতা প্রাধান্য পেয়েছে বেশি। এরা তাই সিনিয়রকে সম্মান করে না। করতে শেখেনি। 
হত্যার বিচারের দাবিতে মশাল মিছিল
একজন ছাত্র এক সময় শিক্ষক হবে। শিক্ষকের ছত্রচ্ছায়ায় সে নিজেকে বিকশিত করবে। এটাই স্বাভাবিক। যুগে যুগে তাই হয়ে আসছে। কিন্তু আজ 'ছাত্র'-শিক্ষকের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে প্রশ্ন তোলে! আর উপাচার্য মহোদয় রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কারণে ওই 'শিক্ষকের' বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেন না। এ কোন বিশ্ববিদ্যালয় আমরা দেখছি? জাবির শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে অনিয়মের সংবাদ ছেপেছে একটি পত্রিকা। এগুলো সবই কি অসত্য? দলীয় বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে উপাচার্য মহোদয়ের সম্মান কি তাতে বেড়েছে? উপাচার্য নিজে একজন প-িত মানুষ। ভালো গবেষক। তাহলে তার হাত দিয়ে এসব অনিয়ম হলো কী করে? এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকে থাকতে হবে আরো অনেক দিন। কিন্তু ভরসা পাচ্ছি না। একজন অধ্যাপক মামুনের ওপর হামলা হয়েছে। কাল যে আমার বিরুদ্ধে হবে না, তার গ্যারান্টি কে দেবে? এমনিতেই আমি 'বিপদ'-এ আছি। জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আমাকে থানায় জিডি পর্যন্ত করতে হয়েছে। সেদিনও আমি কর্তৃপক্ষের সাহায্য পাইনি। আজ মামুন যখন লাঞ্ছিত হলেন, তিনিও কর্তৃপক্ষের সাহায্য ও সহযোগিতা পাবেন, তা মনে হয় না। উপাচার্যের অবস্থান হওয়া উচিত নিরপেক্ষ। অধ্যাপক মামুনের লাঞ্ছনার ছবি যখন পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তখন তার উচিত ছিল সিনিয়র শিক্ষকদের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা। তিনি তা করেননি। না করে তিনি তার নিরপেক্ষতা খুইয়েছেন। তিনি উপাচার্য। এর অর্থ তিনি আমাদের অভিভাবক। একজন শিক্ষক যখন লাঞ্ছিত হন, তখন তার পাশে তার দাঁড়ানো উচিত। তাকে উপদেশ দেয়ার উদ্দেশ্য আমার নয়। কিন্তু তিনি এখনও পারেন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে। যদি ভিডিও ফুটেজ পাওয়া যায়, ভালো। নতুবা উপস্থিত শিক্ষকদের মতামত নেয়া যেতে পারে। একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হলে, আমার বিশ্বাস, শিক্ষকরা আর আন্দোলনে যাবেন না। যার বিরুদ্ধে অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছিত করার অভিযোগে উঠেছে, তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তার কথায় হয়ত সাধারণ শিক্ষকরা আস্থা রাখতে পারছেন না। কিন্তু একটি তদন্ত কমিটি যদি তাকে অভিযোগ থেকে নিষ্কৃতি দেয়, এটা তার নিজের জন্যও ভালো। এতে করে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। গত শনিবার একজন অভিভাবক যখন আমাকে পেয়ে রীতিমত অভিযোগ করলেন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে,তাকে আমি জবাব দিতে পারিনি। আগামীতে আমি জবাবটি দিতে চাই। এ জন্য উপাচার্য মহোদয়কেই এগিয়ে আসতে হবে। 
নিহত জুবায়ের
এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক রয়েছেন, দেশজুড়ে যাদের পরিচিতি রয়েছে। একজন শিক্ষকের জন্য আমরা কেন সবাই অপমানিত হব? জাতির কাছে কেন ছোট হব? শিক্ষিকা নির্যাতনকারীকে আমরা হালকা শাস্তি দিয়েছি। সেদিন শিক্ষক হিসেবে আমরা অসম্মানিত হয়েছিলাম। সেদিনও আমরা বলেছিলাম ওই কুলাঙ্গার শিক্ষককে দিয়ে জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষক সমাজকে বিবেচনা করা যাবে না। আজ যারা অধ্যাপক মামুনকে লাঞ্ছিত করেছে, তারা শিক্ষক বটে। কিন্তু তাদের দিয়েও সব শিক্ষককে বিবেচনা করা যাবে না। আরো একটা কথা। কোনো অবস্থাতেই দীর্ঘস্থায়ী ক্লাস যাতে বন্ধ না থাকে, সেদিকে দৃষ্টি দেয়া সবার উচিত। আমি আশা করি সব শিক্ষকই এটা চান। কর্তৃপক্ষ এদিকে নজর দেবেন। আমার কথা জাহাঙ্গীরনগরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। কর্তৃপক্ষ নতুন একজন প্রক্টর নিয়োগ করেছেন। যদিও তার সম্পর্কে কথা উঠেছে তিনি বেশিরভাগ সময়ে দেশের বাইরে থাকেন। এমতাবস্থায় তিনি ক্যাম্পাসে শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করবেন কীভাবে? জাহাঙ্গীরনগরে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে, তখন সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি। সেখানে সব পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। ক্যাম্পাসের পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। উপাচার্যের প্রশাসন পরিচালনা নিয়েও কথা আছে। স্বয়ং ইউজিসির চেয়ারম্যান শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে উপাচার্যের উপস্থিতিতেই তার সমালোচনা করেছিলেন। ওই সমালোচনার মুখে তিনি পদত্যাগের ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন। দুর্নীতির ও অযোগ্যতার অভিযোগ যদি থাকে এবং শিক্ষকদের মধ্যে যদি তার ব্যাপারে আস্থার ঘাটতি দেখা দেয়, তাহলে সসম্মানে বিদায় নেয়াই শ্রেয়। জোর করে ক্ষমতায় থাকা শোভন নয়। প্রতিটি ক্যাম্পাসেই যা ঘটছে তা ভালো নয়। দৃষ্টিকটু। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। শিক্ষক-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছেন। রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি যেন দেখা না হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাধারণ শিক্ষক হিসেবে জুবায়ের হত্যার যেমনি বিচার চাই, ঠিক তেমনি বিচার চাই অধ্যাপক মামুনের লাঞ্ছিত করার ঘটনারও। বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ছাত্র পড়তে আসে। জীবন দিতে আসে না। আমরা যদি ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারি, এ ব্যর্থতা আমাদের সবার। যে অচলাবস্থা জাহাঙ্গীরনগরে সৃষ্টি হয়েছিল তা কাম্য নয়। সবে প্রথম বর্ষের ছাত্ররা তাদের শিক্ষাজীবন শুরু করেছে। তারা এ ঘটনায় কী শিক্ষা পেল? তারা দেখল তাদের এক সিনিয়র বড় ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। তারা দেখল একজন শিক্ষক অপর একজন শিক্ষকের ওপর চড়াও হয়েছে। শিক্ষকদের ওপর তাদের আস্থা কী থাকে আর? আমি লজ্জিত। দুঃখিত। এবং অপমানিত বোধ করছি পুরো ঘটনায়। আসুন সবাই মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে আমরা কাজ করি। দৈনিক যায় যায় দিন,  ২৭ জানুয়ারি ২০১২ ড. তারেক শামসুর রেহমানপ্রফেসর,  আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগজাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment