তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। চুক্তি হচ্ছে না। এ-সংক্রান্ত কোনো দিকনির্দেশনা না থাকলেও, বিবিসির বাংলা বিভাগ (৯ মে) আমাদের জানাচ্ছে যে তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আদৌ কোনো চুক্তি হচ্ছে না। এ কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। যদিও দীপু মনি তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন অবধি কোনো চুক্তি হয়নি। এখানে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। কিন্তু ভারত আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারত আমাদের বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার বলেছেন, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? নয়াদিল্লিতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেখানে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার। প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপিও ব্যয় করা হয়ে গেছে। বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে, তা একাধিক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা, আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারছি না। জেসিসির যৌথ ইশতেহারে এ-সংক্রান্ত কোনো কথা বলা হয়নি। গঙ্গা চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এর আগেই পদ্মায় পানি নেই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। ২০২৭ সালে লোকসংখ্যা বাড়বে তিন গুণ। যে বিপুল পানির চাহিদা থাকবে, তার কী হবে? চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা নিচ্ছি কই? অতীতে কখনো আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি। সীমান্ত হত্যা আজো বন্ধ হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও একের পর এক সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই, যেখানে বিজিবির গুলিতে কোনো ভারতীয় নাগরিক মারা গেছেন। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন নিরপরাধ বাংলাদেশি নাগরিকরা। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৪০ মাসে কতজন বাংলাদেশি মারা গেছেন, তার পরিসংখ্যান 'অধিকার'-এর কাছে আছে। এ নিয়ে কত শীর্ষ বৈঠক হলো। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয়নি। প্রণব বাবু যখন ঢাকায়, তখনো এটা নিয়ে কিছু বলা হলো না। সীমান্ত চিহ্নিত ও অপদখলীয় ভূমির ব্যাপারেও প্রণব বাবু মুখ খোলেননি ঢাকায়। গুরুত্ব আরোপ করা হয়নি। বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারে আমরা কিছুই শুনলাম না। ভারতের ভেতরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা ভারতেই থাকতে চান। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভেতরে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবেই থাকতে চান। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তারপর কখনোই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেয়নি সংবিধান সংশোধন করার। সমস্যাটা তো আমাদের নয়। সমস্যাটা ভারতের। আজ প্রায় ৩৮ বছর পরও এ কথাগুলো আমাদের বলতে হয়। এতে করে কি ভারতের সদিচ্ছা প্রমাণ করে? ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলার অনুদানের কথা বলে গেলেন। কিন্তু ঋণের টাকা দিয়ে তো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না? ১৩ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। আর ২০১১-১২ সালের পরিসংখ্যান যখন আমাদের হাতে আসবে, ধারণা করছি তা চার মিলিয়ন ডলারের অঙ্ককে ছাড়িয়ে যাবে। ভারত মাঝেমধ্যে কিছু পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বলে বটে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ এসব পণ্যের অনেকগুলোই রপ্তানি করে না। ভারতের অশুল্ক বাধা দূর করা নিয়েও 'নানা কাহিনী' আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নানা ধরনের শুল্ক দূর করা যাচ্ছে না। ফলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি সেই তুলনায় বাড়ছে না। শুধু ঘাটতিই বাড়ছে। এটা আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ। ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি নিয়ে আদৌ কোনো অগ্রগতি নেই। কিন্তু ২০১৩ সালে আমরা আদৌ বিদ্যুৎ পাব- এ ব্যাপারটিতে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশ বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের মুখে। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বন্ধ অনেক কারখানায়। অথচ ভারত যদি আন্তরিক হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভুটানে সারপ্লাস বিদ্যুৎ রয়েছে। এই বিদ্যুৎ ভুটান বাংলাদেশে রপ্তানি করতে পারে। এ জন্য সম্মতি প্রয়োজন ভারতের। কিন্তু ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি। আশুগঞ্জে যে কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়েছে, তাতে লাভবান হবে ভারত। আমরা লাভবান হব না। ভারত তার পণ্যের পরিবহন সুবিধার জন্যই এই টার্মিনাল ব্যবহার করছে। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে আমরা ভারতীয় কনটেইনারগুলো পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছি। ভারত প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমাদের স্বার্থ হয়ে পড়েছে গৌণ। আজ জেসিসির বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহারে যেসব বক্তব্য স্থান পেয়েছিল, তাতে ওই ভারতীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে আমাদের স্বার্থে কোনো কথা বলে গেলেন না।
বাংলাদেশিরা খুবই অতিথিপরায়ণ। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল, প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে পায়েস রান্না করে তাঁকে খাইয়েছিলেন। কত আন্তরিক হলে আমাদের সরকারপ্রধান এই কাজটি করতে পারেন! আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো নয়াদিল্লিতে পদ্মার ইলিশ, মিষ্টি আর সিরামিকের উপহারসামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলেন। এটা তো মিথ্যা নয়। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর 'ইলিশ কূটনীতি' কি আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে? আমরা কি আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে পেরেছি? আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলে দেয়, আমাদের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। আমরা বারবার আশ্বাস পাচ্ছি। ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। ভারতীয় নেতাদের সেই আশ্বাস আর পূরণ হয় না। কিন্তু ভারত ইতিমধ্যে তার ষোলআনাটা বুঝে নিয়েছে। আজ একটি সুযোগ এসেছে আমাদের জন্য। যদিও ভারতীয় রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খুবই সীমিত। নীতিনির্ধারণীতে রাষ্ট্রপতির কোনো ভূমিকা নেই। তিনি হবেন আলংকারিক প্রধান। তবু প্রণব মুখার্জি বলে কথা। যিনি ভারতীয় রাজনীতিতে 'চাণক্য' হিসেবে পরিচিত, তাঁর একটি 'উপদেশ' বা 'পরামর্শ' মন্ত্রীরা গ্রহণ করবেন- এটা আমরা আশা করতেই পারি। আজ যা উপলব্ধি করা প্রয়োজন, তা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক যদি আরো উন্নত হয়, তাহলে তা ভারতের জন্যই মঙ্গল। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ব্যাপারে ভারতের যে নীতি, তাতে পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশকে 'বন্ধু' ভাবতে হবে। প্রণব মুখার্জি বাংলাদেশের জনগণের 'বন্ধু'। আমরা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম।Daily KALERKONTHO01.7.12