রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দুটি সংবাদ ও অনেক প্রশ্ন

 
দুটি সংবাদই ছাপা হয়েছে আমাদের দেশের পত্রপত্রিকায়। প্রথম সংবাদটি দেশের এক মন্ত্রীকে নিয়ে, অপর সংবাদটি দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশের প্রেসিডেন্টকে নিয়ে। আমাদের দেশের মন্ত্রীর নাম দিলীপ বড়-য়া, যিনি শিল্পমন্ত্রী আর দক্ষিণ-পূর্ব আফ্রিকার দেশ মালাওবির প্রেসিডেন্টের নাম জয়েস বান্দা, যিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন মাত্র দু’মাস। একটি কাগজে দিলীপ বড়-য়া সম্পর্কে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল গত ৫ জুন। বাম ঘরানার এই রাজনীতিক, যিনি একটি ছোট্ট দলের প্রধান এবং বোধকরি এখনও স্বপ্ন দেখেন(?) সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও শোষণমুক্ত সমাজের, তার সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি হলÑ মন্ত্রী হয়েই তিনি ও তার পরিবার ছয় ছয়টি প্লট বাগিয়ে নিয়েছেন। নিজের নামে দুটি, স্ত্রীর নামে ১টি, মেয়ের ও ভাইপোর নামে ১টি প্লট নিয়েছেন অভিজাত এলাকায়। উত্তরা ও পূর্বাচলে ১১ কাঠা প্লটের মালিক তিনি। দিলীপ বাবু এখানেই থেমে থাকেননি। চট্টগ্রামেও ৫ কাঠার একটি প্লটের জন্য আবেদন করেছেন। পাঠকদের স্মরণ থাকার কথা, একটি সার কারখানা সফরে গেলে তাকে দামি গাড়ি উপহার(!) দেয়া হয়েছিল। ওই গাড়িটি উপহার দেয়া হয়েছিল এমন এক সময় যখন ওই সার কারখানার ওভারহোলিং নিয়ে দুর্নীতির নানা খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। স্মরণ করতে পারছি না, পত্রপত্রিকায় এই সংবাদটি ছাপা হলে দিলীপ বাবু ওই গাড়িটি (এসিসহ) ফেরত দিয়েছিলেন কিনা? তবে শিল্পমন্ত্রী, যার কোন নিজস্ব আয় নেই, তিনি ইতিমধ্যে সব প্লটের মালিকানা ছেড়ে দিয়েছেন কিনা, তা বলতে পারব না। অন্তত এক সপ্তাহ পরেও এ সংক্রান্ত কোন খবর বা ছেড়ে দেয়ার সংবাদ আমার চোখে পড়েনি। এই হল আমাদের মন্ত্রী কাহিনী।
এবার শুনুন জায়েস বান্দা কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টের ব্যবহারের জন্য কেনা বিমান ও গাড়ির বহর বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের ব্যবহারের জন্য বিমানের পেছনে বছরে খরচ হয় ২ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড। আর প্রেসিডেন্টের বহরে রয়েছে ৬০টি লিমুজিন। একটি ছোট রাষ্ট্র মালাওবি একজন রাষ্ট্রপতির পেছনে এত খরচ করতে পারে না। তিনি ব্রিটেনের রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহণের ৬০ বছর পূর্তি উপলক্ষে লন্ডনে যে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল, তাতে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের একটি বিমানে করে, যাত্রী হয়ে।
সারা বিশ্বে এখনও মন্দা চলছে। গ্রিসসহ ইউরোপের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ফ্রান্সের নয়া প্রেসিডেন্ট ফ্রাঁসোয়া ওলন্দ দায়িত্ব গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রীদের বেতন কমিয়ে দিয়েছেন। এক্ষেত্রে আফ্রিকার একটি গরিব দেশ মালাওবি যে বিশ্ব মন্দায় আক্রান্ত হয়েছে, এটাই স্বাভাবিক। তাই মিসেস বান্দা যখন কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নেন, তার এই সিদ্ধান্তটি সর্বত্র প্রশংসিত হয়েছে। এমনকি ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রী অ্যান্ড্র- মিশেলও মিসেস বান্দার সিদ্ধান্তের প্রশংসা করেছেন। বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে কিছুটা ছোট মালাওবি (৪৫,৭৪৭ বর্গমাইল)। লোকসংখ্যা মাত্র দেড় কোটি। বাংলাদেশের জিডিপির চেয়ে কম, মাত্র ৫ দশমিক ৬৭৩ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয়ও (৩৫১ ডলার) বাংলাদেশের চেয়ে কম।
প্রেসিডেন্ট বান্দা কৃচ্ছ্রসাধনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা কি আমাদের জন্য চিন্তার কোন খোরাক জোগায় না? প্রেসিডেন্ট বান্দা সঠিক কাজটিই করেছেন উড়োজাহাজ বিক্রি করে। সাবেক প্রেসিডেন্ট ড. বিঙ্গু মুথারিকা নিজের জন্য এ বিমানটি কিনেছিলেন। যে দেশের মানব উন্নয়ন সূচক ০.৪৯৩, সে দেশের প্রেসিডেন্ট ও তার পরিবারবর্গের জন্য ৬০টি লিমুজিন গাড়ি থাকতে পারে না। থাকার কোন প্রয়োজন নেই। বিক্রি করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে সঠিক কাজটিই করেছেন বান্দা। আজ শুধু বান্দার কথা কেন বলি, চরম অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত গ্রিসেও সরকার বেতন কমাতে বাধ্য হয়েছে। অথচ আমাদের মতো দেশে কৃচ্ছ্রসাধনের কোন উদ্যোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশ সফরে যান, তার সফর সঙ্গীর সংখ্যা থাকে প্রায় ১০০। সাংবাদিকরা তো বটেই, অনেক বুদ্ধিজীবী, দলীয় নেতাকর্মীরাও তার সফরসঙ্গী হন। যাদের খরচ বহন করে রাষ্ট্র। ব্যবসায়ীরা তার সফরসঙ্গী হন বটে, তবে সম্ভবত ব্যবসায়ীরা নিজেরাই নিজেদের খরচ মেটান। এটা একটা ট্রাডিশনে পরিণত হয়েছে। অতীতেও এমনটি হয়েছে। কিছুদিন আগে (২০০৯) কপ-১৫ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যোগ দিয়েছিলেন। কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত কপ-১৫ সম্মেলনে তার সফরসঙ্গী হয়েছিলেন বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য। ব্যানার হাতে বেল্লা সেন্টারের সামনে দাঁড়ানো তাদের ছবিও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমাদের সংসদ সদস্যরা ‘আইলা’ কিংবা ‘সিডর’ উপদ্রুত এলাকার মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই বিদেশে যাবেন। জাতীয় স্বার্থে এ কাজটি তিনি করবেন। সেক্ষেত্রে এত বড় একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। এতে রাষ্ট্রের খরচ বাড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন বিদেশ যান, তখন তার সঙ্গে এত বড় একটি প্রতিনিধি দল যায় না। আমরা একটা দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি।
দিলীপ বড়-য়া একটা নয় একাধিক প্লট নিয়েছেন। এর বাইরে অন্য কোন ‘সুবিধা’ তিনি নিয়েছেন কিনা জানি না। প্লট নেয়ার কথা তিনি স্বীকারও করেছেন। তবে বলেছেন, পারলে তিনি ১২টি প্লটই নিতেন। কেননা তার ১২ জন আÍীয় প্লটের জন্য আবেদন করেছিলেন। কিন্তু মাননীয় মন্ত্রী যে ‘রাজনীতি’ করেন, তার দলের কিছু কর্মীর ঢাকা শহরে থাকার জায়গাও নেই, চাকরিও নেই। তারা কি কোনদিন একটি প্লটের কথা ‘চিন্তা’ করেছে? মাননীয় মন্ত্রী, রাজউক কিন্তু শুধু এ জমানাতেই প্লট দিচ্ছে না। আগেও দিয়েছে। তখন আপনি আবেদন করলেন না কেন? ৬টি প্লট আপনাকে কোন উচ্চতায় নিয়ে যাবে না। আপনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলেও আপনাকে আমি চিনি ও জানি। প্রয়াত মান্নান ভূঁইয়ার বাসায় (যখন মন্ত্রী ছিলেন না) আপনি গিয়েছিলেন। কেন গিয়েছিলেন, সে কথা না হয় নাইবা বললাম। কিন্তু নিউইয়র্কে আপনাকে যারা চেনে, তারা যখন ফোন করে আমাকে আপনার প্লট প্রাপ্তির কথা জিজ্ঞেস করে, আমি তাদের জবাব দিতে পারি না। ওরা আপনাকে চেনে। আপনি নিউইয়র্কে গিয়ে ওদের সঙ্গেই ছিলেন। এ দেশে বাম রাজনীতি করা অনেক মানুষ রাজনীতির কারণে ‘শেষ’ হয়ে গেছেন। সে রাজনীতি ভুল ছিল কিনা, তারা তা কখনও চিন্তা করেননি। রাজনীতিটাকেই আঁকড়ে ধরেছেন। মারাও গেছেন। নিঃস্ব হয়ে ‘অন্যের দয়ায়’ বেঁচে আছেনÑ এ সংখ্যা একেবারে কম নয়। আবার এ দৃশ্যও আছেÑ এক সময় ‘বাম’ রাজনীতি করে এখন শত কোটি টাকার মালিক। সাবেক সোভিয়েত রাজনীতির সমর্থক, যারা ১৯৭২-৭৪ সময়সীমায় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তারা আজ অনেকে মন্ত্রী, এমপি, আওয়ামী লীগের বড় নেতা। আবার গণবাহিনী গঠন করে যারা আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৭২-৭৪) পতন ঘটাতে চেয়েছিলেন, তারা আজ বড় সুবিধাভোগী। এমপি। কারও বা আবার মন্ত্রীর সমান মর্যাদা। কিভাবে মানুষ বদলে যায়!
প্লট পাওয়া কোন অপরাধ নয়। প্লট তিনি পেতেই পারেন। কিন্তু দৃষ্টিকটু তখনই, যখন মন্ত্রী হয়ে তিনি ওই প্লটটি পান। আগে পেলে একথা উঠত না। একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে তিনি যদি আবেদন করতেন, তিনি ভালো করতেন। সেটাই শোভন ছিল। তখন কোন প্রশ্ন উঠত না। আজ উঠেছে। একজন বাম রাজনীতি করা লোকের কাছে, এটা আশা করা যায় না। লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থাকার কথা তার। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় একটা প্লট না পেলে কি তার জীবন ‘অপূর্ণ’ থাকত? অনেকেরই তো সরকারি প্লট নেই। আমার নিজেরও নেই। তাতে কী হয়েছে? একটা প্লট বা ফ্ল্যাট আমাকে ‘পূর্ণতা’ এনে দেবে না।
যে রাজনীতির ভেতর দিয়ে দিলীপ বড়-য়া বেড়ে উঠেছেন, সেই ‘রাজনীতি’ তাকে ক্ষমতায় বসায়নি। জনগণের ভোটে তিনি নির্বাচিতও হননি। ভোটে দাঁড়ালে ১০০ ভোট পেতেন কিনা সন্দেহ। তবুও তিনি মহাজোট সরকারের মন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহানুভবতায় তিনি শপথ নিয়েছেন। কিন্তু লোভ-লালসা তিনি ত্যাগ করতে পারলেন না। প্লটের হাতছানি তার রাজনৈতিক কমিটমেন্টকে ধূলিসাৎ করে দিল। লোভ-লালসার কাছে তিনি আÍসমর্পণ করলেন। প্রেসিডেন্ট বান্দার সঙ্গে পার্থক্য এখানেই। একটি গরিব দেশের প্রেসিডেন্ট বান্দা। বিলাসবহুল বর্তমান লিমুজিন গাড়ি তার প্রয়োজন নেই। ফ্রান্সের বামপন্থী প্রেসিডেন্ট আগের বেতন রাখতে পারতেন। কিন্তু মন্দার কারণে অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে তিনি মন্ত্রীদের বেতন কমিয়ে দিয়েছেন। এটাই সঠিক। আমাদের মন্ত্রী দিলীপ বড়-য়া পারতেন এ ধরনের একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে। কিন্তু তিনি পারলেন না। বরং দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন তিনিও দুর্নীতির (?) ঊর্ধ্বে নন। এতদিনের তার রাজনৈতিক আদর্শ, কমিটমেন্ট আজ মিথ্যা প্রমাণিত হল। আমাদের দুঃখটা এখানেই। তিনিও গতানুগতিক পথে হাঁটলেন। মন্ত্রী হওয়া মানেই গাড়ি, বাড়ি, প্লটের মালিক হওয়া। মন্ত্রী দিলীপ বড়-য়া আজ সেই ‘পথেরই পথিক’।
Daily JUGANTOR
13.06.12

0 comments:

Post a Comment