রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রসঙ্গে



একটি ‘যুদ্ধের’ কথা বলেছেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। মন্ত্রী তো বটেই, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকও তিনি। গত ২৭ মে ১৪ দলের বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশ্নে বিরোধী দলের সঙ্গে আলোচনার পথ যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, তাহলে ‘যুদ্ধ’ শুরু হয়ে যাবে। প্রতীকী অর্থে সৈয়দ আশরাফ যা বলতে চেয়েছেন, তা বোধ করি এ দেশের লাখ লাখ মানুষেরও কথা। আদৌ কি সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে? কিংবা গঠিত হবে কি একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? নির্বাচনের বাকি আছে দেড় বছর। কিন্তু একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে রাজনীতি এখন আবর্তিত হচ্ছে। আর তা হচ্ছে আগামী নির্বাচন কারা পরিচালনা করবেÑ ক্ষমতাসীন সরকার, নাকি নির্দলীয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার? সৈয়দ আশরাফ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছেন বটে, কিন্তু এর ব্যাখ্যা তিনি দেননি। তিনি এবং মহাজোট সরকারের নেতৃবৃন্দ বলছেন, বিরেধী দল এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাঠামোর ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দিক। সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারটি পরিপূর্ণভাবে খোলাসা হয় না। অনেক প্রশ্ন এখন রয়ে গেছে। এক. কাদের নিয়ে এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হবে? দুই. অনির্বাচিতরা কি এই অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনে থাকবেন? তিন. বর্তমান সরকার কি মেয়াদের শেষের তিন মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে কাজ করবে? চার. বিরোধী দল বা জোট যদি কোন প্রস্তাব না দেয়, তাহলে কি সরকার উদ্যোগী হয়ে একটি প্রস্তাব দেবে? পাঁচ. অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ব্যাপারে যে ‘সংলাপ’, তা কি দুই জোটের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকবে? ছয়. সুশীল সমাজের কোন প্রস্তাব কি গ্রহণযোগ্যতায় নেয়া হবে?
সৈয়দ আশরাফের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাবের মাঝে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে। কেননা প্রধানমন্ত্রী বারবার বলে আসছেন, এমনকি সৈয়দ আশরাফের এই বক্তব্যের একদিন আগেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীনেই দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একই সঙ্গে সিইসি কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের একটি বক্তব্যও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ‘যে কোন সরকারের অধীনেই সুষ্ঠু, অবাধ নির্বাচন সম্ভব’। সিইসি কি প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিলেন না যে, ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন সম্ভব? বলতে গেলে সবাই যখন একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলছেন, সেখানে সিইসির উচিত ছিল চুপচাপ থাকা। সিইসি তার বক্তব্যের যে ব্যাখ্যাই দিন না কেন, নির্বাচন কমিশন যে সরকারের প্রভাবমুক্ত থাকতে পারবে না, সেটা আবারও প্রমাণিত হল। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন আমাদের সামনে একটি ‘মডেল’ থাকলেও আমরা সেখান থেকে কিছুই শিখিনি। একজন টিএন সেশানের (সাবেক ভারতীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার) বড্ড দরকার ছিল এ দেশে। দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন সে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। অতীতেও হয়নি। আগামীতেও হবে না। সুতরাং একটি ‘নিরপেক্ষ সরকার’ আমাদের দরকার, যারা নির্বাচন পরিচালনা করবে। এই ‘নিরপেক্ষ সরকার’-এর কথা হিলারি ক্লিনটন থেকে শুরু করে দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা বারবার বলছেন। এখন সৈয়দ আশরাফ যে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’-এর কথা বলছেন, সেই সরকার যদি ‘নিরপেক্ষ সরকার’ হয়, তাতে ক্ষতির কিছু নেই। খালেদা জিয়া একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছেন বটে, কিন্তু আমার ধারণা ২০০৭-০৮ মেয়াদের যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সেই একই ধরনের সরকার তিনি নিজেও চান না। একাধিকবার তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধান অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের সমালোচনা করেছেন। ওই ধরনের একটি সরকার তিনি চাইবেন না, এটাই স্বাভাবিক। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলতে তিনি একটি নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের কথাই বলতে চেয়েছেন। বিএনপি এ ধরনের একটি সরকারের কাঠামোর ব্যাপারে প্রস্তাব রাখতে পারে। এমনও হতে পারে, সংসদের যে কোন একজন সদস্যের (এ ক্ষেত্রে জোটভুক্ত কেউ অথবা একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য নিজেও) উত্থাপিত একটি ‘বিল’ বিএনপি সমর্থন করতে পারে। এটা নিয়ে সংসদে আলোচনা হলে ভালো হয়। কিন্তু সংসদকে আমরা যেভাবে অকার্যকর করে ফেলেছি, সেখানে এ ধরনের প্রস্তাব বিতর্কের মাত্রা বাড়াবেই মাত্র। ১৪ দলীয় জোটে দুটি দলÑ ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছে। তারাও সৈয়দ আশরাফের প্রস্তাবিত ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’-এর ধারণার সঙ্গে একমত। তবে বিস্তারিত তারাও খোলাসা করেননি। মাঝে মধ্যে জনাব রাশেদ খান মেনন সরকারের মৃদু সমালোচনা করেন বটে, কিন্তু তিনি বর্তমান সরকারকে নিয়েই যে ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’-এর ধারণা, তা সমর্থন করেন কি না, সে ব্যাপারে আমি স্পষ্ট নই। তার দলের কোন চিন্তাধারার খবরও আমরা জানি না। অন্যদিকে জনাব ইনু খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে ‘মাইনাস’ করার যে তত্ত্ব দিয়েছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রীর বাহবা পেলেও, সাধারণ মানুষের কাছে তিনি নিজেকে একজন ‘বিতর্কিত’ ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করলেন। জনাব ইনুর অতীত ইতিহাস খুব স্বচ্ছ নয়। গণবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক কিংবা আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা মিডিয়া কর্মীদের কাছে ব্যাপক পরিচিত। তিনি যখন ‘মাইনাস ওয়ান’ ফর্মুলার কথা বলেন, তখন ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ প্রশ্নে তার বক্তব্য কোন গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। ‘নিরপেক্ষ সরকার’-এর প্রশ্নে একটি ঐকমত্য প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আগামী দু-এক মাসের মধ্যে যদি কোন ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে রাজনীতিতে আরও অস্থিরতা বাড়বে, যা সংকটকে আরও ঘনীভূত করবে। সৈয়দ আশরাফ আলোচনার কথা বলেছেন বটে, কিন্তু ‘বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার’ ধরনের মানসিকতা পরিত্যাগ করতে হবে। সৈয়দ আশরাফকেই স্পষ্ট করতে হবে তারা দলীয় সরকারের বাইরে গিয়ে একটি ‘নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ চান। এখানে বিভিন্ন ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এলডার্স কাউন্সিল, সাংবিধানিক পদের অধিকারী তিন ব্যক্তির সমন্বয়ে একটি কাউন্সিল, সরকার ও বিরোধী দলের মনোনীত সমানসংখ্যক প্রতিনিধির সমন্বয়ে একটি কাউন্সিল, আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ একজন বাংলাদেশীর সমন্বয়ে একটি সরকার ইত্যাদি নানা সম্ভাবনা নিয়ে সংলাপ হতে পারে। বিভিন্ন গুণীজনের কাছ থেকেও তাদের মতামত নেয়া যেতে পারে। মোট কথা, একটি সরকার, যে সরকারের সঙ্গে মহাজোট সরকারের কোন সম্পর্ক থাকবে না, সেই সরকারের ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা উত্তম। কিন্তু বাংলাদেশের যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি, তাতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা দলীয় মানসিকতার বাইরে বেরোতে পারেন না। ফলে তত্ত্বগতভাবে নির্বাচিতদের দিয়ে সরকার গঠন করা যায় বটে, কিন্তু তা আদৌ কোন ফল বয়ে আনতে পারবে না। আরও একটা কথা। সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনায় বিরোধী দলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। যে ‘অভিযোগে’ বিরোধী দলের ৩৩ জন নেতাকে জেলে পাঠানো হয়েছিল, সেই ‘অভিযোগ’ নিয়ে প্রশ্ন আছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, পাঁচজন এমপিকে পর্যন্ত জেলে যেতে হয়েছিল। উচ্চ আদালত এমপিদের জামিন ও বাকিদের ব্যাপারে রুল ইস্যু করেছেন বটে, কিন্তু এতে দুটি বড় দলের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাসের যে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, তা ‘পূরণ’ হবে কিভাবে? আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে উদ্যোগ নিতে হবে সরকারকেই। সরকারকেই নমনীয় হতে হবে। যারা হার্ডলাইনে গিয়ে ‘সমস্যার’ সমাধান চান, তারা দেয়ালের লিখন পড়েননি। ইতিহাস বড় নির্মম। ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে এ দেশে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ইতিহাসে কিভাবে চিহ্নিত হয়েছে ওই নির্বাচনগুলো? ইতিহাস আমাদের শিক্ষা দেয়। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে ইতিহাস থেকে আমরা কেউ শিক্ষা নিই না। তবুও আমরা আস্থা রাখতে চাই রাজনীতিবিদদের ওপর। কেননা তারাই জাতিকে পথ দেখাবেন। একুশ শতকে তারাই বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবেন। আমাদের সমস্যা অনেক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিবেদন, লন্ডনের অ্যামনেস্টির মূল্যায়ন কিংবা দি ইকোনমিস্টে যা লিখেছে, তাতে বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়নি। রাজনীতিবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকবেই। আবার তারাই এক হয়ে জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবেন। ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদে তো আমরা সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়ে সংসদীয় রাজনীতিতে ফিরে এসেছিলাম। সিদ্ধান্তটা তো সেদিন সংসদেই হয়েছিল। আজ সংসদে সে রকম একটি সিদ্ধান্ত নিতে ক্ষতি কী? তত্ত্বাবধায়ক না হোক, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার হতে পারে। এর রূপরেখা কী হবে, তা আলোচনার মাধ্যমেই সম্ভব। বিএনপি যদি একটি প্রস্তাব দেয়, একটি ‘বিল’ সংসদে উপস্থাপন করে; আমি মনে করি তার মাধ্যমেও আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। খালেদা জিয়া নিজেও একটি প্রস্তাব দিতে পারেন। সেটা সংসদেই যে দিতে হবে, তার কোন মানে নেই। একটি ‘প্রস্তাব’, তা যে কোনভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। না হলে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর হবে না।
একজন সিনিয়র মন্ত্রী ও দলের অন্যতম নীতিনির্ধারক যখন একটি ‘যুদ্ধের’ কথা বলেন, তখন আমরা আতংকিত হই। ভয়ে ভয়ে থাকি। পুরনো অনেক স্মৃতি আমাদের মনে পড়ে। আমরা ‘যুদ্ধ’ চাই না। চাই শান্তি। চাই পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা।
Daily JUGANTOR
4.6.12

0 comments:

Post a Comment