রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সম্পর্ক

অতি সাম্প্রতিককালে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ব্যাপক হারে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, এই রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সম্পর্কের অবনতি হবে কী-না? এমনিতেই দুদেশের মাঝে সম্পর্ক যে উষ্ণ রয়েছে, তা বলা যাবে না। গত মে মাসে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাদে ওআইসির উদ্যোগে শরণার্থীবিষয়ক একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা সমস্যাটি তুলে ধরেছিলেন। তিনি সম্মেলনে অভিযোগ করেছিলেন, রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। এর প্রতিক্রিয়ায় কী-না তা বলতে পারব না। কিন্তু বাংলাদেশ যখন রোহিঙ্গা সমস্যাটা আন্তর্জাতিক আসরে তুলে ধরার উদ্যোগ নেয়, ঠিক তার দুই সপ্তাহ পরেই গত ৩ জুন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুনরায় জাতিগত দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এই জাতিগত সহিংসতায় ইতিমধ্যে সেখানে প্রায় ৫২ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। যদিও সেখানে এই জাতিগত সহিংসতার ইতিহাস আজকের নয়। বরং বেশ পুরনো। মূলত সেখানে বসবাসকারী কয়েক লাখ মুসলমান, যারা রোহিঙ্গা হিসেবে পরিচিত তাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হয় না। ১৯৭৮ ও ১৯৯১ সালে এ ধরনের জাতিগত সহিংসতায় ব্যাপক হারে রোহিঙ্গারা অবৈধভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছিল। কক্সবাজার এলাকায় এসব রোহিঙ্গা নানা রকম অবৈধ কর্মকা-ে লিপ্ত। দু-দুটো ক্যাম্পে এরা বসবাস করে। জাতিসংঘের উদ্যোগে পরিচালিত এই দুটো ক্যাম্পে রেজিস্টার্ড রোহিঙ্গার সংখ্যা ২৮ হাজার। কিন্তু এর বাইরে আরো প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা অবৈধভাবে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করছে। স্পষ্টতই বাংলাদেশ আর অতিরিক্ত রোহিঙ্গা গ্রহণ করতে পারে না। অবৈধ রোহিঙ্গারা আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন বিনীতভাবে পশ্চিমা বিশ্বের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেন বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয় রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করা, তখন তিনি সঠিক কাজটিই করেছেন। বাংলাদেশ আর রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে পারে না। এতে করে দুদেশের সম্পর্কে একটা ভুল বোঝাবুঝির যেন সৃষ্টি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। আগামী জুলাই মাসে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন বাংলাদেশ সফরে আসছেন। সেটাও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাসী। কিন্তু ভারতের দ্বিপাক্ষিকতার কারণে আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বহুপাক্ষিকতার চরিত্র হারিয়ে ফেলেছি। ফলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি না নেয়ার কারণে। অথচ চীন, থাইল্যান্ড এবং ভারতও এই জ্বালানি সম্পদকে ব্যবহার করছে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে আমাদের সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক শিল্পকারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা থাকলেও, আমরা এ ব্যাপারে গত তিন বছরে কোনো উদ্যোগ নেইনি। মিয়ানমার চট্টগ্রাম সীমান্তে সারকারখানা স্থাপন করে মিয়ানমারের বিপুল সারের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু তা হয়নি। মংডুর আশপাশে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এর ভিত্তিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিলেট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারত, সঠিক দিকনির্দশনার অভাবে তা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও আমরা উৎসাহিত করিনি। আমরা বেসরকারি উদ্যোগ আফ্রিকায়ও জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদের উদ্যোগ নিয়েছি। অথচ পাশের দেশে রয়েছে প্রচুর অনাবাদি জমি। মিয়ানমার জমি 'লিজ' দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও, আমাদের নীতি প্রণেতারা বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি। এমনকি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও উৎসাহিত করেননি। অতি সম্প্রতি ভারত থেকে তুলা আমদানি নিয়ে একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ মিয়ানমারের কয়েকটি অঞ্চলে প্রচুর তুলা উৎপন্ন হয়। আমরা কখনো ওই তুলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাইনি। এমনকি ওই অঞ্চলে প্রচুর ভুট্টা চাষ হয়। মিয়ানমারে প্রচুর গবাদিপশু উৎপাদন হয়, যা কী-না আমাদের চাহিদা মেটাতে পারে। যৌথভাবে গবাদিপশুর ফার্ম তৈরি করাও সম্ভব। মিয়ানমারে প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসেন। এরা যাতে বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসেন কিংবা সদূর সুন্দরবনে এদের নিয়ে যাওয়া যায় কী না, আমাদের ট্যুর অপারেটররা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। কুনমিং মুসে-ঘুমধুম সড়ক আমাদের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে বটে, কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সড়ক যোগাযোগের জন্য 'মৈত্রী সড়ক' এর কাজ শুরু হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়। এই সড়কে বেশকটি সেতু নির্মাণ করার কথা, যা কী না বাংলাদেশ তার নিজের অর্থায়নে করবে। কিন্তু ওই 'মৈত্রী সড়ক' এর কোনো খবর আমরা জানি না। অথচ ভারতকে ট্রানজিট দিতে আমরা অনেক রাস্তা সংস্কার করেছি। এমনকি তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতীয় ২৮ চাকার যান চলাচলের সুযোগ আমরা করে দিয়েছি। অথচ 'মৈত্রী সড়ক' দ্রুত সম্পন্ন করার তেমন কোনো উদ্যোগ আমাদের নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রয়োজনে আমরা মিয়ানমারকে গুরুত্ব দেইনি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার 'বিমসটেক' এর সদস্য। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশি পণ্যের বাজারই আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত করবে না, বরং আসিয়ানের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আসিয়ানের 'ডায়লগ পার্টনার' এর মর্যাদা পেতে সাহায্য করবে। বলা ভালো, ভারত ইতিমধ্যে 'ডায়লগ পার্টনার' এর মর্যাদা পেয়েছে। মিয়ানমার আসিয়ানের সভাপতির দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে আগামী বছর। এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের যে 'বদনাম' ছিল, তা ইতিমধ্যে কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। গণতন্ত্রী নেত্রী সুচির সঙ্গে সেইন সেইন প্রশাসনের সম্পর্ক এখন ভালো। সুচি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। জেনারেল সেইনস নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক আগের মতো নেই। মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদের সম্ভাবনা মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে। বলতে বাধা নেই, মিয়ানমার আর আগের অবস্থানে নেই। ওখানে ভারতের ভূমিকা লক্ষ্য করার মতো। ভারত তার জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনেই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এ ক্ষেত্রে সুচির গণতান্ত্রিক আন্দোলন কখনই প্রধান্য পায়নি। ভারত বহির্বিশ্বে সুচির মুক্তির ব্যাপারেও তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তোলেনি। মিয়ানমার সরকারের ওপর কোনো 'প্রেসার'ও সৃষ্টি করেনি। কেননা মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে সুচির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ ভারতের এই 'এপ্রোচ' থেকে শিখতে পারে অনেক কিছু।
ঢাকায় নিযুক্ত নয়া চীনা রাষ্ট্রদূত লি জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন গত ১৯ মার্চ। তিনি বলেছেন, চীন এ অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটি মেনে নেবে না। ক্রমবর্ধমান ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এ অঞ্চলে মার্কিন কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়ছে। মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের আওতাধীন এই অঞ্চল। তথাকথিত 'সন্ত্রাসী কর্মকা-' দমনে এ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মার্কিন সেনার উপস্থিতি রয়েছে, যা দৃশ্যমান নয়। তবে যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন, এ অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাই_ আর তা হচ্ছে, ধীরে ধীরে 'চীনকে ঘিরে ফেলা'। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্রাটেজি স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়কার 'কনটেইনমেন্ট পলিসি'র কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই চীন এ ধরনের কোনো 'চাপ' এর কাছে নতি স্বীকার করবে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কারণে স্বাভাবিকভাবে দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বলয়ে বাংলাদেশ যদি প্রবেশ করে, তাহলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চীন তথা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি 'ফ্রন্ট' গড়ে তোলাই হচ্ছে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মূল উদ্দেশ্য। বিদেশের সংবাদপত্র তথা বস্নগে বাংলাদেশের সম্ভাব্য এই ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ও ওআইসির সম্মেলনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়া, একই সূত্রে গাঁথা। এতে করে বাংলাদেশ লাভবান হবে না। বাংলাদেশের এই ভূমিকা মিয়ানমার খুব ভালো চোখে দেখবে বলে মনে হয় না। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য অবশ্যই একটি সমস্যা। নানা সামাজিক সমস্যা তারা সৃষ্টি করছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) আশাবাদে যৌথভাবে এই সম্মেলন আয়োজন করলেও, অতীতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে ইউএনএইচসিআরের ভূমিকা ইতিবাচক ছিল না। তারা রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। আজো তারা রোহিঙ্গাদের পক্ষে কথা বলছে। বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার জন্য। আমরা তা পারি না। এরা আমাদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের উসকে দিচ্ছে। এদের মাঝে ইসলামিক জঙ্গিরাও রয়েছে। আমরা চাই না বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত রোহিঙ্গাদের কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠুক। এতে করে দুদেশের মাঝে সম্পর্কের অবনতি হতে বাধ্য। আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হতে দিতে পারি না। তাই রোহিঙ্গাদের প্রবেশ করতে না দিয়ে বাংলাদেশ সঠিক কাজটিই করেছে। তবে রোহিঙ্গারা যেহেতু এখনো প্রবেশের চেষ্টা করছে সে কারণে বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করা প্রয়োজন। রোহিঙ্গাদের যাতে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেয়া হয়, এ ব্যাপারেও বাংলাদেশের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।
Daily DESTINY
27.6.12

0 comments:

Post a Comment