রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কী হতে যাচ্ছে ঈদের পর





ঢাকার নয়া পল্টনে ১৮ দলের গণসমাবেশে গত ১১ জন বেগম জিয়া ঘোষণা করেছেন দাবি না মানলে ঈদের পর হরতাল ও অবরোধের কর্মসূচি দেয়া হবে। ১৮ দলের মূল দাবি এখন একটাই আর তা হচ্ছে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করা। কিন্তু সরকারের সম্মতি এতে নেই। সৈয়দ আশরাফ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলছেন বটে, কিন্তু এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি দেননি। এদিকে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন আগামী ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবরের মধ্যে নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করা হবে, আর ২০১৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে নির্বাচন হবে (সমকাল, ১২ জুন)। নির্বাচনের সিডিউল ও তারিখ ঘোষণা করার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী আগাম ঘোষণা কিভাবে দেন, তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল। তবে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, তা হচ্ছে সংবিধানের কথা। বর্তমান সরকার ক্ষমতা ছাড়ার তিন মাস আগেই নির্বাচন দেবে এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন একটি 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই সেই নির্বাচনের আয়োজন করবে। বিএনপির আপত্তি সেখানেই। তাদের ভাষায় এতে নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে না। এতে করে জট খুলবে না। কোনো সংলাপও হবে না। বলতে গেলে এ দেশের সুশীল সমাজের প্রায় সবাই বলছেন একটি সংলাপ হোক, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো দাঁড়া করানো হোক, যারা দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালিত করবে। হিলারি ক্লিনটন বলে গেলেন যে কথা। তার কথার প্রতিধ্বনি করলেন ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত। আর সর্বশেষ গত ৩০ মে তাদের সুরে সুর মেলালেন অ্যালিস্টার বাট, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক মন্ত্রী। বললেন, 'বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আশা করে যুক্তরাজ্য'। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে কথা বললেন না বটে, কিন্তু সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেন। একটি সংলাপ হবে, এমনটাও আশা করলেন তিনি। কিন্তু ঘুরে-ফিরে সেই প্রশ্নই তো ফিরে আসছে সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আমরা নিশ্চিত করবো কিভাবে। সরকার হার্ডলাইনে গেছে। এ কথাটা সরাসরিই বলেন মন্ত্রীরা। এর প্রমাণ তো আমরা পাচ্ছিই। ৫ জন এমপিসহ বিরোধী দলের ৩৩ জন নেতাকর্মীকে জেলে পাঠানো হয়েছিল যে 'অভিযোগের' পরিপ্রেক্ষিতে, সেই 'অভিযোগটি' নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে। অভিযোগটি গুরুতর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সম্মুখে বাসে অগি্নসংযোগ। ৫ জন এমপি ছাড়া পেয়েছেন। বাকিরা ছাড়া পেয়েছেন পরে_ তাদের মধ্যে আছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবও। তার বিরুদ্ধে সচিবালয়ে বোমা নিক্ষেপের ঘটনায় অভিযোগ এনে চার্জশিটও দাখিল করা হয়েছে। ফলে ঝুলে গেছে সংলাপ প্রক্রিয়া। এখন সংলাপ হবে, এই বিশ্বাসটা রাখতে পারছি না। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি মানুষকে উদ্বিগ্ন করেছে। পুলিশ এখন নিয়ন্ত্রণবিহীন। কেউ তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সাংবাদিক পেটানো থেকে শুরু করে আদালতপাড়ায় তরুণীর শ্লীলতাহানি, বিচারক পেটানোর মতো ঘটনা ঘটিয়েছে পুলিশ। হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে এ ঘটনায় ৩ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির হতে নির্দেশও দিয়েছেন। অতীতেও একাধিকবার আদালত পুলিশ কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতির নির্দেশও দিয়েছেন। ভর্ৎসনা করেছেন। তাতে কিছু একটা হয়েছে বলে মনে হয় না। যেখানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে 'সার্টিফিকেট' দেন, যেখানে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী 'সাংবাদিকদের পুলিশের কাছ থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন', যেখানে অত্যন্ত ক্ষমতাবান আওয়ামী লীগের যুগ্ম মহাসচিব 'ষড়যন্ত্র' আবিষ্কার করেন, সেখানে পুলিশ বেপরোয়া হয়ে উঠবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা কী ভুলে গেছি বহির্বিশ্বে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যকলাপ মনিটর করা হচ্ছে। অ্যালিস্টার বার্ট বলে গেলেন তারা র‌্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠায় র‌্যাবকে প্রশিক্ষণ দেয়া বন্ধ করেছেন। লন্ডনের অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও পুশিল হেফাজতে নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচনা করা হয়েছে। আর সাপ্তাহিক ইকোনমিস্টের যে রিপোর্ট তা তো আমাদের জন্য কোনো আশার কথা বলে না। রাজনীতির বাইরেও অর্থনীতির যে সূচক তাতেও তো কোনো ভালো খবর নেই। গড়ভিত্তিক মূল্যস্ফীতি তখন ১০.৮৬ শতাংশ। রপ্তানি আয় বৃদ্ধি আগের অর্থবছরের ৪১.৪৭ শতাংশ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে মাত্র ৮.৪১ শতাংশ। অথচ আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১.২২ শতাংশ। টাকার মান কমেছে। কুইক রেন্টাল নিয়ে 'নানা' কাহিনী। এ 'কাহিনী' সাধারণ মানুষ জানে না। বোঝে না। কিন্তু বোঝে বিদ্যুৎ নেই। বিদ্যুৎ মাঝেমধ্যে আসে মাত্র। এখন শোনা যাচ্ছে সাধারণ মানুষের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুতের দাম আবার বাড়বে। 'কুইক রেন্টাল' নিয়ে সংসদে বিদ্যুৎ উপদেষ্টার সমালোচনা করলেন রাশেদ খান মেনন। আগামী দেড় বছর সরকারের জন্য অনেক কঠিন সময়। একটা সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে পরিস্থিতি যে অসহনীয় হয়ে উঠবে, তা বলার আর আপেক্ষা রাখে না। একটি সমঝোতা এখন কীভাবে সম্ভব? প্রধানমন্ত্রী তথা বর্তমান মন্ত্রিপরিষদকে ক্ষমতায় রেখে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, সেই সরকার বিরোধী দল কেন, কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে যদি ষষ্ঠ সংসদের মতো একটি ঝুঁকি নেয়, তাহলে সরকার ভুল করবে। আমরা আর ইয়াজউদ্দীন মার্কা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরে যাবো না_ এটা ঠিক আছে। কিন্তু সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক না হোক, অন্য কোনো নামে একটি নির্দলীয় সরকার গঠন করতে হবে। বিএনপি যদি নিজেরাই একটা 'ফর্মুলা' দেয়, তাতেও আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে। আর সেটা যে সংসদেই হতে হবে, তার কোনো মানে নেই। বিএনপি চলতি জুনের সংসদে যোগ দিয়ে এই 'ফর্মুলা' উপস্থাপন করতে পারে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দেশের দুটি অবিসংবাদিত শক্তি। দুটো শক্তিই প্রায় সমান সংখ্যক জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে। বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফল এ কথাই প্রমাণ করে। এ ক্ষেত্রে কখনো আওয়ামী লীগ জনসমর্থনে এগিয়ে থাকে। কখনো থাকে বিএনপি। সুতরাং এটা উপলব্ধি করেই একটা সমঝোতা প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ যদি ভালো কাজ করে থাকে, তাহলে জনগণ আবার দলটিকে ক্ষমতায় পাঠাবে। আর জনসমর্থন নিশ্চিত করা না গেলে, 'ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে। গণতন্ত্রে এ কথাটাই শেখায়। সংবিধানের যুক্তি তুলে ধরা হয় বটে, কিন্তু বিশ্ব ইতিহাস বলে সংবিধানের বাইরে গিয়েও সমঝোতা হয়েছে। যেমন কেনিয়া ও জিম্বাবুয়েতে ২০০৮ সালে সরকার ও বিরোধী দল মিলেই সেখানে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনা করে আসছে। আসলে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে আন্তরিকতা। বিএনপি কিংবা আওয়ামী লীগ যদি আন্তরিক হয়, তাহলে সমাধান সম্ভব। হার্ডলাইন কখনো মঙ্গল ডেকে আনে না। দেয়ালের লিখনই তাই বলে। সরকার যেহেতু ক্ষমতায়, তাই উদ্যোগটি তাকেই নিতে হবে। সৈয়দ আশরাফ একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে কথা বলেছেন। তিনি এখন এর কাঠামো তুলে ধরতে পারেন, যা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। কিছুটা ছাড় দেয়ার মানসিকতা তাদের থাকতে হবে। এ ক্ষেত্রে একটি 'এলডার্স কাউন্সিল', সর্বজন গ্রহণযোগ্য একজন বিশিষ্ট নাগরিকের নেতৃত্বে একটি সরকার, সাংবিধানিক পদের অধিকারীদের নিয়ে সরকার কিংবা সরকার ও বিরোধী দলের সমসংখ্যক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সরকার ইত্যাদি নানা ফর্মুলা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আর আলোচনার মধ্য দিয়েই একটি পথ বের হয়ে আসবে। কিন্তু সরকারের হার্ডলাইনে যাওয়ার কারণে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না একটি সমঝোতা আদৌ প্রতিষ্ঠিত হবে কিনা? আর যদি সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে দেশ যে এক গভীর সঙ্কটে পড়বে, তা আর কাউকে বলে দিতে হবে না। বেগম জিয়া ঈদের পরে কর্মসূচি দেবেন। হরতাল, অবরোধ দিয়ে সরকারের পতন হয় না। অতীতেও হয়নি। ১৮ দলের ১১ জুনের গণসমাবেশে সরকার তো নিজেরাই এক রকম 'হরতাল' ডেকে বসেছিল। ঢাকা অভিমুখে কোনো গাড়ি, লঞ্চ আসতে দেয়া হয়নি। কিন্তু তাতে গণসমাবেশ 'বাতিল' হয়নি। লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে গণসমাবেশ সমাপ্ত হয়েছে। এখন সরকার গণসমাবেশের ভাষা যদি বিবেচনায় নেয়, তাহলে একটা সমাধান সম্ভব। দেশ গভীর সঙ্কটে পড়ুক আমরা তা চাই না। জাতির বৃহত্তম স্বার্থেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে একটা সমাধান কাম্য। এ প্রশ্নে 'বিভক্তি' যদি থেকেই যায়, তাহলে তা আমাদের কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে নাDaily JAI JAI DIN18.6.12

0 comments:

Post a Comment