পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, এমনকি সরকার ঘেঁষা অর্থনীতিবিদরা প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক উপদেশ দেননি। বরং প্রকাশ্যে বারবার বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটা ‘বৈরিতা’ তৈরি করেছিলেন। এক্ষেত্রে সাবেক ‘মস্কোপন্থী’ বলে পরিচিত মন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে ‘সুদখোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এটিও উচিত হয়নি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংককে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাÍক চেষ্টা চলছে এ মুহূর্তে। এদিকে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষে এ প্রকল্পের অপর অংশীদার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক হুয়ান মিরান্ডা পদ্মা সেতু নির্মাণে জটিলতা নিরসনের ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের কোন ভাষ্য পাওয়া যায়নি। যারা বিশ্বব্যাংকের নীতিমালা সম্পর্কে কিছুটা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন এ প্রতিষ্ঠান একবার কোন প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে দ্বিতীয়বার আর ওই প্রকল্পে অর্থায়নে এগিয়ে আসে না। দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ২৯ জুন বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে আমাদের মধ্যে একটা ধারণার জš§ হয়েছিল, বিশ্বব্যাংক হয়তো আর এ প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। আমাদের সেই ধারণাই সত্য প্রমাণিত হল। তবে অর্থমন্ত্রী অনেকদিন ধরেই বিশ্বব্যাংকের ‘মান ভাঙানোর’ চেষ্টা করে আসছেন। সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রথমে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে দেয়া এবং পরে পদত্যাগে বাধ্য করা হলেও বিশ্বব্যাংক আর ফিরে আসেনি। এমনকি অর্থ উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমানও পদত্যাগে রাজি ছিলেন। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। আসলে এটা বিশ্বব্যাংকের নীতির প্রশ্ন। এখন দুটো প্রশ্ন আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার কি অতিরিক্ত সুদের ঝুঁকি নিয়ে অন্য দাতা সংস্থার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজে এগিয়ে যাবে? নাকি পদ্মা সেতু প্রকল্পটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করবে? দুই. বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে অন্য যেসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, তার কী হবে?
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক বেশ কিছু প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। মোট ৩৪টি প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্র“ত সাহায্যের পরিমাণ ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মাঝে পদ্মা সেতুতে অর্থ সহায়তার পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার। এখন এ প্রকল্প পরিত্যক্ত। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় অন্যান্য প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়করণে কিছুটা শ্লথগতি আসে। বিদায়ী অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৫০ কোটি ডলার। অথচ বিশ্বব্যাংক প্রতি বছর ১০০ কোটি ডলার করে সহায়তা বাড়ানোর কথা বলেছিল। পদ্মা সেতু ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থাটি হতাশা প্রকাশ করেছে, সেগুলো হচ্ছে ঢাকা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প (১৪৯ মিলিয়ন ডলার, শুরু ২০০৯ সালে), সামাজিক বিনিয়োগ প্রকল্প-২ (১১৫ মিলিয়ন ডলার), উচ্চশিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি প্রকল্প (৮১ মিলিয়ন ডলার), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প, সিদ্ধিরগঞ্জ পিকিং পাওয়ার প্লান্ট, বিশুদ্ধ বায়ু ও টেকসই পরিবেশ প্রকল্প, ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন প্রকল্প, ডিএসবিলিটি অ্যান্ড চিলড্রেন অ্যাট রিক্স প্রকল্প, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প, সোশ্যাল ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদি। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই অর্থ ছাড়করণের পরিমাণ খুবই কম। দুর্নীতি ছাড়াও অদক্ষতা, কাজের শ্লথগতির কারণেও বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ উত্থাপন করেছে। হাইটেক পার্কে চলাচলের সুবিধার জন্য ঢাকা-কালিয়াকৈর শাটল ট্রেনপথ নির্মাণ ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংক ৫৫০ কোটি টাকা দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল। একটি এমওইউ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পেও অর্থায়ন স্থগিত করেছে। এখন কোন প্রকল্পেই বিশ্বব্যাংক অর্থছাড় দিচ্ছে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার ‘লিভারেজিং আইসিটি ফর গ্রোথ, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গভর্নেন্স’ প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার এক মহাপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। এতে করে ৩০ হাজার মানুষকে প্রযুক্তিগত জ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে। এ পরিকল্পনায় সরকারের সঙ্গে ৫০৯ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য দেয়ার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বিশ্বব্যাংক। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এ প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ফেব্র“য়ারি মাসে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা ছিল। এখন জটিলতা তৈরি হওয়ায় প্রকল্পটি ঝুলে গেল। অথচ ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য এ প্রকল্পের খুবই প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই আইসিটি ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বিশ্বে খুব ভালো নয়। ইউএনডিপি বিশ্বব্যাপী আইসিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের র্যাংকিং বা তালিকা করে। এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ নম্বরে। অবস্থান আরও উন্নত করতে হলে ইন্টারনেট কানেকটিভি খুবই দরকার। কিন্তু এই কানেকটিভি কাজে লাগাতে দরকার প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ, যা আমরা ওই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করতে পারতাম। এখন আমরা ওই প্রকল্প নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে গেলাম।
বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিয়ে অনেক কথা আছে। গরিব দেশ বলে বিশ্বব্যাংক বিনা সুদে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য দেয় না। সুদে-আসলে তা তুলে নেয়। বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়েই নিজেরা টিকে আছে। তবে তুলনামূলক বিচারে তাদের সুদের পরিমাণ কম এবং পরিশোধের সময়সীমাও দীর্ঘ। যেমন পদ্মা সেতুতে তাদের সুদের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৭৫ ভাগ। অন্যদিকে মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোন বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে সেতু নির্মিত হলে সুদের হার হবে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। উপরন্তু দীর্ঘসময় তাদের টোল আদায়ের সুযোগ দিতে হবে। আর ঋণের টাকা তুলতে তারা অতিরিক্ত টোল আদায় করবে, যাতে করে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে কথা থাকলেও সহজলভ্যতা ও সুদের হার কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে ১ হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার তারা অর্থায়ন করেছে। এখন পর্যন্ত এ সংস্থার ১ হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে মোট ৩৪টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের মোট ৪৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। যদিও খুব কম ক্ষেত্রে এবং বিশেষ কোন কারণ না থাকলে বিশ্বব্যাংক সাধারণত অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় না। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। এতে করে বাকি প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও সরকারের আচরণের ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে। আমরা যত বেশি বিশ্বব্যাংককে সমালোচনা করব, তত তিক্ততা সৃষ্টি হবে, যা কোন ভালো ফল বয়ে আনবে না।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল হওয়া আমাদের জন্য একটি ‘শিক্ষা’। দুর্নীতির এই অভিযোগ সরকার কিভাবে কাটিয়ে উঠবে, তা ভবিষ্যতের ব্যাপার। তবে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারের উপদেষ্টারা, মন্ত্রীরা, এমনকি সরকার ঘেঁষা অর্থনীতিবিদরা প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক উপদেশ দেননি। বরং প্রকাশ্যে বারবার বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটা ‘বৈরিতা’ তৈরি করেছিলেন। এক্ষেত্রে সাবেক ‘মস্কোপন্থী’ বলে পরিচিত মন্ত্রী ও অর্থনীতিবিদরা ছিলেন সবচেয়ে বেশি সোচ্চার। লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বব্যাংককে ‘সুদখোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। এটিও উচিত হয়নি। সরকারের মেয়াদ আছে মাত্র তের থেকে চৌদ্দ মাস। পদ্মা সেতুর বিষয়টিকে আগামী নির্বাচনে বিরোধী দলের কাছে একটি ইস্যু করে তুলে দেয়া হল। পদ্মা সেতু নির্মাণ ছিল সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা। সরকার সেই ওয়াদা পূরণে ব্যর্থ হল। অতিরিক্ত সুদ নিয়ে এখন পদ্মা সেতু নির্মাণ হবে ঝুঁকিপূর্ণ। শেষ সময়ে এসে সরকার যদি আদৌ কিছু ‘শেখে’ সেটা হবে আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।
Daily JUGANTOR
31.08.12