রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

কেন প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে


সম্প্রতি লন্ডন সফরকালে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। গত ২৭ জুলাই আল জাজিরাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। তিনি এও জানিয়েছেন প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে বসবাস করছে। তাই বাংলাদেশের পক্ষে আরো রোহিঙ্গা শরণার্থীর দায়িত্ব নেয়া সম্ভব নয়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে রোহিঙ্গারা আবার বাংলাদেশে আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ত্বরিৎ সিদ্ধান্তের ফলে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ আর ঘটেনি। এটা নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ওপর একটা চাপও আমরা লক্ষ্য করি। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি দেশই বাংলাদেশ সরকারকে চাপ দিয়ে আসছিল রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করার। কিন্তু সরকার অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই পশ্চিমা চাপ উপেক্ষা করতে পেরেছিল। বাংলাদেশ যদি ওই সময় সঠিক সিদ্ধান্তটি না নিত তাহলে ব্যাপকহারে রোহিঙ্গারা পশ্চিমা প্রপাগান্ডায় বিভ্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করত, যা বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াত। আজ প্রধানমন্ত্রী স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন কেন বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে পারে না। এমনিতেই জনসংখ্যার ভারে বাংলাদেশ আক্রান্ত। প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রচুর লোক এখানে বসবাস করে। সবচেয়ে যা হুমকির তা হচ্ছে রোহিঙ্গারা বৃহত্তর কক্সবাজার অঞ্চলে বনাঞ্চল ধ্বংস করে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয় ঘটিয়েছে। এভাবে পরিবেশ বিপর্যয়কে চলতে দেয়া যায় না। আসলে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের সমস্যার ইতিহাস অনেক পুরনো। মিয়ানমারের ক্ষমতাসীনরা বাহ্যত মিয়ানমারকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। বাস্তব সত্য হচ্ছে মিয়ানমারে শুধু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরাই বসবাস করেন না। এখানে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি কারেন, কাচিন কিংবা শান জাতিও যুগ যুগ ধরে বসবাস করে আসছে, যাদের মধ্যে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাও রয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারের নেতৃত্ব এই দেশটিকে একটি বৌদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে চায়। অথচ পরিসংখ্যান বলে ৬৪ মিলিয়ন জনগোষ্ঠীর এই দেশটিতে প্রায় ১৩৫টি ছোট বড় নৃগোষ্ঠী রয়েছে। বড় এবং প্রভাবশালী নৃগোষ্ঠীরা তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় ও জাতিরাষ্ট্রের দাবিতে সেখানে দীর্ঘদিন যাবত একটি সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করে আসছে। কারেন কিংবা শান জাতি গোষ্ঠীর সশস্ত্র সংগ্রামের খবর পত্রপত্রিকায় ছাপা হলেও রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গারা কোনো সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করছে তেমনটি শোনা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২০১০ সালের এক প্রতিবেদনে 'হরকাত উল জিহাদ-ই-ইসলামী' নামক একটি বাংলাদেশি মৌলবাদী সংগঠনের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল, যারা রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বাংলাদেশ ওই সংগঠনটিকে ২০০৫ সালে নিষিদ্ধ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য সংসদে জামায়াতে ইসলামীর কথা উল্লেখ করেছিলেন, যারা রোহিঙ্গাদের উস্কানি দিচ্ছে বলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ দূতাবাস কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। এ ব্যাপারে আরো তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। একটি বন্ধু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক সংগঠন সশস্ত্র উস্কানি দেবে তা কাম্য হতে পারে না। ইতিহাস বলে রোহিঙ্গারা মূলত আরব বংশোদ্ভূত। একসময় আরব বণিকরা এ অঞ্চলে এসে বসবাস করতে শুরু করে। এদের কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করা যাবে না। প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে। ১৯৭৮ সালে ব্যাপকহারে উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আসতে ও বসবাস করতে বাধ্য হন। পরবর্তী সময়ে ১৯৯১ সালেও দ্বিতীয় দফায় আরো বেশকিছু রোহিঙ্গা কক্সবাজার এলাকায় এসে আশ্রয় নেয়। সরকারিভাবে ২৮ হাজার রোহিঙ্গাদের রেজিস্ট্রিভুক্ত করা হলেও ধারণা করা হচ্ছে প্রায় দুই লাখ অবৈধ রোহিঙ্গা বর্তমানে বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে বসবাস করছে। প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন সরকারের মতো অং সান সুচিও তার দল এনএলডিও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। এনএলডি রোহিঙ্গাদের অভিহিত করেছে 'বাঙালি টেররিস্ট' হিসেবে। আজকে মিয়ানমারের জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে দুদেশের মাঝে সম্পর্কের অবনতি হোক আমরা তা চাই না। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাসী। কিন্তু ভারতের দ্বিপাক্ষিকতার কারণে আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বহুপাক্ষিকতার চরিত্র হারিয়ে ফেলেছি। ফলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি না নেয়ার কারণে। অথচ চীন, থাইল্যান্ড এবং ভারতও এই জ্বালানি সম্পদকে ব্যবহার করছে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে আমাদের সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামাল ভিত্তিক শিল্প কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা থাকলেও আমরা এ ব্যাপারে গত সাড়ে তিন বছরে কোনো উদ্যোগ নিই নি। মিয়ানমার-চট্টগ্রাম সীমান্তে সার কারখানা স্থাপন করে মিয়ানমারের বিপুল সারের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু তা হয়নি। আকিয়াব, মংডুর আশপাশে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এর ভিত্তিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারত- সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে তা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও আমরা উৎসাহিত করিনি। আমরা বেসরকারি উদ্যোগে আফ্রিকাতে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদের উদ্যোগ নিয়েছি। অথচ পাশের দেশে রয়েছে প্রচুর অনাবাদি জমি। মিয়ানমার জমি 'লিজ' দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও, আমাদের নীতি প্রণেতারা বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি। এমনকি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও উৎসাহিত করেননি। অতি সম্প্রতি ভারত থেকে তুলা আমদানি নিয়ে একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ মিয়ানমারের মন্দালয় ম্যাগাওয়ে অঞ্চলে প্রচুর তুলা উৎপন্ন হয়। আমরা কখনো ওই তুলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি ওই অঞ্চলে প্রচুর ভুট্টা চাষ হয়। মিয়ানমারে প্রচুর গবাদি পশু উৎপাদন হয়, যা কিনা আমাদের চাহিদা মেটাতে পারে। যৌথভাবে গবাদি পশুর ফার্ম তৈরি করাও সম্ভব। মিয়ানমারে প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসেন। এরা যাতে বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসেন, কিংবা সদূর সুন্দরবনে এদের নিয়ে যাওয়া যায় কি না, আমাদের ট্যুর অপারেটররা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। কুনমিং-মুসে-ঘুমধুম সড়ক আমাদের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে বটে, কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সড়ক যোগাযোগের জন্য 'মৈত্রী সড়ক'-এর কাজ শুরু হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়। ওই সড়কে বেশ কটি সেতু নির্মাণ করার কথা, যা কি না বাংলাদেশ তার নিজের অর্থায়নে করবে। কিন্তু এই 'মৈত্রী সড়ক' কোনো খবর আমরা জানি না। অথচ ভারতকে ট্রানজিট দিতে আমরা অনেক রাস্তা সংস্কার করেছি। এমনকি তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতীয় ২৮ চাকার যান চলাচলের সুযোগ আমরা করে দিয়েছি। অথচ 'মৈত্রী সড়ক' দ্রুত সম্পন্ন করার তেমন কোনো উদ্যোগ আমাদের নেই। অর্থাৎ বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রয়োজনে আমরা মিয়ানমারকে গুরুত্ব দেইনি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার 'বিমস্টেক'-এর সদস্য। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশি পণ্যের বাজারই আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত করবে না বরং আসিয়ানের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আসিয়ানের 'ডায়লগ পার্টনার'-এর মর্যাদা পেতে সাহায্য করবে। বলা ভালো, ভারত ইতোমধ্যে 'ডায়লগ পার্টনার'-এর মর্যাদা পেয়েছে। মিয়ানমার আসিয়ানের সভাপতির দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে আগামী বছর। এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের যে 'বদনাম' ছিল, তা ইতোমধ্যেই কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। গণতন্ত্রী নেত্রী সুচির সঙ্গে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন্স প্রশাসনের সম্পর্ক এখন ভালো। সুচি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। জেনারেল সেইন্স নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক আগের মতো নেই। মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদের সম্ভাবনা মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে। বলতে বাধা নেই মিয়ানমার আর আগের অবস্থানে নেই। এখানে ভারতের ভূমিকাও লক্ষ্য করার মতো। ভারত তার জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনেই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এ ক্ষেত্রে সুচির গণতান্ত্রিক আন্দোলন কখনই প্রাধান্য পায়নি। ভারত বহির্বিশ্বে সুচির মুক্তির ব্যাপারেও তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তোলেনি। মিয়ানমার সরকারের ওপর কোনো 'প্রেসার' ও সৃষ্টি করেনি। কেননা মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে সুচির চাইতে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ ভারতের এই 'এপ্রোচ' থেকে শিখতে পারে অনেক কিছু। কিন্তু তাই বলে রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে মিয়ানমারের যে নীতি, সেই নীতিকে সমর্থন করতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই, তখন তিনি সত্য কথাটাই বলেন। জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই তিনি এ কথাটা বলেছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি আমাদের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু তাই বলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা মিয়ানমার সরকারের অবস্থান সমর্থন করতে পারি না। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক। এ সমস্যা মিয়ানমার সরকারকেই সমাধান করতে হবে। বাংলাদেশ কোনোভাবে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা অংশ হতে পারে না।Daily JAI JAI DIN07.08.12

0 comments:

Post a Comment