রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রসঙ্গে নানা কথা

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি আছে এখনো তের থেকে চৌদ্দ মাস। সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে এই নির্বাচন হতে হবে। আর বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হবে ২০১৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে। এই হিসাবে ২০১৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে। কিন্তু ইতোমধ্যে নির্বাচন নিয়ে একটি বড় ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে_ নির্বাচন হবে দলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে? সংবিধানে বলা আছে সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের যে তিন মাস সেই তিন মাসই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখানে একটি শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। সংবিধানে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলা হয়েছে, তাতে স্পষ্ট করে বলা হয়নি কারা ওই সরকারে থাকবে। ধারণা করা স্বাভাবিক ওই সময় যারা ক্ষমতায় থাকবে তাদেরকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। অর্থাৎ দলীয় সরকার আর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মধ্যে সংবিধান কোনো পার্থক্য করেনি। সমস্যাটা শুরু হয়েছে সেখান থেকেই। বিরোধী দলের আপত্তি তারা দলীয় সরকার (অর্থাৎ ওই সময়ের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার) কর্তৃক পরিচালিত নির্বাচনে অংশ নেবেন না। তাদের দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের, সংবিধান অনুযায়ী যা এই মুহূর্তে নেই। তাদের যুক্তি ফেলে দেয়া যায় না। দলীয় সরকারের আওতায় যে নির্বাচন সেই নির্বাচন কখনো নিরপেক্ষ হয় না। ক্ষমতাসীন দল সব সময় প্রভাব খাটায়। সুতরাং বিরোধী দলের যুক্তি দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন হলে ওই নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে না। এক্ষেত্রে মহাজোটেরও কেউ কেউ চাচ্ছেন নির্বাচনের নিরপেক্ষতার স্বার্থে একটি 'বিকল্প' সরকারের অধীনে নির্বাচন। সম্ভবত জনমতকে বিবেচনায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রী লন্ডনে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কথা বলেছেন, যেখানে বিএনপি যোগ দিতে পারে। তবে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি দেননি। ইতোমধ্যে বিএনপি সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানও করেছে। প্রধানমন্ত্রী একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এটা নিয়ে আলোচনায় হতে পারত। কিন্তু জট খুললো না। এর আগেই প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের মৃত্যু ঘটল। এরই মাঝে বিএনপির সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমদ গত ১১ আগস্ট জানিয়েছেন বিএনপি নির্দলীয় সরকারের রূপরেখা তৈরি করছে। কিন্তু দলের মহাসচিব পরদিন এর প্রতিবাদ করেছেন। সঙ্গত কারণেই তাই সবার আগ্রহ থাকবে বিএনপির পরিকল্পনা আসলে কী? কিন্তু এ ধরনের একটি পরিকল্পনা যে সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। ফলে বিভক্তি থেকেই গেল। একদিকে দলীয় সরকারের আওতায় নির্বাচন, অন্যদিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার_ এতে সমাধান হবে না। যেখানে মহাজোট সরকারের শরিকরা পর্যন্ত বলছেন একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নির্বাচন পরিচালনার জন্য, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর মনোভাব অনেক জটিলতা তৈরি করছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন বটে, কিন্তু সংবিধানে কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াও একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা সম্ভব। এ জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে সরকারের আন্তরিকতা। দুভাবে সরকার এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারে। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশ করে সেই রায় অনুসরণ করে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা। দুই. সরকার তার আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের স্বার্থে সংবিধানে ষোলতম সংশোধনী আনতে পারে। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ইতোমধ্যে জানা গেছে যে, আপিল বিভাগের যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষিত হয়েছে, সেই রায়টি দীর্ঘ প্রায় এক বছর পর আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। পত্র-পত্রিকা থেকে যতটুকু জানা গেছে, তা হচ্ছে সর্বসম্মতিক্রমে ওই রায়টি হয়নি। রায়টি হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতামতের ভিত্তিতে। এই রায়টি একটি ঐতিহাসিক রায়। এর একাডেমিক ভেল্যুও আছে। সর্বোপরি যারা রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে চর্চার করেন, তাদের কাছে এই রায়টির গুরুত্ব অনেক বেশি। এর যেমনি একাডেমিক ভেল্যু রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের একটি দিকনির্দেশনা। কথা ছিল রায়টি 'ওয়েব সাইটে' দেয়া হবে, অথবা প্রকাশ করা হবে। যাতে করে ঐতিহাসিক ওই রায়টি সম্পর্কে সবাই জানতে পারেন। কিন্তু গেল মার্চে ওই রায়টি জমা পড়লেও তা অদ্যাবধি প্রকাশ করা হয়নি। ফলে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে আগামী দুটো সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় সংসদ। এখানেই সমাধানের বীজ রোপিত। সংসদে যে কেউ সরকারের কোনো মন্ত্রী, মহাজোটের কোনো সংসদ সদস্য, কিংবা একমাত্র নির্দলীয় সংসদ সদস্যও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা সংসদে উপস্থাপন করতে পারেন, যেখানে সরকারি দলীয় সংসদ সদস্যরা তা সমর্থন করবেন। সেখানে সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। মূল কথা আন্তরিকতা ও বিশ্বাস। এটি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই, যা দুঃখজনক এবং একটি সংলাপের সম্ভাবনাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে। সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সংবিধানই চূড়ান্ত নয়। মানুষের জন্যই সংবিধান। মানুষের কল্যাণে সংবিধানে পরিবর্তন আনা যায়। অতীতেও আনা হয়েছে। সমঝোতা ছাড়া কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এককভাবে করা নির্বাচনও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নেবে না। এর ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে একটি বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে বহির্বিশ্বে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (এরশাদের জমানায়) আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে সদ্য গঠিত জাতীয় পার্টি ১৫৩টি আসন পেয়েছিল (শতকরা হার ৪২ দশমিক ৩৪ ভাগ), আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৬টি আসন (২৬ দশমিক ১৫ ভাগ)। বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু ৭ মের (১৯৮৬) ওই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে গঠিত সংসদ তার মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। মজার ব্যাপার ওই নির্বাচনে জামায়াত ১০টি, সিপিবি ৫টি, ন্যাপ (মো.) ২টি, ন্যাপ (ভাসানী) ৫টি, বাকশাল ৩টি, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, মুসলিম লীগ ৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি ও স্বতন্ত্ররা ৩২টি আসন পেয়েছিল। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছিল এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৩ মাসের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিও দেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বয়কটের কারণে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তবে ষষ্ঠ সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা যদি মনে করে থাকেন তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন তাহলে সম্ভবত তারা ভুল করবেন। নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বরং সঙ্কটকে আরো গভীরতর করবে। একটা সমঝোতায় পেঁৗছতেই হবে, যা জাতির জন্য মঙ্গল। আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের মডেল অনুসরণ করে (আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে এনে বিরোধী দলে বসান), তা তারা ভুল করবে। জাতীয় পার্টি এই ট্র্যাপে পা দেবে না বলেই আমার বিশ্বাস। বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন কিংবা সদ্যগঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে বিএনপির 'বিকল্প' হিসেবে তৈরি করা, জাতিকে এক চরম সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সংলাপ হোক। একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হোক। এখনো সময় আছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনীতিতে গোয়ার্তুমির কোনো জায়গা নেই। রাজনীতি হচ্ছে 'এ্যান আর্ট অব কম্প্রোমাইজ'। সেই কমপ্রোমাইজের দিকে প্রধানমন্ত্রী যাবেন সেটাই সবাই প্রত্যাশা করে।Daily JAI JAI DIN
17.08.12

0 comments:

Post a Comment