রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারই কাম্য

 লন্ডনে প্রধানমন্ত্রীর দেয়া বক্তব্যে কোনো জট খুলছে না। লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দেয়ার জন্য বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। অনেকটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে তিনি বলেছিলেন বিএনপি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিতে পারে। যদিও এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা তিনি দেননি। কিন্তু বিএনপি নেত্রী ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। বেগম জিয়া জানিয়ে দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নয়, বরং তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনের বাকি আছে ১৩ থেকে ১৪ মাস। নির্বাচন কমিশন একটি সম্ভাব্য সময়সীমাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অথচ মূল প্রশ্নের এখনও কোনো সমাধান হয়নি। দেশের নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশই চাচ্ছেন একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন, এই নির্বাচনে সরকারের শরিকরাও রাজি নয়। প্রধানমন্ত্রীর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো বিস্তারিত ব্যাখ্যা নেই। বিএনপি কিভাবে যোগ দেবে, কতজন সদস্য থাকবে ওই সরকারে কিংবা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব কে দেবেন, তার বিশদ ব্যাখ্যা নেই। প্রধানমন্ত্রী যদি এটা স্পষ্ট করতেন, তাহলে ওই সরকার নিয়ে বিশদ আলোচনা করা যেতো। কিন্তু তার কোনো সুযোগ নেই। মনে হচ্ছে এটা প্রধানমন্ত্রীর ‘বলার কথা’। তবে প্রধানমন্ত্রী এক জায়গায় ঠিক আছেন আর তা হচ্ছে সংবিধান। সংবিধান সংশোধনের ফলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বলে কিছু নেই। আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এর ব্যাখ্যাও আছে সংবিধানেÑ সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩ মাস আগে যে সরকার থাকবে, সেটাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। অর্থাৎ ২০১৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত এই সরকারের বয়স। ২০১৩ সালের অক্টোবরের পর মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত মহাজোট সরকারই ক্ষমতায় থাকবে এবং তারাই সংবিধান অনুযায়ী চিহ্নিত হবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে। শেখ হাসিনাই এই সরকারের নেতৃত্ব দেবেন। এমপিরা থাকবেন। মন্ত্রীরা থাকবেন বহাল তবিয়তে। বিএনপি তাতে যোগ দেবে, এটা মনে করার আদৌ কোনো কারণ নেই। অন্য দিকে বিএনপি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে, তা সংবিধানে না থাকায়, বিএনপি সংবিধান সংশোধনের দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সরকার এটা মানবে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। আর জটটা লেগেছে এ জায়গাতেই। কেউ আধা ইঞ্চি ছাড় দিতেও রাজি নন। দাতারা বারবার বলছেন একটি সংলাপের কথা। বলছেন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা। কিন্তু সরকার এ দিকটাতে যে খুব আন্তরিক, তা মনে হয় না। এতে করে তো সমাধান হবে না। যেখানে মহাজোট সরকারের শরিকরা পর্যন্ত বলছেন, একটা তত্ত্বাবধায়ক সরকার দরকার নির্বাচন পরিচালনার জন্য, সেখানে প্রধানমন্ত্রীর একগুঁয়েমি  মনোভাব অনেক জটিলতা তৈরি করছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার সাথে সাথে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন বটে, কিন্তু সংবিধানে কোনো ধরনের পরিবর্তন ছাড়াই একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধাযক সরকার গঠন করা সম্ভব। এ জন্য যা দরকার, তা হচ্ছে সরকারের আন্তরিকতা। দুটোভাবে সরকার এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে পারে। এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করা সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের রায় প্রকাশ করে সেই রায় অনুসরণ করে সংসদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা। দুই. সরকার তার আন্তরিকতা ও নিরপেক্ষতা প্রমাণের স্বার্থে সংবিধানে ষোলতম সংশোধনী আনতে পারে। সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে। ইতোমধ্যে জানা গেছে যে, আপিল বিভাগের যে রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল ঘোষিত হয়েছে, সেই রায়টি দীর্ঘ প্রায় এক বছর পর আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। পত্রপত্রিকা থেকে যতটুকু জানা গেছে, তা হচ্ছে সর্বসম্মতিক্রমে ওই রায়টি হয়নি। রায়টি হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকদের মতামতের ভিত্তিতে। এই রায়টি একটি ঐতিহাসিক রায়।  এর একাডেমিক ভেল্যুও আছে। সর্বোপরি যারা রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে চর্চা করেন, তাদের কাছে এই রায়টির গুরুত্ব অনেক বেশি। এর যেমনি একাডেমিক ভেল্যু রয়েছে, ঠিক তেমনি রয়েছে দেশের রাজনৈতিক উন্নয়নের একটি দিকনির্দেশনা। কথা ছিল রায়টি ‘ওয়েব সাইট’-এ দেয়া হবে অথবা প্রকাশ করা হবে, যাতে করে ঐতিহাসিক এই রায়টি সম্পর্কে  সবাই জানতে পারেন। কিন্তু গেল মার্চেই রায়টি জমা পড়লেও, তা অদ্যাবধি প্রকাশ করা হয়নি। ফলে সরকারের সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠছেই। রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে আগামী দুটো সংসদ নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হতে পারে। তবে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে জাতীয় সংসদ। এখানেই সমাধানের বীজ রোপিত। সংসদে যে কেউ, সরকারের কোনো মন্ত্রী মহাজোটের কোনো সংসদ সদস্য, কিংবা একমাত্র নির্দলীয় সংসদ সদস্যও নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা সংসদে উপস্থাপন করতে পারেন, যেখানে সরকারি দলীয় সংসদ সদস্যরা তা সমর্থন করবেন। সেখানে সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। মূল কথা আন্তরিকতা ও বিশ্বাস। এটি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে নেই, যা দুঃখজনক এবং একটি সংলাপের সম্ভাবনাও ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছে।
সাংবিধানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান অত্যন্ত শক্তিশালী, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু সংবিধানই চূড়ান্ত নয়। মানুষের জন্যই সংবিধান। মানুষের কল্যাণে সংবিধান পরিবর্তন আনা যায়। অতীতেও আনা হয়েছে। সমঝোতা ছাড়া কোনো নির্বাচনই গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। এককভাবে করা নির্বাচনও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মেনে নেবে না। এর ফলে বাংলাদেশকে নিয়ে একটি বাজে দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে বহিঃবিশ্বে। বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৮৬ সালে তৃতীয়, ১৯৮৮ সালে চতুর্থ, ১৯৯৬ সালে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু তার আদৌ কোনো গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (এরশাদের জমানায়) আওয়ামী লীগ অংশ নিয়েছিল। ওই নির্বাচনে সদ্য গঠিত জাতীয় পার্টি ১৫৩টি ্আসন পেয়েছিল (শতকরা হার ৪২ দশমিক ৩৪ ভাগ), আর আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৬টি আসন (২৬ দশমিক ১৫ ভাগ) বিএনপি ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। কিন্তু ৭ মের (১৯৮৬) ওই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে গঠিত সংসদ তার মেয়াদ শেষ করতে পারেনি। মজার ব্যাপার ওই নির্বাচনে জামায়াত ১০টি, সিপিবি ৫টি, ন্যাপ (মো.) ২টি, ন্যাপ (ভাসানী) ৫টি, বাকশাল ৩টি, জাসদ (রব) ৪টি, জাসদ (সিরাজ) ৩টি, মুসলিম লীগ ৪টি, ওয়ার্কার্স পার্টি ৩টি ও স্বতন্ত্ররা ৩২টি আসন পেয়েছিল। গণআন্দোলনের মুখে ১৯৮৭ সালের ৬ ডিসেম্বর সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল এবং সংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে ৩ মাসের মধ্যে ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি ও আওয়ামী লীগ ওই নির্বাচন বয়কট করেছিল। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিও দেশে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আওয়ামী লীগের বয়কটের কারণে ওই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তবে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিল পাস হয়েছিল। সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ও তার উপদেষ্টারা যদি মনে করে থাকেন, তারা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচলনা করবেন, তাহলে সম্ভবত তারা ভুল করবেন। নির্বাচন হয়তো হবে। কিন্তু তা গ্রহণযোগ্যতা পাবে না। বরং সঙ্কটকে আরো গভীরতর  করবে। একটা সমঝোতায় পৌঁছতেই হবে, যা জাতির জন্য মঙ্গল। আওয়ামী লীগ যদি ১৯৮৬ সালের মডেল অনুসরণ করে (আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে এনে বিরোধী দলে বসান), তা তারা ভুল করবে। জাতীয় পার্টি এই ট্রাপে পা দেবে না বলেই আমার বিশ্বাস। বিএনপিকে বাদ দিয়ে কোনো নির্বাচন, কিংবা সদ্য গঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টকে বিএনপির ‘বিকল্প’ হিসেবে তৈরি করা, জাতিকে এক চরম সঙ্কটের দিকে ঠেলে দেবে। তাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। সংলাপ হোক। একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের ব্যাপারে একটি সিদ্ধান্ত হোক। এখনও সময় আছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। রাজনীতিতে গোয়ার্তুমির কোনো জায়গা নেই। রাজনীতি হচ্ছে ‘এ্যান আর্ট কমপ্রোমাইজ’। সেই ‘কমপ্রোমাইজের’ দিকে প্রধানমন্ত্রী যাবেন, সেটাই সবাই প্রত্যাশা করে।

0 comments:

Post a Comment