রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

হুদার নয়া দল গঠন প্রসঙ্গে


ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা একটি নতুন দল গঠন করেছেন ১০ আগস্ট। দলটির নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট (বিএনএফ)। তিনি জানিয়েছেন, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়ার আদর্শ অনুসরণ করবেন এবং এ কথাটা তিনি জানাতেও ভোলেননি যে তাঁর দল আগামী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। প্রশ্ন হচ্ছে- বিএনএফ আদৌ কী বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো অবদান রাখতে পারবে? নাকি বিএনপিতে তাঁর ফিরে আসার এটা একটা কৌশলমাত্র! বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন তিনি স্থায়ী কমিটির সদস্য ছিলেন বটে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বিএনপির রাজনীতিতে তিনি কোনো অবদান রাখতে পারেননি। তাঁর দুঃখ ছিল যেহেতু তিনি শহীদ জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করেছেন, সেহেতু বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিও তাঁকে স্থায়ী পরিষদের সদস্য করবে। বেগম জিয়া তা করেননি। এর পেছনে সংগত কারণও ছিল। দলের ভেতরে থেকে তিনি একাধিকবার বিতর্কিত বক্তব্য দিয়েছেন। দল থেকে বহিষ্কৃতও হয়েছেন। আবার ফিরেও এসেছেন। কিন্তু নিজেকে 'বিতর্কিত' রাখতে বোধ করি তিনি পছন্দ করেন বেশি, সে কারণে সব শেষে একটি 'বক্তব্য' দিয়ে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন। ২০০১-২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিতর্কিত বক্তব্য দেওয়ার কারণে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তিনি তখন জানতেন দলের নীতি কী? জানতেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিএনপি কী মনে করে। মন্ত্রিসভায় থেকেও তিনি ওই সময় দলের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছিলেন। ২০১০ সালের ২১ নভেম্বর দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কথা বলার জন্য তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে অবশ্য তাঁর বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করেও নেওয়া হয়েছিল। সবচেয়ে হাস্যস্পদ মন্তব্যটি তিনি করেন গত ২৩ মে। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি দাবি করেছিলেন, ৫ জুনের মধ্যে বেগম জিয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যদি চিঠি না লেখেন, তাহলে তিনি দল থেকে পদত্যাগ করবেন। তিনি কথা রেখেছিলেন এবং পদত্যাগ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত অনেকের মতো একটি দলও গঠন করলেন। অনেক প্রশ্ন এখন তাঁকে ঘিরে। দল গঠন করার উদ্দেশ্য কী? প্রথমত, তিনি যদি মনে করে থাকেন, তিনি বিকল্প একটি 'বিএনপি' গঠন করবেন, তাহলে তিনি ভুল করেছেন। ইতিহাস বলে বিএনপি থেকে যারাই বেড়িয়ে গেছেন, তারা কেউই সুবিধা করতে পারেননি। অধ্যাপক বি. চৌধুরী বিএনপি থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিকল্প ধারা গঠন করেছিলেন। কিন্তু তেমন সুবিধা করতে পারেননি। কর্নেল অলি এলডিপি গঠন করেছেন। সাধারণ মানুষ তাঁকে গ্রহণ করে নিয়েছে, এটা বলা যাবে না। কর্নেল অলি এখন ১৮ দলীয় জোটে। অধ্যাপক চৌধুরী এখনো ফিরে আসেননি বটে। কিন্তু বিএনপির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগটা বেশি। অধ্যাপক চৌধুরী ও কর্নেল অলি দুজনই শহীদ জিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তার পরও তাঁর গড়া দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা দল গঠন করেছিলেন। কিন্তু সাধারণ মানুষ তা গ্রহণ করেনি। গত কয়েক বছরের কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে বিকল্প ধারা কিংবা এলডিপি বিএনপির বিকল্প নয়। ১৮ দলে যোগ দিয়ে কর্নেল অলি যেমনই তাঁর বৃহত্তর চট্টগ্রামের নির্বাচনী আসনটি নিশ্চিত করেছেন, ঠিক তেমনি মাহি চৌধুরী তাঁর মুন্সীগঞ্জের আসনটিও নিশ্চিত করতে পারবেন যদি তাঁর দল ১৮ দলে যোগ দেয় অথবা বিএনপি ওই আসনে কোনো প্রার্থী না দেয়। প্রয়াত মান্নান ভূঁইয়াও বিকল্প একটি জাতীয়তাবাদী ধারা তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। এখন নাজমুল হুদাও যে পারবেন না, তা দিব্যি দিয়েই বলা যায়। হুদা সাহেব তাঁর দলের নাম রেখেছেন 'ফ্রন্ট'। কিন্তু মানুষ নাজমুল হুদা। কোনো দলের নাম কী 'ফ্রন্ট' হতে পারে? রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এটি আমার মাথায় ঢোকে না। তিনি জাতীয়তাবাদী নাম ধারণ করেছেন। বুঝতে কষ্ট হয় না, তাঁর উদ্দেশ্য কী? যদি বিএনপি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেয়, তাহলে তিনি বিএনপির সুবিধাভোগীদের নিয়ে 'বিকল্প একটি বিএনপির নামে নির্বাচনে অংশ নেবেন। অনেকটা ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার শামিল। দ্বিতীয়ত, আকার-ইঙ্গিতে কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন যেকোনো একটি 'বিশেষ মহলের' ইঙ্গিতে হুদা সাহেব এই কাজটি করলেন। তাঁর দলের নামে 'জাতীয়তাবাদী' নাম ধারণ করা ও শহীদ জিয়ার নাম ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য বুঝতে কারো কষ্ট হয় না- জাতীয়তাবাদী ধারার সমর্থকদের আকৃষ্ট করা। জাতি যখন তত্ত্বাবধায়ক ও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত এবং প্রধানমন্ত্রী যখন প্রকাশ্যেই অন্তর্বর্তী সরকারে বিএনপিকে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানান, তখন নাজমুল হুদার জাতীয়তাবাদী ধারার একটি দল গঠনের ঘোষণা, এই 'বিতর্কে' 'ঘি' ঢেলে দেবে মাত্র। তৃতীয়ত, একটি দলের গঠনতন্ত্র থাকে, কর্মসূচি থাকে। বিএনএফের তা কী আছে? লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করলেন হুদা সাহেব। তিনি বললেন বটে, জিয়ার ১৯ দফা তিনি বাস্তবায়ন করবেন, তাহলে তো বিএনপি আর বিএনএফের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। একই আদর্শ নিয়ে দুটি দল থাকে নাকি? হুদা সাহেব কী আমজনতাকে বোকা বানাতে চাচ্ছেন? ২১ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি থাকবে বলে ঘোষণা করলেও ইফতার মাহফিলে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিসর্বস্ব একটি দল নিয়েই যাত্রা শুরু করলেন হুদা সাহেব। চতুর্থত, হুদা সাহেবের ঘোষণা 'বিএনপি, আওয়ামী লীগ রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে ও দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়েছে।' তিনি মন্ত্রী হিসেবে সফল ছিলেন, এটা জানাতেও ভোলেননি। তাঁর কথায় বিএনপি যদি দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ হয়ে থাকে, তাহলে সেই 'ব্যর্থ সরকারে' তিনি 'সফল মন্ত্রী' হন কিভাবে! যোগাযোগমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। রেলের জমি তিনি তাঁর নিয়ন্ত্রিত মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থাকে 'লিজ' হিসেবে দিয়েছিলেন- এটা নিয়ে তো কম বিতর্ক হয়নি। অভিযোগের লিস্টি আরো বড় করা যায়, সেটা এখানে উল্লেখ না-ইবা করলাম। 'সবাই খারাপ', 'নিজে সফল' এ ধরনের বক্তব্য দিয়ে তিনি নিজেকে হাস্যস্পদ করে তুললেন মাত্র। তিনি দলের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে যা যা বললেন, তা মূলত একধরনের 'স্টেটমেন্ট', এটা কোনো কর্মসূচি নয়। কর্মসূচি থাকে ভিন্ন। গঠনতন্ত্রও ভিন্ন হয়। একজন ব্যারিস্টার (আইনজীবী হিসেবে খুব একটা মামলা কী তিনি কখনো পরিচালনা করেছেন!) হিসেবে দলের গঠনতন্ত্র ও দলের কর্মসূচির মধ্যে পার্থক্য কী, তা তাঁর জানার কথা। এখন 'হুট' করেই একটি দল গঠনের ঘোষণা, তাঁকে শুধু বিতর্কিতই করবে না, বরং তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে হাজারটা প্রশ্নের জন্ম দেবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে দলগত ব্যবস্থা, সেখানে দলীয় গণতন্ত্র চর্চার অভাব, স্বচ্ছ ও সৎ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা গণতন্ত্রের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে সন্দেহ নেই তাতে। দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে আলাদা দল গঠন করার নাম গণতন্ত্র নয়। দলের ভেতরে থেকেই দলকে আরো গণমুখী, আরো বেশি গণতন্ত্রীকরণের উদ্যোগ নিতে হবে। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সমাজে এমনটাই আমরা দেখি। ব্রিটেনে, জার্মানিতে কিংবা নরডিকভুক্ত দেশগুলোতে একটি সুস্পষ্ট নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি নিয়ে দলের নেতৃত্ব এগিয়ে যায়। দলের কাউন্সিলে কিংবা নির্বাচনে সেই নীতি যদি পরিত্যক্ত হয় কিংবা সমর্থন না পায়, নেতা নেতৃত্বের আসন থেকে সরে দাঁড়ান; এটাই নিয়ম। এটাই গণতন্ত্র। ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রীদের প্রায় সবাই তাঁদের নীতি ও আদর্শ যখন জনসমর্থন পায়নি, দলের কাউন্সিলে যখন তা অনুমোদিত হয়নি, তখন তাঁরা 'ব্যাক বেঞ্চার এমপি' হয়ে যান, নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়ান। ম্যাগী থ্যাচারের দৃষ্টান্ত অনেকেরই মনে থাকার কথা। আজ হুদা সাহেব তেমনটি করতে পারতেন। তিনি স্পষ্ট করে বিএনপির নীতি ও আদর্শকে আরো জনমুখী করার জন্য কর্মসূচি দিতে পারতেন। তিনি যদি মনে করে থাকেন, বিএনপির রাজনীতিতে 'ভুল' আছে, তখন তিনি দলের ভেতরে থেকে এর প্রতিবাদ করতে পারতেন, বিকল্প কর্মসূচি দিতে পারতেন। তা তিনি করেননি। দলে থেকে তিনি প্রকাশ্যে দাবি করলেন, দলের সভাপতি প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখবেন। এটা তিনি দলীয় ফোরামে আলোচনা করতে পারতেন। একজন আইনের মানুষ হিসেবে তিনি ভালো করে জানেন, এভাবে প্রকাশ্যে দাবি করা যায় না। এটা দলের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থী।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দ্বিদলীয় ব্যবস্থার জন্ম হয়েছে। ১৯৭৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত দেশে ৯টি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে তৃতীয় (১৯৮৬), চতুর্থ (১৯৮৮) ও ষষ্ঠ (১৯৯৬) সংসদ নির্বাচন গ্রহণযোগ্যতা পায়নি শুধু একটি কারণে- আর তা হচ্ছে বিএনপি (তৃতীয় ও চতুর্থ) ও আওয়ামী লীগ (ষষ্ঠ) ওই সব নির্বাচনে অংশ নেয়নি। পরিসংখ্যান বলে, আওয়ামী লীগ ৭৩.২০ শতাংশ (১৯৭৩), ২৭.৩৪ (মালেক ও মিজান গ্রুপ ১৯৭৯), ৩০.০৮ শতাংশ (১৯৯১), ৩৭.৪৪ (১৯৯৬), ৪০.১৩ শতাংশ (২০০১) ও ৪৮.০৬ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছে ৪১.১৭ শতাংশ (১৯৭৯), ৩০.৮১ (১৯৯১), ৩৩.৬১ (১৯৯৬), ৪০.৯৭ (২০০১) ও ৩২.৪৫ শতাংশ ভোট (২০০৮)। প্রাপ্ত ভোটের পরিসংখ্যানই আমাদের বলে দেয় এই দুটি দলের বাইরে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অন্য কোনো দলের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃতীয় কিংবা চতুর্থ একটি ধারা থাকবে, তারা কখনোই মূলধারায় আসতে পারবে না। তবে মূলধারার সহযোগী মিত্র হিসেবে কাজ করবে। আজ তাই নাজমুল হুদার একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম শুধু কাগজে-কলমেই থেকে যাবে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট কোনো বড় আবেদন রাখতে পারবে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।Daily SAKALER KHOBOR28.08.12

0 comments:

Post a Comment