রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অনিশ্চয়তার আবর্তে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্প



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের ওপর আবারও চড়াও হয়েছেন। এবার বললেন, বিশ্বব্যাংক ‘কমিশন খায়’। লন্ডনে দেয়া তার এই বক্তব্য যখন বাংলাদেশের মিডিয়ায় ছাপা হয়েছে, তখন ওয়াশিংটন ডিসিতে অবস্থিত বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরেও তা পৌঁছে যাবার কথা। এখন যে প্রশ্ন অনেকের মতো আমাকেও ভাবিয়ে তুলেছে, তা হচ্ছে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের যে ৩৩টি প্রকল্প রয়েছে,তার এখন কী হবে? বিশ্বব্যাংক যখন পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ওই প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেয়, তখন, সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠবে বাকি প্রকল্পগুলোতে বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির প্রশ্ন তুলবে কী না? কিংবা ওইসব প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দেবে কী না? স্পষ্টতই যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তা কোনো আশার কথা বলে না। সদ্য পদত্যাগকারী মন্ত্রী আবুল হোসেনকে যখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ‘বদলি’ করা হয়, তখন ওই সেক্টরে যে দু’টি প্রকল্পে অর্থায়নের কথা ছিল, বিশ্বব্যাংক জানিয়ে দিয়েছে তারা আর অর্থায়ন করবে না। এতে করে  এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, যেখানে আবুল হোসেন থাকবেন, সেখানে বিশ্বব্যাংক কোনো অর্থায়ন করবে না। শুধু তাই নয়, পুরো সরকারের উপরই অসন্তোষ প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক। ফলে ভবিষ্যতে অর্থ ছাড়ের সম্ভাবনা কম। এখন খোদ সরকার প্রধান যখন প্রকাশ্যেই বিদেশে বসে বিশ্বব্যাংকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তখন বিশ্বব্যাংক বিষয়টি সহজভাবে নেবে, এটা মনে করারও কোনো কারণ নেই।
বিশ্বব্যাংক অনেকগুলো প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দিচ্ছে। মোট ৩৪টি প্রকল্পে তাদের প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ছিল ৫৮০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মাঝে পদ্মা সেতুতে অর্থ সহায়তার পরিমাণ ছিল ১২০ কোটি ডলার। এখন এ প্রকল্প পরিত্যক্ত হলো। পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় বিশ্বব্যাংকের অর্থ ছাড়করণে কিছুটা স্লথ গতি আসে। বিদায়ী অর্থবছরে বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৫০ কোটি ডলার। অথচ বিশ্বব্যাংক প্রতিবছর ১০০ কোটি ডলার করে সহায়তা বাড়ানোর কথা বলেছিল। পদ্মা সেতু ছাড়াও বিশ্বব্যাংকের সাহায্যপুষ্ট যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থাটি হতাশা প্রকাশ করেছে, সেগুলো হচ্ছে ঢাকা পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্প (১৪৯ মিলিয়ন ডলার, শুরু ২০০৯ সালে), সামাজিক বিনিয়োগে প্রকল্প-২ (১১৫ মিলিযন ডলার), উচ্চ শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি প্রকল্প (৮১ মিলিয়ন ডলার), চট্টগ্রাম পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প, সিদ্ধিরগঞ্জ পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট, বিশুদ্ধ বায়ু এবং টেকসই পরিবেশ প্রকল্প, ঘূর্ণিঝড় পুনর্বাসন প্রকল্প, ডিসএবিলিটি অ্যান্ড চিলড্রেন অ্যাক্ট রিক্স প্রকল্প, পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন প্রকল্প, সোস্যাল ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদি। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা গেছে, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অর্থ ছাড়করণের পরিমাণ খুবই কম। দুর্নীতি ছাড়াও অদক্ষতা, কাজের স্লথ গতির কারণেও বিভিন্ন সময়ে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ উত্থাপন করেছে। হাইটেক পার্কে চলাচলের সুবিধার জন্য ঢাকা-কালিয়াকৈর শাটল ট্রেনপথ নির্মাণ ও অবকাঠামোগত  উন্নয়নের জন্য বিশ্বব্যাংকে ৫৫০ কোটি টাকা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। একটি এমওইউও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। কিন্তু পদ্মা সেতুর ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক এ প্রকল্পের অর্থায়ন স্থগিত করেছে। এখন কোনো প্রকল্পেই বিশ্বব্যাংক অর্থ ছাড় দিচ্ছে না। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকার ‘লেভারাইজিং আইসিটি ফর গ্রোথ অ্যামপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড গর্ভনেন্স’ প্রকল্পের আওতায় উপজেলা পর্যায়ে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়ার এক মহাপরিকল্পনা  হাতে নিয়েছিল। এতে করে ৩০ হাজার মানুষকে প্রযুক্তিগত জ্ঞান সম্পন্ন করে গড়ে তোলা হবে। এই পরিকল্পনায় সরকারের সঙ্গে ৫০৯ কোটি টাকার আর্থিক সাহায্য দেয়ার একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বিশ্বব্যাংক। ২০০৭ সালে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে অর্থ সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে এই প্রকল্পের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হবার কথা। এখন জটিলতা তৈরি হওয়ায় এই প্রকল্পটি ঝুলে গেল। অথচ ইন্টারনেট প্রযুক্তিকে জনগণের দোড়গোড়ায় নিয়ে যাবার জন্য এই প্রকল্পের খুবই প্রয়োজন ছিল। এমনিতেই আইসিটি ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান বিশ্বে খুব ভালো নয়। ইউএনডিপি বিশ্বব্যাপী আইসিটি ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের র‌্যাংকিং বা তালিকা করে। এই তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩ নম্বরে। এই তালিকা আরো উন্নত করতে হলে ইন্টারভিউ কানেকটিভিটি খুবই দরকার। কিন্তু এই কানেকটিভিটি কাজে লাগাতে দরকার প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ, যা আমরা ওই প্রকল্পের আওতায় তৈরি করতে পারতাম। এখন আমরা ওই প্রকল্প নিয়ে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে থেকে গেলাম।
বিশ্বব্যাংকের সাহায্য নিয়ে অনেক কথা আছে। গরিব দেশ বলে বিশ্বব্যাংক বিনে সুদে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রায় সাহায্য দেয় না। সুদে-আসলে তা তুলে নেয়। বিশ্বব্যাংক উন্নয়নশীল দেশগুলোকে আর্থিক সাহায্য দিয়েই নিজেরা টিকে আছে। তবে তুলনামূলক বিচারে তাদের সুদের পরিমাণ কম এবং পরিশোধের সময়সীমাও দীর্ঘ। যেমন পদ্মা সেতুতে তাদের সুদের পরিমাণ ছিল শূন্য দশমিক ৭৫ ভাগ। অন্যদিকে মালয়েশিয়া কিংবা অন্য কোনো বাণিজ্যিক ঋণের মাধ্যমে সেতু নির্মিত হলে সুদের হার হবে ৪ থেকে ৫ শতাংশ। উপরন্তু দীর্ঘ সময় তাদেরকে টোল আদায়ের সুযোগ দিতে হবে। আর ঋণের টাকা তুলতে তারা অতিরিক্ত টোল আদায় করবে, যাতে করে সাধারণ মানুষ উপকৃত হবে না। বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে কথা থাকলেও সহজলভ্যতা ও সুদের হার কম হওয়ার কারণে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়। স্বাধীনতার পর থেকে এখনঅব্দি ২৫১টি প্রকল্পের বিপরীতে ১ হাজার ৬৮০ কোটি মার্কিন ডলার তারা অর্থায়ন করেছে। এখন পর্যন্ত এ সংস্থার ১ হাজার ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণ অপরিশোধিত রয়েছে। বর্তমানে মোট ৩৪টি প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের মোট ৪৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে। যদিও খুব কম ক্ষেত্রে এবং বিশেষ কোনো কারণ না থাকলে বিশ্বব্যাংক সাধারণত অর্থায়ন বন্ধ করে দেয় না। পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সাথে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। এতে করে বাকি প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে একটি অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলেও সরকারের আচরণের ওপরই এখন সব কিছু নির্ভর করছে। আমরা যতবেশি বিশ্বব্যাংকের সমালোচনা করবো, তত তিক্ততা সৃষ্টি হবে, যা কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না।

0 comments:

Post a Comment