রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

একজন ইমরান খান ও পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ



তার পুরো নাম ইমরান আহমাদ খান নিয়াজী। জন্ম ১৯৫২ সালের ৫ অক্টোবর। তিনি হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ২০১৮ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ৭১তম স্বাধীনতা দিবসের আগেই তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন এবং তার ভাষায়Ñ ‘এক নতুন পাকিস্তানের তিনি জন্ম দিতে যাচ্ছেন! একজন ইমরান খান ক্রিকেটার ছিলেন। ১৯৮২-৯২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাকিস্তান ক্রিকেট টিমের ক্যাপ্টেন। ১৯৯২ সালে তার নেতৃত্বেই পাকিস্তান ক্রিকেট টিম বিশ্বকাপ জয়লাভ করে। এরপর তিনি সমাজসেবায় নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন এবং ১৯৯৬ সালে গঠন করেন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ, সংক্ষেপে পিটিআই। ২৫ জুলাইয়ের সাধারণ নির্বাচনে তার দল বিজয়ী হয়েছে। যদিও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা তিনি পাননি। একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে (১১৮টি) তার দল বিজয়ী হয়েছে। সরকার গঠন করার জন্য তার দরকার ১৩৭টি আসন। এখন স্বতন্ত্র এবং ছোট ছোট দুই-একটি দলের সমর্থন তিনি পাবেন। এমনকি স্বতন্ত্র সদস্যরা তার দলেও যোগ দিতে পারেন। ফলে সরকার গঠন করা তার জন্য কোনো সমস্যা হবে না।
পাকিস্তানের রাজনীতি বরাবরই নিয়ন্ত্রণ করেছেন ভূস্বামী তথা জমিদাররা, পরে আশির দশকে বড় ব্যবসায়ীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন। সিন্ধুর জমিদার আর পাঞ্জাবের ধনী ব্যবসায়ীদের হাতেই ছিল রাজনীতির চাবিকাঠি। পাকিস্তানি রাজনীতিতে এ পাঞ্জাবি প্রাধান্য সেখানে নানা বিতর্কের সৃষ্টি করেছিল। পাঞ্জাবের রাজনীতিবিদরাই যে শুধু রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন, তেমনটি নয়। এমনকি সেনাবাহিনীও নিয়ন্ত্রণ করত পাঞ্জাবি জেনারেলরা। বর্তমান সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া পাঞ্জাবের জাট পরিবারের সন্তান হলেও তার জন্ম করাচিতে। একজন পাঞ্জাবি জেনারেলকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ সেনাপ্রধান হিসেবে বেছে নিলেও এই সেনাবাহিনীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে তিনি ক্ষমতা হারিয়েছিলেন। সেনাবাহিনীর করপোরেট স্বার্থে তিনি আঘাত করেছিলেন, যা ছিল তার ক্ষমতা হারানোর অন্যতম কারণ। সেদিন পাঞ্জাবি জেনারেল বাজওয়া আরেকজন পাঞ্জাবি প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পক্ষে দাঁড়াননি। পাঞ্জাবি প্রভাবাধীন রাজনীতি ও সেনাবাহিনীর বাইরে ইমরান খান কি শেষ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন? ইমরান খান একজন পাঠান; কিন্তু জন্ম লাহোরে। তার বেড়ে ওঠা পাঞ্জাবেই, লাহোরে। ফলে পাঞ্জাবি এলিটদের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে। অনেক পর্যবেক্ষকই এটা বলার চেষ্টা করছেন যে, দুই পরিবারের (ভুট্টো ও নওয়াজ শরিফ) বাইরে সেনাবাহিনী চেয়েছে এমন একজন ব্যক্তিকে, যার গ্রহণযোগ্যতা আছে, জনপ্রিয়তাও আছে। ইমরান খান এ কারণেই ছিলেন তাদের পছন্দের তালিকায়। পর্দার অন্তরালে থেকেই তাকে সেনাবাহিনী তৈরি করেছিল। একজন প্লে-বয় ইমেজের মানুষ ইমরান খান নিজেকে বদলে ফেলেছিলেন, ইসলামকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছিলেনÑ এসবই তিনি করেছিলেন ‘বিশেষ গোষ্ঠীর’ স্বার্থে। উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ পাকিস্তানি সমাজের উপযোগী করে তাকে তৈরি করা। ধর্ম যে পাকিস্তানের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর, এটা ইমরান খান উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই এক পর্যায়ে তিনি ধর্মীয় নেতা তথা পিরদের শরণাপন্ন হন। এ কথা পাকিস্তানে বহুল প্রচলিত যে, এই ধর্মীয় গুরুরাই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন একজন মহিলা পির বুশরা মানিকাকে বিয়ে করার। পাঁচ সন্তানের জননী বুশরা মানিকা ছিলেন তার ধর্মীয় উপদেষ্টা। এমন কথাও শোনা যায় বুশরা নাকি ইমরান খানকে বলেছিলেন তিনি যদি তাকে বিয়ে করেন তাহলে তিনি অর্থাৎ ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন! এর পেছনে সত্যতা কতটুকু আছে বলা মুশকিল। তবে ২০১৮ সালে তার দলের পক্ষ থেকে এটা স্বীকার করা হয়েছিল যে, ইমরান বুশরা মানিকাকে বিয়ে করেছেন। বুশরার বোরকা পড়া ছবি (সম্ভবত পারিবারিক বিয়ে), যেখানে ইমরানও আছেন, এমন একটি ছবি ইন্টারনেটে খুঁজে পাওয়া যায়। কোনো কোনো সংবাদে আমি এমনটাও দেখেছি যে, ইমরানকে বিয়ে করার জন্যই বুশরা মানিকা তার স্বামীকে তালাক পর্যন্ত দিয়েছিলেন!
ইমরান খানের জীবন কখনোই ধর্মীয় জীবন ছিল না। ১৯৯৫ সালে তিনি একজন ইহুদি ব্যবসায়ীর মেয়ে জেমিমা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেছিলেন। তখন ইমরানের বয়স ৪৩, আর জেমিমার মাত্র ২১। এ বিয়ে টেকেনি। ২০০৪ সালে তাদের বিয়েবিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তিনি বিয়ে করেন ব্রিটিশ পাকিস্তানি সাংবাদিক রেহাম খানকে। এ বিয়েও টেকেনি। রেহাম সম্প্রতি একটি বই লিখেছেন, যেখানে তিনি ইমরান খানের নানা অপকর্ম, বিশেষ করে বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তার একাধিক সন্তান রয়েছে বলেও জানান রেহাম। এরপর তিনি যখন বুশরা মানিকাকে বিয়ে করেন, তখন নানা কথাবার্তা আকাশে-বাতাসে ভাসতে থাকে। ইমরান খানের যে ব্যক্তি ইমেজ, তার সঙ্গে বুশরা মানিকার ব্যক্তি ইমেজ মেলে না। বুশরা একজন পির, তার আসলে মুরিদ আছে, সেই পির ইমরানের স্ত্রী! এটা কোনোভাবেই মেলে না। কিন্তু তার দল পিটিআই যখন এই বিয়ের কথা স্বীকার করে (ডন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮), তখন এ নিয়ে আর প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী একটি ফ্যাক্টর। একই সময় স্বাধীন হওয়া ভারত যখন একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দেয়, সেখানে পাকিস্তানে এই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কখনোই বিকশিত হয়নি। মাঝে মধ্যে একটি নির্বাচিত সরকার একটি আস্থার জায়গা তৈরি করলেও অসাংবিধানিক শক্তিগুলো সবসময়ই পর্দার অন্তরালে থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই অগণতান্ত্রিক শক্তিই ‘ডিপ স্টেট’ হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমরা এর একটি নতুন রূপ দেখলাম মাত্র। ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে, ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ। জিন্নাহ একাধারে ছিলেন গভর্নর জেনারেল, মুসলিম লীগ সভাপতি ও সর্বোপরি জাতির পিতা। গভর্নর জেনারেল হয়েও তিনি মন্ত্রিপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করতেন। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলী খান। স্বাধীনতার পর (১৯৪৭) পাকিস্তানে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রধানমন্ত্রী বাহ্যত কোনো ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারতেন না। জিন্নাহর আমলেই সরকারি কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় ও জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল হন। ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হন এবং গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন গোলাম মোহাম্মদ। তখন থেকেই শুরু হয় ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন সরকারি আমলা ও অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী। ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনকে পদচ্যুত করেন। তিনি গণপরিষদ ভেঙেও দিয়েছিলেন (১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট গঠিত)। বিষয়টি শেষ অবধি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালে, আদালত গোলাম মোহাম্মদের সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠনের পর ইসকান্দার মির্জা হন গভর্নর জেনারেল ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলী হন প্রধানমন্ত্রী। এই ইসকান্দার মির্জাই পাকিস্তানে সামরিক শাসন আনেন। কিন্তু আইয়ুব খানের হাতেই তিন ক্ষমতাচ্যুত হন। তারপরের ইতিহাস তো সেনা শাসকদের ইতিহাস। আইয়ুব খান মৌলিক গণতন্ত্রের জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে গণঅভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন আরেক জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে (১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ)। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিয়েছিলেন বটে; কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে না দেওয়ায় ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গণহত্যা শুরু করায় পাকিস্তান ভেঙে যায়! মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশে গণহত্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাকেও সেনাবাহিনী ফাঁসিতে চড়িয়েছিল। যে জিয়াউল হককে ভুট্টো সেনাপ্রধান করেছিলেন, সেই জিয়াউল হকের ক্ষমতার লোভ তাকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় রেখেছিল ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। এই জিয়াউল হকের সময়ই ব্যবসায়ী নওয়াজ শরিফের আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘রাজনীতিবিদ’ হিসেবে। ১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর পাকিস্তানে কিছুদিনের জন্য হলেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু হয়েছিল (১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৩, ২০১৩ সালের নির্বাচন)। কিন্তু অসাংবাধিক শক্তির কাছে গণতন্ত্র বারবার পরাজিত হয়েছে। বেনজির ভুট্টো কিংবা নওয়াজ শরিফ তিন-তিনবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তারা কেউই পূর্ণ টার্ম শেষ করতে পারেননি। তবে ২০১৩ সালে কিংবা ২০০৮ সালের সরকার তাদের ৫ বছরের ম্যান্ডেট পূরণ করতে পেরেছিল। সেনাশাসক জেনারেল জিয়া নেওয়াজ শরিফকে ‘তৈরি’ করলেও সেই সেনাবাহিনীর করপোরেট স্বার্থের কারণেই ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাবাহিনী কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল ২০১৮ সালে। এবার সমতাচ্যুত হয়েছিলেন বিচার বিভাগ দ্বারা। শরিফ সেনাবাহিনীর কর্পোরেট স্বার্থে আঘাত করেছিলেন। তাই তাকে চলে যেতে হয়েছিল। এটা ইমরান খানের জন্যও একটা ভবিষ্যৎ শিক্ষা বটে। সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ব্যবহার করেছে। তাকে ক্ষমতায় বসাতে যাচ্ছে। একসময় ‘প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে’ ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না সেনাবাহিনী।
এখন ইমরান খানের সরকার গঠনের আগেই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে কেমন হবে নয়া সরকার? কেমন হবে নয়া সরকারের পররাষ্ট্রনীতি? পাকিস্তানের জন্য কয়েকটি বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এক. ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে? এ বিষয়ে ইমরান খান যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন, কাশ্মীর হবে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ভিত্তি! অর্থাৎ তিনি স্পষ্ট করেছেন, কাশ্মীর প্রশ্নে তিনি ভারতকে কোনো ছাড় দেবেন না। এর অর্থ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের ব্যাপারে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হবে না। দুই. আফগানিস্তানে একটি শান্তি প্রক্রিয়া ও তালেবানদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা। সেনাবাহিনী আফগান ইস্যুতে একটি ভূমিকা রাখতে চায়। এই ইস্যুতে ইমরান খান নির্ভরশীল থাকবেন তাদের ওপর। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মনে করে, ভারত আফগান সরকারের ওপর প্রভাব খাটাচ্ছে। ফলে আগামীতে তালেবানদের সঙ্গে আদৌ কোনো আলোচনা হবে কি না, সে প্রশ্ন থাকলোই। এখানে আইএসও একটি ফ্যাক্টর। তিন. যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক কী হবে? অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ইরামন খান একবার বলেছিলেন, পাকিস্তান সীমান্তে প্রবেশ করা যে-কোনো মার্কিন ড্রোন তিনি গুলি করে নামাবেন। তার বিভিন্ন বক্তব্যে একটি মার্কিন বিরোধিতা রয়েছে। ফলে মার্কিন প্রশাসন যে খুব খুশি হবে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। চার. ইমরান বলেছেন, তিনি চীনকে গুরুত্ব দেবেন। চীনের বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে পাকিস্তানে। পাকিস্তান তার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখতে চীনের ওপর পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর পাকিস্তানের জন্য বিশাল সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানের অতিরিক্ত চীনের ওপর নির্ভরশীলতা ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে ভিন্ন মেসেজ দেবে।
এটা স্পষ্ট, ইমরান খান তার পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা ইস্যুতে বেশিমাত্রায় সেনাবাহিনীর ওপর নির্ভরশীল থাকবেন। সেনাবাহিনীর স্বার্থহানি হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত তিনি নেবেন না। এর অর্থ হচ্ছে, আগামী ৫ বছর পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনীই দেশটি চালাবে। একজন রাজনীতিবিদ ইমরান খান সেনাবাহিনীর এই প্রভাব থেকে কতটুকু বেরিয়ে আসতে পারবেন, সেটাই দেখার বিষয়। দুটি বড় দলকে তার আস্থায় নিতে হবে। এখানে আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। সেদিকে কতটুকু তিনি যাবেন, সেদিকেও লক্ষ থাকবে অনেকের। একজন ইমরান খানের ওপর পাকিস্তানের মানুষ আস্থা রেখেছে। তারা পরিবারতন্ত্রের বাইরে গিয়ে একজন সৎ মানুষের ওপর আস্থা রেখেছে। এখন দেখার পালা ইমরান খান সাধারণ মানুষের আস্থার কী প্রতিদান দেন
Daily Alokito Bangladesh
29.07.2018

পাকিস্তানের গণতন্ত্র উর্দিতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ রাজনীতি

কোন পথে যাবে এখন পাকিস্তান? গত ২৬ জুলাই সেখানে একটি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ওই নির্বাচন সেখানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করল না, বরং এক ধরনের ‘উর্দিতন্ত্রের’ জন্ম দিয়েছে, যেখানে এখন পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনী আগামী পাঁচ বছর ক্ষমতা পরিচালনা করবে। একটি সংসদ সেখানে গঠিত হবে বটে; কিন্তু মূল ক্ষমতা থাকবে সংসদের হাতে নয়, বরং শীর্ষস্থানীয় জেনারেলদের হাতে। তাঁরা এমনটাই চেয়েছিলেন। তাঁদের এটা প্রয়োজন ছিল। এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা সফলও হলেন।
পাকিস্তানের এই নির্বাচন নতুন একটি ‘মডেল’ উপহার দিল পাকিস্তানবাসীকে। এত দিন সেনাবাহিনী সরাসরিই ক্ষমতা নিয়েছে। কখনো প্রেসিডেন্টকে ব্যবহার করে নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে, কখনো উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার বাইরে রেখেছে। পাকিস্তানের গত ৭১ বছরের ইতিহাসে একটা দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনী সরাসরি দেশটি শাসন করেছে। কখনো কখনো বিরতি দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে; কিন্তু বেশির ভাগই তাদের নিজ নিজ টার্ম পূরণ করতে পারেনি। নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীরা প্রেসিডেন্ট কর্তৃক কখনো উত্খাত হয়েছেন, কখনো বা সরাসরি সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়েছে। বেনজির ভুট্টো কিংবা নওয়াজ শরিফ বারবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিন-তিনবার জনগণ তাঁদের ভোট দিয়ে সরকার পরিচালনা করার জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু তাঁদের উত্খাত করা হয়েছিল। এমনকি সেনা শাসকরা জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো জনপ্রিয় নেতাদের ফাঁসিতে পর্যন্ত ঝুলিয়েছিল।
সেই স্ট্র্যাটেজিতে এবার কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। এবার সরাসরি ক্ষমতা দখল নয়, বরং এমন একটি দল ও তার নেতাকে তারা সামনে নিয়ে এসেছে, যাঁরা বাহ্যত ‘সিভিলিয়ান’ কিন্তু কার্যত সেনাবাহিনীর প্রতিনিধি, বেসামরিক পোশাকে যাঁরা সেনাবাহিনীর হয়েই কাজ করবেন। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সংসদই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের হয়ে সেখানে আইন প্রণয়ন করেন এবং তা প্রয়োগ করেন। এবার পার্লামেন্ট বা সংসদ এবং একটি ক্যাবিনেট গঠিত হতে যাচ্ছে বটে; কিন্তু রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দপ্তরের হাতে থাকবে মূল ক্ষমতা, যাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়িত হবে সংসদে গৃহীত আইনের মধ্য দিয়ে। এটা উর্দিতন্ত্রের নতুন রূপ। সরাসরি ক্ষমতা গ্রহণ নয়, বরং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের এবং তাঁদের দলকে তাদের স্বার্থে ব্যবহার করা। সরাসরি নয়, বরং পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনীই এখন দেশকে পরিচালনা করবে! ইমরান খান ও তাঁর দল তেহরিক-ই-ইনসাফ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েছে। সেনাবাহিনী তাঁকে ব্যবহার করেছিল অনেক আগে থেকেই। তাঁর একটি ব্যক্তিগত ইমেজ ছিল। ক্রিকেটে পাকিস্তানকে নেতৃত্ব দেওয়া, বিশ্বক্রিকেটে পাকিস্তানকে বিজয়ী করা, মায়ের নামে ক্যান্সার হাসপাতাল করে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা, হঠাৎ করে পশ্চিমা লেবাস ছেড়ে ইসলামপন্থী হয়ে যাওয়া, পীরতন্ত্রের ভক্ত ও একজন পীরানিকে (ধর্মগুরু) বিয়ে করা—সবই ছিল পরিকল্পিত। ইমরান খান সেই ছকে পা দিয়েছিলেন। আর এখন ‘বিজয়ী’ হলেন!
পাকিস্তানের যে রাজনীতির ধারা, তাতে পর্দার অন্তরালে থেকেই সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ বাহ্যত ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের হাতেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন নওয়াজ শরিফ। প্রথমে বিচার বিভাগ তাঁকে চলতি নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করেন এবং পরে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্ট্যাবিলিটি ব্যুরোর মামলায় তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হন। নওয়াজ শরিফ শেষের দিকে তাঁর সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে কন্যা মরিয়মকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। অনেকটা জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক কন্যা বেনজিরকে যেভাবে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে ‘তৈরি’ করেছিলেন, নওয়াজ শরিফও মরিয়মকে সেভাবেই তৈরি করেছিলেন। মরিয়মেরও নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু এবার তিনি তা আর পারলেন না। মুসলিম লীগ এবার তাঁর আসনে নওয়াজের নাতি ও মরিয়মের জ্যেষ্ঠ সন্তানকে মনোনয়ন দিয়েছিল।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিচার বিভাগের ‘সখ্য’ নতুন কিছু নয়। নওয়াজের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্বও অনেক পুরনো। তিন-তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কোনোবারই তিনি টার্ম পূরণ করতে পারেননি। এবারও পারলেন না। তবে এবারের প্রেক্ষাপটটা ছিল কিছুটা ভিন্নতর। নওয়াজের সঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধান ও পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্ট মোশাররফের দ্বন্দ্ব ছিল কাশ্মীর নিয়ে। ১৯৯০ ও ১৯৯৭—দু-দুবারই তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন। পাকিস্তানের অন্যতম ‘রাজনৈতিক শক্তি’ সেনাবাহিনীর কাছে তিনি কখনোই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না। ১৯৯৩ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইসহাক খান তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও পেছনে ছিল সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাপ্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পরিণতিতে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন। ২০১৩ সালের ১১ মের নির্বাচনে মুসলিম লীগ (নওয়াজ) বিজয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। কিন্তু এবারও পর্দার অন্তরালে সেনাবাহিনীই তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তবে সেনাবাহিনী এবার ব্যবহার করে বিচার বিভাগকে। সেনাবাহিনী তাঁকে সরাসরি ক্ষমতাচ্যুত করেনি কিংবা কোনো প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে তিনি ক্ষমতা হারাননি।
পর্দার অন্তরালে থাকলেও এই অসাংবিধানিক শক্তিই মূলত ‘ডিপ স্টেট’ নামে পরিচিত। ‘ডিপ স্টেট’ বলতে বোঝায় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিচার বিভাগের কিছু ব্যক্তি সরকারি নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রচলিত যে রীতিনীতি তার বাইরে গিয়ে সরকারি নীতিতে প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করেন। ‘ডিপ স্টেট’ কোনো একক ব্যক্তি নন, বরং প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি চক্র, যারা নীতি প্রণয়নে ও গ্রহণে প্রভাব খাটায় (২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট শিবিরের বাইরে প্রভাবশালী একটি চক্র সক্রিয় ছিল)। পাকিস্তানে, বিশেষ করে আফগান সংকটের পর থেকেই সেনা আমলা, গোয়েন্দা আমলারা রাজনীতিতে বেশি মাত্রায় প্রভাব খাটাচ্ছেন। আর তাঁদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন বিচার বিভাগের কিছু বিচারপতি। তাঁদের কারণেই শেষ পর্যন্ত নওয়াজ শরিফ ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। তবে তাঁর বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব তিনি কখনো দিতে পারেননি। পানামা কেলেঙ্কারিতে তিনি নিজে ও তাঁর সন্তানরা অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে এবার একটি পার্থক্য লক্ষ করা যায়, আর তা হচ্ছে বিকল্প শক্তি হিসেবে ইমরান খান ও তাঁর দল তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) সামনে নিয়ে আসা। সেনাবাহিনী যে ইমরান খানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছে, এটা ছিল দিবালোকের মতো স্পষ্ট।
পাঠক স্মরণ করতে চেষ্টা করুন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই ইমরান খানের আবির্ভাব ঘটেছে। একজন সাবেক ক্রিকেটার, যিনি নিজে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এবং যৌন কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত, তিনি হঠাৎ করে রাজনীতির মাঠে আবির্ভূত হয়েছিলেন একজন ‘রাজনীতিবিদ’ হিসেবে। ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে তাঁকে তৎপর দেখা যায়। এমনকি ২০১৩ সালে নওয়াজ শরিফের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই পিটিআই ও তাহিরুল কাদরির নেতৃত্বে ইসলামাবাদ ঘেরাও করে সরকার পতনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইমরান খান, যদিও তাতে তিনি সফল হননি। কিন্তু সেনাবাহিনী তখন থেকেই ইমরান খানকে ব্যবহার করে নওয়াজ শরিফ সরকারকে চাপে রেখেছিল। শরিফের অবর্তমানে তাঁর ছোট ভাই শাহবাজ শরিফ মুসলিম লীগকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলটি নির্বাচনে জিতলে তিনি হতেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী! কিন্তু সেনাবাহিনী তা মানেনি। এবং তাই ইমরান খানই হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। একসময়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) জনপ্রিয়তা ছিল। মূলত পিপিপি আর মুসলিম লীগ (নওয়াজ) পাকিস্তানে একটি দ্বি-দলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল। বেনজির ভুট্টোও তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনিও কখনো তাঁর টার্ম পূরণ করতে পারেননি। আত্মঘাতী বোমা হামলায় তাঁর মৃত্যু, স্বামী আসিফ জারদারির দুর্নীতি ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা পিপিপিকে আজ তৃতীয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছে। চলতি নির্বাচনে দলটির আসন বাড়েনি, তৃতীয় অবস্থানে আছে। বেনজিরের জ্যেষ্ঠ সন্তান বিলাওয়াল বর্তমানে পিপিপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বটে; কিন্তু মায়ের মতো ক্যারিসমেটিক নেতৃত্ব তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি। বয়সের কারণে ২০১৩ সালে তিনি প্রার্থী হতে পারেননি। এবার বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু গণজোয়ার তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি। মি. টেন পারসেন্ট হিসেবে ‘খ্যাত’ আসিফ জারদারিও মাঠে আছেন। কিন্তু তাঁর জনপ্রিয়তাও শূন্যের কোঠায়। তবে তিনিও নির্বাচিত হয়েছেন।
ফলে পাকিস্তানের এই নির্বাচন নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। নওয়াজ শরিফ কারাদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়েই মৃত্যুশয্যায় শায়িত স্ত্রীকে লন্ডনে রেখে পাকিস্তানে ফিরে এসে কারাজীবন বেছে নিয়েছেন। এতে তাঁর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু তাঁর দল নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় ভবিষ্যতে নওয়াজ শরিফ আর ক্ষমতা ফিরে পাবেন বলে মনে হয় না। অন্যদিকে পিপিপি সিন্ধু প্রদেশভিত্তিক একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। সর্বপাকিস্তানভিত্তিক দলটির গণভিত্তি নেই। ফলে সেনাবাহিনীর স্ট্র্যাটেজি ছিল একটাই—ইমরান খান। ‘ডিপ স্টেট’ তাঁকেই বেছে নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে একটা কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা তাঁর দলে যোগ দিতে পারেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাব মুসলিম লীগ (নওয়াজ) পেয়েছিল ১২৬ আসন (নির্বাচনী আসন ২৭২), পিপলস পার্টি ৩৩ আর তেহরিক-ই-ইনসাফ ২৮ আসন। ১৭২ আসনের দরকার হয় সরকার গঠন করার জন্য। আঞ্চলিক ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি দল রয়েছে, যারা নওয়াজ শরিফের সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করেছিল। সাধারণত ২৭২ আসনে নির্বাচন হয়। ৭০ আসন রিজার্ভ থাকে মহিলা ও ক্ষুদ্র জাতি-গোষ্ঠীর জন্য। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে এসব আসন বণ্টন করা হয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে পিপিপি পেয়েছিল ১১৯ আসন, মুসলিম লীগ (নওয়াজ) পেয়েছিল ৮৯ আসন আর মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম) পেয়েছিল ৫০ আসন।
এবার মুসলিম লীগের (কায়েদে আজম) বড় পরাজয় ঘটেছে। তার জায়গায় এসেছে ইমরান খানের  তেহরিক-ই-ইনসাফ। একসময় সেনাবাহিনীর দল ছিল ওই মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম)। এখন পিটিআই বা তেহরিক-ই-ইনসাফ তাদের স্বার্থ রক্ষা করছে।
এই নির্বাচন পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করল না। মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ও পিপলস পার্টি এবং সেই সঙ্গে একটি বড় ইসলামী অ্যালায়েন্স (মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল) এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে। ভোট কারচুপির অভিযোগ এনেছেন শাহবাজ শরিফ। কিন্তু এতে নির্বাচনী ফলাফলে কোনো পরিবর্তন আসবে না। তাঁরা সংসদে যাবেন। এর ফলে পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসবে কতটুকু? ইমরান খান বলছেন, তিনি নতুন এক পাকিস্তান গড়বেন! কিন্তু নতুন এই পাকিস্তান কেমন হবে তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। সেনাবাহিনী এখন পর্দার অন্তরালে থেকে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন নওয়াজ শরিফ। সেই সম্পর্ক এখন ‘স্ট্যাটাস কো’ অবস্থায় থাকবে। অর্থাৎ সম্পর্ক যেমন ছিল, তেমনই থাকবে! উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ, বরং অবনতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বেলুচিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে ভারতের সম্পৃক্ততার অভিযোগ(?), চাহবারে (ইরানের সিসতান বেলুচিস্তানে) একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, চাহবার-কাবুল সড়ক নির্মাণ, আফগানিস্তানে ভারতের বড় ভূমিকা (যা ট্রাম্প প্রশাসন চাইছে) ইত্যাদি কারণে পাকিস্তান-ভারত সম্পর্ক উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আফগানিস্তানে শান্তিপ্রক্রিয়া এখন আরো পিছিয়ে গেল। সেখানে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার (আইএসআই) ভূমিকা আরো বাড়বে। অর্থনীতির বেহাল অবস্থার উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। চীনের ওপর নয়া সরকারের নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। তবে ইমরান খানের সঙ্গে জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোর সম্পর্ক (হাক্কানি নেটওয়ার্ক) এখন কোন পর্যায়ে যায়, সেটা দেখার বিষয়। ৯০০ কোটি রুপি খরচ করে যে নির্বাচনটি সম্পন্ন হলো, তা গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে না, বরং আরো উন্নত গণতন্ত্রে উন্নীত হওয়ার সম্ভাবনা পিছিয়ে গেল। পাকিস্তান একজন নয়া প্রধানমন্ত্রী পেতে যাচ্ছে বটে; কিন্তু এতে উত্ফুল্ল হওয়ার কোনো কারণ নেই।
Daily Kalerkontho
29.07.2018

পাকিস্তানে ‘কসমেটিক’ পরিবর্তন!


গত ২৫ জুলাই পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের পর যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হচ্ছে, কোন পথে যাবে এখন দেশটি? যা ধারণা করা হয়েছিল তা-ই হয়েছে। ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন পিটিআই নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বটে; কিন্তু তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। অর্থাৎ এককভাবে তার দল সরকার গঠন করতে পারবে না।
এ নির্বাচন অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এক. ইমরান খানকে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, কে হবেন তার কোয়ালিশন সরকারের পার্টনার? দুই. নির্বাচনে পিটিআই বেশি আসনে বিজয়ী হয়েছে সত্য; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই নির্বাচনে ‘বিজয়ী’ হয়েছে সেনাবাহিনী। তারা যা চেয়েছিল তা-ই হয়েছে। একজন ‘দুর্বল’ প্রধানমন্ত্রী দরকার ছিল তাদের। তারা তা পেতে যাচ্ছে। তিন. ভারত ও আফগানিস্তান প্রশ্নে সাবেক ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ একটি ‘রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের’ দিকে যাচ্ছিলেন, যা সেনাবাহিনীর মনঃপূত হয়নি। ফলে তাকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।
এখন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির এ বিষয়গুলো ‘দেখভাল’ করবে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া ভারতের সঙ্গে কোনো আলোচনা করা যাবে না। সেই সঙ্গে আফগানিস্তানের সঙ্গে সমঝোতার ব্যাপারটিও ঝুলে গেল। চার. এই নির্বাচন প্রমাণ করল মুসলিম লীগ (নওয়াজ) এখনও একটি ‘শক্তি’। দলটির পাকিস্তানব্যাপী একটি জনপ্রিয়তা আছে। তারা (সেই সঙ্গে আরও কয়েকটি দল) ভোটে কারচুপির অভিযোগ করেছে।
কিন্তু দলটি যদি এখন ‘মজলিশ-ই শূরা’য় বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করে, দলটি ভালো করবে। পাঁচ. নওয়াজ ও নওয়াজকন্যা মরিয়মের ‘মুক্তি’ আরও প্রলম্বিত হবে। খুব সহসা তারা জেল থেকে মুক্তি পাবেন বলে মনে হয় না। ছয়. মুসলিম লীগ (নওয়াজ) প্রধান শাহবাজ শরিফ জাতীয় রাজনীতিতে থাকবেন, নাকি পাঞ্জাবের রাজনীতিতে ফিরে যাবেন, তা স্পষ্ট নয়। বড় ভাই নওয়াজ শরিফের মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতা তিনি নন। বিরোধী দলের নেতা হিসেবে যে ভূমিকা পালন করার কথা, তার কাছ থেকে তা প্রত্যাশা করা যায় না। ফলে তিনি হয়তো পাঞ্জাবে ফিরে যাবেন। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ‘দায়িত্ব’ নিতে পারেন। সেক্ষেত্রে মুসলিম লীগকে (নওয়াজ) মজলিশ-ই-শূরায় একজন ‘নেতা’ নির্বাচন করতে হবে, যিনি বিরোধী দলের নেতার ভূমিকা পালন করবেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনী একটি ফ্যাক্টর। একই সময় স্বাধীন হওয়া ভারত যখন একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে, তখন পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কখনই বিকশিত হয়নি। মাঝেমধ্যে নির্বাচিত সরকার একটি আস্থার জায়গা তৈরি করলেও অসাংবিধানিক শক্তিগুলো সবসময়ই পর্দার অন্তরালে থেকে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এ অগণতান্ত্রিক শক্তিই ‘ডিপ স্টেট’ হিসেবে পরিচিত। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আমরা এর একটি নতুন রূপ দেখলাম মাত্র। ইতিহাসের দিকে যদি তাকানো যায়, তাহলে দেখা যাবে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ।
জিন্নাহ একাধারে ছিলেন গভর্নর জেনারেল, মুসলিম লীগ সভাপতি ও সর্বোপরি জাতির পিতা। গভর্নর জেনারেল হয়েও তিনি মন্ত্রিপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করতেন। পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিয়াকত আলী খান। স্বাধীনতার পর (১৯৪৭) পাকিস্তানে মন্ত্রিপরিষদ-শাসিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রধানমন্ত্রী বাহ্যত কোনো ক্ষমতা পরিচালনা করতে পারতেন না। জিন্নাহর আমলেই সরকারি কর্মকর্তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় এবং জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। জিন্নাহর মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্নর জেনারেল হন। ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খানের মৃত্যুর পর খাজা নাজিমুদ্দিন প্রধানমন্ত্রী হন এবং গভর্নর জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত হন গোলাম মোহাম্মদ। তখন থেকেই শুরু হয় ষড়যন্ত্রের রাজনীতি।
গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন সরকারি আমলা ও অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী। ১৯৫৩ সালের এপ্রিলে তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনকে পদচ্যুত করেন। তিনি গণপরিষদ ভেঙেও দিয়েছিলেন (১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট গঠিত)। বিষয়টি শেষ অব্দি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ালে আদালত গোলাম মোহাম্মদের সিদ্ধান্তকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠনের পর ইসকান্দার মির্জা হন গভর্নর জেনারেল এবং চৌধুরী মোহাম্মদ আলী হন প্রধানমন্ত্রী। এই ইসকান্দার মির্জাই পাকিস্তানে সামরিক শাসন আনেন। কিন্তু আইয়ুব খানের হাতেই তিনি ক্ষমতাচ্যুত হন।
এর পরের ইতিহাস তো সেনা শাসকদের ইতিহাস। আইয়ুব খান ‘মৌলিক গণতন্ত্রের’ জন্ম দিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৬৮ সালে গণঅভ্যুত্থানে তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দেন আরেক জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে (১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ)। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে ১৯৭০ সালে নির্বাচন দিয়েছিলেন বটে; কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে না দেয়ায় এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করায় পাকিস্তান ভেঙে যায়। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে।
বাংলাদেশে গণহত্যায় পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তাকেও সেনাবাহিনী ফাঁসিতে চড়িয়েছিল। যে জিয়াউল হককে ভুট্টো সেনাপ্রধান করেছিলেন, সেই জিয়াউল হকের ক্ষমতার লোভ তাকে রাষ্ট্রক্ষমতায় রেখেছিল ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত। এই জিয়াউল হকের সময়েই ব্যবসায়ী নওয়াজ শরিফের আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘রাজনীতিবিদ’ হিসেবে। ১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায় জিয়াউল হকের মৃত্যুর পর পাকিস্তানে কিছুদিনের জন্য হলেও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চালু হয়েছিল (১৯৮৮, ১৯৯০, ১৯৯৩, ২০১৩ সালের নির্বাচন)। কিন্তু অসাংবিধানিক শক্তির কাছে গণতন্ত্র বারবার পরাজিত হয়েছে।
বেনজির ভুট্টো কিংবা নওয়াজ শরিফ তিন তিনবার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হলেও তারা কেউই পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেননি। তবে ২০০৮ ও ২০১৩ সালের সরকার তাদের ৫ বছরের ম্যান্ডেট পূরণ করতে পেরেছিল। সেনাশাসক জেনারেল জিয়া নওয়াজ শরিফকে ‘তৈরি’ করলেও সেই সেনাবাহিনীর কর্পোরেট স্বার্থের কারণেই ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাবাহিনী কর্তৃক তিনি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ২০১৮ সালে। এবার ক্ষমতাচ্যুত হন বিচার বিভাগ দ্বারা।
নওয়াজ শরিফ সেনাবাহিনীর কর্পোরেট স্বার্থে আঘাত করেছিলেন। তাই তাকে চলে যেতে হয়েছিল। এটা ইমরান খানের জন্যও একটি ভবিষ্যৎ শিক্ষা বটে। সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ব্যবহার করেছে। তাকে ক্ষমতায় বসাতে যাচ্ছে। একসময় ‘প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে’ ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না সেনাবাহিনী।
নির্বাচনের যে ফলাফল ঘোষিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় পিটিআই ১১৮, মুসলিম লীগ (নওয়াজ) ৫৯, পিপিপি ৪০, এমএমএ (ইসলামপন্থী অ্যালায়েন্স) ১১, বিএনপি-এম ৫, এমকিউএমপি ৫, জিডিএ ৩ সিট এবং স্বতন্ত্র ১৯ সিট পেয়েছে। পিটিআই, মুসলিম লীগ, পিপিপির শীর্ষ নেতারা একাধিক আসনে বিজয়ী হয়েছেন। এ আসনগুলো তাদের ছেড়ে দিতে হবে। এর ফলে মুসলিম লীগ ও পিপিপিকে বাদ দিয়েও (যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন ইমরান এবং কোনো ধরনের জোট করবেন না বলে জানিয়েছেন) পিটিআইয়ের পক্ষে সরকার গঠন করা সম্ভব। সংবিধানের ৯১(২) ধারা অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট ১৫ আগস্টের আগেই সংসদ অধিবেশন ডাকতে বাধ্য। এ ক্ষেত্রে নতুন সরকার ১৫ আগস্টের আগেই শপথ নেবে, যাতে করে তারা স্বাধীনতা দিবস পালন করতে পারে। সংসদের প্রথম অধিবেশনেই স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হবেন।
ইমরান খান জানিয়েছেন, তিনি ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়তে চান। কিন্তু এই ‘নয়া পাকিস্তান’ কেমন হবে, তার ব্যাখ্যা তিনি দেননি। তবে দায়িত্ব নেয়ার আগে ‘জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে’ তিনি কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, তিনি দরিদ্র ও এতিমদের জন্য দাতব্যমূলক ব্যবস্থা চালু করবেন। এটা নিঃসন্দেহে একটা ভালো দিক। তিনি ‘মদিনা সনদ’ অনুযায়ী সরকার চালাবেন এমন কথাও বলেছেন।
৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২৪ সেপ্টেম্বর ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হজরত মুহম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনা শরিফে এসেছিলেন। ভ্রাতৃত্ববোধ, সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ৪৭ ধারা সংবলিত একটি সনদ প্রণয়ন করেছিলেন, যা মদিনা সনদ নামে পরিচিত। এটা ছিল প্রথম ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি। এখন একুশ শতকে এসে ইমরান খান একধরনের ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। এটা কতটুকু বাস্তবভিত্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তিনি নিজে কতটুকু ইসলামী জীবনাচার মেনে চলেন, তা নিয়েও সন্দেহ আছে অনেকের।
একাধিক নারীসঙ্গ, একাধিক বিয়ে, প্লে-বয়দের মতো জীবনযাপন, একজন ইহুদি নারীকে বিয়ে ও ডিভোর্স ইত্যাদি নানা বিতর্কিত ইস্যু রয়েছে তার জীবনে। তিনি একজন পিরানীকে (নারী পীর) বিয়ে করে পীর সম্প্রদায়ের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সবাই তাকে গ্রহণ করে নেবে, এটা মনে হয় না। সেনাবাহিনী তাকে ‘ইসলামী লেবাসে’ পরিচিত করাতে চাচ্ছে। নারী পীরকে ‘বিয়ে’ করানো সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থারই স্ট্র্যাটেজি।
যেহেতু সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু এবং পাকিস্তানের রাজনীতিতে ধর্ম একটি ফ্যাক্টর, সেজন্যই সেনাবাহিনী চেয়েছে ইমরান খানকে ‘ইসলামী আদলে’ তৈরি করতে। সুতরাং ইমরান খানের মুখ থেকে যে ‘মদিনা সনদের’ কথা বের হবে, এটাই স্বাভাবিক। তার ওই বক্তব্যে একটি ‘শান্ত আফগানিস্তান’, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে কাশ্মীরই প্রধান আলোচ্য বিষয়, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগ আনা ইত্যাদি প্রসঙ্গও এসেছে। খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে এসব মূলত সেনাবাহিনীরই কথা। সেনাবাহিনীই চায় আফগানিস্তানে পাকিস্তান একটি বড় ভূমিকা পালন করুক। ভারত আফগানিস্তানে বড় ভূমিকা পালন করছে, এটা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পছন্দ নয়। আর এ কারণেই আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
পাকিস্তানে একটি ‘কসমেটিক’ পরিবর্তন হয়েছে। ট্র্যাডিশনাল পার্টিগুলোর জন্য এ নির্বাচন কোনো সুসংবাদ বয়ে আনতে পারেনি। তবে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য, একটি গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিনির্মাণের জন্য দুই বড় দল মুসলিম লীগ ও পিপিপির সঙ্গে পিটিআইয়ের একটি আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার। ইমরান খান একজন রাজনীতিক হিসেবে যদি নিজের ‘অবস্থান’ শক্তিশালী করতে চান, তাহলে তাকে সব রাজনৈতিক দলকে আস্থায় নিতে হবে। এর পরিবর্তে শুধু সেনা সদর দফতরের দিকে তাকিয়ে তিনি যদি ক্ষমতা পরিচালনা করতে চান, তাহলে তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে! সেনাবাহিনীর স্বার্থ উদ্ধার হলে তারা ইমরান খানকে ছুড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধাবোধ করবে না। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার একটি বড় পরিবর্তন হয়েছে। তবে এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানে কী ধরনের পরিবর্তন আসে, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
Daily Jugantor
28.07.2018

পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন ও ‘ডিপ স্টেট’ তত্ত্ব


২৫ জুলাই পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু এই নির্বাচন ইতিমধ্যে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। একদিকে এ নির্বাচনকে ঘিরে সন্ত্রাসী তথা আত্মঘাতী হামলা যেমন বেড়েছে, অন্যদিকে একটি ‘সাজানো নির্বাচনের’ সম্ভাবনাও বাড়ছে।
ইতিমধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ ও তার কন্যা মরিয়ম ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরোর মামলায় শাস্তি ভোগ করছেন। লন্ডনে বিলাসবহুল চারটি ফ্ল্যাট ক্রয়ের অর্থের উৎস দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় নওয়াজকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়।
তাছাড়া কন্যা মরিয়মকে সাত ও জামাতা সাফদার আওয়ানকে ১ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। কারাদণ্ড মাথায় নিয়েই নওয়াজ ও মরিয়ম দেশে এসে গ্রেফতার হন।
পাকিস্তানের যে রাজনীতির ধারা, তাতে পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনী ও বিচার বিভাগ কার্যত ক্ষমতা পরিচালনা করে আসছে। শেষ পর্যন্ত এদের হাতেই ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিলেন নওয়াজ শরিফ। প্রথমে বিচার বিভাগ তাকে চলতি নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করে ও পরে ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টিবিলিটি ব্যুরো মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হন।
নওয়াজ শরিফ শেষের দিকে তার সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে কন্যা মরিয়মকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন, অনেকটা জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক কন্যা বেনজিরকে যেভাবে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে ‘তৈরি’ করেছিলেন, নওয়াজ শরিফও মরিয়মকে সেভাবেই তৈরি করেছিলেন।
মরিয়মেরও নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন তিনি তা আর পারছেন না। মুসলিম লীগ এখন তার আসনে নওয়াজের নাতি ও মরিয়মের জ্যেষ্ঠ সন্তানকে মনোনয়ন দিয়েছেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিচার বিভাগের ‘সখ্য’ নতুন কিছু নয়। নওয়াজের সঙ্গে সেনাবাহিনীর দ্বন্দ্বও অনেক পুরনো। তিন তিনবার তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু কোনোবারই তিনি টার্ম পূরণ করতে পারেননি। এবারও পারলেন না। তবে এবারের প্রেক্ষাপট কিছুটা ভিন্নতর।
নওয়াজের সঙ্গে সাবেক সেনাপ্রধান ও পরবর্তী সময়ে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের দ্বন্দ্ব ছিল কাশ্মীর নিয়ে। ১৯৯০ ও ১৯৯৭ দু’দুবারই তিনি নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন।
পাকিস্তানের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি সেনাবাহিনীর কাছে তিনি কখনই গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন না। ১৯৯৩ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইসহাক খান তাকে ক্ষমতাচ্যুত করলেও পেছনে ছিল সেনাবাহিনী। ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সেনাপ্রধানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পরিণতিতে তিনি সামরিক অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন।
২০১৩ সালের ১১ মের নির্বাচনে মুসলিম লীগ (নওয়াজ) বিজয়ী হলে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন। কিন্তু এবারও পর্দার অন্তরালে সেনাবাহিনীই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। তবে সেনাবাহিনী এবার ব্যবহার করে বিচার বিভাগকে। সেনাবাহিনী তাকে সরাসরি ক্ষমতাচ্যুত করেনি কিংবা কোনো প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশে তিনি ক্ষমতা হারাননি।
পর্দার অন্তরালে থাকা এ অসাংবিধানিক শক্তিই মূলত ‘ডিপ স্টেট’ নামে পরিচিত। ‘ডিপ স্টেট’ বলতে বোঝায় ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা, গোয়েন্দা কর্মকর্তা, প্রশাসনিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিচার বিভাগের কিছু ব্যক্তি সরকারি নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় প্রচলিত যে রীতিনীতি, তার বাইরে গিয়ে সরকারি নীতিতে প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করেন।
‘ডিপ স্টেট’ কোনো একক ব্যক্তি নন, বরং প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন ব্যক্তির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি চক্র, যারা নীতি প্রণয়নে ও গ্রহণে প্রভাব খাটায় (২০১৬ সালের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেট শিবিরের বাইরে প্রভাবশালী একটি চক্র সক্রিয় ছিল)।
পাকিস্তানে, বিশেষ করে আফগান সংকটের পর থেকেই সেনা আমলা, গোয়েন্দা আমলারা রাজনীতিতে বেশি ক্ষমতার প্রভাব খাটাচ্ছে। আর এদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছে বিচার বিভাগের কিছু বিচারপতি। এদের কারণেই শেষ পর্যন্ত নওয়াজ শরিফ ক্ষমতাচ্যুত হন। তবে তার বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল, তার কোনো সুস্পষ্ট জবাব তিনি কখনও দিতে পারেননি।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারিতে তিনি নিজে ও তার সন্তানরা অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তবে এবারে একটি পার্থক্য লক্ষ করা যায়- আর তা হচ্ছে বিকল্প শক্তি হিসেবে ইমরান খান ও তার দল তেহরিক-ই-ইনসাফকে (পিটিআই) সামনে নিয়ে আসা। সেনাবাহিনী যে ইমরান খানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইছে, এটা এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট। পাঠক স্মরণ করতে চেষ্টা করুন, পাকিস্তানের রাজনীতিতে হঠাৎ করেই ইমরান খানের আবির্ভাব ঘটেছে।
একজন সাবেক ক্রিকেটার যিনি নিজে নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত এবং যৌন কেলেঙ্কারি থেকে শুরু করে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত, তিনি হঠাৎ করে রাজনীতির মাঠে আবির্ভূত হলেন একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে। ২০১৩ সালের নির্বাচনের আগে তাকে তৎপর দেখা যায়।
এমনকি ২০১৩ সালে নওয়াজ শরিফের ক্ষমতা গ্রহণের পরপর পিটিআই ও কানাডা প্রবাসী ধর্ম প্রচারক তাহিরুল কাদরীর নেতৃত্বে ইসলামাবাদ ঘেরাও করে সরকার পতনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ইমরান খান। যদিও তাতে তিনি সফল হননি। কিন্তু সেনাবাহিনী তখন থেকেই ইমরান খানকে ব্যবহার করে নওয়াজ শরিফ সরকারকে চাপে রেখেছিল।
শরিফের অবর্তমানে তার ছোটভাই শাহবাজ শরিফ মুসলিম লীগকে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। দলটি নির্বাচনে জিতলে তিনি হবেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী! কিন্তু সেনাবাহিনী তা মানবে না। বরং খুব সম্ভবত ইমরান খানই হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী।
একসময় পিপিপির জনপ্রিয়তা ছিল। মূলত পিপিপি আর মুসলিম লীগ (নওয়াজ) পাকিস্তানে একটি দ্বি-দলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্ম দিয়েছিল। বেনজির ভুট্টোও তিন তিনবারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনিও কখনও তার টার্ম পূরণ করতে পারেননি।
আত্মঘাতী বোমা হামলায় তার মৃত্যু, স্বামী আসিফ আলী জারদারির দুর্নীতি ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা পিপিপিকে আজ তৃতীয় অথবা চতুর্থ রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছে। চলতি নির্বাচনে দলটির ক্ষমতা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
বেনজিরের জ্যেষ্ঠ সন্তান বিলাওয়াল বর্তমানে পিপিপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন বটে; কিন্তু মার মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্ব তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি। বয়সের কারণে ২০১৩ সালে তিনি প্রার্থী হতে পারেননি। এবার হয়েছেন। কিন্তু গণজোয়ার তিনি সৃষ্টি করতে পারেননি। ‘মি. টেন পারসেন্ট’ হিসেবে খ্যাত আসিফ আলী জারদারিও মাঠে আছেন। কিন্তু তার জনপ্রিয়তাও শূন্যের কোঠায়।
ফলে পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে একটা প্রশ্ন থাকলই। নওয়াজ শরিফ কারাদণ্ডাদেশ মাথায় নিয়েই মৃত্যুশয্যায় শায়িত স্ত্রীকে লন্ডনে রেখে পাকিস্তানে ফিরে এসে জেল জীবন বেছে নিয়েছেন। এতে করে তার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে, সন্দেহ তাতে নেই।
কিন্তু তার দল নির্বাচনে বিজয়ী হলেও (?) নওয়াজ শরিফ আর ক্ষমতা ফিরে পাবেন বলে মনে হয় না। অন্যদিকে পিপিপি সিন্ধু প্রদেশভিত্তিক একটি আঞ্চলিক দলে পরিণত হয়েছে। সর্ব পাকিস্তানভিত্তিক দলটির গণভিত্তি নেই। ফলে সম্ভাবনা একটাই ইমরান খান।
‘ডিপ স্টেট’ তাকেই বেছে নিয়েছে। এক্ষেত্রে একটা কোয়ালিশন সরকার গঠনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ২০১৩ সালের নির্বাচনের দিকে যদি তাকাই, তাহলে দেখতে পাব মুসলিম লীগ (নওয়াজ) পেয়েছিল ১২৬ আসন (নির্বাচনী আসন ২৭২), পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৩৩, আর তেহরিক ই ইনসাফ ২৮ আসন। ১৭২ আসনের দরকার হয় সরকার গঠন করার জন্য।
আঞ্চলিক ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি দল রয়েছে, যারা নওয়াজ শরিফের সঙ্গে মিলে সরকার গঠন করছিল। সাধারণত ২৭২ আসনে নির্বাচন হয়। ৭০ আসন রিজার্ভ থাকে মহিলা ও ক্ষুদ্রজাতি গোষ্ঠীর জন্য। আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতে এসব আসন বণ্টন করা হয়।
২০০৮ সালের নির্বাচনে পিপিপি পেয়েছিল ১১৯ আসন, মুসলিম লীগ (নওয়াজ) পেয়েছিল ৮৯ আসন, আর মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম) পেয়েছিল ৫০ আসন। এবারে মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম) পিছিয়ে আছে। তার জায়গাতে এসেছে ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ।
পাকিস্তানের নির্বাচনী রাজনীতিতে এই মুহূর্তে ইমরান খান ও তার দল পিটিআই ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও পর্যবেক্ষকরা এ কথাও বলেছেন, যে কোনো একটি দলের পক্ষে হয়তো সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না। তিনটি বড় দলের (পিটিআই, পিপিপি, মুসলিম লীগ-এন) যে কোনো একটিকে একাধিক দলের সঙ্গে কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে করাচিনির্ভর মুত্তাহিদা কওমি ম্যুভমেন্ট (এমকিউএম), মুসলিম লীগ (কায়েদ), গ্রান্ড ডেমোক্রেটিক অ্যালফেস (সিন্ধু), মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল (ধর্মীয় সংগঠনগুলোর অ্যালায়েন্স), আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি (পাখতুনখোয়া), পাখতুনখোয়া মিল্লি আওয়ামী পার্টি, বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি, বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পার্টি একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এগুলো সবই আঞ্চলিক দল, আঞ্চলিক ভিত্তিতে এদের প্রভাব রয়েছে।
প্রতিবারই এ দলগুলো কিছু কিছু আসন পায়, যা তাদের কেন্দ্রে সরকার গঠন করতে সাহায্য করে। যেমন বলা যেতে পারে এমকিউএমের কথা। এমকিউএম মোহাজেরদের সংগঠন। এরা করাচি থেকে বরাবরই ১০ থেকে ১৫টি আসন পেয়ে থাকে। আ
ওয়ামী ন্যাশনাল পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন আসফানদিয়ার ওয়ালি খান, যিনি সীমান্ত গান্ধী হিসেবে পরিচিত আবদুল গাফফার খানের নাতি। তার বাবা ওয়ালি খানও ছিলেন আজকের পাখতুনখোয়া প্রদেশের অন্যতম নেতা। জাতীয় পর্যায়ে এই দলটির ভিত্তি তেমন একটা নেই। মওলানা ফজলুর রেহমানের নেতৃত্বে ইসলামপন্থী কয়েকটি দল একটি ইসলামী ঐক্যজোট করেছে (মুত্তাহিদা মজলিস-ই-আমল)।
এই জোটে রয়েছে ফজলুর রেহমানের জামায়াতে উলেমা ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, তেহরিক ই ইসলাম পাকিস্তান, মারকাজি জামিয়াত আহলে হাদিস ও জামিয়ত উলেমা ইসলামের অপর একটি অংশ। এরা জোটগতভাবেই নির্বাচন করছে। পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাদের খুব একটা প্রভাব না থাকলেও তাদের একটা ছোট অবস্থান আছে।
রাজনীতিতে মূল আকর্ষণ এখন তিনজনকে ঘিরে ইমরান খান, বিলাওয়াল ভুট্টো ও শাহবাজ শরিফ। এই তিনজনই প্রধানমন্ত্রীর মূল দাবিদার। তবে নিঃসন্দেহে এগিয়ে আছেন ইমরান খান। ১৯৯৬ সালে জন্ম দেয়া তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি দীর্ঘ ২২ বছর পর ক্ষমতার স্বাদ পেতে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তার ব্যক্তিগত ইমেজ বা দলীয় ইমেজ যতটুকু না শক্তিশালী, তার চেয়ে বেশি শক্তিশালী হচ্ছে সেনাবাহিনীর সমর্থন।
নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়টি এখন অবশ্য সামনে নিয়ে এসেছেন প্রভাবশালী ইংরেজি দৈনিক ডন পত্রিকার প্রধান নির্বাহী হামিদ হারুন। বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, দেশটির সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনী সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান ও তার দল পিটিআইকে সাহায্য করছে। সেনাবাহিনী এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও অনেক পর্যবেক্ষকই এটা মনে করছেন, ইমরান খান সেনাসমর্থন নিশ্চিত করেছেন। এদিকে শাহবাজ শরিফও সেনাসমর্থন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীকে কাছে টানার চেষ্টা করছেন।
১৯ জুলাই ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আফগানিস্তান ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের মতো পররাষ্ট্রনীতির প্রধান অংশগুলোতে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ করবেন, যদি নির্বাচনে বিজয়ী হন। তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগানোরও উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন। তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি এটা স্পষ্ট করলেন, সেনাবাহিনীই হচ্ছে মূল শক্তি।
সেনাবাহিনীর সমর্থন তার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেনাবাহিনীর সমর্থন তিনি কতটুকু নিশ্চিত করতে পারবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেনাবাহিনী মুসলিম লীগ-(এন)-কে আস্থায় নিতে পারছে না। ভারত ও আফগান ইস্যুতে নওয়াজ শরিফের সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর মনঃপূত ছিল না।
বিশেষ করে মোদির শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরিফের যোগদান এবং সেনাবাহিনকে পাশ কাটিয়ে আফগান সমস্যার সমাধানের উদ্যোগ নেয়া সেনাবাহিনী সমর্থন করেনি। ফলে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। এর বাইরে পিপিপির অবস্থান বড় দুর্বল। এককভাবে সরকার গঠনের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
তবে পিপিপি যদি একটি কোয়ালিশন সরকারে যোগ দেয়, আমি অবাক হব না। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদ আর অর্থনীতির বেহাল অবস্থা। রিজার্ভ নেমে এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯.৫ বিলিয়ন ডলারে। এই অর্থ দিয়ে এক মাসের ‘বিল’ মেটানোও সম্ভব নয়।
পাকিস্তানি রুপির মান পড়ে গেছে (১ ডলারে পাওয়া যায় ১২৮ রুপি)। এক বিলিয়ন ডলারের চীনা সাহায্য অর্থনীতির গতিকে কিছুটা চালু রাখতে পেরেছে সত্য; কিন্তু নয়া সরকারের জন্য এক কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। সন্ত্রাসবাদও বন্ধ করা যায়নি। ফলে পাকিস্তান ২৫ জুলাইয়ের পর নতুন একটি সরকার পাবে সত্য; কিন্তু পাকিস্তানের জন্য বড় অস্থিরতা অপেক্ষা করছে।
Daily Jugantor
23.07.2018

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গ

শেষ পর্যন্ত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বীকার করেছেন যে, ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ হয়েছিল। তার এই বক্তব্য হেলসিঙ্কিতে দেওয়া তার বক্তব্যের ঠিক উল্টো। ১৬ জুলাই হেলসিঙ্কিতে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে যে ঐতিহাসিক বৈঠকটি তিনি করেন, তারপর পুতিনের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২০১৬) রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কোনো কারণ তিনি দেখেন না। অর্থাৎ সরাসরি নাকচ করে দেওয়া। এমনকি পুতিনও সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তার দেশ মার্কিন নির্বাচনে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু ট্রাম্প যখন পুতিনের সুরে কথা বললেন, তখন একটা বড় বিতর্কের জন্ম দেয় যুক্তরাষ্ট্রে। খোদ রিপাবলিকান শিবিরেও তার ওই বক্তব্যের সমালোচনা করা হয়। শুধু তা-ই নয়, এফবিআইও ১২ জন রুশ গোয়েন্দাকে চিহ্নিত করেছে, যারা ওই নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছিল। এরই মধ্যে মারিয়া বুটিনা নামে একজন রুশ গোয়েন্দাকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। বুটিনা ছাত্র ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তবে তার সঙ্গে মস্কোর রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল এবং বুটিনা তাদের পক্ষ হয়ে ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছিলেন। বুটিনার গ্রেপ্তার ও এফবিআই কর্তৃক ১৩ জন গোয়েন্দাকে চিহ্নিত করার পর পুরো দৃশ্যপট বদলে যায়। হেলসিঙ্কি থেকে ওয়াশিংটনে ফিরে আসার পর ট্রাম্প তার বক্তব্যে পরিবর্তন আনেন। এখন তিনি বলছেন, ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যে মতামত দিয়েছে তা তিনি গ্রহণ করেছেন। কেন তিনি এর আগের বক্তব্যে রুশ হস্তক্ষেপ না করার কথা বলেছিলেন, তারও একটি ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমার বাক্যে আমি ‘উড’ শব্দটি ব্যবহার করেছি, যা আসলে ‘উডনট’ হবে। বাক্যটি হওয়া উচিত ছিল ‘আই উন্ট সি এনি রিজন হোয়াই ইট উডনট বি রাশিয়া (আমি এটি রাশিয়া না হওয়ার কোনো কারণ দেখি না)। বাক্যে দুটি নেগেটিভ হবে।’
কিন্তু ট্রাম্পের এই ‘ব্যাখ্যা’ কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে বলা মুশকিল। কেননা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট কোনো শিবিরেই ট্রাম্পের হেলসিঙ্কিতে রাশিয়ার পক্ষে দেওয়া বক্তব্য গ্রহণ করেনি। একান্তে পুতিন ও ট্রাম্প কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন, তারও কোনো ব্যাখ্যা তিনি দেননি। ফলে মার্কিন কংগ্রেস এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওকে তলব করেছেন এর ব্যাখ্যা দিতে। পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলেছেন, ট্রাম্পের আগের বক্তব্যে যদি ভুল থেকে থাকে, তাহলে সে কথা স্বীকার করতে ট্রাম্পের দেড় দিন লাগার কথা নয়। তাছাড়া একবার নয়, একই সংবাদ সম্মেলনে তিনি একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থনের বদলে রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন করেছেন।
স্পষ্টতই ট্রাম্পের এই ‘ইউটার্ন’ তাকে বড় ধরনের বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এতে রুশ-মার্কিন ভবিষ্যৎ সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। যদিও শীর্ষ বৈঠকটির পর পুতিন ও ট্রাম্প যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ‘অতীতকে এক পাশে ঠেলে একত্রে হাঁটার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।’ কিন্তু দুই দেশের মাঝে সম্পর্ক এখন কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সে ব্যাপারে প্রশ্ন আছে অনেক। অনেকগুলো ইস্যু রয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্বার্থ পরস্পরবিরোধী, সে ব্যাপারে দুই নেতা কোনো স্পষ্ট বক্তব্য দেননি। ২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এখন তদন্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে এফবিআইয়ের সাবেক প্রধান রবার্ট মুয়েলাবের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল ১২ রুশ গোয়েন্দ কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে অভিযুক্ত করেছে। এমনকি এসব তদন্তে ট্রাম্প নিজেও জড়িয়ে যেতে পারেন! অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০১৬ সালের নভেম্বরের আগে হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের জন্য রুশ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেটা নিয়ে তখন বিতর্ক কম হয়নি। পুতিনের ব্যাপারে খোদ রিপাবলিকান শিবিরেও বড় আপত্তি রয়েছে। কয়েকজন রিপাবলিকান সিনেটর এই বৈঠকটি বাতিলেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন। যদিও সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প ও পুতিন দুজনই স্বীকার করেছেন যে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো ধরনের রুশ হস্তক্ষেপ হয়নি। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদন যদি সত্যি হয়, তাহলে এই শীর্ষ বৈঠক আদৌ কোনো ফল বয়ে আনবে না। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার ব্যাপারে ট্রাম্পের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কেননা পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে তিনি ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জার্মানি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জার্মানি পুরোপুরিভাবে রাশিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জার্মানি রাশিয়ার গ্যাস ক্রয় করে রাশিয়াকে ধনী দেশে পরিণত করছে। এর পরপরই তিনি পুতিনের সঙ্গে দেখা করে পুতিনের প্রশংসা করলেন। ট্রাম্প তার ইউরোপ সফরে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। ন্যাটোর প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি স্নায়ুযুদ্ধকালীন ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। ফলে পুতিনের সঙ্গে তার বৈঠকটি নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
এটা অনেকেই স্বীকার করেন যে, পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতির কারণে এই দুই বৃহৎ শক্তির মাঝে ন্যূনতম একধরনের ‘সমঝোতা’ প্রয়োজন। এই ‘সমঝোতা’ যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে বিশ্বে উত্তেজনা বাড়বে বৈ কমবে না। প্রথমত, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করার পরিপ্রেক্ষিতে ট্রাম্পের সঙ্গে চীনসহ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর একধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধ’ শুরু হয়েছে। এমনকি কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গেও একধরনের বিবাদে জড়িয়ে গেছেন তিনি। সর্বশেষ জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শিল্পোন্নত অন্য দেশগুলোর বিরোধ আমরা লক্ষ করেছি। এক্ষেত্রে রাশিয়ার সহযোগিতা তার প্রয়োজন। রাশিয়া বড় অর্থনীতির দেশ নয়; কিন্তু তারপরও রাশিয়া একটি ‘শক্তি’। রাশিয়ার সঙ্গে যে-কোনো ‘সমঝোতা’ ট্রাম্পকে তার একাকিত্ব অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসতে সাহায্য করবে। দ্বিতীয়ত, সিরীয় সংকট। এটা সবাই জানেন, রাশিয়ার বিমান হামলার পরপরই সিরিয়ার পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যায়। আইএসের সেখানে পতন ঘটে। যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলার পরও সেখানে আইএসের অস্তিত্ব ছিল। কিন্তু সিরিয়ায় রুশ বিমান হামলার পর আইএস তাদের তথাকথিত ‘জিহাদি রাষ্ট্র’ এর রাজধানী রাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। কিন্তু তাই বলে সিরিয়ার সংকটে সমাধান হয়েছে, এটা বলা যাবে না। আসাদবিরোধী কিছু কিছু ইসলামিক জঙ্গি সেখানে এখনও তৎপর। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক সমাধানের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। সিরিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সেখানে একটি ‘রাজনৈতিক অর্ডার’ প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে সমঝোতা প্রয়োজন। না হলে সিরিয়ায় সংকট থেকে যাবে। রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হলে এক পর্যায়ে ইরানও নিউট্রাল হয়ে যাবে। সিরিয়ায় রাজনৈতিক সংকট সমাধানের যে-কোনো উদ্যোগে ইরানকে সম্পৃক্ত করাও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে রাশিয়াকে আস্থায় নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তৃতীয়ত, রাশিয়া কর্তৃক ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের পর ইউক্রেনে যে সংকটের জন্ম হয়েছিল, তা আজও রয়ে গেছে। পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার মদদে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছে। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা এখানে ‘ক্রিমিয়া মডেল’ অনুসরণ করতে চায়। অর্থাৎ এখানে গণভোট হবে, আর তাতে মানুষ রাশিয়ার পক্ষে সংযুক্তির পক্ষে রায় দেবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তি রয়েছে সেখানে। ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে একধরনের ‘ছায়াযুদ্ধ’ চলছে। অনেকেই এটা জানেন, যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিক। ইউক্রেন (এমনকি জর্জিয়াও) যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তাহলে সেখানে ন্যাটোর তথা যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য মোতায়েন করা হবে। তখন রাশিয়া থাকবে একধরনের স্নায়ুবিক চাপে। ন্যাটোর পূর্বমুখী যে সম্প্রসারণ, তাতে ইউক্রেনের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া ইউক্রেনের ন্যাটোর অন্তর্ভুক্তি কখনও মেনে নেবে না। ফলে ইউক্রেন নিয়ে সংকট থেকে যাচ্ছে। ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়াকে আস্থায় নিতে হবে। চতুর্থত, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক সমঝোতা বাতিল করেছেন। এর মধ্য দিয়ে ইরানকে পারমাণবিক শক্তি অর্জনের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তটি ছিল ভুল। এতে বিশ্বে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা বাড়বে বৈ কমবে না।
রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুটি দেশ। দেশ দুটির মাঝে আস্থার সম্পর্ক থাকা দরকার। ইতিহাস বলে অতীতে যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি স্থিতিশীল বিশ্ব উপহার দেওয়ার জন্য বারবার বৈঠক করেছে। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা কমিয়ে আনার জন্য একাধিক চুক্তির স্বাক্ষর করেছে দেশ দুটি। দুই দেশের মাঝে ১৯৪৩ সালের বৈঠকটি ছিল প্রথম। ওই বছরের নভেম্বরে ইরানের তেহরানে বৈঠক করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট, সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিন ও যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল। ওই বৈঠকে হিটলারের বিরুদ্ধে মিত্র জোটের প্রতিনিধিরা একত্রিত হয়েছিলেন। এরপর ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্রিমিয়ার ইয়াল্টায় আবার তারা একত্রিত হয়েছিলেন। এবার রুজভেল্টের বদলে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড স্টেটিনিয়াস। ওই বৈঠকে মুক্ত ইউরোপ ঘোষণায় তারা স্বাক্ষর করেছিলেন। ১৯৪৫ সালের ২ আগস্ট তৃতীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ও সোভিয়েত নেতা স্ট্যালিনের মাঝে। কিন্তু ওই ‘সমঝোতা’ টিকে থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এক ধরনের প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিতে লিপ্ত হয়। একদিকে পশ্চিম ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বাজার অর্থনীতি নির্ভর গণতন্ত্র বিকশিত হয়, অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতন্ত্রের বিকাশ ঘটে। দীর্ঘ ৪৬ বছর এ ‘প্রতিযোগিতা’ বজায় ছিল। এক্ষেত্রে গরবাচেভ সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ক্ষমতায় এসে ১৯৮৮ সালে ওয়ারশ’ সামরিক জোট ভেঙে দিয়েছিলেন সমাজতন্ত্রের প্রসার তথা রক্ষার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ওয়ারশ’ সামরিক জোট গঠিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯১১ সালের ডিসেম্বরে সমাজতন্ত্রের পতন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলেও ন্যাটোর কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়নি। বরং পূর্ব ইউরোপের অনেক দেশ এখন ন্যাটোর সদস্য ও ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ ঘটেছে। ফলে আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল সেখান থেকেই। গেল ১৬ জুলাই ট্রাম্প প্রথমবারের মতো পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ বৈঠকটি সারা বিশ্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের অ্যাপ্রোচে ভুল ছিল। ট্রাম্প ভুলে গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’ কত শক্তিশালী। এই ‘ডিপ স্টেট’ মূলত সাংবিধানিক শক্তির বাইরে গিয়ে (কংগ্রেস, প্রেসিডেন্সি) আলাদাভাবে প্রশাসনে প্রভাব খাটায়। তারা সিদ্ধান্ত নেয়। অনেক সময় প্রেসিডেন্ট তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। দেখা গেল, ট্রাম্প যখন পুতিনের পক্ষাবলম্বন করে হেলসিঙ্কিতে বক্তব্য রাখলেন, তখন ‘ডিপ স্টেট’ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে তো রিপোর্ট ছিলই যে, নির্বাচনে একটা হস্তক্ষেপ ছিল! ওই সময় মার্কিনি পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে সংবাদও ছাপা হয়েছিল। ওই সময়ও ট্রাম্প এই অভিযোগ নাকচ করেছিলেন। ওই সময় এমন সংবাদও পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছিল যে, পুতিন চাচ্ছেন ট্রাম্প ক্ষমতায় আসুক। এর পেছনে যুক্তি ছিল যে, রাশিয়ায় ট্রাম্পের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। ব্যবসায়ী মানুষ ট্রাম্প। তিনি জানেন কীভাবে নিজের স্বার্থ আদায় করে নিতে হয়।
তবে ট্রাম্প বিতর্কিত হয়েছেন আরও একটি কারণে। তিনি মিথ্যা কথা বলেন। গেল ৪৬৬ দিনে ট্রাম্প ৩ হাজারবার মিথ্যা কথা বলেছেন। (সিএনএন, ৯ মে ২০১৮)। একজন প্রেসিডেন্টকে নিয়ে এ ধরনের কথাবার্তা শোভন নয় এবং প্রেসিডেন্টের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকে। এখন ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাশিয়ার হস্তক্ষেপের বিষয়টি সামনে আনল এফবিআই। ধারণা করছি, গোয়েন্দা সংস্থার জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে পারেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের জন্য খুব সুখের হবে না।
Daily Alokito Bangladesh
22.07.2018

রুশ-মার্কিন সম্পর্ক কোন পথে

গত ১৬ জুলাই হেলসিংকিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের ঐতিহাসিক বৈঠকটির পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে রুশ-মার্কিন সম্পর্ক এখন কোন পথে? যদিও শীর্ষ বৈঠকটির পর পুতিন ও ট্রাম্প যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অতীতকে এক পাশে ঠেলে একত্রে হাঁটার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন; কিন্তু দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সে ব্যাপারে প্রশ্ন আছে অনেক। অনেক ইস্যু রয়েছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার স্বার্থ পরস্পরবিরোধী, সে ব্যাপারে দুই নেতা কোনো স্পষ্ট বক্তব্য দেননি।
২০১৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুশ হস্তক্ষেপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এখন তদন্ত হচ্ছে। এরই মধ্যে এফবিআইয়ের সাবেক প্রধান রবার্ট মুলারের নেতৃত্বে একটি তদন্তদল ১২ জন রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে এ ব্যাপারে অভিযুক্ত করেছে। এমনকি এসব তদন্তে ট্রাম্প নিজেও জড়িয়ে যেতে পারেন। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, ২০১৬ সালের নভেম্বরের আগে হিলারি ক্লিনটনের বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের জন্য রুশ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছিলেন ট্রাম্প। সেটা নিয়ে এখন বিতর্ক কম হয়নি। পুতিনের ব্যাপারে খোদ রিপাবলিকান শিবিরেও বড় আপত্তি রয়েছে। কয়েকজন রিপাবলিকান সিনেটর বৈঠকটি বাতিলেরও আহ্বান জানিয়েছিলেন। যদিও সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প ও পুতিন দুজনই স্বীকার করেছেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো ধরনের রুশ হস্তক্ষেপ হয়নি। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রতিবেদন যদি সত্য হয়, তাহলে এই শীর্ষ বৈঠক আদৌ কোনো ফল বয়ে আনবে না। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার ব্যাপারে ট্রাম্পের আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন আছে। কেননা পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের আগে তিনি ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জার্মানি সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, জার্মানি পুরোপুরিভাবে রাশিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। জার্মানি রাশিয়ার গ্যাস ক্রয় করে রাশিয়াকে ধনী দেশে পরিণত করছে। এর পরপরই তিনি পুতিনের সঙ্গে দেখা করে তাঁর প্রশংসা করলেন। ট্রাম্প তাঁর ইউরোপ সফরে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন। ন্যাটোর প্রতিরক্ষা বাজেট বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে তিনি স্নায়ুযুদ্ধকালীন অবস্থায় ফিরে যাওয়ার উদ্যোগ নিচ্ছেন। ফলে পুতিনের সঙ্গে তাঁর বৈঠকটি নিয়ে প্রশ্ন থাকবেই।
শুধু প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়ানোই নয়, বরং ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এক ধরনের বিবাদে জড়িয়ে গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক পণ্যের ওপর (ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি) যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। এটা নিয়ে এক ধরনের বিবাদ এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে ইউরোপে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর এই সফরে ব্রিটেনেও গিয়েছিলেন। ব্রিটেনে তিনি বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়েছিলেন। তাঁর বাণিজ্যনীতি, অভিবাসননীতি তাঁকে ব্রিটেনে বিতর্কিত করছে। অনেকের মনে থাকার কথা, বেশ কিছুদিন আগে লন্ডনের মেয়র সাদিক খান ঘোষণা করেছিলেন, ট্রাম্প লন্ডনে অনাকাঙ্ক্ষিত। সাদিক খানের এই বক্তব্যের জন্য কি না জানি না, লন্ডনে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে ট্রাম্পের এই ইউরোপীয় সফরের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল প্রথমবারের মতো পুতিনের সঙ্গে তাঁর শীর্ষ বৈঠক। এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে ছিল সারা বিশ্ব। সিঙ্গাপুরে কিম জং উনের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের পর হেলসিংকি বৈঠকটি (ট্রাম্প-পুতিন) যেকোনো বিবেচনায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বিভিন্ন ইস্যুতে দেশ দুটি পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২০১৬) রাশিয়ার পরোক্ষ হস্তক্ষেপ, সিরিয়ায় আসাদের পক্ষাবলম্বন ইত্যাদি কারণে দেশ দুটির মধ্যে বড় ধরনের আস্থাহীনতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষুদ্র আকারের পরমাণু বোমা তৈরি করার, যা কিনা বিশ্বে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেওয়ার একটা আশঙ্কা তৈরি করেছে। এই যখন পরিস্থিতি তখন ব্রিটেন প্রথমে ২৩ জন রুশ কূটনীতিককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল। অভিযোগে ছিল ব্রিটেনে বসবাসরত একসময়ের রুশ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য সার্গেই স্ক্রিপালকে হত্যার! স্ক্রিপাল ছিলেন ডাবল এজেন্ট। তিনি রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করলেও, একই সঙ্গে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাকেও তথ্য সরবরাহ করতেন তিনি। তাই স্ক্রিপালকে যখন নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করে হত্যার প্রচেষ্টা চালানো হয় তখন অভিযোগ ওঠে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। তারা সবাই মিলে ১৩৯ জন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া বহিষ্কার করে ১৫০ জন পশ্চিমা কূটনীতিককে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কূটনীতিকরাও ছিলেন। এই বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে নতুন করে দুই দেশের মধ্যে (যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া) উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, এর মধ্য দিয়ে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হতে পারে।
স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল আজ থেকে ২৭ বছর আগে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল। একটা সময় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যখন ইউরোপে প্রভাববলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তির মধ্যে এক ধরনের ‘যুদ্ধের’ আশঙ্কার জন্ম হয়েছিল। দীর্ঘ সময় ওই পরিস্থিতি বহাল ছিল, যা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের দীর্ঘ সময়ে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেখানে দুই পরাশক্তির কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, তা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এ ক্ষেত্রে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ১২২টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। এখন ৫০টি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করলেই ৯০ দিন পর এটি কার্যকর হবে। তবে এই চুক্তি বয়কট করেছে যুক্তরাষ্ট, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। পরমাণু যুদ্ধ এড়াতে সাত দশকের প্রচেষ্টার পর প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করতে বৈশ্বিক ওই চুক্তিটি হয়েছিল। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ দেশের আলোচকরা ১০ পাতার চুক্তিটি চূড়ান্ত করেছিলেন। চুক্তির পক্ষে পড়েছিল ১২২টি ভোট। একটি ভোট পড়েছে বিপক্ষে। দেশটি হচ্ছে নেদারল্যান্ডস। সিঙ্গাপুর ভোটদানে বিরত ছিল।
পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ছিল না। এখন ট্রাম্প-পুতিন আলোচনায় প্রশ্নটি উঠেছে। Vox News আমাদের জানিয়েছিল যে শীর্ষ বৈঠকে New START চুক্তি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণে দুই পক্ষ START চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল ২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। ওই চুক্তিতে দুই পক্ষের পারমাণবিক অস্ত্র পরিদর্শনের সুযোগ ছিল; যদিও ওই চুক্তিটি ২০২১ সাল পর্যন্ত কার্যকর রয়েছে। তবে তা আরো পাঁচ বছর বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, ওই চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল এবং তিনি আর তা নবায়ন করবেন না। ফলে ট্রাম্প-পুতিন আলোচনার পর New START চুক্তি নিয়ে দুই পক্ষ আদৌ কোনো সমঝোতায় উপনীত হবে কি না, সে প্রশ্ন থাকলই। কেননা এ ব্যাপারে বিস্তারিত কোনো তথ্য কোনো পক্ষ থেকেই দেওয়া হয়নি। দুই নেতা একান্তে বৈঠক করেছেন কোনো সহকারী ছাড়াই। তবে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়েছে, আগামী দিনে দুই পক্ষ বিশেষজ্ঞদের নিয়ে বৈঠক করবে। যখন ট্রাম্প প্রশাসন ছোট আকারের পারমাণবিক বোমা তৈরির উদ্যোগ নেয় তখন START চুক্তি নিয়ে কতটুকু সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে, এ প্রশ্ন থাকলই।
পারমাণবিক অস্ত্রের পাশাপাশি সিরিয়া ও ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কারণেই আসাদ সরকার টিকে যায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের মনঃপূত নয়। যুক্তরাষ্ট্র আসাদ সরকারের পতন চেয়ে আসছে এবং আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সমর্থন করছে। এর বাইরে রয়েছে ইউক্রেন পরিস্থিতি। ইউক্রেন নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এক ধরনের ঠাণ্ডা লড়াই চলছে। ইউক্রেনে ইয়ানোকোভিচ সরকারের পতন ঘটেছিল ২০১৪ সালে। অভিযোগ আছে, ইয়ানোকোভিচ, যিনি ছিলেন মস্কোঘেঁষা, তাঁর পতন তথা উত্খাতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় ভূমিকা ছিল। রাশিয়া এখন পূর্ব ইউক্রেনে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করছে এবং ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট পেট্রো প্রোসেনকোকে উত্খাতের উদ্যোগ নিতে পারে। একই সঙ্গে চীন-রাশিয়া সহযোগিতা আরো বৃদ্ধি ট্রাম্পের জন্য চিন্তার কারণ। সার্গেই স্ক্রিপালের হত্যার ঘটনায় পশ্চিমা বিশ্ব যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, চীন তার সমালোচনা করেছিল। চীন কোনো মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেনি সত্য; কিন্তু নৈতিকভাবে রাশিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
রুশ-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি কারো জন্যই কোনো ভালো খবর নয়। প্রেসিডেন্ট পুতিন ক্ষমতায় থাকবেন ২০২৪ সাল পর্যন্ত। সুতরাং পুতিনকে আস্থায় নিয়েই বিশ্বে স্থিতিশীলতা আসবে। পারমাণবিক ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। আস্থাহীনতার সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে তা বিশ্বে উত্তেজনা ছড়াবে মাত্র। স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্বে কোনো মঙ্গল ডেকে আনেনি। সুতরাং নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হলে তা-ও কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ট্রাম্পকে নিয়ে। তিনি এক ধরনের আগ্রাসী নীতি নিয়ে চলতে পছন্দ করেন। ট্রাম্প-উন (উত্তর কোরিয়ার নেতা) শীর্ষ বৈঠক আয়োজনে চীনের একটি বড় ভূমিকা থাকলেও, চীনের সঙ্গে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধে’  তিনি জড়িয়ে গেছেন। কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও তিনি একই ধরনের আচরণ করছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই মস্কোকে কাছে পেতে চাইবেন। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ যদি তিনি না নেন, যদি মস্কোর সঙ্গে এক ধরনের সহাবস্থানে না যান (সিরিয়া, ইউক্রেন ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রশ্নে), তাহলে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা বাড়বেই। এর ফলে চীন-রাশিয়া ঐক্য আরো শক্তিশালী হবে এবং স্নায়ুযুদ্ধ-২-এর আশঙ্কা আরো বাড়বে। এরই মধ্যে ট্রাম্প রাশিয়ার প্রশ্নে কিছুটা হলেও নতি স্বীকার করেছেন। হেলসিংকিতে যেখানে তিনি বলেছেন, তিনি বিশ্বাস করেন না রাশিয়া ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছিল, সেখানে ওয়াশিংটনে ফিরে এসে শেষ পর্যন্ত তিনি স্বীকার করে নিলেন রাশিয়া নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করেছিল (ফিন্যানশিয়াল টাইমস, ১৮ জুলাই)। তাঁর এই স্বীকারোক্তি রুশ-মার্কিন সম্পর্কের ওপর এখন প্রভাব ফেলতে পারে। এমনিতেই ট্রাম্প এখন নানা জটিলতায় জড়িয়ে আছেন। চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে তিনি যে এক ধরনের ‘বাণিজ্যযুদ্ধ’ শুরু করেছেন, তা যুক্তরাষ্ট্রকেই বিশ্ব আসরে একাকী করছে। এফবিআইয়ের তদন্তের তিনি মুখোমুখি হতে পারেন। অনেক কংগ্রেসম্যান তাঁর নেতৃত্বের সমালোচনা করেছেন। অভিবাসী ইস্যু, বিশেষ করে শিশুদের তাদের মা-বাবার কাছ থেকে পৃথক করা তাঁকে আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত করেছে। তিনি পুতিনের সঙ্গে বৈঠক করে অভ্যন্তরীণ ইস্যুকে অন্যদিকে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এখানেও তিনি ব্যর্থ।
সিঙ্গাপুরে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠক শেষ পর্যন্ত ‘ফটোসেশনে’ পরিণত হয়েছিল। ওই বৈঠকের পর সেখানে পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণের ব্যাপারে অগ্রগতি কম। এখন পুতিনের সঙ্গে ঐতিহাসিক বৈঠকটিও আরেকটি ‘ফটোসেশনের’ জন্ম দিতে যাচ্ছে! স্পষ্টতই রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধ থেকে যাচ্ছে, যা কিনা নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম দেবে মাত্র।
Daily Kalerkontho
22.07.2018

প্রসঙ্গ কোটা সংস্কার

কোটা সংস্কার নিয়ে এখন সর্বত্র আলোচনা। কোটা আন্দোলনকারী কয়েকজন ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত রাশেদের মা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি ছেলের মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্তি জানিয়েছেন। কয়েকটি দূতাবাস এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

সংসদে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে এবং যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের ছাড়া হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষক এটা নিয়ে একটি মিছিলও করেছেন। সব মিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়।

আমার কাছে দুটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এক. বিদেশি দূতাবাসগুলোর বিবৃতি; দুই. প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ মন্তব্য। আন্দোলনকারীদের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে কয়েকটি দূতাবাস বিবৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডস দূতাবাস এসব বিবৃতি দেয়।

দূতাবাসগুলোর ফেসবুকে তা প্রকাশিত হয়। নরওয়ে দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর ধারাবাহিক হামলার বিষয়টি নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সুইজারল্যান্ড দূতাবাস বলছে, যেসব নীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিভিন্ন স্থানে সমাবেশের ওপর হামলা, সেসব নীতির পরিপন্থী। নেদারল্যান্ডস দূতাবাস উল্লেখ করেছে, মতপ্রকাশ ও সমাবেশ করার অধিকার সার্বজনীন মানবাধিকার।

আর মার্কিন দূতাবাস তাদের ফেসবুক পাতায় উল্লেখ করেছে, ‘বাকস্বাধীনতা, জমায়েতের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারের মতো যে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো যারা প্রয়োগ করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে।’ স্পষ্টতই এ ধরনের বক্তব্যে সরকারের খুশি হওয়ার কথা নয়।

ক্ষমতাসীনদের অনেকেই মনে করছেন, এই আন্দোলনের পেছনে সরকারবিরোধীদের মদদ রয়েছে এবং কোটা সংস্কারের ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে সরকারবিরোধীরা রাস্তায় সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এখানে অনেক বিষয় আছে।

এক. দূতাবাসগুলো এ ধরনের বিবৃতি দিতে পারে কি না? দুই. তারা আসলে কী বলেছে? তিন. কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে রাজপথের বিরোধী দলের কোনো ইন্ধন আছে কি না? দূতাবাসগুলোর কাজের যে ধরন, তার সঙ্গে বিবৃতির কোনো ‘মিল’ খুঁজে পাওয়া যাবে না।



কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্রদের একটি আন্দোলন। এক্ষেত্রে বিদেশি দূতাবাসগুলো যদি জড়িয়ে যায়, তাহলে তো আগামীতে প্রতিটি ইস্যুতেই তারা বিবৃতি দেবে! এ ধরনের বিবৃতি অনাকাক্সিক্ষত। তবে তারা মানবাধিকার ও সহিংস ঘটনার কথা বলছে। মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি তাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি অংশ। অতীতেও তারা এ ধরনের বিবৃতি দিয়েছে। তবে রাজপথের বিরোধী দল কিংবা অন্য কোনো বিরোধী দলের কোনো ইন্ধন এ কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিল, তা প্রমাণিত নয়। এটা ছাত্রদেরই একটি আন্দোলন এবং ছাত্রদের মাঝেই এটা সীমাবদ্ধ ছিল।

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ। এই কোটা ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিল আন্দোলনকারীরা।

এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী কেবিনেট সচিবকে প্রধান করে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিও গঠন করে দিয়েছিলেন। আমার ধারণা, ওই কমিটি যদি সময়ক্ষেপণ না করে সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে দ্রুততার সঙ্গে একটি প্রাক-প্রতিবেদন জমা দিতেন, তাতে পরিস্থিতি এতদূর গড়াতো না। দেশের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বলেছেন, কোটা পদ্ধতি বাতিল নয়, তবে তাতে সংস্কার আনা যেতে পারে। আন্দোলনকারীরাও এটা চাইছে। আমি আমার অনেক ছাত্রের মাঝে এ কোটা নিয়ে এক ধরনের ক্ষোভ দেখেছি।



এরা কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়। রাজনীতিও করে না। এরা সংস্কার চায়। কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠনের হামলা, হাতুড়ি সংস্কৃতি নতুন এক মাত্রা এনে দিয়েছে। যে ছাত্র সংগঠনের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, তারা কী করে হাতুড়ি সংস্কৃতির জন্ম দেয়? কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়া কেন? এক সময় আমরা রগকাটা সংস্কৃতির কথা শুনেছিলাম। এখন দেখলাম হাতুড়ি সংস্কৃতি? এতে কী ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য হারাতে বসছে? আমরা কোন পথে যাচ্ছি?

আরও একটি কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে হামলা খুব জঘন্য একটি কাজ। উপাচার্য একটি প্রতিষ্ঠান। তার বাড়িতে হামলা, তার নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই একটি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার নামান্তর। যারাই এ কাজ করেছে, তারা ছাত্র এটা আমি মানতে পারছি না। যারাই এ কাজ করেছে, ফুটেজ দেখে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। তাই বলে কোনো সাধারণ ছাত্র যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

যদি কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের কেউ এ কাজ করে থাকে, আমি তার বিচার দাবি করব। কেননা এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। কিন্তু দু’জন উপাচার্যের কোটাবিরোধী বিরূপ মন্তব্য আমাকে আহত করেছে। আন্দোলনকারীরা তো ছাত্র, সন্তানতুল্য। তাদের সম্পর্কে কি বিরূপ মন্তব্য করা যায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেছেন, তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে জঙ্গিদের ছায়া দেখেছেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান সাহেবকে চিনি। তিনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। ভালো মানুষ। বরিশালের আঞ্চলিক টোনেই তিনি কথা বলেন। একাধিকবার তার সঙ্গে টকশো করেছি। তিনি কেন ছাত্রদের জঙ্গিদের আখ্যায়িত করে বক্তব্য দিলেন, আমি তা বুঝতে অপারগ।

যদিও পরে তিনি বলেছেন, তিনি ছাত্রদের জঙ্গিদের সঙ্গে তুলনা করেননি। অপর উপাচার্য আবদুস সোবহান। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। উপাচার্য হওয়ার পরপরই তার বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ উঠেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরকে মিথ্যা তথ্য দেয়ার। আন্দোলনকারীদের তিনি ‘বাম ঘরানার শিবির’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একজন শিক্ষক তিনি। একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি এ ধরনের মন্তব্য করা শোভন?

তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল যখন হাতুড়ির আক্রমণে পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং হাসপাতাল যখন তাকে চিকিৎসা শেষ না করেই ডিসচার্জ করল, তিনি তাকে দেখতে গেলেন না। একজন অভিভাবক যখন তার সন্তানকে আমাদের কাছে রেখে যান, তখন আমরাই তার অভিভাবক। তার দায়িত্ব তো বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার নৈতিক দায়িত্ব ছিল উপাচার্যের। তিনি তা করেননি। দলীয় রাজনীতি আর কি!



অধ্যাপক আখতারুজ্জামান এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামও কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। উপাচার্যরা ছাত্রদের পাশে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের পছন্দ অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যদের কাছে ছাত্রদের দাবি দাওয়ার পরিবর্তে মুখ্য হয়ে দেখা দেয় দলীয় রাজনীতি।

সংবাদপত্রে খবর হয়েছে ঢাবির ১২ বিভাগে ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করেছে গত ১২ জুলাই। গ্রেফতারকৃতদের কেউ কেউ এসব বিভাগের ছাত্র। সহমর্মিতা দেখানোর জন্য এমনটি হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ক্লাস বর্জন অন্তত শিক্ষক হিসেবে আমি সমর্থন করতে পারি না। ক্লাসে যেতে হবে। ক্লাস বাদ দিয়ে আন্দোলন নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভবিষ্যৎ এখন কোনদিকে আমি বলতে পারব না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর এ আন্দোলন কী এখন মুখ থুবড়ে পড়ল? এটা অস্বীকার করা যাবে না, প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ঘোষণার পর কেবিনেট সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির কাজ আরও জটিল হয়ে গেল।

এখন দেখার পালা এ কমিটি কী সিদ্ধান্ত দেয়! মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের কোটা থাকতে পারে। কিন্তু নাতি-নাতনির কোটা থাকা নিয়ে অনেকেই আপত্তি করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে নানা কথা আছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার খবর সংবাদপত্রে একাধিকবার ছাপা হয়েছে। কয়েকজন সচিবের খবর ছাপা হয়েছিল, যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে সুবিধা নিয়েছিলেন।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার কাজটি অত সহজ নয়। এমনিতেই প্রশাসনে যোগ্য লোকের সংখ্যা কমছে। বর্তমান বিশ্বে নেগোসিয়েশনের কাজটি অত্যন্ত জটিল। প্রশাসনে যদি যোগ্য লোকের স্থান না হয়, তাহলে নেগোসিয়েশনে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এর মধ্যে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশি মাত্রায় দলীয়করণের কারণে সেখানে দক্ষ শিক্ষক আমরা পাচ্ছি না। আর সিনিয়র শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ায় দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি দেখা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এখন প্রশাসনেও যদি দক্ষ জনবলের ঘাটতি দেখা দেয়, আমাদের জন্য তা ভালো কোনো খবর নয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটা সুন্দর সমাপ্তি হোক। দিনের পর দিন এভাবে চলতে পারে না। প্রায় এক কোটি তরুণ ভোটার নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভোটার তালিকায়। এদের অধিকাংশই ছাত্র। এটা বিবেচনায় নিতে হবে আওয়ামী লীগকে। তরুণ প্রজন্মের সমর্থন পেয়েছিল বিধায় আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল। সুতরাং এবার ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এ তরুণ প্রজন্মের সমর্থন হারাবে কেন আওয়ামী লীগ?

ট্রাম্পের ইউরোপ সফর এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতি



শুধু প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানোই নয়, বরং ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গে একধরনের বিবাদে জড়িয়ে গেছে। অনেক ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পণ্যের ওপর (ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি) যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করেছে। ফলে এটা নিয়ে একধরনের বিবাদ এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে ইউরোপে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার এই সফরে ব্রিটেনেও গিয়েছিলেন। ব্রিটেনে তিনি বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। তার বাণিজ্য নীতি ও অভিবাসন নীতি তাকে ব্রিটেনে বিতর্কিত করেছে। অনেকের মনে থাকার কথা, বেশকিছু দিন আগে লন্ডনের মেয়র সাদিক খান ঘোষণা করেছিলেন ট্রাম্প লন্ডনে অনাকাক্সিক্ষত। সাদিক খানের এই বক্তব্যের জন্য কি না জানি না, লন্ডনে ব্যাপক নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে ট্রাম্পের এই ইউরোপিয়ান দেশগুলো সফরের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে আগামীকালের পুতিনের সঙ্গে তার শীর্ষ বৈঠক। এই বৈঠকের দিকে তাকিয়ে আছে সারা বিশ্ব। সিঙ্গাপুরে কিম জং উনের সঙ্গে শীর্ষ বৈঠকের পর হেলসিংকি বৈঠকটি (ট্রাম্প-পুতিন) যে-কোনো বিবেচনায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
সাম্প্রতিক সময়গুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বিভিন্ন ইস্যুতে দেশ দুটি পরস্পরবিরোধী একটা অবস্থান গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে (২০১৬) রাশিয়ার পরোক্ষ হস্তক্ষেপ, সিরিয়ায় আসাদের পক্ষাবলম্বন ইত্যাদি কারণে দেশ দুটির মধ্যে বড় ধরনের আস্থাহীনতার সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ক্ষুদ্র আকারের পরমাণু বোমা তৈরি করার, যা কি না বিশ্বে পরমাণু অস্ত্র প্রতিযোগিতাকে উসকে দেওয়ার একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এই যখন পরিস্থিতি, তখন ব্রিটেন প্রথমে ২৩ রুশ কূটনীতিককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছিল। অভিযোগ ছিল, ব্রিটেনে বসবাসরত একসময়ের রুশ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য সার্গেই স্ক্রিপালকে হত্যার! স্ক্রিপাল ছিলেন ডবল এজেন্ট। তিনি রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার হয়ে কাজ করলেও একই সঙ্গে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাকেও তথ্য সরবরাহ করতেন। তাই স্ক্রিপালকে যখন নার্ভ গ্যাস প্রয়োগ করে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়, তখন অভিযোগ ওঠে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে। ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্ত অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ। তারা সবাই মিলে ১৩৯ রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া বহিষ্কার করে ১৫০ পশ্চিমা কূটনীতিককে, আর মাঝে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের কূটনীতিকরাও ছিলেন। এই বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে নতুন করে দুই দেশের মাঝে (যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া) উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছিল। পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, এর মধ্য দিয়ে নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হতে পারে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল আজ থেকে ২৭ বছর আগে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের মধ্য দিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হয়েছিল। একটা সময় ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ইউরোপে প্রভাব বলয় বিস্তারের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে দুই পরাশক্তির মাঝে একধরনের ‘যুদ্ধের’ সম্ভাবনার জন্ম দিয়েছিল। দীর্ঘ সময় ওই পরিস্থিতি বহাল ছিল, যা ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে স্নায়ুযুদ্ধ হিসেবে। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধকালীন দীর্ঘ সময়ে একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেখানে দুই পরাশক্তির কাছে যে পারমাণবিক অস্ত্র ছিল, তা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এক্ষেত্রে আরও কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ১২২ দেশ পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল। এখন ৫০টি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করলেই ৯০ দিন পর এটি কার্যকর হবে। তবে এই চুক্তি বয়কট করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স। পরমাণু যুদ্ধ এড়াতে সাত দশকের প্রচেষ্টার পর প্রথমবারের মতো পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধ করতে বৈশ্বিক ওই চুক্তিটি হয়েছিল। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ দেশের আলোচকরা ১০ পাতার চুক্তিটি চূড়ান্ত করেছিলেন। চুক্তির পক্ষে পড়েছিল ১২২টি ভোট। একটি ভোট পড়েছে বিপক্ষে। দেশটি হচ্ছে নেদারল্যান্ডস। সিঙ্গাপুর ভোটদানে বিরত ছিল। পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া ছিল না। এখন ট্রাম্প-পুতিন আলোচনায় এ প্রশ্নটি উঠবে। ঠড়ী হবংি আমাদের জানাচ্ছে, (৫ জুলাই) শীর্ষ বৈঠক ঘবি ঝঃধৎঃ চুক্তি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণে দুপক্ষ  চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল ২০১১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। ওই চুক্তিতে দুপক্ষের পারমাণবিক অস্ত্র পরিদর্শনের সুযোগ ছিল। যদিও ওই চুক্তিটি ২০২১ সাল পর্যন্ত কার্যকর রয়েছে। তবে তা আরও ৫ বছর বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন, ওই চুক্তিটি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে ছিল এবং তিনি আর তা নবায়ন করবেন না। ফলে ট্রাম্প-পুতিন আলোচনায়  চুক্তি নিয়ে দুপক্ষ আদৌ কোনো সমঝোতায় উপনীত হবে কি না, সে প্রশ্ন থাকলই।
পারমাণবিক অস্ত্রের পাশাপাশি সিরিয়া ও ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে একধরনের মতপার্থক্য রয়েছে। সিরিয়ায় রাশিয়ার হস্তক্ষেপের কারণেই আসাদ সরকার টিকে যায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের মনঃপূত নয়। যুক্তরাষ্ট্র আসাদ সরকারের পতন চেয়ে আসছে এবং আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের সমর্থন করছে। এর বাইরে রয়েছে ইউক্রেন পরিস্থিতি। ইউক্রেন নিয়ে দুপক্ষের মাঝে একধরনের ঠান্ডা লড়াই চলছে। ইউক্রেনে ইয়ানোকোভিচ সরকারের পতন ঘটেছিল ২০১৪ সালে। অভিযোগ আছে, ইয়ানোকোভিচ, যিনি ছিলেন মস্কোঘেঁষা, তার পতন তথা উৎখাতের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের একটা বড় ভূমিকা ছিল। রাশিয়া এখন পূর্ব ইউক্রেনে তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করছে এবং উইক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট পেট্রো প্রোসেনকাকে উৎখাতের উদ্যোগ নিতে পারে। একই সঙ্গে চীন-রাশিয়া সহযোগিতা আরও বৃদ্ধি ট্রাম্পের জন্য চিন্তার কারণ। সার্গেই স্ক্রিপালের হত্যার ঘটনায় পশ্চিমাবিশ্ব যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, চীন তার সমালোচনা করেছিল। চীন কোনো মার্কিন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেনি সত্য; কিন্তু নৈতিকভাবে রাশিয়ার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল।
রুশ-মার্কিন সম্পর্কের অবনতি কারও জন্যই কোনো ভালো খবর নয়। প্রেসিডেন্ট পুতিন ক্ষমতায় থাকবেন ২০২৪ সাল পর্যন্ত। সুতরাং পুতিনকে আস্থায় নিয়েই বিশ্বে স্থিতিশীলতা আসবে। পারমাণবিক ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। আস্থাহীনতার সম্পর্ক বৃদ্ধি পেলে তা বিশ্বে উত্তেজনা ছড়াবে মাত্র। স্নায়ুযুদ্ধ বিশ্বে কোনো মঙ্গল ডেকে আনেনি। সুতরাং নতুন করে স্নায়ুযুদ্ধের জন্ম হলে তা-ও কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ট্রাম্পকে নিয়ে। তিনি একধরনের আগ্রাসী নীতি নিয়ে চলতে পছন্দ করেন। ট্রাম্প-উন (উত্তর কোরিয়ার নেতা) শীর্ষ বৈঠক আয়োজনে চীনের একটি বড় ভূমিকা থাকলেও চীনের সঙ্গে একধরনের ‘বাণিজ্য যুদ্ধে’ তিনি জড়িয়ে গেছেন। কানাডা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সঙ্গেও তিনি একই ধরনের আচরণ করছেন। এক্ষেত্রে তিনি খুব স্বাভাবিকভাবেই মস্কোকে কাছে পেতে চাইবেন। কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ যদি তিনি না নেন, যদি মস্কোর সঙ্গে একধরনের সহাবস্থানে না যান (সিরিয়া, ইউক্রেন ও পারমাণবিক অস্ত্র প্রশ্নে), তাহলে দু’পক্ষের মাঝে উত্তেজনা বাড়বেই। এর ফলে চীন-রাশিয়া ঐক্য আরও শক্তিশালী হবে এবং স্নায়ুযুদ্ধ-২ এর সম্ভাবনা আরও বাড়বে।
Daily Alokito Bangladesh
15.07.2018

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কোন পথে


আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির প্রেসিডেন্ট পিটার মাউরা একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন ৩ জুলাই। ঢাকায় আইসিআরসি দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরার পরিবেশ তৈরি হয়নি। মাউরা মিয়ানমারের রাখাইনে কয়েকটি এলাকা ঘুরে বাংলাদেশে আসেন। প্রায় একই সময়ে বাংলাদেশে আসেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। এরাও সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন। গুতেরেস রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আর বিশ্বব্যাংক ৪৮ কোটি ডলার সাহায্য দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গারা কবে নাগাদ ফিরে যাবেন, এ ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়নি। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গেল ২৩ নভেম্বর (২০১৭) মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে একটি সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯ ডিসেম্বর দেশ দুটি একটি ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’ গঠন করে। এর মধ্য দিয়ে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে, বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গারা শেষ পর্যন্ত বোধ হয় নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন! কিন্তু ২৩ জানুয়ারি একটি তারিখ নির্ধারিত হলেও প্রত্যাবাসনের কাজটি শুরু হয়নি। আমরা বারবার বলে আসছি, মিয়ানমারের ওপর আস্থা রাখাটা সত্যিকার অর্থেই কঠিন। মিয়ানমার সনাতন কূটনৈতিক শিষ্টাচার মেনে চলে না। আমরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, মিয়ানমার এর আগে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সে প্রতিশ্রুতি তারা পালন করেনি। এ নিয়ে দুই দেশের মাঝে একাধিক বৈঠক হলেও তা কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিছু রোহিঙ্গা তারা ফেরত নিয়ে গেছে; কিন্তু ব্যাপকসংখ্যক রোহিঙ্গা, যারা নিবন্ধিত নয়, তারা বাংলাদেশের মাটিতে রয়ে গিয়েছিলেন। এখন এর সঙ্গে যোগ হলো আরও সাড়ে ৬ লাখ রোহিঙ্গা। বাংলাদেশ এদের আশ্রয় দিয়ে নিঃসন্দেহে মানবতার পরিচয় দিয়েছিল। বাংলাদেশের এ ভূমিকা বিশ্বে প্রশংসিত হয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে একটি চুক্তি অথবা সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করা জরুরি ছিল। বাংলাদেশ সেটা করেছে। কিন্তু মিয়ানমার সরকারের মানসিকতার যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মাটিতে থেকে যেতে পারে! সুতরাং মিয়ানমার সরকারের মানসিকতায় পরিবর্তন এসেছে, এটা আমরা বলতে পারি না। তাদের কোনো কার্যকলাপে তা প্রমাণিতও হয় না। সেজন্য একটা আশঙ্কা এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে যে, মিয়ানমার তথাকথিত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে কালক্ষেপণ করছে! এই কালক্ষেপণের স্ট্র্যাটেজি তাদের অনেক পুরানো। এবারও এমনটি হতে যাচ্ছে! ২৩ জানুয়ারি একটি তারিখ নির্ধারিত হলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আজ অবধি শুরু হয়নি। রোহিঙ্গা সংকট শুরু হওয়ার পর ১১ মাস পার হয়েছে। এ ১১ মাসে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আন্তর্জাতিক ভিআইপি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। তুরস্কের ফার্স্টলেডি, পোপ ফ্রান্সিস, মার্কিন কংগ্রেস প্রতিনিধি দলসহ একাধিক ব্রিটিশমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন। সবাই আশা করেছিলেন রোহিঙ্গারা ফিরে যাবেন। আন্তর্জাতিক কমিউনিটির চাপে শেষ অবধি এপ্রিলে একজন মিয়ানমারের মন্ত্রীও বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনিও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়া হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে আদৌ কোনো অগ্রগতি নেই। আর এখন এলেন তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তারা ঢাকায় এসে রোহিঙ্গা প্রশ্নে যেসব মন্তব্য করেছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আইসিআরসির প্রেসিডেন্ট যখন বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরার কোনো পরিবেশ নেই, তখন এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, মিয়ানমারের আসল উদ্দেশ্যটি কী। তারা কালক্ষেপণ করছে এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে বিভ্রান্ত করছে। এখন জাতিসংঘের মহাসচিব বলছেন, ‘চাপ’ প্রয়োগের কথা। কিন্তু এই ‘চাপ’ প্রয়োগ কীভাবে হবে? নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হবে বলেও মনে হয় না। কেননা চীন ও রাশিয়ার সমর্থন তাতে পাওয়া যাবে না। উত্তর কোরিয়া ও ইরানের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদ অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর একটা ‘চাপ’ আছে। উপরন্তু পোপ ফ্রান্সিস ‘রাখাইনের নির্যাতিত ভাইবোনের’ পক্ষে কথা বলেছিলেন। সেক্ষেত্রে মিয়ানমারের পক্ষে রোহিঙ্গাদের আবিষ্কার করা সহজ হবে না। তারা রাখাইন স্টেটের নির্যাতনের খবর অস্বীকার করবেন কীভাবে? অ্যান্তোনিও গুতেরেসের ঢাকা সফরের পর রোহিঙ্গা সংকটের আন্তর্জাতিক মাত্রাটা আরও বাড়ল। আমাদের কাজটি হবে এখন আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ আরও দ্রুত করা। আন্তর্জাতিক কমিউনিটি আমাদের পক্ষে। এখন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টও আমাদের পক্ষে দাঁড়ালেন। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এর মাধ্যমে তারা উভয়েই অন্তত একটি মেসেজ দিলেন বিশ্ব সম্প্রদায়কে। আমাদের কাজটিই হবে এখন তাদের এ মেসেজটি ধারণ করে আন্তর্জাতিক আসরে রোহিঙ্গা প্রশ্নে জনমত গড়ে তোলা। রাষ্ট্রদূতদের সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীও এ রকম আহ্বান জানিয়েছিলেন। একদিকে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা অব্যাহত রাখা, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক আসরে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ অব্যাহত রাখাÑ এভাবেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।জাতিসংঘের মহাসচিব বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। এ সফরের অনেক ইতিবাচক দিক আছে। বাংলাদেশ যে একটি শান্তি ও সম্প্রীতির দেশ, সেই মেসেজটি তিনি বিশ্ববাসীকে দিলেন। সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী মিয়ানমার তাদের নাগরিকদের ফেরত নেবে। এ স্বীকারোক্তি তাদের আছে। কমিটমেন্টও আছে। এখন তথাকথিত ‘ভেরিফিকেশন’ এর নামে রোহিঙ্গা পুনর্বাসন প্রক্রিয়া যেন আটকে না যায়! এক্ষেত্রে মিয়ানমারের আন্তরিকতাই হলো আসল। মিয়ানমার যেন তাদের আন্তরিকতা প্রদর্শন করে, সে ব্যাপারে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে আমাদের স্বার্থে ‘ব্যবহার’ করতে হবে। এজন্য কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো জরুরি। পোপ, গুতেরেস আর কিমের ঢাকা সফরের পর আন্তর্জাতিক আসরে আমাদের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। তাই ওয়াশিংটন, ব্রাসেলস ও বেইজিংয়েও আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়াতে হবে। আমাদের প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ে রোহিঙ্গা প্রশ্নে নীতিগতভাবে কিছুু পরিবর্তন এসেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা নির্যাতনকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। দু-একজন মার্কিন সিনেটরের বক্তব্যেও এমনটি ফুটে উঠেছে। এখন মিয়ানমার যদি দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কালক্ষেপণের উদ্যোগ নেয়, আমরা মার্কিন আইন, প্রণেতা ও প্রশাসনকে ব্যবহার করতে পারব। চীনের নীতিতেও ‘কিছু পরিবর্তন’ লক্ষণীয়। চীন এখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এসে বলে গিয়েছিলেন, প্রয়োজনে চীন মধ্যস্থতা করতে পারে! বাংলাদেশে চীনের প্রচুর বিনিয়োগ রয়েছে। বাংলাদেশ বরাবরই বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। মিয়ানমারের বহুল আলোচিত সেনাবাহিনীপ্রধান রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পরপরই বেইজিং সফর করেছিলেন। এর পরপরই মিয়ানমার বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও বেইজিং সফর করেছেন। গুতেরেসের ঢাকা সফরের পর বিশ্বমিডিয়া রোহিঙ্গাদের করুণ কাহিনি আরও প্রকাশ করেছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস এর আগে জানিয়েছিল, রোহিঙ্গা ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছে মিয়ানমার। টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, মিয়ানমারের স্বাধীনতার শুরুর দিকে বিশিষ্ট রোহিঙ্গারা বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলেন। দেশটির শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রেঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালয়ে রোহিঙ্গা শিক্ষার্থীদের আলাদা একটি ইউনিয়নও ছিল। স্বাধীনতার পর দেশটির প্রথম নেতা উনুর মন্ত্রিসভাতেও একজন সদস্য ছিলেন রোহিঙ্গা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করা সেই মন্ত্রীও নিজে আরাকান মুসলিম হিসেবেই পরিচয় দিতেন। এমনকি জেনারেল নে উইনের সময়ও মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় বেতার থেকে রোহিঙ্গা ভাষায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হতো। সংসদে নারীদের প্রতিনিধিত্ব ছিল(No such Thing as Rohingya : Myanmar Erases a History, New York Times, 2 December 2017)। নিউইয়র্ক টাইমসের ওই প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের বাস্তব ইতিহাসটিই ফুটে উঠেছিল। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ইতিহাস কতটুকু মুছে ফেলতে পারবে, তা হয়তো আগামী দিনের ইতিহাস বলবে। কিন্তু এভাবে একটি জনগোষ্ঠীকে পরিপূর্ণভাবে উচ্ছেদ করে নতুনভাবে ইতিহাস লেখা যায় না। হিটলার জামার্নিতে পারেননি। মিলোসোভিচ বসনিয়ায় পারেননি। টালর্স টেলরও পারেননি লাইবেরিয়াতে। দক্ষিণ আফ্রিকা কিংবা আফ্রিকার রুয়ান্ডাতেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সেখানেও শাসকরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। তাই যত দ্রুত মিয়ানমারের নেতাদের মাঝে এ উপলব্ধিবোধটুকু আসবে, ততই মিয়ানমারের জন্য মঙ্গল। গুতেরেসের সাম্প্রতিক ঢাকা সফরের মধ্য দিয়ে তিনি আরও একবার এ মেসেজটিই দিয়ে গেলেন। বাংলাদেশের উচিত হবে এখন আন্তর্জাতিক আসরে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো। মিয়ানমার যে কালক্ষেপণ করছে, এটা বোঝানোই হবে আমাদের প্রধান কূটনীতি। বিশ্ব সম্প্রদায়কে এটা বোঝানো যে, রোহিঙ্গাদের মাঝে ক্ষোভ আছে। এখন এ ক্ষোভকে যদি প্রশমিত করা না যায়, তাহলে এ অঞ্চল ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে। এখানে জঙ্গিবাদ বিস্তার করবে। এ ধরনের সম্ভাবনা আছে বলে পশ্চিমা পর্যবেক্ষকরা আভাস দিয়েছেন। সিরিয়া থেকে জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস উৎখাত হয়েছে। এরা আশ্রয় নিয়েছে ফিলিপাইনসের মিন্দানাওয়ে। সেখানকার ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে একত্রিত হয়ে তারা ‘ইসলামি খেলাফত’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সুতরাং আমাদের যেমন সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে, ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটা একধরনের সতর্কবার্তা। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা বাড়ছে। এ অঞ্চল ধীরে ধীরে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। একদিকে দক্ষিণ চীন সাগর, অন্যদিকে ভারত মহাসাগর, যেখানে চীনের নৌবাহিনীর তৎপরতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার কারণ। সম্ভাব্য চীনের ভূমিকাকে সামনে রেখে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র স্ট্রাটেজিক অ্যালায়েন্স গড়ে উঠছে। এক্ষেত্রে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গার এ অঞ্চলে উপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে। মিয়ানমারে চীনের স্বার্থ রয়েছে, এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য, রাখাইন উপকূল অঞ্চল থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন ইউনান প্রদেশে যে গ্যাস নিয়ে যাচ্ছে, সে পাইপলাইনও ঝুঁকির মাঝে থাকতে পারে। স্মরণ করা প্রয়োজন, চীন মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলে যে বিশাল একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরি করেছিল (জলবিদ্যুৎ), তা স্থানীয় আদিবাসীদের বিক্ষোভের মুখে বাতিল হয়েছে। এখন রোহিঙ্গা অসন্তোষে যদি এ পাইপলাইন প্রজেক্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে তা চীনের অর্থনীতিতে আঘাত হানবে। উপরন্তু চীনের উইঙ্গোর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে স্থানীয় মুসলমানদের নিয়ে সমস্যায় আছে চীন। রোহিঙ্গা মুসলমানদের ব্যাপারে একধরনের সহমর্মিতা আছে উইঙ্গোর মুসলমানদের। এতে করে সেখানেও অসন্তোষ বাড়তে পারে। এ কারণেই রোহিঙ্গা প্রশ্নে চীনের মনোভাবের কিছু পরিবর্তন এসেছে।সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসছে। বাংলাদেশের জন্য এটা একটা সুযোগ। জাতিসংঘের মহাসচিবের বক্তব্য অনুসরণ করে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সদস্যদের মাঝে রোহিঙ্গা প্রশ্নে একটি জনমত তৈরি করতে পারে। এখন থেকে তাই প্রস্তুতিটি দরকার।
Daily Kalerkontho
08.07.2018

গুতেরেস ও কিমের সফরে কী পেল বাংলাদেশ

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিমের বাংলাদেশ সফরের পর যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হচ্ছে এই সফরে বাংলাদেশ কী পেল? এই দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশে এসেছিলেন রোহিঙ্গাদের অবস্থা নিজ চোখে দেখার জন্য। তাঁরা দুজনই একসঙ্গে রোহিঙ্গাদের অবস্থা নিজ চোখে দেখেছেন। কথা বলেছেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। গুতেরেস নিজে বিশ্ব কমিউনিটিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের অধিকার দিতে, তাদের স্বাধীনভাবে নিজ দেশে চলাফেরার সুযোগ দিতে, তাদের সম্পত্তির অধিকার দিতে, সব মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ দিতে হবে। তাঁর মতে, রোহিঙ্গারা এমন একটি সম্প্রদায়, যারা বিশ্বে বৈষম্যের শিকার। সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। একই সংবাদ সম্মেলনে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য ৪৮ কোটি ডলার সহায়তা দেওয়ার কথাও ঘোষণা করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের বক্তব্য রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত যেতে আদৌ কোনো সহায়তা করবে কি না? এরই মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছিল, তার অগ্রগতিও আশাব্যঞ্জক নয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন স্পষ্টতই কয়েকটি বিষয়কে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এক. রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের বিষয়টি কিভাবে নিশ্চিত হবে এখন? দুই. রোহিঙ্গারা নিজ দেশে কতটুকু নিরাপদ? তিন. রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে পারবে কি না? চার. রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে তাদের জীবন-জীবিকার কী হবে? মিয়ানমারের সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক ও পরবর্তী সময়ে ‘বাস্তুচ্যুত রাখাইনের বাসিন্দাদের প্রত্যাবাসন’ সংক্রান্ত যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তাতে নাগরিকত্বের বিষয়টি আদৌ নেই। মিয়ানমার এদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। রোহিঙ্গা নামেও আপত্তি রয়েছে তাদের। এমনকি কফি আনান কমিশনের রিপোর্টেও রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা হয়নি। মিয়ানমার এদের ‘বাঙালি’ হিসেবে উল্লেখ করে!
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় ও ডকুমেন্টে কোথাও রোহিঙ্গা শব্দটি নেই। গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারে রোহিঙ্গা খেদাও অভিযান শুরু হওয়ার পর মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত থাকলেও নাগরিকত্বের প্রশ্নে তাদের অবস্থানে পরিবর্তন হয়েছে। এসব কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। এ ক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা ছাড়া রোহিঙ্গারা আদৌ ফেরত যেতে চাইবে কি না?
মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের এটা একটা বড় দুর্বলতা। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় এই নাগরিকত্বের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারিনি। দ্বিতীয় প্রশ্নটিও সমান গুরুত্বপূর্ণ—নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে কিভাবে? নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে এসেছে। অনেকে তার স্ত্রী, স্বামী, সন্তানকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক হত্যা করতে দেখেছে। অনেক দেরিতে হলেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনীপ্রধান ‘সীমিত হত্যাকাণ্ডের’ কথা স্বীকার করেছেন। তাদের নিরাপত্তা যদি নিশ্চিত না হয়, তাহলে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। এখন তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে কে? যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাদের নিজ বাসভূম থেকে উত্খাত করেছে, রোহিঙ্গারা তাদের বিশ্বাস করবে না। এরই মধ্যে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁরা সুস্পষ্ট করেই বলেছেন, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ছাড়া তাদের ফেরত পাঠানো যাবে না। রোহিঙ্গারা এ ধরনের বক্তব্যে উৎসাহিত হবে নিঃসন্দেহে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো নিজেই বলেছেন, জোর করে কোনো রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো হবে না। এ ধরনের বক্তব্য রোহিঙ্গাদের এ দেশে থেকে যেতে উৎসাহ জোগাতে পারে। তৃতীয় প্রশ্নটিকেও আমাদের গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। রোহিঙ্গারা কি আদৌ নিজ বাসভূমে ফেরত যেতে পারবে? এর সরাসরি জবাব হচ্ছে ‘না’। যে চুক্তি হয়েছে, তাতে মিয়ানমার দুটি ক্যাম্প করবে। প্রথমটি অভ্যর্থনা ক্যাম্প, দ্বিতীয়টি অন্তর্বর্তীকালীন ক্যাম্প। অর্থাৎ যারা বাংলাদেশ থেকে ফেরত যাবে, তাদের প্রথমে অভ্যর্থনা ক্যাম্পে রাখা হবে। এরপর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন ক্যাম্পে পাঠানো হবে। এখানেই সমস্যাটা তৈরি হবে। এই ক্যাম্পে তারা বছরের পর বছর থেকে যেতে বাধ্য হবে। এটা এক ধরনের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’। এখানে রেখেই তথাকথিত যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি হবে।
শঙ্কা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের ভাগ্য ফিলিস্তিনিদের মতো হতে পারে! পাঠক স্মরণ করতে পারেন, ফিলিস্তিনিরা নিজ বাসভূম থেকে উত্খাত হয়ে বছরের পর বছর, জেনারেশনের পর জেনারেশন থেকে যাচ্ছে ক্যাম্পে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পাঠক, দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ যুগে ‘হোমল্যান্ড’গুলোর কথা স্মরণ করতে পারেন। বর্ণবাদ যুগের অবসানের আগে কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে সাতটি হোমল্যান্ডে রাখা হয়েছিল। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের অবস্থা অনেকটা হোমল্যান্ডগুলোতে থাকা কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী অথবা ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর মতো হতে পারে। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় নীতি এটাই—রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করা। আন্তর্জাতিক ‘চাপ’-এর কারণে তারা রোহিঙ্গাদের নিতে চাচ্ছে বটে; কিন্তু বাস্তবতা বলে তারা রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করে নিতে চাইছে না। উপরন্তু তারা কোনো দিনই তাদের নিজ নিজ বসতবাড়িতে ফেরত নেবে না। কেননা ওই সব বসতবাড়ির আদৌ কোনো অস্তিত্ব নেই। রাখাইনে কয়েক শ গ্রামে রোহিঙ্গাদের বসতবাটি মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ওই সব গ্রাম এখন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ‘লিজ’ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ফলে রোহিঙ্গারা নিজ বাসভূমে থাকতে পারছে না। রোহিঙ্গারা কোনো মতেই অন্যত্র থাকতে চাইবে না। বংশপরম্পরায় তারা নিজ বাসভূমে বসবাস করে আসছিল। জমিজমা চাষ করে আসছিল। কেউ কেউ ব্যবসায় নিয়োজিত ছিল। এখন তাদের যদি অন্যত্র রাখা হয়, তারা তা মানতে চাইবে না। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে এটা একটা অন্যতম সমস্যা। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে এসব প্রশ্নের জবাব থাকা বাঞ্ছনীয়।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে বাংলাদেশ খুব শক্ত অবস্থানে গেছে, এটা আমার মনে হয়নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য এবং পরবর্তী সময়ের কার্যক্রম বলে দেয়, বাংলাদেশ একটি চুক্তি করতে চেয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করার কোনো কৌশল অবলম্বন করেনি। জাতিসংঘের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, মিয়ানমারে জাতিগত নিধনযজ্ঞ হয়েছে। জাতিগত উচ্ছেদ অভিযান একটি ঘৃণিত অপরাধ। আন্তর্জাতিক আইনে তা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য। এরই মধ্যে বসনিয়া-হারজেগোভিনা, কঙ্গো, সাইবেরিয়া কিংবা রুয়ান্ডায় যাঁরা জাতিগত উচ্ছেদ অভিযানে জড়িত ছিলেন, সেই সেনা কর্মকর্তাদের বিচার হয়েছে। রায়ও দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একাধিক সেনা কর্মকর্তাকে মিয়ানমারে গণহত্যার জন্য চিহ্নিত করেছে। বাংলাদেশ তাঁদের বিচারের দাবি করতে পারত। তাহলে অন্তত মিয়ানমার সরকার একটা ‘চাপ’-এর মুখে থাকত। কিন্তু বাংলাদেশ তা করেনি। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে একটি ‘সফট ডিপ্লোম্যাসি’র আশ্রয় নিয়েছে। ২৫ আগস্টের (২০১৭) রোহিঙ্গা গণহত্যা ও রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও বাংলাদেশ নিকট-প্রতিবেশী, বিশেষ করে চীন ও ভারতের ‘সাহায্য’ নিয়ে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা বন্ধ করার ব্যাপারে বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। শেষ অব্দি চীন নিজ উদ্যোগে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল এবং সেই প্রস্তাব অনুসরণ করেই মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। আগস্টের পর থেকে সংকটের গভীরতা বাড়লেও, অতিসম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনে গিয়েছিলেন। তিনি রাশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র সফর করেননি। এমনকি ওই সব দেশের সাহায্যও চাননি। অথচ প্রতিটি দেশের সঙ্গে আমাদের ব্যাবসায়িক সম্পর্ক ভালো। এ দেশগুলোকে দিয়ে আমরা মিয়ানমারের ওপর ‘প্রভাব’ খাটাতে পারতাম।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আমাদের অনুকূলে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের পক্ষে। কিছুদিন আগে ঢাকা ঘুরে গেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিজয় গোখলে। তিনিও বলেছেন, ভারত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের প্রশ্নে বাংলাদেশের পাশে থাকবে। কিন্তু জাতিসংঘের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উরসুলা মুয়েলার গেল এপ্রিলে বলেছিলেন, রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার পরিস্থিতি অনুকূল নয়। তাঁর এই বক্তব্য বিশ্ব সম্প্রদায়কে ভিন্ন মেসেজ পৌঁছে দিতে পারে। তারা ‘জোর করে’ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চাইবে না। এমনকি বাংলাদেশ যেখানে আট হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা দিয়েছিল, সেখানে মিয়ানমার জানিয়েছে, তারা মাত্র ৩৮৩ জনকে গ্রহণ করবে। এর অর্থ পরিষ্কার, মিয়ানমার অন্য রোহিঙ্গাদের তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে না। তাহলে এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশ কোথায় আশ্রয় দেবে? ভাসানচরে কিছু বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গার স্থান হবে বটে; কিন্তু বাকিরা থেকে যাবে বৃহত্তর কক্সবাজার এলাকায়। রেডক্রস ও জাতিসংঘের কর্মকর্তার বক্তব্য প্রকারান্তরে রোহিঙ্গাদের উৎসাহ জোগাতে পারে বাংলাদেশে থেকে যেতে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী উ উইন মাইয়াত আই। প্রথমে তিনি কুতুপালং ক্যাম্পে যান। রোহিঙ্গাদের আশ্বস্ত করে এরপর ঢাকায় এসে দেখা করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। রোহিঙ্গাদের তিনি ‘সব কিছু ভুলে’ নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে বলেছেন, তাদের জন্য নতুন নতুন গ্রাম তৈরি করা হবে। রোহিঙ্গাদের NVC বা National Varification Card দেওয়া হবে বলেও তিনি জানান। কিন্তু এই কার্ড নাগরিকত্বের পরিচয় বহন করে না। ফলে প্রশ্ন থাকলই। রোহিঙ্গারা শেষ অব্দি নিজ দেশে ফিরে যেতে পারবে কি না?
গুতেরেস ও কিম বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। গুতেরেস নিজে এখন সাধারণ পরিষদে একটি রিপোর্ট দেবেন। তিনি আন্তর্জাতিক কমিউনিটিকে ‘চাপ’ দেওয়ার কথা বলেছেন বটে; কিন্তু সেটি কিভাবে সম্ভব? জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সত্যিকার অর্থেই কঠিন হবে। ‘চাপ’ প্রয়োগ করার একটি পথ হচ্ছে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ। চীন ও রাশিয়া এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাইবে না। উত্তর কোরিয়া ও ইরানের ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছিল, মিয়ানমারের ক্ষেত্রে তেমনটি না-ও হতে পারে।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্র এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত সমর্থন করবে বলেও মনে হয় না। মিয়ানমারে চীন ও রাশিয়ার যেমনি ‘স্বার্থ’ রয়েছে, ঠিক তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেরও স্বার্থ রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা দু-দুবার মিয়ানমার সফর করেছিলেন। মার্কিন ব্যবসায়ীরা এখন মিয়ানমারে তৎপর। তারা কোনো অবস্থাতেই মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের পক্ষে থাকবে না। তারা বিশাল বিনিয়োগ নিয়ে সেখানে যাচ্ছে। চীন রাখাইন উপকূলে গভীর সমুদ্রে গ্যাস উত্তোলন করছে এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে তা নিয়ে যাচ্ছে ইউনান প্রদেশে। সুতরাং চীন এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যাতে মিয়ানমারের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ফলে মিয়ানমারের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করার বিষয়টি একটি প্রশ্নের মধ্যে থেকে যেতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে গুতেরেস ও কিমের বাংলাদেশ সফর আমাদের অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করবে। আমাদের এখন বিশ্ব আসরে দূতিয়ালি বাড়াতে হবে। শীর্ষস্থানীয় মিয়ানমারের জেনারেলদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের দাবি জানাতে হবে। চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। মিয়ানমার যে কালক্ষেপণ করছে, তা বিশ্ব আসরে তুলে ধরতে হবে। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসছে। এই অধিবেশনে বাংলাদেশ একটি ‘শক্ত’ অবস্থানে যেতে পারে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে আমাদের অবস্থান এখন অনেক শক্তিশালী। এখন প্রয়োজন আন্তর্জাতিক আসরে একটি শক্ত কূটনৈতিক অবস্থান তৈরি করা।
Daily Kalerkontho
08.07.2018