রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

প্রসঙ্গ কোটা সংস্কার

কোটা সংস্কার নিয়ে এখন সর্বত্র আলোচনা। কোটা আন্দোলনকারী কয়েকজন ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত রাশেদের মা সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তিনি ছেলের মুক্তির জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্তি জানিয়েছেন। কয়েকটি দূতাবাস এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে।

সংসদে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা কোটা থাকবে এবং যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল, তাদের ছাড়া হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন হয়েছে। কয়েকজন শিক্ষক এটা নিয়ে একটি মিছিলও করেছেন। সব মিলিয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন আলোচনার অন্যতম একটি বিষয়।

আমার কাছে দুটি বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এক. বিদেশি দূতাবাসগুলোর বিবৃতি; দুই. প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ মন্তব্য। আন্দোলনকারীদের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে কয়েকটি দূতাবাস বিবৃতি দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, সুইজারল্যান্ড, নরওয়ে ও নেদারল্যান্ডস দূতাবাস এসব বিবৃতি দেয়।

দূতাবাসগুলোর ফেসবুকে তা প্রকাশিত হয়। নরওয়ে দূতাবাসের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর ধারাবাহিক হামলার বিষয়টি নিয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সুইজারল্যান্ড দূতাবাস বলছে, যেসব নীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বিভিন্ন স্থানে সমাবেশের ওপর হামলা, সেসব নীতির পরিপন্থী। নেদারল্যান্ডস দূতাবাস উল্লেখ করেছে, মতপ্রকাশ ও সমাবেশ করার অধিকার সার্বজনীন মানবাধিকার।

আর মার্কিন দূতাবাস তাদের ফেসবুক পাতায় উল্লেখ করেছে, ‘বাকস্বাধীনতা, জমায়েতের স্বাধীনতা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকারের মতো যে মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকারগুলো যারা প্রয়োগ করছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছে।’ স্পষ্টতই এ ধরনের বক্তব্যে সরকারের খুশি হওয়ার কথা নয়।

ক্ষমতাসীনদের অনেকেই মনে করছেন, এই আন্দোলনের পেছনে সরকারবিরোধীদের মদদ রয়েছে এবং কোটা সংস্কারের ইস্যুটিকে কাজে লাগিয়ে সরকারবিরোধীরা রাস্তায় সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এখানে অনেক বিষয় আছে।

এক. দূতাবাসগুলো এ ধরনের বিবৃতি দিতে পারে কি না? দুই. তারা আসলে কী বলেছে? তিন. কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে রাজপথের বিরোধী দলের কোনো ইন্ধন আছে কি না? দূতাবাসগুলোর কাজের যে ধরন, তার সঙ্গে বিবৃতির কোনো ‘মিল’ খুঁজে পাওয়া যাবে না।



কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্রদের একটি আন্দোলন। এক্ষেত্রে বিদেশি দূতাবাসগুলো যদি জড়িয়ে যায়, তাহলে তো আগামীতে প্রতিটি ইস্যুতেই তারা বিবৃতি দেবে! এ ধরনের বিবৃতি অনাকাক্সিক্ষত। তবে তারা মানবাধিকার ও সহিংস ঘটনার কথা বলছে। মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি তাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি অংশ। অতীতেও তারা এ ধরনের বিবৃতি দিয়েছে। তবে রাজপথের বিরোধী দল কিংবা অন্য কোনো বিরোধী দলের কোনো ইন্ধন এ কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিল, তা প্রমাণিত নয়। এটা ছাত্রদেরই একটি আন্দোলন এবং ছাত্রদের মাঝেই এটা সীমাবদ্ধ ছিল।

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ। এই কোটা ব্যবস্থায় সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছিল আন্দোলনকারীরা।

এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী কেবিনেট সচিবকে প্রধান করে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিও গঠন করে দিয়েছিলেন। আমার ধারণা, ওই কমিটি যদি সময়ক্ষেপণ না করে সমস্যাটির গুরুত্ব অনুধাবন করে দ্রুততার সঙ্গে একটি প্রাক-প্রতিবেদন জমা দিতেন, তাতে পরিস্থিতি এতদূর গড়াতো না। দেশের বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই বলেছেন, কোটা পদ্ধতি বাতিল নয়, তবে তাতে সংস্কার আনা যেতে পারে। আন্দোলনকারীরাও এটা চাইছে। আমি আমার অনেক ছাত্রের মাঝে এ কোটা নিয়ে এক ধরনের ক্ষোভ দেখেছি।



এরা কোনো ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়। রাজনীতিও করে না। এরা সংস্কার চায়। কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠনের হামলা, হাতুড়ি সংস্কৃতি নতুন এক মাত্রা এনে দিয়েছে। যে ছাত্র সংগঠনের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে, তারা কী করে হাতুড়ি সংস্কৃতির জন্ম দেয়? কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলন নস্যাৎ করতে সন্ত্রাসের আশ্রয় নেয়া কেন? এক সময় আমরা রগকাটা সংস্কৃতির কথা শুনেছিলাম। এখন দেখলাম হাতুড়ি সংস্কৃতি? এতে কী ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য হারাতে বসছে? আমরা কোন পথে যাচ্ছি?

আরও একটি কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাড়িতে হামলা খুব জঘন্য একটি কাজ। উপাচার্য একটি প্রতিষ্ঠান। তার বাড়িতে হামলা, তার নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেই একটি ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়ার নামান্তর। যারাই এ কাজ করেছে, তারা ছাত্র এটা আমি মানতে পারছি না। যারাই এ কাজ করেছে, ফুটেজ দেখে তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা প্রয়োজন। তাই বলে কোনো সাধারণ ছাত্র যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

যদি কোটা নিয়ে আন্দোলনকারীদের কেউ এ কাজ করে থাকে, আমি তার বিচার দাবি করব। কেননা এটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা ছিল না। কিন্তু দু’জন উপাচার্যের কোটাবিরোধী বিরূপ মন্তব্য আমাকে আহত করেছে। আন্দোলনকারীরা তো ছাত্র, সন্তানতুল্য। তাদের সম্পর্কে কি বিরূপ মন্তব্য করা যায়? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেছেন, তিনি আন্দোলনকারীদের মধ্যে জঙ্গিদের ছায়া দেখেছেন।

আমি ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক আখতারুজ্জামান সাহেবকে চিনি। তিনি একজন সজ্জন ব্যক্তি। ভালো মানুষ। বরিশালের আঞ্চলিক টোনেই তিনি কথা বলেন। একাধিকবার তার সঙ্গে টকশো করেছি। তিনি কেন ছাত্রদের জঙ্গিদের আখ্যায়িত করে বক্তব্য দিলেন, আমি তা বুঝতে অপারগ।

যদিও পরে তিনি বলেছেন, তিনি ছাত্রদের জঙ্গিদের সঙ্গে তুলনা করেননি। অপর উপাচার্য আবদুস সোবহান। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সম্প্রতি দ্বিতীয়বারের মতো নিয়োগ পেয়েছেন তিনি। উপাচার্য হওয়ার পরপরই তার বিরুদ্ধে একটা বড় অভিযোগ উঠেছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরকে মিথ্যা তথ্য দেয়ার। আন্দোলনকারীদের তিনি ‘বাম ঘরানার শিবির’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। একজন শিক্ষক তিনি। একজন শিক্ষক হিসেবে তার কি এ ধরনের মন্তব্য করা শোভন?

তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তরিকুল যখন হাতুড়ির আক্রমণে পা ভেঙে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল এবং হাসপাতাল যখন তাকে চিকিৎসা শেষ না করেই ডিসচার্জ করল, তিনি তাকে দেখতে গেলেন না। একজন অভিভাবক যখন তার সন্তানকে আমাদের কাছে রেখে যান, তখন আমরাই তার অভিভাবক। তার দায়িত্ব তো বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাকে হাসপাতালে দেখতে যাওয়ার নৈতিক দায়িত্ব ছিল উপাচার্যের। তিনি তা করেননি। দলীয় রাজনীতি আর কি!



অধ্যাপক আখতারুজ্জামান এর আগে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামও কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। উপাচার্যরা ছাত্রদের পাশে থাকবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকারের পছন্দ অনুযায়ী নিয়োগপ্রাপ্ত উপাচার্যদের কাছে ছাত্রদের দাবি দাওয়ার পরিবর্তে মুখ্য হয়ে দেখা দেয় দলীয় রাজনীতি।

সংবাদপত্রে খবর হয়েছে ঢাবির ১২ বিভাগে ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করেছে গত ১২ জুলাই। গ্রেফতারকৃতদের কেউ কেউ এসব বিভাগের ছাত্র। সহমর্মিতা দেখানোর জন্য এমনটি হতে পারে। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী ক্লাস বর্জন অন্তত শিক্ষক হিসেবে আমি সমর্থন করতে পারি না। ক্লাসে যেতে হবে। ক্লাস বাদ দিয়ে আন্দোলন নয়। কোটা সংস্কার আন্দোলনের ভবিষ্যৎ এখন কোনদিকে আমি বলতে পারব না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর এ আন্দোলন কী এখন মুখ থুবড়ে পড়ল? এটা অস্বীকার করা যাবে না, প্রধানমন্ত্রীর সর্বশেষ ঘোষণার পর কেবিনেট সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির কাজ আরও জটিল হয়ে গেল।

এখন দেখার পালা এ কমিটি কী সিদ্ধান্ত দেয়! মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের কোটা থাকতে পারে। কিন্তু নাতি-নাতনির কোটা থাকা নিয়ে অনেকেই আপত্তি করেছেন। সবচেয়ে বড় কথা মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নিয়ে নানা কথা আছে। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার খবর সংবাদপত্রে একাধিকবার ছাপা হয়েছে। কয়েকজন সচিবের খবর ছাপা হয়েছিল, যারা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে সুবিধা নিয়েছিলেন।

ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করার কাজটি অত সহজ নয়। এমনিতেই প্রশাসনে যোগ্য লোকের সংখ্যা কমছে। বর্তমান বিশ্বে নেগোসিয়েশনের কাজটি অত্যন্ত জটিল। প্রশাসনে যদি যোগ্য লোকের স্থান না হয়, তাহলে নেগোসিয়েশনে আমরা পিছিয়ে পড়ব। এর মধ্যে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেশি মাত্রায় দলীয়করণের কারণে সেখানে দক্ষ শিক্ষক আমরা পাচ্ছি না। আর সিনিয়র শিক্ষকরা অবসরে যাওয়ায় দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি দেখা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। এখন প্রশাসনেও যদি দক্ষ জনবলের ঘাটতি দেখা দেয়, আমাদের জন্য তা ভালো কোনো খবর নয়।

কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটা সুন্দর সমাপ্তি হোক। দিনের পর দিন এভাবে চলতে পারে না। প্রায় এক কোটি তরুণ ভোটার নতুন করে যুক্ত হয়েছে ভোটার তালিকায়। এদের অধিকাংশই ছাত্র। এটা বিবেচনায় নিতে হবে আওয়ামী লীগকে। তরুণ প্রজন্মের সমর্থন পেয়েছিল বিধায় আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল। সুতরাং এবার ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এ তরুণ প্রজন্মের সমর্থন হারাবে কেন আওয়ামী লীগ?

0 comments:

Post a Comment