শরীফ এনামুল কবীর আমাদের ভিসি ছিলেন। তার পদত্যাগের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একজন নতুন ভিসি পেয়েছে। পদত্যাগী উপাচার্য আমাদের বন্ধু মানুষ। ভালো একাডেমিসিয়ান। কিন্তু তার তিন বছরের ‘রাজত্বে’ তিনি যেসব ‘কাজ’ করে গেলেন, তাতে করে ভিসি নামের একটি ‘প্রতিষ্ঠানের’ ওপর থেকে আমার আস্থা উঠে গেছে। কী পেলেন অধ্যাপক কবীর? তাকে নিয়ে প্রকাশ্যে ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিল ছাত্ররা। একাত্তরের ঘাতকদের মতো করে তার ব্যঙ্গচিত্র আঁকা হয়েছিল এবং তা সেঁটে দেয়া হয়েছিল সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনেছি সচিবালয়ের গেটেও নাকি টানিয়ে দেয়া হয়েছিল দু-একটি পোস্টার। তাতে করে কি তার সম্মান বেড়েছে? কোন মুখ নিয়ে তিনি এখন দাঁড়াবেন তার সহকর্মীদের পাশে? চৈতী, তার ‘সন্তান’, ছাত্রী, যখন
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In his Office at UGC Bangladesh
Prof Rahman With US Congressman Joseph Crowley
here you go!!!
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
During his stay in Germany
Prof Dr Tareque Shamsur Rahman
At Fatih University, Turkey during his recent visit.
Prof Dr Tareque Shamsur Rehman
In front of an Ethnic Mud House in Mexico
আবারো সীমান্তে হত্যা
18:44
No comments
আবারো
সীমান্তে হত্যা হয়েছে। গত ২৫ মে একাধিক জাতীয় দৈনিকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে
একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, গত ২৩ মে দিনাজপুরের
ফুলবাড়ী সীমান্তের আমড়া বিওপির সোনাপাড়া, রসুলপুর সীমান্তের ছোট সইচান্দা
গ্রামের মো. নাজের আলী বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এ কথা স্বীকার
করেছেন ফুলবাড়ী ৪০ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল তায়েফ উল
হক (সমকাল, ২৫ মে)। এ ধরনের সীমান্তে হত্যার ঘটনা এই নতুন নয়। প্রায় প্রতি
সপ্তাহেই সীমান্তে হত্যা হচ্ছে এবং নিরপরাধ বাংলাদেশি
উপমহাদেশে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা
16:57
No comments
ভারতে অগি্ন-৫ ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তান কর্তৃক হাতফ গজনবি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানোর ঘটনায় ভারতীয় উপমহাদেশে নতুন করে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা উস্কে দিল। অগি্ন-৫ ও হাতফ গজনবি পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য। এবং দুই দেশের বড় শহরগুলোতে আঘাত হানার জন্য যথেষ্ট। ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষার ঘটনাটি ঘটল এমন এক সময়ে, যখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বেসরকারি সফরে ভারত ঘুরে গেছেন এবং আগামী জুন মাসে সিয়াচেনে সৈন্যসংখ্যা হ্রাস করা নিয়ে দুই দেশ বৈঠকে বসছে। পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার পাশাপাশি গ্যালাপ পোলের একটি প্রতিবেদনও সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে।
তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ধূম্রজাল
16:51
No comments
তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) বৈঠকে অংশ নিতে নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি। গত ৮ মে জেসিসি বৈঠক শেষে যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, তাতে তিস্তার পানি বণ্টনের চুক্তির প্রসঙ্গটি রাখা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে যত দ্রুত সম্ভব তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে দায়বদ্ধ দুই দেশই। দৈনিক যায়যায়দিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে (৯ মে) তিস্তা নিয়ে নয়াদিলি্লর ওপর চাপ বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং নয়াদিলি্ল সফরে দীপু মনি বিষয়টি নিয়ে যে আলোচনা করবেন, সেটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু এখানে নানা বিভ্রান্তি কাজ করছে। যৌথ বিবৃতিতে যখন বলা হচ্ছে 'চুক্তি সম্পাদনে দুই দেশ দায়বদ্ধ', ঠিক তখনই বিবিসির বাংলা বিভাগ আমাদের জানাচ্ছে তিস্তা চুক্তি হচ্ছে না।
সংলাপ কেন জরুরি
16:46
No comments
দেশে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বাকি এখনও দেড় বছর। কিন্তু এরই মধ্যে রাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক ঘটনা ঘটেছে একের পর এক, যা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অস্থির করে তুলেছে। সাবেক রেলমন্ত্রী ও বর্তমান দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের এপিএসের গাড়িতে গভীর রাতে ৭০ লাখ টাকা পাওয়ার ঘটনা এবং ঘটনার রেশ ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই ‘গুম’ হলেন বিএনপির মাঝ সারির এক নেতা। এর প্রতিবাদে বিএনপি তথা ১৮ দল হরতাল করল পাঁচ দিন। ১৭ এপ্রিল ইলিয়াস ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার এক মাস পার হয়ে গেছে অনেক আগেই।
বিএনপির গণঅনশনে
16:36
No comments
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টি অত সহজ নয়। এ
ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধনী আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সংবিধান রেখে
কোনো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যাবে না। প্রশ্ন
হচ্ছে, সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব কে আনবে? সরকার? বিরোধী দল? নাকি সরকারের
কোনো \'বন্ধু\'? এটা তো ঠিক, বিরোধী দল কোনো সংশোধনী আনলে তা সংসদে পাস
করানো যাবে না। তাদের সেই \'সংসদীয় ক্ষমতা\' নেই। একমাত্র সরকার যদি
\'সিদ্ধান্ত\' নেয়, তাহলেই সংবিধান সংশোধনী আনা সম্ভব। সরকার নীতিগতভাবে
একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে জোটভুক্ত কোনো \'দল\'কে দিয়ে এ ধরনের একটি প্রস্তাব
সংসদে উপস্থাপন করতে পারে
গ্রিসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার
18:19
No comments
শেষ পর্যন্ত ইউরোপের দেশ গ্রিসেও একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত
হয়েছে। প্রেসিডেন্ট কারোলোস পাপুলিয়াস শেষবারের মতো চেষ্টা করেছিলেন একটি
কোয়ালিশন সরকার গঠন করার। গেল সপ্তাহে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে
কয়েক দফা বৈঠক করেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সংবিধান অনুযায়ী জুন মাসেই
নির্বাচন দিতে হবে। আর সে জন্যই তিনি একজন বিচারপতির নেতৃত্বে
(প্রানগিওটিস পিকরাসানোস) তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়েছেন, যারা
নির্বাচন পরিচালনা করবেন। গ্রিসের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলে
কিছু নেই। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে গ্রিসের প্রেসিডেন্টকে এ
ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিতে হলো।
প্রশ্নের মুখে ভারতের আশ্বাস
17:16
No comments
অতি সম্প্রতি নয়াদিলি্লতে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরামর্শক কমিশনের (জেসিসি) বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। কমিশনের বৈঠকে অংশ নিতে নয়াদিলি্ল গিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি সেখানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, পানিসম্পদমন্ত্রী প্রণব কুমার বানসালের সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনা করেন। মনমোহন সিং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করেছেন যে, ভারত সরকার তিস্তা চুক্তি ও সীমান্ত প্রটোকলসহ গণচুক্তি বাস্তবায়নে আন্তরিক। এমনকি ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময়ও তিনি টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে মন্তব্য করেছেন যে, ভারত এমন কিছু করবে না যে, তাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের একটা উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে, এই টিপাইমুখ ও তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। দুটো ক্ষেত্রেই এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে।
বারবার আমাদের আশ্বস্ত করা হচ্ছে যে, টিপাইমুখ বাঁধে আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না, অথচ নয়াদিলি্লতে এ ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী সেখানে পানি ধরে রেখে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। ইতিমধ্যে সেখানে ৯ হাজার কোটি রুপি খরচও হয়েছে। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন টিপাইমুখে বাঁধ হলে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল পানিশূন্য হবে। বাংলাদেশের এ আশঙ্কা ও উদ্বেগ ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কাছে পেঁৗছে দেওয়া হয়েছে; কিন্তু তাতে করে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ থেকে ভারতকে বন্ধ রাখা যায়নি। দীপু মনির নয়াদিলি্ল সফরের সময় এবার কথা হল বাংলাদেশের একদল সাংবাদিককে নিয়ে যাওয়া হবে টিপাইমুখে। এতে করে তো বাঁধ নির্মাণ বন্ধ রাখা যাবে না? অতীতে আমাদের বেশ ক'জন সাংসদও গিয়েছিলেন টিপাইমুখে। তারা ফিরে এসে আমাদের জানান, তারা সেখানে কিছুই দেখতে পাননি। এখন সাংবাদিকরা গেলে সেখানে কী দেখতে পাবেন, আমরা তা জানি না।
আমাদের আরেকটা উদ্বেগের জায়গা তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি না হওয়া। গেল বছর সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় এ চুক্তি স্বাক্ষরের কথা ছিল; কিন্তু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণে এ চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানি ভাগাভাগির প্রশ্নে সিকিমও একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সিকিম ইতিমধ্যে তিস্তাকে ব্যবহার করে ২৭টি হাইড্রো পাওয়ার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। এসব কারণে গজলডোবায় আগামীতে কতটুকু পানি পাওয়া যাবে, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। পত্রপত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, একই নদীর ওপর এনএইচসিসির ২টি প্রকল্প রয়েছে_ ৩৩২ মেগাওয়াটের একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পে রয়েছে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র।
এ কারণে তিস্তায় যথেষ্ট পানি থাকার কথা নয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর উত্তরবঙ্গ উন্নয়নে যথেষ্ট উদ্যোগ নিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। এর অংশ হিসেবে ২৫ বছর আগে তৈরি ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁহাতি খালে তিস্তা থেকে পানি নিয়ে এসে ছাড়া হয়েছে। এতে করে উপকৃত হয়েছে সেখানকার ১১ হাজার হেক্টর জমির সেচ কাজ। বাংলাদেশকে না জানিয়ে উজানে পশ্চিমবঙ্গ সরকার পানি প্রত্যাহার করে নিতে পারে কি-না, সেটা একটা বর প্রশ্ন হয়েই রইল। বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে খোঁজ খবর করতে পারে।
২০০৯ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার 'জাতীয় প্রকল্প' হিসেবে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের ৬টি জেলার ৯ লাখ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০১৫ সালে। এই ব্যারাজ পুরোপুরিভাবে চালু হলে বাংলাদেশের পানি প্রাপ্তি যে কমে যাবে, তা নয়, বরং ড্যাম সংলগ্ন এলাকায় ভূমি ধস বৃদ্ধি পাবে, নদীতে নুড়ি পাথরের প্রবাহ বাড়বে, বিপুল পলি বাংলাদেশ প্রবেশ করে বাংলাদেশের নদী ভরে ফেলবে। ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বাড়বে। ইতিমধ্যে ভারত নিয়ন্ত্রিত গজলডোবা ব্যারাজের বিরূপ প্রভাবে লালমনিরহাটের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া তিস্তাসহ ছোট-বড় ১২টি নদী নাব্য হারিয়ে আবাদি জমিও খেলার মাঠে পরিণত হয়েছে 'আমার দেশ, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১২)। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুমারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ীর কাছে ডিমলা উপজেলার ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী।
ছাতনাই থেকে এ নদী ডিমলা, জলঢাকা, লালমনিরহাটের সদর, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট এরিয়ার প্রায় ১ হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৮৩ সালের জুলাইয়ে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫ ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; কিন্তু ওই সিদ্ধান্তে তিস্তার পানি প্রবাহের পরিমাণ বা কোন জায়গায় পানি ভাগাভাগি হবে_ এ রকম কোনো বিষয় উল্লেখ না থাকায় তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
অন্যদিকে ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দু'দেশের মাঝে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। শুধু তাই নয়, ভারত তিস্তা ব্যারাজের সেচ এলাকা কমিয়ে দ্বিতীয় প্রকল্প বাতিল করার জন্য চাপ দেয় এবং সর্বশেষ এক চিঠিতে তিস্তার মাত্র ২০ ভাগ পানি ভাগাভাগি করার বিষয়টি জানিয়ে দিয়ে চরম হঠকারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। ১৯৮৫ সালে ভারত তিস্তার উৎসমুখে গজলডোবা নামক স্থানে গজলডোবা ব্যারাজ নির্মাণ করায় শুষ্ক মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পটি সেচ প্রদানে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এ সেচ প্রকল্পের উপকৃত এলাকা ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর। ইরিগেবল এরিয়ার (কৃষিযোগ্য ভূমি) ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর।
বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ উপজেলার শাহগিন্দি নামক স্থানে ২৪ কোটি ৮৬ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ব্যায়ে দ্বিতীয় তিস্তা প্রকল্পের যে কাজ শুরু করেছে, তা বাস্তবায়িত হলে রংপুর, গাইবান্ধা, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার ৪ লাখ ৪৮ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসবে। এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হলে অতিরিক্ত প্রায় ১৬.২১ লাখ মেট্রিক টন ধান ও ৪৩ হাজার টন গম উৎপাদিত হবে। এর বাজার দর ২০ হাজার কোটি টাকার উপরে; কিন্তু প্রধান নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে এখন পানি শূন্যতায় অসংখ্য চরের মরুদ্বীপে রূপান্তরিত হয়েছে। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদপত্রে (যুগান্তর) প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, তিস্তা ব্যারাজে পানি প্রবাহ কমতে শুরু করেছে।
একদিনের ব্যবধানে কমেছে ২ হাজার কিউসেক। ১৩ ফেব্রুয়ারি পানির পরিমাণ যেখানে ছিল ৪ হাজার কিউসেফ, পরের দিন তা কমে এসে দাঁড়ায় ২ হাজার কিউসেকে। সেচনির্ভর বোরো আবাদে তিস্তার সেচ কমান্ড এলাকায় পর্যাপ্ত পানি প্রয়োজন এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। এভাবে পানি কমে গেলে বোরো আবাদ চরমভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এই যখন পরিস্থিতি, তখন তিস্তার পানি ভাগাভাগিতে নতুন যে ফর্মুলার কথা শোনা যাচ্ছে; কিন্তু তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হবে না। তিস্তার উজানে পানির প্রবাহ আরো হ্রাস পাবে। ফলে আগামী দিনগুলোতে বোরো আবাদে নীলফামারী, দিনাজপুরও রংপুর জেলার ১৩ উপজেলায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ৪৪ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হবে না। এতে করে বাংলাদেশ বড় ধরনের খাদ্য ঘাটতির সম্মুখীন হতে পারে।
ইতিমধ্যেই বিষয়টি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে। গত ১০ মে বিবিসির বাংলা বিভাগ আমাদের জানায় যে, তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আদৌ কোনো চুক্তি হচ্ছে না। কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দীপু মনি বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। এমনকি আমাদের পররাষ্ট্র উপদেষ্টাও বিষয়টি স্বীকার করে নেননি। কিন্তু তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে জট যে লেগেছে, তা-তো অস্বীকার করা যাবে না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এ মুহূর্তে শরিকদের ভূমিকাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এ মুহূর্তে মনমোহন সিংয়ের কাছে বাংলাদেশের চেয়ে মমতা ব্যানার্জির গুরুত্ব অনেক বেশি। জোট সরকারে কংগ্রেসের পরেই তৃণমূল কংগ্রেসের অবস্থান। মমতাকে চটাতে চায় না কেন্দ্র। ২০১৪ সালে ভারতের সাধারণ নির্বাচন।
মমতাকে চটিয়ে আবার মমতাকে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোটে ঠেলে দিতে চায় না কংগ্রেস। অতীতে তো মমতা বিজেপির সঙ্গেই ছিলেন। এমনি এক পরিস্থিতিতে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি আটকে যেতে পারে। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন। মমতা নিজেও তার জনপ্রিয়তা হারাবেন না। দীপু মনি নয়াদিলি্লতে একটা কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন তিস্তার পানিবণ্টনের চুক্তি না হলে, তা দু'দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। মিথ্যা বলেননি দীপু মনি। ভারত বার বার আশ্বাস দেবে; কিন্তু সমস্যার সমাধানে কোনো উদ্যোগ নেবে না, তা কাম্য নয়। আমরা অবশ্যই চাইব তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি হোক এবং তাতে যেন বাংলাদেশের স্বার্থ থাকে। ২০১৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশেও নির্বাচন হবে। তিস্তার পানি বণ্টনের বিষয়টি যে একটি ফ্যাক্টর হয়ে যাবে, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। তাই দু'দেশের সম্পর্ককে আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে হলে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টির সমাধান করতে হবে। শুধু ভারতীয় আশ্বাসে আমরা ভরসা রাখতে পারছি না
Daily DESTINY
23.5.12
জেসিসি বৈঠক নিয়ে কিছু কথা
04:44
No comments
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জেসিসি বা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরামর্শক কমিশনের প্রথম বৈঠক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। জেসিসি বৈঠক শেষে যে যৌথ বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে চিহ্নিত সীমান্ত ও অপদখলীয় ভূমির নকশা স্বাক্ষরসহ স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রটোকল দ্রুত বাস্তবায়নে দু’দেশ সম্মত হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে আমার কাছে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে, তা হচ্ছে বন্দি বিনিময় চুক্তি দ্রুত স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত। এর বাইরে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সহযোগিতা, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়, আশুগঞ্জে ভারতীয় সহায়তায় একটি কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপন, বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ ইত্যাদি যেসব বিষয় স্থান পেয়েছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, যেমন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ, ছিটমহল বিনিময়, ভারতীয় ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে জটিলতা, সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির ক্ষেত্রেও কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত আমরা পাইনি।
যৌথ বিবৃতিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা কূটনৈতিক ভাষা। এখানে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতীয় ইচ্ছাই প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন বন্দিবিনিময় চুক্তি। এ ব্যাপারে নীতিগতভাবে দু’দেশ সম্মত হয়েছে। এখন শুধু চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষা। অনেকেই জানেন, এই চুক্তিটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারত মূলত একটি জিনিসই চায়Ñ আর তা হচ্ছে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত পেতে। অনুপ চেটিয়া এখন বাংলাদেশের জেলে আটক। বন্দিবিনিময়ের যে চুক্তিটি হতে যাচ্ছে, তাতে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি নিজ দেশে সাজা খাটার সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে অনুপ চেটিয়া ভারতে সাজা খাটতে পারেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এই মুহূর্তে অনুপ চেটিয়াকে অত্যন্ত দরকার। উলফা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার একটা আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। উলফার চেয়ারম্যান এখন তাদের কব্জায়। এ জন্যই তাদের অনুপ চেটিয়াকে দরকার। কিন্তু বিষয়টি কি অত সহজ হবে? অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে একটি আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। তার সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। এ অবস্থায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী কোন ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানো যায় কিনা, তা এক প্রশ্ন বটে। যে কোন আন্তর্জাতিক আইনের এটা পরিপন্থী। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য।
তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে এ সংক্রান্ত কোন দিকনির্দেশনা না থাকলেও বিবিসির বাংলা বিভাগ (৯ মে) আমাদের জানাচ্ছে যে, তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আদৌ কোন চুক্তি হচ্ছে না। এ কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেয়া হয়েছে। যদিও দীপু মনি তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত প্রতিশ্র“তি দিলেও এখন অবধি কোন চুক্তি হয়নি। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। কিন্তু ভারত আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারত আমাদের বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার বলেছেন, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? নয়াদিল্লিতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার। প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপিও ব্যয় করা হয়ে গেছে। বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে, তা একাধিক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা হল আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারছি না। জেসিসির যৌথ ইশতেহারে এ সংক্রান্ত কোন কথা নেই। গঙ্গা চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এর আগেই পদ্মায় পানি নেই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। ২০২৭ সালে লোকসংখ্যা বাড়বে ৩ গুণ। যে বিপুল পানির চাহিদা থাকবে, তার কী হবে? চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা নিচ্ছি কই? জেসিসির সভায় আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি।
সীমান্ত হত্যা আজও বন্ধ হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও একের পর এক সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই যেখানে বিজিবির গুলিতে কোন ভারতীয় নাগরিক মারা গেছেন। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন নিরপরাধ বাংলাদেশী নাগরিক। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৪০ মাসে কতজন বাংলাদেশী মারা গেছেন, তার পরিসংখ্যান ‘অধিকার’-এর কাছে আছে। এ নিয়ে কত শীর্ষ বৈঠক হল। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয়নি। জেসিসির বৈঠকে এটা নিয়ে কিছু বলা হল না। সীমান্ত চিহ্নিত ও অপদখলীয় ভূমির নকশা স্বাক্ষরের ওপর জেসিসি বৈঠকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারে আমরা কিছুই শুনলাম না। ভারতের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা ভারতেই থাকতে চান। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবেই থাকতে চান। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তারপর কখনোই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেয়নি সংবিধান সংশোধন করার। সমস্যাটা তো আমাদের নয়, সমস্যা ভারতের। আজ প্রায় ৩৮ বছর পরও এ কথাগুলো আমাদের বলতে হয়। এটা কি ভারতের সদিচ্ছা প্রমাণ করে?
১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলার অনুদানের কথা বলে গেলেন। কিন্তু ঋণের টাকা দিয়ে তো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না! ১৩ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। ২০১১-১২ সালের পরিসংখ্যান এখন আমাদের হাতে আসবে, ধারণা করছি তা ৪ বিলিয়ন ডলারের অঙ্ককে ছাড়িয়ে যাবে। ভারত মাঝেমধ্যে কিছু পণ্যের শুল্কমূল্য প্রবেশাধিকারের কথা বলে বটে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ এসব পণ্যের অনেকগুলোই রফতানি করে না। ভারতের অশুল্ক বাধা দূর করা নিয়েও ‘নানা কাহিনী’ আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নানা ধরনের শুল্ক দূর করা যাচ্ছে না। ভারতে বাংলাদেশের রফতানি সেই তুলনায় বাড়ছে না। ফলে ঘাটতি বাড়ছেই। এটা আমাদের জন্য শংকার কারণ।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি যৌথ ইশতেহারে আছে বটে। কিন্তু ২০১৩ সালে আমরা আদৌ বিদ্যুৎ পাব, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশ বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের মুখে। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বন্ধ অনেক কারখানায়। অথচ ভারত যদি আন্তরিক হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভুটানে সারপ্লাস বিদ্যুৎ রয়েছে। এই বিদ্যুৎ ভুটান বাংলাদেশে রফতানি করতে পারে। কিন্তু সম্মতি প্রয়োজন ভারতের। দুর্ভাগ্যজনক, ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি।
আশুগঞ্জে যে কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের কথা যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছে, তাতে লাভবান হবে ভারত। আমরা লাভবান হব না। ভারত তার পণ্যের পরিবহন সুবিধার জন্যই এই টার্মিনাল ব্যবহার করছে। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে আমরা ভারতীয় কনটেইনারগুলো পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছি। ভারত প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে, আমাদের স্বার্থ হয়ে পড়েছে গৌণ। এবার জেসিসির বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহারে যেসব বক্তব্য স্থান পেয়েছে, তাতে ওই ভারতীয় স্বার্থকেই বেশি করে প্রাধান্য দেয়া হল মাত্র।
বাংলাদেশীরা খুবই অতিথিপরায়ণ। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে পায়েস রান্না করে তাকে খাইয়েছেন। কত আন্তরিক হলে আমাদের সরকারপ্রধান এ কাজটি করতে পারেন! আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো নয়াদিল্লিতে পদ্মার ইলিশ, মিষ্টি আর সিরামিকের উপহার সামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলেন। এটা তো মিথ্যা নয়। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ইলিশ কূটনীতি’ কি আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে? আমরা কি আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে পেরেছি? যৌথ ইশতেহারের ভাষাই বলে দেয় আমাদের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। আমরা বারবার আশ্বাস পাচ্ছি। ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। আমরা আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি, দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কৌশল অবলম্বন করতে আমাদের ব্যর্থতা, জাতিসংঘ সনদের ১(৭) ধারা অনুযায়ী সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে আমাদের ব্যর্থতা আমাদের সব ‘অর্জন’কে ম্লান করে দিয়েছে। হিলারি ক্লিনটন ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশকে ‘সফট পাওয়ার’ (ঝড়ভঃ চড়বিৎ) হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু আমাদের এই মর্যাদা আমরা ধরে রাখতে পারব না, যদি না আমরা ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে না পারি।
Daily JUGANTOR
19.5.12
জাবির ‘কালো বিড়াল’!
18:17
No comments
সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে ‘কালো বিড়াল’র কাহিনী যখন সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, ঠিক তখনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘কালো বিড়াল’র কাহিনী ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে (যুগান্তর) গত ৪ মে। সংবাদটিতে বলা হয়েছে চাকরি দেয়ার নাম করে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে আটক হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারী। নাম তার জসিমুদ্দিন। অনেকটা সেই এপিএস ওমর ফারুকের ৭০ লাখ টাকার কাহিনীর মতো। কী অদ্ভুত এক মিলÑ অভিযুক্ত ওমর ফারুকও ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অভিযোগে বলা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নাম করে এই অর্থ সংগ্রহ করেছিল জসিমুদ্দিন। তিনি যে সেকশনে চাকরি করেন, সেই সেকশনের প্রধানও স্বীকার করেছেন এর সত্যতা। তাহলে কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা। ভিসি বিরোধী আন্দোলনকারী ‘শিক্ষক সমাজ’ ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাও দীর্ঘদিন ধরে এ কথাটাই বলে আসছিলেন যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদায়ী উপাচার্যের সময় শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি জড়িত। এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় অভিযুক্ত জসিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে জাবির অ্যাকাউন্টস অফিসার আবদুস সাত্তার কর্তৃক আশুলিয়া থানায় মামলা দায়ের করার পর। তখন ‘শিক্ষক সমাজ’র অভিযোগটি প্রমাণিত হলো। শিক্ষক নিয়োগেও এই ‘টাকার খেলা’ হয়েছে। দুই থেকে তিনজন শিক্ষকের নাম পত্র-পত্রিকায়ও উঠে এসেছে, যারা টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে কর্তৃপক্ষকে ‘সহযোগিতা’ করেছেন। কিছুদিন আগে আমার কাছেও এ ধরনের একটি লিখিত অভিযোগ এসেছিল। সেদিন আমি গুরুত্ব দেইনি।
দীর্ঘ তিন মাসের আন্দোলনে আপাতত একটি সমাধান পাওয়া গেছে। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের অনশন ভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে তা কি ফিরে পাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়? ভিসি পদটি ছেড়ে দিলেও গত তিন মাসে যেসব প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, সেসব প্রশ্নের কোনো সমাধান পাওয়া যাবে কি-না, আমরা সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নই। এর আগে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের দু’জন শিক্ষককে রেজিস্ট্রার বলেছেন শিক্ষক গ্রেপ্তারের ঘটনা তিনি জানেন না। তাহলে কে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল? একজন ক্রিমিনালের মতো দু’জন শিক্ষককে গভীর রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবেÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে তাতে করে কি উপাচার্যের সম্মান থাকে। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। বিভাগের সভাপতি নিজেই বিতর্কিত একজন ব্যক্তি। কিছুদিন আগে বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষিকাকে (যিনি তার শিক্ষকও বটে) অসম্মানিত করার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। শিক্ষক সমিতির ওই ঘটনার বিচারও চেয়েছিল। উপাচার্য মহোদয়ের উচিত ছিল ওই বিভাগের ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া। তার শৈথিল্যের সুযোগেই ওই বিভাগের সভাপতিকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর শিক্ষক কর্তৃক ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্ষমতার অপব্যবহার করার কারণে একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতিকে লাঞ্ছিত করেছিলেন আরেক শিক্ষক, যিনি উপাচার্যের খুব আস্থাভাজন একজন জুনিয়র শিক্ষককে লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছিল। তারও বিচার হয়নি আজো। নৃবিজ্ঞান বিভাগেও একজন সিনিয়র শিক্ষক কর্তৃক একজন জুনিয়র শিক্ষককে লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছিল। তারও বিচার হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে একের পর এক অনিয়ম হচ্ছে। পরীক্ষায় অতিরিক্ত নাম্বার দিয়ে বিশেষ বিশেষ ছাত্রকে প্রথম শ্রেণী পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে কোনো একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে, একজন সিনিয়র শিক্ষককে অসম্মানিত করার অভিযোগও রয়েছে দু’জন জুনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধে তারও বিচার করেননি উপাচার্য মহোদয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এবং দলীয় শিক্ষকরা এসব ঘটনার সাথে জড়িত। কোনো একটি ঘটনারও যদি বিচার হতো, তাহলে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটত না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি আজ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে কোনো শুভবুদ্ধির মানুষ এখন আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আসবেন না। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা উপাচার্য অফিসের সম্মুখে উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। একজন উপাচার্যের জন্য এর চেয়ে আর অসম্মানজনক কিছু হতে পারে না। উপাচার্য মহোদয়ের অতীতের সব অর্জন এখন ভেস্তে গেল। একজন শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে তার জন্য আমার কষ্ট হয়। একজন উপাচার্য এভাবে অপমানিত হবেন, তা তো কাম্য হতে পারে না। উপাচার্যের পদটি অনেক সম্মানের। উপাচার্য মহোদয় অনেকগুলো কাজ ‘সঠিক’ করেননি। অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন ছিল না। দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, বিভাগে অতিরিক্ত শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও (যাদের আদৌ কোর্স দেয়া যাচ্ছে না) নতুন করে শিক্ষক নিয়োগে, কোনো কোনো বিভাগে সিনিয়র শিক্ষকের পরিবর্তে প্রভাষক নিয়োগ দিয়ে একটা ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করা, দলীয় শিক্ষকদের কন্যা ও তাদের স্বামীদের কিংবা ছেলেকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, কর্মচারী নিয়োগে গোপালগঞ্জের আধিবাসীদের একচ্ছত্রভাবে নিয়োগ দেয়া, সর্বোপরি সব ধরনের নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ জাবির উপাচার্যের পদটিকে অসম্মানিত করেছে। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর এসব ঘটনায় কতটুকু ‘উপকৃত’ হয়েছেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু গত তিন মাস যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ ছাপা হয়ে আসছে, তখন নিজেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি আপাতত আছেন বটে। কিন্তু আর কতদিন, সেটাই প্রশ্ন।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো। অনশন প্রত্যাহার করা হলো। কিন্তু তাতে করে কি এই আন্দোলন বন্ধ হবে? যাদের দিয়ে তিনি সংলাপ কমিটি গঠন করেছিলেন, তারা কোনো সমাধান দিতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। উপাচার্য মহোদয়ের হিসেবে কিছুটা ‘ভুল’ হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসুক, আমি তা চাই। উপাচার্য মহোদয় ছাত্র-শিক্ষকদের অনশনের আগে যে কাজটি করতে পারতেন, তা হচ্ছে; ১. ‘শিক্ষক সমাজের’ নেতৃবৃন্দের সাথে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করা; ২. উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা এবং সে লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা; ৩. ‘অযোগ্য’ শিক্ষকদের নিয়োগ বাতিল অথবা তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য একটি ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করা। এতে ‘শিক্ষক সমাজ’-এর প্রতিনিধি ও শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; ৪. শিক্ষকদের ওপর হামলায় যাদের নাম পত্র-পত্রিকায় এসেছে, তাদের আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা; ৫. ‘পাারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের’ প্রবণতারোধ করার লক্ষ্যে সিন্ডিকেটে অতি দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নেয়া; ৬. ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করার ওপর যে সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট নিয়েছিল, তা বাতিল করা; ৭. শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সকল নিয়োগ স্থগিত রাখা।
আমি জানি শিক্ষক সমাজের এই আন্দোলন কোনো দলের আন্দোলন নয়। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো চান। ক্লাসে ফিরে যেতে চান। এদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটি ছিল উপাচার্য মহোদয়ের। কিন্তু তা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে ছাত্র-শিক্ষকদের দীর্ঘদিন অনশনে যেতে হয়েছিল। এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রইল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।
একজন উপাচার্য যাবেন, আরেকজন উপাচার্য আসবেন। এটাই নিয়ম। কিন্তু উপাচার্য মহোদয় যে কাজটি করলেন ছাত্রদের লেলিয়ে দিলেন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, পাল্টা শিক্ষকদের দিয়ে একটি ‘মঞ্চ’ তৈরি করলেন- তাতে করে সুধী সমাজে তার ভাবমূর্তি বেড়েছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে ছাত্র-শিক্ষকরা অনশন করেছেন, কিংবা তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে, এ তথ্য আমার জানা নেই। এটা সত্যিই দুঃখজনক। এই তিন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ‘ক্ষতি’ হয়েছে। ‘সেশনজট’র হুমকির মুখে এখন বিশ্ববিদ্যালয়টি। উপাচার্য হয়ত চলে যাবেন। উপাচার্য ‘খেদাও’ আন্দোলনে আজ যারা জড়িত ছিলেন, কিংবা যারা উপাচার্যের পক্ষাবলম্বন করেছেন, তাদের সবার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সেই সাথে দুর্নীতির ‘কালো বিড়াল’র সাথে যারাই জড়িত থাকুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।
যায়যায়দিন 15 মে 2012
দীর্ঘ তিন মাসের আন্দোলনে আপাতত একটি সমাধান পাওয়া গেছে। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের অনশন ভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে তা কি ফিরে পাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়? ভিসি পদটি ছেড়ে দিলেও গত তিন মাসে যেসব প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, সেসব প্রশ্নের কোনো সমাধান পাওয়া যাবে কি-না, আমরা সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নই। এর আগে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের দু’জন শিক্ষককে রেজিস্ট্রার বলেছেন শিক্ষক গ্রেপ্তারের ঘটনা তিনি জানেন না। তাহলে কে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল? একজন ক্রিমিনালের মতো দু’জন শিক্ষককে গভীর রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবেÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে তাতে করে কি উপাচার্যের সম্মান থাকে। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। বিভাগের সভাপতি নিজেই বিতর্কিত একজন ব্যক্তি। কিছুদিন আগে বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষিকাকে (যিনি তার শিক্ষকও বটে) অসম্মানিত করার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। শিক্ষক সমিতির ওই ঘটনার বিচারও চেয়েছিল। উপাচার্য মহোদয়ের উচিত ছিল ওই বিভাগের ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া। তার শৈথিল্যের সুযোগেই ওই বিভাগের সভাপতিকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর শিক্ষক কর্তৃক ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্ষমতার অপব্যবহার করার কারণে একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতিকে লাঞ্ছিত করেছিলেন আরেক শিক্ষক, যিনি উপাচার্যের খুব আস্থাভাজন একজন জুনিয়র শিক্ষককে লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছিল। তারও বিচার হয়নি আজো। নৃবিজ্ঞান বিভাগেও একজন সিনিয়র শিক্ষক কর্তৃক একজন জুনিয়র শিক্ষককে লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছিল। তারও বিচার হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে একের পর এক অনিয়ম হচ্ছে। পরীক্ষায় অতিরিক্ত নাম্বার দিয়ে বিশেষ বিশেষ ছাত্রকে প্রথম শ্রেণী পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে কোনো একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে, একজন সিনিয়র শিক্ষককে অসম্মানিত করার অভিযোগও রয়েছে দু’জন জুনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধে তারও বিচার করেননি উপাচার্য মহোদয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এবং দলীয় শিক্ষকরা এসব ঘটনার সাথে জড়িত। কোনো একটি ঘটনারও যদি বিচার হতো, তাহলে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটত না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি আজ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে কোনো শুভবুদ্ধির মানুষ এখন আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আসবেন না। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা উপাচার্য অফিসের সম্মুখে উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। একজন উপাচার্যের জন্য এর চেয়ে আর অসম্মানজনক কিছু হতে পারে না। উপাচার্য মহোদয়ের অতীতের সব অর্জন এখন ভেস্তে গেল। একজন শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে তার জন্য আমার কষ্ট হয়। একজন উপাচার্য এভাবে অপমানিত হবেন, তা তো কাম্য হতে পারে না। উপাচার্যের পদটি অনেক সম্মানের। উপাচার্য মহোদয় অনেকগুলো কাজ ‘সঠিক’ করেননি। অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন ছিল না। দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, বিভাগে অতিরিক্ত শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও (যাদের আদৌ কোর্স দেয়া যাচ্ছে না) নতুন করে শিক্ষক নিয়োগে, কোনো কোনো বিভাগে সিনিয়র শিক্ষকের পরিবর্তে প্রভাষক নিয়োগ দিয়ে একটা ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করা, দলীয় শিক্ষকদের কন্যা ও তাদের স্বামীদের কিংবা ছেলেকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, কর্মচারী নিয়োগে গোপালগঞ্জের আধিবাসীদের একচ্ছত্রভাবে নিয়োগ দেয়া, সর্বোপরি সব ধরনের নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ জাবির উপাচার্যের পদটিকে অসম্মানিত করেছে। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর এসব ঘটনায় কতটুকু ‘উপকৃত’ হয়েছেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু গত তিন মাস যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ ছাপা হয়ে আসছে, তখন নিজেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি আপাতত আছেন বটে। কিন্তু আর কতদিন, সেটাই প্রশ্ন।
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো। অনশন প্রত্যাহার করা হলো। কিন্তু তাতে করে কি এই আন্দোলন বন্ধ হবে? যাদের দিয়ে তিনি সংলাপ কমিটি গঠন করেছিলেন, তারা কোনো সমাধান দিতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। উপাচার্য মহোদয়ের হিসেবে কিছুটা ‘ভুল’ হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসুক, আমি তা চাই। উপাচার্য মহোদয় ছাত্র-শিক্ষকদের অনশনের আগে যে কাজটি করতে পারতেন, তা হচ্ছে; ১. ‘শিক্ষক সমাজের’ নেতৃবৃন্দের সাথে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করা; ২. উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা এবং সে লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা; ৩. ‘অযোগ্য’ শিক্ষকদের নিয়োগ বাতিল অথবা তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য একটি ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করা। এতে ‘শিক্ষক সমাজ’-এর প্রতিনিধি ও শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; ৪. শিক্ষকদের ওপর হামলায় যাদের নাম পত্র-পত্রিকায় এসেছে, তাদের আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা; ৫. ‘পাারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের’ প্রবণতারোধ করার লক্ষ্যে সিন্ডিকেটে অতি দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নেয়া; ৬. ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করার ওপর যে সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট নিয়েছিল, তা বাতিল করা; ৭. শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সকল নিয়োগ স্থগিত রাখা।
আমি জানি শিক্ষক সমাজের এই আন্দোলন কোনো দলের আন্দোলন নয়। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো চান। ক্লাসে ফিরে যেতে চান। এদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটি ছিল উপাচার্য মহোদয়ের। কিন্তু তা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে ছাত্র-শিক্ষকদের দীর্ঘদিন অনশনে যেতে হয়েছিল। এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রইল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।
একজন উপাচার্য যাবেন, আরেকজন উপাচার্য আসবেন। এটাই নিয়ম। কিন্তু উপাচার্য মহোদয় যে কাজটি করলেন ছাত্রদের লেলিয়ে দিলেন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, পাল্টা শিক্ষকদের দিয়ে একটি ‘মঞ্চ’ তৈরি করলেন- তাতে করে সুধী সমাজে তার ভাবমূর্তি বেড়েছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে ছাত্র-শিক্ষকরা অনশন করেছেন, কিংবা তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে, এ তথ্য আমার জানা নেই। এটা সত্যিই দুঃখজনক। এই তিন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ‘ক্ষতি’ হয়েছে। ‘সেশনজট’র হুমকির মুখে এখন বিশ্ববিদ্যালয়টি। উপাচার্য হয়ত চলে যাবেন। উপাচার্য ‘খেদাও’ আন্দোলনে আজ যারা জড়িত ছিলেন, কিংবা যারা উপাচার্যের পক্ষাবলম্বন করেছেন, তাদের সবার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সেই সাথে দুর্নীতির ‘কালো বিড়াল’র সাথে যারাই জড়িত থাকুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।
যায়যায়দিন 15 মে 2012
হিলারী কি মেসেজ দিয়ে গেলেন
18:10
No comments
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ২৪ ঘণ্টা সফরে তিনি কী মেসেজ দিয়ে গেলেন? এ প্রশ্ন এখন অনেকের মধ্যেই। সরকারি ও বিরোধী উভয় দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মন্তব্যের মধ্য থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তারা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে এ সফরকে দেখছেন। এ ক্ষেত্রে মওদুদ আহমদের বক্তব্যে এক ধরনের \'আশাবাদ\' থাকলেও অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যে হতাশাই প্রতিফলিত হয়েছে। তবে হিলারি ক্লিনটন স্পষ্টতই একটি মেসেজ দিয়ে গেছেন। এ মেসেজটি যে শুধু সরকারের জন্যই প্রযোজ্য, তা নয়। বরং বিরোধী দলের জন্যও প্রযোজ্য। এর একটি নেগেটিভ দিক আছে। আছে পজিটিভ দিকও। এভাবে একজন বিদেশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মন্তব্য করবেন, দিকনির্দেশনা দেবেন, এটি কাম্য নয়। আগামী নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, কিংবা হরতাল করা ঠিক কি ঠিক নয়, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে এ দেশের জনগণ। দেশে সংসদ আছে। সেখানে বিরোধী দলের প্রতিনিধিত্বও আছে। সংসদই সিদ্ধান্ত নেবে। এ ক্ষেত্রে হিলারি ক্লিনটনের মতো একটি \'হার্ড পাওয়ার\'-এর একজন নেতা যখন এ ধরনের মন্তব্য করেন, তখন তা জাতিসংঘের ১(৭) ধারা লঙ্ঘন করার শামিল। এটি একটি নেগেটিভ দিক। তবে পজিটিভ দিক হচ্ছে হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যে যে \'দিকনির্দেশনা\' রয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও দুটি বড় দলের জন্য এটি একটি মেসেজ! এ মেসেজগুলো যদি আমরা অনুসরণ করতে পারি, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। প্রথমত, \'সংলাপ\' হলে ক্ষতির চেয়ে লাভের সম্ভাবনাই বেশি। যদিও অতীতে সংলাপের অভিজ্ঞতা ভালো নয়। জলিল-মান্নান ভঁূইয়া সংলাপ আমাদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারেনি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্নতর। সংলাপ হওয়া উচিত এবং তাতে অন্তত উত্তেজনা আমরা হ্রাস করতে পারব। দ্বিতীয়ত, একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করা। এটি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, তার কোনো মানে নেই। অন্য কোনো নামেও এটি হতে পারে। সরকারের একটি প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে বর্তমান সংবিধান। বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বিএনপিরও কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই। বিএনপি চাচ্ছে, সরকার সংবিধান সংশোধন করুক। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন না করেও সংসদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এখানে বিভিন্ন \'ফর্মুলা\' নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা, মহাজোটের শরিকরাও চায় আগামী নির্বাচন হোক একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায়। এ নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো কী হবে, এটা নিয়েই সংলাপ জরুরি। বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে, সংসদ সদস্যদের নিজেদের \'পদ\' বজায় রেখে (যা সংবিধান সম্মত) যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সরকার ভালো করবে যদি বিরোধী দলসহ সব দলের সঙ্গে একটি সংলাপ শুরু করে। এতে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়বে। তৃতীয়ত, হরতাল আহ্বান না করা। হরতাল এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ। অতীতেও হরতাল হয়েছে। বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য। তবে সব ক্ষেত্রে দাবি-দাওয়া আদায় হয় না। সাম্প্রতিক সময়ের যে হরতাল, সেই হরতালের পেছনে যুক্তি আছে। ইলিয়াস আলীকে কে বা কারা \'গুম\' করল রাষ্ট্র তা জানবে না, তা হতে পারে না। বিএনপি এ ইস্যুতে হরতাল ডেকেছে। হরতাল পালন করার মধ্য দিয়ে ইলিয়াস আলী ফিরে আসেনি। এটি দুঃখজনক। এ ইস্যুতে ভবিষ্যতে হরতাল দিয়ে কোনো লাভ হবে বলে আমার মনে হয় না। হরতালে দেশের ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা তো ক্ষতিগ্রস্ত হনই, সবচেয়ে বড় কথা বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগকারীরা কিংবা আরএমজির ক্রেতারা বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। সরকারের এটি বোঝা উচিত কেন বিরোধী দল হরতাল দেয়। সেই \'পরিস্থিতি\' যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। চতুর্থত, ইলিয়াস আলীর পাশাপাশি শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অন্তর্ধান (পরবর্তী সময়ে হত্যা) রহস্য উন্মোচন হওয়া প্রয়োজন। এটা কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়। একজন শ্রমিক নেতার মৃত্যু \'ভুল সিগন্যাল\' পেঁৗছে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার লেবার অর্গানাইজেশন অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা বাংলাদেশি তৈরি পোশাক বয়কটের ডাক দিতে পারে। আমরা যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি করছি, সেখানে এই হত্যাকাণ্ড ও এর বিচার না হওয়া, বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। আমাদের তৈরি পোশাক বাজারজাতকরণের স্বার্থেই আমিনুলের হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত। পঞ্চমত, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের একটি মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া অর্থমন্ত্রী দেখিয়েছেন, তা শোভন নয়। তার জবাব ভদ্রজনিত হওয়া উচিত ছিল। এখানে \'রাগ দেখানো\'র কোনো সুযোগ নেই। ব্যক্তি ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় কী করেছেন, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে; কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে, বিশ্বজুড়েই ড. ইউনূসের অনেক \'বন্ধু\' রয়েছেন। ড. ইউনূসের অপসারণের ঘটনায় তারা আহত হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার কোনো একটি ক্ষেত্রে তাকে রাখা গেলে ক্ষতি কী? তিনি নিশ্চয়ই এখন আর আগের মতো গ্রামীণ ব্যাংকে প্রভাব খাটাতে পারবেন না। সরকার এ বিষয়টি ভেবে দেখলে ভালো করবে। ষষ্ঠত, এমসিএ বা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টস থেকে আমরা সহায়তা পাচ্ছি না। বড় বাধা আমাদের দুর্নীতি। আমাদের স্বার্থেই দুর্নীতি রোধে বাস্তব কর্মসূচি গ্রহণ করা উচিত। সপ্তমত, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্র একটি \'অংশীদারিত্ব সংলাপ\'-এর যৌথ ঘোষণা স্বাক্ষর করেছে। এ চুক্তিতে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কি রক্ষিত হবে? নাকি চুক্তিটি ভবিষ্যতে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে_ এ প্রশ্ন অনেকের মনে। হিলারি ক্লিনটন যখন আমাদের তরুণদের স্মরণ করিয়ে দেন চীন ও ভারতের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান এবং বাংলাদেশের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে, তখন এই \'অংশীদারিত্ব চুক্তি\' নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক দৃশ্যপট দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আগামী দিনগুলো বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এ চুক্তির ব্যবহার ও বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। অষ্টমত, হিলারি ক্লিনটনের একটি কর্মসূচি ছিল ঢাকায় তরুণদের সঙ্গে। \'তরুণদের সম্পর্কে আমার জানার আগ্রহ রয়েছে\'_এটি ছিল হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্য। যারা \'আরব বসন্ত\' সম্পর্কে ধারণা রাখেন, তারা জানেন মিসরের তরুণ প্রজন্মকে \'গণতন্ত্রমুখী\' করতে যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিল। তাদের অনেককে যুক্তরাষ্ট্র ওয়াশিংটন পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল। দুটি সংস্থার (April 6 Movement I Kafaya Movement) নেতাদের ওয়াশিংটন প্রশিক্ষণ দিয়েছে এসব খবরও পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। হিলারি ক্লিনটন যে সিভিল সোসাইটির কথা ঢাকায় বলে গেছেন, এদের কর্মকাণ্ড নিয়ে বাংলাদেশে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন থেকে যাবে তরুণ সমাজ তথা সিভিল সোসাইটিকে \'প্রমোট\' করে যুক্তরাষ্ট্র আসলে কী চায়? হিলারি ক্লিনটন চলে গেছেন। কিন্তু রেখে গেছেন অনেক প্রশ্ন। আর এসব প্রশ্নের জবাব পেতে আমাদের আরও বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
Daily SAMAKAL
15.5.12
হিলারির সফরে প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা
19:11
No comments
গেল সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফর করে গেলেন। এই সফর বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছিল। তার ওই সফর নিয়ে আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হয়েছে, এ নিয়ে বিতর্ক এখনো চলছে। এমনকি কোনো কোনো মন্ত্রী মন্তব্য পর্যপ্ত করেছেন। মোটা দাগে তার বক্তব্যগুলো বিশ্লেষণ করলে যা দাঁড়ায়, তা হচ্ছে : ১. যুক্তরাষ্ট্র চায় সংঘাত এড়াতে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে একটি 'সংলাপ' হোক, ২. একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায় নির্বাচন হওয়া বাঞ্ছনীয়, ৩. বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর অন্তর্ধান ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের হত্যাকা-ের নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত, ৪. চীন ও ভারতের মাঝখানে বাংলাদেশের স্ট্রাটেজিক গুরুত্ব রয়েছে, ৫. গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকা-ে সরকারের হস্তক্ষেপ কাম্য নয়, ৬. হরতাল মার্কিন বিনিয়োগকারীদের 'ভুল' সিগন্যাল দিতে পারে, ৭. মিলিনিয়াম একাউন্টস থেকে সাহায্য পেতে হলে দুর্নীতি রোধ করতে হবে। এ ধরনের বক্তব্যে সরকারের নীতি-নির্ধারকরা যে খুব একটা খুশি হননি, তা বলাই বাহুল্য। গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকা-ে সরকার হস্তক্ষেপ করছে, এটা মানতে রাজি নন সরকারের নীতি-নির্ধারকরা। হিলারি ক্লিনটনের এ ধরনের মন্তব্যকে অর্থমন্ত্রী 'রাবিশ' বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তবে এটি সত্য, হিলারি ক্লিনটন যেসব মন্তব্য করেছেন, তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় হস্তক্ষেপের শামিল। কোনো বন্ধুরাষ্ট্রের 'প্রেসক্রিপশন' অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা যায় না এবং সেটি ঠিকও নয়। নিঃসন্দেহে হিলারি ক্লিনটনের মতো ব্যক্তিত্বের বাংলাদেশ সফর প্রমাণ করে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন প্রশাসনের আগ্রহ বাড়ছে।
বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসগরীয় অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে সেখানে যে 'শূন্যতার' সৃষ্টি হবে, সেই 'শূন্যতা' পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি 'শান্তিরক্ষী' বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৪ সালের মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গাড়তে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বিপুল জ্বালানি সম্পদ রয়েছে (গভীর সমুদ্রে)। বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকদের জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী চীনের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে প্রভাব ঘাটানো সম্ভব। হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরকে আমি এসব বিষয়কে সামনে রেখেই বিশ্লেষণ করতে চাই।
হিলারির সফরের গুরুত্বপূর্ণ যে দিক তা হচ্ছে, একটি যৌথ অংশীদারিত্ব সংলাপ চুক্তি সাক্ষর। এই সংলাপের আওতায় বছরে একবার বাংলাদেশ ও মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের কর্তাব্যক্তিরা মিলিত হবেন। চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধরোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের ব্যাখ্যা নানাভাবে বিশ্লেষণ হতে পারে। 'সন্ত্রাসবাদ রোধে সহযোগিতার' আলোকে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়, সেটাই দেখার বিষয় এখন। আরো একটা কথা, তরুণদের এক সমাবেশে হিলারি ক্লিনটন যখন বাংলাদেশের স্ট্রাটেজিক গুরুত্বের কথা বলেন, তখন আমাদের প্রখ্যাত মার্কিন স্ট্রাটেজিস্ট রবার্ট কাপলানের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কাপলান লিখেছেন, দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাই_ আর তা হচ্ছে চীনের প্রভাবকে সঙ্কুচিত করা। বাংলাদেশের অবস্থান তাই খুব স্বাভাবিক কারণেই মার্কিন নীতি-নির্ধারকদের আকৃষ্ট করবে। মার্কিন স্ট্রাটেজিতে ভারতের গুরুত্ব বেড়েছে। এটাই হচ্ছে মোদ্দাকথা। চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে, সে জন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা। চীন ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। চীন এ অঞ্চলে ্তুঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং্থ বা 'মুক্তার মালার' মতো বিভিন্ন সামুদ্রিক বন্দরে তার অবস্থান শক্তিশালী করে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। চীনের ্তুঝঃৎরহম ড়ভ চবধৎষং্থ এর যে নেটওয়ার্ক, তাতে পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত গাওদার সমুদ্রবন্দর একটি বড় ভূমিকা পালন করছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে এরাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ ও পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীন যে তেল আমদানি করে তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালি হয়ে চীনে যায়। তাই সঙ্গত কারণেই চীনের জন্য তার ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিটও থাকবে, যা কি-না ভারত মহাসাগরের সব নৌম্যুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরো বেড়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৮০ ন্যাটিকাল মাইল। আর ইরান সীমান্তে রয়েছে মাত্র ৭১ কিলোমিটার দূরে। চীন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গাওদার সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে। চীন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস ওই গাওদার বন্দর দিয়েই গাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। চীন শ্রীলঙ্কার হামবানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চীন শ্রীলঙ্কা সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারে রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়ে আরো বেশ কটি বন্দরে রয়েছে চীনা উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা গড়ে তুলছে, তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে মার্কিন তেল কম্পানিগুলোর বড় বিনিয়োগ রয়েছে এ দেশে। শেভরনের বিনিয়োগের পরিমাণ এক বিলিয়ন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮২০০ কোটি টাকার সমান। শেভরন বর্তমানে জালালাবাদ, মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে কাজ করছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত গ্যাসের শতকরা ৫০ ভাগ শেভরন একাই উৎপাদন করে। বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডে তাদের কর্মকা-ে স্থানীয় জনগণ অসন্তুষ্ট। সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। এখন অপর একটা কম্পানি চাইছে গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে তাদের অধিকার। বহুল আলোচিত 'টিফা' চুক্তির ব্যাপারেও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ 'টিফা' নয়, বরং 'ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কো-অপরারেশন ফোরাম' (টিআইসিএফ) নামে ভিন্ন নামে চুক্তিটি করতে যাচ্ছে। এটি এখনো স্বাক্ষরিত হয়নি। তবে চূড়ান্ত হয়েছে। এ ধরনের একটি চুক্তিতে বাংলাদেশের লাভের সম্ভাবনা কম। এ ধরনের চুক্তি হলে বাংলাদেশ কোনো পাইরেটেড পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। ওষুধ শিল্পও হুমকির মুখে পড়বে। এটা ঠিক, হিলারি ক্লিনটনের এই সফরের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরো উন্নতি ঘটবে। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় হিলারি ক্লিনটনের ব্যক্তিগত বন্ধু ড. ইউনূসের প্রসঙ্গ উঠলেও 'গুম' তথা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা 'মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন' (এমসিসি) থেকে বাংলাদেশ কোনো সাহায্য পাচ্ছে না_ এ প্রশ্নটিরও সমাধান হয়নি হিলারির সফরের সময়। মূলত দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়তা দেয়ার লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৪ সালে এমসিসি গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক কোনো বিরোধ নেই। বরং শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভূমিকায় যুক্তরাষ্ট্র বারবার প্রশংসা করে আসছে। হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় এসেও একই কথা বলছেন। সংলাপের যে কথা তিনি বলেছেন, তা নতুন নয়। ড. ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তারা দুজন একটি নিরপক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলেছেন। বিএনপি এ ব্যাপারে সংসদে একটি প্রস্তাব রাখতে পারে। পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের ব্যাপারেও হিলারি কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাননি। অথচ এটি ছিল আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনায় মন্তব্য করে হিলারি ক্লিনটন যেমনি কোনো কোনো মহলে 'বিতর্কিত' হয়েছেন, আবার 'সংলাপ' এর আহ্বানে কেউ কেউ প্রশংসাও করেছেন। তবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, হিলারি ক্লিনটনের ওই সফর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছে। এটিকে এখন আমাদের স্বার্থে ব্যবহার করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য এখানেই নিহিত।
Daily Destiny
16.5.12
একটি অভিমত ও বাংলাদেশের বাস্তবতা
19:06
No comments
এই মুহূর্তে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলে কিছু নেই। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীবলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্ত ঘোষিত হয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বর্তমান সরকার ও সংসদকে রেখেই এবং সংসদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে। যদিও ওই সরকারকে আখ্যায়িত করা হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে। প্রধান বিরোধী দলের আপত্তি এখানেই। তারা চাচ্ছে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। এ নিয়ে দেশে হরতাল হয়েছে। বিএনপি তথা ১৮ দলীয় জোট এখন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে আন্দোলন করছে। এ ক্ষেত্রে সরকার যে এতটুকুও নমনীয় হয়েছে, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীরা বারবার বলে আসছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে, আর তার নেতৃত্ব দেবেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী। এই যখন পরিস্থিতি, তখন অধ্যাপক ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদও এক অভিমত দিলেন। যদিও এর আগে ড. কামাল হোসেন কিংবা ব্যারিস্টার রফিক-উল হকও একই ধরনের অভিমত দিয়েছিলেন। সরকার তাতে আদৌ গুরুত্ব দেয়নি। এখন হিলারি ক্লিনটনের উপস্থিতিতে ড. ইউনূস ও আবেদ যখন একই অভিমত দিলেন, তখন সরকার এটাকে গুরুত্ব দিলে ভালো করবে। ধারণা করছি, যুক্তরাষ্ট্রও চায় একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হোক। বর্তমান সরকার তাদের ক্ষমতার শেষ পর্যায়ে এসেছে। গত ৪০ মাসে তারা কতটুকু তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পেরেছে, তার ভার জনগণের ওপর ছেড়ে দেওয়াই মঙ্গল। এ ক্ষেত্রে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে নির্বাচন পরিচালনার ভার দিলে তাতে ক্ষতির কিছু নেই। বরং আমার বিশ্বাস, সরকারের জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে।
তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টি অত সহজ নয়। এ ক্ষেত্রে সংবিধানে সংশোধনী আনা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান সংবিধান রেখে কোনো নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যাবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাব কে আনবে? সরকার? বিরোধী দল? নাকি সরকারের কোনো 'বন্ধু'? এটা তো ঠিক, বিরোধী দল কোনো সংশোধনী আনলে তা সংসদে পাস করানো যাবে না। তাদের সেই 'সংসদীয় ক্ষমতা' নেই। একমাত্র সরকার যদি 'সিদ্ধান্ত' নেয়, তাহলেই সংবিধানে সংশোধনী আনা সম্ভব। সরকার নীতিগতভাবে একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে জোটভুক্ত কোনো 'দল'কে দিয়ে এ ধরনের একটি প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করতে পারে। ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা জাসদ নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা সমর্থন করে। তারাও একটি প্রস্তাব সংসদে উপস্থাপন করতে পারে। তবে নিঃসন্দেহে এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার 'ওয়ান-ইলেভেন'-এর সময়কার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো হবে না। এর একটি নতুন কাঠামো দেওয়া যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন 'ফর্মুলা' নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এক. ড. ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদের যৌথ নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার, যাদের দায়িত্ব হবে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করা। কোনো উপদেষ্টা থাকবেন না। সচিবরা মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন পরিচালনা করবেন। এই সরকার নীতিগত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। দুই. ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের নেতৃত্বে একটি সরকার। ব্যারিস্টার হক দুটি বড় দলেরই 'বন্ধু' এবং দুই দলীয় প্রধানের কাছেই গ্রহণযোগ্য। তিন. প্রধান বিচারপতি অথবা সংসদের বর্তমান স্পিকারকে প্রধান করে সরকার ও বিরোধী দলের পাঁচজন করে প্রতিনিধি নিয়ে (যাঁরা নির্বাচন করতে পারবেন না। স্পিকারও নির্বাচন করবেন না) তিন মাসের জন্য একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যাদের দায়িত্ব নির্বাচন আয়োজন করা। চার. একটি 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠন, যাদের দায়িত্ব হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করা। এই 'এলডার্স কাউন্সিল' যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হবে। সদস্যসংখ্যা তিন থেকে চারজন হতে পারে। সাবেক তিন প্রধান বিচারপতি তিনজন গুণী ব্যক্তি অথবা তিনজন সাংবিধানিক পদমর্যাদার অধিকারী ব্যক্তিকে নিয়েও এই 'এলডার্স কাউন্সিল' গঠিত হতে পারে। এ ধরনের যেকোনো 'ফর্মুলা' সংবিধানের কোনো অংশ হবে না। সংসদে গৃহীত একটি সিদ্ধান্তের মাধ্যমেও এটি করা সম্ভব। তবে বিষয়টি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক যাতে না হয়, সে ব্যাপারে সংবিধান বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলাপ করা যেতে পারে।
সরকার বারবার বলছে, তারা গত ৪০ মাসে যেসব কর্মসূচি নিয়েছে, তাতে জনগণের স্বার্থ নিহিত রয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো (?) থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত- প্রতিটি সিদ্ধান্তই জনস্বার্থে করা। এটা যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে তাদের ভয় থাকার কথা নয়। জনস্বার্থে হলে জনগণই তাদের আবার ক্ষমতায় বসাবে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত যদি না হয়, তাহলে রাজনৈতিক সংকট আরো বাড়বে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। সমুদ্রে আমাদের অধিকার রক্ষিত হওয়ায় তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি আইওসির আগ্রহ বেড়েছে। তারা বিনিয়োগ করতে চায়। কিন্তু এ জন্য চাই পরিবেশ, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। হিলারি ক্লিনটন ঢাকায় এসে এ কথাই বলে গেলেন। এমনকি গরিব দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রের মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্ট থেকে যে সাহায্য পায়, রাজনৈতিক অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে, বাংলাদেশের সেই সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। হিলারি হরতালের নেতিবাচক দিকগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিরোধী দলের সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে কোনো সমঝোতা না হলে ভবিষ্যতে এ দেশ আরো হরতাল প্রত্যক্ষ করবে।
অবশ্যই আমরা আমাদের রাজনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে আমরাই সিদ্ধান্ত নেব। কোনো বিদেশি রাষ্ট্র আমাদের 'দিকনির্দেশনা' দেবে- এটা কাম্য নয়। তাই অধ্যাপক ইউনূস ও ফজলে হাসান আবেদ যে অভিমত দিয়েছেন, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে, বিরোধী দলের সঙ্গে এখনই 'সংলাপ' শুরু করা উচিত।Daily KALER KONTHO13.5.12
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য সম্পর্কে দুটি কথা
18:55
No comments
মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পর দেশ দুুটির মাঝে সম্পর্ক উন্নয়নের একটি সম্ভাবনার যখন জন্ম হয়েছে, ঠিক তখনই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ‘নালিশ’ করলেন ওআইসির সম্মেলনে তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাদে। তিনি ওই সম্মেলনে অভিযোগ করেছেন যে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সমাজে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোরও দাবি করেন তিনি (সকালের খবর, ১৩ মে)। দীপু মনি যা বলেছেন তার মধ্যে কোনো মিথ্যা নেই। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য একটা সমস্যা। এটা নিয়ে দীর্ঘদিন দু’দেশের মাঝে দেনদরবার চলছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক আসরে বলার সময় এখনও আসেনি। সবচেয়ে বড় কথা, মিয়ানমার ধীরে ধীরে ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ তাদের অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্যও একটা সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্য দু’দেশের মাঝে একটা আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি করতে পারে। আমরা পররাষ্ট্রনীতিতে খুব সফলতা দেখছি না। তাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, তারা বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ আদায়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কোনো সফলতার পরিচয় দিতে পারেননি। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে দু’জন উপদেষ্টাকে তত্পর হতে দেখা গেছে, যদিও কোনো ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। শুধু তাই নয়, ভারতকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে আমরা আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমারকে কখনই বিবেচনায় নিইনি এবং নিকট প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গাঢ় করার তেমন কোনো বড় উদ্যোগ নিইনি। আমাদের জাতীয় স্বার্থের কারণে মিয়ানমার ও চীনের প্রয়োজন রয়েছে অনেক বেশি। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন ও মিয়ানমার সফর করেছেন, কিন্তু দেশ দুটির সঙ্গে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তা বলা যাবে না। তবে একটি সম্ভাবনার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। এই সম্ভাবনা এখন প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগ্য নেতৃত্ব দরকার, যারা সময়ের বিবেচনাকে প্রাধান্য দিয়ে পররাষ্ট্রনীতিতে নয়া দিকনির্দেশনা দেবেন।
আমাদের পররাষ্ট্রনীতির একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা বহুপাক্ষিকতায় বিশ্বাসী। কিন্তু ভারতের দ্বিপাক্ষিকতার কারণে আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির বহুপাক্ষিকতার চরিত্র হারিয়ে ফেলেছি। ফলে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে না। মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদকে আমরা কাজে লাগাতে পারিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্তটি না নেওয়ার কারণে। অথচ চীন, থাইল্যান্ড এবং ভারতও এই জ্বালানি সম্পদকে ব্যবহার করছে। প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে আমাদের সুযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রামে মিয়ানমারের কাঁচামালভিত্তিক শিল্প-কারখানা স্থাপনের সম্ভাবনা থাকলেও আমরা এ ব্যাপারে গত তিন বছরে কোনো উদ্যোগ নিইনি। মিয়ানমার-চট্টগ্রাম সীমান্তে সার কারখানা স্থাপন করে মিয়ানমারের বিপুল সারের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারতাম। কিন্তু তা হয়নি। আকিয়াব, মংডুর আশপাশে প্রচুর বাঁশ, কাঠ ও চুনাপাথর পাওয়া যায়। এর ভিত্তিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সিমেন্ট ও কাগজ শিল্প বিকশিত হতে পারত। সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে তা হয়নি। এমনকি বাংলাদেশে বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও আমরা উত্সাহিত করিনি। আমরা বেসরকারি উদ্যোগে আফ্রিকাতে জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদের উদ্যোগ নিয়েছি। অথচ পাশের দেশে রয়েছে প্রচুর অনাবাদি জমি। মিয়ানমার জমি ‘লিজ’ দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও আমাদের নীতি প্রণেতারা বিষয়টি নিয়ে ভাবেননি। এমনকি বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও উত্সাহিত করেননি। অতিসম্প্রতি ভারত থেকে তুলা আমদানি নিয়ে একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল। অথচ মিয়ানমারের মন্দালয়-ম্যাগাওয়ে অঞ্চলে প্রচুর তুলা উত্পন্ন হয়। আমরা কখনও ওই তুলার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাইনি। এমনকি ওই অঞ্চলে প্রচুর ভুট্টা চাষ হয়। মিয়ানমারে প্রচুর গবাদিপশু উত্পাদন হয়, যা কিনা আমাদের চাহিদা মেটাতে পারে। যৌথভাবে গবাদিপশুর ফার্ম তৈরি করাও সম্ভব। মিয়ানমারে প্রচুর বিদেশি পর্যটক আসেন। এরা যাতে বাংলাদেশের বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে আসেন কিংবা সুন্দরবনে এদের নিয়ে যাওয়া যায় কি না, আমাদের ট্যুর অপারেটররা বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। কুনমিং-মুসে-ঘুমধুম সড়ক আমাদের জন্য একটি বিশাল সম্ভাবনার সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ আগ্রহ দেখিয়েছে বটে, কিন্তু তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে মিয়ানমারের সড়ক যোগাযোগের জন্য ‘মৈত্রী সড়ক’-এর কাজ শুরু হয়েছিল বিগত চারদলীয় জোট সরকারের সময়। ওই সড়কে বেশ ক’টি সেতু নির্মাণ করার কথা, যা কিনা বাংলাদেশ নিজের অর্থায়নে করবে। কিন্তু এই ‘মৈত্রী সড়ক’-এর কোনো খবর আমরা জানি না। অথচ ভারতকে ট্রানজিট দিতে আমরা অনেক রাস্তা সংস্কার করেছি। এমনকি তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে ভারতীয় ২৮ চাকার যান চলাচলের সুযোগ আমরা করে দিয়েছি। অথচ ‘মৈত্রী সড়ক’ দ্রুত সম্পন্ন করার তেমন কোনো উদ্যোগ আমাদের নেই। অর্থাত্ বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রয়োজনে আমরা মিয়ানমারকে গুরুত্ব দিইনি। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ‘বিমসটেক’-এর সদস্য। মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বৃদ্ধি শুধু বাংলাদেশি পণ্যের বাজারই আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর জন্য উন্মুক্ত করবে না, বরং আসিয়ানের সদস্যপদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আসিয়ানের ‘ডায়ালগ পার্টনার’-এর মর্যাদা পেতে সাহায্য করবে। বলা ভালো, ভারত ইতোমধ্যে ‘ডায়ালগ পার্টনার’-এর মর্যাদা পেয়েছে। মিয়ানমার আসিয়ানের সভাপতির দায়িত্ব পেতে যাচ্ছে আগামী বছর। এটাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এবং বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। বহির্বিশ্বে মিয়ানমারের যে ‘বদনাম’ ছিল তা ইতোমধ্যেই কাটিয়ে ওঠার উদ্যোগ নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। গণতন্ত্রী নেত্রী সু চি’র সঙ্গে প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন প্রশাসনের সম্পর্ক এখন ভালো। সু চি উপনির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। জেনারেল সেইন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক আগের মতো নেই। মিয়ানমারের বিপুল জ্বালানি সম্পদের সম্ভাবনা মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলোকে মিয়ানমারের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে। বলতে বাধা নেই, মিয়ানমার আর আগের অবস্থানে নেই। এখানে ভারতের ভূমিকাও লক্ষ করার মতো। ভারত তার জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনেই মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। এ ক্ষেত্রে সু চি’র গণতান্ত্রিক আন্দোলন কখনই প্রাধান্য পায়নি। ভারত বহির্বিশ্বে সু চি’র মুক্তির ব্যাপারেও তেমন কোনো আন্দোলন গড়ে তোলেনি। মিয়ানমার সরকারের ওপর কোনো ‘প্রেশার’ও সৃষ্টি করেনি। কেননা মিয়ানমারের জ্বালানি সম্পদ ভারতীয় নেতাদের কাছে সু চি’র চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ ভারতের এই ‘অ্যাপ্রোচ’ থেকে শিখতে পারে অনেক কিছু।
ঢাকায় নিযুক্ত নয়া চীনা রাষ্ট্রদূত লি জুন একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন গত ১৯ মার্চ। তিনি বলেছেন, চীন এ অঞ্চলে মার্কিন ঘাঁটি মেনে নেবে না। ক্রমবর্ধমান ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্যের গুরুত্ব অপরিসীম। এ অঞ্চলে মার্কিন কর্তৃত্ব ও প্রভাব বাড়ছে। মার্কিন প্যাসিফিক কমান্ডের আওতাধীন এই অঞ্চল। তথাকথিত ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ দমনে এ অঞ্চলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মার্কিন সেনার উপস্থিতি রয়েছে, যা দৃশ্যমান নয়। তবে যারা নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করেন, তারা জানেন এ অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতির উদ্দেশ্য একটাই-আর তা হচ্ছে ধীরে ধীরে ‘চীনকে ঘিরে ফেলা’। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্র্যাটেজি স্নায়ুযুদ্ধকালীন ‘কনটেইনমেন্ট পলিসি’র কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই চীন এ ধরনের কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করবে না। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের কারণে স্বাভাবিকভাবেই দৃষ্টি এখন বাংলাদেশের দিকে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সামরিক বলয়ে বাংলাদেশ যদি প্রবেশ করে, তা হলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চীন তথা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একটি ‘ফ্রন্ট’ গড়ে তোলাই হচ্ছে হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের মূল উদ্দেশ্য। বিদেশের সংবাদপত্র তথা ব্লগে বাংলাদেশের সম্ভাব্য এই ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ও ওআইসির সম্মেলনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া একই সূত্রে গাঁথা। এতে করে বাংলাদেশ লাভবান হবে না। বাংলাদেশের এই ভূমিকা মিয়ানমার খুব ভালো চোখে দেখবে বলেও মনে হয় না। রোহিঙ্গারা আমাদের জন্য অবশ্যই একটি সমস্যা। নানা সামাজিক সমস্যা তারা সৃষ্টি করছে। কিন্তু মজার ব্যাপার হল জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশন (ইউএনএইচসিআর) আশগাবাদে যৌথভাবে এই সম্মেলন আয়োজন করলেও অতীতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে ইউএনএইচসিআরের ভূমিকা ইতিবাচক ছিল না। তারা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।
‘সফল কূটনীতি’ প্রয়োগে আমাদের সফলতা খুব বেশি নেই। আমাদের জন্য যেসব সুযোগের সৃষ্টি হয়েছে, ‘সফল কূটনীতি’র ব্যর্থতার কারণে সেই সুযোগগুলো থেকে আমরা ফায়দা তুলতে পারছি না। মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার সমাধান করা উচিত ছিল। তা না করে আন্তর্জাতিক আসরে রোহিঙ্গা প্রশ্নটি তুলে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে পারব বলে মনে হয় না। বরং দু’দেশের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হতে বাধ্য। মিয়ানমার যখন ‘উন্মুক্ত’ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তখনই রোহিঙ্গা প্রশ্নটি আন্তর্জাতিকীকরণের মধ্য দিয়ে আমরা একটা ভুল সিগন্যাল পৌঁছে দিলাম। এতে করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষিত হবে না।
Daily SAKALER KHOBOR
15.5.12
হিলারির সফর : একটি মূল্যায়ন
11:44
No comments
এক ঝটিকা সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন হিলারি ক্লিনটন। বাংলাদেশটা তার একেবারে অপরিচিত নয়। এর আগেও তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। তবে অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নয়। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণের বিকাশ, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার সখ্য, বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নানা বিষয় হিলারি ক্লিনটনকে আগ্রহান্বিত করে তুলেছিল। এর প্রমাণও তিনি দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ না হলেও ড. ইউনূসের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছে। দীর্ঘ কথাও হয়েছে। তবে এবার হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিভিন্ন কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব এ মুহূর্তে অনেক বেশি। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, ভারত মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি বেড়ে যাওয়া, মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়া, ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা, ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হওয়া ইত্যাদি নানা বিষয় যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। নিছক প্রটোকল রক্ষার্থে হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছেন, এটা আমি মনে করি না। বরং দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন নীতিতে যে পরিবর্তন আসছে, সেই পরিবর্তনের আলোকেই এই সফরকে বিশ্লেষণ করতে হবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী? বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের আলোকে এ সফর থেকে আমরা কতটুকু সুবিধা আদায় করে নিতে পেরেছি? যৌথ সংবাদ সম্মেলনে হিলারি ক্লিনটনের দেয়া বক্তব্য থেকে যে বিষয়গুলো বেরিয়ে এসেছে, তাতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি যে খুব বেশি, তা আমার কাছে মনে হয়নি। প্রথমত, একটি যৌথ অংশীদারিত্বের চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে বছরে একবার সংলাপ হবে। এ ধরনের সংলাপ অতীতে হলেও এবার এর একটি আইনি কাঠামো দেয়া হল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘সংলাপে’র মধ্য দিয়ে কি আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ আদায় করে নিতে পারব? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থটা এখানে বেশি? চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান আর জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধ রোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হতে পারে। যা আশংকা করা হচ্ছে তা হচ্ছে, ভবিষ্যতে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদ রোধে সহযোগিতা’র আলোকে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক, মার্কিন সেনা মোতায়েন হবে কিনা? যে ‘অংশীদারি সংলাপে’র কথা বলা হচ্ছে, তা এ দিকটা নির্দেশ করে কিনা? অনেকের মনে থাকার কথা, গত ২ মার্চ সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ প্যাসিফিক ফ্লিটের অন্তর্ভুক্ত) কমান্ডার রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ বাহিনী’ মোতায়েন রয়েছে। যদিও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস পরে এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিল।
আসলে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে নানা কারণে। ভারতীয় মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর শক্তিশালী উপস্থিতি, যা মার্কিন তথা ভারতীয় স্বার্থকে আঘাত করছে, এটা পেন্টাগনের উদ্বেগের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে মিয়ানমার এখন অনেকটা ‘উš§ুক্ত’ হয়ে যাচ্ছে। অং সান সু চি সংসদে গেছেন। সু চিকে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় বসানো এবং মিয়ানমারে তাদের উপস্থিতি বাড়িয়ে চীনকে ঘিরে ফেলার মার্কিন নীতিতে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। যদিও এটা ঠিক যে যুক্তরাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠুক। বাংলাদেশকে তারা একটি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবেই মনে করে। জঙ্গিবাদকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভয়। প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের ব্যর্থতা স্বীকার করে ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে যাচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়া, ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ বিকশিত হোক, এটা যুক্তরাষ্ট্র কখনও চাইবে না। আমেরিকা-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব চুক্তি এ লক্ষ্যেই স্বাক্ষরিত হচ্ছে কিনা, এটাই বড় প্রশ্ন এখন। ভুলে গেলে চলবে না, দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব মার্কিনিদের কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। অতি সম্প্রতি এডমিরাল জেমস স্টাভরিডিস মার্কিন বাহিনীর ‘ভড়ৎধিৎফ ঢ়ৎবংবহপব’-এর কথা বলেছেন। এডমিরাল স্টাভরিডিস যুক্তরাষ্ট্রের ঊটঈঙগ (টহরঃবফ ঝঃধঃবং ঊঁৎড়ঢ়বধহ ঈড়সসধহফ)-এর প্রধান। স্টাভরিডিস দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য তথা আফ্রিকাতে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তার কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। এখন দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিটিকে কিভাবে ব্যবহার করে। এখান থেকে আমাদের পাওয়ার কিছু নেই।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে সুযোগ চেয়েছিল তা পায়নি। বাংলাদেশকে তার তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যে শুল্ক দিতে হয়, তাতে করে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না। অথচ এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) দেশ হিসেবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ আমাদের পাওয়ার কথা। তৃতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন’ (এমসিপি) থেকে বাংলাদেশ কোন সাহায্য পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের কোন বক্তব্য বা সহযোগিতার আশ্বাস আমরা পাইনি। চতুর্থত, মিসেস ক্লিনটন ‘গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ’ ও ‘পার্লামেন্টারি ডিবেটে’র কথা বলেছেন। এগুলো হচ্ছে তত্ত্বের কথা। আমরা সবাই জানি, গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সংলাপ ছাড়া কোন বিকল্প নেই। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখা যে জরুরিÑ এ কথাটা আমরা বারবার বলে আসছি। কিন্তু এই ‘সংলাপ’ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। এমনকি সংসদীয় ডিবেটও তেমন কার্যকর নয়। এখন হিলারি ক্লিনটনের মুখ থেকে এ কথাটি বেরিয়ে এসেছে সত্য। কিন্তু আদৌ ‘সংলাপ’ অনুষ্ঠিত হবে, এ আস্থাটা রাখতে পারছি না। হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের একটা খারাপ দিক হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নাক গলানো’। ভারত কিংবা অন্য কোন দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করে না। আমরা এমন একটা ‘ক্ষেত্র’ তৈরি করেছি, যেখানে বিদেশীরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করছে। পঞ্চমত, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অন্তর্ধান নিয়ে হিলারি ক্লিনটনের মন্তব্য, হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের যে অভিমত হিলারি দিয়েছেন, সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করবে।
হিলারি ক্লিনটন তার বক্তব্য ও চুক্তিতে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, শক্তিশালী সুশীল সমাজ, এনজিওর ভূমিকা, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনে সহযোগিতা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা কিংবা হরতালের ক্ষতিকর দিক এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে কথা বলেছেন, তার মাঝে নতুনত্ব কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে এসব প্রতিফলিত হয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়নের কথা যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র বিনির্মাণের সমস্যাটা মানবিক। রাজনীতিকদের মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে এ দেশে সাচ্চা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়েও কথা আছে। ওয়ান-ইলেভেনে সুশীল সমাজের ভূমিকা তাদের বিতর্কিত করেছে।
আমরা হিলারি ক্লিনটনের সফরকে বেশি করে গুরুত্ব দিয়েছি। ক্লিনটনের সঙ্গে মমতা ব্যার্নাজির বৈঠকেও আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম যে, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে হিলারি কথা বলবেন। কিন্তু সেটা হয়নি। আমরা ভুলে গেছি, এটা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নয়। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কখনও হস্তক্ষেপ করে না। হিলারির এ সফরে আমাদের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। এতে করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা আরও ‘একটু উন্নত’ হল মাত্র। তবে মূল বিষয় যেটি তা হচ্ছে ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব চুক্তি’ বা সংলাপ তৃতীয় কোন দেশের (চীন) বিরুদ্ধে ব্যবহƒত হয় কিনা, তা দেখা। আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে আমরা এই চুক্তি থেকে কতটুকু উপকৃত হব।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই সফরে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী? বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের আলোকে এ সফর থেকে আমরা কতটুকু সুবিধা আদায় করে নিতে পেরেছি? যৌথ সংবাদ সম্মেলনে হিলারি ক্লিনটনের দেয়া বক্তব্য থেকে যে বিষয়গুলো বেরিয়ে এসেছে, তাতে বাংলাদেশের প্রাপ্তি যে খুব বেশি, তা আমার কাছে মনে হয়নি। প্রথমত, একটি যৌথ অংশীদারিত্বের চুক্তি চূড়ান্ত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ে বছরে একবার সংলাপ হবে। এ ধরনের সংলাপ অতীতে হলেও এবার এর একটি আইনি কাঠামো দেয়া হল। প্রশ্ন হচ্ছে, এই ‘সংলাপে’র মধ্য দিয়ে কি আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থ আদায় করে নিতে পারব? নাকি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থটা এখানে বেশি? চুক্তিতে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই, সহিংস চরমপন্থা এবং মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান আর জলদস্যুতার মতো আন্তঃদেশীয় অপরাধ রোধ ও নিরাপত্তা সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। এ ধরনের নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ হতে পারে। যা আশংকা করা হচ্ছে তা হচ্ছে, ভবিষ্যতে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদ রোধে সহযোগিতা’র আলোকে বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেভাবেই হোক, মার্কিন সেনা মোতায়েন হবে কিনা? যে ‘অংশীদারি সংলাপে’র কথা বলা হচ্ছে, তা এ দিকটা নির্দেশ করে কিনা? অনেকের মনে থাকার কথা, গত ২ মার্চ সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ প্যাসিফিক ফ্লিটের অন্তর্ভুক্ত) কমান্ডার রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার ৫টি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ বাহিনী’ মোতায়েন রয়েছে। যদিও ঢাকার মার্কিন দূতাবাস পরে এর একটি ব্যাখ্যাও দিয়েছিল।
আসলে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ রয়েছে নানা কারণে। ভারতীয় মহাসাগরে চীনা নৌবাহিনীর শক্তিশালী উপস্থিতি, যা মার্কিন তথা ভারতীয় স্বার্থকে আঘাত করছে, এটা পেন্টাগনের উদ্বেগের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে মিয়ানমার এখন অনেকটা ‘উš§ুক্ত’ হয়ে যাচ্ছে। অং সান সু চি সংসদে গেছেন। সু চিকে ভবিষ্যতে ক্ষমতায় বসানো এবং মিয়ানমারে তাদের উপস্থিতি বাড়িয়ে চীনকে ঘিরে ফেলার মার্কিন নীতিতে বাংলাদেশ অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছে কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন এখন। যদিও এটা ঠিক যে যুক্তরাষ্ট্র চায় না বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠুক। বাংলাদেশকে তারা একটি মডারেট মুসলিম দেশ হিসেবেই মনে করে। জঙ্গিবাদকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ভয়। প্রায় ৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের ব্যর্থতা স্বীকার করে ২০১৪ সালে সেখান থেকে সব সৈন্য প্রত্যাহার করে নিতে যাচ্ছে। এমনই এক পরিস্থিতিতে দক্ষিণ এশিয়া, ‘হর্ন অব আফ্রিকা’ কিংবা মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদ বিকশিত হোক, এটা যুক্তরাষ্ট্র কখনও চাইবে না। আমেরিকা-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব চুক্তি এ লক্ষ্যেই স্বাক্ষরিত হচ্ছে কিনা, এটাই বড় প্রশ্ন এখন। ভুলে গেলে চলবে না, দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্ব মার্কিনিদের কাছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। অতি সম্প্রতি এডমিরাল জেমস স্টাভরিডিস মার্কিন বাহিনীর ‘ভড়ৎধিৎফ ঢ়ৎবংবহপব’-এর কথা বলেছেন। এডমিরাল স্টাভরিডিস যুক্তরাষ্ট্রের ঊটঈঙগ (টহরঃবফ ঝঃধঃবং ঊঁৎড়ঢ়বধহ ঈড়সসধহফ)-এর প্রধান। স্টাভরিডিস দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য তথা আফ্রিকাতে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তার কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। এখন দেখার বিষয় যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিটিকে কিভাবে ব্যবহার করে। এখান থেকে আমাদের পাওয়ার কিছু নেই।
দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের যে সুযোগ চেয়েছিল তা পায়নি। বাংলাদেশকে তার তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে যে শুল্ক দিতে হয়, তাতে করে প্রতিযোগিতায় আমরা টিকতে পারছি না। অথচ এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) দেশ হিসেবে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের সুযোগ আমাদের পাওয়ার কথা। তৃতীয়ত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সাহায্য সংস্থা ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ কর্পোরেশন’ (এমসিপি) থেকে বাংলাদেশ কোন সাহায্য পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের কোন বক্তব্য বা সহযোগিতার আশ্বাস আমরা পাইনি। চতুর্থত, মিসেস ক্লিনটন ‘গণতন্ত্রের জন্য সংলাপ’ ও ‘পার্লামেন্টারি ডিবেটে’র কথা বলেছেন। এগুলো হচ্ছে তত্ত্বের কথা। আমরা সবাই জানি, গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধী দলের মাঝে সংলাপ ছাড়া কোন বিকল্প নেই। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখা যে জরুরিÑ এ কথাটা আমরা বারবার বলে আসছি। কিন্তু এই ‘সংলাপ’ বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয়নি। এমনকি সংসদীয় ডিবেটও তেমন কার্যকর নয়। এখন হিলারি ক্লিনটনের মুখ থেকে এ কথাটি বেরিয়ে এসেছে সত্য। কিন্তু আদৌ ‘সংলাপ’ অনুষ্ঠিত হবে, এ আস্থাটা রাখতে পারছি না। হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যের একটা খারাপ দিক হচ্ছে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ‘নাক গলানো’। ভারত কিংবা অন্য কোন দেশের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এমনটা করে না। আমরা এমন একটা ‘ক্ষেত্র’ তৈরি করেছি, যেখানে বিদেশীরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করছে। পঞ্চমত, বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী ও শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অন্তর্ধান নিয়ে হিলারি ক্লিনটনের মন্তব্য, হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য তদন্তের যে অভিমত হিলারি দিয়েছেন, সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিলে ভালো করবে।
হিলারি ক্লিনটন তার বক্তব্য ও চুক্তিতে মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধা, শক্তিশালী সুশীল সমাজ, এনজিওর ভূমিকা, খাদ্য নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তনে সহযোগিতা, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা কিংবা হরতালের ক্ষতিকর দিক এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার যে কথা বলেছেন, তার মাঝে নতুনত্ব কিছু নেই। যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে এসব প্রতিফলিত হয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়নের কথা যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্র বিনির্মাণের সমস্যাটা মানবিক। রাজনীতিকদের মানসিকতায় যদি পরিবর্তন না হয়, তাহলে এ দেশে সাচ্চা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। আর সুশীল সমাজের ভূমিকা নিয়েও কথা আছে। ওয়ান-ইলেভেনে সুশীল সমাজের ভূমিকা তাদের বিতর্কিত করেছে।
আমরা হিলারি ক্লিনটনের সফরকে বেশি করে গুরুত্ব দিয়েছি। ক্লিনটনের সঙ্গে মমতা ব্যার্নাজির বৈঠকেও আমরা আশান্বিত হয়েছিলাম যে, তিস্তা চুক্তির ব্যাপারে হিলারি কথা বলবেন। কিন্তু সেটা হয়নি। আমরা ভুলে গেছি, এটা যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নয়। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে তৃতীয় পক্ষ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কখনও হস্তক্ষেপ করে না। হিলারির এ সফরে আমাদের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। এতে করে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কটা আরও ‘একটু উন্নত’ হল মাত্র। তবে মূল বিষয় যেটি তা হচ্ছে ‘যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারিত্ব চুক্তি’ বা সংলাপ তৃতীয় কোন দেশের (চীন) বিরুদ্ধে ব্যবহƒত হয় কিনা, তা দেখা। আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে আমরা এই চুক্তি থেকে কতটুকু উপকৃত হব।
দৈনিক যুগান্তর , ১০ মে ২০১২।
ড. তারেক শামসুর রেহমান
ড. তারেক শামসুর রেহমান
প্রফেসর, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ,
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
হিলারি ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য অরুচিকর
11:36
No comments
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্প্রতি যে মন্তব্য করেছেন তাকে অসৌজন্যমূলক ও অরুচিকর বলে মন্তব্য করেছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। তারা বলেন, সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী ও সম্মানিত ব্যক্তির কাছ থেকে এ ধরনের রাগান্বিত ভাষায় তীর্যক মন্তব্য দেশবাসী আশা করে না। হিলারি ক্লিনটন ছিলেন আমাদের অতিথি এবং ড. ইউনূস হচ্ছেন বিশ্বে একজন সম্মানিত ব্যক্তি ও নোবল বিজয়ী। তাই তাদের প্রতি সম্মান রেখেই কথা বলা উচিত বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তারা বলেন, এমনিতেই বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশ সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করে না। তার ওপর সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রী এ ধরনের মন্তব্য করায় পরিস্থিতি আরও জটিল রূপ ধারণ করবে। সম্প্রতি ঢাকা সফরকালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বলেছিলেন, সরকার এমন কোন পদক্ষেপ নেবে না, যাতে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হিলারির এই বক্তব্যকে অনাকাক্সিক্ষত বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আর সরকার গ্রামীণ ব্যাংক দখল করতে চায় বলে ড. ইউনূসের মন্তব্যকে রাবিশ বলে মন্তব্য করেন অর্থমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্য সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সাবেক বিচারপতি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা তীব্র সমালোচনা করেছেন।
ড. আকবর আলি খান : এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলী খান যুগান্তরকে বলেন, এটা অর্থমন্ত্রীর নিজস্ব বক্তব্য। এরজন্য অর্থমন্ত্রী দায়ী থাকবেন। এ বিষয়ে এর বেশি মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
এম হাফিজউদ্দীন খান : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও টিআইবির সাবেক চেয়ারম্যান এম হাফিজউদ্দীন খান এ বিষয়ে বলেন, অর্থমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য অনভিপ্রেত। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন যখন বাংলাদেশে ছিলেন, তখন না বলে এখন এ ধরনের মন্তব্য করা মোটেও ঠিক নয়। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা গেল তাকে আদর-আপ্যায়ন করে এখন অপমান করা হচ্ছে। তার বক্তব্য পছন্দ হয়নি বলে তার ব্যাপারে বিষোদ্গার করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী রেগে গিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শোভা পায় না। ড. ইউনূসের বক্তব্যকে রাবিশ বলে ইউনূসকে অপমান করা হয়েছে। ড. ইউনূসকে যদি তার পছন্দ না হয়, তাহলেও অনেক ভালো ভালো শব্দ ব্যবহার করা যেত। তিনি রাবিশ বলে অর্থমন্ত্রীর পদকে খাটো করেছেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সফরে এসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে যে উদ্বেগের কথা বলেছেন তাতে মঙ্গলবার সচিবালয়ে অর্থমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, এই মন্তব্য অপ্রত্যাশিত। গ্রামীণ ব্যাংকের ড. ইউনূস ঝগড়া করেছে। আমরা ঝগড়া করিনি। গ্রামীণ ব্যাংকের একটি টাকাও দেশের বাইরের নয়, সব টাকা সরকারের। সুতরাং গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশ সরকারের।
সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরকালীন বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রফেসর ড. ইউনূসের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হন। সেই সাক্ষাৎ শেষে প্রফেসর ড. ইউনূস সাংবাদিকদের গ্রামীণ ব্যাংক প্রসঙ্গে তেমন কিছু না বললেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তরুণদের সঙ্গে এক আড্ডায় বিভিন্ন প্রশ্নের মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন হলে তিনি এ ব্যাপারে তার উদ্বেগের বিষয়টি প্রকাশ করেন। অর্থমন্ত্রী অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, হিলারি ক্লিনটন গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বলে শুনেছি। এটা আমি আশা করিনি। কারণ আমি এ ব্যাংকের একজন প্রতিষ্ঠাতা। গ্রামীণ ব্যাংকে সরকার কখনও হস্তক্ষেপ করেনি। যে কারণে গ্রামীণ ব্যাংক এখনও সে অবস্থানে রয়েছে। সরকার গ্রামীণ ব্যাংক দখল করতে চায়, এই ধরনের মন্তব্য শুনে অর্থমন্ত্রী বেশ কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলেন, এটা ‘রাবিশ’। গ্রামীণ ব্যাংক আগে যে অবস্থায় ছিল এখনও সে অবস্থায় রয়েছে। শুধু পরিবর্তন হয়েছে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের। গ্রামীণ ব্যাংক ড. ইউনূস দাবি করেন কিভাবে? একটি টাকাও তো তিনি দেননি। তবে হ্যাঁ, গ্রামীণের যে অন্য সংস্থাগুলো রয়েছে সেগুলো খতিয়ে দেখতে খুব শিগগির একটি কমিশন গঠন করা হবে।
দুই দিনের সফরে ঢাকায় এসে রোববার এক অনুষ্ঠানে হিলারি ক্লিনটন বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকে ইউনূসের পদ নিয়ে ‘বিরোধের’ বিষয়টি তিনি ওয়াশিংটন থেকে লক্ষ্য করেছেন। তিনি আশা করেন, সরকার এমন কিছু করবে না যাতে গ্রামীণ ব্যাংকের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ ইউনূস যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও তার স্ত্রী হিলারির পারিবারিক বন্ধু হিসেবে পরিচিত। মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার কারণ দেখিয়ে গত বছরের ২ মার্চ গ্রামীণ ব্যাংকের পদ থেকে ইউনূসকে অপসারণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউনূস এর বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে গেলেও উচ্চ আদালতের রায় তার বিপক্ষে যায়। ইউনূসের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার চাপ থাকলেও সরকার গত এক বছর ধরেই গ্রামীণ ব্যাংকে তাকে না ফেরানোর সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে। ব্যাংকের জন্য একজন নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠনের প্রস্তাবও চলতি বছরের শুরুতে খারিজ করে দিয়েছে সরকার।
ড. এমাজউদ্দীন আহমদ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দিন আহমদ অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যকে অসৌজন্যমূলক ও অরুচিকর বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কোন ভদ্রলোক এ ধরনের মন্তব্য করতে পারে না। অর্থমন্ত্রী ড. আবুল মাল আবদুল মুহিত আমাদের ব্যাচমেট ছিলেন। তিনি ভদ্রলোক বলেই আমরা জানতাম। কিন্তু ড. ইউনূস ও হিলারির ব্যাপারে যে মন্তব্য করেছেন তা অগ্রহণযোগ্য। তিনি যে বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তা হয়তো ভুলে গেছেন। এমাজ উদ্দিন আহমদ আরও বলেন, একজন বিদেশীর বক্তব্য নিয়ে অর্থমন্ত্রী যে উক্তি করেছেন তা শুনে আমার বিশ্রি লেগেছে। অর্থমন্ত্রী যেটা বললেন, এটা বলা উচিত হয়নি। এমনিতেই বিশ্বব্যাংক ও পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশের ওপর ক্ষিপ্ত। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে হিলারির উদ্বেগের কারণ সম্পর্কে আগেই জানা দরকার ছিল এবং এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থাকা প্রয়োজন ছিল। তিনি উল্লেখ করেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যকে রাবিশ বলা অসৌজন্যমূলক তো বটেই অরুচিকরও।
বিচারপতি সৈয়দ আমিনুল ইসলাম : হিলারি ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য সম্পর্কে হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম বলেন, বিদেশী অতিথিদের আমরা শ্রদ্ধা ও সম্মান করি। তাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা শোভন নয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : হিলারি ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যকে অসৌজন্যমূলক বলে অভিহিত করেছেন লেখক, কলামিস্ট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমান। তিনি বলেন, কারও কথার সমালোচনা যে কেউ করতেই পারেন। কিন্তু তা হওয়া উচিত কূটনৈতিক ভাষায়। হিলারি ও ড. ইউনূসের সমালোচনা করার সময় অর্থমন্ত্রীর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে ক্ষোভ ও ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ছিল। তিনি ভদ্রোচিত ভাষায় সমালোচনা করতে পারতেন। হিলারি ক্লিনটন ছিলেন আমাদের অতিথি। বাংলাদেশের উন্নয়নে সহযোগিতা, বাংলাদেশী পণ্য রফতানিতে শুল্ক ও কোটামুক্তসহ অনেক কিছু তাদের কাছে চাওয়ার আছে। অন্যদিকে গ্রামীণ ব্যাংক ও হরতাল ইস্যুতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হিলারি ক্লিনটন এ ধরনের মন্তব্য না করলেই পারতেন। তবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর সুযোগ দুই রাজনৈতিক দলই করে দিয়েছেন। অভ্যন্তরীণ সমস্যায় তাদের কাছেই ছুটে যান আমাদের রাজনীতিবিদরা।
ড. বদিউল আলম মজুমদার : হিলারি ক্লিনটন ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যকে অনাকাক্সিক্ষত বলে অভিহিত করেছেন সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, হিলারি ও ড. ইউনূস সম্পর্কে অর্থমন্ত্রীর মন্তব্য আমি টেলিভিশনে দেখেছি। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য শুধু আমার কাছে নয়, অনেকের কাছেই অসৌজন্যমূলক লেগেছে বলে মনে হয়। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যে ক্রোধ ও ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ লক্ষ্য করা যায়। একজন সš§ানিত সিনিয়র মন্ত্রীর কাছে এটা আশা করা যায় না। কারও সমালোচনা যে কেউ করতেই পারেন, কিন্তু তা এমন ভাষায় হওয়া উচিত নয়। গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. ইউসূনকে নিয়ে একটি সমস্যা আছে এটা ঠিক। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান সরকার করতে পারত, কিন্তু করেনি। নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বিশ্বে একজন সš§ানিত ব্যক্তি, আমাদের গর্ব। সরকারের কাছ থেকে তার সেই সš§ান আশা করতেই পারি। ড. শহীদুল্লাহ বলেছিলেন, যে দেশে গুণীজনরা সš§ান পায় না, সেই দেশে গুণীজন জš§ায় না। আর হিলারি ক্লিনটনের বক্তব্যে বদিউল আলম জানান, আমরাই যুক্তরাষ্ট্রকে মোড়ল হিসেবে মান্য করি। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিও সেটা মেনে চলে। কিন্তু আমরা নাগরিকরা বারবার বলেছি, অভ্যন্তরীণ সমস্যা সমাধানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকারি ও বিরোধী দলকে সমঝোতায় বসতে হবে। নাগরিকরা দুই রাজনৈতিক দলের সমঝোতায় উৎসাহী। বিদেশী নয়, দেশের নাগরিকরা কি বলে সেটাই গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু তারা বিদেশীদেরই বেশি গুরুত্ব দেন এবং সমস্যা সমাধানে অতীতে তাদের ডেকে এনেছেন।
অকুপাই মুভমেন্ট' ও নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা
01:31
No comments
যুক্তরাষ্ট্রের
নিউইয়র্ক শহরে 'অকুপাই মুভমেন্ট' গত ৩০ জুলাই ২২৬ দিন পার করল। এটা কী
চিন্তা করা যায় একটি আন্দোলন এতদিন ধরে চলছে এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে
এতটুকু ক্লান্তি নেই। হতাশা নেই। এই 'অকুপাই মুভমেন্ট' প্রমাণ করেছে নয়া
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা জরুরি। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে
মার্কিন সমাজে যে অসমতা ও দরিদ্রতা-তা দূর করা। একসময় এই মুভমেন্ট সমগ্র
বিশ্বের বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখন অবিশ্য ইউরোপের দেশগুলো থেকে এই
আন্দোলনের তেমন কোনো খবর পাওয়া যায় না; কিন্তু নিউইয়র্কের 'অকুপাই
মুভমেন্ট' ঠিকই অব্যাহত রয়েছে। যারা অনলাইনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদ
নেয়ার চেষ্টা করেন, তারা নিউইয়র্কের 'অকুপাই মুভমেন্ট' এর খবর খুব সহজেই
পেয়ে যাবেন। একসময় আন্দোলনকারীদের সেস্নস্নাগান ছিল ্তুবি ধৎব ঃযব মমু.্থ
অর্থাৎ আমরাই সমাজের শতকরা ৯৯ ভাগ। মার্কিনি সমাজে বেশির ভাগ মানুষ যে
বৈষম্যের শিকার, আন্দোলনকারীদের বক্তব্যে সেটাই প্রমাণিত হয়েছিল। অনেকেরই
মনে থাকার কথা, গেল বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে এই আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন
আন্দোলনকারীরা নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের পাশে জুকোট্টি পার্কে জমায়েত হয়ে
পার্কটি দখল করে নিয়েছিল এবং সেখানেই রাতে তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করতে শুরু
করেছিল। একসময় ওই পার্কের মালিক (পার্কটি ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন) কোর্টের
অনুমতি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সেখান থেকে উৎখাত করে। কিন্তু তাতেও
আন্দোলনকারীরা দমে যায়নি। তারা রাস্তার পাশে জমায়েত হয়ে তাদের প্রতিবাদ
অব্যাহত রেখেছে। সংবাদপত্রগুলোর (মার্কিনি) ভাষায় এই আন্দোলন চিহ্নিত করা
হয়েছে 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন হিসেবে। এই আন্দোলন হচ্ছে অসমতা ও
বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ। আজ যখন এই প্রতিবাদ এক দেশ থেকে অন্য
দেশে ছড়িয়ে যায় তখন সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে
একটি নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র বড় অর্থনীতির দেশ।
কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ধনী শ্রেণী হিসেবে পরিচিত একশ্রেণীর
মানুষের বৈষম্য যখন স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে, তখন বুঝতে হবে পুঁজিবাদী সমাজেও
ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এটাও কোনো সমাধান নয়। এক সময় সমাজতান্ত্রিক সমাজকে বলা
হতো বৈষম্যহীন সমাজ, অর্থাৎ সেখানে মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য নেই। কিন্তু
বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল তথাকথিত পার্টির কার্ডধারীরা বিশেষ সুবিধাভোগী।
১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে যখন সমাজতন্ত্রের ভাঙন শুরু হয়েছিল, তখন আমার
অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেই সমাজ প্রত্যক্ষ করার। সমাজে বিরাজমান দ্বন্দ্ব,
একশ্রেণীর ক্ষমতা করায়ত্ব করার কারণেই সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল। সমাজতন্ত্রও
কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। এক সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত, অধিক জনসংখ্যা,
কর্মহীন, শিক্ষাহীন এবং সুশাসনহীন দেশ সোমালিয়া ও সুদানকে বলা হতো অকার্যকর
রাষ্ট্র। অর্থাৎ রাষ্ট্র অকার্যকর। আজ ইউরোপের একটি রাষ্ট্র গ্রিসও
অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের ধনী রাষ্ট্রগুলো গ্রিসকে ১১ বিলিয়ন
ডলার ঋণ দিয়েও গ্রিসের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না।
একসময় ইউরোপে এক মুদ্রা ইউরো চালু হয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৯টি দেশের
মাঝে ১৫টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। কিন্তু সেই এক মুদ্রা ইউরো এখন কাজ করছে
না। গেল অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ইউরোপের ভয়াবহ ঋণ সংকট কাটাতে ইউরোপিয়ান
ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ফান্ড গঠন করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে একটি চুক্তিও
স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তির অংশ হিসেবে গ্রিসের ঋণের ওপর ৫০ শতাংশ
লোকসানের দায় নেবে ইউরো জোনের ব্যাংকগুলো। কিন্তু এই উদ্যোগ ইউরোপের
অর্থনৈতিক সংকটকে মোকাবেলা করতে আদৌ কোনো সাহায্য করতে পারেনি। গ্রিসের
ভবিষ্যৎ কী, তা আগামী দিনগুলোই বলতে পারে। স্পষ্টতই বিশ্ব অর্থনৈতিক
ব্যবস্থা একটা বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর সমাধান কোন
পথে? যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি গত প্রায় দুবছর যাবৎ ভালো যাচ্ছে না।
ইতিমধ্যে সেখানে বেশ কিছু ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরির বাজারও ভালো নয়।
তরুণ গ্রাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কোনো চাকরি পাচ্ছে না। এদের
একটা অংশই তখন জুকোট্টি পার্কে জমায়েত হয়েছিল। অনেকেই জানেন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থায় একটি ধনী শ্রেণীর জন্ম হয়েছে,
যারা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের
সমাজে যখন অসমতা বেশি, তখন এই অসমতা দূর না করে সরকার শত শত কোটি ডলার খরচ
করছে যুদ্ধের পেছনে। একটা তথ্য দেই, যাতে করে পাঠক বুঝতে পারবেন
যুক্তরাষ্ট্র কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে যুদ্ধের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্র এখন
অব্দি ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধের
পেছনে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগান সেনাদের
প্রশিক্ষণের জন্য। যে দেশ শিশুদের নূ্যনতম অধিকার (২১ ভাগ সন্তান নির্ধারিত
দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে) নিশ্চিত করতে পারেনি, সেই দেশ বিলিয়ন
বিলিয়ন ডলার খরচ করে শুধু অন্য দেশের সেনা প্রশিক্ষণের জন্য। পরিসংখ্যান
বলে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৬ জনের মাঝে ১ জন গরিব। ৪ কোটি ৬২ লাখ মানুষ বাস
করে দারিদ্র্যসীমার নিচে, শতকরা হারে যা ১৫ দশমিক ১ ভাগ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর
মাঝে আবার আফ্রো-আমেরিকানদের এবং হিস্পানিকদের সংখ্যা বেশি। এই হার
যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৪ ও ২৬ দশমিক ৬ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর
জন্য চাকরির সংস্থান না করে, তাদের জন্য নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না
করে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে যুদ্ধের পেছনে। এ জন্যই প্রতিবাদটা
উঠেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর থেকেই।যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজিবাদী সমাজে অসমতার যে চিত্র দেখতে পাওয়া যায়, সেই
একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায় পশ্চিম ইউরোপে, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
পুঁজিবাদনির্ভর সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, ওই সমাজেও
বৈষম্য ও অসমতা রয়েছে। দেখা গেল, ধনীরা আরো ধনী হয়েছে, আর শ্রমিক শ্রেণী যে
তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। নোয়াম চমস্ক্রি এই সমাজ ব্যবস্থাকে
'প্লুটোক্রেসি' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ ধনী লোকদের সমন্বয়ে ও ধনী
লোকদের নিয়েই একটি সমাজ ব্যবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই
কথাটা বেশি প্রযোজ্য। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
সিনেটে কিংবা হাউস অফ কংগ্রেসে যারা সদস্য নির্বাচিত হন, তারা একেকজন শত শত
কোটি ডলারের মালিক। অর্থ ছাড়া এখানে যেমনি নির্বাচন করা যায় না, ঠিক তেমনি
এই অর্থই তাদেরকে পরিচালনা করে। অর্থাৎ কংগ্রেসম্যান তথা সিনেটরদের অর্থ
দিয়ে সাহায্য করে বড় বড় ব্যবসায়ীরা। এরাই আবার পরবর্তী সময়ে সিনেটরদের কাছ
থেকে সুবিধা আদায় করে নেয় কিংবা নতুন ব্যবসা বাগিয়ে নেয়। এই যে রাজনীতি, এই
রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের আদৌ কোনো ভূমিকা নেই। এ জন্যই দেখা যায়, কোনো
নির্বাচনে সেখানে খুব কমই ভোট পড়ে।১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পতন ঘটে, তখন ফ্রান্সিস ফুকিয়ামা ঞযব বহফ
ড়ভ ঐরংঃড়ৎু ধহফ ঃযব ষধংঃ সধহ লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর
মাঝে তার ওই প্রবন্ধ বড় ধরনের বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। তিনি বলার চেষ্টা
করেছিলেন, সমাজতন্ত্র যে 'মিথ্যা' ধ্যান-ধারণা তা প্রমাণিত হয়েছে।
পুঁজিবাদনির্ভর 'লিবারেলিজম'ই টিকে থাকবে। তার এই মতবাদের সঙ্গে হয়ত অনেকেই
দ্বিমত পোষণ করবেন। সমাজতন্ত্র মিথ্যা ছিল, এটা বোধ হয় বলা যাবে না।
ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাকে অস্বীকার করা
যাবে না। তবে নিঃসন্দেহে ওই সমাজেও বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। আজ একুশ শতকে এসে
পুঁজিবাদও যে একমাত্র সমাধান, তাও বলা যাবে না। নতুন এক সমাজ ব্যবস্থা,
নতুন এক অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে। এই অর্থনীতির ধরন কী হবে, তা এই মুহূর্তে
বলা না গেলেও, এতটুকু বলা যায় ইন্টারনেটভিত্তিক একটি সমাজ ব্যবস্থা বিকশিত
হচ্ছে, যেখানে কোনো বড় রাষ্ট্রের কিংবা ওই রাষ্ট্রের অর্থনীতির একক প্রভাব
বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই। আগামী দিনগুলোই বলবে ওই অর্থনীতির স্বরূপ কী
হবে। নিউইর্য়কের 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' প্রমাণ করেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে
পরিবর্তনটা আসন্ন।
ড.তারেক শামসুর রেহমান
প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক
16:36
No comments
তা রে ক শা ম সু র রে হ মা ন
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব ও সাবেক ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ও বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের যৌথ অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এটা স্পষ্ট করেই বলা যায়, এই দেশ দুটির মাঝে সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছল। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই চুক্তিটি করা হয়েছে বলা হলেও, চুক্তিটি আদৌ কোনো তৃতীয় দেশ, বিশেষ করে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গেই এ ধরনের চুক্তি করে। গেল সপ্তাহে হঠাত্ করেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কাবুলে গিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি এ ধরনের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। তবে এ ধরনের একটি চুক্তি বাংলাদেশকে মার্কিন প্রভাববলয়ে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অক্ষে নিয়ে যাবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ না-হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা গুরুত্ব দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। যেহেতু এ অঞ্চলে ভারত একটি শক্তি, সেহেতু ভারতকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে মার্কিন নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অতিসম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের আগ্রহটা আরও বেড়েছে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে। একদিকে ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে সেখানে যে ‘শূন্যতার’ সৃষ্টি হবে, মার্কিন নীতিনির্ধারকরা মনে করেন সেই ‘শূন্যতা’ পূরণ হতে পারে ভারতকে দিয়ে, যা চূড়ান্ত বিচারে তার স্বার্থকে রক্ষা করবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত, যার পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার। ভারত সেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করছে। প্রচুর হাইওয়ে তৈরি করছে ভারত। এখানে সীমান্তবর্তী পাকিস্তান বরারবই উপেক্ষিত থেকেছে। আর ভারতের এই বিনিয়োগ সম্ভব হয়েছে মার্কিন নীতিনির্ধারকের সম্মতি দেওয়ার পরই। ধারণা করছি, ২০১৪ সালে মার্কিন বাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হলে ভারতের তথাকথিত একটি ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী সেখানে অবস্থান নেবে। অথবা ন্যাটোর একটি এশীয় সংস্করণ দেখতে পারি আমরা ওই সময়, যেখানে ভারতের একটি অংশগ্রহণ থাকবে। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো যখন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এই বাহিনী শুধু ইউরোপেই নিয়োজিত থাকবে। ন্যাটোর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে ‘ইউরোপের গণতন্ত্র’কে রক্ষা করা। ন্যাটোর সেই ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। প্রথমবারের মতো আফগান যুদ্ধে ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যেহেতু ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্ররা আর আফগানিস্তানে ‘ঝুঁকি’ নিতে চাচ্ছে না, সেহেতু এ অঞ্চলকে ঘিরে ন্যাটোর এশীয় সংস্করণ (সেটা ভিন্ন নামেও হতে পারে) হবে এবং ভারত তাতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এই ‘প্রক্রিয়া’য় বাংলাদেশও জড়িত হবে। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সুবিধা এখানেই যে বাংলাদেশ সরকার ‘ভারতের এই ভূমিকা’কে যা যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, সমর্থন করছে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে আরও দেখা যাবে, অতিসম্প্রতি ভারত পারমাণবিক অস্ত্র বহনযোগ্য যে মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র (অগ্নি-৫) সাফল্যের সঙ্গে উেক্ষপণ করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে যে নীতি গ্রহণ করেছে, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে তার সেই নীতি পরস্পরবিরোধী। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার মিত্র দেশগুলোকে ব্যবহার করছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে এই কাজটি করছে না। বরং ভারতকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে, এই কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে পারমাণবিক চুক্তি রয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অত্যাধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই-আর তা হচ্ছে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো। নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বেশ ক’টি ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশ সফর করার আগে হিলারি ক্লিনটন বেইজিংও সফর করেছেন। সেখানে চীনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার আলোচনা সফল হয়নি। চীনের সমরসজ্জা বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার একটি কারণ। চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা।
চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই গড়ে উঠছে ভারত যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, যে অক্ষে বাংলাদেশও একটি অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্র্যাটেজি বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে গড়ে ওঠা ‘ঈড়হঃধরহঃসবহঃ ঞযবড়ত্ু’র কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি অবলম্বন করেছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে মিয়ানমার, যে দেশটির সঙ্গে চীনের কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। চীনের সীমান্তবর্তী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে। সু চি এখন সংসদ সদস্য। অনেক পশ্চিমা দেশ এখন মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জেনারেল সেইন এখন তার সরকারকে একটি ‘বেসামরিক অবয়ব’ দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশ ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে। এমনকি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিসম্প্রতি, বিশেষ করে গেল ফেব্রুয়ারি থেকে গত ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিলেন মারিয়া ওটেরো (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয় সম্পর্কিত ডেস্ক), রবার্ট ও’ব্লেক (সহকারী পররাষ্ট্র সচিব, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ডেস্ক), ভেন্ডি শেরম্যান (আন্ডার সেক্রেটারি, রাজনৈতিক বিষয়াদি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)। গত ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা শীর্ষক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব (রাজনৈতিক বিষয়াদি) আন্দ্রে শাপিরো। অত্যন্ত গোপনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিংবা কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা সংবাদপত্রে জানানো হয়নি। নিরাপত্তা বিষয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু’দেশ আলোচনা করল কিন্তু জাতি তা জানল না। গোপনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত গোপনই রাখা হল। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে পড়েনি। তবে বাংলাদেশে মার্কিন সেনা মোতায়েনের একটি সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা গত ২ মার্চ সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ বাহিনী’ মোতায়েন রয়েছে। এটি নিয়ে বাংলাদেশে গুজবের সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মজিনা এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন কিছু সেনা রয়েছে, যারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য আসে, আবার চলেও যায়। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা ‘তথাকথিত সন্ত্রাসীদের মোকাবেলার’ জন্য (?) ভিন্ন নামে ও ভিন্ন পরিচয়ে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর লোকজন বাংলাদেশে রয়েছে। এর একটা আইনি কাঠামো দেওয়ার জন্যই ওই নিরাপত্তা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও স্বীকার করে না যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রয়েছে। তবে ভারত তা মনে করে। এ কারণেই ভারতের পক্ষ থেকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সামরিক জোট গঠনের সম্ভাবনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ‘সন্ত্রাসীদের’ কথা বলা হলেও মূল টার্গেট মূলত চীন। চীনকে পেছনে ফেলা। তবে হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় এ বিষয়টি আলোচিত হয়নি। বাংলাদেশে মার্কিন আইওসির (তেল ও গ্যাস সংস্থা) যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। শেভরনের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। শেভরন বর্তমানে জালালাবাদ, মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে কাজ করছে। বাংলাদেশে উত্পাদিত গ্যাসের শতকরা ৫০ ভাগ শেভরন একাই উত্পাদন করে। বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে তাদের কর্মকাণ্ডে স্থানীয় জনগণ অসন্তুষ্ট। সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। এখন কনোকো ফিলিপ চাইছে গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করতে। হিলারি ক্লিনটন পরোক্ষভাবে এটা নিয়েও তদবির করেছেন। বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ‘টিফা’ চুক্তি নিয়েও কথা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ টিফা নয়, বরং টিআইসিএফ বা ‘ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন ফোরাম’ নামে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তবে মন্ত্রিসভায় এখনও তা উত্থাপিত হয়নি। যে নামেই চুক্তিটি হোক, তাতে বাংলাদেশের লাভের সম্ভাবনা কম। এ ধরনের চুক্তি হলে বাংলাদেশ কোনো পাইরেটেড পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। ওষুধ শিল্পও হুমকির মুখে পড়বে। মিসেস ক্লিনটনের সফরের সময় টিআইসিএফ চুক্তিটি চূড়ান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ‘গুম’জনিত পরিস্থিতি নিয়ে হিলারি ক্লিনটন মন্তব্য করেছেন, যা বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক মন্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘গুম’-এর বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হিলারি ক্লিনটনের এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু উপকৃত হবে বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশে যে মার্কিনি প্রভাব বাড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবলয়ে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে।
Daily SAKALER KHOBOR
8.5.12
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র সচিব ও সাবেক ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ও বাংলাদেশের সঙ্গে ওয়াশিংটনের যৌথ অংশীদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর এটা স্পষ্ট করেই বলা যায়, এই দেশ দুটির মাঝে সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছল। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এই চুক্তিটি করা হয়েছে বলা হলেও, চুক্তিটি আদৌ কোনো তৃতীয় দেশ, বিশেষ করে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে কি না, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। যদিও যুক্তরাষ্ট্র অনেক দেশের সঙ্গেই এ ধরনের চুক্তি করে। গেল সপ্তাহে হঠাত্ করেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কাবুলে গিয়েছিলেন। সেখানেও তিনি এ ধরনের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছেন। তবে এ ধরনের একটি চুক্তি বাংলাদেশকে মার্কিন প্রভাববলয়ে নিয়ে যাবে। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের একটি অংশীদারিত্ব চুক্তি বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অক্ষে নিয়ে যাবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ না-হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে যুক্তরাষ্ট্র কিছুটা গুরুত্ব দেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতকেন্দ্রিক যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাতে বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র তার উপস্থিতি বাড়াতে চায়। যেহেতু এ অঞ্চলে ভারত একটি শক্তি, সেহেতু ভারতকে সঙ্গে নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে। বাংলাদেশের ভূ-কৌশলগত অবস্থানের কারণে মার্কিন নীতিনির্ধারক, বিশেষ করে সামরিক নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। অতিসম্প্রতি ভারত-বাংলাদেশ কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় মার্কিন নীতিনির্ধারকদের আগ্রহটা আরও বেড়েছে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র একটি অক্ষ গড়ে উঠেছে। একদিকে ২০১৪ সালে আফগানিস্তান থেকে সকল মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের ফলে সেখানে যে ‘শূন্যতার’ সৃষ্টি হবে, মার্কিন নীতিনির্ধারকরা মনে করেন সেই ‘শূন্যতা’ পূরণ হতে পারে ভারতকে দিয়ে, যা চূড়ান্ত বিচারে তার স্বার্থকে রক্ষা করবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করেছে ভারত, যার পরিমাণ কয়েক বিলিয়ন ডলার। ভারত সেখানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ করছে। প্রচুর হাইওয়ে তৈরি করছে ভারত। এখানে সীমান্তবর্তী পাকিস্তান বরারবই উপেক্ষিত থেকেছে। আর ভারতের এই বিনিয়োগ সম্ভব হয়েছে মার্কিন নীতিনির্ধারকের সম্মতি দেওয়ার পরই। ধারণা করছি, ২০১৪ সালে মার্কিন বাহিনী সেখান থেকে প্রত্যাহার করা হলে ভারতের তথাকথিত একটি ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী সেখানে অবস্থান নেবে। অথবা ন্যাটোর একটি এশীয় সংস্করণ দেখতে পারি আমরা ওই সময়, যেখানে ভারতের একটি অংশগ্রহণ থাকবে। ১৯৪৯ সালে ন্যাটো যখন গঠিত হয়েছিল, তার প্রথম এবং একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল এই বাহিনী শুধু ইউরোপেই নিয়োজিত থাকবে। ন্যাটোর উদ্দেশ্য ছিল সম্ভাব্য সোভিয়েত আগ্রাসন থেকে ‘ইউরোপের গণতন্ত্র’কে রক্ষা করা। ন্যাটোর সেই ধ্যান-ধারণায় পরিবর্তন এসেছে। প্রথমবারের মতো আফগান যুদ্ধে ন্যাটো বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। যেহেতু ন্যাটোর ইউরোপীয় মিত্ররা আর আফগানিস্তানে ‘ঝুঁকি’ নিতে চাচ্ছে না, সেহেতু এ অঞ্চলকে ঘিরে ন্যাটোর এশীয় সংস্করণ (সেটা ভিন্ন নামেও হতে পারে) হবে এবং ভারত তাতে একটি বড় ভূমিকা পালন করবে। এই ‘প্রক্রিয়া’য় বাংলাদেশও জড়িত হবে। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের সুবিধা এখানেই যে বাংলাদেশ সরকার ‘ভারতের এই ভূমিকা’কে যা যুক্তরাষ্ট্র চাইছে, সমর্থন করছে। সূক্ষ্মভাবে লক্ষ করলে আরও দেখা যাবে, অতিসম্প্রতি ভারত পারমাণবিক অস্ত্র বহনযোগ্য যে মিসাইল ক্ষেপণাস্ত্র (অগ্নি-৫) সাফল্যের সঙ্গে উেক্ষপণ করেছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে যে নীতি গ্রহণ করেছে, ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র নীতির ব্যাপারে তার সেই নীতি পরস্পরবিরোধী। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে যুক্তরাষ্ট্র যেখানে তার মিত্র দেশগুলোকে ব্যবহার করছে, সেখানে যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে এই কাজটি করছে না। বরং ভারতকে সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে, এই কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে যেতে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের যে পারমাণবিক চুক্তি রয়েছে, তাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে অত্যাধুনিক পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে একটাই-আর তা হচ্ছে চীনের বিরুদ্ধে ভারতকে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো। নানা কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। বেশ ক’টি ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে মতপার্থক্য রয়ে গেছে। বাংলাদেশ সফর করার আগে হিলারি ক্লিনটন বেইজিংও সফর করেছেন। সেখানে চীনা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে তার আলোচনা সফল হয়নি। চীনের সমরসজ্জা বৃদ্ধি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চিন্তার একটি কারণ। চীন যাতে শক্তিশালী হয়ে উঠতে না পারে সেজন্য ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা।
চীন ইতোমধ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা ভারত মহাসাগরে অন্যতম নৌশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করছে। এটাকে বিবেচনায় নিয়েই গড়ে উঠছে ভারত যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, যে অক্ষে বাংলাদেশও একটি অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই স্ট্র্যাটেজি বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে গড়ে ওঠা ‘ঈড়হঃধরহঃসবহঃ ঞযবড়ত্ু’র কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে ঘিরে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই নীতি অবলম্বন করেছিল। এ কারণে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়োজন। বাংলাদেশের সীমান্তে রয়েছে মিয়ানমার, যে দেশটির সঙ্গে চীনের কৌশলগত সামরিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। চীনের সীমান্তবর্তী দেশ হচ্ছে মিয়ানমার। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের হাওয়া বইছে। সু চি এখন সংসদ সদস্য। অনেক পশ্চিমা দেশ এখন মিয়ানমারের ওপর থেকে অর্থনৈতিক অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছে। জেনারেল সেইন এখন তার সরকারকে একটি ‘বেসামরিক অবয়ব’ দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্র চাইবে বাংলাদেশ ও ভারতকে সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে। এমনকি ভবিষ্যতে এ অঞ্চলে মার্কিন সেনাবাহিনী মোতায়েনের সম্ভাবনার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অতিসম্প্রতি, বিশেষ করে গেল ফেব্রুয়ারি থেকে গত ১৯ এপ্রিল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বাংলাদেশ সফর করেছেন। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিলেন মারিয়া ওটেরো (পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয় সম্পর্কিত ডেস্ক), রবার্ট ও’ব্লেক (সহকারী পররাষ্ট্র সচিব, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ডেস্ক), ভেন্ডি শেরম্যান (আন্ডার সেক্রেটারি, রাজনৈতিক বিষয়াদি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)। গত ১৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে নিরাপত্তা শীর্ষক একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেন সহকারী পররাষ্ট্র সচিব (রাজনৈতিক বিষয়াদি) আন্দ্রে শাপিরো। অত্যন্ত গোপনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে কোন কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিংবা কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা সংবাদপত্রে জানানো হয়নি। নিরাপত্তা বিষয়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু’দেশ আলোচনা করল কিন্তু জাতি তা জানল না। গোপনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত গোপনই রাখা হল। এ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের কোনো মন্তব্যও আমার চোখে পড়েনি। তবে বাংলাদেশে মার্কিন সেনা মোতায়েনের একটি সম্ভাবনা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা হচ্ছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা গত ২ মার্চ সিনেটের এক অধিবেশনে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাসিফিক ফ্লিটের (বাংলাদেশ এর অন্তর্ভুক্ত) কমান্ডার অ্যাডমিরাল রবার্ট উইলার্ড বলেছিলেন বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বিশেষ বাহিনী’ মোতায়েন রয়েছে। এটি নিয়ে বাংলাদেশে গুজবের সৃষ্টি হলে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মজিনা এর একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন কিছু সেনা রয়েছে, যারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট বাহিনীকে প্রশিক্ষণের জন্য আসে, আবার চলেও যায়। পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা ‘তথাকথিত সন্ত্রাসীদের মোকাবেলার’ জন্য (?) ভিন্ন নামে ও ভিন্ন পরিচয়ে মার্কিন বিশেষ বাহিনীর লোকজন বাংলাদেশে রয়েছে। এর একটা আইনি কাঠামো দেওয়ার জন্যই ওই নিরাপত্তা শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সরকারিভাবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও স্বীকার করে না যে বাংলাদেশে সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য রয়েছে। তবে ভারত তা মনে করে। এ কারণেই ভারতের পক্ষ থেকে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সামরিক জোট গঠনের সম্ভাবনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। ‘সন্ত্রাসীদের’ কথা বলা হলেও মূল টার্গেট মূলত চীন। চীনকে পেছনে ফেলা। তবে হিলারি ক্লিনটনের সফরের সময় এ বিষয়টি আলোচিত হয়নি। বাংলাদেশে মার্কিন আইওসির (তেল ও গ্যাস সংস্থা) যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। শেভরনের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। শেভরন বর্তমানে জালালাবাদ, মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে কাজ করছে। বাংলাদেশে উত্পাদিত গ্যাসের শতকরা ৫০ ভাগ শেভরন একাই উত্পাদন করে। বিবিয়ানা গ্যাসফিল্ডে তাদের কর্মকাণ্ডে স্থানীয় জনগণ অসন্তুষ্ট। সেখানে বিক্ষোভ হয়েছে। এখন কনোকো ফিলিপ চাইছে গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন করতে। হিলারি ক্লিনটন পরোক্ষভাবে এটা নিয়েও তদবির করেছেন। বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ‘টিফা’ চুক্তি নিয়েও কথা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশ টিফা নয়, বরং টিআইসিএফ বা ‘ট্রেড অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন ফোরাম’ নামে একটি চুক্তি করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। তবে মন্ত্রিসভায় এখনও তা উত্থাপিত হয়নি। যে নামেই চুক্তিটি হোক, তাতে বাংলাদেশের লাভের সম্ভাবনা কম। এ ধরনের চুক্তি হলে বাংলাদেশ কোনো পাইরেটেড পণ্য বাজারজাত করতে পারবে না। ওষুধ শিল্পও হুমকির মুখে পড়বে। মিসেস ক্লিনটনের সফরের সময় টিআইসিএফ চুক্তিটি চূড়ান্ত হয়েছে। বাংলাদেশে ‘গুম’জনিত পরিস্থিতি নিয়ে হিলারি ক্লিনটন মন্তব্য করেছেন, যা বেশ গুরুত্বের দাবি রাখে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সাম্প্রতিক মন্তব্যের পর যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের পক্ষ থেকে ‘গুম’-এর বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। হিলারি ক্লিনটনের এই সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ কতটুকু উপকৃত হবে বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশে যে মার্কিনি প্রভাব বাড়বে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তাবলয়ে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হবে, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে।
Daily SAKALER KHOBOR
8.5.12
উত্তপ্ত রাজনীতি, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
09:50
No comments
Subscribe to:
Posts (Atom)