রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

গ্রিসে তত্ত্বাবধায়ক সরকার

শেষ পর্যন্ত ইউরোপের দেশ গ্রিসেও একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছে। প্রেসিডেন্ট কারোলোস পাপুলিয়াস শেষবারের মতো চেষ্টা করেছিলেন একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করার। গেল সপ্তাহে এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কয়েক দফা বৈঠক করেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সংবিধান অনুযায়ী জুন মাসেই নির্বাচন দিতে হবে।  আর সে জন্যই তিনি একজন বিচারপতির নেতৃত্বে (প্রানগিওটিস পিকরাসানোস) তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে বাধ্য হয়েছেন, যারা নির্বাচন পরিচালনা করবেন। গ্রিসের সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বলে কিছু নেই। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে গ্রিসের প্রেসিডেন্টকে এ ধরনের একটি সিদ্ধান্ত নিতে হলো।
১৭ জুন সেখানে নির্বাচন। গ্রিসের প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের পরিস্থিতির কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিলো।
 আমাদের সংবিধানেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নেই। তবুও বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে বাংলাদেশে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া কোন বিকল্প নেই, যারা ২০১৩ সালের শেষের দিকে অনুষ্ঠেয় দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনা করবেন। সবচেয়ে বড় কথা দাতাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরাও আগামী নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দেখতে চায়। অতি সম্প্রতি ঢাকাস্থ ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতও বলেছেন সে কথা।  এর আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনও দু’টি বড় দলের মাঝে ‘সংলাপ’-এর আহ্বান জানিয়ে গেলেন। ‘সংলাপ’ হলে ক্ষতির চাইতে লাভের সম্ভাবনা বেশি। যদিও অতীতে ‘সংলাপ’-এর অভিজ্ঞতা ভালো নয়। জলিল-মান্নান ভূঁইয়া 
 ‘সংলাপ’ আমাদের ভালো কিছু উপহার দিতে পারেনি। তবে এবারের প্রেক্ষাপট একটু ভিন্নতর। ‘সংলাপ’ হওয়া উচিত এবং তাতে করে অন্তত উত্তেজনা আমরা হ্রাস করতে পারবো। একই সাথে একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন পরিচালনা করা জরুরী। এটা যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে, তার কোন মানে নেই। অন্য কোন নামেও এটা হতে পারে। সরকারের উদ্যোগে সংবিধান ইতোমধ্যে সংশোধিত হয়েছে। বর্তমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে বিএনপিরও সুস্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে। বিএনপি চাচ্ছে সরকার সংবিধান সংশোধন করুক। এ ক্ষেত্রে সংবিধান সংশোধন না করেও সংসদে গৃহীত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এখানে বিভিন্ন ‘ফর্মুলা’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার ধারণা মহাজোটের শরিকরাও চায় আগামী নির্বাচন হোক একটি নিরপেক্ষ সরকারের আওতায়। এই নিরপেক্ষ সরকারের কাঠামো কী হবে, এটা নিয়েই ‘সংলাপ’ জরুরী। 
বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় রেখে, সংসদ সদস্যদের নিজেদের ‘পদ’ বজায় রেখে (যা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে) যে নির্বাচন, সেই নির্বাচনের কোন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে না। সরকার ভালো করবে যদি বিরোধী দলসহ সকল দলের সাথে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করে। 
এতে করে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা আরো বাড়বে। হিলারি হরতাল না করার আহ্বান জানিয়ে গেছেন। হরতাল এ দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি অংশ। অতীতেও হরতাল হয়েছে। বিরোধী দল হরতাল আহ্বান করে তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য। তবে সব ক্ষেত্রে দাবি-দাওয়া আদায় হয় না। সাম্প্রতিক সময়ের যে হরতাল, সেই হরতালের পেছনে যুক্তি আছে। ইলিয়াস আলীকে কে বা কারা ‘গুম’ করলো, রাষ্ট্র তা জানবে না, তা হতে পারে না। বিএনপি এই ইস্যুতে হরতাল করেছে। হরতাল পালন করার মধ্য দিয়ে ইলিয়াস আলী ফিরে আসেননি। এটা দুঃখজনক। তবে এই ইস্যুতে ভবিষ্যতে হরতাল দেয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের উপর প্রত্যক্ষ চাপ সৃষ্টি করা। হরতালে দেশের ক্ষতি হয়। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হন, সবচেয়ে বড় কথা বিদেশী পুঁজি বিনিয়োগকারীরা, কিংবা আরএমজির ক্রেতারা বাংলাদেশের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেন। সরকারের এটা বোঝা উচিত কেন বিরোধীদল হরতাল দেয়। সেই ‘পরিস্থিতি’ যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন।
আরো একটি কথা, ইলিয়াস আলীর পাশাপাশি শ্রমিক নেতা আমিনুল ইসলামের অন্তর্ধান (পরবর্তীতে হত্যা) রহস্য উন্মোচন হওয়া প্রয়োজন। এটা কি কোন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড? জনপ্রিয় একজন শ্রমিক নেতার মৃত্যু ‘ভুল সিগন্যাল’ পৌঁছে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার লেবার অর্গানাইজেশন অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা বাংলাদেশী তৈরি পোশাক বয়কটের ডাক দিতে পারে। আমরা যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আমাদের পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দাবি করছি, সেখানে এই হত্যাকাণ্ড ও এর বিচার না হওয়া, বাংলাদেশের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। আমাদের তৈরি পোশাকের স্বার্থেই আমিনুলের হত্যাকাণ্ডের বিচার হওয়া উচিত।
এদিকে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে হিলারি ক্লিনটনের একটি মন্তব্যের যে প্রতিক্রিয়া অর্থমন্ত্রী দেখিয়েছেন, তা শোভন নয়। তার জবাব ভদ্রজনিত হওয়া উচিত ছিল। এখানে ‘রাগ দেখানো’র কোন সুযোগ নেই। ব্যক্তি ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় কী করেছেন, সেটা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে সারা বিশ্ব জুড়েই ড. ইউনূসের অনেক ‘বন্ধু’ রয়েছেন। ড. ইউনূসের অপসারণের ঘটনায় তারা আহত হয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনায় কোন একটি ক্ষেত্রে তাঁকে রাখা গেলে ক্ষতি কি? তিনি নিশ্চয়ই এখন আর আগের মত গ্রামীণ ব্যাংকে প্রভাব খাটাতে পারবেন না। সরকার এই বিষয়টি ভেবে দেখলে ভালো করবে।
এমসিএ বা মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ অ্যাকাউন্টস থেকে আমরা সহায়তা পাচ্ছি না। বড় বাধা আমাদের দুর্নীতি। এই দুর্নীতি আমরা রোধ করতে পারছি না। পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্বব্যাংক। ঢাকা সফরে এসে জাপানি উপ-প্রধানমন্ত্রীও বলে গেলেন বিশ্বব্যাংকের সাথে সমস্যা মিটিয়ে ফেলার। বিএনপিও বলছে বিশ্বব্যাংকের সাথে বিরোধ মিটিয়ে বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আমাদের স্বার্থেই আমাদের বিশ্বব্যাংকের সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা উচিত। হিলারি ক্লিনটন মূলত এ কথাগুলোই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বলে গেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না এই বিষয়গুলো আগামী নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এ ক্ষেত্রে একটি নিরপেক্ষ সরকার না হলে কোনভাবেই সাধারণ মানুষের মনোভাব  প্রতিফলিত হবে না। সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে হলে তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
হিলারি ক্লিনটনের মত ব্যক্তিরা ঢাকায় এসে এ কথাটাই আমাদের বলে গেছেন। সরকার যদি এটা উপলব্ধি করতে না পারে, তাহলে সরকার ভুল করবে। আমাদের কাছে প্রচুর দৃষ্টান্ত রয়েছে যেখানে জাতির বৃহত্তর স্বার্থের খাতিরে সরকার এমন সব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা সংবিধান সম্মত ছিল না। যেমন ২০০৮ সালে কেনিয়া ও জিম্বাবুয়ের কথা আমরা বলতে পারি। এই দু’টো দেশে প্রধানমন্ত্রীর কোন পদ ছিল না সংবিধানে। কিন্তু রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলায় ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট মুগাবে (জিম্বাবুয়ে) সালঙ্গিরাইকে প্রধানমন্ত্রী ও কেনিয়াতে প্রেসিডেন্ট কি বাকি বিরোধী দল নেতা অর্ডিগাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিতে বাধ্য হন। আজ গ্রিসের সাথে সাথে আমরা পাকিস্তানের দৃষ্টান্তও দিতে পারি। সাম্প্রতিককালে পাকিস্তানের সংসদেও একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন আয়োজন করার। আমরা চাই দেশে তত্ত্বাবধায়ক তথা নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার একটা ঘোষণা সরকার দিক। এর মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনা হ্রাস করা সম্ভব। গ্রিস আমাদের জন্য একটা উদাহরণ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমরা এই উদাহরণটা অনুসরণ করতে পারি।

0 comments:

Post a Comment