রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জেসিসি বৈঠক নিয়ে কিছু কথা



সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জেসিসি বা বাংলাদেশ-ভারত যৌথ পরামর্শক কমিশনের প্রথম বৈঠক। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওই বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। জেসিসি বৈঠক শেষে যে যৌথ বিবৃতিটি প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে চিহ্নিত সীমান্ত ও অপদখলীয় ভূমির নকশা স্বাক্ষরসহ স্থলসীমান্ত চুক্তির প্রটোকল দ্রুত বাস্তবায়নে দু’দেশ সম্মত হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে আমার কাছে যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়েছে, তা হচ্ছে বন্দি বিনিময় চুক্তি দ্রুত স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত। এর বাইরে সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সহযোগিতা, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়, আশুগঞ্জে ভারতীয় সহায়তায় একটি কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপন, বাণিজ্য বৃদ্ধির উদ্যোগ ইত্যাদি যেসব বিষয় স্থান পেয়েছে, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ, যেমন তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি, টিপাইমুখ বাঁধ, ছিটমহল বিনিময়, ভারতীয় ১০০ কোটি ডলার ঋণ নিয়ে জটিলতা, সীমান্তে বিএসএফের হত্যাকাণ্ড ইত্যাদির ক্ষেত্রেও কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত আমরা পাইনি।
যৌথ বিবৃতিতে যে ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা কূটনৈতিক ভাষা। এখানে আমাদের প্রাপ্তি শূন্য। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতীয় ইচ্ছাই প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন বন্দিবিনিময় চুক্তি। এ ব্যাপারে নীতিগতভাবে দু’দেশ সম্মত হয়েছে। এখন শুধু চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের অপেক্ষা। অনেকেই জানেন, এই চুক্তিটি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে ভারত মূলত একটি জিনিসই চায়Ñ আর তা হচ্ছে উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ফেরত পেতে। অনুপ চেটিয়া এখন বাংলাদেশের জেলে আটক। বন্দিবিনিময়ের যে চুক্তিটি হতে যাচ্ছে, তাতে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি নিজ দেশে সাজা খাটার সুযোগ পাবেন। এক্ষেত্রে অনুপ চেটিয়া ভারতে সাজা খাটতে পারেন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য এই মুহূর্তে অনুপ চেটিয়াকে অত্যন্ত দরকার। উলফা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকার একটা আলাপ-আলোচনা শুরু করেছে। উলফার চেয়ারম্যান এখন তাদের কব্জায়। এ জন্যই তাদের অনুপ চেটিয়াকে দরকার। কিন্তু বিষয়টি কি অত সহজ হবে? অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে একটি আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে। কারণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। তার সেই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে, এমন তথ্য আমাদের জানা নেই। এ অবস্থায় রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী কোন ব্যক্তিকে ফেরত পাঠানো যায় কিনা, তা এক প্রশ্ন বটে। যে কোন আন্তর্জাতিক আইনের এটা পরিপন্থী। এতে করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্ট হতে বাধ্য।
তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারটি নিয়ে একটি ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে এ সংক্রান্ত কোন দিকনির্দেশনা না থাকলেও বিবিসির বাংলা বিভাগ (৯ মে) আমাদের জানাচ্ছে যে, তিস্তার পানি বণ্টনের ব্যাপারে আদৌ কোন চুক্তি হচ্ছে না। এ কথাটা নাকি দীপু মনিকে জানিয়েও দেয়া হয়েছে। যদিও দীপু মনি তা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারত প্রতিশ্র“তি দিলেও এখন অবধি কোন চুক্তি হয়নি। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্যা। আমরা আমাদের ন্যায্য অধিকার চাই। কিন্তু ভারত আমাদের সেই অধিকার নিশ্চিত করছে না। টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও ভারত আমাদের বারবার মিথ্যা আশ্বাস দিচ্ছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং একাধিকবার বলেছেন, ভারত এমন কিছু করবে না, যাতে বাংলাদেশের ক্ষতি হয়। কিন্তু বাস্তবতা কী বলে? নয়াদিল্লিতে ইতিমধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সেখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করার। প্রায় ৯ হাজার কোটি রুপিও ব্যয় করা হয়ে গেছে। বাঁধটি যদি নির্মিত হয়, তাতে বাংলাদেশের কী ক্ষতি হবে, তা একাধিক সেমিনারে আলোচিত হয়েছে। এখানে আমাদের ব্যর্থতা হল আমরা শক্ত অবস্থানে যেতে পারছি না। জেসিসির যৌথ ইশতেহারে এ সংক্রান্ত কোন কথা নেই। গঙ্গা চুক্তি আমরা করেছিলাম ১৯৯৬ সালে। চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৭ সালে। এর আগেই পদ্মায় পানি নেই। চুক্তি অনুযায়ী আমরা পানি পাচ্ছি না। ২০২৭ সালে লোকসংখ্যা বাড়বে ৩ গুণ। যে বিপুল পানির চাহিদা থাকবে, তার কী হবে? চুক্তি অনুযায়ী পর্যালোচনার সুযোগ আছে। কিন্তু সেই সুযোগটি আমরা নিচ্ছি কই? জেসিসির সভায় আমরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করিনি।
সীমান্ত হত্যা আজও বন্ধ হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরও একের পর এক সীমান্ত হত্যা হচ্ছে। এমন কোন দৃষ্টান্ত নেই যেখানে বিজিবির গুলিতে কোন ভারতীয় নাগরিক মারা গেছেন। প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন নিরপরাধ বাংলাদেশী নাগরিক। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত ৪০ মাসে কতজন বাংলাদেশী মারা গেছেন, তার পরিসংখ্যান ‘অধিকার’-এর কাছে আছে। এ নিয়ে কত শীর্ষ বৈঠক হল। কিন্তু হত্যা বন্ধ হয়নি। জেসিসির বৈঠকে এটা নিয়ে কিছু বলা হল না। সীমান্ত চিহ্নিত ও অপদখলীয় ভূমির নকশা স্বাক্ষরের ওপর জেসিসি বৈঠকে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরে ভারতের ১১১টি ছিটমহল ও ভারতের ভেতরে বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের ব্যাপারে আমরা কিছুই শুনলাম না। ভারতের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা ভারতেই থাকতে চান। ঠিক তেমনি বাংলাদেশের ভেতরে যারা রয়েছেন, তারা বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবেই থাকতে চান। ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল সেই ১৯৭৪ সালে। তারপর কখনোই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগ নেয়নি সংবিধান সংশোধন করার। সমস্যাটা তো আমাদের নয়, সমস্যা ভারতের। আজ প্রায় ৩৮ বছর পরও এ কথাগুলো আমাদের বলতে হয়। এটা কি ভারতের সদিচ্ছা প্রমাণ করে?
১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছিল ভারত। প্রণব বাবু ঢাকায় এসে ২০ কোটি ডলার অনুদানের কথা বলে গেলেন। কিন্তু ঋণের টাকা দিয়ে তো প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে না! ১৩ প্রকল্প চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু সমন্বয়হীনতার অভাবে প্রকল্পগুলো আটকে আছে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে বিশাল এক বাণিজ্য ঘাটতি। ২০০৯-১০ সালে ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। আর ২০১০-১১ সালে তা এসে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলারে। ২০১১-১২ সালের পরিসংখ্যান এখন আমাদের হাতে আসবে, ধারণা করছি তা ৪ বিলিয়ন ডলারের অঙ্ককে ছাড়িয়ে যাবে। ভারত মাঝেমধ্যে কিছু পণ্যের শুল্কমূল্য প্রবেশাধিকারের কথা বলে বটে; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশ এসব পণ্যের অনেকগুলোই রফতানি করে না। ভারতের অশুল্ক বাধা দূর করা নিয়েও ‘নানা কাহিনী’ আছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় নানা ধরনের শুল্ক দূর করা যাচ্ছে না। ভারতে বাংলাদেশের রফতানি সেই তুলনায় বাড়ছে না। ফলে ঘাটতি বাড়ছেই। এটা আমাদের জন্য শংকার কারণ।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়টি যৌথ ইশতেহারে আছে বটে। কিন্তু ২০১৩ সালে আমরা আদৌ বিদ্যুৎ পাব, এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। বাংলাদেশ বড় ধরনের বিদ্যুৎ সংকটের মুখে। বিদ্যুতের অভাবে উৎপাদন বন্ধ অনেক কারখানায়। অথচ ভারত যদি আন্তরিক হয়, তাহলে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান সম্ভব। ভুটানে সারপ্লাস বিদ্যুৎ রয়েছে। এই বিদ্যুৎ ভুটান বাংলাদেশে রফতানি করতে পারে। কিন্তু সম্মতি প্রয়োজন ভারতের। দুর্ভাগ্যজনক, ভারতের সম্মতি পাওয়া যায়নি।
আশুগঞ্জে যে কনটেইনার টার্মিনাল স্থাপনের কথা যৌথ ইশতেহারে বলা হয়েছে, তাতে লাভবান হবে ভারত। আমরা লাভবান হব না। ভারত তার পণ্যের পরিবহন সুবিধার জন্যই এই টার্মিনাল ব্যবহার করছে। তিতাস নদীতে বাঁধ দিয়ে আমরা ভারতীয় কনটেইনারগুলো পরিবহনের সুযোগ করে দিয়েছি। ভারত প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে, আমাদের স্বার্থ হয়ে পড়েছে গৌণ। এবার জেসিসির বৈঠকের পর যৌথ ইশতেহারে যেসব বক্তব্য স্থান পেয়েছে, তাতে ওই ভারতীয় স্বার্থকেই বেশি করে প্রাধান্য দেয়া হল মাত্র।
বাংলাদেশীরা খুবই অতিথিপরায়ণ। সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে, প্রণব মুখার্জির ঢাকা সফরের সময় আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে পায়েস রান্না করে তাকে খাইয়েছেন। কত আন্তরিক হলে আমাদের সরকারপ্রধান এ কাজটি করতে পারেন! আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো নয়াদিল্লিতে পদ্মার ইলিশ, মিষ্টি আর সিরামিকের উপহার সামগ্রী নিয়ে গিয়েছিলেন। এটা তো মিথ্যা নয়। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ‘ইলিশ কূটনীতি’ কি আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছে? আমরা কি আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে পেরেছি? যৌথ ইশতেহারের ভাষাই বলে দেয় আমাদের প্রাপ্তি খুব বেশি নয়। আমরা বারবার আশ্বাস পাচ্ছি। ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে বারবার আশ্বাস দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। আমরা আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে ব্যর্থ হয়েছি। আমাদের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি, দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় কৌশল অবলম্বন করতে আমাদের ব্যর্থতা, জাতিসংঘ সনদের ১(৭) ধারা অনুযায়ী সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে আমাদের ব্যর্থতা আমাদের সব ‘অর্জন’কে ম্লান করে দিয়েছে। হিলারি ক্লিনটন ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশকে ‘সফট পাওয়ার’ (ঝড়ভঃ চড়বিৎ) হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু আমাদের এই মর্যাদা আমরা ধরে রাখতে পারব না, যদি না আমরা ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের স্বার্থ আদায় করে নিতে না পারি।
Daily JUGANTOR
19.5.12

0 comments:

Post a Comment