রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

জাবির ‘কালো বিড়াল’!

সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারির ঘটনা নিয়ে ‘কালো বিড়াল’র কাহিনী যখন সাধারণ মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে, ঠিক তখনই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ‘কালো বিড়াল’র কাহিনী ছাপা হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে (যুগান্তর) গত ৪ মে। সংবাদটিতে বলা হয়েছে চাকরি দেয়ার নাম করে ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় জনতার হাতে আটক হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মচারী। নাম তার জসিমুদ্দিন। অনেকটা সেই এপিএস ওমর ফারুকের ৭০ লাখ টাকার কাহিনীর মতো। কী অদ্ভুত এক মিলÑ অভিযুক্ত ওমর ফারুকও ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। অভিযোগে বলা হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নাম করে এই অর্থ সংগ্রহ করেছিল জসিমুদ্দিন। তিনি যে সেকশনে চাকরি করেন, সেই সেকশনের প্রধানও স্বীকার করেছেন এর সত্যতা। তাহলে কী দাঁড়ালো ব্যাপারটা। ভিসি বিরোধী আন্দোলনকারী ‘শিক্ষক সমাজ’ ও সাংস্কৃতিক কর্মীরাও দীর্ঘদিন ধরে এ কথাটাই বলে আসছিলেন যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদায়ী উপাচার্যের সময় শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি জড়িত। এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় অভিযুক্ত জসিমুদ্দিনের বিরুদ্ধে জাবির অ্যাকাউন্টস অফিসার আবদুস সাত্তার কর্তৃক আশুলিয়া থানায় মামলা দায়ের করার পর। তখন ‘শিক্ষক সমাজ’র অভিযোগটি প্রমাণিত হলো। শিক্ষক নিয়োগেও এই ‘টাকার খেলা’ হয়েছে। দুই  থেকে তিনজন শিক্ষকের নাম পত্র-পত্রিকায়ও উঠে এসেছে, যারা টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক নিয়োগে কর্তৃপক্ষকে ‘সহযোগিতা’ করেছেন। কিছুদিন আগে আমার কাছেও এ ধরনের একটি লিখিত অভিযোগ এসেছিল। সেদিন আমি গুরুত্ব দেইনি।

দীর্ঘ তিন মাসের আন্দোলনে আপাতত একটি সমাধান পাওয়া গেছে। শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের অনশন ভঙ্গ হয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে তা কি ফিরে পাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়? ভিসি পদটি ছেড়ে দিলেও গত তিন মাসে যেসব প্রশ্নের জন্ম হয়েছে, সেসব প্রশ্নের কোনো সমাধান পাওয়া যাবে কি-না, আমরা সে ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত নই। এর আগে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের দু’জন শিক্ষককে রেজিস্ট্রার বলেছেন শিক্ষক গ্রেপ্তারের ঘটনা তিনি জানেন না। তাহলে কে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছিল? একজন ক্রিমিনালের মতো দু’জন শিক্ষককে গভীর রাতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবেÑ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে তাতে করে কি উপাচার্যের সম্মান থাকে। উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব অনেক পুরনো। বিভাগের সভাপতি নিজেই বিতর্কিত একজন ব্যক্তি। কিছুদিন আগে বিভাগের একজন সিনিয়র শিক্ষিকাকে (যিনি তার শিক্ষকও বটে) অসম্মানিত করার অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হয়েছিলেন। শিক্ষক সমিতির ওই ঘটনার বিচারও চেয়েছিল। উপাচার্য মহোদয়ের উচিত ছিল ওই বিভাগের ব্যাপারে বিশেষ দৃষ্টি দেয়া। তার শৈথিল্যের সুযোগেই ওই  বিভাগের সভাপতিকে লাঞ্ছিত করার ঘটনা ঘটেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শ্রেণীর শিক্ষক কর্তৃক ক্ষমতা প্রদর্শন, ক্ষমতার অপব্যবহার করার কারণে একের পর এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচিত সভাপতিকে লাঞ্ছিত করেছিলেন আরেক শিক্ষক, যিনি উপাচার্যের খুব আস্থাভাজন একজন জুনিয়র শিক্ষককে লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছিল। তারও বিচার হয়নি আজো। নৃবিজ্ঞান বিভাগেও একজন সিনিয়র শিক্ষক কর্তৃক একজন জুনিয়র শিক্ষককে  লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটেছিল। তারও বিচার হয়নি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে  একের পর এক অনিয়ম হচ্ছে। পরীক্ষায় অতিরিক্ত নাম্বার দিয়ে বিশেষ বিশেষ ছাত্রকে প্রথম শ্রেণী পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে কোনো একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে, একজন সিনিয়র শিক্ষককে অসম্মানিত করার অভিযোগও রয়েছে দু’জন জুনিয়র শিক্ষকের বিরুদ্ধে তারও বিচার করেননি উপাচার্য মহোদয়। প্রতিটি ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এবং দলীয় শিক্ষকরা এসব ঘটনার সাথে জড়িত। কোনো একটি ঘটনারও যদি বিচার হতো, তাহলে এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটত না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি আজ এমন এক পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে যে কোনো শুভবুদ্ধির মানুষ এখন আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় আসবেন না। আন্দোলনকারী শিক্ষকরা উপাচার্য অফিসের সম্মুখে উপাচার্য প্রত্যাখ্যান মঞ্চ তৈরি করেছিলেন। একজন উপাচার্যের জন্য এর চেয়ে আর অসম্মানজনক কিছু হতে পারে না। উপাচার্য মহোদয়ের অতীতের সব অর্জন এখন ভেস্তে গেল। একজন শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে তার জন্য আমার কষ্ট হয়। একজন উপাচার্য এভাবে অপমানিত হবেন, তা তো কাম্য হতে পারে না। উপাচার্যের পদটি অনেক সম্মানের। উপাচার্য মহোদয় অনেকগুলো কাজ ‘সঠিক’ করেননি। অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগের প্রয়োজন ছিল না। দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ, বিভাগে অতিরিক্ত শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও (যাদের আদৌ কোর্স দেয়া যাচ্ছে না) নতুন করে শিক্ষক নিয়োগে, কোনো কোনো বিভাগে সিনিয়র শিক্ষকের পরিবর্তে প্রভাষক নিয়োগ দিয়ে একটা ক্ষমতার বলয় সৃষ্টি করা, দলীয় শিক্ষকদের কন্যা ও তাদের স্বামীদের কিংবা ছেলেকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা, কর্মচারী নিয়োগে গোপালগঞ্জের আধিবাসীদের একচ্ছত্রভাবে নিয়োগ দেয়া, সর্বোপরি সব ধরনের নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ জাবির উপাচার্যের পদটিকে অসম্মানিত করেছে। অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীর এসব ঘটনায় কতটুকু ‘উপকৃত’ হয়েছেন, আমি বলতে পারব না। কিন্তু গত তিন মাস যখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ ছাপা হয়ে আসছে, তখন নিজেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে ভাবতে কষ্ট হচ্ছে। তিনি আপাতত আছেন বটে। কিন্তু আর কতদিন, সেটাই প্রশ্ন।

বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হলো। অনশন প্রত্যাহার করা হলো। কিন্তু তাতে করে কি এই আন্দোলন বন্ধ হবে? যাদের দিয়ে তিনি সংলাপ কমিটি গঠন করেছিলেন, তারা কোনো সমাধান দিতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল। উপাচার্য মহোদয়ের হিসেবে কিছুটা ‘ভুল’ হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসুক, আমি তা চাই। উপাচার্য মহোদয় ছাত্র-শিক্ষকদের অনশনের আগে যে কাজটি করতে পারতেন, তা হচ্ছে; ১. ‘শিক্ষক সমাজের’ নেতৃবৃন্দের সাথে একটা ‘সংলাপ’ শুরু করা; ২. উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা এবং সে লক্ষ্যে সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করা; ৩. ‘অযোগ্য’ শিক্ষকদের নিয়োগ বাতিল অথবা তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য একটি ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করা। এতে ‘শিক্ষক সমাজ’-এর প্রতিনিধি ও শিক্ষক সমিতির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা; ৪. শিক্ষকদের ওপর হামলায় যাদের নাম পত্র-পত্রিকায় এসেছে, তাদের আজীবনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা; ৫. ‘পাারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ের’ প্রবণতারোধ করার লক্ষ্যে সিন্ডিকেটে অতি দ্রুত একটি সিদ্ধান্ত নেয়া; ৬. ক্যাম্পাসে মিছিল ও সমাবেশ করার ওপর যে সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট নিয়েছিল, তা বাতিল করা; ৭. শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার জন্য সকল নিয়োগ স্থগিত রাখা।

আমি জানি শিক্ষক সমাজের এই আন্দোলন কোনো দলের আন্দোলন নয়। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো চান। ক্লাসে ফিরে যেতে চান। এদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটি ছিল উপাচার্য মহোদয়ের। কিন্তু তা করতে তিনি ব্যর্থ হয়েছিলেন। ফলে ছাত্র-শিক্ষকদের দীর্ঘদিন অনশনে যেতে হয়েছিল। এটা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে রইল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য।

একজন উপাচার্য যাবেন, আরেকজন উপাচার্য আসবেন। এটাই নিয়ম। কিন্তু উপাচার্য মহোদয় যে কাজটি করলেন ছাত্রদের লেলিয়ে দিলেন শিক্ষকদের বিরুদ্ধে, পাল্টা শিক্ষকদের দিয়ে একটি ‘মঞ্চ’ তৈরি করলেন- তাতে করে সুধী সমাজে তার ভাবমূর্তি বেড়েছে বলে মনে হয় না।

বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো উপাচার্যের অপসারণের দাবিতে ছাত্র-শিক্ষকরা অনশন করেছেন, কিংবা তার কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়েছে, এ তথ্য আমার জানা নেই। এটা সত্যিই দুঃখজনক। এই তিন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ‘ক্ষতি’ হয়েছে। ‘সেশনজট’র হুমকির মুখে এখন বিশ্ববিদ্যালয়টি। উপাচার্য হয়ত চলে যাবেন। উপাচার্য ‘খেদাও’ আন্দোলনে আজ যারা জড়িত ছিলেন, কিংবা যারা উপাচার্যের পক্ষাবলম্বন করেছেন, তাদের সবার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসা। সেই সাথে দুর্নীতির ‘কালো বিড়াল’র সাথে যারাই জড়িত থাকুন, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থেই তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া প্রয়োজন।


যায়যায়দিন 15 মে 2012

0 comments:

Post a Comment