রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আবারো সীমান্তে হত্যা

আবারো সীমান্তে হত্যা হয়েছে। গত ২৫ মে একাধিক জাতীয় দৈনিকে সীমান্ত হত্যা নিয়ে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ওই সংবাদে বলা হয়েছে, গত ২৩ মে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী সীমান্তের আমড়া বিওপির সোনাপাড়া, রসুলপুর সীমান্তের ছোট সইচান্দা গ্রামের মো. নাজের আলী বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। এ কথা স্বীকার করেছেন ফুলবাড়ী ৪০ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়ানের অধিনায়ক লে. কর্নেল তায়েফ উল হক (সমকাল, ২৫ মে)। এ ধরনের সীমান্তে হত্যার ঘটনা এই নতুন নয়। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই সীমান্তে হত্যা হচ্ছে এবং নিরপরাধ বাংলাদেশি
নাগরিকরা বিএসএফের গুলিতে মারা যাচ্ছে। কিশোরী ফেলানীর মৃত্যু কিংবা চাঁপাইনবাবগঞ্জের যুবক হাবিবুর রহমানকে উলঙ্গ করে অত্যাচারের দৃশ্য যখন বিশ্বব্যাপী বিতর্কের ঝড় তুলেছিল, সেদিন ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল_ এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের দৃষ্টিও আকৃষ্ট হয়েছিল। তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘাটে সে ব্যাপারে বিশেষ পদক্ষেপ নেয়ার। বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দকেও তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন_ এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। কিন্তু তারপরও একটি নয়, একাধিক হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটেছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, নিউইয়র্ক ভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ হাবিবুর রহমানের অত্যাচারের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিচার দাবি করেছিল। প্রভাবশালী ভারতীয় দৈনিক দি হিন্দু হাবিবের অত্যাচারের ঘটনায় বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ারও আহ্বানও জানিয়েছিল। এটা সত্য যে, হাবিবুর রহমানের অত্যাচারের সঙ্গে জড়িত ৮ জন বিএসএফ সদস্যকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও বিএসএফের অত্যাচার বন্ধ হয়নি। এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি_ আসলেই কী বিএসএফের এই হত্যাকা- বন্ধ হবে?
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিয়ে নানা সমস্যা রয়েছে। এটা নিয়ে অতীতে দুদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত নির্যাতনের হার কমছে না_ উদ্বেগের কারণ এটাই। আজ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কিংবা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো যখন সীমান্ত নির্যাতন নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে, তখন বিষয়টিকে হালকাভাবে নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। তখন ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দুঃখ প্রকাশ করে প্রকারান্তরে 'দোষ' স্বীকার করে নিয়েছিলেন। তার এই সৎসাহসের জন্য তিনি নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। তিনি বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন ও ভালোবাসা পাবেন, যদি তিনি এই নির্যাতন বন্ধে কার্যকর কোনো কর্মসূচি হাতে নেন। দুঃখ প্রকাশ করে হাবিবুর রহমানের সম্মান ফিরিয়ে দেয়া যাবে না। আস্থা অর্জন করতে হলে নিতে হবে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা। নাদের আলীদের হত্যাকা- তাকেই বন্ধ করতে হবে।
বিএসএফের নির্যাতন আজ চরম পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়েছে। হাবিবুর রহমানের নির্মম অত্যাচারের রেশ কাটতে না কাটতে গত ২৬ জানুয়ারি ছাপা হয়েছিল আরেকটি সংবাদ_ কুড়িগ্রামের ভুরঙ্গামারী সীমান্তে বাংলাদেশি আবদুল লতিফ লেবুর লাশ ফেরত দিয়েছিল ভারতীয় পুলিশ। সরকারের এটা বড় ব্যর্থতা যে, সরকার শক্ত হাতে এ ধরনের হত্যাকা-ের প্রতিবাদ করতে পারছে না। বাংলাদেশের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে বিএসএফ এই সুযোগটি নিচ্ছে। দুঃখজনক হচ্ছে এটাই যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর ভারতকে একের পর এক সুযোগ দেয়ার পরও বিনিময়ে আমরা পাচ্ছি বাংলাদেশিদের লাশ। এটা কোন ধরনের বন্ধুত্বের নিদর্শন, সহজেই অনুমান করা যায়। সত্যিকার অর্থেই ভারত বাংলাদেশকে একটি বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে গণ্য করে কী-না এটা বড় প্রশ্ন এখন। বাংলাদেশকে তাদের প্রয়োজন নানা কারণে। প্রায় ১৬ কোটি দেশের এই জনগোষ্ঠী ভারতের জন্য বিশাল একটা 'বাজার'। ভারত দেখছে তাদের স্বার্থ। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসে সীমান্তে হত্যা বন্ধ হবে বলে আশ্বাস দিলেও, তা আদৌ কার্যকর হয়নি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আদৌ সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনো নির্দেশ দেননি। দিলে হাবিব বা নাদের হত্যার মতো ঘটনা ঘটত না। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, গত এক যুগে বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ১০০৬ জন বাংলাদেশি। খুব সূক্ষ্মভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশ ছাড়া ভারতের সীমান্ত রয়েছে মিয়ানমার, পাকিস্তান, ভুটান, নেপাল ও চীনের সঙ্গে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সরাসরি সীমান্ত না থাকলেও, শ্রীলঙ্কার সীমান্তও খুব বেশি দূরে নয়। কিন্তু কোনো একটি সীমান্তে কী এ ধরনের হত্যাকা- কখনো হয়েছে? চোরাকারবারির অভিযোগ তোলা হয়। কিন্তু ভারত-নেপাল সীমান্ত কিংবা ভারত-মিয়ানমার সীমান্তে চোরাকারবারি বা মাদক ব্যবসায়ীদের তৎপরতা কম নয়। তাহলে ওইসব সীমান্তে ভারত হত্যাকা- চালায় না কেন? এখানেই এসে যায় মূল প্রশ্নটি। আসলে ভারত বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। আমাদের ব্যর্থতা এখানেই যে, আমরা এই সমমর্যাদা নিশ্চিত করতে পারিনি। কাঁটাতারের বেড়ায় যখন কিশোরী ফেলানীর লাশ ঝুলে ছিল, সেদিন আমরা এর প্রতিবাদ করেছিলাম। কিন্তু অত্যাচার বন্ধ হয়নি। আমরা ব্যর্থ হয়েছিলাম। আমাদের এই 'ব্যর্থতা' বহির্বিশ্বে আমাদের ভাবমূর্তি যথেষ্ট নষ্ট করেছে। আমরা অবশ্যই ভারতের বন্ধুত্ব চাই। বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত বড় ভূমিকা রাখতে পারে_ এটাও আমরা মনে করি। কিন্তু এই 'বন্ধুত্ব' এখন যেন একতরফা হয়ে যাচ্ছে। গত ২৬ জানুয়ারি সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল একটি সংবাদ_ তাতে বলা হয়েছিল ভারতকে দ্রুত চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করতে দেয়ার জন্য একজন উপদেষ্টার নেতৃত্বে (ড. মসিউর রহমান) একটি কমিটি গঠিত হয়েছে। এরা কাজ করছে। অর্থাৎ এখানেও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার একটি তাগিদ। একই দিন কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল আরেকটি সংবাদ_ গেল সেপ্টেম্বরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরের সময় যে ছিটমহল বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, তা আদৌ ভারতীয় মন্ত্রী সভায় উত্থাপিত হয়নি বরং অনুমোদিতও হয়নি। কেননা এতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ও বিজেপির আপত্তি রয়েছে। এর অর্থ কী? চুক্তি হল; কিন্তু তা কার্যকর করল না ভারত। আমরা নদীকে 'হত্যা' করে বাঁধ দিয়ে ভারতের ৪২ চাকার যান চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছি। এভাবে পৃথিবীর কোথাও নদীতে বাঁধ দেয়া হয়, এটা চিন্তাও করা যায় না। কোনো আইনই ওই 'নদী হত্যা'কে সমর্থন করে না। অথচ আমরা করলাম।
আজ যখন তরুণ ব্যবসায়ী নাদের আলীর হত্যাকা-ের খবর আমরা জাতীয় দৈনিক প্রাকশিত হতে দেখি, তখন ভাবি ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা কী পারবে একজন চীনা নাগরিক কিংবা 'চিরশত্রু' একজন পাকিস্তানি নাগরিককে এভাবে হত্যা করতে? সেই সাহস কী তাদের আছে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সাহস তারা পায় কোথায়? আমাদের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতিই বিএসএফকে এই 'সাহস' জুগিয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত বিএসএফের নির্যাতনের শিকার হচ্ছি। সীমান্তে এখন লাশের মিছিল।
সীমান্ত হত্যা নিয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান যখন কথা বলেন, তখন আমরা উৎসাহিত হই। তিনি সেই অর্থে সরকারি কর্মকর্তা নন। তিনি বলতে পারেন। তার চাকরি হারানোর ভয়ও নেই। তার জাতিসংঘে নালিশ জানানোর সিদ্ধান্তটি সঠিক। এটাই জনগণের দাবি। কমিশনের পক্ষ থেকে তিনি জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে সীমান্ত হত্যার বিষয়টি তুলতে পারেন। এখানে সরকারের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় আর নেই। তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব বলেই তিনি কাজটি করতে পারেন। তবে তিনি যদি না করেন, তাহলে বুঝতে হবে তিনিও রাজনীতিবিদদের মতো কথা বলেন। মানুষকে বিভ্রান্ত করেন। সাময়িক বাহবা নেয়ার জন্যই তিনিও এ ধরনের কথা বলেছেন। তিনি অধ্যাপক মানুষ। তিনি এ কাজটি করবেন, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বে উজ্জ্বল করবেন, আমাদের প্রত্যাশা এটাই।
সীমান্ত হত্যা দুদেশের মাঝে সম্পর্কের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি করছে। আমরা আগের সংখ্যায় লিখেছিলাম_ ভারত একের পর এক আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই আশ্বাস কার্যকর করছে না। সীমান্ত হত্যা বন্ধের ব্যাপারে আমরা আশ্বাস পেয়েছি বহুবার। কিন্তু সেই আশ্বাস কার্যকর হচ্ছে না। কোথায় যেন একটা 'রহস্য' রয়ে গেছে। এটা ঠিক, বাংলাদেশের কিছু লোক সীমান্ত পারাপার করে বৈধ কাগজপত্র ছাড়াই। কিছু অসাধু গরু ব্যবসায়ীও আছেন, তারা নিয়মবহির্ভূতভাবে সীমান্তের ওপারে যান। এটা তো আজকের কথা নয়। বলা যেতে পারে গত ৪০ বছর এভাবেই ব্যবসায়ীরা ওপারে যান। গরু আনেন। নিয়মিত তারা বিএসএফের জওয়ানদের মসোহারা দেন। কিন্তু এভাবে গুলি করে হত্যা কেন? সীমান্ত হাট হয়েছে। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। এখন এই গরু ব্যবসাকে কেন্দ্র করে যে হত্যাকা- হয়, তা কীভাবে রোধ করা যায়_ এটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। যে কোনো একটা পদ্ধতি বের করা প্রয়োজন, যাতে গরু চোরাচালানকারীরা অবৈধ পথে সীমান্ত অতিক্রম করতে না পারে। সীমিত সময়ের জন্য 'সীমান্ত পাস' দেয়া ও এর জন্য একটি 'ফি' আদায় করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে পণ্যের জন্য ট্যাক্স আদায় করা যেতে পারে। মোট কথা, 'সীমান্ত হাট' এর ধারণা আরো ব্যাপক সম্প্রসারণ করা হলে আমার ধারণা, সীমান্ত হত্যা অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাবে। পৃথিবীর কোনো সভ্য মানুষ চাইবে না এভাবে সীমান্ত হত্যা হোক। এই হত্যা মানবাতাবিরোধী একটি অপরাধ। এটা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।
Daily DESTINY
30.5.12

0 comments:

Post a Comment