রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

অকুপাই মুভমেন্ট' ও নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে 'অকুপাই মুভমেন্ট' গত ৩০ জুলাই ২২৬ দিন পার করল। এটা কী চিন্তা করা যায় একটি আন্দোলন এতদিন ধরে চলছে এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে এতটুকু ক্লান্তি নেই। হতাশা নেই। এই 'অকুপাই মুভমেন্ট' প্রমাণ করেছে নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা জরুরি। এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে মার্কিন সমাজে যে অসমতা ও দরিদ্রতা-তা দূর করা। একসময় এই মুভমেন্ট সমগ্র বিশ্বের বড় বড় শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। এখন অবিশ্য ইউরোপের দেশগুলো থেকে এই আন্দোলনের তেমন কোনো খবর পাওয়া যায় না; কিন্তু নিউইয়র্কের 'অকুপাই মুভমেন্ট' ঠিকই অব্যাহত রয়েছে। যারা অনলাইনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংবাদ নেয়ার চেষ্টা করেন, তারা নিউইয়র্কের 'অকুপাই মুভমেন্ট' এর খবর খুব সহজেই পেয়ে যাবেন। একসময় আন্দোলনকারীদের সেস্নস্নাগান ছিল ্তুবি ধৎব ঃযব মমু.্থ অর্থাৎ আমরাই সমাজের শতকরা ৯৯ ভাগ। মার্কিনি সমাজে বেশির ভাগ মানুষ যে বৈষম্যের শিকার, আন্দোলনকারীদের বক্তব্যে সেটাই প্রমাণিত হয়েছিল। অনেকেরই মনে থাকার কথা, গেল বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে এই আন্দোলন যখন শুরু হয়, তখন আন্দোলনকারীরা নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিটের পাশে জুকোট্টি পার্কে জমায়েত হয়ে পার্কটি দখল করে নিয়েছিল এবং সেখানেই রাতে তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করতে শুরু করেছিল। একসময় ওই পার্কের মালিক (পার্কটি ছিল ব্যক্তি মালিকানাধীন) কোর্টের অনুমতি নিয়ে আন্দোলনকারীদের সেখান থেকে উৎখাত করে। কিন্তু তাতেও আন্দোলনকারীরা দমে যায়নি। তারা রাস্তার পাশে জমায়েত হয়ে তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছে। সংবাদপত্রগুলোর (মার্কিনি) ভাষায় এই আন্দোলন চিহ্নিত করা হয়েছে 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন হিসেবে। এই আন্দোলন হচ্ছে অসমতা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিবাদ। আজ যখন এই প্রতিবাদ এক দেশ থেকে অন্য দেশে ছড়িয়ে যায় তখন সঙ্গত কারণেই যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দেয়, তা হচ্ছে একটি নয়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন। যুক্তরাষ্ট্র বড় অর্থনীতির দেশ। কিন্তু সেখানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে ধনী শ্রেণী হিসেবে পরিচিত একশ্রেণীর মানুষের বৈষম্য যখন স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে, তখন বুঝতে হবে পুঁজিবাদী সমাজেও ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। এটাও কোনো সমাধান নয়। এক সময় সমাজতান্ত্রিক সমাজকে বলা হতো বৈষম্যহীন সমাজ, অর্থাৎ সেখানে মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য নেই। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল তথাকথিত পার্টির কার্ডধারীরা বিশেষ সুবিধাভোগী। ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপে যখন সমাজতন্ত্রের ভাঙন শুরু হয়েছিল, তখন আমার অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেই সমাজ প্রত্যক্ষ করার। সমাজে বিরাজমান দ্বন্দ্ব, একশ্রেণীর ক্ষমতা করায়ত্ব করার কারণেই সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল। সমাজতন্ত্রও কোনো সমাধান বয়ে আনতে পারেনি। এক সময় দুর্ভিক্ষপীড়িত, অধিক জনসংখ্যা, কর্মহীন, শিক্ষাহীন এবং সুশাসনহীন দেশ সোমালিয়া ও সুদানকে বলা হতো অকার্যকর রাষ্ট্র। অর্থাৎ রাষ্ট্র অকার্যকর। আজ ইউরোপের একটি রাষ্ট্র গ্রিসও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। ইউরোপের ধনী রাষ্ট্রগুলো গ্রিসকে ১১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েও গ্রিসের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। একসময় ইউরোপে এক মুদ্রা ইউরো চালু হয়েছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ২৯টি দেশের মাঝে ১৫টি দেশ ইউরো চালু করেছিল। কিন্তু সেই এক মুদ্রা ইউরো এখন কাজ করছে না। গেল অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ইউরোপের ভয়াবহ ঋণ সংকট কাটাতে ইউরোপিয়ান ফিন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি ফান্ড গঠন করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তির অংশ হিসেবে গ্রিসের ঋণের ওপর ৫০ শতাংশ লোকসানের দায় নেবে ইউরো জোনের ব্যাংকগুলো। কিন্তু এই উদ্যোগ ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকটকে মোকাবেলা করতে আদৌ কোনো সাহায্য করতে পারেনি। গ্রিসের ভবিষ্যৎ কী, তা আগামী দিনগুলোই বলতে পারে। স্পষ্টতই বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটা বড় ধরনের সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এর সমাধান কোন পথে? যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি গত প্রায় দুবছর যাবৎ ভালো যাচ্ছে না। ইতিমধ্যে সেখানে বেশ কিছু ব্যাংক বন্ধ হয়ে গেছে। চাকরির বাজারও ভালো নয়। তরুণ গ্রাজুয়েটরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে কোনো চাকরি পাচ্ছে না। এদের একটা অংশই তখন জুকোট্টি পার্কে জমায়েত হয়েছিল। অনেকেই জানেন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থায় একটি ধনী শ্রেণীর জন্ম হয়েছে, যারা রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যখন অসমতা বেশি, তখন এই অসমতা দূর না করে সরকার শত শত কোটি ডলার খরচ করছে যুদ্ধের পেছনে। একটা তথ্য দেই, যাতে করে পাঠক বুঝতে পারবেন যুক্তরাষ্ট্র কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করছে যুদ্ধের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্র এখন অব্দি ৩ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে আফগানিস্তান ও ইরাকের যুদ্ধের পেছনে। যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ৬ বিলিয়ন ডলার খরচ করে আফগান সেনাদের প্রশিক্ষণের জন্য। যে দেশ শিশুদের নূ্যনতম অধিকার (২১ ভাগ সন্তান নির্ধারিত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে) নিশ্চিত করতে পারেনি, সেই দেশ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে শুধু অন্য দেশের সেনা প্রশিক্ষণের জন্য। পরিসংখ্যান বলে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ৬ জনের মাঝে ১ জন গরিব। ৪ কোটি ৬২ লাখ মানুষ বাস করে দারিদ্র্যসীমার নিচে, শতকরা হারে যা ১৫ দশমিক ১ ভাগ। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে আবার আফ্রো-আমেরিকানদের এবং হিস্পানিকদের সংখ্যা বেশি। এই হার যথাক্রমে ২৭ দশমিক ৪ ও ২৬ দশমিক ৬ ভাগ। যুক্তরাষ্ট্রের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য চাকরির সংস্থান না করে, তাদের জন্য নূ্যনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত না করে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হচ্ছে যুদ্ধের পেছনে। এ জন্যই প্রতিবাদটা উঠেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর থেকেই।যুক্তরাষ্ট্রের মতো পুঁজিবাদী সমাজে অসমতার যে চিত্র দেখতে পাওয়া যায়, সেই একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায় পশ্চিম ইউরোপে, যেখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পুঁজিবাদনির্ভর সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল, ওই সমাজেও বৈষম্য ও অসমতা রয়েছে। দেখা গেল, ধনীরা আরো ধনী হয়েছে, আর শ্রমিক শ্রেণী যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। নোয়াম চমস্ক্রি এই সমাজ ব্যবস্থাকে 'প্লুটোক্রেসি' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ ধনী লোকদের সমন্বয়ে ও ধনী লোকদের নিয়েই একটি সমাজ ব্যবস্থা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই কথাটা বেশি প্রযোজ্য। পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে কিংবা হাউস অফ কংগ্রেসে যারা সদস্য নির্বাচিত হন, তারা একেকজন শত শত কোটি ডলারের মালিক। অর্থ ছাড়া এখানে যেমনি নির্বাচন করা যায় না, ঠিক তেমনি এই অর্থই তাদেরকে পরিচালনা করে। অর্থাৎ কংগ্রেসম্যান তথা সিনেটরদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করে বড় বড় ব্যবসায়ীরা। এরাই আবার পরবর্তী সময়ে সিনেটরদের কাছ থেকে সুবিধা আদায় করে নেয় কিংবা নতুন ব্যবসা বাগিয়ে নেয়। এই যে রাজনীতি, এই রাজনীতিতে সাধারণ মানুষের আদৌ কোনো ভূমিকা নেই। এ জন্যই দেখা যায়, কোনো নির্বাচনে সেখানে খুব কমই ভোট পড়ে।১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের যখন পতন ঘটে, তখন ফ্রান্সিস ফুকিয়ামা ঞযব বহফ ড়ভ ঐরংঃড়ৎু ধহফ ঃযব ষধংঃ সধহ লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন। বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর মাঝে তার ওই প্রবন্ধ বড় ধরনের বিতর্কের ঝড় তুলেছিল। তিনি বলার চেষ্টা করেছিলেন, সমাজতন্ত্র যে 'মিথ্যা' ধ্যান-ধারণা তা প্রমাণিত হয়েছে। পুঁজিবাদনির্ভর 'লিবারেলিজম'ই টিকে থাকবে। তার এই মতবাদের সঙ্গে হয়ত অনেকেই দ্বিমত পোষণ করবেন। সমাজতন্ত্র মিথ্যা ছিল, এটা বোধ হয় বলা যাবে না। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। তবে নিঃসন্দেহে ওই সমাজেও বৈষম্য তৈরি হয়েছিল। আজ একুশ শতকে এসে পুঁজিবাদও যে একমাত্র সমাধান, তাও বলা যাবে না। নতুন এক সমাজ ব্যবস্থা, নতুন এক অর্থনীতি বিকশিত হচ্ছে। এই অর্থনীতির ধরন কী হবে, তা এই মুহূর্তে বলা না গেলেও, এতটুকু বলা যায় ইন্টারনেটভিত্তিক একটি সমাজ ব্যবস্থা বিকশিত হচ্ছে, যেখানে কোনো বড় রাষ্ট্রের কিংবা ওই রাষ্ট্রের অর্থনীতির একক প্রভাব বিস্তারের কোনো সুযোগ নেই। আগামী দিনগুলোই বলবে ওই অর্থনীতির স্বরূপ কী হবে। নিউইর্য়কের 'অকুপাই ম্যুভমেন্ট' প্রমাণ করেছে বিশ্ব অর্থনীতিতে পরিবর্তনটা আসন্ন।
ড.তারেক শামসুর রেহমান
প্রফেসর, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

0 comments:

Post a Comment