রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

হেগের আদালতের সিদ্ধান্ত ও আমাদের করণীয়

হেগের আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমা নিয়ে যে বিরোধ ছিল, এর একটি সমাধান করে দিয়েছেন। এই রায় নিয়েও দুর্ভাগ্যজনকভাবে হলেও দুটি বড় দল যে পরস্পরবিরোধী অবস্থান নিয়েছে, তা তাদের প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি। সরকারি দল বলছে, ‘এটা তাদের বিজয়।’ এমনকী এটাও বলা হচ্ছে, ৫ জানুয়ারি সংসদের নির্বাচন হয়েছিল বলেই এই রায় পাওয়া গেছে। অন্যদিকে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই রায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাংলাদেশ। মজার ব্যাপার, বাংলাদেশের সংবাদপত্র, ইলেকট্রনিক মিডিয়া এই ইস্যু নিয়ে ‘অতি আগ্রহ’ দেখালেও ভারতের কোনও আগ্রহ দেখিনি। ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপির কোনও নেতৃবৃন্দের কোনও মন্তব্য আমি পাঠ করিনি- যাতে তারা দাবি করেছেন, এই রায়ে তারা ‘বিজয়ী’ হয়েছেন। এমনকী বাংলাদেশের সংবাপদত্রে যেভাবে লেখালেখি হচ্ছে, ভারতে সেভাবে দেখিনি। অনেক সংবাদপত্রে রায়ের খবরটিও প্রকাশিত হয়নি। এখন একটি রায় বের হয়েছে। কিন্তু আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। দক্ষিণ তালপট্টি আমরা হারিয়েছি- এটা সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, একসময় আমরা এই জেগে ওঠা দ্বীপটি দাবি করেছিলাম এবং আওয়ামী লীগও অতীতে যখন ক্ষমতায় ছিল (১৯৯৬, ২০০৮-বর্তমান) কিংবা বিরোধী দলে ছিল (১৯৯১-২০০১), তখনও তারা এ দ্বীপটি বাংলাদেশের নয়- এমন দাবি করেনি। এখন ২০১৪ সালে এসে সালিশি আদালতের বিচারপতিরা স্বচক্ষে ওই দ্বীপটির অস্তিত্ব দেখতে পাননি। এটিই বাস্তবতা। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের দুর্বল উপস্থাপনায়ও বেশ ত্রুটি ছিল। তারা সঠিক ম্যাপ উপস্থাপন করতে পারেননি। যে ম্যাপটি তারা ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে সংগ্রহ করেছিলেন, এতে ভুল তথ্য সংযোজিত ছিল। আদালত এটি গ্রহণ করেননি। তবে মজার ব্যাপার, ১৯৮১ সাল থেকে বাংলাদেশ এ দ্বীপটি জেগে ওঠার পর থেকে দ্বীপটির ওপর বাংলাদেশের দাবি অব্যাহত রাখলেও কখনও ম্যাপে দক্ষিণ তালপট্টিকে অন্তর্ভুক্ত করেনি। তাই প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই ওঠে, বাংলাদেশের কোনও সরকারই কেন এটি করেনি? ভারতের আপত্তির কারণে যদি দ্বীপটি ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত না হয়ে থাকে, তাহলে সরকারগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তো থাকবেই। এখানে বলা ভালো, ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মিয়ানমার ও ভারতের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার বিষয়টি অবহিত করেছিলেন। দীর্ঘ শুনানির পর ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে আমরা একটা রায় পেয়েছি। এর মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে। এখন ভারতের সঙ্গেও এই সীমা নির্ধারিত হল। সমুদ্রের সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি বেশ জটিল। সমুদ্রসীমা নির্ধারণের জন্য বর্তমানে বলবৎ রয়েছে ৩ৎফ টহরঃবফ ঘধঃরড়হং ঈড়হাবহঃরড়হ ড়হ ঃযব খধি ড়ভ ঝবধ (টঘঈখঙঝওওও)। এই আইন ১৯৮২ সালে গৃহীত এবং ১৯৯৪ সালের নভেম্বর থেকে কার্যকর। ভারত ১৯৯৫ সালের ২৭ জুন আর মিয়ানমার ১৯৯৬ সালের ২১ মে টঘঈখঙঝওওও অনুমোদন করে। আর বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষরের পর তা অনুমোদন করে ২০০১ সালের ২৭ জুলাই। আইন অনুযায়ী অনুমোদনের ১০ বছরের মধ্যে সমুদ্রসীমায় দাবির পক্ষে তথ্য ও উপাত্ত উপস্থাপন করতে হয়। টঘঈখঙঝ১১১-এর ধারা ২৮৭, এনেক্স ঠওও, আর্টিকেল-১ অনুযায়ী বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই তার দাবি উপস্থাপন করেছিল। এখানে বলা ভালো, বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালে ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ধিঃবৎ ধহফ গধৎরঃরসব ২০ হড়ং অপঃ ১৯৭৪ গেজেট আকারে প্রকাশ করে। এই অ্যাক্টের বেজলাইন ৬০ ফুট সমুদ্র গভীরতার ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হয়। ভারত ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের এই দাবির বিরোধিতা করে এই যুক্তিতে, সর্বপশ্চিমের পয়েন্ট তার (ভারতের) ২১ মাইল ভেতরে চলে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভারত ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরেই সমুদ্রসীমা নির্ধারণ নিয়ে আলোচনায় বসে। এখানে বলা ভালো, কোন নীতি অনুসরণ করে ওই বিবাদ নিষ্পত্তি করা হবে- এটি নিয়ে মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে পরস্পরবিরোধী অবস্থান ছিল। মিয়ানমার ও ভারত চেয়েছে ‘সমদূরত্ব’নীতি অনুসারণ করে এই বিবাদের নিষ্পত্তি। অন্যদিকে বাংলাদেশ চেয়ে এসেছে, ‘সমতা’নীতি। ‘সমদূরত্ব’-পদ্ধতি বা নীতি অনুসরণ করলে বঙ্গোপসাগরের ওপর যথাক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে দুটি সীমারেখা টানা হতো। ফলে বাংলাদেশ সমুদ্র অঞ্চলের ওপর তার অধিকার হারাত। অন্যদিকে ‘সমতা’-পদ্ধতি অনুসরণ করলে সোজা দক্ষিণ দিকে এই সীমারেখা টানা হবে। তবে এটিও সত্য, আন্তর্জাতিক আইনে সমদূরত্ব এবং সমতানীতি- দুটোই স্বীকৃত এবং দুটোই অনুসরণ করা হয়। এক্ষেত্রে দুপক্ষ যদি আলাপ-আলোচনায় কোনও সমঝোতায় উপনীত হতে না পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতে দেশ দুটোকে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে আদালতের রায় দেশ দুটো মানতে বাধ্য। তখন বাংলাদেশ ও ভারত কোনও আপত্তি উপস্থাপন করতে পারবে না। রায় মানতে হবে। আপিলেরও কোনও সুযোগ নেই। জাতিসংঘের সমুদ্র আইন অনুযায়ী কোনও দেশ বেজলাইন থেকে সমুদ্রের দিকে ২০০ মাইল পর্যন্ত একান্ত অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে দাবি করতে পারে। সব দেশের ক্ষেত্রে সমান দূরত্বের এই বিধানকে সমদূরত্বনীতি বলা হয়। তবে যদি দুটি বা ততোধিক দেশের উপকূলরেখা পরস্পর-বিপরীতভাবে বা বক্রভাবে বিরাজ করে, তাহলে সমদূরত্বের নীতি কার্যকর হবে না। কারণ এতে কোনও একটি দেশ তার ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। তাই সেক্ষেত্রে টঘঈখঙঝ- এর ৭৪ ধারা অনুযায়ী দেশগুলোর পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে ন্যায়পরায়ণতার নীতির ভিত্তিতে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করতে হবে। এ জন্য একাধিক বিষয় বিবেচনায় আনতে বলা হয়েছে। দেশের উপকূলের রেখা বিন্যাস, এর বক্রতা, দৈর্ঘ্য ইত্যাদি। অথচ বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সমুদ্র উপকূল পরস্পর বক্র আকারে বিরাজ করলেও তারা দীর্ঘদিন তা গণ্য করেনি, বরং সমদূরত্বের নীতির আলোকে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের দাবি করে আসছিল। এখন আদালত এই সমুদূরত্বের নীতি গ্রহণ না করে কিছুটা সমতা ও ন্যায়পরায়ণতার ভিত্তিতে এ রায়টি দিল। এখন এ রায়টি নিয়ে আমরা যত কম বির্তক করব, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল। আমাদের এখন সামনে তাকাতে হবে। দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে শুধু-শুধু বিতর্ক করলে আমরা আর কোনও দিনই দক্ষিণ তালপট্টি ফিরে পাব না। এটি সত্য, দক্ষিণ তালপট্টির অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেশি ছিল। এখানে প্রচুর গ্যাস, তেল ও মিনারেল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এর আশপাশে আমাদের যে অঞ্চল রয়েছে, সেখানে আমরা তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান চালাতে পারি। শুধু দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে ‘বিবাদ’ করলে আমরা বঙ্গোপসাগরে যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে, তা কাজে লাগাতে পারব না। এই রায়ের ফলে বঙ্গোপসাগরে আমাদের সীমানা নির্ধারিত হল। বঙ্গোপসাগর হচ্ছে বিশাল এক সম্ভাবনার জায়গা। প্রায় ২ দশমিক ২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে বিশাল এই বঙ্গোপসাগর। এই বঙ্গোপসাগর পৃথিবীর বৃহৎ উপসাগর, আগামী প্রজন্মের জন্য আশীর্বাদ। বঙ্গোপসাগর থেকে পানি, লবণ, শক্তি, মৎস্যসহ বিভিন্ন মিনারেলস পাওয়া যাবে। যতটুকু এলাকাই আমরা পেয়েছি, সেখানে যদি অনুসন্ধান চালানো যায়- তাহলে বিশাল এক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। শুধু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, মিয়ানমার গভীর সমুদ্রে যে গ্যাস ও তেল পেয়েছে, তা এখন চীন ও থাইল্যান্ডে রপ্তানি করছে। ভারত এখানে বিনিয়োগ করেছে। এই গ্যাস ভারতেও যাবে। অথচ পাশের দেশ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের বৈদেশিক নীতির ব্যর্থতার কারণে মিয়ানমারের এই গ্যাস আমরা আমদানি করতে পারলাম না। ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানি ভিসাখাপট্টমের কাছে বঙ্গোপসাগরে ২০০৩ সালে ৭ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট গ্যাস পেয়েছিল। সেই গ্যাস এখন উত্তোলিত হচ্ছে। ভারতের অভ্যন্তরীণ চাহিদার এক শতাংশ গ্যাস আসে গভীর সমুদ্র থেকে। ভারত এখন প্রাপ্ত গ্যাসকে এলএনজিতেও রূপান্তর করছে। ভারতের ৭০ শতাংশ তেল আমদানি হয় (প্রধানত প্যারসীয় অঞ্চল থেকে) বঙ্গোপসাগর রুট ব্যবহার করে। এর পরিমাণ ২০১৫ সালে বাড়বে ৮৫ শতাংশে। আর চীনের বঙ্গোপসাগরের ওপর নির্ভরতার হার শতকরা ৬০ ভাগ। এশিয়ার বড় অর্থনীতি ভারত ও চীন। তাদের জ্বালানি চাহিদা বাড়ছে। ভারতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প চালু হলেও চাহিদার মাত্র ৩ শতাংশ সরবরাহ করা হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে। ভারত এখন বিশ্বের তৃতীয় অর্থনীতি। ভারতের জ্বালানি চাহিদা বাড়বেই। ফলে বঙ্গোপসাগরে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ভারত বাড়াবেই। আমাদের উচিত হবে এখন দ্রুত গভীর ও অগভীর সমুদ্রে যে ২৮টি ব্লক (তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান), এর কোনও কোনওটির- যেগুলো নিয়ে আদালতের রায়ে সুস্পষ্ট হয়েছে, সীমানা নতুন করে নির্ধারণ করা। এক্ষেত্রে অনুসন্ধানে বাপেক্সের দক্ষতা আছে কি না, তা আমি নিশ্চিত নই। আমরা ইতোমধ্যে কিছু ব্লক বিদেশি কোম্পানিকে দিয়েছি। বাকিগুলো নিয়ে দ্রুত আলোচনা হতে পারে। সমুদ্রবিজ্ঞান দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে অবহেলিত। একমাত্র দুটো বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়টি একাডেমিক কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু গবেষণার পরিধি সীমিত। এক্ষেত্রে সরকার ‘বিস’কে শক্তিশালী করতে পারে। সেখানে গবেষণার সুযোগ অনেক বেশি। এখানে বঙ্গোপসাগর নিয়ে পৃথক একটি উইং থাকতে পারে। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও সিঙ্গাপুরের সাউথ ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বিস যৌথভাবে বঙ্গোপসাগর নিয়ে গবেষণা চালাতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনক্লোজ ডেস্কটি শক্তিশালী করাও জরুরি। সমুদ্র আইন নিয়ে দেশে কাজ করা মানুষের সংখ্যা কম। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন অনুষদগুলো যথেষ্ট জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। হেগের রায় দেখিয়ে দিল, আমাদের কাজ এখনও অনেক বাকি। এখন রায়ের ফলে আমরা যদি আত্মতুষ্টিতে ভুগি, তাহলে খুব বেশিদূর যেতে পারব না। সমুদ্রের সম্পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে জাতীয় ঐকমত্যও প্রয়োজন। সুতরাং দায়িত্ব এখন আরও বাড়ল। গভীর সমুদ্রে মহীসোপানের ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত হয়নি। সিদ্ধান্ত হতে আরও ৪ থেকে ৫ বছর লেগে যাবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করার প্রয়োজন নেই। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে আমাদের সমুদ্রসীমা এখন নির্ধারিত হয়েছে। এ সীমানা নিয়েই এখন আমাদের দ্রুত এগোতে হবে। Daily AMADER SOMOY 17.07.14

0 comments:

Post a Comment