রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

আসল কথাটি ফাঁস করে দিলেন সুষমা

শেষ পর্যন্ত আসল কথাটি ফাঁস করে দিলেন সুষমা স্বরাজ। আসাম বিজেপির সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় তিনি জানিয়ে দিয়েছেন তার ঢাকা সফরের সময় তার সঙ্গে বাংলাদেশি নেতাদের চুক্তি নিয়ে কোনো কথা হয়নি। এ তথ্যটি আমাদের দিয়েছে ভারতীয় দৈনিক টাইমস অফ ইন্ডিয়া ৩ জুলাই। সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফর শেষ হয়েছে বেশ কয়েকদিন হলো। কিন্তু তার রেশ এখনো রয়ে গেছে। ভারতীয় পত্রপত্রিকা তো বটেই, বাংলাদেশি পত্রপত্রিকাগুলোয়ও সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের 'পোস্ট মর্টেম' এখনো চলছে। এরই মধ্যে খালেদা জিয়া একটি ভারতীয় সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, সেখানে তিনি বেশ কিছু কথা বলেছেন, যা তিনি আগে কখনো বলেননি। নিঃসন্দেহে সুষমা স্বরাজের ঢাকা সফরের একটি গুরুত্ব আছে। এখন অনেক সিদ্ধান্তে আমরা আসতে পারি যদি আমরা মোটা দাগে এই সফরকে বিশ্লেষণ করি। ভারতে নয়া সরকার বাংলাদেশকে যে তাদের বৈদেশিক নীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রেখেছে, তা কার্যত ভারত আজ স্বীকার করে নিল। ভারত 'জি টু জি' সম্পর্ককে গুরুত্ব দেয়। অর্থাৎ 'সরকার টু সরকার' সম্পর্ক। কোনো বিশেষ দলকে তারা সমর্থন করবে না। তবে ভারতের জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে একটি 'বিশেষ সম্পর্ক' স্থাপন করেছিল ভারতীয় কংগ্রেস। এ ক্ষেত্রে বিজেপির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সম্পর্ক অতীতে কংগ্রেস-আওয়ামী লীগের মতো কোনো পার্থক্য থাকবে কি? বিজেপি দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তাকে তাদের বৈদেশিক নীতিতে অন্যতম এজেন্ডাভুক্ত করেছে। ভুটান সফরের পর প্রকাশিত যৌথ ইশতেহার পর্যালোচনা করলে এই নিরাপত্তার বিষয়টি বোঝা যায়। বাংলাদেশের সঙ্গেও সম্পর্কের প্রশ্নে এ নিরাপত্তা ইস্যুটি প্রাধান্য পাবে। বিশেষ করে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে চীনের অংশগ্রহণ ও ব্যবস্থাপনায় চীনের ভূমিকা ভারতের নিরাপত্তাকে বিঘ্ন করবে কিনা, এটা ভারত নিশ্চিত হতে চায়। এখন কিছু আশ্বাস পাওয়া গেছে। তাতে বাংলাদেশের মূল স্বার্থ রক্ষিত হয়নি। এই আশ্বাস অতীতেও পেয়েছি। ঢাকা-শিলং-গৌহাটি বাস চালুর সিদ্ধান্ত, মৈত্রী এক্সপ্রেসের ট্রেন সংখ্যা বৃদ্ধি, নতুন ৪টি বর্ডার হাট চালু, কিংবা ৬৫ বছরের বেশি ও ১৩ বছরের কম বয়সীদের ৫ বছরের মাল্টিপাল ভিসা (এ নিয়ে প্রশ্ন আছে)। ইস্যুর যে নীতিগত সিদ্ধান্ত তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ খুব বেশি রক্ষিত হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে_ তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে কোনো 'কমিটমেন্ট' নেই। সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেই। তার অ্যারাইভাল ভিসা প্যাকেজ ঘোষিত হয়নি। অশুল্ক বাণিজ্য বাধা অপসারণে কিছু হয়নি। ভারতে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল প্রচারে কোনো উদ্যোগের কথা বলে যাননি সুষমা। এসবই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল। খালেদা-সুষমা বৈঠকের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো মোদি সরকার খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর বলে মনে করে। এমনকি খালেদা জিয়া স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করার মধ্য দিয়ে ভারত যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর তা বিএনপিও স্বীকার করে নিয়েছে। তবে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, প্রতিটি দেশ বাংলাদেশে 'সকল দলের অংশগ্রহণে' একটি নির্বাচনের কথা বলেছে, সেখানে সুষমা স্বরাজ এ ধরনের কোনো কথা বলেননি। বরং বলা হয়েছে 'অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান জনগণকেই খরতে হবে।' এতে সরকারের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থনই প্রকাশ পায়। 'দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই'_ খালেদা জিয়ার এ ধরনের উক্তির একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এরকম_ বিএনপি চায় ভারত বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুন। সরকারি দলের পক্ষ থেকে এরকম একটি অভিযোগ উঠেছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি দৈনতা। আমরা আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারি না। আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় বিদেশিদের। এবারই যে এরকমটি হলো তা নয়। এর আগেও হয়েছে। সুষমার এই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়াদিলি্ল সফর নিশ্চিত হলো। এটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সুষমার এই সফর বাংলাদেশের স্থিতিশীল রাজনীতির জন্য কোনো মেসেজ নেই। খালেদা জিয়া ইতোমধ্যে কোরবানির পর পরই আন্দোলনের কথা বলেছেন। ফলে বছর না ঘুরতেই হয়তো আমরা আবারো 'হরতালের রাজনীতি' প্রত্যক্ষ করব। এক কথায় সুষমা স্বরাজের এই সফরের মধ্য দিয়ে বড় কিছু অর্জিত হয়নি। আগামী ৫ বছর বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে। অর্থাৎ ২০১৯ সাল পর্যন্ত। এই সময় সীমায় তিস্তাচুক্তি হবে কিংবা সীমান্তচুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান সংশোধন হবে, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তিস্তার পানিবণ্টন পশ্চিমবঙ্গে একটি রাজনৈতিক ইস্যু। মমতা ব্যানার্জি এটা হাতছাড়া করতে চাইবেন না। কেননা ২০১৬ সালে সেখানে বিধানসভার নির্বাচন। নির্বাচনে পানির বিষয়টি তিনি দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবেন। আর সীমান্তচুক্তি বাস্তবায়নে প্রধান আন্তরায় হচ্ছে আসাম বিজেপি। সুতরাং বিজেপির পক্ষে এটি রামসভায় পাস করিয়ে আইনে পরিণত করা সহজ হবে না। একই সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো কিংবা সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টি একান্তই মানসিকতার ব্যাপার। ভারতের ব্যুরোক্রেসি বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। ফলে রাজনৈতিক নেতারা (সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং) সীমান্তে হত্যাকা- হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেও, হত্যাকা- হচ্ছে। কাজ হচ্ছে না তবে একটা কথা এখানে বলা দরকার। সুষমা স্বরাজকে যে সম্মান বাংলাদেশ দিয়েছে, তাতে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে আরো ইতিবাচক হওয়া। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ত্রিপুরায় ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছে। কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ হয়ে আগরতলা যাবে এই খাদ্যশস্য। এর জন্য রাস্তাঘাট ও ব্রিজও বাংলাদেশ তৈরি করে দেবে। বাংলাদেশের এই 'উদ্যোগ'-এর প্রতিদান হিসেবে ভারত আমাদের কী দেবে, তাই দেখার বিষয় এখন। বাংলাদেশ শুধু দেবে, আর ভারত তার স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে, এই মানসিকতায় ভারতের নেতারা যদি পরিবর্তন না আনেন, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নত হবে না। সুষমা স্বরাজ চলে গেছেন। কিন্তু জয় করে যেতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। কিন্তু অনেক প্রশ্ন তিনি রেখে গেছেন তার এই সফরের মধ্য দিয়ে। মিডিয়া এবং জাতীয় নেতারা যেভাবে তার এই সফরকে চিহ্নিত করেছেন এবং অতি উৎসাহভাব প্রকাশ করেছেন, তা কোনো ভাল লক্ষণ নয়। এতে আমাদের দৈন্যই প্রকাশ পেয়েছে। কিছুদিন আগে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ এসেছিলেন। তাকে নিয়ে এত নাচানাচি হয়নি। অথচ আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জাপান কিংবা চীনের অবস্থান ভারতের চেয়ে বেশি। এমনকি খালেদা জিয়ার সব প্রটোকল ভেঙে হোটেলে গিয়ে সুষমার সঙ্গে দেখা করা নিয়েও কথা উঠেছে। খোদ ভারতীয় পত্রিকা এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ভারত আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এখন সবাই মিলে যদি ভারতকে তোষামোদ করে চলি। তাহলে ভারতের ব্যুরোক্রেসি এ সুযোগ নেবেই। ভারতকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে হলে, সেভাবে আচরণ করাই মঙ্গল। আমরা তা করিনি। আমরা বারবার বলে আসছি ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। এটা ঠিক ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে ভারত এক ধরনের নীরবতা অবলম্বন করেছিল। এই নীরবতাই সমর্থনের শামিল। বাংলাদেশে ভারতের প্রচুর স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের বিশাল বাজার। ১৬ কোটি মানুষের দেশ এই বাংলাদেশে ভারতের বিক্রি করার অনেক কিছু আছে। এবং ভারত তা করছে। উপরন্তু ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের একটা পথ দরকার। তাও তারা পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রাপ্তির খ্যাতি শূন্য। আমাদের পণ্যের যে বাজার সৃষ্টি হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোয়, তা এখন ভারতীয় পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। ফলে বাংলাদেশ তার বাজার হারাচ্ছে। এমনিতেই বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। আমরা বারবার এ কথাগুলো বলছি। যখন মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখনও বলেছি। এখন যখন সুষমা এলেন, তখনও বললাম। কিন্তু তাতে এতটুকু দৃষ্টি দেয়নি ভারত। অথচ আমরা সুষমা স্বরাজকে যেভাবে সম্মান দিলাম তা সমসাময়িককালে বিরল একটি ঘটনা। এখন ভয় হচ্ছে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়, ওই সফরটা না জানি কেমন হয়। সুষমা স্বরাজ নয়াদিলি্ল ফিরে গিয়ে সাক্ষাৎকারে খাঁটি কথাই বলেছেন_ চুক্তি নিয়ে কোনো কথাই হয়নি। এটাই স্বাভাবিক। যে সরকারের বয়স মাত্র এক মাস, সে সরকার হুট করে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু আমাদের 'অতি উৎসাহ' ভারতে একটি ভুল সিগনাল পেঁৗছে দিতে পারে। ভারতীয় ব্যুরোক্রেসি আমাদের দুর্বল ভাবতে পারে। দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে এটা ভালো নয়। ধারণা করছি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলতি বছরই নয়াদিলি্ল যাবেন। আমাদের প্রত্যাশা হবে তিনি বাংলাদেশের অবস্থান শক্তভাবে তুলে ধরবেন। আমরা ভারতের বন্ধুত্ব চাই। কিন্তু তাদের আধিপত্য নয়। তিস্তার পানি আমাদের ন্যায্য অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। আর সীমান্তচুক্তি করতে ভারত বাধ্য। বিজেপি সরকার এটা চাইলেই পারে। কেননা দলকে নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সংবিধানে সংশোধন করার ক্ষমতা তারা সংসদে রাখেন। তাই প্রয়োজন মানসিকতা পরিবর্তনের। সুষমা স্বরাজের সর্বশেষ মন্তব্য এটাই মনে করিয়ে দিল অতি উৎসাহ কখনো কোনো মঙ্গল ডেকে আনে না Daily JAI JAI DIN 09.07.14

0 comments:

Post a Comment