রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে গবেষণা হোক

গত ৩০ জুন টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটা অংশের দুর্নীতি, অনিয়ম ও সুশাসনের অভাব নিয়ে একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপক অনিয়মের একটি চিত্র তুলে ধরেছে টিআইবি। তারা ১৬ দফার একটি সুপারিশমালাও উপস্থাপন করেছে। সংগত কারণেই যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে তাহলে টিআইবি কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দুর্নীতি, অনিয়ম আর সুশাসনের অভাব নিয়ে কাজ করছে না? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সনদ বাণিজ্যের' খবর আমরা জানি। পারিবারিকভাবে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয়, সে খবরও আমাদের অপরিচিত নয়। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি এ থেকে ব্যতিক্রম? সেখানে কি অনিয়ম হয় না? সেখানে কি সুশাসন আছে? তবে এটা সত্য, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের প্রায় সবাই এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষকতা করেন। এখনো বিভাগের শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীরা বিসিএস বা করপোরেট হাউসে উচ্চ বেতনে যোগ না দিয়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরিটি বেছে নেন। তবে এই প্রবণতা কত দিন থাকবে, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা এখন ৩৫টি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় আছে বটে, কিন্তু এটি বাহ্যত একটি 'সার্টিফিকেট বিতরণ' কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অবাক হতে হয়, এখানে আবার শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, যাঁরা আদৌ ক্লাস নেন না! তাঁদের কাজ হচ্ছে পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরি করা, হাজার হাজার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা (আদৌ কি তা সম্ভব?), মৌখিক পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন পরীক্ষাকেন্দ্রে যাওয়া ইত্যাদি। যিনি কোনোদিন পড়ান না, গবেষণা করেন না, তিনি 'শিক্ষক' হন কিভাবে? জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো ভেঙে দিয়ে সাতটি বিভাগীয় শহরে সাতটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে ওই বিভাগের আওতাধীন কলেজগুলোকে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় আনা যেতে পারে। কিন্তু উদ্যোগটি নেবে কে? টিআইবি এটা নিয়ে গবেষণা করে তাদের একটা মতামত দিতে পারে। এখন যেহেতু টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেছে, সেহেতু টিআইবিরও উচিত হবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে একটা গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা। না হলে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হতে পারে টিআইবি। যদিও বেশ কয়েক বছর আগে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে টিআইবিতে কিছুটা কাজ হয়েছিল। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক এই কাজটি করেছিলেন। কিন্তু ওই গবেষণাটি পরিপূর্ণ ছিল না। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংখ্যা বেড়েছে। দুর্নীতির মাত্রা বেড়েছে। সুশাসন সেখানে একেবারেই অনুপস্থিত। তাই টিআইবি আরেকটি 'প্রজেক্ট' হাতে নিতে পারে। কারণ হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারি রাজস্ব থেকে দেওয়া হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে। এই টাকা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না, এখানে দুর্নীতি হচ্ছে কি না কিংবা আর্থিক সুশাসন কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে, এটা গবেষণা করে দেখতে পারে টিআইবি। দুটি কারণে টিআইবির এই কাজটি করা উচিত। এক. টিআইবি দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে আর অভিযোগ আছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নীতির মাত্রা এখন সর্বোচ্চ। দুই. আগের চেয়ে অনেক দক্ষ ও মেধাসম্পন্ন জনবল রয়েছে টিআইবিতে। খুব সংগত কারণেই সরকার, বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এটা চাইবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে টিআইবির গবেষণা রিপোর্টও প্রত্যাখ্যান করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি। তারা কখনো চাইবে না টিআইবি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতি তদন্ত করে সরকারকে একটি বিব্রত অবস্থার মধ্যে ফেলে দিক। এখানে মঞ্জুরি কমিশন যদি শক্ত অবস্থানে যেতে পারত, তাহলে টিআইবিকে আজ তদন্ত করতে হতো না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক সেক্টরে দুর্নীতি তথা অনিয়ম হয়। কয়েকটি নমুনা দেওয়া যেতে পারে। এক. রাজনৈতিক বিবেচনায় মেধাহীনদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। অতীতে যাঁরা কোনোদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রশাসনিক কাজে জড়িত ছিলেন না, তাঁদের কেউ কেউ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এখানে কোনো আর্থিক সংশ্লিষ্টতা আছে কি না, টিআইবি এটা দেখতে পারে। দুই. গত পাঁচ বছরে রাজনৈতিক বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে, যিনি ওই বিষয়ে আদৌ পড়াশোনা করেননি, কিন্তু 'দলীয় চাপ' ও 'রাজনৈতিক আনুগত্যের' কারণে তাঁকে ওই বিষয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিন. উপাচার্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। চার. ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই নতুন নতুন বিভাগ খোলা ও অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পাঁচ. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেন কোনো কোনোটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শিক্ষকের স্ত্রী বা স্বামী শিক্ষক হচ্ছেন। তাঁর সন্তান ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অবধারিতভাবে শিক্ষক হচ্ছেন। কোথাও কোথাও ক্ষমতাবান শিক্ষকের উপস্থিতিতেই নির্বাচনী বোর্ডে তাঁর সন্তানকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে 'আমেরিকান মডেল' আমরা অনুসরণ করতে পারি কি না, সেটা টিআইবি খতিয়ে দেখতে পারে। ছয়. বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা কর্মচারী নিয়োগে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। এটা একটা ভয়ংকর অপরাধ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে কাজটি দেখেছে টিআইবি। এখন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও টিআইবি কাজটি করুক। সাত. বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী ধরনের গবেষণা হয়, তাও জরিপ করা উচিত। শিক্ষকদের পাঠ্য বই রচনার বিষয়টিও আসতে পারে এ গবেষণায়। মোটা দাগে এগুলোই মূল বিষয়। গত পাঁচ বছরে সংবাদপত্রে একাধিক ভিসির দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারির সংবাদ ছাপা হয়েছে। কিন্তু কোনো একটি ক্ষেত্রে তদন্ত হয়েছে কিংবা দুদক আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি খতিয়ে দেখছে, এমন কোনো নজির নেই। কাজটি ইউজিসি করতে পারত। কিন্তু অতিরিক্ত রাজনৈতিক আনুগত্য তাদের এটা করা থেকে বিরত রেখেছে। বয়সের ভারে ক্লান্ত ইউজিসির সদস্যরা। এত কাজের ভার তাঁদের সইবে কেন! তাদের এই নির্লিপ্ততা প্রতিষ্ঠানটির ভাবমূর্তিই শুধু নষ্ট করছে না, বরং ভবিষ্যৎ ইউজিসি নেতৃত্বের ব্যাপারেও একটা আশঙ্কা রয়ে গেল- তারাও একই কাজ করবে! পাঠক, আপনাদের শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের কথাটা একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। চলতি ২০১৪-১৫ অর্থবছরের জন্য শিক্ষায় উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাত মিলিয়ে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯ হাজার ২১৩ কোটি টাকা (গেল অর্থবছরে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ১১৪ কোটি ৬০ লাখ টাকা)। এবারের ২৯ হাজার কোটি টাকার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ ১৫ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। এ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়, তার পরিমাণ খুব বেশি না হলেও তা কয়েক হাজার কোটি টাকা। এখন প্রশ্নটা দাঁড়ায়, এই বিপুল অর্থ সঠিকভাবে ও স্বচ্ছভাবে ব্যবহার হচ্ছে কি না, তা দেখার কেউ নেই। উপাচার্য মহোদয়রা ইউজিসির বরাদ্দের বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে বরাদ্দ না থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বাজেট থেকে অর্থ এনে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা হয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার শিক্ষকদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭-এ উন্নীত করেছে। কর্মচারীদের দাবি ৬২। অথচ এর কোনো সরকারি অনুমোদন ও আর্থিক বরাদ্দও নেই। ফলে একটা বড় 'জটিলতা' নিয়ে ৬৫ বছরে অবসরে না গিয়ে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নতুন অর্থবছরে তাঁদের শিক্ষকতা অব্যাহত রেখেছেন। এটা ঠিক, সিনিয়র শিক্ষকদের সান্নিধ্যে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। কিন্তু আর্থিক প্রশ্নে যে অনিয়ম হলো, তার সমাধান হবে কিভাবে? এখানেই এসে যায় সুশাসনের অভাবের প্রশ্নটি। ইউজিসি যদি দক্ষভাবে এবং সততার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা ও আর্থিক বিষয়াদি মনিটর করত, তাহলে টিআইবির গবেষণার প্রশ্নটি উঠত না। কিন্তু ইউজিসির ব্যর্থতা প্রতিষ্ঠানটিকে একটি কাগুজে প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে। ইউজিসির আইনে সংস্থাটি অনেক কিছুই করতে পারে না। এ ক্ষেত্রে তাদের ক্ষমতা আরো বাড়ানো উচিত। টিআইবি এ বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়ে অনেক অভিযোগ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আর্থিক অনিয়মসহ নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এ ক্ষেত্রে টিআইবি যদি একটি উদ্যোগ নেয়, তাহলে আমার ধারণা জাতি একটি দিকনির্দেশনা পাবে। একুশ শতকে বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এটা খুবই জরুরি। Daily Kaler Kontho 06.07.14

0 comments:

Post a Comment