রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In his Office at UGC Bangladesh

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

During his stay in Germany

Prof Dr Tareque Shamsur Rahman

At Fatih University, Turkey during his recent visit.

Prof Dr Tareque Shamsur Rehman

In front of an Ethnic Mud House in Mexico

যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা ঐতিহাসিক সংলাপ



দীর্ঘ ৫৪ বছরের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে গত ২১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যকার আলোচনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় ধরনের একটি আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ড নতুন করে 'স্নায়ুযুদ্ধ'-এর সূচনা করেছে, সেখানে এই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন ডেকে আনে কি না এ বিষয়টিই এখন মুখ্য আলোচনার বিষয়। বলা ভালো, দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে। ফলে একদিকে এই নিষেধাজ্ঞা যেমন বিশ্বে কিউবার পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না, অন্যদিকে তেমন কিউবায় কোনো বিনিয়োগও হচ্ছে না। ফলে কিউবার প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে কোনো রাজনৈতিক সংস্কারও আসেনি। গেল ডিসেম্বরে বারাক ওবামা এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। আর এর রেশ ধরেই দুই পক্ষ প্রথমবারের মতো আলোচনায় বসল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই আলোচনার একটি বিষয়। কিউবা কী আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিত্যাগ করবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র 'আবারও' হাভানায় সরকার উৎখাতের উদ্যোগ নেবে- এসব প্রশ্ন বারবার মিডিয়ায় ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের লেখনীতে উঠে এসেছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ইউরোপে 'সোভিয়েত ধাঁচের' সমাজতন্ত্রের পতনের রেশ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল, তখন বলতে গেলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি এক রকম নিবদ্ধ ছিল কিউবার দিকে। কেননা কিউবা ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অন্যতম সমর্থক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল কিউবার অর্থনীতির অন্যতম উৎস, সেই সঙ্গে নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কিউবা টিকে থাকতে পারবে কি না- এ প্রশ্নটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের 'আগ্রাসনের' মুখে থেকে কিউবা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না এটা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। আরো একটি প্রশ্ন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিল- তা হচ্ছে কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে? কেননা, চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পরিবর্তন এসেছে। এই দুটি দেশ এখন আর ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ অনুসরণ করে না। তাই খুব সংগত কারণেই প্রশ্ন ছিল, কিউবা চীন বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করবে কি না?

কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল কিউবার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কিউবায় একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। বরং কিউবায় বিপ্লবের পর (১৯৫৯) কিউবা সরকার যখন লাতিন আমেরিকাজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চাইল, চে গুয়েভারা যখন 'বিপ্লব' সম্পন্ন করার জন্য কিউবা সরকারের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে বলিভিয়ায় গেলেন (সেখানেই তাঁকে পরে হত্যা করা হয়) তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ভিন্ন একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চায়নি 'তার প্রভাবাধীন এলাকায়' অন্য কোনো 'শক্তি' প্রভাব খাটাক। 'মনরো ডকট্রিন'-এর আদলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে এ এলাকায় তথা লাতিন আমেরিকায় তার পূর্ণ কর্তৃত্ব। কিন্তু কিউবার বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের এই 'হিসাব-নিকাশে' বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র কিউবা বিপ্লবের মাত্র দুই বছরের মধ্যে ১৯৬১ সালে ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। সিআইএর অর্থে পরিচালিত এই অভিযান 'বে অব পিগস'-এর অভিযান হিসেবে খ্যাত। বলা বাহুল্য, ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। ঠিক এর পরের বছর ১৯৬২ সালের অক্টোবরে 'কিউবা সংকট' একটি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল, কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে, এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ-অবরোধ আরোপ করে, যাতে করে কিউবায় কোনো ধরনের সামরিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করা না যায়। এই নৌ-অবরোধ অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন এই নৌ-অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা 'যুদ্ধ' করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
দুই দিনের আলোচনা শেষ হলেও আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো ঘোষণা আসেনি। খোদ কংগ্রেসের অনেক রিপাবলিকান সদস্য কিউবায় রাজনৈতিক সংস্কার না আসা পর্যন্ত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের দাবি (ডেমোক্র্যাট সদস্যসহ) কিউবায় আরো বেশি গণতন্ত্রায়ন। আরো বেশি অর্থনৈতিক উদারীকরণ। মানবাধিকার পরিস্থিতির আরো উন্নতি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কার। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে কিউবা সব কিছু 'উন্মুক্ত' করে দেবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে গর্বাচেভের সংস্কার কর্মসূচির ফলাফল তাদের অজানা নয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে গিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। চীন ও ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কার কর্মসূচির 'পেরেস্ক্রোইকা' বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু 'গ্লাসনস্ত' কার্যকর হয়নি। রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। কিউবায় কোনোটাই আসেনি। চীন তার সংস্কার কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে এখন ঋণ গ্রহণ করছে। ভিয়েতনামও কম পায়নি। যে ভিয়েতনাম প্রায় ৪০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তারাই আজ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের যে বিশাল চাহিদা, তার একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম সরবরাহ করছে। এখানে 'রাজনীতি' অগ্রাধিকার পায়নি। পেয়েছে বাণিজ্য। এখন কিউবা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাও দেখার বিষয়। তবে হুট করে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে না। প্রেসিডেন্ট রাওল কাস্ত্রো ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে কিউবার রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিউবার জনগণ এখনো কিউবার সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, বিশ্বায়নের এই যুগে কিউবা 'একা একা' চলতে পারবে না। দেশটিকে 'দুয়ার উন্মুক্ত' করে দিতে হবেই। দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশ এখনো সরকার নিয়ন্ত্রিত। কিছু কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার। বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ট্যুরিজম খাত। এ খাত কিছুটা উন্মুক্ত করা হয়েছে। আরো উন্মুক্ত করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেন ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিউবায় সীমিত আকারে 'ডলার বাণিজ্য' হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিউবান আমেরিকানদের পাঠানো অর্থ এখন নিয়মিত কিউবায় আসছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে একটা সমস্যা রয়েছে। কিউবা প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল 'অত্যন্ত কম মূল্যে' ভেনিজুয়েলা থেকে পেয়ে আসছে। এর বিনিময়ে কিউবা ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক দিচ্ছে। এসব ডাক্তার, নার্স আর শিক্ষক এখন ভেনিজুয়েলার হয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কাজ করছেন। পুরো ব্যয়ভার বহন করছে ভেনিজুয়েলা। প্রয়াত হুগো শাভেজ এই পরিকল্পনা শুরু করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো এই পরিকল্পনা কত দিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, সে প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছে। কেননা ভেনিজুয়েলার রমরমা তেল ব্যবসার দিন শেষ। অর্থনীতি আগের মতো আর শক্তিশালী নয়। রাজধানী কারাকাসে বিশাল বিশাল ভবন খালি পড়ে আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভেনিজুয়েলার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যখন ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি করার উদ্যোগ নেন, তার ঠিক এক দিন পর ১০ ডিসেম্বর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত থেকে কিউবার দূরত্ব মাত্র ১৪৫ কিলোমিটার। এই সাগরপথ পাড়ি দিয়ে কোনো কিউবান নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা রাখলেই তাকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। এই অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তনের কথা বলেছে কিউবা। দূতাবাস খোলা ও কবে নাগাদ বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে, সে ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা ঐতিহাসিক সংলাপ একটি প্রশ্নের মধ্যে থেকে গেল বৈকি!
Daily Kalerkontho
01.02.15

রাজনৈতিক অচলাবস্থা : কোন পথে উত্তরণ

বাংলাদেশের রাজনীতি একটি অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অবরোধ আর হরতালের মধ্য দিয়েই প্রতিদিন আমরা পার করছি। আর প্রতিদিনই পেট্রলবোমা আক্রমণের শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। বার্ন ইউনিটগুলোয় অগ্নিদগ্ধ মানুষের করুণ কাহিনী প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে সংবাদপত্রে। ছোট শিশুরা অগ্নিদগ্ধ মা-বাবাকে চিনতে পারছে না। প্রশ্ন রাখছে- সে তো কোনো অন্যায় করেনি, তাহলে তাকে মানুষ পোড়াল কেন? এ প্রশ্নের জবাব কারও কাছেই নেই। সাধারণ মানুষ জানে না, এ পরিস্থিতির অবসান হবে কীভাবে বা কখন আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে দেশে। অবরোধের মাঝে ঢাকার বাইরে থেকে রাজধানীতে খুব বেশি যানবাহন আসেনি। অবশ্য রাজধানীতে কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে এসেছে; স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় অনিয়মিত ক্লাস হচ্ছে; ভয়ের মাঝেও মানুষ তার নিত্যদিনের কাজ করে নিচ্ছেন। কিন্তু তাদের মধ্যে আছে অসন্তোষ আর রাজনীতিবিদদের প্রতি এক ধরনের ক্রোধ। এ পরিস্থিতিতেও দোষারোপের রাজনীতি আমরা লক্ষ করছি। সরকার দায়ী করছে বিএনপিকে। সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের জন্য বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরকে অভিযুক্ত করছে। অন্যদিকে বিএনপির অভিযোগ বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকারই দায়ী। তাদের দাবি, ৫ জানুয়ারি (২০১৪) নির্বাচন না হলে এ পরিস্থিতির জন্ম হতো না। পরস্পর দোষারোপের মধ্য দিয়ে এক অসহিষ্ণু রাজনীতির জন্ম হয়েছে এদেশে। এ বড় দল দুটোর বাইরে শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের কেউই কোনো সমাধান বের করতে পারছেন না। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সরকারের 'বিশেষ উপদেষ্টা' এইচএম এরশাদ ৫ ঘণ্টা অনশন পর্যন্ত করেছেন ৩০ জানুয়ারি। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীও অবস্থান ধর্মঘট করেছেন। পরিস্থিতির আদৌ কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরই মধ্যে খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যু, প্রধানমন্ত্রীর খালেদা জিয়ার গুলশান অফিসে যাওয়া এবং গেট বন্ধ অবস্থায় সমবেদনা না জানিয়ে ফেরত আসা- সব মিলিয়ে একটা সংলাপের এবং পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থার সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও এক্ষেত্রে 'বরফ' গলেনি। কেন খালেদা জিয়ার অফিস খোলা হলো না- এ নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। তবে কোকোর জানাজায় লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি সরকারের নীতিনির্ধারকরা কীভাবে নিয়েছেন, আমি জানি না। তবে এটা একটা মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে। কোকো রাজনীতিক পরিবারের সন্তান হয়েও রাজনীতি করেননি। জিয়া পরিবারের প্রতি মানুষ যে সহানুভূতিশীল, এটাই প্রমাণিত হলো। সরকারের নীতিনির্ধারকরা এটা থেকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে আমি সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত বাহিনীকে ধন্যবাদ জানাই একটাই কারণে; তা হচ্ছে তারা নির্বিঘ্নে এ জানাজা সম্পন্ন করতে দিয়েছেন। কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেনি। এরপরও সরকারের নীতিনির্ধারকদের দু-একজন ব্যক্তি 'মৃত ব্যক্তি' সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ধরনের বক্তব্য তাদের নিজেদের অবস্থানকে জনমানসে শক্তিশালী করে না। একটা প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে- এবার তাহলে সঙ্কট থেকে উত্তরণের পথ কী? এটা সত্য, সরকার সাংবিধানভাবেই ক্ষমতায় আছে। সংবিধান অনুযায়ীই একটা নির্বাচন হয়েছে গেল বছরের ৫ জানুয়ারি। ওই নির্বাচনে সব দল অংশ না নিলেও নির্বাচন ছিল সাংবিধানিকভাবে বৈধ; কিন্তু এ নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে পারেনি। কেননা গণতন্ত্রে 'কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারস' এর যে কথা বলা হয়, তা রক্ষিত হয়নি; অর্থাৎ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপিত হয়নি। বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তখন অবশ্য বলা হয়েছিল ৫ জানুয়ারির নির্বাচন 'নিয়মরক্ষার নির্বাচন'। আমরা সেটাই ধরে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সরকার এক বছরের মধ্যে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলবে। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা প্রায় সবাই বলছেন, পরবর্তী নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে। সংবিধান আমাদের এ কথাটাই বলে, ৫ বছর পর পর নির্বাচন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় ৫ জানুয়ারির নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছিল, তা স্বাভাবিক ছিল না। অস্বাভাবিক একটি পরিস্থিতিতে ১৫৪ সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাকি আসনগুলোয় যে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে ভোটারদের উপস্থিতির হার ছিল কম। তারপরও নির্বাচন হয়েছে। ১৯৯৬ সালেও তেমন একটি নির্বাচন (ষষ্ঠ সংসদ) আমরা দেখেছিলাম। কিন্তু এ সংসদ টিকেছিল মাত্র ১৩ দিন। ওই নির্বাচনের সঙ্গে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে তুলনা করতে চাই না। দুটো নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। তবে গণতন্ত্রে 'সব দলের অংশগ্রহণে' যে নির্বাচনের কথা বলা হয়, ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে সেটা ছিল না এবং দশম সংসদ নির্বাচনেও (২০১৪) সব দলের অংশগ্রহণে নিশ্চিত হয়নি। এতে এক জায়গায় মিলটা আছেই। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট একটি ভিন্ন সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। বোমাবাজি আর পেট্রলবোমা এখন রাজনীতিকে 'নিয়ন্ত্রণ' করছে। অদৃশ্য বোমাবাজরা আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিচ্ছে! যেখানে সংসদ দেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, আইন প্রণয়ন করবে, জাতিকে নেতৃত্ব দেবে, সেখানে অদৃশ্য বোমাবাজরা রাজপথে থেকে রাজনীতিকে কলুষিত করছে। বোমাবাজদের শিকারে পরিণত হয়েছে শিশুরা পর্যন্ত। এ পেট্রলবোমার সংস্কৃতি যে আমাদের রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমরা বোধকরি কেউই এটা বুঝতে চাইছি না। বুঝতে পারাটা স্বাভাবিক, কিন্তু বুঝতে চাইছি না! আমাদের সংবিধানে সুষ্ঠুভাবে বলা আছে, 'সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।' কিন্তু মানুষ যখন দগ্ধ হয়, তখন তার মৌলিক মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয় বৈকি! সংবিধানে চলাফেরার স্বাধীনতা (৩৬ নম্বর অনুচ্ছেদ) নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির নামে যারা পেট্রলবোমা ছুড়ছে, তারা তো সংবিধানের ওই ধারাকে এক রকম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ থেকে আমরা বের হয়ে আসব কীভাবে? কে দেবে আমাদের এ নিশ্চয়তা? রাজনীতির নামে বলি হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফারজানা কিংবা সাকিবের মতো ছোট্ট শিশুরাও বোমাবাজদের কাছ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী এ পেট্রলবোমায় আহত হয়েছেন, এমনটি কখনও দেখা যায় না। গত ক'দিনে ডিএমসির বার্ন ইউনিটের যে ছবি ও সংবাদ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তা হৃদয়বিদারক। ঝলসে গেছে মুখ, ছোট শিশুটি চিনতে পারছে না তার বাবাকে। ফ্যালফ্যাল করে 'অচেনা' এক বাবার দিকে তাকিয়ে আছে সে। ছোট্ট মনে তার হাজার প্রশ্ন- এমন কেন বাবা! এর জবাব কে দেবে? মার কোলে এই ছোট্ট সোনামণির ছবিও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আমি জানি না, কারা বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়েছে; তাদের ক'জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে; কিন্তু সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদ- ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে পেট্রলবোমা ছুড়ে, বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় খালেদা জিয়াকে 'হুকুমের আসামি' করে দুটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। আর ডিএমপির কমিশনার আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, প্রমাণসাপেক্ষে খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করা হবে! অর্থাৎ খালেদা জিয়াও গ্রেফতার হতে পারেন যদি 'প্রমাণ' পাওয়া যায়! খালেদা জিয়া অবরোধ-হরতালের ডাক দিয়েছেন- সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা জানিয়েছেন। তার বক্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। কিন্তু যাত্রাবাড়ীতে বাসে তিনি কি বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন? কী জানি পুলিশি 'তদন্তে' তা বেরিয়েও আসতে পারে! যাত্রাবাড়ীতে বাসে বোমা হামলা হয়েছিল ২৩ জানুয়ারি। তার মামলা হলো ২৪ তারিখ। এ হামলায় ৩১ জন দগ্ধ হয়েছিল। এটা একটা বড় ধরনের অপরাধ। এর শাস্তি হওয়া উচিত- এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য যে বিএনপির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না গেলে এ সঙ্কট থেকে বের হয়ে আসা যাবে না। কিন্তু খালেদা জিয়াকে 'হুকুমের আসামি' করায় (কুমিল্লায়ও তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা হয়েছে) এতে 'সমঝোতার ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও জটিলতা সৃষ্টি হলো বৈকি! এরই মধ্যে গতকাল (শনিবার) খালেদা জিয়ার গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ের বিদ্যুৎ, ডিশ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। এর আগে শুক্রবার খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এখন এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ একটি 'জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের কথা বলেছেন। কিন্তু 'জাতীয় ঐকমত্যের' সরকার তো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। সংবিধানে এ ধরনের কোনো কথা লেখা নেই; বরং বলা আছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তবে এর গঠন কাঠামো নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। বিএনপিকে কীভাবে এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা যায়, এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে। শেখ হাসিনাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান করেও একটা 'ফরমুলা' বের করা যায়। এর জন্যই প্রয়োজন সংলাপের। আর এ সংলাপ যত দেরি হবে, ততই সঙ্কটের গভীরতা বাড়বে। অসাংবিধানিক শক্তি এটা থেকে সুবিধা নেবে। এজন্য একটা সমঝোতা প্রয়োজন। কেননা সমঝোতা না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে আশা করছি- এ লক্ষ্যেও আমরা পৌঁছতে পারব না। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে আমরা দেশটিকে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের এ প্রত্যাশা পূরণ হবে না। কেননা 'সমঝোতা' না হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। রফতানি খাত থাকবে ঝুঁকির মুখে। ফলে লক্ষ্য অর্জিত হবে না। 'সমঝোতা' না হলে অরাজনৈতিক কর্মকান্ড বাড়বে; সুশাসন ব্যাহত হবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। 'সমঝোতা' যদি না হয়, তাহলে কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে না; আর দায়বদ্ধতা সৃষ্টি না হলে বাড়বে দুর্নীতি, বাড়বে অসহিষ্ণুতা। সরকার থাকবে, কিন্তু এক ধরনের অস্থিরতা সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেবে। এতে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চারও ব্যাঘাত ঘটবে। সংসদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের মূল চালিকা শক্তি। গণতন্ত্র আমাদের এটাই শেখায়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন ও 'সব দলের অংশগ্রহণে' এই নির্বাচন, একটি জাতীয় সংসদ, জবাবদিহিতা এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক। এ আস্থার সম্পর্কটা ফিরে আসুক, মানুষ স্বস্তি পাক, বোমাবাজির সংস্কৃতি বন্ধ হোক- এ মুহূর্তে সাধারণ মানুষ এটাই প্রত্যাশা করে। Daily Alokito Bangladesh 01.02.15

ওবামার ভারত সফর ও প্রসঙ্গ কথা

আজ সোমবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ভারতের ‘রিপাবলিকান ডে’ অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনীর মার্চপাস্ট অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। ওবামার এটা দ্বিতীয়বার ভারত সফর। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারত যে কত বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা এই সফরের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হলো। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ২০১০ সালের নভেম্বরে ওবামার ভারত সফরের সময় প্রায় ২০০ ব্যবসায়ীর একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে তিনি ভারতে এসেছিলেন। এবারে কতজন ব্যবসায়ী তার সঙ্গে থাকবেন, তার একটা পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও এটা জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ওবামার নয়াদিল্লি সফরের সময় সেখানে বেশ কিছু মার্কিন সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা করছে। সংবাদপত্রে এ খবর দিয়ে আরও বলা হচ্ছে, ওই সময় ৬টি মার্কিন জঙ্গিবিমান নয়াদিল্লির ওপর টহল দেবে এবং একটি যুদ্ধজাহাজ ওই এলাকায় মোতায়েন করা হবে। ভারত সরকার ৮০ হাজার পুলিশ ও ১০ হাজার আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য মোতায়েনেরও পরিকল্পনা করছে। কেননা ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ওবামার ওই সফরের সময় একটি জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করছে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এই জানুয়ারি মাসেই (১১-১৩) গুজরাটে অনুষ্ঠিত ‘ভাইব্রান্ট গুজরাট’ শীর্ষ সম্মেলনেও যোগ দেন। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয়েছে যে, বিশ্ব রাজনীতির আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের যে দক্ষিণ এশীয় নীতি, তাতে ভারত একটি বড় অংশ দখল করে আছে। অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, এর আগে জন কেরির বাংলাদেশেও আসার কথা ছিল। শেষ মুহূর্তে সেই সফর বাতিল ঘোষিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে টিকফা চুক্তি করেছে। এর বাইরে ‘আকসা’ বা ‘অ্যাকুইজেশন অ্যান্ড ক্রস সার্ভিসেস এগ্রিমেন্ট’ নামে অপর একটি চুক্তি করতে চায়। এই চুক্তির বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা পাবে। বাংলাদেশ এর আগে ন্যাটোর স্ট্র্যাটেজিক পার্টনারশিপ কর্মসূচির ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তারা ন্যাটোর সদর দফতরে শীর্ষস্থানীয় মার্কিন কমান্ডারদের সঙ্গে এক সৌজন্য সাক্ষাৎকারে (জুন ২০১২) এই আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন। তবে এটা জানা যায় যে, এই আগ্রহের ধরন-প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ন্যাটোর সম্প্রসারিত ভূমিকা। অর্থাৎ ইউরোপের বাইরেও ন্যাটো একটি ভূমিকা রাখতে চায়। অনেকেরই মনে থাকার কথা, ২০১২ সালের ৩১ মে টাইমস অব ইন্ডিয়ার অনলাইনে একটি সংবাদ ছাপা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গোপসাগরে একটি ঘাঁটি গাড়তে চাইছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব লিওন প্যানেট্রা ‘সংগ্রিলা ডায়ালগ’ (সিঙ্গাপুর জুন ২০১২)-এ এটা স্পষ্ট করেছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রণতরীর সংখ্যা বাড়াবে। ২০১৭ সালের শেষের দিকে এই রণতরীর সংখ্যা দাঁড়াবে ৬-এ। খুব স্বাভাবিক কারণেই এতে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীর যাতায়াত বাড়বে। তারা চট্টগ্রাম বন্দরের ‘পোর্ট অব কল’ সুবিধা নেবে। এ জন্যই তারা চাচ্ছে আকসা চুক্তিটি। মনে রাখতে হবে, দক্ষিণ এশিয়ার বঙ্গোপসাগরভুক্ত এই অঞ্চল ক্রমেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। অনেকেরই মনে থাকার কথা, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর-পরই প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মিয়ানমারকে (নভেম্বর ১৯, ২০১২)। মিয়ানমারে ইতোমধ্যেই প্রথমবারের মতো একজন মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়েছে। এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহের ধারাবাহিকতায়ই প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্বিতীয়বার মিয়ানমার সফর করেন গেল বছরের নভেম্বরে। তিনি বাংলাদেশে না এলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিননীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। তবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা দেখা দিয়েছে। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বেড়েছে নানা কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চিনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালেই আফগানিস্তান থেকে যুদ্ধরত মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে সেখানে যে ‘শূন্যতার’ সৃষ্টি হয়েছে, সেই শূন্যতা পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি ‘শান্তিরক্ষী’ বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৫ সালে মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা দক্ষিণ এশিয়ায়, বিশেষ করে বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গাড়তে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বিপুল জ্বালানিসম্পদ রয়েছে (গভীর সমুদ্রে)। মার্কিনি আইওসির এ ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট-প্রতিবেশী চিনের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে প্রভাব খাটানো সম্ভব। হিলারি কিনটনের বাংলাদেশ সফরের পর-পরই বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্রান্ড স্ট্র্যাটেজি রচিত হয়েছে। এ লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আকসা চুক্তি করতে চাচ্ছে। যদিও এখন অবধি বাংলাদেশ তার সমর্থনের কথা জানায়নি। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীর দীর্ঘ উপস্থিতি, বাংলাদেশকে তার স্ট্র্যাটেজিক কনসেপ্টের আওতায় নিয়ে আসা, এমনকি মালদ্বীপের সঙ্গে একই মডেলে অপর একটি চুক্তির অর্থ একটাইÑ চিন যে এ অঞ্চল ঘিরে ‘ঝঃৎরহম ড়ভ ঢ়বধৎঃং’ বা ‘মুক্তার মালা’ নীতি গ্রহণ করছে, তার বিরুদ্ধে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। দক্ষিণ চিন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে রাশিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এ পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চিন। চিন যে তেল আমদানি করে তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালি হয়ে চিনে যায়। তাই সংগত কারণেই চিনের জন্য তার ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চিনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিটও থাকবে, যা কি না ভারত মহাসাগরের সব নৌ মুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরও বেড়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৮০ নটিকাল মাইল। আর ইরান সীমান্ত রয়েছে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। চিন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গাওদার সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে। চিন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস এই গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। চিন শ্রীলংকার হামবানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চিন শ্রীলংকা সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারে রয়েছে চিনের নৌবাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়েসহ আরও বেশ কটি বন্দরে রয়েছে চিনা উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চিন যে বিশাল প্রতিরক্ষা গড়ে তুলছে, তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চিনের এই জাতীয় স্বার্থকে আঘাত করা ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এই অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি পার্টনার হিসেবে দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই যে স্ট্র্যাটেজি তাতে আদৌ পরিবর্তন আসবে না। জন কেরি না এলেও ঊর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তারা নিয়মিত বাংলাদেশ সফর করছেন এবং আগামীতেও করবেন। এখানে দেখতে হবে আমরা আমাদের স্বার্থকে কীভাবে নিশ্চিত করতে পারি। সেই জাতীয় স্বার্থ খুব একটা নিশ্চিত হচ্ছে না। মহাজোট সরকারের আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হলেও নানা ইস্যুতে এখনো জটিলতা রয়ে গেছে। তিস্তাচুক্তি নিয়ে এখনো ধূম্রজাল রয়ে গেছে। বলা হচ্ছে আগামীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্ভাব্য ভারত সফরের সময় এই তিস্তাচুক্তি স্বাক্ষরিত হতে পারে। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে যে সমীকরণ, তাতে পশ্চিম বাংলার আপত্তির মুখে কেন্দ্রীয় সরকার আদৌ চুক্তি করতে পারবে বলে মনে হয় না। উপরন্তু পশ্চিম বাংলায় ২০১৬ সালে নির্বাচন। এই নির্বাচনে তিস্তাচুক্তি একটি ইস্যু হয়ে যেতে পারে। তবে বারাক ওবামার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের চেয়ে ভারতকে গুরুত্ব দেয় বেশি। সেটাই স্বাভাবিক। ভারত উঠতি অর্থনৈতিক শক্তি। সেখানে মার্কিনি স্বার্থ অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই ভারতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধি করবে না। এ অঞ্চলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র যে অক্ষ গড়ে উঠছে, বাংলাদেশকে সেই অক্ষেই অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। এর বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ লাভবান হবে না। তবে মনে রাখতে হবে, ভারত-যুক্তরাষ্ট্র অক্ষকে ব্যবহার করেই বাংলাদেশকে তার জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে হবে। আর সেভাবেই পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করতে হবে। অতি সম্প্রতি এই জানুয়ারিতেই ওবামার ভারত সফরের আগে নয়াদিল্লি ঘুরে এসেছেন প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা এইচটি ইমাম। সেখানে নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে তার আলাপ-আলোচনায় এ অঞ্চলের জঙ্গি তৎপরতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নটিও উঠে এসেছে। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠন জেএমবির সম্পর্কতা ও ঢাকায় অতি সম্প্রতি ৪ জন আইএস জঙ্গির গ্রেফতার ইত্যাদি ঘটনায় বাংলাদেশের উদ্বেগ রয়েছে। একই ধরনের উদ্বেগ রয়েছে নয়াদিল্লিরও। যুক্তরাষ্ট্রও এ অঞ্চলে জঙ্গি তৎপরতার ব্যাপারে উৎকণ্ঠিত। নয়াদিল্লিতে ওবামা-মোদি আলোচনায়ও এই বিষয়টি স্থান পাবে। এ ক্ষেত্রে নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটন যে কোনো ‘উদ্যোগের’ সঙ্গে বাংলাদেশও সম্পৃক্ত হতে পারে। ভারত বড় অর্থনীতির দেশ। বড় বাজার। পরিবর্তিত বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত-চিন সম্পর্ক (ঈযরহফরধ) ওয়াশিংটনে একটা উদ্বেগ সৃষ্টি করলেও শ্রীলংকায় সরকার পরিবর্তনে ভারতের একটা ‘ভূমিকার’ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সন্তুষ্ট। আগামীতে ভারত-চিন সম্পর্ক বৃদ্ধি না পেয়ে একটা পারস্পরিক অবিশ্বাসের জন্ম হতে পারে। আর এটা থেকেই ফায়দা উঠাবে ওয়াশিংটন। ওবামার দ্বিতীয়বার ভারত সফর এই সম্ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করবে মাত্র। Dailyn AMADER SOMOY 26.1.15

শিশু সাফির মতোই দগ্ধ দেশের গণতন্ত্র

বিবিসির বাংলা বিভাগ গত ২০ জানুয়ারি গণতন্ত্র দিবস পালন করেছে। এ উপলক্ষে বেতারে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে তারা। এর অংশ হিসেবে তারা ঢাকা শহরে দুটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মতামত নেয় এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে তাদের ভাবনা প্রচার করে। একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে আমাকেও বিবিসির ঢাকা অফিসের স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মন্তব্য করার জন্য। বিবিসির বাংলা বিভাগের শায়লা রুখসানার সঙ্গে ওদের আলাপচারিতায় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকটের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। বিবিসির ওই সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হল এমন এক সময় যখন দেশ চরম এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে অবরোধ, হরতাল, সহিংসতা; অন্যদিকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র মধ্য দিয়ে আমরা দিন পার করছি এবং ‘গণতন্ত্র চর্চা’ করছি! বিবিসির সঙ্গে আলাপচারিতায় তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে সাদিয়া, নাঈমা, সাদিক, হৃদয়, মাসরুররা যেসব মন্তব্য করেছে, তা যে কোনো বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘বোমাবাজি গণতন্ত্র নয়’, ‘গণতন্ত্রের নামে জনগণের জন্য কোনো কাজ হচ্ছে না’, ‘বিরোধী দল গণতন্ত্রের অংশ’, ‘জনগণের অংশগ্রহণ নেই’, ‘সরকার এককেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে’, ‘মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না’, ‘নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য গণতন্ত্র’- এ ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশের গণতন্ত্র বোঝার জন্য যথেষ্ট। ওদের মুখ থেকে এক ধরনের সমঝোতার কথাও বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে এসেছে নিরাপত্তাহীনতার কথা। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা যখন তাদের হতাশা আর নিরাপত্তাহীনতার কথা বলছিল, তখন আমার মনে পড়ছিল ঢাকার চলমান ঘটনাবলীর কথা।এটা অনেকেই স্বীকার করেন একটা ‘সমঝোতা’ প্রয়োজন। কারণ সমঝোতা না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে আশা করছি, এ লক্ষ্যে আমরা পৌঁছতে পারব না। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের এ প্রত্যাশাও পূরণ হবে না। কারণ সমঝোতা না হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। রফতানি খাত থাকবে ঝুঁকির মুখে। ফলে লক্ষ্য অর্জিত হবে না। সমঝোতা না হলে অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। সুশাসন ব্যাহত হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে না। আর দায়বদ্ধতা সৃষ্টি না হলে বাড়বে দুর্নীতি। বাড়বে অসহিষ্ণুতা। সরকার থাকবে বটে; তবে এক ধরনের অস্থিরতা সরকারের মধ্যে কাজ করবে। এতে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চারও ব্যাঘাত ঘটবে। সংসদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের মূল চালিকা শক্তি। গণতন্ত্র আমাদের এটাই শেখায়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচন এবং ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ সেই নির্বাচন, একটি জাতীয় সংসদ, জবাবদিহিতা এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক। কিন্তু অতীতে যা ঘটেনি, তা ঘটেছিল ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে। সংবিধানের ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচন হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনীতির ‘বাস্তববাদী নীতি’ এতে প্রতিফলিত হয়নি। অর্থাৎ বাস্তবতা এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। আর বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। বিএনপির ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়া সঠিক ছিল, নাকি ভুল ছিল- এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। বিএনপির নির্বাচন প্রশ্নে ‘অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়, সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি। কারণ ১৯৯১ সালের নির্বাচনের (পঞ্চম) মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম ও ২০০৮ সালে নবম সংসদ তথা প্রতিটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে গড়ে ৩৩ ভাগ ভোট নিশ্চিত করেছে (১৯৯১ সালে ৩০:৮১ ভাগ এবং ১৯৯৬ সালে ৩৩.৬১ ভাগ, ২০০১ সালে ৪০.৯৭ ভাগ এবং ২০০৮ সালে ৩৩.২০ ভাগ)। এখন এদের বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যে যুক্তিতে বিএনপি তথা ২০ দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেটা তারা বারবার স্পষ্ট করেছে। এমনকি ৩১ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনেও খালেদা জিয়া বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তার ৭ দফার প্রথম দফাই হচ্ছে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সংবিধানে এর কোনো সুযোগ নেই। সেজন্যই খালেদা জিয়া দাবি করেছেন সংবিধান সংশোধনের। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষও বোধকরি এটা উপলব্ধি করবেন যে, বর্তমান সরকার ‘দ্বিতীয়বার’ আর সংবিধান সংশোধন করবে না, যদি না তাদের ‘বাধ্য’ করা হয়! প্রশ্নটা এখানেই- বিএনপি তথা ২০ দল সরকারকে বাধ্য করাতে পারবে কিনা? হরতাল দিয়ে যে বাধ্য করা যায় না, তা এর আগেও প্রমাণিত হয়েছে।এখানে যা দিবালোকের মতো স্পষ্ট তা হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী দুই মতের সহাবস্থান হচ্ছে না। আর সহাবস্থান না হলে সংঘাত বাড়বেই। কোনো পক্ষই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। এখানে মধ্যস্থতা করারও সুযোগ নেই। আমরা অতীতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূতের দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। ফলাফল শূন্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্র দফতর একাধিকবার ‘সব দলের অংশগ্রহণে ‘নির্বাচনে’র কথা বলে আসছে। এখানেও কোনো জট খোলেনি। তাই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় অন্ধকার রয়েই গেছে। বারবার বিদেশীদের কাছে ছুটে যাওয়াও কোনো ভালো সংবাদ নয়।আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, রাজনীতিকদের দূরদর্শিতা। আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। দু’পক্ষই যে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে, তা দেশ ও জাতির জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। গেল বছরের শেষের দিকে বিএনপি গাজীপুরে সভা করতে পারেনি। কারণ সেখানে সব দলের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। এর আগে ছাত্রলীগ তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপির জনসভা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। ফলে প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারি অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। এখানে মুখ্য হওয়া উচিত ছিল রাজনীতি। শক্তি কখনও মুখ্য হওয়া উচিত নয়। বিএনপিকে গাজীপুরে জনসভা করার অনুমতি দিলে তাতে সরকারেরই লাভ হতো। উচিত ছিল ছাত্রলীগেরও জনসভা করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করা। এতে সাধারণ মানুষের পক্ষে সুবিধা হতো একটি সিদ্ধান্তে আসার। ওই ঘটনার পরও বিএনপি জনসভার অনুমতি পায়নি। এক্ষেত্রেও সরকার আরও উদার হতে পারত। কারণ সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮নং অনুচ্ছেদে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিএনপি একটি বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন। দলকে সমাবেশ করতে দিলে ক্ষতির কিছু ছিল না। ডিএমপি তো এর আগেও অনুমতি দিয়েছে। উপরন্তু ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টিও সমাবেশ করেছে। সমাবেশ করতে না দিলে বিষয়টি বিএনপি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবে, এটাই তো স্বাভাবিক।খালেদা জিয়া ৭ দফা উপস্থাপন করেছেন। এই ৭ দফায় নতুন কিছু নেই। এ কথাগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন। তবে এই ৭ দফার মাঝে ১নং দফাই প্রধান। ১নং দফায় বলা হয়েছে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সমস্যা এখানেই। সরকার এক্ষেত্রে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান তাদের পক্ষে। বিএনপি সংবিধান সংশোধনের কথা বলছে। খুব সঙ্গত কারণেই সরকার এটি করবে না। আর বিএনপি সরকারকে এ কাজটি করতে ‘বাধ্য’ করাতে পারবে, এটিও বাস্তবসম্মত নয়। তবে বিএনপি যে সংলাপের কথা বলছে, সেই সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান খুঁজে বের করা অমূলক কিছু নয়। যদিও অতীতে সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিন্তু তাই বলে এখন হবে না, এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই কিছুটা ‘ছাড়’ দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার’- এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।খালেদা জিয়ার গুলশানস্থ অফিস থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে নেয়ার পরও খালেদা জিয়া তার অফিসেই অবস্থান করছেন। গত ২১ ও ২২ জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়েছে। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। একটি সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী অবরোধে গত ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত মারা গেছে ২৮ জন, যাদের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে ১৪ জন। গাড়ির ক্ষতি হয়েছে ৫৬৪টি, সম্পূর্ণ পোড়ানো হয়েছে ৬৪টি। আর ওই সংবাদপত্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আহত হয়েছে ৫৫ হাজার ২০৭ জন ব্যক্তি। ধ্র“পদী গণতন্ত্র চর্চার সঙ্গে এই তথ্য বড় বেমানান। সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিতে দগ্ধ শিশু সাফির করুণ চাহনি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাফির মতোই দগ্ধ বাংলাদেশের গণতন্ত্র! বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি ছোট্ট শিশুকে পর্যন্ত পঙ্গুত্বের ঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে। এ কোন রাজনীতি? আর এ রাজনীতি চলবেই বা কতদিন ধরে? পেট্রল ঢেলে যারা বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়, যারা বাসে পেট্রলবোমা ছোড়ে, তারা গণতন্ত্রের শত্র“। বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, যারা এ ধরনের কাজ করে তারা দুর্বৃত্ত। তাদের কোনো পরিচয় থাকতে পারে না। আর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খুনি হিসেবে খালেদা জিয়ার বিচার হবে। সংসদেও দাবি উঠেছে তার গ্রেফতার ও বিচারের। কিন্তু এটা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। বরং সংঘাতকে আরও প্রলম্বিত করবে। আমরা চাই হরতাল, অবরোধ আর সংঘাতের অবসান। যারাই মানুষ হত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। মানুষ হত্যার নাম গণতন্ত্র হতে পারে না। সেই সঙ্গে সহনশীলতা, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখাটাও জরুরি। মনে রাখতে হবে, রাজনীতির অপর নাম হচ্ছে মানুষকে সেবা করা। মানুষ হত্যা করে কিংবা বালুর ট্রাক আর ইটের ট্রাকে কাউকে ‘গৃহবন্দি’ করে রেখে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যায় না। তাই চাই সমঝোতা। চাই দূরদর্শিতা। চাই ছাড় দেয়ার মানসিকতা। শিশু সাফি যে কথা বলতে পারেনি, কিংবা এ প্রজন্মের সাদিয়ারা যে প্রশ্ন রেখেছে, আমাদের রাজনীতিকরা যদি তা উপলব্ধি করেন, তার মাঝেই সবার মঙ্গল নিহিত। মানুষের জন্যই রাজনীতি। আর এ রাজনীতি যদি বেশি মাত্রায় সন্ত্রাসনির্ভর হয়, তাহলে আমাদের আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। দুঃখ একটাই- ৪৪ বছরে পা দিতে গিয়েও আমাদের এ কথাটা বলতে হচ্ছে। Daily Jugantor ২৪ জানুয়ারি, ২০১৫

সমঝোতা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই

আমরা আবারো ১৫ জানুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল প্রত্যক্ষ করলাম। বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে এ হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল এবং প্রতিটি হরতালের ক্ষেত্রে যা হয়, এবারো তাই হয়েছে। গাড়ি ভাংচুর, আগুন ধরানো, চোরাগোপ্তা হামলা_ কোনো একটি ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম হয়নি। ঢাকা একরকম 'বিচ্ছিন্ন' হয়ে আসছে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। বালুর ট্রাক আর ইটের ট্রাকে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্র! হাজারটা প্রশ্ন এখন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে_ এর শেষ কোথায়? বেগম জিয়া একরকম 'অবরুদ্ধ' হয়ে আছেন তার গুলশান অফিসে। যদিও প্রধানমন্ত্রী জনসভায় বলেছেন বেগম জিয়া ইচ্ছা করলে তার বাসায় যেতে পারেন। কিন্তু আমরা যারা আমজনতা আমাদের কাছে বিষয়টি আদৌ স্পষ্ট নয়, বেগম জিয়া কি সত্যি সত্যিই অবরুদ্ধ? নাকি তিনি চাইলেই বাসায় যেতে পারেন? ঘটনার পেছনে সত্যতা যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে বেগম জিয়া, যিনি তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি একরকম 'গৃহবন্দি'র জীবন যাপন করছেন। এভাবে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে 'গৃহবন্দি' করে রাখা গণতন্ত্রের জন্য কতটুকু ভালো ও মঙ্গল_ এ প্রশ্ন উঠবেই। সরকারের দৃষ্টিতে বিএনপি নেত্রী যদি কোনো 'রাষ্ট্রবিরোধী' কর্মকা- করে থাকেন তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করাই শ্রেয়। তিনি আইনি মোকাবেলায় তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি মোকাবেলা করবেন। তা না করে ট্রাক এনে বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখা, তালা লাগিয়ে তাকে ঘরের ভেতরে অবরুদ্ধ করে রাখা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। প্রয়োজনে বেগম জিয়া সংবিধানের ৭, ১১, ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৬, ৩৭ কিংবা ৩৯ ধারা উল্লেখ করে হাইকোর্ট রিট করতে পারেন। উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে সরকারের কাছে তার 'অবরুদ্ধ'-এর বিষয়টি নিয়ে ব্যাখ্যা চাইতে পারে। তবে আমরা ইতোমধ্যে অবগত হয়েছি যে, সরকার বেগম জিয়াকে গ্রেপ্তার করতে পারে। মন্ত্রী ইনু প্রকাশ্যেই সে কথা বলেছেন, যা পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, যিনি আদৌ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন, তিনি ও তার দলের অন্য একজন সদস্য যেভাবে মন্তব্য দেন, তা কিন্তু সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না। জনাব মঈনউদ্দিন খান বাদল জাসদের কার্যকরী সভাপতি। জীবনে কোনো দিনই জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে পারেননি। শুধু প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় তিনি গেল সংসদেও এমপি হয়েছিলেন, আর ৫ জানুয়ারির ২০১৪ ভোটারবিহীন নির্বাচনেও এমপি হয়েছেন। তিনি যখন বলেন, 'প্রয়োজনে পুলিশ বুকে গুলি চালাবে'_ তখন কি তিনি একবারও ভেবে দেখেছিলেন যে, এ বক্তব্য তার নিজের, দলের কিংবা সরকারের কী ক্ষতি করে গেল? পরে তিনি এ 'বক্তব্য' অস্বীকার করলেও, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। প্রতিটি সংবাদপত্রে তার এ বক্তব্য ছাপা হয়েছিল। তখন 'অস্বীকার' করলেও মানুষ এটা বিশ্বাস করবেই যে তার মতো ব্যক্তির পক্ষে এ ধরনের বক্তব্য দেয়া সম্ভব। আমরা জাসদের হঠকারী রাজনীতির অতীত ইতিহাস জানি। এ জাসদেরই প্রডাক্ট হচ্ছেন বাদল সাহেব। রাজনীতিবিদরা আমাদের তরুণ সমাজের কাছে মডেল হবেন। কিন্তু কী ভাবমূর্তি নিয়ে তারা আসছেন! আমরা এক অনিশ্চিত জীবনের মাঝে বাস করছি। অবরোধ চলছে। চোরাগোপ্তা হামলা চলছে। একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই রিয়াজ রহমান পরিচিত ছিলেন। তিনি রাজনীতিবিদ নন। টেকনোক্র্যাট। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে বেগম জিয়াকে পরামর্শ দেন। অথচ তার ওপরই হামরা হলো। এ হামলা আমাদেরও একটা ভয়ের মধ্যে ফেলে দিল। কেননা আমরা টিভিতে যাই। দুই দলেরই সমালোচনা করি। সরকারকেও সুপরামর্শ দিই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের ব্যক্তিরা তাতে আপত্তি তোলেন। ২০ দল হরতাল দিল। কিন্তু এ হরতাল কি কোনো সমাধান বয়ে আনবে? লাগাতার অবরোধও কি কোনো সমাধান দেবে? তাহলে কি এভাবে হরতাল-অবরোধ হতেই থাকবে? একটা জায়গায় রাজনীতিবিদদের আসতেই হবে। রাজনীতিবিদরা যদি পরস্পরকে 'শত্রু' মনে করেন, তা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, সিনিয়র রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সাধারণ মানুষের যে প্রত্যাশা তা তারা পূরণ করতে পারছেন না। সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা করে একটা 'সমঝোতা' হবে। একটা সংলাপ হবে। বর্তমান অস্থিরতার অবসান হবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। সরকারের ঊর্ধ্বতন নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য স্টাইলে বোঝা যায় ২০১৯ সালের আগে নির্বাচন কিংবা সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই। সংবিধান তা-ই বলে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি কী নির্বাচন হয়েছে, জনগণের আদৌ অংশগ্রহণ ছিল কিনা, এটা কি আমাদের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে একবারও চেষ্টা করেন? এতে আমরা গণতন্ত্রের বিকাশকে কতটুকু ক্ষতি করলাম, তা কি একবারও চিন্তা করেছি? আমরা কি একটা 'বাজে' দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম না? এটা যে ভবিষ্যতে একটা 'দৃষ্টান্ত' হবে না, এর গ্যারান্টি আমাদের কে দেবে? এটা তো এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, পরস্পরবিরোধী দুই দল, মত ও আদর্শের সহাবস্থান হচ্ছে না। আর সহাবস্থান না হলে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কোনো পক্ষই তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। এখানে মধ্যস্থতা করারও সুযোগ নেই। আমরা অতীতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূতের দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। ফলাফল শূন্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র দপ্তর একাধিকবার 'সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন'-এর কথা বলে আসছেন। এখানেও কোনো জট খোলেনি। তাই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে অন্ধকার, তা রয়েই গেছে। আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতা। আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। দুই পক্ষই যে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে, তা দেশ ও জাতির জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। গেল বছরের শেষের দিকে বিএনপি গাজীপুরে সভা করতে পারেনি। কেননা সেখান সব দলের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। এর আগে ছাত্রলীগ তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপির জনসভা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। ফলে প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারি অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। এখানে মুখ্য হওয়া উচিত ছিল রাজনীতি। ব্যক্তি কখনো মুখ্য হওয়া উচিত নয়। বিএনপিকে গাজীপুরে জনসভা করার অনুমতি দিলে, তাতে সরকারেরই লাভ হতো। উচিত ছিল ছাত্রলীগেরও জনসভা করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করা। এতে সাধারণ মানুষের পক্ষে সুবিধা হতো একটি সিদ্ধান্তে আসার। ৫ জানুয়ারি বিএনপি জনসভার অনুমতি পায়নি। এখানেও সরকার আরো উদার হতে পারত। কেননা সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ নাম্বার অনুচ্ছেদে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিএনপি একটি বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন। এ দলকে সমাবেশ করতে দিলে ক্ষতির কিছু ছিল না। ডিএমপি তো এর আগেও অনুমতি দিয়েছে। উপরস্তু ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টিও সমাবেশ করেছে। সমাবেশ করতে না দিলে বিষয়টি বিএনপি তাদের স্বার্থেই ব্যবহার করবে। বেগম জিয়া সাত দফা উপস্থাপন করেছেন। এ সাত দফায় নতুনত্ব কিছু নেই। এ কথাগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন। তবে এ সাত দফার মাঝে ১ নাম্বার দফাই প্রধান। ১ নাম্বার দফায় বলা হয়েছে_ নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সমস্যা এখানেই। সরকার এ ক্ষেত্রে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান তাদের পক্ষে। বিএনপি সংবিধান সংশোধনের কথা বলছে। খুব সঙ্গত কারণেই সরকার এটি করবে না। আর বিএনপি সরকারকে এ কাজটি করতে 'বাধ্য' করতে পারবে, এটিও বাস্তবসম্মত নয়। তবে বিএনপি যে সংলাপের কথা বলছে, সে সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান খুঁজে বের করা অমূলক কিছু নয়। যদিও অতীতে সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিন্তু তাই বলে এখন হবে না, এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে কিছুটা 'ছাড়' দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। 'বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার'_ এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। সরকার যেহেতু একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এবং দাবিগুলো তার কাছেই পেশ করা, সেহেতু 'সংলাপ'-এর ব্যাপারে সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার যদি একটু 'নমনীয়' হয়, তাহলে একটি সমাধান বের করা সম্ভব। মধ্যবর্তী নির্বাচন গণতন্ত্রসম্মত। সে ক্ষেত্রে ২০১৯ নয়, এর আগেও নির্বাচন হতে পারে। আর দুই দলের প্রস্তাবের আলোকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনও সম্ভব। প্রয়োজনে 'ভারতীয় মডেল' অনুসরণ করে নির্বাচনকালীন সব ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের কাছে ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা নিজেও থেকে যেতে পারেন। বিএনপির প্রতিনিধিদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেও একটা সমাধান খুঁজে বের করা যায়। আর এখানেই প্রশ্নটি হচ্ছে আন্তরিকতার। সরকার বা বিএনপি কতটুকু আন্তরিক হবে, প্রশ্ন সেখানেই। সঙ্কটের মাত্রা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাত দফা প্রত্যাখ্যান ও আরো একবার মধ্যবর্তী নির্বাচন নাকচ করার অর্থ হচ্ছে সঙ্কটের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দেয়া। অবরোধ চলছে, হরতাল হচ্ছে। আমরা আবারো 'হরতালের সংস্কৃতি'তে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু অতীত ইতিহাস বলে আশাবাদী হতে চাই। চাই না সংঘাতমুখর রাজনীতি আমাদের সব অর্জনকে মস্নান করে দিক। আমরা চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। জনগণের জন্য যে রাজনীতি, সে রাজনীতিই ফিরে আসুক। Daily Jai Jai Din বুধবার, জানুয়ারী ২১, ২০১৫

সিরিসেনার উত্থান প্রসঙ্গে কিছু কথা

শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মিথ্রিপাল সিরিসেনার বিজয় অনেককে অবাক করলেও একটি প্রশ্ন কোনো কোনো মহলে আলোচিত হচ্ছে সিরিসেনাকে ‘বিজয়ী’ করিয়ে নিয়ে আসার ব্যাপারে ভারতের কোনো ভূমিকা ছিল কি না এবং চিনের পরিবর্তে ভারত এখন শ্রীলংকায় বড় ভূমিকা পালন করবে কি না? সম্ভাব্য ভারতের এই ভূমিকা ইতোমধ্যে সংবাদপত্রে আলোচনাও হয়েছে। বিশেষ করে শ্রীলংকার কোনো কোনো সংবাদপত্রে এমনও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে বেশিমাত্রায় চিনের প্রতি ঝুঁকেছিলেন। ফলে ভারতের স্ট্র্যাটেজিস্টরা বিষয়টিকে খুব ভালো চোখে নেননি। নির্বাচনের ফল চূড়ান্তভাবে ঘোষিত হওয়ার আগেই মিথ্রিপাল সিরিসেনাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এ থেকে একটি সন্দেহ দৃঢ় হয় যে, ভারত নিশ্চিত ছিল সিরিসেনা বিজয়ী হবেন। সিরিসেনা এক সময় রাজাপক্ষের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধে’ সিরিসেনা রাজাপক্ষেকে সমর্থন করেছিলেন। উপরন্তুরাজাপক্ষের দল শ্রীলংকান ফ্রিডম পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। এক্ষেত্রে বিশেষ মহলের পরামর্শে সিরিসেনা মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। মজার ব্যাপার, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির প্রার্থী রনিল বীক্রমাসিংহ প্রার্থী না হয়ে সিরিসেনাকে সমর্থন করেন। ধারণা করা হয়, ভারতের একটি ‘মহল’ রাজাপক্ষের নিশ্চিত বিজয় ঠেকাতেই সিরিসেনাকে সমর্থন করতে ইউপিএ নেতাদের চাপ দেন। সিরিসেনা নিশ্চিত করেছেন, তিনি তার প্রথম বিদেশ সফরে নয়াদিল্লি যাবেন। তাই বোঝাই যায়, তিনি সরকার পরিচালনায় বেশিমাত্রায় ভারতের ওপর নির্ভরশীল হবেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্ররা ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ সম্পর্কে কিছুটা ধারণা রাখেন। ২০০৭ সালের পর থেকে শ্রীলংকা, চিন, ইরান ও রাশিয়ার সমন্বয়ে এ অঞ্চলে যে ‘ঐক্য’ গড়ে উঠছে এবং যা ‘প্রিমাকভ ডকট্রিন’ হিসেবে পরিচিতÑ তা একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের স্বার্থকে আঘাত করছে। চিনের এ অঞ্চল ঘিরে যে ‘মুক্তার মালা’ নীতি, তা ভারত মহাসাগরে এর কর্তৃত্বকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই প্রণীত। ভারত মহাসাগরে চিনের শক্তি বৃদ্ধিকে ভারত তার নিরাপত্তার প্রতি হুমকিস্বরূপ হিসেবেও মনে করছে। ফলে শ্রীলংকায় একটা পরিবর্তন অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। মনে রাখতে হবে, চিন একদিকে বেলুচিস্তানের গাওদার বন্দর তৈরি করে দিয়েছিল, অন্যদিকে শ্রীলংকার হাসবানতোতায়ও একটি গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি করে দিয়েছে। গাওদারে চিনা নৌবাহিনীর একটি ঘাঁটি আছে। আর হাসবানতোতায় চিনা নৌবাহিনীর উপস্থিতি না থাকলেও বন্দরটি তারাই পরিচালনা করে। ১ হাজা ৫০০ কোটি ডলারের বিশাল এক চিনা বিনিয়োগে রয়েছে শ্রীলংকায়। ভারতের ব্যবসায়ীদের এখানে স্বার্থ রয়েছে। চিনের বদলে তারা এখন শ্রীলংকায় ব্যবসা করতে চান। এ জন্যই দরকার একটি ‘ভারতবান্ধব’ সরকার। সম্ভবত সিরিসেনার বিজয় এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাচ্ছে এখন। নিঃসন্দেহে সিরিসেনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি সবাইকে অবাক করেছে। তাকে ফিরে একটি বড় ধরনের ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছে। আমাদের মতো দেশ হলে নির্বাচনে বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) নিজেদের প্রার্থী দিত। কিন্তু দলটি তা করেনি। বরং সিরিসেনাকে সমর্থন করে একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছে শ্রীলংকায়। তাই অনেক প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আদৌ থাকবে কিনা? সিরিসেনা ইতোমধ্যেই ইউএনপি নেতা রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী করেছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সিরিসেনার নিজের দল শ্রীলংকান ফ্রিডম পার্টি এই ঐকমত্যের প্রক্রিয়াটি আগামী সংসদ নির্বাচনে সমর্থন করবে কিনা? সাধারণত যিনি হেরে যান, তিনি আর রাজনীতিতে তেমন একটা সক্রিয় থাকেন না (যেমন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা)। এখন দেখার বিষয়, রাজাপক্ষে আদৌ শ্রীলংকার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন কি না? তবে শ্রীলংকার ইতিহাস বলে, ফ্রিডম পার্টিকে এখন নতুন একজন নেতা খুঁজতে হবে। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে রাজাপক্ষে শ্রীলংকার অখ-তা রক্ষা করেছেন সত্য। কিন্তু৫ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তিনি শ্রীলংকার তামিলদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। এটি ছিল তার বড় ব্যর্থতা। সাধারণ তামিলরা তাকে বরাবর ঘৃণা করে আসছে এবং নির্বাচনে তারা এককভাবে সিরিসেনাকে ভোট দিয়েছে। এখন সিরিসেনার প্রধান কাজ হবে তামিলদের আস্থা অর্জন করা। এখানে ভারতীয় তামিলরা একটি ফ্যাক্টর। তাই ওই কাজটি করা খুবই সহজ হবে বলে মনে হয় না। সিংহলিদের একটা অংশ এখনো তামিলবিরোধী। শ্রীলংকার জাতিগত দ্বন্দ্বের ইতিহাসও বেশ পুরনো। ৬৫ হাজার ৬০৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনেও ওই দেশটির লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ৩ লাখ। ভারত মহাসাগর ঘেঁষা ওই দেশটি বিভিন্ন সময় পর্তুগাল, হল্যান্ড ও ব্রিটেনের কলোনি ছিল। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজরা দেশটির পশ্চিম ও দক্ষিণে বসতি স্থাপন করে। পরের শতকের মাঝামাঝি ডাচরা (হল্যান্ড) দেশটি দখল করে নেয়। ১৮০২ সালে শ্রীলংকা পৃথক ব্রিটিশ কলোনি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটির পরিচয় ছিল সিংহল হিসেবে। তামিলদের আস্থা অর্জন করার কাজটি হবে কঠিন। জনগোষ্ঠীর ১১ দশমিক ২ শতাংশ তামিল। তামিল টাইগার নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের হত্যাকা-ের ঘটনা সাধারণ তামিলরা মেনে নিতে পারেনি আজও। প্রবাসী তামিলদের মধ্যে স্বাধীনতার চেতনা এখনো আছে। শ্রীলংকার মূলধারার রাজনীতিতে তাদের নিয়ে আসার কাজটি হবে কঠিন। তামিল অধ্যুষিত দুটি প্রদেশ (মোট প্রদেশ ৯টি) পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলকে ২০০৬ সালে একত্র করা হয়। কিন্তু প্রাদেশিক নির্বাচন ও প্রাদেশিক সরকার গঠিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব বেশি। সত্যিকার অর্থে প্রাদেশিক সরকার কোনো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে না। ফলে তামিলরা এখনো নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। সিরিসেনাকে এখন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বলা ভালো, ১৮০২ সালে ইংরেজরা শ্রীলংকায় ব্রিটিশ শাসন কায়েম করার আগে থেকেই সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী তামিলরা বসতি স্থাপন করে। তামিলরা আসে মূলত ভারতের তামিলনাড়– রাজ্য থেকে। ব্রিটিশরা তাদের এ অঞ্চলে চায়ের বাগান ও রাবার বাগানে কাজ করার জন্য নিয়ে এসেছিল। তবে দীর্ঘদিন তাদের শ্রীলংকার নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। এই বৈষম্যমূলক আচরণের ফলেই তামিলরা ১৯৮৪-৮৫ সালের পর থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। তবে তামিল টাইগারদের (তারা তাদের সিম্বলে বাঘের মুখ ব্যবহার করতো। তাই তামিল টাইগার হিসেবে তারা পরিচিতি পেয়েছিল) কথা প্রথম জানা যায়, ১৯৭৫ সালেÑ যখন জাফনার মেয়র দুরায়াপ্পাকে টাইগাররা হত্যা করে। শ্রীলংকার জনগোষ্ঠীর ১০ শতাংশ হচ্ছে মুসলমান, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা ৭৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। সম্প্রতি সেখানে মুসলমান-বৌদ্ধ দাঙ্গার খবর আমরা জানি। বাংলাদেশ দূতাবাস আক্রান্ত হওয়ার খবরও আমরা জানি। একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জঙ্গিগোষ্ঠী ‘বদুপালা সেনা’র অপতৎপরতা ও শ্রীলংকাকে একটি পরিপূর্ণ বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণার খবরও আমরা জানি। রাজাপক্ষে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন দেখার বিষয়, সিরিসেনা তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষে নেন! জাতিসংঘসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রীলংকায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় সোচ্চার। জাতিসংঘ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে এবং শ্রীলংকার কয়েক সামরিক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। এখন সিরিসেনাকে বহির্বিশ্বের, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আস্থা অর্জন করতে হবে। কাজটি খুব সহজ হবে না নয়া প্রেসিডেন্টের জন্য। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার জন্য একটি খারাপ খবর হচ্ছে, সংসদের স্পিকার হচ্ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষের ভাই চামাল রাজাপক্ষে। ২২৫ আসনের সংসদে রাজাপক্ষের সমর্থকদের অর্থাৎ তার দলের সদস্য সংখ্যা ১৪৪। অথচ প্রধানমন্ত্রী রানিল বিক্রমসিংহের (যিনি এর আগেও দু’বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপক্ষের কাছে হেরে যান) দলের সদস্য সংখ্যা মাত্র ৬০। সমস্যাটি এখানেই তৈরি হবে। বিক্রমসিংহ সংসদের আস্থা নাও পেতে পারেন। পরবর্তী সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা ২০১৬ সালে। কিন্তু এখন হবে এই এপ্রিলে। এক্ষেত্রে সিরিসেনার ‘ভারতমুখিতা’ ভোটারদের আবার শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টিমুখী করতে পারে। তাই সিরিসেনাকে খুব হিসাব করে চলতে হবে। শ্রীলংকায় জাতীয়তাবাদী চেতনা অত্যন্ত শক্তিশালী। ভারত তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলাকÑ এটি সিংহলিরা কখনোই ভালো চোখে দেখবে না। অতীত ইতিহাসটি ভারতের জন্য কোনো ভালো সংবাদ নয়। তামিল বিদ্রোহীদের হাতে সেখানে মারা গেছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রেমাদাসা, বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ললিত আথুলাথদালি, গামিনি দেশনায়েকে ও ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী। রাজিব গান্ধীর বিরুদ্ধে তামিলদের অবিযোগ ছিল, শ্রীলংকার শাসকদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে তিনি শ্রীলংকার তামিলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৮৭ সালে শ্রীলংকার সঙ্গে ভারতের একটি চুক্তির বিনিময়ে তামিল বিদ্রোহ দমন করতে ভারতীয় সৈন্য তামিল অধ্যুষিত এলাকায় প্রবেশ করেছিল। ফলটি অনেকেই স্মরণ করতে পারবেনÑ ১ হাজার ২০০ ভারতীয় সৈন্য মারা গিয়েছিল সেখানে। বাধ্য হয়ে ভারত ১৯৯০ সালে শ্রীলংকা থেকে তাদের সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিয়েছিল। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৮৭ সালে ভারত-শ্রীলংকা চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন রাজিব গান্ধী ও শ্রীলংকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস জয়াবর্ধনে। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রেমাদাসা এর বিরোধিতা করেছিলেন। ওই বিরোধিতা সামনে রেখেই প্রেমাদাসা ১৯৮৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিজয়ী হন। আজ শ্রীলংকার রাজনীতিতে ওই ‘দৃশ্যপট’ লক্ষণীয়। ভারতীয় প্রভাব সেখানে বাড়ছে। সিরিসেনা ওই ‘ভারতীয় স্বার্থ’ই প্রতিনিধিত্ব করছেন। নির্বাচনের আগে তিনি একাধিকবার ‘চিনবিরোধী’ বক্তব্য রেখেছেন। এমনকি নয়া প্রধানমন্ত্রীও ঘোষণা দিয়েছেন, চিনের সঙ্গে সাক্ষরিত ১ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের চুক্তি তিনি বাতিল করবেন। এখন দেখা যাক সত্যি সত্যিই তিনি তা করেন কিনা? ভারতের মোদি সরকারের সঙ্গে এখন অনেক ব্যবসায়ী শ্রেণি ভিড় করেছে। ১১-১৩ জানুয়ারি গুজরাটে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘ভাইব্রান্ট গুজরাট’ সম্মেলনে। ওই সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি যোগ দিয়েছিলেন। ফলে মাদি সরকারকে যারা ক্ষমতায় বসিয়েছে, ওই ব্যবসায়ী শ্রেণি (যেমন আদালি গ্রুপ) চাইবে মোদি সরকারকে ব্যবহার করে শ্রীলংকার বাইরে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করতে। শ্রীলংকায় দ্বন্দ্বটি এভাবেই তৈরি হতে পারে। ভুলে গেলে চলবে না, শ্রীলংকার ব্যাপারে চিনের শুধু যে ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে, তা নয়। বরং চিন যে ‘ম্যারিটাইম সিল্ক রুট’-এর কথা বলেছে, শ্রীলংকা এর অংশ। বাংলাদেশের কক্সবাজারের কাছে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করতে চেয়েছিল চিন। তা এখন আর হচ্ছে না।এটি স্বীকার করতেই হবে, রাজাপক্ষের কিছু ভুলের কারণে শ্রীলংকার জনগণ তার ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। শ্রীলংকার স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত তিনি অনেক সিদ্ধান্ত নিলেও তা তার নিজের ও দলের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারেননি। ভারতীয় নেতারা তার ওপর শতভাগ সন্তুষ্ট ছিলেন না। শ্রীলংকায় চিনের অর্থের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটলেও ভারতকে ‘উপেক্ষা’ করা এবং তামিল মুসলমানদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়া তার পতনকে ত্বরান্বিত করে। উপরন্তু ছিল পারিবারিক দুর্নীতি ও ক্ষমতা করায়ত্ত করার প্রচেষ্টা। এটি একটি ‘শিক্ষা’। নিশ্চয়ই সিরিসেনা এটি থেকে শিখবেন। আগামী তিন মাসের মধ্যে সেখানে সংসদ নির্বাচন। তিনি চাচ্ছেন, শ্রীলংকায় একটি সংসদীয় সরকার পদ্ধতি। চাচ্ছেন পদত্যাগকারী প্রধান বিচারপতিকে ফিরিয়ে আনতে। কাজগুলো খুব সহজ নয়। তার ঐকমত্যের সরকার এখন কতটুকু কাজ করে, সেটিই দেখার বিষয়। Daily Amader Somoy 19.1.15

কতদূর যেতে পারবেন সিরিসেনা?

শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে মিথ্রিপাল সিরিসেনার বিজয়ের পর একটি প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছে- তিনি কতদূর যেতে পারবেন? কতগুলো সিদ্ধান্তের কথা তিনি নির্বাচনের আগে ও পরে জানিয়েছেন। এগুলোর সব কি তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন? শ্রীলংকার মানুষ একটি পরিবর্তন চেয়েছে। আর সেই পরিবর্তনটি সম্পন্ন হয়েছে। ছ’বছরের জন্য তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু যেতে হবে অনেক দূর। যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের কথা তিনি জানিয়েছেন, তা শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এক. তার এক ঘনিষ্ঠ সহচর জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা আগামী মাসে নয়াদিল্লি সফর করবেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এবং শ্রীলংকার বৈদেশিক নীতির সুস্পষ্ট পরিবর্তনের ইঙ্গিত। কারণ সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন। এমনকি তার শাসনামলে এ অঞ্চলে চীন-পাকিস্তান-শ্রীলংকা একটি অক্ষ তৈরি হয়েছিল। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, চীন শ্রীলংকার উন্নয়নে একটি বড় অবদান রেখেছে। রাজাপাকসের নিজস্ব এলাকা হচ্ছে হামবানতোতা। একসময় এ অঞ্চল ছিল গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ও অনুন্নত। রাজাপাকসে চীনের সহায়তায় এ অঞ্চলে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছেন। একটি আন্তর্জাতিক মানের ক্রিকেট স্টেডিয়াম তৈরি করে দিয়েছে চীন। এখন সিরিসেনা চীনের ওপর এ নির্ভরতা কমিয়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর উদ্যোগ নেবেন। তবে এটাও সত্য, শ্রীলংকার মানুষ কিছুটা স্বাধীনচেতা। ভারতীয় ‘আধিপত্যকে’ তারা কখনও স্বীকার করে নেয়নি। তামিল বিদ্রোহ ঠেকাতে ১৯৮৭ সালে ভারতীয় সৈন্য জাফনায় প্রবেশ করেছিল। ওই ‘যুদ্ধে’ প্রায় ১২শ’ ভারতীয় সৈন্য প্রাণ হারায়। ফলে ১৯৯০ সালে ভারত তার সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয়ত, একটি ঐকমত্যের সরকার গঠন করার কথা তিনি বলেছেন। কিন্তু সংসদে রাজাপাকসের সমর্থকের সংখ্যা বেশি। সিরিসেনা শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির সবার সমর্থন পাবেন, এটা মনে করার কারণ নেই। তৃতীয়ত, তিনি প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকারব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন এবং সংবিধানের ১৮তম সংশোধনী পুনঃস্থাপনের (রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকারব্যবস্থা বাতিল) কথাও বলেছেন। এ ক্ষেত্রে সংসদে দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থন তিনি নাও পেতে পারেন। চতুর্থত, শিরানি বন্দরনায়েকে অর্থাৎ সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তিনি ফিরিয়ে আনার কথাও বলেছেন। এটিও খুব সহজ হবে না। স্বাধীন বিচার বিভাগ, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের কাজটিও খুব সহজ হবে না। তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, শ্রীলংকায় গণতন্ত্রেরই বিজয় হয়েছে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন রাষ্ট্রপতি মাহিন্দ রাজাপাকসে হেরে গেছেন। উন্নয়নশীল দেশের গণতন্ত্রের জন্য এটা একটা বড় শিক্ষা, যেখানে ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট জনরায়ে হেরে যান। হেরে যাওয়ার আগেই তিনি পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিলেন এবং কোনো রকম আপত্তির কথা তার সমর্থকদের মুখ থেকে শোনা যায়নি। কোনো ধরনের ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ কথাও আমরা শুনিনি। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়েই ক্ষমতায় যাওয়া যায়। আবার জনসমর্থন না থাকলে ‘জোর করে’ সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার করেও ক্ষমতায় থাকা যায় না। রাজাপাকসের বিদায় এটাই প্রমাণ করল আবার। অথচ রাজাপাকসে একসময় যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিলেন। শ্রীলংকাকে ভেঙে যাওয়ার হাত থেকে তিনি রক্ষা করেছেন। ২০০৯ সালে তামিল বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তিনি ‘বিজয়ী’ হয়েছেন। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকার সেনাবাহিনীর বিজয় নানা বিতর্কের জন্ম দিলেও এটা প্রমাণিত হয়েছিল যে, রাজাপাকসে যদি ওই সময় টাইগারদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা না করতেন, তাহলে সম্ভবত শ্রীলংকা তার রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারত না। এখানে বলা ভালো, রাজাপাকসে ২০০৫ সালে ক্ষমতাসীন হয়ে সেখানে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার একটি প্লাস পয়েন্ট ছিল, তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। ২৬ বছর ধরে চলা তামিল বিদ্রোহ দমন করে তিনি সিংহলি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ছিল পারিবারিকীকরণের। তার দু’ভাই, ছেলে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে তারা প্রভাব খাটাতেন। এ পারিবারিকীকরণ শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। তামিল টাইগারদের পরাজিত করার মাধ্যমে অর্জিত জনপ্রিয়তাকে ব্যবহার করে ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়ে তিনি বিজয়ী হয়েছিলেন। তার দ্বিতীয় টার্ম শেষ হওয়ার কথা আরও দু’বছর পর। তৃতীয় টার্মে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারতেন না- এ ক্ষেত্রে সংবিধান অন্যতম বাধা ছিল। কিন্তু অত্যন্ত উচ্চাকাক্সক্ষী রাজাপাকসে সংবিধানে পরিবর্তন এনে নিজের জন্য তৃতীয়বার প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ প্রশস্ত করেন। তার ধারণা ছিল, তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো কোনো উপযুক্ত প্রার্থী খুঁজে পাবে না বিরোধী দল। কিন্তু তার সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মিথ্রিপাল সিরিসেনা যে খোদ তাকেই চ্যালেঞ্জ করে বসবেন, এটা তিনি বুঝতে পারেননি। একসময় সিরিসেনা তার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এমনকি ক্ষমতাসীন শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টির তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। কিন্তু সিরিসেনা অক্টোবরে (২০১৪) মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। এক পর্যায়ে রাজাপাকসেকে তিনি চ্যালেঞ্জ করতে শুরু করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি কোনো প্রার্থী দেয়নি। বরং তারা একত্রিত হয়ে সিরিসেনাকে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে এবং নির্বাচনে তাকে সর্বাত্মক সমর্থন দেয়। নির্বাচনের আগে সিরিসেনার সঙ্গে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির যে সমঝোতা হয়েছিল, তার আলোকেই বিরোধীদলীয় নেতা রনিল বিক্রমাসিংহকে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। বিক্রমাসিংহ ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথও নিয়েছেন। শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সিরিসেনার বিজয় এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ জয়ের সুবাদে এত জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও রাজাপাকসে হেরে গেলেন কেন, এ প্রশ্ন এখন অনেকেই করেন। রাজাপাকসে জনগণের পালস বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ক্ষমতা মানুষকে যে ‘অন্ধ’ করে দেয়, রাজাপাকসে ছিলেন তার বড় প্রমাণ। তিনি শ্রীলংকার মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে এক ধরনের একনায়কতন্ত্র চালু করেছিলেন। তার নিজের কথাই ছিল আইন। প্রায় ৯৮ ভাগ শিক্ষিতের দেশ শ্রীলংকার মানুষ এটা গ্রহণ করে নেয়নি। তার এই একনায়কতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে মানুষ তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, যা শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ সমর্থন করেনি। তিনি পরিবারতন্ত্র চালু করেছিলেন, এটাও মানুষ ভালোভাবে নেয়নি। যদিও শ্রীলংকায় এক ধরনের পরিবারতন্ত্র চালু আছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা কিংবা তার মা প্রয়াত শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে পরিবারতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব করে গেছেন। বন্দরনায়েকে ছিলেন স্বাধীনতা পরবর্তী (১৯৪৮ সালে দেশটি স্বাধীন হয়) শ্রীলংকার প্রধানমন্ত্রী। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী শ্রীমাভো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে মেয়ে চন্দ্রিকাও প্রেসিডেন্ট হন। মেয়ে চন্দ্রিকা যখন প্রেসিডেন্ট, তখন মা শ্রীমাভো দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সিরিসেনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিযুক্তি সবাইকে অবাক করেছে। তাকে ঘিরে একটি বড় ধরনের ‘ঐক্য’ গড়ে উঠেছে। আমাদের মতো দেশ হলে বিরোধী দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টি (ইউএনপি) নিজেদের প্রার্থী দিত। কিন্তু দলটি তা করেনি। বরং সিরিসেনাকে সমর্থন দিয়ে শ্রীলংকায় একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। তাই অনেক প্রশ্ন এখন সামনে চলে এসেছে। এক. যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা আদৌ থাকবে কি-না? সিরিসেনা ইতিমধ্যেই ইউএনপি নেতা রনিল বিক্রমাসিংহকে প্রধানমন্ত্রী করলেও প্রশ্ন হচ্ছে, সিরিসেনার নিজের দল শ্রীলংকা ফ্রিডম পার্টি এই ঐকমত্যের প্রক্রিয়াকে সমর্থন করবে কি-না? সাধারণত যিনি হেরে যান, তিনি আর রাজনীতিতে তেমন একটা সক্রিয় থাকেন না (যেমন চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গা)। এখন দেখার বিষয়, রাজাপাকসে আদৌ শ্রীলংকার রাজনীতিতে সক্রিয় থাকেন কি-না। তবে শ্রীলংকার ইতিহাস বলে, ফ্রিডম পার্টিকে এখন নতুন একজন নেতা খুঁজতে হবে। দ্বিতীয়ত, তামিল টাইগারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে রাজাপাকসে শ্রীলংকার অখণ্ডতা রক্ষা করেছেন সত্য, কিন্তু দীর্ঘ ৫ বছর পার হয়ে যাওয়ার পরও তিনি শ্রীলংকার তামিলদের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। এটা ছিল তার বড় ব্যর্থতা। সাধারণ তামিলরা তাকে বরাবর ঘৃণা করে আসছে। এবং নির্বাচনে তারা এককভাবে সিরিসেনাকে ভোট দিয়েছে। এখন সিরিসেনার প্রধান কাজ হবে তামিলদের আস্থা অর্জন করা। সেই কাজটি করা খুব সহজ হবে বলে মনে হয় না। সিংহলিদের একটা অংশ এখনও তামিলবিরোধী। শ্রীলংকার জাতিগত দ্বন্দ্বের ইতিহাসও বেশ পুরনো। ৬৫ হাজার ৬০৯ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট এ দেশটির লোকসংখ্যা মাত্র ২ কোটি ৩ লাখ। ভারত মহাসাগর ঘেঁষা এ দেশটি বিভিন্ন সময়ে পর্তুগাল, হল্যান্ড ও ব্রিটেনের কলোনি ছিল। ১৫০৫ সালে পর্তুগিজরা দেশটির পশ্চিমে ও দক্ষিণে বসতি স্থাপন করে। পনেরো শতকের মাঝামাঝি ডাচরা (হল্যান্ড) দেশটি দখল করে নেয়। ১৮০২ সালে শ্রীলংকা পৃথক ব্রিটিশ কলোনিতে পরিণত হয়। স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৪৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দেশটির পরিচয় ছিল সিংহল হিসেবে। তৃতীয়ত, তামিলদের আস্থা অর্জন করার কাজটি হবে কঠিন। জনগোষ্ঠীর ১১ দশমিক ২ ভাগ তামিল। তামিল টাইগার নেতা ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণের ‘হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনা সাধারণ তামিলরা মেনে নিতে পারেননি আজও। প্রবাসী তামিলদের মাঝে স্বাধীনতার চেতনা এখনও আছে। শ্রীলংকার মূলধারার রাজনীতিতে এদের নিয়ে আসার কাজটি হবে কঠিন। তামিল অধ্যুষিত দুটি প্রদেশ (মোট প্রদেশ ৯টি) পূর্বাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলকে ২০০৬ সালে একত্রিত করা হয়। কিন্তু প্রাদেশিক নির্বাচন ও প্রাদেশিক সরকার গঠিত হলেও কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাব বেশি। সত্যিকার অর্থে প্রাদেশিক সরকার কোনো স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে না। ফলে তামিলরা এখনও নিজেদের বঞ্চিত মনে করে। সিরিসেনাকে এখন প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বলা ভালো, ইংরেজরা শ্রীলংকায় ব্রিটিশ শাসন কায়েম করার আগে থেকেই সেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী তামিলরা বসতি স্থাপন করে। তামিলরা আসে মূলত ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য থেকে। ব্রিটিশরা তাদের এ অঞ্চলে চায়ের বাগান ও রাবার বাগানে কাজ করার জন্য নিয়ে এসেছিল। তবে দীর্ঘদিন তাদের শ্রীলংকার নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল। এ বৈষম্যমূলক আচরণের ফলেই তামিলরা ১৯৮৪-৮৫ সাল থেকেই স্বাধীনতা আন্দোলন শুরু করে। তবে তামিল টাইগারদের (তারা প্রতীক হিসেবে বাঘের মুখ ব্যবহার করত বলে তামিল টাইগার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল) কথা প্রথম জানা যায় ১৯৭৫ সালে যখন জাফনার মেয়র দুরায়াপ্পাকে টাইগাররা হত্যা করে। চতুর্থত, শ্রীলংকার জনসংখ্যার ১০ ভাগ হচ্ছে মুসলমান (জনসংখ্যার ৭৪ দশমিক ৮৮ ভাগ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী)। সাম্প্রতিককালে সেখানে মুসলমান-বৌদ্ধ দাঙ্গার খবর আমরা জানি। বাংলাদেশ দূতাবাস আক্রান্ত হওয়ার খবরও রয়েছে। একটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জঙ্গিগোষ্ঠী ‘বদু পালা সেনা’র অপতৎপরতা এবং শ্রীলংকাকে একটি পরিপূর্ণ বৌদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত করার ঘোষণার খবরও আমরা জানি। রাজাপাকসে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এখন দেখার বিষয় সিরিসেনা এদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেন। পঞ্চমত, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রীলংকায় মানবাধিকার লংঘনের ঘটনায় সোচ্চার। জাতিসংঘ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে এবং শ্রীলংকার বেশ কিছু সামরিক কর্মকর্তা ও সরকারি কর্মকর্তাকে বিচারের মুখোমুখি করার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন শ্রীলংকাকে দেয়া জিএসপি সুবিধা বাতিল করে দিয়েছে। এখন সিরিসেনাকে বহির্বিশ্বের, বিশেষ করে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের আস্থা অর্জন করতে হবে। কাজটি খুব সহজ হবে না নতুন প্রেসিডেন্টের জন্য। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার জন্য একটা খারাপ খবর হল সংসদের স্পিকার হচ্ছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসের ভাই চামাল রাজাপাকসে। ২২৫ আসনবিশিষ্ট সংসদে রাজাপাকসের সমর্থকরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, তার দলের সদস্য সংখ্যা ১৪৪। আর প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহের (যিনি এর আগেও দু’বার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং একবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রাজাপাকসের কাছে হেরে যান) দলের সদস্য সংখ্যা মাত্র ৬০। সমস্যাটা এখানেই তৈরি হবে। বিক্রমাসিংহ সংসদের আস্থা নাও পেতে পারেন। ২০১৬ সালে সেখানে পরবর্তী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। এটা সত্য, সিরিসেনা একটি ভালো নির্বাচন দেয়ার জন্য রাজাপাকসেকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তবে এ প্রশ্নও উঠেছিল- নির্বাচনে হেরে যাওয়ার আশংকায় রাজাপাকসে সেনা নামাতে চেয়েছিলেন। তারপরও বাস্তবতা হচ্ছে, শ্রীলংকায় শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে। একটি ভালো নির্বাচন সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন স্থিতিশীলতা ও জাতীয় ঐক্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবেই নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সিরিসেনার। Daily Jugantor ১৭ জানুয়ারি, ২০১৫

সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না

সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। এখনো অন্ধকার সেখানে। গেল বছরের শেষ দিনে বেগম জিয়ার সংবাদ সম্মেলন ও এর প্রতি-উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের পাল্টা সংবাদ সম্মেলন আবারও প্রমাণ করল রাজনীতিতে যে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকা দরকার, তা বড় দল দুটোর মধ্যে নেই। তাই চলতি ২০১৫ সাল যে ক্রমেই সংঘাত-বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, তার আভাস আরো স্পষ্ট, আরো ক্লিয়ার। একটা নির্বাচন হয়ে গেছে গেল বছরের ৫ জানুয়ারি। সেই নির্বাচনে মানুষ ভোট দিক বা না দিক, বহির্বিশ্বে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, একটি ‘নতুন রাজনীতিক সংস্কৃতি’ আমরা এ দেশে জন্ম দিয়েছি। একটি ‘ঐকমত্যের সরকার’ গঠিত হয়েছে, যে সরকারের অংশীদার একটি দল আবার সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাও পালন করছে! বিগত মহাজোট সরকারের আমলেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা বাতিল করা হয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারের সময় সংশোধিত সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে যেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’, এই অনুচ্ছেদটিও উপেক্ষিত থেকেছে। কেননা ১৫৪টি আসনে ‘জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হয়নি। তাই একটি ‘সমঝোতা’ যেখানে প্রত্যাশিত ছিল, সেই ‘সমঝোতার’ সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় শুধুই অন্ধকার!
এটা অনেকেই স্বীকার করেন, একটা ‘সমঝোতা’ প্রয়োজন। কেননা ‘সমঝোতা’ না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে আশা করছি- এ লক্ষ্যেও আমরা পৌঁছতে পারব না। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে আমরা দেশটিকে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের এই প্রত্যাশা পূরণ হবে না। কেননা ‘সমঝোতা’ না হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। রপ্তানি খাত থাকবে ঝুঁকির মুখে। ফলে লক্ষ্য অর্জিত হবে না। ‘সমঝোতা’ না হলে অরাজনৈতিক কর্মকা- বাড়বে। সুশাসন ব্যাহত হবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ‘সমঝোতা’ যদি না হয়, তাহলে কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে না। আর দায়বদ্ধতা সৃষ্টি না হলে বাড়বে দুর্নীতি। বাড়বে অসহিষ্ণুতা। সরকার থাকবে বটে। কিন্তু এক ধরনের অস্থিরতা সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেবে। এতে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চারও ব্যাঘাত ঘটবে। সংসদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের মূল চালিকাশক্তি। গণতন্ত্র আমাদের এটাই শেখায়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন ও ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ সেই নির্বাচন, একটি জাতীয় সংসদ, জবাবদিহিতা এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক। কিন্তু অতীতে যা ঘটেনি, তা ঘটল ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন। সংবিধানের ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচন হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু রাজনীতিতে যে ‘বাস্তববাদী নীতি’, তা এতে প্রতিফলিত হয়নি। অর্থাৎ ‘বাস্তবতা’ এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। আর বাস্তবতা হচ্ছে ‘বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ’ প্রয়োজন ছিল। বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়া সঠিক ছিল, নাকি ভুল ছিল- এটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। বিএনপির নির্বাচন প্রশ্নে ‘অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয় সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি! কারণ ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ ও ২০০৮ সালে নবম সংসদ- প্রতিটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে গড়ে ৩৩ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করেছে (১৯৯১ সালে ৩০.৮১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৩৩.৬১ শতাংশ, ২০০১ সালে ৪০.৯৭ শতাংশ ও ২০০৮ সালে ৩৩.২০ শতাংশ)। এখন তাদের বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যে যুক্তিতে বিএনপি তথা ২০ দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেটা তারা বারবার স্পষ্ট করেছে। এমনকি ৩১ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনেও বেগম জিয়া বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তাঁর সাত দফার প্রথম দফাই হচ্ছে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সংবিধানে এর কোনো সুযোগ নেই। সে জন্যই বেগম জিয়া দাবি করেছেন সংবিধান সংশোধনের। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষও বোধকরি এটা উপলব্ধি করেন যে বর্তমান সরকার ‘দ্বিতীয়বার’ আর সংবিধান সংশোধন করবে না, যদি না তাদের বাধ্য করা হয়! প্রশ্নটা এখানেই যে বিএনপি তথা ২০ দল সরকারকে বাধ্য করাতে পারবে কি না?
সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না
সাদা চোখে আমি যা দেখি তা হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী দুই মতের সহাবস্থান হচ্ছে না। আর সহাবস্থান না হলে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কোনো পক্ষই তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। এখানে মধ্যস্থতা করারও সুযোগ নেই। আমরা অতীতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। ফলাফল শূন্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র দপ্তর একাধিকবার ‘সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন’-এর কথা বলে আসছে। এখানেও কোনো জট খোলেনি। তাই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে অন্ধকার, তা রয়েই গেছে।
আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতা। আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। দুই পক্ষই যে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে, তা দেশ ও জাতির জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। গেল বছরের শেষের দিকে বিএনপি গাজীপুরে সভা করতে পারেনি। কেননা সেখানে সব দলের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। এর আগে ছাত্রলীগ তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপির জনসভা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। ফলে প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারি অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। এখানে মুখ্য হওয়া উচিত ছিল রাজনীতি। ব্যক্তি কখনো মুখ্য হওয়া উচিত নয়। বিএনপিকে গাজীপুরে জনসভা করার অনুমতি দিলে তাতে সরকারেরই লাভ হতো। উচিত ছিল ছাত্রলীগেরও জনসভা করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করা। এতে করে সাধারণ মানুষের পক্ষে সুবিধা হতো একটি সিদ্ধান্তে আসার। ৫ জানুয়ারি বিএনপি জনসভার অনুমতি পায়নি। এখানেও সরকার আরো উদার হতে পারত। কেননা সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিএনপি একটি বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন। দলকে সমাবেশ করতে দিলে ক্ষতির কিছু ছিল না। ডিএমপি তো এর আগেও অনুমতি দিয়েছে। উপরন্তু ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টিও সমাবেশ করেছে। সমাবেশ করতে না দিলে বিষয়টি বিএনপি তাদের স্বার্থেই তা ব্যবহার করবে।
বেগম জিয়া সাত দফা উপস্থাপন করেছেন। এই সাত দফায় নতুনত্ব কিছু নেই। এ কথাগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন। তবে এই সাত দফার মধ্যে ১ নম্বর দফাই প্রধান। ১ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সমস্যা এখানেই। সরকার এ ক্ষেত্রে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান তাদের পক্ষে। বিএনপি সংবিধান সংশোধনের কথা বলছে। খুব সংগত কারণেই সরকার এটি করবে না। আর বিএনপি সরকারকে এ কাজটি করতে ‘বাধ্য’ করাতে পারবে এটিও বাস্তবসম্মত নয়। তবে বিএনপি যে সংলাপের কথা বলছে, সেই সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান খুঁজে বের করা অমূলক কিছু নয়। যদিও অতীতে সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিন্তু তাই বলে এখন হবে না- এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে কিছুটা ‘ছাড়’ দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ‘বিচার মানি। কিন্তু তালগাছ আমার’- এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।
সরকার যেহেতু একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এবং দাবিগুলো তার কাছেই পেশ করা, সেহেতু ‘সংলাপ’-এর ব্যাপারে সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার যদি একটু ‘নমনীয়’ হয়, তাহলে একটি সমাধান বের করা সম্ভব। মধ্যবর্তী নির্বাচন গণতন্ত্রসম্মত। সে ক্ষেত্রে ২০১৯ নয়, এর আগেও নির্বাচন হতে পারে। আর দুদলের প্রস্তাবের আলোকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনও সম্ভব। প্রয়োজনে ‘ভারতীয় মডেল’ অনুসরণ করে নির্বাচনের সময়ে সব ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনারের কাছে ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা নিজেও থেকে যেতে পারেন। বিএনপির প্রতিনিধিদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেও একটা সমাধান খুঁজে বের করা যায়। আর এখানেই প্রশ্নটি হচ্ছে আন্তরিকতার। সরকার বা বিএনপি কতটুকু আন্তরিক হবে- প্রশ্ন সেখানেই।
সংকটের মাত্রা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাত দফা প্রত্যাখ্যান ও আরো একবার মধ্যবর্তী নির্বাচন নাকচ করার অর্থ হচ্ছে, সংকটের মাত্রা আরো বাড়তে দেওয়া। ১ জানুয়ারি হরতাল হয়েছে। আমরা আবারও ‘হরতাল-অবরোধের সংস্কৃতি’তে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু অতীত ইতিহাস বলে হরতাল ডেকে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। আমরা আশাবাদী হতে চাই। চাই না সংঘাতমুখর রাজনীতি আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিক। আমরা চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। জনগণের জন্য যে রাজনীতি, সেই রাজনীতিই ফিরে আসুক। ২০১৫ সালকে নিয়ে আশাবাদী হতে চাই আমরা। কা:ক:
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
স্থানীয় সময় : ০৫৪২ ঘণ্টা , ১৪ জানুয়ারি ২০১৫

শিক্ষার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন

শিক্ষার মান নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন উঠেছে। উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, এমনকি পিএসসি, জেএসসি কিংবা জেডিসি পরীক্ষায় ‘মেধা বিস্ফোরণ’-এর যে ঘটনা একের পর এক ঘটে চলেছে, তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে। পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে নিজ মেয়ের রেজাল্ট সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারেন! ফাহমিদুল হককে আমরা মোটামুটি সবাই চিনি। দলবাজ শিক্ষক তিনি নন। গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তিনি সহযোগী অধ্যাপক। তার মেয়ে তাহিয়া এবার জেএসসি পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পেয়েছে। মেয়ে দুঃখ পাবে জেনেও তিনি ফেসবুকে লিখেছেন দেশজুড়ে যে গণ ‘এ প্লাস’ দেয়া হয়েছে, তার শিকার তাহিয়া। তার সহজ সরল স্বীকারোক্তি তাহিয়া এ প্লাসের যোগ্য নয়! ফাহমিদুলকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি ‘ছোট করব না। কিন্তু তার সাহসী বক্তব্য আমার মতো অনেককে আরও সাহসী করবে। এই গণ এ প্লাসের কাহিনি শুরু হয়েছে আরও আগে থেকে। গণহারে এইচএসসি আর এসএসসিতে এ প্লাস দেওয়া হচ্ছে। অথচ এই এ প্লাস পাওয়া পরীক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় (শতকরা ৮০ ভাগ) ন্যূনতম পাস নম্বর পেতে ব্যর্থ হয়েছে। অথচ আমাদের শিক্ষামন্ত্রী এসব নিয়ে গর্ব করেন। মাননীয় মন্ত্রী, শিক্ষার মান বাড়ছে বলে আপনি যখন গর্ব করেন, তখন আপনাকে আমি সমর্থন করতে পারি না। বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষার মানের প্রচ- অবনতি হয়েছে। জিপিএ ৫ এখন গলার কাঁটা। এই জিপিএ ৫ এখন হাসির ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আপনার সরকার দেশে ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা নিয়েও আপনার গর্ব হতে পারে। কিন্তু এর মাঝেও আমি কোনো কর্তৃত্ব দেখি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানোর মধ্য দিয়ে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো যাবে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে এক ধরনের বৈষম্য তৈরি করে ফেলেছি ইতোমধ্যে। রাজনৈতিক বিবেচনায় শত শত শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এক বিষয়ের শিক্ষক, অন্য বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হয়নি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি তরুণ শিক্ষকদের দায়বদ্ধতাও আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। তরুণ প্রজন্ম শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে বেছে নেয়নি। তাই উচ্চশিক্ষা ও এর মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। ভালো শিক্ষক না হলে ভালো ছাত্র তৈরি হয় না, মন্ত্রী হিসেবে তো এটা আপনার জানার কথা? উচ্চশিক্ষা নিয়ে মাননীয় মন্ত্রীর কাছে পূর্ণ চিত্র আছে কি না সন্দেহ। একদিকে ‘ভালো ছাত্ররা’ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় যেমনি শিক্ষকতায় আসতে পারছে না, অন্যদিকে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭-তে উন্নীত করায়, এখানেও তৈরি হয়েছে বৈষম্য। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হচ্ছে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগানদাতা। সেই মঞ্জুরি কমিশনই যখন অবসরের বয়সসীমা ৬৭ নিয়ে আপত্তি তুলেছে, তখন কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এটা বাস্তবায়ন করে কীভাবে? এখানে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। নেওয়া হচ্ছে দলীয় আনুগত্য আর রাজনীতির বিষয়টি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা। উচ্চশিক্ষা নিয়ে আরও কিছু কথা বলা দরকার। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন ঢালাওভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করেছে। কিন্তু কারা করছে পিএইচডি? পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, সিনিয়র জেনারেল আর সচিবরা এখন পিএইচডি করছেন। যে কেউ তার যদি মেধা থাকে, তিনি পিএইচডি করতেই পারেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই পিএইচডি একটি গবেষণা। গবেষককে ছুটি নিতে হয়। লাইব্রেরিতে যেতে হয়। ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হয়। কোর্সওয়ার্ক করতে হয়। লাইব্রেরিতে না গিয়ে, ফিল্ড ওয়ার্ক না করে, ‘ফুল টাইম’ অফিস করে কি গবেষণা হয়? এটি দেখার কেউ নেই। মাননীয় মন্ত্রীর কাছেও সঠিক তথ্যটি নেই। ফলে উচ্চশিক্ষার নামে আমরা শুধু সার্টিফিকেটধারীদের সংখ্যাই বাড়াচ্ছি না, এখন আবার পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাও বাড়াচ্ছি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীও রয়েছে। এরা আবার স্বনামে কার্ড ছাপিয়ে তা বিলিও করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এটা দেখে না। মাননীয় মন্ত্রীর সময় নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা বয়সের ভারে কান্ত, অবসন্ন! কাজটি তাহলে কে করবে? অপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। কোন কোন সেক্টরে আমাদের কত গ্রাজুয়েট দরকার, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। ফলে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিবিএর মতো বিষয়ে ‘সার্টিফিকেট’ নিচ্ছে এবং তারা এখন বেসরকারি খাতে ‘ভদ্র কেরানি’তে পরিণত হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। সেটিও আমরা করছি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ঘরে ঘরে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী তৈরি করে আর যাই হোক আমরা শিক্ষার মান বাড়াতে পারিনি। কোটা ব্যবস্থা নিয়েও চিন্তা করার সময় এসেছে। যেখানে জিপিএ ৫ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারছে না, সেখানে কোটার কারণে ভর্তি হচ্ছে শত শত শিক্ষার্থী। অযোগ্য এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে জাতীয় জীবনে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বরং এরা জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আবার পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এদিকেও দৃষ্টি দেওয়া দরকার। মাননীয় মন্ত্রীর সময় কই? জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শতকরা ৮০ জন যখন ন্যূনতম পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হয়, তখন সত্যিকার অর্থে বিষয়টা আমাদের ভাবায়। পাসের হার বাড়িয়ে দেখানোর মাঝে কোনো কর্তৃত্ব নেই। এই সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল যে, উত্তরপত্রগুলো সাধারণভাবে মূল্যায়ন করা ও নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া। এখন অভিভাবকরা বুঝতে পারবেন জিপিএ ৫ পাওয়া তার সন্তানটি তার জন্য বোঝা হয়ে গেল। এক ধরনের হতাশা ওইসব শিক্ষার্থীর মধ্যে এসে যাবে যখন জিপিএ ৫ নিয়েও তারা কোথাও ভর্তি হতে পারবে না। এসব বিষয় নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিন্তাভাবনা করা উচিত। আমার ধারণা তাকে যারা পরামর্শ দেন, সঠিক পরামর্শটি তারা দেন না। সীমিত ‘লাভ’ বা সুবিধা নিয়ে আর যাই হোক সমাজে বড় পরিবর্তন আনা যায় না। মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন। গত ৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসসি), জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার রেজাল্ট। পরিসংখ্যান বলছে, পিএসসিতে পাসের হার শতকরা ৯৭.৯২ ভাগ। জেএসসিতে পাসের হার ৮৯.৮৫ ভাগ, আর জেডিসির পাসের হার ৯৩.৫০ ভাগ। পিএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়েছে ২,২৪,৪১১ জন, জেএসসিতে ১,৩৬,৯৪৫ জন আর জেডিসিতে ১৯,২৯০ জন। আমি কোমলমতি ছোট শিশুদের মেধাকে ‘ছোট’ করতে চাই না। কিন্তু আমরা কী এই বয়সেই তাদের প্রত্যাশাকে আরও বাড়িয়ে দিলাম না? একটি শিশু কষ্ট করে শিখবে। প্রতিযোগিতা থাকবে ওর ভেতর। আর ‘ভালো করার’ একটা জিদ তৈরি হবে ছোটবেলা থেকেই। তা না করে তার জিপিএ ৫ প্রাপ্তি তাকে ‘ভালো করে পড়াশোনা’ করার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করবে। ভবিষ্যতে সে যখন এই জিপিএ ৫ নিয়ে কোনো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না, তখন সে হতাশায় পড়ে যাবে। এক সময় অসৎ পথে পা বাড়াবে! আমাদের দেশের শিশুরা অনেক মেধাবী। তাহিয়ার মতো মেয়েরা আমাদের ভবিষ্যৎ। ওদের নিজেদের মতো ‘বড়’ হতে দেওয়াই উচিত। তথাকথিত জিপিএ ৫ তাহিয়াদের ‘বড়’ করবে না। ওদের জীবনটা ওদেরই গড়তে দেওয়া উচিত। ওরা শুধু সীমিত ‘প্রশ্ন’ পড়ে, মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৫ নিয়ে জীবনকে ‘বড়’ করে গড়ে তুলতে পারবে না। ওদের অনেক কিছু পড়াশোনা করা উচিত। বিজ্ঞান, সাহিত্য, বিশ্ব, সবকিছু। জ্ঞানের রয়েছে এক বিশাল ভা-ার। এর মাঝেই ওরা খুঁজে পাবে ওদের ‘পৃথিবী’কে। আমি জানি এই বয়সে শিশুরা অনেক মেধাবী হয়। অনেক কিছু জানতে চায়। শিখতে চায়। কিন্তু তাদের শেখাটাকে আমরা ‘সীমিত’ করে দিচ্ছি। অযাচিতভাবে জিপিএ ৫ দিয়ে ওদের প্রত্যাশাকে আমরা বাড়িয়ে দিয়েছি। এটা ভালো নয়। এটা করে আমাদের নীতিনির্ধারকরা অভিভাবকদের কাছে বাহবা নিতে চেয়েছেন। হয়তো কোনো কোনো অভিভাবক এতে খুশি হবেন। কিন্তু ফাহমিদুল হকের মতো অভিভাবকও আছেন, যারা খুশি হবেন না। একজন শিক্ষক যে কাজটি করেন, তিনি সে কাজটিই করেছেন। তারপরও ‘ছোট্ট’ তাহিয়ার জন্য আমার অনেক ভালোবাসা ও আদর। আমি জানি ‘ও’ অনেক ‘বড়’ হবে, বাবার চেয়েও ‘বড়’Ñ যাতে করে ফাহমিদুল একদিন তার মেয়ের জন্য গর্ব করতে পারেন। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম। Daily Amader Somoy 12.01.15

বরফ আদৌ গলবে কি?

আন্তর্জাতিক সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক অনেকদিন ধরেই আলোচনার একটি বিষয়। কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিত্যাগ করবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র আবারও হাভানায় সরকারের উৎখাতের উদ্যোগ নেবে- এসব প্রশ্ন বারবার মিডিয়া ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের লেখনীতে উঠে এসেছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ধাঁচের সমাজতন্ত্রের পতনের রেশ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল, তখন বলতে গেলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি একরকম নিবদ্ধ ছিল কিউবার দিকে। কারণ কিউবা ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অন্যতম সমর্থক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, কিউবার অর্থনীতির অন্যতম উৎস এবং নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কিউবা টিকে থাকতে পারবে কি-না? একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ‘আগ্রাসনের’ মুখ থেকে কিউবা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি-না, এ প্রশ্নও ছিল। আরও একটি প্রশ্ন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিল- তা হচ্ছে, কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে? কারণ চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পরিবর্তন এসেছে। এ দুটি দেশ এখন আর ধ্র“পদি মার্কসবাদ অনুসরণ করে না। তাই খুব সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ছিল, কিউবা চীন বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করবে কি-না?কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল কিউবার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কিউবার সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। বরং বিপ্লবের পর (১৯৫৯) কিউবা সরকার যখন লাতিন আমেরিকাজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চাইল, চে গুয়েভারা যখন ‘বিপ্লব’ সম্পন্ন করার জন্য কিউবা সরকারের মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করে বলিভিয়ায় গেলেন (সেখানেই তাকে পরে হত্যা করা হয়), তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ভিন্ন একটি বার্তা পৌঁছেছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চায়নি তার ‘প্রভাবাধীন এলাকায়’ অন্য কোনো শক্তি প্রভাব খাটাক। মনরো ডকট্রিনের আদলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে এ এলাকায় তথা লাতিন আমেরিকায় তার পূর্ণ কর্তৃত্ব বজায় রাখতে। কিন্তু কিউবার বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের এই হিসাব-নিকাশে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিউবার বিপ্লবের মাত্র দু’বছরের মাঝে ১৯৬১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টাচালায়। সিআইএ’র অর্থে পরিচালিত এই অভিযান ‘বে অফ পিগস’-এর অভিযান হিসেবে খ্যাত। বলাই বাহুল্য, ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। এর পরের বছরই ১৯৬২ সালের অক্টোবরে ‘কিউবার মিসাইল সংকট’ একটি পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগকরেছিল, কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে, এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ-অবরোধ আরোপ করে, যাতে করে কিউবায় কোনো ধরনের সামরিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করা না যায়। এই নৌ-অবরোধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন এই নৌ-অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের আশংকা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা লড়াই করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্পর্কোন্নয়নের ও বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের কথা বললেও এর বাস্তবায়ন খুব সহজ হবে না। কারণ ওবামাকে এ সংক্রান্ত একটি আইন পাস করাতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে কংগ্রেসে তার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। কংগ্রেসের উভয় কক্ষ এখন নিয়ন্ত্রণ করছে রিপাবলিকানরা। তারা ওবামার ঘোষণায় খুশি নন। আমি একাধিক কংগ্রেস সদস্য তথা সিনেটরের বক্তব্য দেখেছি, যেখানে তারা ওবামার এ-সংক্রান্ত বক্তব্যের সমালোচনা করেছেন। সিনেটর জন ম্যাককেইন ও সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার এই সিদ্ধান্ত বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে সংকুচিত করবে। অন্যদিকে সিনেটর রয় ব্লান্ট মনে করেন, এই ঘোষণার বাস্তবায়ন ক্যাস্ট্রোকে ক্ষমতায় রাখতে সাহায্য করবে। ডেমোক্রেট দলীয় সিনেটর রবার্ট মেনডেজ মনে করেন, প্রেসিডেন্ট ওবামার সিদ্ধান্ত হচ্ছে কিউবার মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা ও স্বৈরশাসনকে স্বীকার করে নেয়া। সিনেটর মেনডেজ নিজে কিউবান আমেরিকান। এতে করে ধারণা করা স্বাভাবিক যে, কিউবার ওপর থেকে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার সংক্রান্ত কোনো আইনকে কংগ্রেস অনুমোদন দেবে না। ফলে ওবামার ঘোষণা শেষ পর্যন্ত ‘একটি ঘোষণা’ হিসেবেই থেকে যেতে পারে।যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা কিউবায় আরও বেশি গণতন্ত্রায়ন, আরও বেশি অর্থনৈতিক উদারিকরণ চান। মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও উন্নতি চান। একই সঙ্গে চান রাজনৈতিক সংস্কার। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে কিউবা সবকিছু ‘উন্মুক্ত’ করে দেবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে গরবাচেভের সংস্কার কর্মসূচির ফলাফল তাদের অজানা নয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে গিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। চীন ও ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে; কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কার কর্মসূচি ‘পেরেস্ত্রয়কা’র বাস্তবায়ন হয়েছে; কিন্তু ‘গ্লাসনস্ত’ কার্যকর হয়নি। রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। কিউবায় কোনোটাই আসেনি। চীন তার সংস্কার কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে এখন ঋণ গ্রহণ করছে। ভিয়েতনামও কম যায়নি। যে ভিয়েতনাম প্রায় ৪০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তারাই আজ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের যে বিশাল চাহিদা, তার একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম সরবরাহ করছে। এখানে রাজনীতি অগ্রাধিকার পায়নি। পেয়েছে বাণিজ্য। এখন কিউবা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাও দেখার বিষয়। তবে হুট করে দু’দেশের সম্পর্কে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে না। কিউবার প্রেসিডেন্ট রাউল ক্যাস্ট্রো ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার এ প্রস্তাবের ভিত্তিতে কিউবার রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিউবার জনগণ এখনও কিউবার সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, বিশ্বায়নের এই যুগে কিউবা ‘একা’ চলতে পারবে না। দেশটিকে ‘দুয়ার’ উন্মুক্ত করে দিতে হবেই। দেশের অর্থনীতির শতকরা ৮০ ভাগ এখনও সরকার নিয়ন্ত্রিত। কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার। বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পর্যটন খাত। এ খাত কিছুটা উন্মুক্ত করা হয়েছে। আরও উন্মুক্ত করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেইন ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিউবায় সীমিত আকারে ‘ডলার বাণিজ্য’ হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিউবান আমেরিকানদের পাঠানো অর্থ এখন নিয়মিত কিউবায় আসছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে একটা সমস্যা রয়েছে। কিউবা প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল অত্যন্ত কম দামে ভেনিজুয়েলা থেকে পেয়ে আসছে। এর বিনিময়ে কিউবা ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক দিচ্ছে। এসব ডাক্তার, নার্স আর শিক্ষক এখন ভেনিজুয়েলার হয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কাজ করছে। পুরো ব্যয়ভার বহন করছে ভেনিজুয়েলা। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট হুগো শাভেজ এই পরিকল্পনা শুরু করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো তা কতদিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, সেই প্রশ্ন ইতিমধ্যে উঠেছে। কারণ ভেনিজুয়েলার রমরমা তেল ব্যবসার দিন শেষ! অর্থনীতি আগের মতো আর শক্তিশালী নয়। রাজধানী কারাকাসে বিশাল বিশাল ভবন খালি পড়ে আছে। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। এরই মাঝে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভেনিজুয়েলার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যখন ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করার উদ্যোগ নেন, তার ঠিক একদিন পর ১০ ডিসেম্বর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। এই নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর মেনডেজ ‘ভেনিজুয়েলার জনগণের বিজয়’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গত এপ্রিল থেকেই সেখানে অসন্তোষ চলছে। যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেশ কয়েকজন ভেনিজুয়েলান ভিআইপির ওপর। সম্পদ আটক থেকে শুরু করে ভ্রমণের ওপর নিষেধাজ্ঞাও রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, ভেনিজুয়েলার মানবাধিকার পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এটা সত্য, হুগো শাভেজের মৃত্যুর পর ভেনিজুয়েলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়; কিন্তু তার চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে কলম্বিয়া ও মেক্সিকোতে। মেক্সিকোর ৪৩ জন স্কুল শিক্ষার্থীকে অপহরণ করে হত্যা করা হয়। কিন্তু সেখানে কোনো বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি। ভেনিজুয়েলার বিষয়টি যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, তা কাউকে বলে দিতে হয় না। এখন খুব সঙ্গত কারণেই ভেনিজুয়েলার ওপর মার্কিন ‘চাপ’ যদি বাড়ে, তাহলে কিউবাকে দেয়া তাদের আর্থিক সহযোগিতা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে তা কিউবার অর্থনীতিকে আঘাত করবে।কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করে খোদ যুক্তরাষ্ট্রও উপকৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাত মারাত্মক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র পর্যাপ্ত ডাক্তার, নার্স কিংবা স্বাস্থ্যকর্মী তৈরি করতে পারছে না। স্বাস্থ্যকর্মীদের একটা বড় অংশ আসছে বাইরে থেকে। এক্ষেত্রে কিউবার স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা জগৎ বিখ্যাত। তারা যুক্তরাষ্ট্রের এই চাহিদা পূরণ করতে পারে। ২০০২ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রো এ ধরনের একটি প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়েছিলেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র তা গ্রহণ করেনি। এখন পশ্চিম আফ্রিকায় মারাত্মক ইবোলা রোগ ছড়িয়ে পড়ায় কিউবার স্বাস্থ্যকর্মীরা সেখানে গেছেন। কিউবার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের উন্নতি হলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যখাত উপকৃত হতে পারে।প্রেসিডেন্ট ওবামার ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটি ‘বড় উদ্যোগ’। কিন্তু এই উদ্যোগের পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ কনজারভেটিভদের একটা বড় অংশ এখন যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে। এটা সত্য, দীর্ঘ ৫৪ বছরের বৈরিতার অবসান হওয়া প্রয়োজন। স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি এখন আর নেই। ছোট রাষ্ট্র কিউবাকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার উন্নয়ন সম্ভব নয়। কিউবাকে সঙ্গে নিয়েই সমস্যার সমাধান করতে হবে। একই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, কিউবা এ বিশ্বকে অনেক কিছু দিতে পারে। তাই বিকাশমান নয়া বিশ্বব্যবস্থার আলোকে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্কোন্নয়ন অত্যন্ত জরুরি। Daily Jugantor ০৩ জানুয়ারি, ২০১৫