রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শিশু সাফির মতোই দগ্ধ দেশের গণতন্ত্র

বিবিসির বাংলা বিভাগ গত ২০ জানুয়ারি গণতন্ত্র দিবস পালন করেছে। এ উপলক্ষে বেতারে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে তারা। এর অংশ হিসেবে তারা ঢাকা শহরে দুটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মতামত নেয় এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্র নিয়ে তাদের ভাবনা প্রচার করে। একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক হিসেবে আমাকেও বিবিসির ঢাকা অফিসের স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মন্তব্য করার জন্য। বিবিসির বাংলা বিভাগের শায়লা রুখসানার সঙ্গে ওদের আলাপচারিতায় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকটের একটি চিত্র ফুটে উঠেছে। বিবিসির ওই সাক্ষাৎকারটি প্রচারিত হল এমন এক সময় যখন দেশ চরম এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। একদিকে অবরোধ, হরতাল, সহিংসতা; অন্যদিকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র মধ্য দিয়ে আমরা দিন পার করছি এবং ‘গণতন্ত্র চর্চা’ করছি! বিবিসির সঙ্গে আলাপচারিতায় তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে সাদিয়া, নাঈমা, সাদিক, হৃদয়, মাসরুররা যেসব মন্তব্য করেছে, তা যে কোনো বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘বোমাবাজি গণতন্ত্র নয়’, ‘গণতন্ত্রের নামে জনগণের জন্য কোনো কাজ হচ্ছে না’, ‘বিরোধী দল গণতন্ত্রের অংশ’, ‘জনগণের অংশগ্রহণ নেই’, ‘সরকার এককেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে’, ‘মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না’, ‘নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য গণতন্ত্র’- এ ধরনের মন্তব্য বাংলাদেশের গণতন্ত্র বোঝার জন্য যথেষ্ট। ওদের মুখ থেকে এক ধরনের সমঝোতার কথাও বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে এসেছে নিরাপত্তাহীনতার কথা। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা যখন তাদের হতাশা আর নিরাপত্তাহীনতার কথা বলছিল, তখন আমার মনে পড়ছিল ঢাকার চলমান ঘটনাবলীর কথা।এটা অনেকেই স্বীকার করেন একটা ‘সমঝোতা’ প্রয়োজন। কারণ সমঝোতা না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের উপরে আশা করছি, এ লক্ষ্যে আমরা পৌঁছতে পারব না। ২০২১ সালের মধ্যে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের এ প্রত্যাশাও পূরণ হবে না। কারণ সমঝোতা না হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। রফতানি খাত থাকবে ঝুঁকির মুখে। ফলে লক্ষ্য অর্জিত হবে না। সমঝোতা না হলে অরাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়বে। সুশাসন ব্যাহত হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে না। আর দায়বদ্ধতা সৃষ্টি না হলে বাড়বে দুর্নীতি। বাড়বে অসহিষ্ণুতা। সরকার থাকবে বটে; তবে এক ধরনের অস্থিরতা সরকারের মধ্যে কাজ করবে। এতে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চারও ব্যাঘাত ঘটবে। সংসদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের মূল চালিকা শক্তি। গণতন্ত্র আমাদের এটাই শেখায়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পরপর নির্বাচন এবং ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ সেই নির্বাচন, একটি জাতীয় সংসদ, জবাবদিহিতা এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক। কিন্তু অতীতে যা ঘটেনি, তা ঘটেছিল ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে। সংবিধানের ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচন হয়েছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু রাজনীতির ‘বাস্তববাদী নীতি’ এতে প্রতিফলিত হয়নি। অর্থাৎ বাস্তবতা এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। আর বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রয়োজন ছিল। বিএনপির ওই নির্বাচনে অংশ না নেয়া সঠিক ছিল, নাকি ভুল ছিল- এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। বিএনপির নির্বাচন প্রশ্নে ‘অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়, সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি। কারণ ১৯৯১ সালের নির্বাচনের (পঞ্চম) মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম ও ২০০৮ সালে নবম সংসদ তথা প্রতিটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে গড়ে ৩৩ ভাগ ভোট নিশ্চিত করেছে (১৯৯১ সালে ৩০:৮১ ভাগ এবং ১৯৯৬ সালে ৩৩.৬১ ভাগ, ২০০১ সালে ৪০.৯৭ ভাগ এবং ২০০৮ সালে ৩৩.২০ ভাগ)। এখন এদের বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যে যুক্তিতে বিএনপি তথা ২০ দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেটা তারা বারবার স্পষ্ট করেছে। এমনকি ৩১ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনেও খালেদা জিয়া বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তার ৭ দফার প্রথম দফাই হচ্ছে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সংবিধানে এর কোনো সুযোগ নেই। সেজন্যই খালেদা জিয়া দাবি করেছেন সংবিধান সংশোধনের। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষও বোধকরি এটা উপলব্ধি করবেন যে, বর্তমান সরকার ‘দ্বিতীয়বার’ আর সংবিধান সংশোধন করবে না, যদি না তাদের ‘বাধ্য’ করা হয়! প্রশ্নটা এখানেই- বিএনপি তথা ২০ দল সরকারকে বাধ্য করাতে পারবে কিনা? হরতাল দিয়ে যে বাধ্য করা যায় না, তা এর আগেও প্রমাণিত হয়েছে।এখানে যা দিবালোকের মতো স্পষ্ট তা হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী দুই মতের সহাবস্থান হচ্ছে না। আর সহাবস্থান না হলে সংঘাত বাড়বেই। কোনো পক্ষই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। এখানে মধ্যস্থতা করারও সুযোগ নেই। আমরা অতীতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূতের দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। ফলাফল শূন্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্র দফতর একাধিকবার ‘সব দলের অংশগ্রহণে ‘নির্বাচনে’র কথা বলে আসছে। এখানেও কোনো জট খোলেনি। তাই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় অন্ধকার রয়েই গেছে। বারবার বিদেশীদের কাছে ছুটে যাওয়াও কোনো ভালো সংবাদ নয়।আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে, রাজনীতিকদের দূরদর্শিতা। আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। দু’পক্ষই যে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে, তা দেশ ও জাতির জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। গেল বছরের শেষের দিকে বিএনপি গাজীপুরে সভা করতে পারেনি। কারণ সেখানে সব দলের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। এর আগে ছাত্রলীগ তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপির জনসভা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। ফলে প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারি অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। এখানে মুখ্য হওয়া উচিত ছিল রাজনীতি। শক্তি কখনও মুখ্য হওয়া উচিত নয়। বিএনপিকে গাজীপুরে জনসভা করার অনুমতি দিলে তাতে সরকারেরই লাভ হতো। উচিত ছিল ছাত্রলীগেরও জনসভা করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করা। এতে সাধারণ মানুষের পক্ষে সুবিধা হতো একটি সিদ্ধান্তে আসার। ওই ঘটনার পরও বিএনপি জনসভার অনুমতি পায়নি। এক্ষেত্রেও সরকার আরও উদার হতে পারত। কারণ সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮নং অনুচ্ছেদে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। বিএনপি একটি বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন। দলকে সমাবেশ করতে দিলে ক্ষতির কিছু ছিল না। ডিএমপি তো এর আগেও অনুমতি দিয়েছে। উপরন্তু ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টিও সমাবেশ করেছে। সমাবেশ করতে না দিলে বিষয়টি বিএনপি তাদের স্বার্থে ব্যবহার করবে, এটাই তো স্বাভাবিক।খালেদা জিয়া ৭ দফা উপস্থাপন করেছেন। এই ৭ দফায় নতুন কিছু নেই। এ কথাগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন। তবে এই ৭ দফার মাঝে ১নং দফাই প্রধান। ১নং দফায় বলা হয়েছে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সমস্যা এখানেই। সরকার এক্ষেত্রে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান তাদের পক্ষে। বিএনপি সংবিধান সংশোধনের কথা বলছে। খুব সঙ্গত কারণেই সরকার এটি করবে না। আর বিএনপি সরকারকে এ কাজটি করতে ‘বাধ্য’ করাতে পারবে, এটিও বাস্তবসম্মত নয়। তবে বিএনপি যে সংলাপের কথা বলছে, সেই সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান খুঁজে বের করা অমূলক কিছু নয়। যদিও অতীতে সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিন্তু তাই বলে এখন হবে না, এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে উভয় পক্ষেরই কিছুটা ‘ছাড়’ দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ‘বিচার মানি কিন্তু তালগাছ আমার’- এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।খালেদা জিয়ার গুলশানস্থ অফিস থেকে পুলিশ প্রত্যাহার করে নেয়ার পরও খালেদা জিয়া তার অফিসেই অবস্থান করছেন। গত ২১ ও ২২ জানুয়ারি হরতাল পালিত হয়েছে। খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছেন, অবরোধের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। একটি সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী অবরোধে গত ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত মারা গেছে ২৮ জন, যাদের মধ্যে অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেছে ১৪ জন। গাড়ির ক্ষতি হয়েছে ৫৬৪টি, সম্পূর্ণ পোড়ানো হয়েছে ৬৪টি। আর ওই সংবাদপত্রের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আহত হয়েছে ৫৫ হাজার ২০৭ জন ব্যক্তি। ধ্র“পদী গণতন্ত্র চর্চার সঙ্গে এই তথ্য বড় বেমানান। সংবাদপত্রে প্রকাশিত ছবিতে দগ্ধ শিশু সাফির করুণ চাহনি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সাফির মতোই দগ্ধ বাংলাদেশের গণতন্ত্র! বাংলাদেশের চলমান রাজনীতি ছোট্ট শিশুকে পর্যন্ত পঙ্গুত্বের ঝুঁকিতে ঠেলে দিচ্ছে। এ কোন রাজনীতি? আর এ রাজনীতি চলবেই বা কতদিন ধরে? পেট্রল ঢেলে যারা বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়, যারা বাসে পেট্রলবোমা ছোড়ে, তারা গণতন্ত্রের শত্র“। বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, যারা এ ধরনের কাজ করে তারা দুর্বৃত্ত। তাদের কোনো পরিচয় থাকতে পারে না। আর প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, খুনি হিসেবে খালেদা জিয়ার বিচার হবে। সংসদেও দাবি উঠেছে তার গ্রেফতার ও বিচারের। কিন্তু এটা কোনো সমাধান বয়ে আনবে না। বরং সংঘাতকে আরও প্রলম্বিত করবে। আমরা চাই হরতাল, অবরোধ আর সংঘাতের অবসান। যারাই মানুষ হত্যার সঙ্গে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনা হোক। মানুষ হত্যার নাম গণতন্ত্র হতে পারে না। সেই সঙ্গে সহনশীলতা, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা রাখাটাও জরুরি। মনে রাখতে হবে, রাজনীতির অপর নাম হচ্ছে মানুষকে সেবা করা। মানুষ হত্যা করে কিংবা বালুর ট্রাক আর ইটের ট্রাকে কাউকে ‘গৃহবন্দি’ করে রেখে গণতন্ত্র বিনির্মাণ করা যায় না। তাই চাই সমঝোতা। চাই দূরদর্শিতা। চাই ছাড় দেয়ার মানসিকতা। শিশু সাফি যে কথা বলতে পারেনি, কিংবা এ প্রজন্মের সাদিয়ারা যে প্রশ্ন রেখেছে, আমাদের রাজনীতিকরা যদি তা উপলব্ধি করেন, তার মাঝেই সবার মঙ্গল নিহিত। মানুষের জন্যই রাজনীতি। আর এ রাজনীতি যদি বেশি মাত্রায় সন্ত্রাসনির্ভর হয়, তাহলে আমাদের আস্থার জায়গাটা আর থাকে না। দুঃখ একটাই- ৪৪ বছরে পা দিতে গিয়েও আমাদের এ কথাটা বলতে হচ্ছে। Daily Jugantor ২৪ জানুয়ারি, ২০১৫

0 comments:

Post a Comment