শিক্ষার
মান নিয়ে এখন নানা প্রশ্ন উঠেছে। উচ্চমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, এমনকি পিএসসি,
জেএসসি কিংবা জেডিসি পরীক্ষায় ‘মেধা বিস্ফোরণ’-এর যে ঘটনা একের পর এক ঘটে
চলেছে, তা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি বড় প্রশ্নের মাঝে ঠেলে দিয়েছে।
পরিস্থিতি কত ভয়াবহ হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক
আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে নিজ মেয়ের রেজাল্ট সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতে পারেন! ফাহমিদুল
হককে আমরা মোটামুটি সবাই চিনি। দলবাজ শিক্ষক তিনি নন। গণযোগাযোগ ও
সাংবাদিকতা বিভাগের তিনি সহযোগী অধ্যাপক। তার মেয়ে তাহিয়া এবার জেএসসি
পরীক্ষায় ‘এ প্লাস’ পেয়েছে। মেয়ে দুঃখ পাবে জেনেও তিনি ফেসবুকে লিখেছেন
দেশজুড়ে যে গণ ‘এ প্লাস’ দেয়া হয়েছে, তার শিকার তাহিয়া। তার সহজ সরল
স্বীকারোক্তি তাহিয়া এ প্লাসের যোগ্য নয়! ফাহমিদুলকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি ‘ছোট
করব না। কিন্তু তার সাহসী বক্তব্য আমার মতো অনেককে আরও সাহসী করবে। এই গণ এ
প্লাসের কাহিনি শুরু হয়েছে আরও আগে থেকে। গণহারে এইচএসসি আর এসএসসিতে এ
প্লাস দেওয়া হচ্ছে। অথচ এই এ প্লাস পাওয়া পরীক্ষার্থীরা ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় (শতকরা ৮০ ভাগ) ন্যূনতম পাস নম্বর পেতে
ব্যর্থ হয়েছে। অথচ আমাদের শিক্ষামন্ত্রী এসব নিয়ে গর্ব করেন।
মাননীয়
মন্ত্রী, শিক্ষার মান বাড়ছে বলে আপনি যখন গর্ব করেন, তখন আপনাকে আমি সমর্থন
করতে পারি না। বাস্তবতা হচ্ছে শিক্ষার মানের প্রচ- অবনতি হয়েছে। জিপিএ ৫
এখন গলার কাঁটা। এই জিপিএ ৫ এখন হাসির ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আপনার সরকার
দেশে ৩৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। এটা নিয়েও আপনার গর্ব হতে পারে।
কিন্তু এর মাঝেও আমি কোনো কর্তৃত্ব দেখি না। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা
বাড়ানোর মধ্য দিয়ে শিক্ষার গুণগত মান বাড়ানো যাবে না। প্রত্যন্ত অঞ্চলে
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে আমরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে এক ধরনের
বৈষম্য তৈরি করে ফেলেছি ইতোমধ্যে। রাজনৈতিক বিবেচনায় শত শত শিক্ষক নিয়োগ
দেয়া হয়েছে। এক বিষয়ের শিক্ষক, অন্য বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শিক্ষকদের
সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত হয়নি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের
ব্যবস্থা করা হয়নি। এমনকি তরুণ শিক্ষকদের দায়বদ্ধতাও আমরা নিশ্চিত করতে
পারিনি। তরুণ প্রজন্ম শিক্ষকতাকে মহান পেশা হিসেবে বেছে নেয়নি। তাই
উচ্চশিক্ষা ও এর মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেল। ভালো শিক্ষক না হলে ভালো ছাত্র
তৈরি হয় না, মন্ত্রী হিসেবে তো এটা আপনার জানার কথা? উচ্চশিক্ষা নিয়ে
মাননীয় মন্ত্রীর কাছে পূর্ণ চিত্র আছে কি না সন্দেহ। একদিকে ‘ভালো ছাত্ররা’
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা না থাকায় যেমনি শিক্ষকতায় আসতে পারছে না, অন্যদিকে
কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা তাদের অবসরের বয়সসীমা ৬৭-তে উন্নীত
করায়, এখানেও তৈরি হয়েছে বৈষম্য। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন হচ্ছে সরকারি
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থের জোগানদাতা। সেই মঞ্জুরি কমিশনই যখন অবসরের বয়সসীমা
৬৭ নিয়ে আপত্তি তুলেছে, তখন কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এটা বাস্তবায়ন করে
কীভাবে? এখানে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না। নেওয়া
হচ্ছে দলীয় আনুগত্য আর রাজনীতির বিষয়টি। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার এর
নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা। উচ্চশিক্ষা নিয়ে আরও কিছু কথা বলা
দরকার। প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এখন ঢালাওভাবে পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু
করেছে। কিন্তু কারা করছে পিএইচডি? পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, সিনিয়র জেনারেল
আর সচিবরা এখন পিএইচডি করছেন। যে কেউ তার যদি মেধা থাকে, তিনি পিএইচডি
করতেই পারেন। কিন্তু আমরা ভুলে যাই পিএইচডি একটি গবেষণা। গবেষককে ছুটি নিতে
হয়। লাইব্রেরিতে যেতে হয়। ফিল্ড ওয়ার্ক করতে হয়। কোর্সওয়ার্ক করতে হয়।
লাইব্রেরিতে না গিয়ে, ফিল্ড ওয়ার্ক না করে, ‘ফুল টাইম’ অফিস করে কি গবেষণা
হয়? এটি দেখার কেউ নেই। মাননীয় মন্ত্রীর কাছেও সঠিক তথ্যটি নেই। ফলে
উচ্চশিক্ষার নামে আমরা শুধু সার্টিফিকেটধারীদের সংখ্যাই বাড়াচ্ছি না, এখন
আবার পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সংখ্যাও বাড়াচ্ছি। ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারীও
রয়েছে। এরা আবার স্বনামে কার্ড ছাপিয়ে তা বিলিও করছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়
এটা দেখে না। মাননীয় মন্ত্রীর সময় নেই। আর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের
কর্তাব্যক্তিরা বয়সের ভারে কান্ত, অবসন্ন! কাজটি তাহলে কে করবে?
অপরিকল্পিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থা। কোন কোন সেক্টরে আমাদের কত
গ্রাজুয়েট দরকার, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। ফলে লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী সরকারি
ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বিবিএর মতো বিষয়ে
‘সার্টিফিকেট’ নিচ্ছে এবং তারা এখন বেসরকারি খাতে ‘ভদ্র কেরানি’তে পরিণত
হয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও আমাদের চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। সেটিও
আমরা করছি না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে ঘরে ঘরে মাস্টার্স ডিগ্রিধারী
তৈরি করে আর যাই হোক আমরা শিক্ষার মান বাড়াতে পারিনি। কোটা ব্যবস্থা নিয়েও
চিন্তা করার সময় এসেছে। যেখানে জিপিএ ৫ নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে
ভর্তি হতে পারছে না, সেখানে কোটার কারণে ভর্তি হচ্ছে শত শত শিক্ষার্থী।
অযোগ্য এসব শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে জাতীয় জীবনে
কোনো অবদান রাখতে পারছে না। বরং এরা জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। কোনো কোনো
বিশ্ববিদ্যালয় আবার পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। এদিকেও দৃষ্টি
দেওয়া দরকার। মাননীয় মন্ত্রীর সময় কই? জিপিএ ৫ পাওয়া ছাত্রছাত্রীদের
মধ্যে শতকরা ৮০ জন যখন ন্যূনতম পাস নম্বর তুলতে ব্যর্থ হয়, তখন সত্যিকার
অর্থে বিষয়টা আমাদের ভাবায়। পাসের হার বাড়িয়ে দেখানোর মাঝে কোনো কর্তৃত্ব
নেই। এই সিদ্ধান্তটি ভুল ছিল যে, উত্তরপত্রগুলো সাধারণভাবে মূল্যায়ন করা ও
নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া। এখন অভিভাবকরা বুঝতে পারবেন জিপিএ ৫ পাওয়া তার
সন্তানটি তার জন্য বোঝা হয়ে গেল। এক ধরনের হতাশা ওইসব শিক্ষার্থীর মধ্যে
এসে যাবে যখন জিপিএ ৫ নিয়েও তারা কোথাও ভর্তি হতে পারবে না। এসব বিষয় নিয়ে
শিক্ষামন্ত্রীর চিন্তাভাবনা করা উচিত। আমার ধারণা তাকে যারা পরামর্শ দেন,
সঠিক পরামর্শটি তারা দেন না। সীমিত ‘লাভ’ বা সুবিধা নিয়ে আর যাই হোক সমাজে
বড় পরিবর্তন আনা যায় না। মাননীয় মন্ত্রী নিশ্চয়ই এটি উপলব্ধি করবেন। গত ৩১
ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিএসসি), জুনিয়র স্কুল
সার্টিফিকেট (জেএসসি) ও জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট (জেডিসি) পরীক্ষার
রেজাল্ট। পরিসংখ্যান বলছে, পিএসসিতে পাসের হার শতকরা ৯৭.৯২ ভাগ। জেএসসিতে
পাসের হার ৮৯.৮৫ ভাগ, আর জেডিসির পাসের হার ৯৩.৫০ ভাগ। পিএসসিতে জিপিএ ৫
পেয়েছে ২,২৪,৪১১ জন, জেএসসিতে ১,৩৬,৯৪৫ জন আর জেডিসিতে ১৯,২৯০ জন। আমি
কোমলমতি ছোট শিশুদের মেধাকে ‘ছোট’ করতে চাই না। কিন্তু আমরা কী এই বয়সেই
তাদের প্রত্যাশাকে আরও বাড়িয়ে দিলাম না? একটি শিশু কষ্ট করে শিখবে।
প্রতিযোগিতা থাকবে ওর ভেতর। আর ‘ভালো করার’ একটা জিদ তৈরি হবে ছোটবেলা
থেকেই। তা না করে তার জিপিএ ৫ প্রাপ্তি তাকে ‘ভালো করে পড়াশোনা’ করার প্রতি
আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে বাধ্য করবে। ভবিষ্যতে সে যখন এই জিপিএ ৫ নিয়ে কোনো
ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না, তখন সে হতাশায় পড়ে যাবে। এক
সময় অসৎ পথে পা বাড়াবে! আমাদের দেশের শিশুরা অনেক মেধাবী। তাহিয়ার মতো
মেয়েরা আমাদের ভবিষ্যৎ। ওদের নিজেদের মতো ‘বড়’ হতে দেওয়াই উচিত। তথাকথিত
জিপিএ ৫ তাহিয়াদের ‘বড়’ করবে না। ওদের জীবনটা ওদেরই গড়তে দেওয়া উচিত। ওরা
শুধু সীমিত ‘প্রশ্ন’ পড়ে, মুখস্থ করে পরীক্ষা দিয়ে জিপিএ ৫ নিয়ে জীবনকে
‘বড়’ করে গড়ে তুলতে পারবে না। ওদের অনেক কিছু পড়াশোনা করা উচিত। বিজ্ঞান,
সাহিত্য, বিশ্ব, সবকিছু। জ্ঞানের রয়েছে এক বিশাল ভা-ার। এর মাঝেই ওরা খুঁজে
পাবে ওদের ‘পৃথিবী’কে। আমি জানি এই বয়সে শিশুরা অনেক মেধাবী হয়। অনেক কিছু
জানতে চায়। শিখতে চায়। কিন্তু তাদের শেখাটাকে আমরা ‘সীমিত’ করে দিচ্ছি।
অযাচিতভাবে জিপিএ ৫ দিয়ে ওদের প্রত্যাশাকে আমরা বাড়িয়ে দিয়েছি। এটা ভালো
নয়। এটা করে আমাদের নীতিনির্ধারকরা অভিভাবকদের কাছে বাহবা নিতে চেয়েছেন।
হয়তো কোনো কোনো অভিভাবক এতে খুশি হবেন। কিন্তু ফাহমিদুল হকের মতো অভিভাবকও
আছেন, যারা খুশি হবেন না। একজন শিক্ষক যে কাজটি করেন, তিনি সে কাজটিই
করেছেন। তারপরও ‘ছোট্ট’ তাহিয়ার জন্য আমার অনেক ভালোবাসা ও আদর। আমি জানি
‘ও’ অনেক ‘বড়’ হবে, বাবার চেয়েও ‘বড়’Ñ যাতে করে ফাহমিদুল একদিন তার মেয়ের
জন্য গর্ব করতে পারেন। আমি সেদিনের অপেক্ষায় থাকলাম।
Daily Amader Somoy
12.01.15
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment