আমরা
আবারো ১৫ জানুয়ারি সকাল-সন্ধ্যা হরতাল প্রত্যক্ষ করলাম। বিএনপির উপদেষ্টা
পরিষদের সদস্য সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমানের
ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে এ হরতাল আহ্বান করা হয়েছিল এবং প্রতিটি হরতালের
ক্ষেত্রে যা হয়, এবারো তাই হয়েছে। গাড়ি ভাংচুর, আগুন ধরানো, চোরাগোপ্তা
হামলা_ কোনো একটি ক্ষেত্রেই ব্যতিক্রম হয়নি। ঢাকা একরকম 'বিচ্ছিন্ন' হয়ে
আসছে প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে। বালুর ট্রাক আর ইটের ট্রাকে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে
বাংলাদেশের বিকাশমান গণতন্ত্র! হাজারটা প্রশ্ন এখন উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে_
এর শেষ কোথায়? বেগম জিয়া একরকম 'অবরুদ্ধ' হয়ে আছেন তার গুলশান অফিসে। যদিও
প্রধানমন্ত্রী জনসভায় বলেছেন বেগম জিয়া ইচ্ছা করলে তার বাসায় যেতে পারেন।
কিন্তু আমরা যারা আমজনতা আমাদের কাছে বিষয়টি আদৌ স্পষ্ট নয়, বেগম জিয়া কি
সত্যি সত্যিই অবরুদ্ধ? নাকি তিনি চাইলেই বাসায় যেতে পারেন? ঘটনার পেছনে
সত্যতা যাই থাকুক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে বেগম জিয়া, যিনি তিনবার
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনি একরকম 'গৃহবন্দি'র জীবন যাপন
করছেন। এভাবে একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে 'গৃহবন্দি' করে রাখা গণতন্ত্রের
জন্য কতটুকু ভালো ও মঙ্গল_ এ প্রশ্ন উঠবেই। সরকারের দৃষ্টিতে বিএনপি নেত্রী
যদি কোনো 'রাষ্ট্রবিরোধী' কর্মকা- করে থাকেন তাহলে তাকে গ্রেপ্তার করাই
শ্রেয়। তিনি আইনি মোকাবেলায় তার গ্রেপ্তারের বিষয়টি মোকাবেলা করবেন। তা না
করে ট্রাক এনে বাসায় অবরুদ্ধ করে রাখা, তালা লাগিয়ে তাকে ঘরের ভেতরে
অবরুদ্ধ করে রাখা কোনোমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। প্রয়োজনে বেগম জিয়া সংবিধানের
৭, ১১, ২৭, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৬, ৩৭ কিংবা ৩৯ ধারা উল্লেখ করে হাইকোর্ট রিট করতে
পারেন। উচ্চ আদালত এ ব্যাপারে সরকারের কাছে তার 'অবরুদ্ধ'-এর বিষয়টি নিয়ে
ব্যাখ্যা চাইতে পারে। তবে আমরা ইতোমধ্যে অবগত হয়েছি যে, সরকার বেগম জিয়াকে
গ্রেপ্তার করতে পারে। মন্ত্রী ইনু প্রকাশ্যেই সে কথা বলেছেন, যা
পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, যিনি আদৌ
আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন, তিনি ও তার দলের অন্য একজন সদস্য
যেভাবে মন্তব্য দেন, তা কিন্তু সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না। জনাব
মঈনউদ্দিন খান বাদল জাসদের কার্যকরী সভাপতি। জীবনে কোনো দিনই জনগণের ভোটে
নির্বাচিত হতে পারেননি। শুধু প্রধানমন্ত্রীর বদান্যতায় তিনি গেল সংসদেও
এমপি হয়েছিলেন, আর ৫ জানুয়ারির ২০১৪ ভোটারবিহীন নির্বাচনেও এমপি হয়েছেন।
তিনি যখন বলেন, 'প্রয়োজনে পুলিশ বুকে গুলি চালাবে'_ তখন কি তিনি একবারও
ভেবে দেখেছিলেন যে, এ বক্তব্য তার নিজের, দলের কিংবা সরকারের কী ক্ষতি করে
গেল? পরে তিনি এ 'বক্তব্য' অস্বীকার করলেও, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
প্রতিটি সংবাদপত্রে তার এ বক্তব্য ছাপা হয়েছিল। তখন 'অস্বীকার' করলেও মানুষ
এটা বিশ্বাস করবেই যে তার মতো ব্যক্তির পক্ষে এ ধরনের বক্তব্য দেয়া সম্ভব।
আমরা জাসদের হঠকারী রাজনীতির অতীত ইতিহাস জানি। এ জাসদেরই প্রডাক্ট হচ্ছেন
বাদল সাহেব। রাজনীতিবিদরা আমাদের তরুণ সমাজের কাছে মডেল হবেন। কিন্তু কী
ভাবমূর্তি নিয়ে তারা আসছেন!
আমরা এক অনিশ্চিত জীবনের মাঝে বাস করছি। অবরোধ চলছে। চোরাগোপ্তা হামলা
চলছে। একজন সজ্জন ব্যক্তি হিসেবেই রিয়াজ রহমান পরিচিত ছিলেন। তিনি
রাজনীতিবিদ নন। টেকনোক্র্যাট। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে বেগম জিয়াকে পরামর্শ
দেন। অথচ তার ওপরই হামরা হলো। এ হামলা আমাদেরও একটা ভয়ের মধ্যে ফেলে দিল।
কেননা আমরা টিভিতে যাই। দুই দলেরই সমালোচনা করি। সরকারকেও সুপরামর্শ দিই।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকারের ব্যক্তিরা তাতে আপত্তি তোলেন। ২০ দল হরতাল দিল।
কিন্তু এ হরতাল কি কোনো সমাধান বয়ে আনবে? লাগাতার অবরোধও কি কোনো সমাধান
দেবে? তাহলে কি এভাবে হরতাল-অবরোধ হতেই থাকবে? একটা জায়গায় রাজনীতিবিদদের
আসতেই হবে। রাজনীতিবিদরা যদি পরস্পরকে 'শত্রু' মনে করেন, তা কোনো সমাধান
বয়ে আনবে না। দুঃখজনক হলেও সত্য, সিনিয়র রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে সাধারণ
মানুষের যে প্রত্যাশা তা তারা পূরণ করতে পারছেন না। সাধারণ মানুষ প্রত্যাশা
করে একটা 'সমঝোতা' হবে। একটা সংলাপ হবে। বর্তমান অস্থিরতার অবসান হবে।
কিন্তু তা হচ্ছে না। সরকারের ঊর্ধ্বতন নীতিনির্ধারকদের বক্তব্য স্টাইলে
বোঝা যায় ২০১৯ সালের আগে নির্বাচন কিংবা সংলাপের কোনো সম্ভাবনা নেই।
সংবিধান তা-ই বলে। কিন্তু ৫ জানুয়ারি কী নির্বাচন হয়েছে, জনগণের আদৌ
অংশগ্রহণ ছিল কিনা, এটা কি আমাদের নীতিনির্ধারকরা বুঝতে একবারও চেষ্টা
করেন? এতে আমরা গণতন্ত্রের বিকাশকে কতটুকু ক্ষতি করলাম, তা কি একবারও
চিন্তা করেছি? আমরা কি একটা 'বাজে' দৃষ্টান্ত স্থাপন করলাম না? এটা যে
ভবিষ্যতে একটা 'দৃষ্টান্ত' হবে না, এর গ্যারান্টি আমাদের কে দেবে? এটা তো
এখন দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, পরস্পরবিরোধী দুই দল, মত ও আদর্শের সহাবস্থান
হচ্ছে না। আর সহাবস্থান না হলে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কোনো পক্ষই তাদের স্ব
স্ব অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। এখানে মধ্যস্থতা করারও সুযোগ নেই।
আমরা অতীতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূতের দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। ফলাফল শূন্য।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র দপ্তর একাধিকবার 'সব দলের অংশগ্রহণে
নির্বাচন'-এর কথা বলে আসছেন। এখানেও কোনো জট খোলেনি। তাই সুড়ঙ্গের শেষ
মাথায় যে অন্ধকার, তা রয়েই গেছে।
আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতা। আস্থার সম্পর্ক গড়ে
তোলাটা জরুরি। দুই পক্ষই যে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে, তা দেশ ও জাতির জন্য
কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। গেল বছরের শেষের দিকে বিএনপি গাজীপুরে সভা করতে
পারেনি। কেননা সেখান সব দলের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল।
এর আগে ছাত্রলীগ তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপির জনসভা প্রতিহত
করার ঘোষণা দিয়েছিল। ফলে প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারি অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে
যায়। এখানে মুখ্য হওয়া উচিত ছিল রাজনীতি। ব্যক্তি কখনো মুখ্য হওয়া উচিত
নয়। বিএনপিকে গাজীপুরে জনসভা করার অনুমতি দিলে, তাতে সরকারেরই লাভ হতো।
উচিত ছিল ছাত্রলীগেরও জনসভা করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করা। এতে সাধারণ
মানুষের পক্ষে সুবিধা হতো একটি সিদ্ধান্তে আসার। ৫ জানুয়ারি বিএনপি জনসভার
অনুমতি পায়নি। এখানেও সরকার আরো উদার হতে পারত। কেননা সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮
নাম্বার অনুচ্ছেদে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে।
বিএনপি একটি বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন। এ দলকে সমাবেশ করতে দিলে ক্ষতির কিছু
ছিল না। ডিএমপি তো এর আগেও অনুমতি দিয়েছে। উপরস্তু ১ জানুয়ারি জাতীয়
পার্টিও সমাবেশ করেছে। সমাবেশ করতে না দিলে বিষয়টি বিএনপি তাদের স্বার্থেই
ব্যবহার করবে।
বেগম জিয়া সাত দফা উপস্থাপন করেছেন। এ সাত দফায় নতুনত্ব কিছু নেই। এ
কথাগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন। তবে এ সাত দফার মাঝে ১ নাম্বার দফাই
প্রধান। ১ নাম্বার দফায় বলা হয়েছে_ নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে
নির্বাচন। সমস্যা এখানেই। সরকার এ ক্ষেত্রে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
সংবিধান তাদের পক্ষে। বিএনপি সংবিধান সংশোধনের কথা বলছে। খুব সঙ্গত কারণেই
সরকার এটি করবে না। আর বিএনপি সরকারকে এ কাজটি করতে 'বাধ্য' করতে পারবে,
এটিও বাস্তবসম্মত নয়। তবে বিএনপি যে সংলাপের কথা বলছে, সে সংলাপ অনুষ্ঠিত
হতে পারে। সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান খুঁজে বের করা অমূলক কিছু নয়। যদিও
অতীতে সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিন্তু তাই বলে এখন হবে না, এটাও
গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে কিছুটা 'ছাড়' দেয়ার মানসিকতা থাকতে
হবে। 'বিচার মানি, কিন্তু তালগাছ আমার'_ এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।
সরকার যেহেতু একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এবং দাবিগুলো তার কাছেই পেশ করা,
সেহেতু 'সংলাপ'-এর ব্যাপারে সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার
যদি একটু 'নমনীয়' হয়, তাহলে একটি সমাধান বের করা সম্ভব। মধ্যবর্তী নির্বাচন
গণতন্ত্রসম্মত। সে ক্ষেত্রে ২০১৯ নয়, এর আগেও নির্বাচন হতে পারে। আর দুই
দলের প্রস্তাবের আলোকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনও সম্ভব। প্রয়োজনে 'ভারতীয়
মডেল' অনুসরণ করে নির্বাচনকালীন সব ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের কাছে ছেড়ে দিয়ে
নির্বাচন আয়োজন করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা
নিজেও থেকে যেতে পারেন। বিএনপির প্রতিনিধিদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেও
একটা সমাধান খুঁজে বের করা যায়। আর এখানেই প্রশ্নটি হচ্ছে আন্তরিকতার।
সরকার বা বিএনপি কতটুকু আন্তরিক হবে, প্রশ্ন সেখানেই।
সঙ্কটের মাত্রা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাত দফা প্রত্যাখ্যান ও আরো
একবার মধ্যবর্তী নির্বাচন নাকচ করার অর্থ হচ্ছে সঙ্কটের মাত্রাকে আরো
বাড়িয়ে দেয়া। অবরোধ চলছে, হরতাল হচ্ছে। আমরা আবারো 'হরতালের সংস্কৃতি'তে
ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু অতীত ইতিহাস বলে আশাবাদী হতে চাই। চাই না সংঘাতমুখর
রাজনীতি আমাদের সব অর্জনকে মস্নান করে দিক। আমরা চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
জনগণের জন্য যে রাজনীতি, সে রাজনীতিই ফিরে আসুক।
Daily Jai Jai Din
বুধবার, জানুয়ারী ২১, ২০১৫
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment