রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না

সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। এখনো অন্ধকার সেখানে। গেল বছরের শেষ দিনে বেগম জিয়ার সংবাদ সম্মেলন ও এর প্রতি-উত্তরে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদকের পাল্টা সংবাদ সম্মেলন আবারও প্রমাণ করল রাজনীতিতে যে আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক থাকা দরকার, তা বড় দল দুটোর মধ্যে নেই। তাই চলতি ২০১৫ সাল যে ক্রমেই সংঘাত-বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে, তার আভাস আরো স্পষ্ট, আরো ক্লিয়ার। একটা নির্বাচন হয়ে গেছে গেল বছরের ৫ জানুয়ারি। সেই নির্বাচনে মানুষ ভোট দিক বা না দিক, বহির্বিশ্বে তার গ্রহণযোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক, একটি ‘নতুন রাজনীতিক সংস্কৃতি’ আমরা এ দেশে জন্ম দিয়েছি। একটি ‘ঐকমত্যের সরকার’ গঠিত হয়েছে, যে সরকারের অংশীদার একটি দল আবার সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকাও পালন করছে! বিগত মহাজোট সরকারের আমলেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা বাতিল করা হয়েছে। অথচ বর্তমান সরকারের সময় সংশোধিত সংবিধানের ১১ নম্বর অনুচ্ছেদে যেখানে বলা হয়েছে, ‘প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হইবে’, এই অনুচ্ছেদটিও উপেক্ষিত থেকেছে। কেননা ১৫৪টি আসনে ‘জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ’ নিশ্চিত হয়নি। তাই একটি ‘সমঝোতা’ যেখানে প্রত্যাশিত ছিল, সেই ‘সমঝোতার’ সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় শুধুই অন্ধকার!
এটা অনেকেই স্বীকার করেন, একটা ‘সমঝোতা’ প্রয়োজন। কেননা ‘সমঝোতা’ না হলে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরে আশা করছি- এ লক্ষ্যেও আমরা পৌঁছতে পারব না। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে আমরা দেশটিকে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের এই প্রত্যাশা পূরণ হবে না। কেননা ‘সমঝোতা’ না হলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। রপ্তানি খাত থাকবে ঝুঁকির মুখে। ফলে লক্ষ্য অর্জিত হবে না। ‘সমঝোতা’ না হলে অরাজনৈতিক কর্মকা- বাড়বে। সুশাসন ব্যাহত হবে। এরই মধ্যে বিভিন্ন সেক্টরে সুশাসনের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ‘সমঝোতা’ যদি না হয়, তাহলে কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে না। আর দায়বদ্ধতা সৃষ্টি না হলে বাড়বে দুর্নীতি। বাড়বে অসহিষ্ণুতা। সরকার থাকবে বটে। কিন্তু এক ধরনের অস্থিরতা সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেবে। এতে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চারও ব্যাঘাত ঘটবে। সংসদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের মূল চালিকাশক্তি। গণতন্ত্র আমাদের এটাই শেখায়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর পর নির্বাচন ও ‘সব দলের অংশগ্রহণে’ সেই নির্বাচন, একটি জাতীয় সংসদ, জবাবদিহিতা এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক। কিন্তু অতীতে যা ঘটেনি, তা ঘটল ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচন। সংবিধানের ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচন হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু রাজনীতিতে যে ‘বাস্তববাদী নীতি’, তা এতে প্রতিফলিত হয়নি। অর্থাৎ ‘বাস্তবতা’ এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। আর বাস্তবতা হচ্ছে ‘বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ’ প্রয়োজন ছিল। বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়া সঠিক ছিল, নাকি ভুল ছিল- এটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। বিএনপির নির্বাচন প্রশ্নে ‘অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয় সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি! কারণ ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ ও ২০০৮ সালে নবম সংসদ- প্রতিটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে গড়ে ৩৩ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করেছে (১৯৯১ সালে ৩০.৮১ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৩৩.৬১ শতাংশ, ২০০১ সালে ৪০.৯৭ শতাংশ ও ২০০৮ সালে ৩৩.২০ শতাংশ)। এখন তাদের বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যে যুক্তিতে বিএনপি তথা ২০ দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেটা তারা বারবার স্পষ্ট করেছে। এমনকি ৩১ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনেও বেগম জিয়া বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তাঁর সাত দফার প্রথম দফাই হচ্ছে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, সংবিধানে এর কোনো সুযোগ নেই। সে জন্যই বেগম জিয়া দাবি করেছেন সংবিধান সংশোধনের। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষও বোধকরি এটা উপলব্ধি করেন যে বর্তমান সরকার ‘দ্বিতীয়বার’ আর সংবিধান সংশোধন করবে না, যদি না তাদের বাধ্য করা হয়! প্রশ্নটা এখানেই যে বিএনপি তথা ২০ দল সরকারকে বাধ্য করাতে পারবে কি না?
সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না
সাদা চোখে আমি যা দেখি তা হচ্ছে, পরস্পরবিরোধী দুই মতের সহাবস্থান হচ্ছে না। আর সহাবস্থান না হলে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। কোনো পক্ষই তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। এখানে মধ্যস্থতা করারও সুযোগ নেই। আমরা অতীতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূতের দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। ফলাফল শূন্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও পররাষ্ট্র দপ্তর একাধিকবার ‘সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন’-এর কথা বলে আসছে। এখানেও কোনো জট খোলেনি। তাই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে অন্ধকার, তা রয়েই গেছে।
আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতা। আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। দুই পক্ষই যে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে, তা দেশ ও জাতির জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। গেল বছরের শেষের দিকে বিএনপি গাজীপুরে সভা করতে পারেনি। কেননা সেখানে সব দলের সমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল। এর আগে ছাত্রলীগ তারেক রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপির জনসভা প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। ফলে প্রশাসনের ১৪৪ ধারা জারি অনেকটাই বাধ্যতামূলক হয়ে যায়। এখানে মুখ্য হওয়া উচিত ছিল রাজনীতি। ব্যক্তি কখনো মুখ্য হওয়া উচিত নয়। বিএনপিকে গাজীপুরে জনসভা করার অনুমতি দিলে তাতে সরকারেরই লাভ হতো। উচিত ছিল ছাত্রলীগেরও জনসভা করে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করা। এতে করে সাধারণ মানুষের পক্ষে সুবিধা হতো একটি সিদ্ধান্তে আসার। ৫ জানুয়ারি বিএনপি জনসভার অনুমতি পায়নি। এখানেও সরকার আরো উদার হতে পারত। কেননা সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিএনপি একটি বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন। দলকে সমাবেশ করতে দিলে ক্ষতির কিছু ছিল না। ডিএমপি তো এর আগেও অনুমতি দিয়েছে। উপরন্তু ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টিও সমাবেশ করেছে। সমাবেশ করতে না দিলে বিষয়টি বিএনপি তাদের স্বার্থেই তা ব্যবহার করবে।
বেগম জিয়া সাত দফা উপস্থাপন করেছেন। এই সাত দফায় নতুনত্ব কিছু নেই। এ কথাগুলো তিনি বিভিন্ন সময়ে বলে আসছেন। তবে এই সাত দফার মধ্যে ১ নম্বর দফাই প্রধান। ১ নম্বর দফায় বলা হয়েছে, নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন। সমস্যা এখানেই। সরকার এ ক্ষেত্রে একটি সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। সংবিধান তাদের পক্ষে। বিএনপি সংবিধান সংশোধনের কথা বলছে। খুব সংগত কারণেই সরকার এটি করবে না। আর বিএনপি সরকারকে এ কাজটি করতে ‘বাধ্য’ করাতে পারবে এটিও বাস্তবসম্মত নয়। তবে বিএনপি যে সংলাপের কথা বলছে, সেই সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান খুঁজে বের করা অমূলক কিছু নয়। যদিও অতীতে সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিন্তু তাই বলে এখন হবে না- এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে কিছুটা ‘ছাড়’ দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ‘বিচার মানি। কিন্তু তালগাছ আমার’- এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে।
সরকার যেহেতু একটা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে এবং দাবিগুলো তার কাছেই পেশ করা, সেহেতু ‘সংলাপ’-এর ব্যাপারে সরকারকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার যদি একটু ‘নমনীয়’ হয়, তাহলে একটি সমাধান বের করা সম্ভব। মধ্যবর্তী নির্বাচন গণতন্ত্রসম্মত। সে ক্ষেত্রে ২০১৯ নয়, এর আগেও নির্বাচন হতে পারে। আর দুদলের প্রস্তাবের আলোকে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনও সম্ভব। প্রয়োজনে ‘ভারতীয় মডেল’ অনুসরণ করে নির্বাচনের সময়ে সব ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনারের কাছে ছেড়ে দিয়ে নির্বাচন আয়োজন করা যায়। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা নিজেও থেকে যেতে পারেন। বিএনপির প্রতিনিধিদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেও একটা সমাধান খুঁজে বের করা যায়। আর এখানেই প্রশ্নটি হচ্ছে আন্তরিকতার। সরকার বা বিএনপি কতটুকু আন্তরিক হবে- প্রশ্ন সেখানেই।
সংকটের মাত্রা বাড়ছে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সাত দফা প্রত্যাখ্যান ও আরো একবার মধ্যবর্তী নির্বাচন নাকচ করার অর্থ হচ্ছে, সংকটের মাত্রা আরো বাড়তে দেওয়া। ১ জানুয়ারি হরতাল হয়েছে। আমরা আবারও ‘হরতাল-অবরোধের সংস্কৃতি’তে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু অতীত ইতিহাস বলে হরতাল ডেকে সরকারের পতন ঘটানো যায় না। আমরা আশাবাদী হতে চাই। চাই না সংঘাতমুখর রাজনীতি আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দিক। আমরা চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। জনগণের জন্য যে রাজনীতি, সেই রাজনীতিই ফিরে আসুক। ২০১৫ সালকে নিয়ে আশাবাদী হতে চাই আমরা। কা:ক:
লেখক : অধ্যাপক ও রাজনীতি বিশ্লেষক
স্থানীয় সময় : ০৫৪২ ঘণ্টা , ১৪ জানুয়ারি ২০১৫

0 comments:

Post a Comment