দীর্ঘ ৫৪ বছরের বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে গত ২১ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র ও কিউবার মধ্যকার আলোচনা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় ধরনের একটি আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের নানা কর্মকাণ্ড নতুন করে 'স্নায়ুযুদ্ধ'-এর সূচনা করেছে, সেখানে এই দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোনো গুণগত পরিবর্তন ডেকে আনে কি না এ বিষয়টিই এখন মুখ্য আলোচনার বিষয়। বলা ভালো, দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র কিউবার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা বজায় রেখেছে। ফলে একদিকে এই নিষেধাজ্ঞা যেমন বিশ্বে কিউবার পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে না, অন্যদিকে তেমন কিউবায় কোনো বিনিয়োগও হচ্ছে না। ফলে কিউবার প্রচুর সম্ভাবনা থাকলেও সেখানে কোনো রাজনৈতিক সংস্কারও আসেনি। গেল ডিসেম্বরে বারাক ওবামা এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। আর এর রেশ ধরেই দুই পক্ষ প্রথমবারের মতো আলোচনায় বসল।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা সম্পর্ক অনেক দিন ধরেই আলোচনার একটি বিষয়। কিউবা কী আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতি পরিত্যাগ করবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্র 'আবারও' হাভানায় সরকার উৎখাতের উদ্যোগ নেবে- এসব প্রশ্ন বারবার মিডিয়ায় ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষকের লেখনীতে উঠে এসেছে। ১৯৯১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব ইউরোপে 'সোভিয়েত ধাঁচের' সমাজতন্ত্রের পতনের রেশ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নে যখন সমাজতন্ত্রের পতন ঘটল, তখন বলতে গেলে সারা বিশ্বের দৃষ্টি এক রকম নিবদ্ধ ছিল কিউবার দিকে। কেননা কিউবা ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অন্যতম সমর্থক এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল কিউবার অর্থনীতির অন্যতম উৎস, সেই সঙ্গে নিরাপত্তার অন্যতম গ্যারান্টার ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের অবর্তমানে অর্থনৈতিকভাবে কিউবা টিকে থাকতে পারবে কি না- এ প্রশ্নটি বারবার উচ্চারিত হয়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের 'আগ্রাসনের' মুখে থেকে কিউবা তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারবে কি না এটা নিয়েও প্রশ্ন ছিল। আরো একটি প্রশ্ন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিল- তা হচ্ছে কিউবা কি আদৌ তার সমাজতান্ত্রিক নীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে? কেননা, চীন ও ভিয়েতনামের মতো দেশেও স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর পরিবর্তন এসেছে। এই দুটি দেশ এখন আর ধ্রুপদী মার্ক্সবাদ অনুসরণ করে না। তাই খুব সংগত কারণেই প্রশ্ন ছিল, কিউবা চীন বা ভিয়েতনামের পথ অনুসরণ করবে কি না?
কিউবা-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় ছিল কিউবার নিরাপত্তাহীনতা। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কিউবায় একটি সমাজতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকার করে নেয়নি। বরং কিউবায় বিপ্লবের পর (১৯৫৯) কিউবা সরকার যখন লাতিন আমেরিকাজুড়ে বিপ্লব ছড়িয়ে দিতে চাইল, চে গুয়েভারা যখন 'বিপ্লব' সম্পন্ন করার জন্য কিউবা সরকারের মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে বলিভিয়ায় গেলেন (সেখানেই তাঁকে পরে হত্যা করা হয়) তখন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের কাছে ভিন্ন একটি বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কখনোই চায়নি 'তার প্রভাবাধীন এলাকায়' অন্য কোনো 'শক্তি' প্রভাব খাটাক। 'মনরো ডকট্রিন'-এর আদলে যুক্তরাষ্ট্র চেয়েছে এ এলাকায় তথা লাতিন আমেরিকায় তার পূর্ণ কর্তৃত্ব। কিন্তু কিউবার বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের এই 'হিসাব-নিকাশে' বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যুক্তরাষ্ট্র কিউবা বিপ্লবের মাত্র দুই বছরের মধ্যে ১৯৬১ সালে ভাড়াটে কিউবানদের দিয়ে কিউবা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা চালায়। সিআইএর অর্থে পরিচালিত এই অভিযান 'বে অব পিগস'-এর অভিযান হিসেবে খ্যাত। বলা বাহুল্য, ওই অভিযান ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র থেমে থাকেনি। ঠিক এর পরের বছর ১৯৬২ সালের অক্টোবরে 'কিউবা সংকট' একটি পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কার জন্ম দিয়েছিল। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছিল, কিউবায় সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বসিয়েছে, যা তার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপন করেছে, এটা বিবেচনায় নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র একটি নৌ-অবরোধ আরোপ করে, যাতে করে কিউবায় কোনো ধরনের সামরিক মারণাস্ত্র সরবরাহ করা না যায়। এই নৌ-অবরোধ অনেকটা সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রকে একটি যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন তখন দাবি করে, যুক্তরাষ্ট্রকে তুরস্ক থেকে তাদের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে। দীর্ঘ ১৩ দিন এই নৌ-অবরোধ বহাল ছিল। অবশেষে যুক্তরাষ্ট্র তুরস্ক থেকে মিসাইল প্রত্যাহার করে নিলে সোভিয়েত ইউনিয়নও কিউবা থেকে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সরিয়ে নেয়। এর মধ্য দিয়ে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা কমে গেলেও সংকট থেকে গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র কিউবার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। দীর্ঘ ৫৪ বছর ধরে এই অর্থনৈতিক অবরোধের বিরুদ্ধে কিউবা 'যুদ্ধ' করে আসছে। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পরও মার্কিন দৃষ্টিভঙ্গিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি।
দুই দিনের আলোচনা শেষ হলেও আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো ঘোষণা আসেনি। খোদ কংগ্রেসের অনেক রিপাবলিকান সদস্য কিউবায় রাজনৈতিক সংস্কার না আসা পর্যন্ত বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার বিপক্ষে মতামত দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস সদস্যদের দাবি (ডেমোক্র্যাট সদস্যসহ) কিউবায় আরো বেশি গণতন্ত্রায়ন। আরো বেশি অর্থনৈতিক উদারীকরণ। মানবাধিকার পরিস্থিতির আরো উন্নতি। একই সঙ্গে রাজনৈতিক সংস্কার। এটাই হচ্ছে মোদ্দা কথা। বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের শর্তে কিউবা সব কিছু 'উন্মুক্ত' করে দেবে না। সোভিয়েত ইউনিয়নে গর্বাচেভের সংস্কার কর্মসূচির ফলাফল তাদের অজানা নয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার আনতে গিয়েই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গিয়েছিল। চীন ও ভিয়েতনামে অর্থনৈতিক সংস্কার এসেছে। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সংস্কার কর্মসূচির 'পেরেস্ক্রোইকা' বাস্তবায়ন হয়েছে। কিন্তু 'গ্লাসনস্ত' কার্যকর হয়নি। রাজনৈতিক সংস্কার আসেনি। কিউবায় কোনোটাই আসেনি। চীন তার সংস্কার কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীন থেকে এখন ঋণ গ্রহণ করছে। ভিয়েতনামও কম পায়নি। যে ভিয়েতনাম প্রায় ৪০ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে, তারাই আজ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র। ভিয়েতনামের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি পোশাকের যে বিশাল চাহিদা, তার একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম সরবরাহ করছে। এখানে 'রাজনীতি' অগ্রাধিকার পায়নি। পেয়েছে বাণিজ্য। এখন কিউবা কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, তাও দেখার বিষয়। তবে হুট করে দুই দেশের সম্পর্কে কোনো বড় পরিবর্তন আসবে না। প্রেসিডেন্ট রাওল কাস্ত্রো ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, ওবামার এই প্রস্তাবের ভিত্তিতে কিউবার রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো পরিবর্তন আসবে না। কিউবার জনগণ এখনো কিউবার সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে এটাও ঠিক, বিশ্বায়নের এই যুগে কিউবা 'একা একা' চলতে পারবে না। দেশটিকে 'দুয়ার উন্মুক্ত' করে দিতে হবেই। দেশের অর্থনীতির ৮০ শতাংশ এখনো সরকার নিয়ন্ত্রিত। কিছু কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসা বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সারা দেশে এ সংখ্যা প্রায় চার লাখ ৫০ হাজার। বেসরকারি খাত সম্প্রসারণের সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ট্যুরিজম খাত। এ খাত কিছুটা উন্মুক্ত করা হয়েছে। আরো উন্মুক্ত করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের হোটেল চেন ব্যবসায়ীরা এ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে। কিউবায় সীমিত আকারে 'ডলার বাণিজ্য' হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত কিউবান আমেরিকানদের পাঠানো অর্থ এখন নিয়মিত কিউবায় আসছে। ক্রেডিট কার্ড ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে একটা সমস্যা রয়েছে। কিউবা প্রতিদিন এক লাখ ব্যারেল তেল 'অত্যন্ত কম মূল্যে' ভেনিজুয়েলা থেকে পেয়ে আসছে। এর বিনিময়ে কিউবা ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক দিচ্ছে। এসব ডাক্তার, নার্স আর শিক্ষক এখন ভেনিজুয়েলার হয়ে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে কাজ করছেন। পুরো ব্যয়ভার বহন করছে ভেনিজুয়েলা। প্রয়াত হুগো শাভেজ এই পরিকল্পনা শুরু করলেও বর্তমান প্রেসিডেন্ট মাদুরো এই পরিকল্পনা কত দিন টিকিয়ে রাখতে পারবেন, সে প্রশ্ন ইতিমধ্যেই উঠেছে। কেননা ভেনিজুয়েলার রমরমা তেল ব্যবসার দিন শেষ। অর্থনীতি আগের মতো আর শক্তিশালী নয়। রাজধানী কারাকাসে বিশাল বিশাল ভবন খালি পড়ে আছে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা আসছেন না। রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ছে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভেনিজুয়েলার সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। ভেনিজুয়েলার ওপর বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। যখন ওবামা কিউবার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নতি করার উদ্যোগ নেন, তার ঠিক এক দিন পর ১০ ডিসেম্বর এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত থেকে কিউবার দূরত্ব মাত্র ১৪৫ কিলোমিটার। এই সাগরপথ পাড়ি দিয়ে কোনো কিউবান নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে পা রাখলেই তাকে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ দেওয়া হয়। এই অভিবাসন নীতিতে পরিবর্তনের কথা বলেছে কিউবা। দূতাবাস খোলা ও কবে নাগাদ বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে, সে ব্যাপারে কোনো সুস্পষ্ট ঘোষণা আসেনি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা ঐতিহাসিক সংলাপ একটি প্রশ্নের মধ্যে থেকে গেল বৈকি!
Daily Kalerkontho
01.02.15
0 comments:
Post a Comment