ছোট্ট
ফারজানার একটি ছবি ও সেই সঙ্গে একটি প্রশ্নও ছাপা হয়েছে আমাদের সময়ে গত ২৬
জানুয়ারি। রামেকের বার্ন ইউনিটের বেডে বসে আছে ফারজানা। ৫ বছর বয়সি এ
শিশুটির পেট্রলবোমার আগুনে মুখের বামপাশ পুড়ে গেছে। আঘাতে বাম চোখ ফুলে
বন্ধ হয়ে গেছে। চোখের নিচ থেকে থুতনি পর্যন্ত দগদগে ঘা। ফারজানার অভিযোগ,
‘আমি কিছু করিনি, মানুষ আমাকে পুড়াইল ক্যান?’ ফারজানার এ প্রশ্নের জবাব কে
দেবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি সাংবিধানিকভাবে এখন দেশ পরিচালনার
দায়িত্বে নিয়োজিত, তিনি দেবেন এ প্রশ্নের জবাব? বেগম জিয়া, যিনি সরকার
পতনের ডাক দেওয়ায় জন্ম হয়েছে এই সহিংস রাজনীতির, তিনি দেবেন এ প্রশ্নের
জবাব? সংবাদপত্রের ভাষায়, ‘দুর্বৃত্তরা’ই এই পেট্রলবোমা ছোড়ে। তাদের
নাম-ঠিকানা মাঝে মধ্যে ধরা পড়লে ছাপা হয় বটে, কিন্তু রাজশাহীর তানোরে বাসে
যে বা যারা পেট্রলবোমা ছুড়ে ফারজানাকে আহত করল, তারা গ্রেফতার হয়নি। ধরা
পড়লে ওদের কাছে জানতে চাইতাম কেন এরা এ কাজটি করল? এই পেট্রলবোমার
সংস্কৃতি যা আমাদের রাজনীতিকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, আমরা বোধ করি কেউই এটা
বুঝতে চাইছি না! বুঝতে পারাটা স্বাভাবিক। কিন্তু বুঝতে চাইছি না! আমাদের
সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের
শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য,
স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ কিন্তু ফারজানারা যখন দগ্ধ হয় তখন
তাদের মৌলিক মানবাধিকার লংঘিত হয় বৈকি। সংবিধানে চলাফেরার স্বাধীনতা (৩৬নং
অনুচ্ছেদ) নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির নামে যারা বাসে পেট্রলবোমা
ছুড়ছে, তারা তো সংবিধানের ওই ধারাকে এক রকম চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এ থেকে
আমরা বের হয়ে আসব কীভাবে? কে দেবে আমাদের এই নিশ্চয়তা? রাজনীতির নামে বলি
হচ্ছে সাধারণ মানুষ। ফারজানা কিংবা সাফিয়ের মতো ছোট্ট শিশুরাও বোমাবাজদের
কাছ থেকে রেহাই পাচ্ছে না। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক নেতা বা কর্মী এই
পেট্রলবোমায় আহত হয়েছেন, এমনটি কখনো দেখা যায় না। গত কদিনে ডিএমসির বার্ন
ইউনিটের যে ছবি ও সংবাদ পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়েছে, তা হৃদয়বিদারক। ঝলসে গেছে
মুখ, ছোট্ট শিশু চিনতে পারছে না বাবাকে। ফ্যালফ্যাল করে ‘অচেনা’ এক বাবার
দিকে তাকিয়ে আছে। ছোট্ট মনে তার হাজার প্রশ্নÑ এমন কেন বাবা! এর জবাব কে
দেবে? মায়ের কোলে এই ছোট্ট সোনামণির ছবিও পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু ওই
পর্যন্তই। আমি জানি না যারা বোমা মেরে মানুষ পুড়িয়েছে, তাদের কজনকে
গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে একটি সংবাদÑ ঢাকার
যাত্রাবাড়ীতে পেট্রলবোমা ছুড়ে বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় বেগম জিয়াকে
‘হুকুমের আসামি’ করে দুটি মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। আর ডিএমপির কমিশনার
আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, ‘প্রমাণ সাপেক্ষে খালেদা জিয়াকেও গ্রেফতার করা
হবে।’ অর্থাৎ খালেদা জিয়াও গ্রেফতার হতে পারেন যদি ‘প্রমাণ’ পাওয়া যায়।
বেগম জিয়া অবরোধ, হরতালের ডাক দিয়েছেন। নিজে সংবাদ সম্মেলন করে এ কথা
জানিয়েছেন। তার ওই বক্তব্য পত্রপত্রিকায় ছাপাও হয়েছে। কিন্তু যাত্রাবাড়ীতে
বাসে তিনি কি বোমা হামলার নির্দেশ দিয়েছিলেন? কী জানি হয়তো পুলিশি ‘তদন্তে’
তা বেরিয়েও আসতে পারে! যাত্রাবাড়ীতে বাসে বোমা হামলা হয়েছিল ২৩ জানুয়ারি।
আর মামলা হলো ২৪ জানুয়ারি। এই হামলায় ৩১ জন দগ্ধ হয়েছিল। এটা একটা বড় ধরনের
অপরাধ। এর শাস্তি হওয়া উচিত। এটা যেমন সত্য, তেমনি এটাও সত্য বিএনপির
সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না গেলে, এই সংকট থেকে বের হয়ে আসা যাবে না। কিন্তু
বেগম জিয়াকে ‘হুকুমের আসামি’ করায় (কুমিল্লায়ও তার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা
হয়েছে) এই ‘সমঝোতার’ ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও জটিলতা সৃষ্টি হলো।
বেগম জিয়া এখন পুত্রহারা। ছোট ছেলে কোকোকে হারানোর ব্যথা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। কিন্তু অবরোধ-হরতাল আর সন্ত্রাসী কর্মকা- যদি চলতে থাকে, তা তো দেশের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। ক্ষতির পরিমাণ একেকজন একেকভাবে দিচ্ছেন। পোশাকশিল্পে অর্ডার কমেছে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না এর ফলে। এখন সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে না। আর দায়বদ্ধতা সৃষ্টি না হলে বাড়বে দুর্নীতি। বাড়বে অসহিষ্ণুতা। সরকার থাকবে বটে। কিন্তু এক ধরনের অস্থিরতা সরকারের ভিতকে কাঁপিয়ে দেবে। এতে করে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চারও ব্যাঘাত ঘটবে। সংসদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের মূল চালিকাশক্তি। গণতন্ত্র আমাদের এটাই শেখায়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর-পর নির্বাচন ও ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ সেই নির্বাচন, একটি জাতীয় সংসদ, জবাবদিহিতা এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক। কিন্তু অতীতে যা ঘটেনি, তা ঘটেছিল ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে। সংবিধানের ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচন হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু রাজনীতিতে যে ‘বাস্তববাদী নীতি’, তা এতে প্রতিফলিত হয়নি। অর্থাৎ ‘বাস্তবতা’ এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। আর বাস্তবতা হচ্ছে ‘বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ’ প্রয়োজন ছিল। বিএনপির ওই নির্বাচনে অংশ না নেওয়া সঠিক ছিল, নাকি ভুল ছিলÑ এটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। বিএনপির নির্বাচন প্রশ্নে ‘অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়, সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি! কারণ ১৯৯১ সালের নির্বাচনের (৫গ) মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ ও ২০০৮ সালে নবম সংসদÑ প্রতিটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে গড়ে ৩৩ ভাগ ভোট নিশ্চিত করেছে (১৯৯১ সালে ৩০.৮১ ভাগ, ১৯৯৬ সালে ৩৩.৬১ ভাগ, ২০০১ সালে ৪০.৯৭ ভাগ এবং ২০০৮ সালে ৩৩.২০ ভাগ)। এখন তাদের বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যে যুক্তিতে বিএনপি তথা ২০ দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেটা তারা বারবার স্পষ্ট করেছে। এমনকি একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনেও বেগম জিয়া বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তার ৭ দফার প্রথম দফাই হচ্ছে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সংবিধানে এর কোনো সুযোগ নেই। সে জন্যই বেগম জিয়া দাবি করেছেন সংবিধান সংশোধনের। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষও বোধ করি এটা উপলব্ধি করেন যে, বর্তমান সরকার ‘দ্বিতীয়বার’ আর সংবিধান সংশোধন করবে না, যদি না তাদের ‘বাধ্য’ করা হয়! প্রশ্নটা এখানেই যে, বিএনপি তথা ২০ দল সরকারকে বাধ্য করাতে পারবে কি না? হরতাল দিয়ে যে ‘বাধ্য’ করা যায় না, তা এর আগেও প্রমাণিত হয়েছে। এখানে যা স্পষ্ট দিবালোকের মতো, তা হচ্ছে পরস্পরবিরোধী দুই মতের সহাবস্থান হচ্ছে না। আর সহাবস্থান না হওয়ায় সন্ত্রাস বাড়ছেই। কোনো পক্ষই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। এখানে মধ্যস্থতা করারও সুযোগ নেই। আমরা অতীতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূতের দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। ফলাফল শূন্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্র দফতর একাধিকবার ‘সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন’-এর কথা বলে আসছেন। এখানেও কোনো জট খোলেনি। তাই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে অন্ধকার, তা রয়েই গেছে। বারবার বিদেশিদের কাছে ছুটে যাওয়াও কোনো ভালো সংবাদ নয়।
আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতা। আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। দুপক্ষই যে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে, তা দেশ ও জাতির জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি, তা আমাদের একটি বড় শংকার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বার্ন ইউনিটে অসহায় মানুষদের আহাজারি যে কোনো বিবেকমান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেলেও তা স্পর্শ করেনি আমাদের রাজনীতিবিদদের। সরকার ক্রমেই শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে। আর বিএনপি ফিরে গেছে ‘না ফেরার’ অবস্থানে। এখানে সমঝোতার উদ্যোগ কে নেবে? কাদের সিদ্দিকী, ড. কামাল হোসেন কিংবা অধ্যাপক বি. চৌধুরী অনশন, ধরনা ইত্যাদির কথা বলছেন বটে। কিন্তু তাতে বরফ গলছে না। বেগম জিয়া যখন একদিকে পুত্র শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, অন্যদিকে তাকে ‘হুকুমের আসামি’ করে মামলা দেওয়া সমঝোতার পথকে আরও দূরে সরিয়ে দেবে। স্পষ্টতই সরকার কঠোর অবস্থানে গেছে। জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু রাজনীতির প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে। বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দিতে হবে। এখানেও সরকারকে আরও উদার হতে হবে। কেননা সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮নং অনুচ্ছেদে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিএনপি একটি বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন। দলকে সমাবেশ করতে দিলে ক্ষতির কিছু ছিল না। ডিএমপি তো এর আগেও অনুমতি দিয়েছে। উপরন্তু ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টিও সমাবেশ করেছে। বিএনপি সরকারকে এ কাজটি করতে ‘বাধ্য’ করতে পারবে, এটিও বাস্তবসম্মত নয়। তবে বিএনপি যে সংলাপের কথা বলছে, সেই সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান খুঁজে বের করা অমূলক কিছু নয়। যদিও অতীতে সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিন্তু তাই বলে এখন হবে না, এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে কিছুটা ‘ছাড়’ দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ‘বিচার মানি। কিন্তু তালগাছ আমার’Ñ এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। ছোট্ট ফারজানা যে প্রশ্ন করেছে, এ প্রশ্ন আজ সবার। সাধারণ মানুষ, যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তারা কেন সন্ত্রাসের শিকার হবে। আমি খুশি হব যদি সরকারপ্রধান ছোট্ট ফারজানার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করে। কিন্তু এর চেয়েও বড় প্রশ্ন একটিইÑ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী অবস্থান ধর্মঘট করেছেন। এরশাদ অনশন করেছেন। কিন্তু তা কি কোনো মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে সরকারকে? কিংবা বেগম জিয়ার কাছে? একমাত্র দু’ব্যক্তিই পারেন এর সমাধান খুঁজে বের করতেÑ একজন শেখ হাসিনা ও অপরজন বেগম জিয়া। দল বলি, প্রেসিডিয়াম সদস্য বলি, স্থায়ী সদস্য বলিÑ কারও কোনো ‘ভূমিকা’ নেই। তবুও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন গুলশানে সমবেদনা জানাতে। দরজা খোলা হয়নি। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে কারও সঙ্গেই দেখা না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এখন একজনকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ চায় একটা নিশ্চয়তা। চায় ঘরে সুস্থভাবে ফিরে যাওয়ার অধিকার। কিন্তু অদৃশ্য পেট্রলবোমা তাদের এই ন্যূনতম অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে। Daily Amader SOMOY 02.02.15
বেগম জিয়া এখন পুত্রহারা। ছোট ছেলে কোকোকে হারানোর ব্যথা কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। কিন্তু অবরোধ-হরতাল আর সন্ত্রাসী কর্মকা- যদি চলতে থাকে, তা তো দেশের জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। ক্ষতির পরিমাণ একেকজন একেকভাবে দিচ্ছেন। পোশাকশিল্পে অর্ডার কমেছে। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না এর ফলে। এখন সমঝোতা যদি না হয়, তাহলে কোনো দায়বদ্ধতা সৃষ্টি হবে না। আর দায়বদ্ধতা সৃষ্টি না হলে বাড়বে দুর্নীতি। বাড়বে অসহিষ্ণুতা। সরকার থাকবে বটে। কিন্তু এক ধরনের অস্থিরতা সরকারের ভিতকে কাঁপিয়ে দেবে। এতে করে সুস্থ গণতান্ত্রিক চর্চারও ব্যাঘাত ঘটবে। সংসদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক সমাজের মূল চালিকাশক্তি। গণতন্ত্র আমাদের এটাই শেখায়। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় পর-পর নির্বাচন ও ‘সকল দলের অংশগ্রহণে’ সেই নির্বাচন, একটি জাতীয় সংসদ, জবাবদিহিতা এবং সেই সঙ্গে বিরোধী দলের সঙ্গে একটি আস্থার সম্পর্ক। কিন্তু অতীতে যা ঘটেনি, তা ঘটেছিল ৫ জানুয়ারির (২০১৪) নির্বাচনে। সংবিধানের ধারাবাহিকতায় এই নির্বাচন হয়েছে, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু রাজনীতিতে যে ‘বাস্তববাদী নীতি’, তা এতে প্রতিফলিত হয়নি। অর্থাৎ ‘বাস্তবতা’ এখানে উপেক্ষিত হয়েছে। আর বাস্তবতা হচ্ছে ‘বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ’ প্রয়োজন ছিল। বিএনপির ওই নির্বাচনে অংশ না নেওয়া সঠিক ছিল, নাকি ভুল ছিলÑ এটা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। বিএনপির নির্বাচন প্রশ্নে ‘অবস্থান’ নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যে নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেয়, সেই নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হয় বৈকি! কারণ ১৯৯১ সালের নির্বাচনের (৫গ) মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমরা গড়ে তুলেছি, এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৬ সালে সপ্তম, ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ ও ২০০৮ সালে নবম সংসদÑ প্রতিটি গ্রহণযোগ্য সংসদ নির্বাচনে বিএনপি এককভাবে গড়ে ৩৩ ভাগ ভোট নিশ্চিত করেছে (১৯৯১ সালে ৩০.৮১ ভাগ, ১৯৯৬ সালে ৩৩.৬১ ভাগ, ২০০১ সালে ৪০.৯৭ ভাগ এবং ২০০৮ সালে ৩৩.২০ ভাগ)। এখন তাদের বাদ দিয়ে যে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। বিএনপি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেয়নি। যে যুক্তিতে বিএনপি তথা ২০ দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেটা তারা বারবার স্পষ্ট করেছে। এমনকি একাধিকবার সংবাদ সম্মেলনেও বেগম জিয়া বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। তার ৭ দফার প্রথম দফাই হচ্ছে নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি নির্বাচন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সংবিধানে এর কোনো সুযোগ নেই। সে জন্যই বেগম জিয়া দাবি করেছেন সংবিধান সংশোধনের। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষও বোধ করি এটা উপলব্ধি করেন যে, বর্তমান সরকার ‘দ্বিতীয়বার’ আর সংবিধান সংশোধন করবে না, যদি না তাদের ‘বাধ্য’ করা হয়! প্রশ্নটা এখানেই যে, বিএনপি তথা ২০ দল সরকারকে বাধ্য করাতে পারবে কি না? হরতাল দিয়ে যে ‘বাধ্য’ করা যায় না, তা এর আগেও প্রমাণিত হয়েছে। এখানে যা স্পষ্ট দিবালোকের মতো, তা হচ্ছে পরস্পরবিরোধী দুই মতের সহাবস্থান হচ্ছে না। আর সহাবস্থান না হওয়ায় সন্ত্রাস বাড়ছেই। কোনো পক্ষই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে এতটুকু সরে আসছে না। এখানে মধ্যস্থতা করারও সুযোগ নেই। আমরা অতীতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূতের দৌড়ঝাঁপ দেখেছি। ফলাফল শূন্য। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্র দফতর একাধিকবার ‘সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন’-এর কথা বলে আসছেন। এখানেও কোনো জট খোলেনি। তাই সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় যে অন্ধকার, তা রয়েই গেছে। বারবার বিদেশিদের কাছে ছুটে যাওয়াও কোনো ভালো সংবাদ নয়।
আজ যা প্রয়োজন তা হচ্ছে রাজনীতিবিদদের দূরদর্শিতা। আস্থার সম্পর্ক গড়ে তোলাটা জরুরি। দুপক্ষই যে অনমনীয় অবস্থানে রয়েছে, তা দেশ ও জাতির জন্য কোনো মঙ্গল ডেকে আনবে না। বর্তমানে দেশের যে পরিস্থিতি, তা আমাদের একটি বড় শংকার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বার্ন ইউনিটে অসহায় মানুষদের আহাজারি যে কোনো বিবেকমান মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেলেও তা স্পর্শ করেনি আমাদের রাজনীতিবিদদের। সরকার ক্রমেই শক্ত অবস্থানে যাচ্ছে। আর বিএনপি ফিরে গেছে ‘না ফেরার’ অবস্থানে। এখানে সমঝোতার উদ্যোগ কে নেবে? কাদের সিদ্দিকী, ড. কামাল হোসেন কিংবা অধ্যাপক বি. চৌধুরী অনশন, ধরনা ইত্যাদির কথা বলছেন বটে। কিন্তু তাতে বরফ গলছে না। বেগম জিয়া যখন একদিকে পুত্র শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না, অন্যদিকে তাকে ‘হুকুমের আসামি’ করে মামলা দেওয়া সমঝোতার পথকে আরও দূরে সরিয়ে দেবে। স্পষ্টতই সরকার কঠোর অবস্থানে গেছে। জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু রাজনীতির প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসতে হবে। বিএনপিকে সভা-সমাবেশ করতে দিতে হবে। এখানেও সরকারকে আরও উদার হতে হবে। কেননা সংবিধানের ৩৭ ও ৩৮নং অনুচ্ছেদে সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বিএনপি একটি বিধিবদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠন। দলকে সমাবেশ করতে দিলে ক্ষতির কিছু ছিল না। ডিএমপি তো এর আগেও অনুমতি দিয়েছে। উপরন্তু ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টিও সমাবেশ করেছে। বিএনপি সরকারকে এ কাজটি করতে ‘বাধ্য’ করতে পারবে, এটিও বাস্তবসম্মত নয়। তবে বিএনপি যে সংলাপের কথা বলছে, সেই সংলাপ অনুষ্ঠিত হতে পারে। সংলাপের মাধ্যমে একটা সমাধান খুঁজে বের করা অমূলক কিছু নয়। যদিও অতীতে সংলাপ কোনো ফল বয়ে আনেনি। কিন্তু তাই বলে এখন হবে না, এটাও গ্রহণযোগ্য নয়। এ ক্ষেত্রে উভয় পক্ষকে কিছুটা ‘ছাড়’ দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। ‘বিচার মানি। কিন্তু তালগাছ আমার’Ñ এই মানসিকতা ত্যাগ করতে হবে। ছোট্ট ফারজানা যে প্রশ্ন করেছে, এ প্রশ্ন আজ সবার। সাধারণ মানুষ, যাদের সঙ্গে রাজনীতির কোনো সম্পর্ক নেই, তারা কেন সন্ত্রাসের শিকার হবে। আমি খুশি হব যদি সরকারপ্রধান ছোট্ট ফারজানার চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করে। কিন্তু এর চেয়েও বড় প্রশ্ন একটিইÑ বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী অবস্থান ধর্মঘট করেছেন। এরশাদ অনশন করেছেন। কিন্তু তা কি কোনো মেসেজ পৌঁছে দিয়েছে সরকারকে? কিংবা বেগম জিয়ার কাছে? একমাত্র দু’ব্যক্তিই পারেন এর সমাধান খুঁজে বের করতেÑ একজন শেখ হাসিনা ও অপরজন বেগম জিয়া। দল বলি, প্রেসিডিয়াম সদস্য বলি, স্থায়ী সদস্য বলিÑ কারও কোনো ‘ভূমিকা’ নেই। তবুও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন গুলশানে সমবেদনা জানাতে। দরজা খোলা হয়নি। তবে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এক বিবৃতিতে কারও সঙ্গেই দেখা না হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এখন একজনকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষ চায় একটা নিশ্চয়তা। চায় ঘরে সুস্থভাবে ফিরে যাওয়ার অধিকার। কিন্তু অদৃশ্য পেট্রলবোমা তাদের এই ন্যূনতম অধিকারটুকুও কেড়ে নিয়েছে। Daily Amader SOMOY 02.02.15
0 comments:
Post a Comment