রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

মোদি-কেজরিওয়াল দ্বন্দ্ব কি শুরু হয়ে গেল

দিলি্লর বিধানসভার নির্বাচনে আপ আদমি পার্টির অভাবনীয় বিজয় নিয়ে যখন সারা ভারতে মাতামাতি চলছে, তখন নরেন্দ্র মোদির একটি মন্তব্য কেজরিওয়ালের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। দিলি্ল একটি পূর্ণ রাজ্য নয়_ এটা কেজরিওয়াল বোঝেন। তাই নির্বাচনে বিজয়ের পরপরই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে। কারণ দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল জানেন তিনি যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করতে হলে নরেন্দ্র মোদির সমর্থন তার প্রয়োজন। সে কারণেই মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে অফিস করার আগেই তিনি ছুটে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে। প্রধানমন্ত্রী সেদিন আশ্বাসও দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, কেজরিওয়াল লীলাবতী ময়দানে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পরাজিত বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রার্থী কিরণ বেদিকে 'বড় দিদি' হিসেবে সম্বোধন করে প্রশাসন পরিচালনায় তার সহযোগিতাও চেয়েছিলেন। বলেছিলেন কিরণ বেদির সঙ্গে পরামর্শ করেই তিনি সরকার পরিচালনা করবেন। কিন্তু মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে এ 'পরিস্থিতি' কী বদলে গেল? কেজরিওয়াল নির্বাচনের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন (বিনামূল্যে পানি, বিদ্যুৎবিল ছাড়), প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এসব প্রস্তাবকে অবাস্তব বলেছেন। গেল সোমবার দিলি্লতে বিদ্যুৎসংক্রান্ত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, 'বিদ্যুতের জন্য অন্য রাজ্যের ওপর যাদের নির্ভর করতে হয়, সেসব দল কিভাবে দাম ছাড়ের প্রতিশ্রুতি দেয় বুঝতে পারি না।' তিনি আরো বলেছেন, 'যখনই ভোট হয়, রাজনৈতিক দলগুলো তখনই বিনে পয়সায় বিদ্যুৎ দেয়ার কথা বলতে থাকে। এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ভর্তুকির রাজনীতিতে লাগাতার ছাড়ের বন্যা ভারতের অর্থনীতিকে যে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারবে না তা আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে অর্থনীতিতে সংস্কারের প্রস্তাব করেছেন। ভর্তুকি কমানো এই সংস্কারেরই অংশ। ফলে নরেন্দ্র মোদির এ বক্তব্য একটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যে, কেজরিওয়াল কেন্দ্র থেকে কোনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা নাও পেতে পারেন। নরেন্দ্র মোদি যা বলেছেন, তাকে একেবারে অস্বীকারও করা যাবে না। দিলি্লর বিদ্যুৎ আসে অন্য রাজ্য থেকে। সেই বিদ্যুৎ বিল মেটাবে কে? কেন্দ্র বা দিলি্লর রাজ্য সরকার? খুব সঙ্গত কারণেই দিলি্ল সরকার যখন বিদ্যুৎবিলে ভর্তুকি দেবে, তাতে আপত্তি জানাবে কেন্দ্রের সরকার। দিলি্লর পানির সঙ্কট অনেক পুরনো। ভূগর্ভের পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। এই পানির চাহিদা মেটায় হরিয়ানা রাজ্য। তাদের পানির বিল মেটাবে কে? কেন্দ্র কেন এখানে ভর্তুকি দেবে? তাহলে কী দিলি্লর বিধানসভার নির্বাচনে আম আদমি পার্টির (আপ) অসাধারণ বিজয় ও আপ 'সুপ্রিমো' অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সব প্রতিশ্রুতি শেষ পর্যন্ত কাগজকলমেই থেকে যাবে? ইতোমধ্যেই হিসাব-নিকেশ শুরু হয়ে গেছে_ কিভাবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল তার প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করবেন। কেননা দিলি্লর নিজস্ব আয়ের ক্ষেত্রটা খুব বড় নয়। তার ওপর কেন্দ্রে যে সরকার রয়েছে, তার সঙ্গে 'আপে'র সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন আছে। নির্বাচনের আগে কেজরিওয়াল যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার মধ্যে রয়েছে বিদ্যুৎবিল অর্ধেক করে দেয়া, পরিবারপ্রতি প্রতিমাসে ২০ হাজার লিটার পানি সরবরাহ করা বিনামূল্যে, ১৫ লাখ সিসি টিভি স্থাপন, ফ্রি ওয়াইফাই, ৫০০ ফ্রি স্কুল, ২০ ফ্রি কলেজ, হাসপাতালে ৩০ হাজার 'বেড' বাড়ানো, ৫৫ হাজার নতুন স্থায়ী চাকরি, ভিআইপি সংস্কৃতি বন্ধ ইত্যাদি। এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি 'ধাক্কা' খাবেন। দিলি্লর বর্তমান বিদ্যুৎ চাহিদা ৬২০০ মেগাওয়াট। 'আপ' নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা বলছে। এক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের কারণে কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র কিংবা অতিরিক্ত গ্যাসের কারণে গ্যাস বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা সম্ভব হবে না। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা দিলি্লতে বেসরকারি খাতে। এরা শতকরা ৫২ ভাগ বেশি আয় করে। এদের আয়-ব্যয় হিসাব করার হুমকি দিয়েছে 'আপ'। এখন যদি মুখ্যমন্ত্রী বিদ্যুৎবিল অর্ধেক করার নির্দেশ দেন তাতে রাজস্ব আয় অনেক কমে যাবে। আয় কমে গেলে কোন খাত থেকে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল রাজ্যের উন্নয়নের অর্থ যোগাবেন? প্রতিমাসে ২০ হাজার লিটার পানি বিনামূল্যে দেয়ার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। অথচ দিলি্লর ভূগর্ভে পানির স্তর এই সরবরাহের জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে তাকে পার্শ্ববর্তী হরিয়ানা রাজ্যের দিকে তাকাতে হবে। কিন্তু সেখানে রয়েছে একটি বিজেপি সরকার। বিজেপির সঙ্গে তার সম্পর্ক ভবিষ্যতে কোন পর্যায় উন্নীত হয়, সেটা একটা বড় প্রশ্ন এখন। পুরো দিলি্ল শহরে ১৫ লাখ সিসি টিভি বসানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে 'আপ'। এতে খরচ হবে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা, যা কিনা দিলি্লর বার্ষিক আয়ের চারগুণ বেশি। সিসি টিভির নজরদারির জন্য দরকার হবে আরো ৪ লাখ পুলিশ। এতে তো খরচ বাড়বে। এত বিপুল খরচ 'আপ' মেটাবে কিভাবে? পত্রিকাগুলো লিখছে, যেখানে বেইজিং ও লন্ডনের মতো শহরে সিসি টিভির সংখ্যা ৪ লাখ ৭০ হাজার ও ৪ লাখ ২০ হাজার, সেখানে দিলি্লতে ১৫ লাখ সিসি টিভি বসানোর প্রতিশ্রুতি কাগজকলমেই থেকে যাবে। বর্তমানে দিলি্লতে ১ লাখ পুলিশ রয়েছে। নজরদারির জন্য অতিরিক্ত পুলিশ নিয়োগে খরচ বাড়বে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। হাসপাতালগুলোয় অতিরিক্ত 'বেড' বসাতে খরচ হবে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। ৫৫ হাজার অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়োগে আরো খরচ হবে ১৫ হাজার কোটি টাকা। দিলি্লর বার্ষিক বাজেট ৩৭ হাজার কোটি টাকা। নয়া পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে এই বাজেট বাড়বে। অথচ রাজস্ব আসে মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। এরই মধ্যে ভ্যাট কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন কেজরিওয়াল। তাহলে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবেন কিভাবে নয়া মুখ্যমন্ত্রী? দিলি্লর বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করল গেলবারের ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে রাজ্যটি মুক্তি পেয়েছে। এবার তারা একটি স্থায়ী রাজ্য সরকার পাবে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেজরিওয়াল কতটুকু সফল হবেন, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তবে সর্বভারতব্যাপী এটা কোনো মডেল হবে না। অনেক রাজ্য আছে, যেখানে স্থানীয় দলগুলো রাজ্য সরকার পরিচালনা করে। মাত্র দু'বছর আগে এএপির আবির্ভাব সর্বভারতব্যাপী তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। অরবিন্দ কেজরিওয়াল একজন জাতীয় নেতা হিসেবেও স্বীকৃতি পাননি। গেলবারের লোকসভায় তার দল কোনো আসন পায়নি। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন তাকে পরিচিত করেছিল। সামান্য একজন সরকারি কর্মচারী থেকে আজ তিনি দিলি্লর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন দ্বিতীয়বারের মতো। তার এই অর্জন একেবারে কম নয়। তবে দিলি্লর রাজ্য সরকার পরিচালনা করা তার জন্য একটা সমস্যা হতে পারে। কেন্দ্র থেকে তিনি যদি আদৌ আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা না পান, তাহলে কোনো কর্মসূচি তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। প্রতিশ্রুতি দেয়া যায় কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। যদিও মোদি এক সময় তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই 'প্রতিশ্রুতি'র পেছনে কতটুকু আন্তরিকতা আছে, তা শুধু আগামী দিনগুলোর জন্য একটা প্রশ্ন হয়ে থাকল। তবে এটা সত্য, কেজরিওয়াল একটা 'ইমেজ' ইতোমধ্যে গড়ে তুলেছেন। একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ তিনি চান। কাজটি যে খুব সহজ, তা নয়। ভারতে দুর্নীতি প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই রয়েছে। অতিসম্প্রতি একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে_ তাতে দেখা যায়, জেনেভায় বিভিন্ন ব্যাংকে ভারতীয়দের হাজার হাজার কোটি টাকা রয়েছে। কর ফাঁকি আর দুর্নীতির মাধ্যমে এই টাকা পাচার করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার ৬০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে বলেও সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং যে রাজ্যের দায়িত্ব নিয়েছেন কেজরিওয়াল, সেখানে কর ফাঁকি আর দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা বেশি। এক্ষেত্রে তিনি কতটুকু সফল হবেন, তা একমাত্র ভবিষ্যৎই বলতে পারবে। কেজরিওয়ালের মূল স্পিরিট হচ্ছে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা ও শাসনব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া। এজন্যই তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করা এবং বিনামূল্যে দিলি্লবাসীকে পানি সরবরাহ করা ইত্যাদি। ভয় হচ্ছে যে, তার এসব প্রতিশ্রুতি না আবার সস্তা সস্নোগান হয়ে যায়। এখন বিদ্যুৎ কিংবা পানির বিলে রাজ্য সরকার ভর্তুকি দিলে কেন্দ্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক খারাপ হতে বাধ্য। দিলি্লর আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী নয়। এসব ক্ষেত্রে এই ভর্তুকি তিনি কিভাবে মেটাবেন, সে ব্যাপারে তাকে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। পাঞ্জাবে বিনে পয়সায় কৃষকদের বিদ্যুৎ দেয়া হয়। সেখানে আকালি দল ক্ষমতায়। আর আকালি দল হচ্ছে কেন্দ্রের এনডিএ জোটের মিত্র। দিলি্লতেও আকালি দলের সঙ্গে জোট বেধেছিল বিজেপি। সুতরাং একটা প্রশ্ন থাকবেই_ যদি পাঞ্জাবে এই ভর্তুকির ব্যাপারটি বিজেপি সরকার সমর্থন দিয়ে থাকে, তাহলে দিলি্লতে তারা দেবে না কেন? তবু মোদির মন্তব্যের পর কেজরিওয়ালকে এখন নতুন করে ভাবতে হবে। কেজরিওয়ালের ফেরত আসার আর পথ নেই। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাকে এখন তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে হবে। কেন্দ্রের সাহায্য ছাড়া কিভাবে তিনি এসব বাস্তবায়ন করবেন_ সেটাই বড় প্রশ্ন এখন Daily Jai Jai Din 23.02.15

0 comments:

Post a Comment