সব জনমত জরিপকে 'সত্য' প্রমাণ করে আম আদমি পার্টি আবার দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। শনিবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও মঙ্গলবার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এতে দেখা যায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে আম আদমি পার্টি বিজয়ী হয়েছে। ৭০ আসনবিশিষ্ট দিল্লির বিধানসভায় এই দলটি পেয়েছে ৬৭টি আসন। অন্যদিকে বিজেপি পেয়েছে তিনটি আসন। ভরাডুবি ঘটেছে কংগ্রেসের। তারা আসন পায়নি। অথচ ২০১৩ সালে সেখানে বিধানসভার যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে বিজেপি ও শিরোমণি আকালি দল বেশি আসন পেয়েছিল, যদিও কংগ্রেসের সহায়তা নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন আম আদমি পার্টির আহ্বায়ক অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ওই নির্বাচনে (২০১৩) বিজেপি ও শিরোমণি আকালি দল মিলে পেয়েছিল ৩২টি আসন। মাত্র চারটি আসন কম থাকায় তারা সরকার গঠন করতে পারেনি। শতকরা হিসাবে তারা পেয়েছিল ৩১.১ শতাংশ ভোট। অন্যদিকে ২৯.৫ শতাংশ ভোট পেয়ে এবং ২৮টি আসন পেয়ে এএপি সরকার গঠন করতে পেরেছিল। কেননা কংগ্রেস আটটি আসন নিয়ে (২৪.৬ শতাংশ ভোট) কেজরিওয়ালকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু এএপি ও কংগ্রেস সমঝোতা স্থায়ী হয়নি। অরবিন্দ কেজরিওয়াল, যিনি মিডিয়ার কাছে 'মাফলারম্যান' হিসেবে পরিচিত ছিলেন, মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পেরেছিলেন মাত্র ৪৯ দিন। দুর্নীতিবিরোধী বিল তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় তিনি পদত্যাগ করেছিলেন। এখন সেই 'মাফলারম্যান'ই আবার দিল্লির মসনদে এলেন। আম আদমি পার্টির আবার ক্ষমতায় ফিরে আসা এখন নানা প্রশ্নের জন্ম দেবে। কেননা লোকসভার নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়ে নরেন্দ্র মোদি এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায়। শুধু তা-ই নয়, গেল বছর লোকসভা নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরও বেশ কয়টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বিজয়ী হয়ে তাদের 'বিজয়ের ধারা' অব্যাহত রেখেছিল। এতে করে একটা ধারণার জন্ম হয়েছিল যে নরেন্দ্র মোদি যে ভারতব্যাপী একটি ঢেউ বা 'ওয়েভ' সৃষ্টি করেছিলেন, সেই 'ঢেউ' এখনো অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু খোদ দিল্লিতে যাকে কিনা বলা হয় 'মিনি ইন্ডিয়া', সেখানেই একটা বড় ধাক্কা খেলেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৪ সালেও লোকসভা নির্বাচনে দিল্লির সাতটি আসনের সব কয়টিতে বিজেপি বিজয়ী হয়েছিল। আম আদমি পার্টি একটি আসনও পায়নি। তাহলে বিজেপির বিপর্যয় কেন ঘটল?
সূক্ষ্মভাবে দেখলে দেখা যাবে বিজেপির ভোটপ্রাপ্তি বেড়েছে কিছুটা। অর্থাৎ বিজেপির যে নির্দিষ্ট ভোটব্যাংক ছিল, তা খুব একটা বেশি বাড়েনি। তাদের নির্দিষ্ট ভোটার আছে। তবে ধস নেমেছে কংগ্রেস ভোটে। যারা এত দিন কংগ্রেসকে ভোট দিত, তারা এখন কংগ্রেসের ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। গরিব, মধ্যবিত্ত, দলিত মুসলমানরা এত দিন কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছে। এরাই কংগ্রেসের ভোটব্যাংক। এরা এবার আর কংগ্রেসকে ভোট দেয়নি। এরা এখন এএপিতে তাদের আস্থা খুঁজে পেয়েছে। ফলে দেখা গেছে, এএপির ভোটপ্রাপ্তি বেড়েছে; যা কিনা এখন অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে সরকার গঠন করতে সাহায্য করবে। একটা প্রশ্ন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষকই করবেন- তা হচ্ছে যেখানে লোকসভায় সব কয়টি আসন পেয়েছিল বিজেপি, সেখানে মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে বিজেপি সমর্থন হারাল কেন? এর অনেক কারণ আছে। প্রথমত, লোকসভা আর বিধানসভার নির্বাচন এক নয়। দুটো নির্বাচনের মেজাজ ভিন্ন ধরনের। লোকসভায় জাতীয় ইস্যু প্রাধান্য পায়। আর বিধানসভায় প্রাধান্য পায় স্থানীয় ইস্যু। ২০১৪ সালে ভারতব্যাপী একটি পরিবর্তনের ঢেউ ছিল। সেই পরিবর্তনে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার। মোদি নতুন একটা ইমেজ নিয়ে এসেছিলেন। সাধারণ মানুষ তাতে আস্থা রেখেছিল। আর কংগ্রেসের ব্যর্থতার কারণ ছিল কংগ্রেস নিজেই, ২০১৪ সালে কোনো 'নতুন রাজনীতি' উপহার দিতে পারেনি। কিন্তু দিল্লির বিধানসভার নির্বাচন একটি ভিন্ন বিষয়। এখানে মোদির চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে স্থানীয় ইস্যু। দ্বিতীয়ত, কিরণ বেদীকে বিজেপি সম্ভাব্য 'মুখ্যমন্ত্রী' হিসেবে তুলে ধরেছে। এতে সমস্যা হয়েছে একাধিক। দলের ভেতরে, যাঁরা স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁরা খুশি হননি। তাঁদের 'নীরবতা' এএপিকে সমর্থন জুটিয়েছে। উপরন্তু কিরণ বেদী দিল্লির বাসিন্দা নন। তিনি বহিরাগত। রাজনীতিতেও যথেষ্ট অভিজ্ঞ নন। দক্ষ পুলিশ অফিসার হিসেবে তাঁর নামডাক আছে। মানুষ তাঁকে চেনে দক্ষ ও যোগ্য অফিসার হিসেবে। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে যোগ দিয়ে তিনি নিজেকে 'সুবিধাবাদী রাজনীতির' সঙ্গেই জড়ালেন। তুলনামূলক বিচারে অরবিন্দ কেজরিওয়াল আরো বেশি যোগ্য ও গ্রহণযোগ্য ছিলেন। তৃতীয়ত, দিল্লির এক কোটি ৩০ লাখ ভোটারের একটা বড় অংশ নিম্ন-মধ্যবিত্ত, দলিত এবং মুসলমান। বিজেপি এদের কাছে যেতে পারেনি। কিরণ বেদীর ব্যর্থতা ছিল এখানেই যে তিনি এই শ্রেণির সমর্থন নিশ্চিত করতে পারেননি। এরা কংগ্রেসের পরিবর্তে এএপিকেই ভোট দিয়েছে। চতুর্থত, বিজেপির নীতি এবং নরেন্দ্র মোদির নীতি উচ্চবিত্ত, তথা ব্যবসায়ী শ্রেণিকে টার্গেট করে পরিচালিত হচ্ছে। বড় বড় ব্যবসার কথা বলেন মোদি। তার আগে পাশে নব্য ব্যবসায়ী শ্রেণির ভিড় বেড়েছে। এতে করে উপেক্ষিত থাকছে মধ্যবিত্ত ও গরিব শ্রেণি। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন ওবামার অনুষ্ঠানে মোদি যে স্যুটটি পরেছিলেন তার দাম প্রায় ১০ লাখ টাকা। লন্ডনের এক ফ্যাশন হাউস থেকে এটি তৈরি করা। মোদি 'গরিবের বন্ধু' নন, এমন একটা ইমেজ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যে। ফলে মধ্যবিত্ত ও দলিত শ্রেণি যে তাঁর ওপর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে, এটাই স্বাভাবিক। কিরণ বেদী নিজেও কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক। খুব স্বাভাবিকভাবেই দলিত শ্রেণি ধরে নিয়েছে, তিনিও মোদির মতো 'ধনীদের বন্ধু'। পঞ্চমত, বিজেপির সমর্থন নিয়ে 'সংঘ পরিবারের নেতৃত্বে ভারতজুড়ে 'ঘর ওয়াপসি' বা ধর্মান্তকরণ কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। অর্থাৎ ধর্মান্তকরণের (আবার মূল ধর্মে প্রত্যাবর্তন) নামে ক্রিশ্চিয়ান ও মুসলমানদের হিন্দু বা সনাতন ধর্মে দীক্ষিত করার কর্মসূচি ভারতজুড়ে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। খোদ ওবামার ভারত সফরের সময় তিনি পরোক্ষভাবে এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন। দিল্লির ভোটারদের একটা অংশ শিক্ষিত। তারা বিজেপির এই পরোক্ষ সমর্থনকে সহজভাবে নিতে পারেনি। ভোটের হিসাব-নিকাশে এর প্রভাব পড়েছে। ষষ্ঠত, অরবিন্দ কেজরিওয়ালের অনেক কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছে। যেমন- ক্ষমতায় গিয়ে তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি ও বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করে দিয়েছিলেন। এতে বস্তিবাসী গরিব মানুষ উপকৃত হয়েছিল। সাধারণ মানুষ এখনো মনে করে, তিনি এ ধরনের কর্মসূচি আরো নেবেন। তাতে উপকৃত হবে মধ্যবিত্ত, ধনীরা তাঁর কাছ থেকে সুবিধা পাবে না। ফলে ভোট পড়েছে বেশি। সপ্তমত, তাঁর দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচিতেও মানুষের আস্থা রয়েছে। ভোটারদের একটা বড় অংশই মনে করে ভারতে দুর্নীতি একটা বড় সমস্যা। এ সমস্যার কারণেই উন্নয়ন ঠিকমতো হচ্ছে না। আর রাজনীতিবিদদের একটা বড় অংশই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। এ ক্ষেত্রে এএপি একটি ব্যতিক্রম।
দিল্লির বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল প্রমাণ করল গেল বারের ত্রিশঙ্কু অবস্থা থেকে রাজ্যটি মুক্তি পেল। এবার তারা একটি স্থায়ী রাজ্য সরকার পাবে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কেজরিওয়াল কতটুকু সফল হবেন, তা শুধু আগামী দিনগুলোই বলতে পারবে। তবে ভারতব্যাপী এটা কোনো মডেল হবে না। অনেক রাজ্য আছে, যেখানে স্থানীয় দলগুলো রাজ্য সরকার পরিচালনা করে। এএপির আবির্ভাব ভারতব্যাপী তেমন কোনো প্রভাব ফেলেনি। অরবিন্দ কেজরিওয়াল একজন জাতীয় নেতা হিসেবেও স্বীকৃতি পাননি। লোকসভায় তাঁর দল কোনো আসন পায়নি। দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন তাঁকে পরিচিত করেছিল। সামান্য একজন সরকারি কর্মচারী থেকে আজ তিনি দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন দ্বিতীয়বারের মতো। তাঁর এই অর্জন একেবারে
কম নয়। তবে দিল্লির রাজ্য সরকার পরিচালনা করা তাঁর জন্য একটা সমস্যা হতে পারে। কেন্দ্র থেকে তিনি যদি আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতা না পান, তাহলে কোনো কর্মসূচিই তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করে দেওয়া কিংবা পরিবারপ্রতি মাসে বিনা মূল্যে ২০ হাজার লিটার পানি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করার কাজটি খুব সহজ হবে না। দিল্লির বিদ্যুৎ বিতরণটি বেসরকারি খাতে। এখানে বিদ্যুতের বিল অর্ধেক করলে অর্থের জোগান আসবে কোত্থেকে? দিল্লির পানির সরবরাহ আসে হরিয়ানা থেকে। এ ক্ষেত্রে পরিবারপ্রতি ২০ হাজার লিটার পানি বিনা মূল্যে সরবরাহের বিষয়টি অত সহজ হবে না। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি হেরে গেলে অন্তত একটি ক্ষেত্রে মোদি 'খুশি' হবেন এই ভেবে যে কংগ্রেসকে তিনি ও তাঁর দল মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে 'ক্ষমতা থেকে আরো দূরে' সরিয়ে রাখতে পেরেছেন। কংগ্রেসকে আরো জনবিচ্ছিন্ন করাই হচ্ছে মোদির মূল টার্গেট। এ ক্ষেত্রে আম আদমি এলেও কেন্দ্রে তাঁর সরকারের ওপর 'চাপ' কম পড়বে। তবে সেই সঙ্গে এটাও সত্য, দিল্লির পরাজয় মোদি-অমিত শাহ জুটির ওপর 'চাপ' আরো বাড়াবে। দলের ভেতরে রাজনাথ সিং, সুষমা স্বরাজ ও নীতিন গাদকাররা আরো শক্তিশালী হবেন। আদভানিও আবার সক্রিয় হতে পারেন। কংগ্রেসকেও এখন 'নতুন রাজনীতি' নিয়ে আসতে হবে। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বের ওপর 'চাপ' আরো বাড়ল। সামনে রয়েছে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভার নির্বাচন। এই দুই রাজ্যে বিজেপি ও কংগ্রেসের অবস্থান শক্তিশালী নয়। ফলে দিল্লির নির্বাচন এই দুই রাজ্যের আগামী নির্বাচনের জন্য অনেক অর্থ বহন করে।
Daily KALER KONTHO
15.02.15
0 comments:
Post a Comment