সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৯ ফেব্রুয়ারি
রাতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ঢাকা আসছেন। বিষয়টি ইতোমধ্যেই
নিশ্চিত হয়েছে। কয়েকজন ফিল্ম স্টার ও ব্যবসায়ী তার সঙ্গে আসছেন। তিনি একুশে
ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও তিনি দেখা করবেন। কিন্তু যে প্রশ্নটি
বাংলাদেশের অনেকেই করতে চাইবেন তা হচ্ছে, মমতার এই সফরের মধ্য দিয়ে কি একটি তিস্তা
চুক্তির পথ প্রশস্ত হবে? আদৌ কি একটি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে?
এখানে বলা ভালো, ২০১১ সালে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমাহন সিংয়ের ঢাকা
সফরের সময় মমতা ব্যানার্জির সফরসঙ্গী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তিনি
ঘুরে দাঁড়ান। জানিয়ে দেন তিনি ঢাকা যাবেন না। সেই থেকে তিস্তা পানিবণ্টন নিয়ে একটা
অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হয়েছে। সে কারণেই একটা প্রশ্ন থাকবে যে, মমতার এই সফরের মধ্য
দিয়ে বরফ আদৌ গলবে কিনা? মমতা কি শেষ পর্যন্ত পানিবণ্টনে রাজি হবেন? তার এই সফর কি
নরেন্দ্র মোদির মার্চে বাংলাদেশ সফরের পথ প্রশস্ত করবে?
এই নদীর পানিবণ্টন আন্তর্জাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে হতে হবে। মমতার ‘পাগলামো’র জন্য পানি-নাটক বন্ধ থাকতে পারে না। পানি দেওয়া, না দেওয়ার সঙ্গে তার বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশ পানি পাবে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। আর পশ্চিমবঙ্গ যদি বাধা দেয়, তার দায়ভার গিয়ে বর্তাবে ভারত সরকারের ওপর। এতে করে আন্তর্জাতিক আসরে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে থাকবে। ভারত বিশ্বসভায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের স্থায়ী পরিষদে স্থায়ী সদস্য হতে চায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশীর প্রতি তার আচরণ যদি ন্যায়সঙ্গত না হয়, যা জাতিসংঘের আইনে বলা আছে, তাহলে তার ‘নেতৃত্ব’ প্রশ্নের মুখে থাকবে। এমনিতেই ভারতের আচরণ নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলো এ ধরনের অস্বস্তিতে থাকে। এ ক্ষেত্রে তিস্তায় পানি না দিয়ে উজানে পানি প্রত্যাহার করা হলে, তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলকে ঠেলে দেবে মরুময়তার দিকে। পানির এভাবে যে সংকটের সৃষ্টি হবে, তা বাংলাদেশকে ঠেলে দেবে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিতিশীলতার দিকে।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তিস্তার
পানিবণ্টনের বিষয়টি আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। আমাদের
নীতিনির্ধারকরা যদি বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখেন তাহলে এ দেশ, বিশেষ কর উত্তরবঙ্গ
একটি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে থাকবে। এমনকি রাজনৈতিক
অস্থিতিশীলতা এতে করে বাড়বে। মনে রাখতে হবে, তিস্তায় পানিপ্রাপ্তি আমাদের ন্যায্য
অধিকার। আন্তর্জাতিক আইন আমাদের পক্ষে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্ব আমাদের
অধিকারকে নিশ্চিত করা। এ ক্ষেত্রে মমতা ব্যানার্জির আপত্তিÑ এটা আমাদের বিষয় নয়।
আমরা এটা বিবেচনায় নিতে চাই না। আমাদের অধিকার, যা আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, তা
নিশ্চিত করবে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার। এখানে বলা ভালো, সিকিম হয়ে ভারতের দার্জিলিং
ও জলপাইগুড়ি হয়ে পশ্চিমবঙ্গের ডুয়ারের সমভূমি দিয়ে চিলাহাটি থেকে চার-পাঁচ
কিলোমিটার পূর্বে বাংলাদেশের নীলফামারী জেলার উত্তর খড়িবাড়ির কাছে ডিমলা উপজেলার
ছাতনাই দিয়ে প্রবেশ করেছে তিস্তা নদী। ছাতনাই থেকে এ নদী নীলফামারীর ডিমলা,
জলঢাকা, লালমনিরহাট সদর, পাটগ্রাম, হাতীবান্ধা, কালীগঞ্জ, রংপুরের কাউনিয়া,
পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর হয়ে চিলমারীতে গিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে
মিশেছে। ডিমলা থেকে চিলমারী এ নদীর বাংলাদেশ অংশের মোট ক্যাচমেন্ট এরিয়া প্রায় ১
হাজার ৭১৯ বর্গকিলোমিটার। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ নদী কমিশন গঠনের পর
তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৮৩ সালের জুলাই মাসে দুদেশের মন্ত্রী
পর্যায়ের এক বৈঠকে তিস্তার পানিবণ্টনে শতকরা ৩৬ ভাগ বাংলাদেশ ও ৩৯ ভাগ ভারত এবং ২৫
ভাগ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু কোনো
চুক্তি হয়নি। পরবর্তীকালে ২০০৭ সালের ২৫, ২৬, ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে
বাংলাদেশ তিস্তার পানির ৮০ ভাগ দুদেশের মধ্যে বণ্টন করে বাকি ২০ ভাগ নদীর জন্য
রেখে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। ভারত সে প্রস্তাবে রাজি হয়নি। এখন যুক্ত হয়েছে
মমতার আপত্তি। বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবের ব্যাপারেই মমতার সম্মতি পাওয়া যায়নি।
এখানে আরও একটা বিষয় বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তিস্তার পানিবণ্টনে সিকিমকে জড়িত
করার প্রয়োজনীয়তা পড়েছে। কেননা সিকিম নিজে উজানে পানি প্রত্যাহার করে বাঁধ দিয়ে
বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। ফলে তিস্তায় পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরবঙ্গে কৃষকদের কাছে তিস্তার পানির চাহিদা বেশি। সেচকাজের জন্য
তাদের প্রচুর পানি দরকার। এটা মমতার জন্য একটি ‘রাজনৈতিক
ইস্যু’।
তিস্তা একটি আন্তর্জাতিক নদী। এ
ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এককভাবে পানি প্রত্যাহার করতে পারে না। আন্তর্জাতিক নদীর পানি
ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের আন্তর্জাতিক আইন সমিতির হেলসিংকি নীতিমালার ৪ ও ৫
অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভুক্ত রাষ্ট্র, অভিন্ন নদীসমূহ ব্যবহারের
ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজনকে বিবেচনায় নেবে। এখন
পশ্চিমবঙ্গের পানি প্রত্যাহার বাংলাদেশের ‘অর্থনৈতিক
ও সামাজিক প্রয়োজন’কে বিবেচনায়
নেয়নি। হেলসিংকি নীতিমালার ১৫নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রত্যেকটি তীরবর্তী রাষ্ট্র
তার সীমানায় আন্তর্জাতিক পানিসম্পদের ব্যবহারের অধিকার ভোগ করবে যুক্তি ও ন্যায়ের
ভিত্তিতে। কিন্তু এই ‘যুক্তি ও
ন্যায়ের ভিত্তি’টি উপেক্ষিত
থাকে যখন পশ্চিমবঙ্গ বাংলাদেশকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। ১৯৯২ সালের
ডাবলিন নীতিমালার ২নং নীতিতে বলা হয়েছে, পানি উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় অবশ্যই সবার
অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। তিস্তার পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটা হয়নি। ১৯৯৭ সালে
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ‘জলপ্রবাহ
কনভেনশন’ নামে একটি
নীতিমালা গ্রহণ করে। এই নীতিমালার ৬নং অনুচ্ছেদে পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘যুক্তি ও ন্যায়পরায়ণতা’র কথা বলা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের
ব্যবহার অর্থাৎ এককভাবে তিস্তার পানির ব্যবহার এই ‘যুক্তি
ও ন্যায়পরায়ণতা’র ধারণাকে
সমর্থন করে না। আমরা আরও আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যা দিতে পারব, যেখানে বাংলাদেশের
অধিকারকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে পরিবেশ সংক্রান্ত জীববৈচিত্র্য কনভেনশনের
১৪নং অনুচ্ছেদ, জলাভূমি বিষয়ক রামসাগর কনভেনশনের ৫নং অনুচ্ছেদ প্রতিটি ক্ষেত্রে
পরিবেশের প্রভাব এবং উদ্ভিদ ও প্রাণীসমূহের সংরক্ষণের যে কথা বলা হয়েছে, তা রক্ষিত
হচ্ছে না। এখানে সমস্যাটা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের। ভারতের
ফেডারেল কাঠামোয় রাজ্য কিছু সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে। কিন্তু কোনো রাজ্য (এ ক্ষেত্রে
পশ্চিমবঙ্গ) এমন কিছু করতে পারে না, যা আন্তর্জাতিক আইনের বরখেলাপ ও আন্তর্জাতিক আইন
লঙ্ঘন করে। সমস্যাটা ভারতের। পশ্চিমবঙ্গকে আশ্বস্ত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয়
সরকারের। আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই আমাদের পানির হিস্যা নিশ্চিত করতে চাই।
0 comments:
Post a Comment