রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

তিনি এলেন, দেখলেন কিন্তু জয় করতে পারলেন কি?

ভারতের ৬৮ বছরের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো একজন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভারতের 'প্রজাতন্ত্র দিবস' অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে শুধু একটি ইতিহাসই সৃষ্টি করলেন না, বরং ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নতুন করে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাওয়া এবং দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব বৃদ্ধি এবং একই সঙ্গে চীন-ভারত দ্বন্দ্বের ফলে ওবামার ভারত সফর এখন ভারতের 'অবস্থান'কে শক্তিশালী করল। একই সঙ্গে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদে ভারতের প্রার্থিতাকে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে নতুন একটি উচ্চতায় নিয়ে গেল। বেশ কটি চুক্তি হয়েছে। বিশেষ করে বেসামরিক পারমাণবিক সহযোগিতা চুক্তিটির কথা বলা যায়। ২০০৮ সালে বিগত ইউপিএ সরকার চুক্তিটি করলেও তা আটকে ছিল। এখন এই চুক্তির কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারতে একটি পারমাণবিক চুলি্ল বসাবে, যা বিদ্যুৎ উৎপাদন কাজে ব্যবহার হবে। এতে ব্যয় হবে ৭৫০ কোটি টাকা। একটি শিক্ষা তহবিলও গঠন করা হবে। ভারতে সমরাস্ত্র তৈরিতে প্রযুক্তি সরবরাহেও একটি চুক্তি হয়েছে। এতে ভারত ছোট আকারের 'রাভেন মিনি' নামে ড্রোন বিমান তৈরি করবে, যা নজরদারি কাজে ব্যবহৃত হবে। বাণিজ্য ১০০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে নিয়ে যাওয়ার চুক্তিও হয়েছে। ওবামার এই ভারত সফর ও ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক এখন অন্যতম আলোচিত বিষয়। এ অঞ্চলের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আগ্রহ বেড়েছে বিভিন্ন কারণে। প্রথমত, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের নৌবাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থকে আঘাত করতে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, ২০১৪ সালেই আফগানিস্তান থেকে যুদ্ধরত মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে সেখানে যে 'শূন্যতার' সৃষ্টি হয়েছে সেই 'শূন্যতা' পূরণের জন্য দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি 'শান্তিরক্ষী' বাহিনী গঠন করা, যারা ২০১৫ সালে মার্কিন সৈন্যদের পরিবর্তে আফগানিস্তানে শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত হবে। তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ইসলামিক কট্টরপন্থীরা দক্ষিণ এশিয়ায় বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে নতুন করে একটি ঘাঁটি গড়তে পারে। সে কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে নিয়ে একটি সন্ত্রাসবিরোধী মোর্চা গঠন করা প্রয়োজন। চতুর্থত, এ অঞ্চলে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে বিপুল জ্বালানিসম্পদ রয়েছে (গভীর সমুদ্রে)। মার্কিনি আইওসির এ ব্যাপারে আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ভূরাজনৈতিক অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের জন্য এ কারণেই যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে অবস্থান করে খুব সহজেই মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা যায় এবং বাংলাদেশের নিকট প্রতিবেশী চীনের রাজনৈতিক উত্থান-পতনে প্রভাব খাটানো সম্ভব। হিলারি ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফরের পরপরই বাংলাদেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গ্র্যান্ড স্ট্রাটেজি রচিত হয়েছিল। এ লক্ষ্যেই যুক্তরাষ্ট্র আকসা চুক্তি করতে যাচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ তার সমর্থনের কথা জানায়নি। বঙ্গোপসাগরে মার্কিন রণতরীর দীর্ঘ উপস্থিতি, বাংলাদেশকে তার স্ট্রাটেজিক কনসেপ্টের আওতায় নিয়ে আসা, এমনকি মালদ্বীপের সঙ্গে একই মডেলে অন্য একটি চুক্তির অর্থ একটাই_ চীন যে এ অঞ্চল ঘিরে 'মুক্তার মালা' নীতি গ্রহণ করছে, তার বিরুদ্ধে একটা অ্যালায়েন্স গড়ে তোলা। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালি হয়ে ভারত মহাসাগর পার হয়ে অ্যারাবিয়ান গলফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, এ পথের নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। চীন যে তেল আমদানি করে তার ৮০ ভাগ এই মালাক্কা প্রণালি হয়ে চীনে যায়। তাই সঙ্গত কারণেই চীনের জন্য তার ভারত মহাসাগরে উপস্থিতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গাওদারে চীনা নৌবাহিনীর একটি ছোট্ট ইউনিটও থাকবে, যা কি না ভারত মহাসাগরের সব নৌ মুভমেন্ট মনিটর করবে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে গাওদার বন্দরের কৌশলগত গুরুত্ব আরো বেড়েছে। স্ট্রেইট অব হরমুজ থেকে গাওদারের দূরত্ব মাত্র ১৮০ ন্যাটিকাল মাইল। আর ইরান সীমান্ত রয়েছে মাত্র ৭২ কিলোমিটার দূরে। চীন প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে গাওদার সমুদ্রবন্দর উন্নয়নে। চীন তার দক্ষিণাঞ্চলের ইউনান প্রদেশে মধ্য এশিয়ার গ্যাস ওই গাওদার বন্দর দিয়েই পাইপলাইনের মাধ্যমে নিয়ে যেতে চায়। চীন শ্রীলংকার হামবানটোটায় একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে। তামিল টাইগারদের সঙ্গে যুদ্ধে চীন শ্রীলংকা সরকারকে সমর্থন করেছিল। মিয়ানমারে রয়েছে চীনের নৌবাহিনীর একটি রাডার স্টেশন। সিটওয়েসহ আরো বেশ কটি বন্দরে রয়েছে চীনা উপস্থিতি। ভারত মহাসাগরভুক্ত অঞ্চলে চীন যে বিশাল প্রতিরক্ষা গড়ে তুলছে তা মূলত তার জাতীয় স্বার্থকে সামনে রেখেই করা হয়েছে। চীনের এই জাতীয় স্বার্থকে আঘাত ও চীনের নৌবাহিনীর ভূমিকাকে খর্ব করার উদ্দেশ্য নিয়েই যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়ে এ অঞ্চলে একটি মোর্চা গড়ে তুলছে, যাতে বাংলাদেশকে অন্যতম একটি ভূমিকায় দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। এখন ওবামার ভারত সফরের পর যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী ভূমিকা কী হয়, সেদিকে লক্ষ্য থাকবে অনেকের। শ্রীলংকায় সরকার পরিবর্তন হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজাপাকসে চীনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল ছিলেন এবং শ্রীলংকাকে অতিমাত্রায় চীনের ওপর নির্ভরশীল করে তুলেছিলেন। এই নির্ভরশীলতা একটি নিরাপত্তা সংকট তৈরি করেছিল, যা ভারত খুব ভালো চোখে নেয়নি। এখন শ্রীলংকার নয়া সরকার বলছে তারা শ্রীলংকা-চীন সম্পর্ক নতুন করে পুনর্বিবেচনা করবে। এমনকি শ্রীলংকায় চীনের বিনিয়োগ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন নয়া প্রধানমন্ত্রী। ফলে শ্রীলংকায় সরকার পরিবর্তনে 'ভারতের একটি ভূমিকা' নিয়ে কথা উঠেছে। চীনবিরোধী কথাবার্তা বলার মধ্য দিয়ে শ্রীলংকা-চীন সম্পর্ক এখন প্রশ্নের মুখে থাকল। অন্যদিকে শ্রীলংকা-ভারত সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠল। এটা স্পষ্ট যে, এ অঞ্চলে, বিশেষ করে শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান কিংবা বাংলাদেশে চীনের একটি 'ভূমিকা'র ব্যাপারে ভারতের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দারা খুব খুশি ছিলেন না। ভারত চীনের এই ভূমিকাকে আরো সংকুচিত করতে চায়। অনেকের স্মরণ থাকার কথা, গেল বছরের মাঝামাঝি মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে প্রথম বিদেশ সফরে ভুটানে গিয়েছিলেন। তখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে জানা গিয়েছিল, চীন ভুটানে দূতাবাস খুলতে চায়, এ ব্যাপারে ভারতের আপত্তি রয়েছে। ভারতের নীতিনির্ধারকরা একে নিরাপত্তা দৃষ্টিকোণের আলোকে দেখেছিলেন। অরুণাচল নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে দ্বন্দ্ব বেশ পুরনো। চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফর ও গুজরাটে সরাসরি চীনা প্রেসিডেন্টকে সংবর্ধনা জানানোর পরও চীন অরুণাচল রাজ্যের ওপর থেকে তার 'দাবি' প্রত্যাহার করে নিয়েছে, তা বলা যাবে না। এর অর্থ হচ্ছে নতুন আঙ্গিকে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব তৈরি হচ্ছে। এমনকি কক্সবাজারের অদূরে সোনাদিয়ায় যে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করার কথা ছিল চীনের, তাও এখন বাতিল করা হয়েছে। এখন এটা নির্মাণ করা হবে পায়রা বন্দরে। এখানে নিরাপত্তার প্রশ্নটি উঠেছে। ভারত চায় না এ অঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক প্রভাব বৃদ্ধি পাক। এখানেই তাই ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এক ও অভিন্ন। যুক্তরাষ্ট্রও চায় না এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব বৃদ্ধি পাক। ওবামার ভারত সফরের পেছনে এ উদ্দেশ্যটিও কাজ করেছে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে। প্রশ্ন থাকবেই, ওবামার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে কে লাভবান হলো_ ভারত না যুক্তরাষ্ট্র? ওবামাকে ভারতে নিয়ে আসার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদি কৃতিত্ব দাবি করতেই পারেন। এতে তার 'মেক ইন ইন্ডিয়া' কর্মসূচির কিছুটা হলেও অগ্রগতি হবে। এর আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি 'ভাইব্রান্ট গুজরাট' সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর মধ্য দিয়ে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা ভারতে আসবেন। এখন বেসামরিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় এবং তাতে মার্কিনি বিনিয়োগকারীদের জন্য রক্ষাকবচ থাকায়, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বাড়াল। ওবামা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী পদে ভারতের প্রার্থিতা সমর্থন করে ভারতকে কাছে টানার একটি উদ্যোগ নিলেন বটে। কিন্তু তিনি যদি ভারতকে চীনের বিরুদ্ধে 'ব্যবহার' করেন তাহলে ভুল করবেন এবং ভারতও যদি এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে সঙ্গে নিয়ে চীনবিরোধী একটি অ্যালায়েন্স গড়ে তোলে তাও এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য কোনো মঙ্গল বয়ে আনবে না। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে উত্তেজনা দিন দিন বাড়ছে। এখানে 'সীমিত যুদ্ধে'র সম্ভাবনা উজ্জ্বল হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এ অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য চীন ও ভারত একটি ফ্যাক্টর। এদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, একে অন্যের ওপর কর্তৃত্ব করার প্রবণতা শুধু স্থিতিশীলতাকেই বিপন্ন করবে না, বরং 'নয়া স্নায়ুযুদ্ধে'র সম্ভাবনাকে আরো উস্কে দেবে। ওবামা তার সফর সংক্ষিপ্ত করে ফিরে গেছেন। ভারতের 'বাম'রা তার এ সফরে খুশি হননি। তারা বিক্ষোভ করেছেন। তাদের যুক্তি, ওবামার 'যুদ্ধবাজ নীতি'কে ভারত সমর্থন করতে পারে না। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী নীতির অংশ হতে পারে না। ওবামা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই এলেন। তার স্ত্রীর জন্য ১০০ বেনারসি শাড়ি গ্রহণ করে কিংবা রাইসিনা হিলের নৈশভোজে গলৌটি কাবাব খেয়ে ভারতবাসীর মন জয় করতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। Daily JAI JAI DIN 02.02.15

0 comments:

Post a Comment