রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

শুধুমাত্র তিস্তা চুক্তিই নয়

বহুল আলোচিত মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফর শেষ হয়েছে গেল সপ্তাহে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সফরের গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি। কেননা ভারত আমাদের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করবে- এর পুরোটাই নির্ভর করছে মমতা ব্যানার্জির ওপর। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একটি চুক্তি করতে চাইলেও মমতার আপত্তির কারণে তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তিটি হতে পারেনি। যদিও যতদূর জানা যায়, একটা খসড়া চুক্তিতে উভয় দেশ রাজি হয়েছিল। কিন্তু মমতার আপত্তির কারণে চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। এখন চুক্তিটি আদৌ স্বাক্ষরিত হবে কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। সে কারণেই মমতার ঢাকা সফরের সময় আমাদের প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। আমরা ধারণা করেছিলাম, মমতা আমাদের একটা 'কমিটমেন্ট' করে যাবেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। শুধু বলে গেছেন, আস্থা রাখতে। এ আস্থা রাখার কথা বলা একটি কূটনৈতিক ভাষা। এতে করে সমস্যার সমাধান করা যাবে না। আমরা এটাও লক্ষ্য করেছি মমতার ঢাকা সফর কলকাতায় একটি মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তার ঢাকা সফরের পর কলকাতার জনপ্রিয় দৈনিক আনন্দবাজারে মন্তব্য করা হয়েছিল এভাবে- 'পশ্চিমবঙ্গের পাওনা শূন্য'। এর অর্থ পরিষ্কার, তিস্তায় পানিবণ্টন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের একটা আপত্তি রয়েছে। সুতরাং অদূর ভবিষ্যতে তিস্তা চুক্তি হবে- এটা আশা করতে পারছি না। তবে শুধু তিস্তার পানি বণ্টনই নয়, আরও বেশ কিছু ইস্যু রয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের মাঝে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে ভারতের সাবেক মনমোহন সিং সরকারের সঙ্গে বর্তমান নরেন্দ্র মোদি সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পার্থক্য নেই। কেননা মোদি সরকার ক্ষমতায় এসে অবধি একটি সমস্যাও সমাধানের উদ্যোগ নেয়নি। বরং সমস্যাগুলো যেভাবে ছিল, সেভাবেই রয়ে গেছে। এটা ঠিক, মোদি দায়িত্ব নেয়ার এক মাসের মাথায় জুলাই মাসে (২০১৪) তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন। নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুবার সাক্ষাৎ হয়েছে। কিন্তু দ্বিপক্ষীয় কোনো আলোচনা হয়নি। তবে বাংলাদেশের মনোভাব বুঝতে সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফর যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার সফরের সময় কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল বটে; কিন্তু তাতে করে বাংলাদেশের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হয়েছে, সে প্রশ্ন থাকবেই। বাংলাদেশ ছোট দেশ হতে পারে। কিন্তু সম্ভাবনার দেশ। বাংলাদেশে ভারতের প্রচুর স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের বিশাল বাজার। ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশে ভারতের বিক্রি করার অনেক কিছু আছে এবং ভারত সেটা করছেও। উপরন্তু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের একটা পথ দরকার। সেটাও তারা পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রাপ্তির খাতা শূন্য। আমাদের পণ্যের যে বাজার সৃষ্টি হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে, তা এখন ভারতীয় পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। ফলে বাংলাদেশ তার বাজার হারাবে। এমনিতেই বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। আমরা বারবার এ কথাগুলো বলছি। যখন মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখনও বলেছি। এরপর যখন সুষমা এলেন, তখনও আমরা বললাম। কিন্তু তাতে এতটুকু দৃষ্টি দেয়নি ভারত। অথচ আমরা সুষমা স্বরাজকে ও পরে মমতাকে যেভাবে সম্মান দিলাম, তা সমসাময়িককালে বিরল একটি ঘটনা। এখন ভয় হচ্ছে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফর নিয়ে, ওই সফরটা না-জানি কেমন হয়! ভারত বড় দেশ। আমাদের উন্নয়নে ভারত একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু ভারতীয় নেতৃবৃন্দ সব সময় তাদের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখেন। ছোট্ট একটি ঘটনা- প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের চাহিদার কথা বলেছিলেন। অথচ তিনি তিস্তার পানির অভাবে বৃহত্তর রংপুরের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের কথা একবারও বললেন না। পানির চেয়ে মমতার কাছে ইলিশই বড় হয়ে দেখা দিল। ঘটনাটি ছোট; কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ২ মার্চ ভারতের নয়া পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামনিয়াম জয়শংকর ঢাকা আসছেন। এ সফর একটি রুটিন ওয়ার্ক হলেও এই সফরে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদির মনোভাব জানাবেন ঢাকাকে। তার ওই সফরে মোদির ঢাকা সফরও চূড়ান্ত হতে পারে। জয়শংকরের সফরের এই সুযোটাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। আমাদের সমস্যাগুলো আবারও আমরা তুলে ধরতে পারি জয়শংকরের কাছে। বিশেষ করে, তিস্তা পানিশূন্য হওয়ায় আমরা যে পরিবেশগত মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, এ বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারি। যাতে করে মোদির ঢাকা সফরের সময় তার কাছ থেকে একটি আশ্বাসের বাণী আমরা শুনতে পারি। মমতা ব্যানার্জি যাতে রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করেন, সে ব্যাপারে আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করতে পারি। কেন্দ্রীয় সরকার মমতা ব্যানার্জির ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সেইসঙ্গে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে যখন প্রচুর বৃষ্টি হয় উজানে, অর্থাৎ সিকিমে, সেখানে জলাধার নির্মাণ করে পানি ধরে রাখা যায় কিনা সে ব্যাপারে একটি যৌথ কমিশন গঠন করার প্রস্তাব রাখতে পারি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি ও পানি ঘাটতি মেটাতে যৌথ ব্যবস্থাপনার কথা বলেছেন। জয়শংকরের ঢাকা সফরের সময়ও আমরা এ ব্যাপারটি পুনর্ব্যক্ত করতে পারি। দক্ষিণ এশিয়ার মোট আয়তনের ৭২ ভাগ ভারতের। সুতরাং ভারতকে বাদ দিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। একটি স্থিতিশীল দক্ষিণ এশিয়া তিনি চান। কিন্তু বাস্তবতা বলে ভিন্ন কথা। প্রধানমন্ত্রী মোদি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে ফোন করে বিশ্বকাপে পাকিস্তানের ক্রিকেট দলের সাফল্য কামনা করলেও এই দুটো দেশ এরই মধ্যে এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। ওবামার জানুয়ারিতে ভারত সফরের পরপরই ভারত পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য অগ্নি-৫ মিসাইল উৎক্ষেপণ করেছে। এটি তাদের আধুনিক সংস্করণ। এ অগ্নি-৫ এর ব্যাপ্তি সুদূর চীন পর্যন্ত। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে বিবেচনায় নিচ্ছে না। ভারতের টার্গেট এখন চীন। অর্থাৎ চীনের কর্তৃত্ব কমানো। অগ্নি-৫ নিক্ষেপের পরদিনই পাকিস্তান তার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র 'রাদ' বা 'ব্রজ' এর পরীক্ষা চালিয়েছে। এর আগে পাকিস্তান 'হাতাফ' নামে পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। ফলে দেশ দুইটি আবারও এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় নিয়োজিত হলো। মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানের কোনো জায়গা নেই। যদিও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল, দুই দেশের সম্পর্ক বাড়বে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলো গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। এরই মধ্যে তিনি ভুটান, নেপাল সফর করছেন। এ মার্চেই তিনি যাবেন শ্রীলঙ্কায়। তিনি জাফনায়ও যাবেন। মার্চে বাংলাদেশেও আসতে পারেন। চীনকে গুরুত্ব দেয়ার পেছনে কাজ করছে তার ব্যবসায়িক নীতি। তিনি চান বিনিয়োগ। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোই হবে মোদি সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার। মোদির পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করলে এটা বলা যায়, মোদি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছেন। একদিকে চীন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গেও সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক রক্ষা করে মোদি তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন। রাশিয়া থেকে তিনি অস্ত্র কিনছেন। ইউক্রেন ইস্যুতে তিনি রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করেছেন। (এ প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থানও অনেকটা ভারতের মতো)। রাশিয়া ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে ভারত ব্রিকস ব্যাংক গড়ে তুলছে, যা কিনা হবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প 'আরেকটি বিশ্বব্যাংক'। বাংলাদেশও এ ব্যাংকের ব্যাপারে আগ্রহী। সুষমা স্বরাজের বেইজিং সফরের সময় সেখানে ত্রিদেশীয় একটি 'মিনি সামিট' হয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সেখানে মিলিত হয়েছেন। ফলে বোঝাই যায়, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের ব্যবসায়িক ও পারমাণবিক সম্পর্ক গড়ে তুললেও চীন ও রাশিয়াকে কাছে রাখতে চায়। এখন আগামী দিনগুলোই প্রমাণ করবে এ সম্পর্ক কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হয়। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নির্ধারণ করবে। সঙ্গত কারণেই বিশ্বের বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ থাকবে এ অঞ্চলের ব্যাপারে। যদিও জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টারও যুক্তরাষ্ট্র। জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে) তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। এদিকে চীনের নয়া প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং যে নয়া সিল্ক রুটের কথা বলছেন, তা 'অন্য চোখে' দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনের প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক এমনি এক পরিস্থিতিতে মোদি চাচ্ছেন দক্ষিণ এশিয়ায় তার অবস্থানকে শক্তিশালী করতে। একইসঙ্গে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোও হবে তার অন্যতম স্ট্র্যাটেজি। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে এ কারণেই গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে পারে না। শুধু তিস্তার পানিবণ্টনই নয়, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, টিপাইমুখ বাঁধ, শুল্ক, অশুল্ক বাধা, ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তার জাতীয় স্বার্থকে বিবেচনায় নিয়ে ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। ২ মার্চ ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের সময় বাংলাদেশ পক্ষের উচিত হবে এই অবস্থান স্পষ্ট করা। Daily ALOKITO BANGLADESH 01.03.15

0 comments:

Post a Comment