রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটা ছবি : প্রশ্ন অনেক

একটি ছবি ছাপা হয়েছে দৈনিক যায়যায়দিন পত্রিকায় ২২ ফেব্রুয়ারি। ১১ পাতায় যে ছবিটি ছাপা হয়েছে, তা অনেক কথা বলে। আর এ ছবিটি ছাপা হয়েছে এমন একটি সময় যখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তার ঠিক একদিন আগে ঢাকা সফর শেষ করে কলকাতায় ফিরে গেছেন। প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে এই ছবিটির সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের একটা যোগসূত্র আছে। ছবিটি পানিশূন্য তিস্তা নদীর। কাউনিয়া (রংপুর) থেকে যায়যায়দিনের প্রতিবেদক আমাদের জানাচ্ছেন তিস্তা মরা খালে পরিণত হয়েছে। কোথাও হাঁটু পানি, কোথাও তিন-চার ইঞ্চি পানি রয়েছে। আর এ ছবির সঙ্গে মমতা ব্যানার্জির যোগসূত্রতা এ কারণেই যে শুধু তার একগুঁয়েমির কারণেই তিস্তা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়নি। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর যখন ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন, তখন তিস্তা চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মমতার আপত্তি ও ঢাকায় ওই সময় না আসার কারণে চুক্তিটি শেষ পর্যন্ত আর স্বাক্ষরিত হয়নি। এমনকি ফেব্রুয়ারি মাসে মমমতা ব্যানার্জির ঢাকা সফরের সময়ও চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে আমরা আশার কথা তেমন একটা শুনিনি। শুধু বলা হয়েছে 'আস্থা' রাখার জন্য। প্রশ্ন হচ্ছে_ এই আস্থাটা আমরা আর কতদিন ধরে রাখব? যেখানে বৃহত্তর রংপুর জেলার ২৫টি উপজেলার ৬৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল সেচের অভাবে হুমকির মুখে পড়েছে, যেখানে ফসল উৎপাদন ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে, সেখানে আমরা আর কতদিন তিস্তা চুক্তির জন্য অপেক্ষা করব। ২০১১ সালেই দুই দেশ (ভারত ও বাংলাদেশ) নীতিগতভাবে একটি চুক্তিতে উপনীত হতে রাজি হয়েছিল, সেখানে শুধু মমতা ব্যানার্জির আপত্তির কারণেই কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। তখন তিস্তা যখন পানি 'শূন্য', যখন তিস্তাবাসীর হাহাকারের ছবি পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে, তখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নতুন করে প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অনেকেই স্মরণ করতে পারেন গেল বছর মোদি নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করার পর পরই তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে জুলাই মাসে ঢাকায় পাঠিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে তখন তিনি বাংলাদেশের সমস্যাগুলো জেনে গেছেন। কিন্তু তিনিও কোনো উদ্যোগ নেননি সমস্যা সমাধানের। তবে তার এই সফরে বেশ কটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বলাই বাহুল্য বিভিন্ন ইস্যুর ক্ষেত্রে ভারতীয় যে নীতিগত সিদ্ধান্ত তাতে বাংলাদেশের স্বার্থ খুব বেশি রক্ষিত হয়নি। বাস্তবতা হচ্ছে_ তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তির ব্যাপারে কোনো 'কমিটমেন্ট' ছিল না। সীমান্ত হত্যা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেই। তবে অ্যারাইভাল ভিসা প্যাকেজ ঘোষিত হয়নি। অশুল্ক বাণিজ্য বাধা অপসারণের কিছু হয়নি। ভারতে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল প্রচারে কোনো উদ্যোগের কথাও বলে যাননি সুষমা। এগুলো সবই বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল। তবে ওই সময় খালেদা-সুষমা বৈঠকের মধ্যদিয়ে প্রমাণিত হয়েছিল মোদি সরকার খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশের চলমান রাজনীতিতে একটি ফ্যাক্টর বলে মনে করেন। এমনকি খালেদা জিয়া স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সুষমা স্বরাজের সঙ্গে দেখা করার মধ্যদিয়ে ভারত যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি 'ফ্যাক্টর' তা বিএনপিও স্বীকার করে নিয়েছিল। তবে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুরু করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন প্রতিটি দেশ বাংলাদেশে 'সব দলের অংশগ্রহণ'-এ একটি নির্বাচনের কথা বলেছে, সেখানে সুষমা স্বরাজ এ ধরনের কোনো কথা বলেননি। বরং বলা হয়েছিল 'অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান জনগণকেই করতে হবে।' এতে সরকারের প্রতি মোদি সরকারের একটি প্রচ্ছন্ন সমর্থনই প্রকাশ পায়। সুষমার সঙ্গে আলাপে 'দেশে কোনো গণতন্ত্র নেই'_ বেগম খালেদা জিয়ার এ ধরনের উক্তির একটা ব্যাখ্যা হতে পারে এরকম_ বিএনপি চায় ভারত বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করুক! সরকারি দলের পক্ষ থেকে তখন এরকম একটি অভিযোগই উঠেছিল। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি দৈন্য। আমরা আমাদের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে পারি না। আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় বিদেশিদের। এবারই যে এরকমটি হলো তা নয়। এর আগেও হয়েছে। সুষমার এই সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নয়া দিলি্ল সফরও নিশ্চিত হয়েছিল। এটা প্রধানমন্ত্রীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে সুষমার ওই সফর বাংলাদেশের স্থিতিশীল রাজনীতির জন্য কোনো ম্যাসেজ ছিল না। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অবরোধ পার করেছে ৫১ দিন। এই পরিস্থিতি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের যে স্বস্তি দেবে না, এটা বলাই বাহুল্য। এক কথায় সুষমা স্বরাজের এই সফরের মধ্যদিয়ে বড় কিছু অর্জিত হয়নি। আগামী ৫ বছর বিজেপি ক্ষমতায় থাকবে। অর্থাৎ ২০১৯ সাল পর্যন্ত। এই সময়সীমায় তিস্তা চুক্তি হবে কিংবা সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সংবিধান কবে নাগাদ সংশোধন হবে, এটা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিস্তার পানি বণ্টন পশ্চিমবঙ্গে একটি রাজনৈতিক ইস্যু। মমতা ব্যানার্জি এটা হাতছাড়া করতে চাইলেন না। কেননা ২০১৬ সালে সেখানে বিধান সভার নির্বাচন। নির্বাচনে পানির বিষয়টি তিনি দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করবেন। আর সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের প্রধান অন্তরায় ইতোমধ্যে অপসারিত হয়েছে। সুতরাং বিজেপির পক্ষে এটি লোকসভায় পাস করিয়ে আইনে পরিণত করা সহজ হবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো কিংবা সীমান্ত হত্যা বন্ধের বিষয়টি একান্তই মানসিকতার ব্যাপার। ভারতের ব্যুরোক্রেসি বাংলাদেশকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখে না। ফলে রাজনৈতিক নেতারা (সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং) সীমান্তে হত্যাকা- হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেও হত্যাকা- হচ্ছে। বন্ধ হচ্ছে না। একটা কথা এখানে বলা দরকার। সুষমা স্বরাজকে যে সম্মান বাংলাদেশ দিয়েছিল তাতে ভারতের উচিত হবে বাংলাদেশের সমস্যাগুলোর ব্যাপারে আরো ইতিবাচক হওয়া। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ত্রিপুরায় ১০ হাজার টন খাদ্যশস্য পাঠানোর অনুমোদন দিয়েছে। কলকাতা থেকে আশুগঞ্জ হয়ে আগরতলা গেছে এই খাদ্যশস্য। এর জন্য রাস্তাঘাট ও ব্রিজও বাংলাদেশ সংস্কার করে দিয়েছে। বাংলাদেশের এই 'উদ্যোগ'-এর প্রতিদান হিসেবে ভারত আমাদের কী দেবে সেটাই দেখার বিষয় এখন। বাংলাদেশ শুধু দেবে, আর ভারত তার স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করবে, এই মানসিকতায় ভারতের নেতারা যদি পরিবর্তন না আনেন তাহলে দু'দেশের সম্পর্ক উন্নত হবে না। সুষমা আর মমতা এলেই কিন্তু তারা জয় করে যেতে পেরেছেন বলে মনে হয় না। অনেক প্রশ্ন তারা রেখে গেছেন তাদের ওই সফরের মধ্যদিয়ে। মিডিয়া এবং জাতীয় নেতারা যেভাবে তাদের এই সফরকে চিহ্নিত করেছেন এবং অতি উৎসাহ ভাব প্রকাশ করেছেন, তা কোনো ভালো খবর নয়। এতে আমাদের দৈন্যই প্রকাশ পেয়েছে। কিছুদিন আগে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসেছিলেন। তাকে নিয়ে এত নাচানাচি হয়নি। অথচ আমাদের অর্থনৈতিক কূটনীতিতে জাপান কিংবা চীনের অবস্থান ভারতের চেয়ে বেশি। এমনকি বেগম জিয়ার সব প্রটোকল ভেঙে হোটেলে গিয়ে সুষমার সঙ্গে দেখা করা নিয়েও কথা উঠেছিল। খোদ ভারতীয় পত্রিকায় এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তখন। ভারত আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু এখন সবাই মিলে যদি ভারতকে তোষামোদ করে চলি তাহলে ভারতের ব্যুরোক্রেসি এ সুযোগ নেবেই। ভারতকে সমমর্যাদার দৃষ্টিতে দেখতে হলে, সেভাবে আচরণ করাই মঙ্গল। আমরা তা করিনি। আমরা বার বার বলে আসছি ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় আমাদের শক্ত অবস্থানে যেতে হবে। এটা ঠিক ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে ভারত এক ধরনের নীরবতা অবলম্বন করেছিল। এই নীরবতাই সমর্থনের শামিল। বাংলাদেশে ভারতের প্রচুর স্বার্থ রয়েছে। বাংলাদেশ ভারতের বিশাল বাজার। ১৬ কোটি দেশের এই বাংলাদেশে ভারতের বিক্রি করার অনেক কিছু আছে এবং ভারত তা করছে। উপরন্তু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যাওয়ার জন্য বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে তাদের একটা পথ দরকার। তাও তারা পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রাপ্তির খাতা শূন্য। আমাদের পণ্যের যে বাজার সৃষ্টি হয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে তা এখন ভারতীয় পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। ফলে বাংলাদেশ তার বাজার হারাবে। এমনিতেই বাংলাদেশ তার পণ্য নিয়ে ভারতীয় বাজারে প্রবেশ করতে পারছে না। আমরা বার বার এ কথাগুলো বলছি। যখন মনমোহন সিং বাংলাদেশে এসেছিলেন তখনো বলেছি। এরপর যখন সুষমা এলেন তখনো আমরা বললাম। কিন্তু তাতে এতটুকু দৃষ্টি দেয়নি ভারত। অথচ আমরা সুষমা স্বরাজকে ও পরে মমতাকে যেভাবে সম্মান দিলাম, তা সমসাময়িককালে বিরল একটি ঘটনা। এখন ভয় হচ্ছে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময়, ওই সফরটা না জানি কেমন হয়! ভারত বড় দেশ। আমাদের উন্নয়নে ভারত একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে_ এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু ভারতীয় নেতারা সবসময় তাদের স্বার্থটাকেই বড় করে দেখেন। ছোট্ট একটি ঘটনা_ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গে ইলিশের চাহিদার কথা বলেছিলেন। অথচ তিনি তিস্তার পানির অভাবে বৃহত্তর রংপুরের মানুষ অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের কথা একবারও বললেন না। পানির চেয়ে মমতার কাছে ইলিশই বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। ঘটনাটি ছোট, কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ২ মার্চ ভারতের নয়া পররাষ্ট্রসচিব সুব্রামানিয়াম জয়শংকর ঢাকা আসছেন। এ সফর একটি রুটিন ওয়ার্ক হলেও এ সফরে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে নরেন্দ্র মোদির মনোভাব জানাবেন ঢাকাকে। তার ওই সফরে মোদির ঢাকা সফরও চূড়ান্ত হতে পারে। জয়শংকরের এ সুযোগটাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। আমাদের সমস্যাগুলো আবারো আমরা তুলে ধরতে পারি জয়শংকরের কাছে। বিশেষ করে তিস্তা পানিশূন্য হওয়ায় আমরা যে পরিবেশগত মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি এ বিষয়টি স্পষ্ট করে তুলে ধরতে পারি। যাতে মোদির ঢাকা সফরের সময় আমরা তার কাছ থেকে একটি আশ্বাসের বাণী শুনতে পারি। মমতা ব্যানার্জি যাতে রুদ্র কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন করেন, সে ব্যাপারে আমরা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে অনুরোধ করতে পারি। কেন্দ্রীয় সরকার মমতা ব্যানার্জির ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সেই সঙ্গে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে যখন প্রচুর বৃষ্টি হয় উজানে, অর্থাৎ সিকিমে, সেখানে জলাধার নির্মাণ করে পানি ধরে রাখা যায় কিনা সে ব্যাপারে একটি যৌথ কমিশন গঠন করার প্রস্তাব রাখতে পারি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একাধিকবার এ অঞ্চলে বিদ্যুৎ ঘাটতি ও পানি ঘাটতি মেটাতে যৌথ ব্যবস্থাপনার কথা বলে আসছেন। জয়শংকরের ঢাকা সফরের সময়ও আমরা এ ব্যাপারটি পুনর্ব্যক্ত করতে পারি। দক্ষিণ এশিয়ার মোট আয়তনের ৭২ ভাগ ভারতের। সুতরাং ভারতকে বাদ দিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান সম্ভব নয়। Daily JAI JAI DIN 02.03.15

0 comments:

Post a Comment