রাজনীতি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং সমসাময়িক ঘটনাবলীর বিশ্লেষণ সংক্রান্ত অধ্যাপক ড. তারেক শামসুর রেহমানের একটি ওয়েবসাইট। লেখকের অনুমতি বাদে এই সাইট থেকে কোনো লেখা অন্য কোথাও আপলোড, পাবলিশ কিংবা ছাপাবেন না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন লেখকের সাথে

একটি ভালো সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রত্যাশা


তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে আলোচনা এখন তুঙ্গে। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে চলমান রাজনীতিকে সক্রিয় করার একটি উদ্যোগ নিয়েছে বটে; কিন্তু তাদের সিদ্ধান্ত কিছুটা হলেও ‘বিতর্ক’ সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে অনেকেই মনে করেন, খুব দ্রুত তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকরা চাচ্ছিলেন ঢাকা সিটির (উত্তর ও দক্ষিণ) নির্বাচন হোক। কেননা আট বছর ধরে এই নির্বাচন হচ্ছে না। তবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত মেয়রের সময়সীমা খুব শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে এবং আগামী জুলাই মাসের মধ্যে সেখানে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হতো। দেশের চলমান রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা ছিল যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি(?) অব্যাহত থাকার মাঝে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে বৈকি। তবে প্রশ্ন যতই থাকুক, একটা নির্বাচনের প্রয়োজন ছিল। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেই জনসেবা নিশ্চিত করা যায়। আমলা দিয়ে জনসেবা নিশ্চিত করা যায় না। ঢাকা মহানগরের মানুষ এ জনসেবা পাচ্ছে না বেশকিছু দিন ধরে। মশক নিধন কর্মসূচিসহ অনেক জনসেবামূলক কর্মসূচি মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কোটি

কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে এই মশক নিধন কর্মসূচিতে। তাহলে এ টাকা কোথায় যাচ্ছে? কে এ থেকে সুবিধা নিচ্ছে? জনপ্রতিনিধিরা থাকলে তাদের দায়বদ্ধতা থাকে; কিন্তু আমলারা থাকলে তাদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। সেজন্যই আসন্ন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের সিদ্ধান্তটি প্রশংসাযোগ্য।
বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকারের নীতিনির্ধারকরা চাচ্ছেন নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়ে ‘সব রাজনৈতিক দলকে’ স্বাভাবিক কার্যক্রম শুরু করার একটি সুযোগ দিতে। কিন্তু যে মিলিয়ন ডলার প্রশ্নের সমাধান এখন পর্যন্ত হয়নি তা হচ্ছে, বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা? পত্রপত্রিকায় বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে বলা হলেও এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়া কিংবা তারেক রহমান বিষয়টি খোলাসা করেননি। ২৯ মার্চের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে। সুতরাং সময় খুব বেশি নেই। এরই মধ্যে বিএনপির দু-একজন নেতা মনোনয়নপত্র ক্রয়ও করেছেন। তবে যেহেতু সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে হয়, সেহেতু বিএনপি একটি কৌশল অবলম্বন করতে পারে। কোনো প্রার্থীর নাম ঘোষণা না করে বিএনপি পরোক্ষভাবে কোনো কোনো প্রার্থীকে মেয়র পদে সমর্থন করতে পারে। সেই সঙ্গে কাউন্সিলর পদে বিএনপি সমর্থকরাও প্রার্থী হবেন বলে আমার ধারণা। এক্ষেত্রে
বিএনপি দুটি কৌশল গ্রহণ করতে পারে- এক. আন্দোলন যেভাবে চলছে, সেভাবে আন্দোলন
অব্যাহত রাখা। দুই. নির্বাচনে প্রার্থী হতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা। এর মধ্য দিয়ে বিএনপি তার জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটারও পরীক্ষা করে দেখতে পারে।
তবে নির্বাচন কমিশনের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর একটি সুযোগ এসেছে। নির্বাচনটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও সন্ত্রাসমুক্ত হবে- এটা ইসিকে নিশ্চিত করতে হবে। এমনিতেই ইসি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তার গ্রহণযোগ্যতা অনেক হারিয়েছে। এখন সুযোগ এসেছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর। এটা তো সত্য, সরকার যদি ইসিকে সহযোগিতা না করে, তাহলে ইসির পক্ষে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেয়া সম্ভব নয়। সরকার সমর্থকরা প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। ইসি এক্ষেত্রে কতটুকু শক্তিশালী হতে পারবে, এ প্রশ্ন থাকলই। নির্বাচনী এলাকায় কর্মকর্তাদের বদলি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসি এ ব্যাপারে সরকারকে চিঠি দিয়েছে। এখন সরকার ইসির পরামর্শ কতটুকু গ্রহণ করে সেটি দেখার বিষয়। একটি জটিলতা আছে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) ওয়ার্ড সংখ্যা নিয়ে। উত্তরের লোকসংখ্যা ২৩ লাখ ৪৯ হাজার ৩১৩, আর ওয়ার্ডের সংখ্যা ৩৬। অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের লোকসংখ্যা কম, কিন্তু ওয়ার্ড সংখ্যা বেশি। লোকসংখ্যা ১৮ লাখ ৭০ হাজার ৩৬৩, আর ওয়ার্ড ৫৭টি। ফলে এক্ষেত্রে এক ধরনের বৈষম্য রয়েছে। নির্বাচনের আগে এ বৈষম্য দূর করা সম্ভবও হবে না। ফলে একটা প্রশ্ন থেকেই গেল।
নির্বাচনের জন্য যে বিষয়টি বেশ জরুরি তা হচ্ছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করা। ইসি কি এটা পারবে? বিএনপির অনেক স্থানীয় নেতা, সাবেক কাউন্সিলর হয় পলাতক, নতুবা মামলার আসামি। কেউ বা আবার গ্রেফতার হয়ে জেলে আছেন। তাদের কেউ যদি প্রার্থী হনও তারা তো ভয়ে প্রচারণা চালাতে পারবেন না। তাহলে কি নির্বাচনটা একপক্ষীয় হয়ে যাবে না? তাদের ন্যূনতম যে সুযোগ থাকার কথা তা নিশ্চিত হবে কীভাবে? সরকারি দলের ঘোষিত প্রার্থীরা এরই মধ্যে নির্বাচনী আচরণবিধি লংঘন করেছেন। একজন ব্যবসায়ী, একজন সংসদ সদস্য এবং একজন সাবেক মেয়রপুত্রের বিলবোর্ডে ঢাকা শহর ছেয়ে গিয়েছিল নির্বাচনের আগেই। কেউ নির্বাচনে ‘জয়ী’ হওয়ার আগেই যদি আচরণবিধি লংঘন করে, তা ইসির ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বৈকি! শুধু তাই নয়, প্রার্থীরা আদৌ ঋণখেলাপি কিনা, এটাও আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। একজন প্রার্থীর কাছে একটি বেসরকারি ব্যাংকের পাওনা ছিল ১১৮ কোটি টাকা। তিনি বাড়ি বিক্রি করে টাকার কিছুটা পরিশোধ করেছেন, এমন তথ্য সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী প্রার্থীর খবর কী? তিনি আদৌ ঋণখেলাপি কিনা, ঋণ রিসিডিউল করেছেন কিনা, আমরা জানি না। এসব ধনী ব্যক্তি, ব্যবসায়ী যখন প্রার্থী হন এবং যাদের কাছে ব্যাংকের পাওনা থাকে ১০০ কোটি টাকার ওপরে, তারা যখন ‘নগরপিতা’ হতে চান, তখন আমাদের দুঃখ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা
থাকে না। সিটি কর্পোরেশনের মতো জায়গায় ব্যবসায়ীদের প্রার্থী না করাই মঙ্গল। কারণ এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তাদের ব্যবসায়িক ‘স্বার্থ’
থাকে। হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের কাজ
হয় সিটি কর্পোরেশনগুলোয়। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ থাকাটাই স্বাভাবিক।
এ তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন কতটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে, আমরা জানি না। বিএনপির প্রার্থীরা অংশ নিলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে। আর না নিলে সরকারি দলের প্রার্থীরা ‘খালি মাঠে’ গোল দেবে! প্রশ্ন এখানেই। বিএনপি এ সুযোগটি দেবে কিনা? বিএনপির ব্যাপক সমর্থক গোষ্ঠী রয়েছে। আন্দোলনের পরিণতি
যাই হোক না কেন, একটা নৈতিক সমর্থন তো বিএনপির প্রতি আছেই। বিএনপি কি এ সুযোগটি কাজে লাগাবে না? বিএনপি আন্দোলনের বিকল্প হিসেবেও এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে, সেটা প্রত্যক্ষ হোক কিংবা পরোক্ষভাবে হোক।
দীর্ঘদিন ধরে দেশে এক ধরনের অস্বাভাবিক পরিবেশ বিরাজ করছে। সরকার ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের মধ্যে কোনো আস্থার সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না। খালেদা জিয়া সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনে ৩ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করলেও কোনো একটি দাবিও সরকার মানেনি। ফলে নির্বাচন সামনে রেখে আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠার যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তা একরকম ‘ভেস্তে’ গেছে। তাই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির সরাসরি অংশগ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন থাকলই। যদিও জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমানের মতো সিনিয়র নেতারা বলেছেন, বিএনপি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবে। ২০ দলীয় জোটে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে, এমন কথাও আমাদের জানিয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান।
বিএনপি তার কর্মসূচিতে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। অতীতে টানা হরতাল থাকলেও গেল ২৫ মার্চ বিএনপি কোনো হরতালের কর্মসূচি দেয়নি। ২৬ মার্চ ছিল স্বাধীনতা দিবস। বোধকরি এটা বিবেচনায় নিয়েই বিএনপি হরতাল কর্মসূচি স্থগিত করেছে। তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ হচ্ছে ২৯ মার্চ। ওইদিন মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষদিন। ১ ও ২ এপ্রিল মনোনয়নপত্র বাছাই আর ৯ এপ্রিল প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। এখন ২৯ তারিখ একদিন মাত্র কর্মদিবস। মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার তারিখ বাড়িয়ে ইসি একটি সুযোগ নিতে পারে বিএনপিকে কাছে টানার। কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকদের মনোভাব এ ব্যাপারে কী তা স্পষ্ট নয়।
একটি ভালো নির্বাচন আমরা চাই, দলমত নির্বিশেষে সবাই তাতে অংশ নিক। একটা প্রতিযোগিতার আবহ তৈরি হোক। আর নির্বাচন মানেই তো প্রতিযোগিতা। প্রধান রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতি এ প্রতিযোগিতাকে ম্লান করে দেবে। প্রতিযোগিতাবিহীন একটি নির্বাচন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য মোটেই কোনো ভালো খবর নয়।
Daily Jugantor
28.03.15

0 comments:

Post a Comment