প্রশ্নটা
হাইপ্যোথেটিকাল। বিদেশী কূটনীতিকদের উদ্যোগ যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে কী হবে
দেশে? এ ধরনের হাজারটা প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছি প্রতিদিন। বন্ধুরা জিজ্ঞেস
করে। ই-মেইলে প্রশ্ন আসে। টকশোতে সঞ্চালক জানতে চান, কী হতে পারে ভবিষ্যৎ
রাজনীতি? বিদেশে বন্ধুরা, নিজের আত্মীয়স্বজন জিজ্ঞেস করেন, তারা দেশে আসতে
চান- আসবেন কিনা এখন? পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে? এর জবাব কী দেব? টকশোতে
প্রায়ই যাই। কিছু পরিচিত মুখকে প্রায়ই দেখি। কখনও-সখনও মনে হয়, সরকারের
বক্তব্যই যেন শুনছি তাদের মুখ থেকে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, জামায়াত- ঘুরেফিরে
আসছে এসব কথাই। সাহস করে আগ বাড়িয়ে কিছু বলা যায় না। বলিও না। মধ্যবিত্তের
মানসিকতায় বেড়ে ওঠা আমি। যেখানে সরকারের শীর্ষ
পর্যায় থেকে টকশোতে অংশগ্রহণকারীদের সমালোচনা করা হচ্ছে, সেখানে আমার মতো সাধারণ একজনের কী-ই বা বলার আছে?রাজনীতির
গতিপ্রকৃতি নিয়ে পড়াশোনা করতে আর লিখতে ভালো লাগে। তুলনামূলক রাজনীতি আমার
প্রিয় বিষয়। বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশের
সঙ্গে অন্য দেশের রাজনীতিকে মেলাতে চাই। কোথায় মিল আছে, কোথায় অমিল আছে-
খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। কিন্তু মিলটা আর খুঁজে পাই না। সাম্প্রতিক
সময়গুলোতে যা ঘটছে, কিংবা যা ঘটে চলেছে গত প্রায় দুমাস ধরে, তার ব্যাখ্যা
আমরা কীভাবে দেব? বার্ন ইউনিটের আহাজারি আমার হৃদয়কে বারবার ছুঁয়ে গেছে।
একাধিকবার লিখেছি। নিজে গিয়েছিও দেখতে। চোখ ভিজে যায় ওইসব দৃশ্য দেখে।
বাংলাদেশের ৪৪ বছরে কেউ কখনও দেখেনি এ দৃশ্য। হরতালে ঢাকা শহরে যানজটের
চেনা দৃশ্য! রাস্তায় গাড়িগুলো পার্ক করা থাকে যত্রতত্র। এ কারণে রাস্তা
সংকুচিত হয়ে আসে, সৃষ্টি হয় যানজটের। দিনের বেলায় শ্যামলী-কল্যাণপুর-রিংরোড
এলাকায় গেলে দেখতে পাবেন এ দৃশ্য। আমি ঠিক জানি না, ট্রাফিক বিভাগের
জ্ঞাতসারেই গাড়িগুলো পার্ক করা থাকে কি-না। তবে এটা তো ঠিক, হরতাল-অবরোধের
ধার অনেক কমে গেছে। মানুষের সমর্থন আছে কী নেই, এ প্রশ্ন অর্থহীন। বাস্তবতা
হচ্ছে, অবরোধ আর হরতাল ডেকে যে সরকারের পতন ঘটানো যায় না, সেটা প্রমাণিত
হয়েছে। সরকার আরও শক্তিশালী হয়েছে। এ পরিস্থিতি এমন একটা মেসেজ দিল, যা
ভবিষ্যতে রাজনীতিকদের জন্য শিক্ষণীয় হবে। যারা বিশ্বের রাজনীতির কিছুটা
খোঁজখবর রাখেন, তাদের কাছে কালার রেভ্যুলেশনের ইতিহাস অজানা নয়।
থাইল্যান্ডের রেড শার্ট মুভমেন্ট, জর্জিয়ার গোলাপ বিপ্লব, ইউক্রেনের অরেঞ্জ
রেভ্যুলেশন, কিরঘিজস্তানের টিউলিপ রেভ্যুলেশন কিংবাকায়রোর
তেহরির স্কয়ারের পরিস্থিতির সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে কোনোভাবেই
মেলানো যাবে না। নিশ্চয়ই বিএনপি এ আন্দোলন থেকে শিখছে অনেক কিছুই।গত
দুমাসের পরিস্থিতি দেখে আমার কাছে চারটি বিষয় স্পষ্ট। এক. দেশে জঙ্গিবাদের
উত্থান ঘটছে; দুই. দেশে সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড বাড়ছে; তিন. জামায়াতকে
নিষিদ্ধ করার দাবি শক্তিশালী হচ্ছে; চার. বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে
বিদেশীদের হস্তক্ষেপ বাড়ছে। বর্তমানে যে আন্দোলন চলছে, তাকে জঙ্গিবাদের
উত্থানের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্যে
যে জঙ্গিবাদের উত্থান, তার সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিবাদের উত্থানকে মেলানো
যাবে না। আবার এটাও সত্য, দেশে জঙ্গিরা আছে। অভিজ্ঞতা বলে, জঙ্গিরা দেশের
একটি জেলা বাদে প্রতিটি জেলায় একসঙ্গে একই সময় বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, কিংবা
আদালত পাড়ায় আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে একটা মেসেজ দিয়েছিল। জঙ্গি নেতাদের
গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ
করা গেছে, এটা সত্য। কিন্তু জঙ্গিবাদকে উৎখাত করা সম্ভব হয়নি। মাঝে মধ্যেই
এদের তৎপরতা আমাদের চোখে পড়ে। ত্রিশালে জঙ্গি ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনার মধ্য দিয়ে
তারা তাদের উপস্থিতির জানান দিয়েছিল। তবে এটাও সত্য, মধ্যপ্রাচ্যে আইএস বা
আল কায়দার জঙ্গিদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের মেলানো যাবে না। বাংলাদেশে
জঙ্গিরা বিভ্রান্ত। ইসলামের নামে এদের বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।প্রচলিত
রাজনৈতিক দলগুলো যখন ব্যর্থ হয়, তখন জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এটা
তত্ত্বের কথা। মধ্যপ্রাচ্যে এভাবেই জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের পার্থক্য এখানেই যে, এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক
শক্তিশালী। সমাজেও তাদের অবস্থান শক্তিশালী। ফলে নিশ্চিত করেই বলা যায়,
আইএসের মতো কোনো জঙ্গি সংগঠনকে আমরা বাংলাদেশে দেখব না। তবে এটা আমাদের
স্বীকার করতেই হবে, বর্তমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাসবাদের ব্যাপক
বিস্তার ঘটেছে। পেট্রলবোমা সংস্কৃতির যে জন্ম হয়েছে, তা কোনো ভালো কথা বলে
না। সাইকেল বোমা কিংবা সীতাকুণ্ড পাহাড় থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি ও
পেট্রলবোমা উদ্ধার প্রমাণ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেমে নেই। সন্ত্রাসী
কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে খোদ বিদেশীরা যখন প্রশ্ন
রাখেন, তখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন। তবে বিদেশীরা যেভাবে আমাদের
অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছেন, তা কোনো আশার কথা বলে না। সর্বশেষ
১৬ জন রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার সঙ্গে তার অবরুদ্ধ কার্যালয়ে দেখা করে
একদিকে যেমন বোঝাতে চেয়েছেন, খালেদা জিয়া চলমান সংকট সমাধানে একটি
ফ্যাক্টর; অন্যদিকে প্রকাশ পাচ্ছে, তারা একটা দূতিয়ালি করতে চান। এটা
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির জন্য কোনো ভালো খবর নয়।একটা
প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহলে আলোচিত হচ্ছে- সংকট থেকে উত্তরণের পথ কী? এটা
সত্য, সরকার সাংবিধানিকভাবেই ক্ষমতায় আছে। সংবিধান অনুযায়ীই একটা নির্বাচন
হয়েছে গেল বছরের ৫ জানুয়ারি। ওই নির্বাচনে সব দল অংশ না নিলেও নির্বাচনটি
ছিল সাংবিধানিকভাবে বৈধ। কিন্তু এ নির্বাচন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে
শক্তিশালী করতে পারেনি। কেননা গণতন্ত্রে কনফিডেন্স বিল্ডিং মেজারসের যে কথা
বলা হয়, তা রক্ষিত হয়নি। অর্থাৎ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপিত হয়নি। বিএনপিসহ
আরও কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তখন অবশ্য বলা হয়েছিল, ৫ জানুয়ারির
নির্বাচন নিয়ম রক্ষার নির্বাচন। আমরা সেটাই ধরে নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম,
সরকার এক বছরের মধ্যে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলবে। কিন্তু সরকারের
নীতিনির্ধারকরা প্রায় সবাই বলছেন, পরবর্তী নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে। সংবিধান
এ কথাই বলে, ৫ বছর পরপর নির্বাচন। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। কিন্তু
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের আন্দোলন এখনই একটি নয়া নির্বাচনকে কেন্দ্র
করে। আর সংকটটা তৈরি হয়েছে সেখানেই। দুটি বড় দল আওয়ামী লীগ তথা সরকার, আর
বিএনপি তথা ২০ দল আজ নো রিটার্নের পর্যায়ে চলে গেছে। কেউ কাউকে এতটুকু
স্পেস দিতে চাচ্ছে না। সরকার তার অবস্থানে অনড়। আর বিএনপিও এতটুকু পিছপা
হচ্ছে না। যদিও এটা সত্য, মাঠে বিএনপির নেতাকর্মীদের আদৌ দেখা যাচ্ছে না;
কিন্তু হরতাল-অবরোধের আহ্বান আসছে। আর সংবাদপত্রের মাধ্যমেই মানুষ জানছে
পরবর্তী সপ্তাহের হরতালের খবর। ফলে বিদেশী দাতাগোষ্ঠী যে উদ্বিগ্ন থাকবে,
এটাই স্বাভাবিক। সর্বশেষ খবরে দেখলাম, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার
সংস্থার হাইকমিশনার জেইড রাড হুসেইন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে চলমান
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করার পরামর্শ দিয়েছেন।খালেদা
জিয়ার সঙ্গে বিদেশী দূতদের দেখা করা, আর জেইড রাড হুসেইনের পরামর্শ মূলত
একই সূত্রে গাঁথা। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো চাচ্ছে একটা সমঝোতা। এটা সত্যিই
দুঃখজনক যে, আমরা আমাদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারছি না। এভাবে
বিদেশীদের হস্তক্ষেপ আমাদের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে কতটুকু উন্নত করবে, তা
আমাদের রাজনীতিকরা নিশ্চয়ই উপলব্ধি করবেন।নয়া
মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, গণতন্ত্র বিকাশে ভিন্নমত ও সংলাপ প্রয়োজন।
মার্কিন কংগ্রেসের ১১ জন সদস্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরিকে লেখা এক
চিঠিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে ভূমিকা রাখার অনুরোধ করেছেন। এ ধরনের ঘটনা
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের শামিল। জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী
একটি রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না।
তাহলে কেরি ভূমিকা রাখবেন কীভাবে? এদিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি
পরোয়ানা জারি হলেও তা নিয়েও একটা ধোঁয়াশা রয়েছে। খালেদা জিয়া গ্রেফতার হলে
সরকারের শেষ অস্ত্রটিও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। সরকার বোধকরি এটি চাচ্ছে না
এবং তারা আইনি পথেই এগোতে চায়। ৫ এপ্রিল আদালত নতুন তারিখ নির্ধারণ করেছেন
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায়। অন্যদিকে বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলার নতুন
তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ১৫ মার্চ। বোঝাই যায়, সরকার মামলা-মোকদ্দমা দিয়ে
খালেদা জিয়াকে চাপে রাখতে চায়। তাতে কতটুকু ফল মিলবে, এটা নিশ্চিত করে বলা
যাবে না।রাজনীতিকরা দেশ চালাবেন,
এটাই কাম্য। এটাই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি। কিন্তু যে রাজনীতি জনগণ ও
অর্থনীতির ক্ষতি করে, সেই রাজনীতি দেশের কোনো মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। তাই
সংকটের গভীরতা অনুধাবন করে এবং অর্থমন্ত্রীর ভাষায় বর্তমান সংকট জাতীয় সংকট
এটা বিবেচনায় নিয়ে উভয়পক্ষ যদি একটি সমঝোতায় উপনীত হয়, তা হবে সবার জন্যই
সুখবর। সেই সমঝোতাটা কী, তার ধরন কী, কোন পক্ষ কতটুকু ছাড় দেবে কিংবা
কীভাবে বিএনপি তার বর্তমান অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারবে, তা নির্ধারিত
হতে পারে একটা সংলাপের মাধ্যমে।
Daily Jugantor
14 march 2015
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment