আগামী ২৬ মার্চ জাতি যখন তার ৪৪তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছে, ঠিক তখনই বেশকিছু প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে ভিড় করেছে। এক. বেগম জিয়া গত ১০ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতা দিবস পালনের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, আগামীতে এর আদৌ কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা? দুই. বহুল প্রত্যাশিত ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) নির্বাচনের কথা ঘোষণা করে সরকার কি বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে পারবে? তিন. একদিকে হরতাল-অবরোধ, অন্যদিকে নির্বাচনী আমেজ- কোন পথে যাবে বাংলাদেশ? চার. বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ অবস্থায় রয়েছেন ১১ দিন ধরে (২১ মার্চ পর্যন্ত)। তাকে খুঁজে বের করতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতাকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব?
বেগম জিয়ার ১০ মার্চের সংবাদ সম্মেলনে নতুন কথা বলা হয়নি এটা যেমনি সত্য, তেমনি এটাও সত্য, বেগম জিয়া একটি নরম কর্মসূচি দিয়ে চাচ্ছেন- সরকার নমনীয় হোক, সংলাপে রাজি হোক। তিনি অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন ওই দিন। চলমান সংকটকে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক হিসেবে আখ্যায়িত করা, সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করা, নেতাকর্মীদের মুক্তিসহ সবার অংশগ্রহণে নির্বাচনের জন্য সংলাপের আহ্বান জানিয়ে তিনি একটা মেসেজ অন্তত দিলেন- সরকার আলোচনার উদ্যোগ নিক। আর আলোচনার উদ্যোগ নিলে বিএনপি তার কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেবে, এমন একটা ধারণা তার ওই বক্তব্য থেকে পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু সরকারের কৌশল সুস্পষ্ট- তারা বিএনপির সঙ্গে আলোচনার ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নয়। উল্টো তিনটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে (২৮ এপ্রিল) সরকার এখন চাচ্ছে বিএনপিকে নির্বাচনের মাঠে নামাতে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, বিএনপির একটা অংশ নির্বাচনে অংশ নেবে এবং এতে করে বিএনপির আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়বে।
সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন দিয়ে সরকার বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে চায়। এতে করে সরকার বিশ্বকে দেখাতে পারবে বিএনপি নির্বাচনে এসেছে। সুতরাং আগামীতে একাদশতম সংসদ নির্বাচন যখনই হোক, ওই নির্বাচনেও বিএনপি অংশ নেবে। এটা সরকারের একটা কৌশল- বিএনপিকে নির্বাচনে নিয়ে আসা। কিন্তু বেগম জিয়া কি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন? কিংবা তিনি যদি এ ব্যাপারে নীরব থাকেন, তাহলে কি বিএনপি সমর্থিত কাউকে কাউকে প্রার্থী হতে পরোক্ষভাবে সমর্থন করবেন? স্থানীয়ভাবে নির্বাচন দলীয়ভাবে হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিগত উপজেলা নির্বাচনও অনেকটা দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) বিএনপি অংশ না নিলেও এর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই অনুষ্ঠিত উপজেলা নির্বাচনে অনেক বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়েছিল। এটা বিএনপির নীতিনির্ধারকরা ভালো করে জানেন। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ ঢাকা সিটির প্রচুর নেতাকর্মী এখন জেলে অথবা ফেরারি। অনেকের নামেই মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে। গ্রেফতারের ভয় রয়েছে। বেগম জিয়া নেতাকর্মীদের মুক্তি দাবি করেছিলেন। সরকার মুক্তি দেয়নি। এ অবস্থায় তিনি প্রার্থী দেবেন, এটা মনে হয় না। তবে বিএনপি স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থীকে (যেমন মাহমুদুর রহমান মান্না) সমর্থন করতে পারে। অথবা স্ট্যাটাস কো ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারে। অর্থাৎ বিএনপির কোনো শীর্ষ নেতা বা স্থানীয় নেতা যদি প্রার্থী হন, বিএনপি সেক্ষেত্রে নীরবতা অবলম্বন করবে। তবে আমি নিশ্চিত ঢাকা সিটির মোট ওয়ার্ডের সংখ্যা ৯২, এ ক্ষেত্রে বিএনপি সমর্থক অনেকেই ওয়ার্ড কমিশনের নির্বাচনে অংশ নেবেন। এটা তাদের এক ধরনের নিরাপত্তাও দিতে পারে। ক্ষমতা প্রয়োগ করার একটা সম্ভাবনাও তাদের জন্য তৈরি হতে পারে। বিএনপির এসব স্থানীয় নেতাদের অনেকেরই ব্যবসা-বাণিজ্য আছে। প্রশাসনে না থাকলে এসব ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি হয়। তারা এ ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। এজন্যই আমার ধারণা, স্থানীয় পর্যায়ের এসব নেতার কেউ কেউ ওয়ার্ড কমিশনের নির্বাচনে অংশ নেবেন। তারা যদি ভবিষ্যতে নতুন এক রাজনৈতিক মেরুকরণে অংশ নেন, আমি তাতে অবাক হব না।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জনপ্রিয় মেয়র এম মনজুর আলম অংশ নেবেন কিনা, তা স্পষ্ট নয়। তিনি বিষয়টি ছেড়ে দিয়েছেন বেগম জিয়ার হাতে। বেগম জিয়া চাইলে তিনি নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন বিএনপির হাতে থাকা জরুরি। মনজুর আলম ছাড়া কোনো বিকল্প নেই সেখানে। মনজুর আলম প্রার্থী না হলে আওয়ামী লীগের আজম নাসির হতে যাচ্ছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থী। অপর সম্ভাব্য প্রার্থী আখতারুজ্জামান হয়তো আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। ধনাঢ্য ব্যক্তি মনজুর আলম। তিনি যতটুকু না রাজনীতিক, তার চেয়ে বেশি একজন সজ্জন ব্যক্তি। তার এই ইমেজ তাকে অতীতে নির্বাচনে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল। চূড়ান্ত বিচারে বিএনপি এ সুযোগটি নিলেও নিতে পারে।
তবে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে কথা অনেক। ব্যবসায়ী আনিসুল হক মেয়র প্রার্থী হয়েছেন উত্তরের। ব্যক্তি আনিসুল হকের সাফল্য অনেক। ধনী ব্যক্তি। সজ্জন ব্যক্তি। সফল উপস্থাপক। ব্যবসায়ীদের নেতা হিসেবে তিনি ছিলেন সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু মানুষ কি তাকে একজন রাজনীতিক হিসেবে দেখতে চাইবে? আমার মনে হয় না। একজন মেয়রের চেয়েও অনেক বেশি সম্মান তিনি পান এবং পেয়ে আসছেন। মেয়র পদ তাকে বাড়তি সম্মান দেবে না। ঢাকার বিলবোর্ডগুলো তার ছবিতে ভরে গেছে। তিনি কি এগুলো ভাড়া নিয়েছেন? বিল পরিশোধ করেছেন? যদি না করে থাকেন, তাহলে প্রশ্ন উঠবে। একজন ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি ঋণখেলাপি কিনা, ঋণ সিডিউল করেছেন কিনা, তা ব্যাংকগুলোই বলতে পারবে এবং নির্বাচন কমিশন নিশ্চই বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। একজন ভোটার হিসেবে আমি আনিসুল হককে ব্যবসায়ী কাম সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চেয়েছি, একজন মেয়র হিসেবে নয়। এ ক্ষেত্রে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কামাল মজুমদারের বক্তব্যের সঙ্গে আমি একমত। মজুমদার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, মেয়র পদে ব্যবসায়ী নয়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন (মানবকণ্ঠ, ১৯ মার্চ)। রাজনীতিকদের জনগণের কাছে যেতে হয়। তাদের সঙ্গে ভোটারদের সম্পর্ক থাকে সরাসরি। তারা সমস্যাগুলো বোঝেন ও জানেন। আর ব্যবসায়ীরা সুযোগ সন্ধানী। তারা জানেন শুধু লাভের বিষয়টি। একজন ধনী ব্যক্তি হিসেবে আনিস সাহেবরা জনস্বার্থে কতটুকু কাজ করেছেন, আদৌ করেন কি-না তা তিনি নিজে বলতে পারবেন। বিলবোর্ডে স্বপ্নের কথা তিনি আমাদের শোনাচ্ছেন। ইতিমধ্যে সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তিনি মতবিনিময় শুরু করেছেন। এ কাজটি তিনি ভালো পারেন। এখন বিএনপি প্রার্থীর অবর্তমানে তিনি যে জিতে যাবেন, তা নিশ্চিত করে বলা যায়। তবে আবদুল আউয়াল মিন্টু যদি শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হন, তার জন্য সমস্যা হবে। উপরন্তু দলীয় সমর্থন পুরোপুরিভাবে তিনি পাবেন না। কামাল মজুমদারের মতো ব্যক্তি যদি শেষ পর্যন্ত প্রার্থী হন, তিনি অনেক ভোট কাটবেন। সাঈদ খোকনের জন্যও সমস্যা অনেক। তিনি ঋণখেলাপি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে তার মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সম্ভাবনা কম। তিনি ঢাকা দক্ষিণের প্রার্থী হলেও থাকেন উত্তরে। এক-এগারোর সময় তিনি পিডিপিতে যোগ দিয়ে সুবিধাবাদী রাজনীতির পরিচয় দিয়েছিলেন। তারপরও আওয়ামী লীগ তাকে গ্রহণ করে নিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন তো আছেই। তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী হাজী সেলিম। হাজী সেলিম আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকলেও আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন। তিনি এখন সংসদে স্বতন্ত্র সদস্য। নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী নামে তার একটি সংগঠন রয়েছে। ওই সংগঠনের ব্যানারেই তিনি প্রেস ক্লাবভিত্তিক আলোচনা সভার আয়োজন করে তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রেখেছেন। ধনাঢ্য ব্যক্তি তিনি। থাকেন পুরনো ঢাকাতে। কথাবার্তা বলেন ঢাকাইয়া ভাষায়। তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও তার জনপ্রিয়তা কিছুটা হলেও আছে।
তবে ঢাকা শহরের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন আছে। বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা সংগঠিত হচ্ছে। তারা একটা সমস্যা তৈরি করতে পারে। বেগম জিয়ার সংবাদ সম্মেলনের পর পরিস্থিতির খুব উন্নতি হয়েছে, এটা বলা যাবে না। ১৯ মার্চের খবর : দিনাজপুরে বাসে পেট্রলবোমা হামলা, দগ্ধ ও আহত ৮ জন। চাঁদপুরে ট্রাকে পেট্রলবোমা হামলায় দগ্ধ হয়েছেন ৩ জন। এর অর্থ পরিষ্কার- সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। এসব সন্ত্রাসী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সময় ঢাকা ও চট্টগ্রামে সমবেত হতে পারে এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত হতে পারে। ভয়টা এখানেই।
ঢাকা শহরে নির্বাচন হচ্ছে। অনেক আগেই এ নির্বাচন প্রত্যাশিত ছিল। হয়নি নানা কারণে। প্রশাসক দিয়ে চলছে সিটি কর্পোরেশনের কর্মকাণ্ড। এটা সমর্থনযোগ্য নয়। সে জন্যই নির্বাচনটা প্রয়োজন ছিল, যাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কর্পোরেশনের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে পারে। কিন্তু বিএনপি অংশ না নিলে নির্বাচন হবে বটে, তবে জমজামট হবে না। ভোটারদের উপস্থিতিও হবে কম। দলীয়ভাবে নির্বাচন হয় না বটে। কিন্তু স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যখন প্রার্থী ঠিক করেন, তখন এটা দলীয় হয়ে যায় বৈকি। তাই সঙ্গতকারণেই মানুষ তাকিয়ে থাকবে বেগম জিয়ার দিকে।
এক কঠিন সময় পার করছেন বেগম জিয়া। তাকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। স্থায়ী পরিষদের সদস্যরা কেউই ভয়ে তার কার্যালয়ে যেতে পারছেন না। ২০-দলীয় নেতাদের সঙ্গে তার যোগাযোগ একরকম বিচ্ছিন্ন। সালাউদ্দিন আহমেদ নিখোঁজ রয়েছেন আজও। কেউ তার খোঁজ জানে না। সরকারের ভাষ্য- তিনি নিজে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছেন। বিএনপির বক্তব্য- সালাউদ্দিনের ভাগ্য ইলিয়াস আলীর মতোই হতে যাচ্ছে। এটা দুঃখজনক যে, একজন বিরোধী রাজনৈতিক ব্যক্তি হঠাৎ করে নিখোঁজ হয়ে যাবেন, সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা এর কোনো খোঁজ পাবে না। এটা মেনে নেয়া যায় না। বেগম জিয়া এখন অনেকটা কিংকর্তব্যবিমুঢ়। কী সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি? মাথার ওপরে গ্রেফতারি পরোয়ানা। যে কোনো মুহূর্তে তিনি গ্রেফতার হতে পারেন। অবরোধ-হরতালের ডাক দিচ্ছেন বটে, কিন্তু তাতে খুব একটা কাজ হচ্ছে না। হরতালেও ঢাকা এখন যানজটের নগরী। নির্বাচনের কোনো আমেজ তাই আমি দেখি না। নির্বাচন মানেই তো এক ধনের উৎসব। কোথায় সেই উৎসব? ভয় হচ্ছে, এ নির্বাচন না আবার নিয়ম রক্ষার নির্বাচন হয়ে যায়! একটা নির্বাচন আমরা চাই। চাই প্রতিযোগিতা হোক। ভোটারদের সাংবিধানিক অধিকার প্রয়াগ করার সুযোগ দেয়া হোক। ভোটারদের এ প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হবে, জানি না।
২১ মার্চ, ২০১৫
Daily Jugantor.
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
0 comments:
Post a Comment